Search

Saturday, July 13, 2019

হুদার ‘অস্বাভাবিক’ ভোট ও ‘বকাউল্লাহর’ সংসদ

সোহরাব হাসান
প্রথম আলো/১৩ জুলাই ২০১৯

গত ৩০ জুন ঢাকার লালবাগ সরকারি মডেল স্কুল ও কলেজে ভোটার তালিকা হালনাগাদ প্রশিক্ষণের উদ্বোধনকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, ‘নির্বাচনে শতভাগ ভোট পড়া স্বাভাবিক নয়। তবে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের করণীয় কিছু নেই। ভোটের পরই প্রিসাইডিং কর্মকর্তা কেন্দ্রভিত্তিক সব নিষ্পত্তি করেন। একীভূত ফল রিটার্নিং কর্মকর্তা আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। তখন ওই বিষয়ে আমাদের কিছু জানায়নি; তাই এখন ইসির কিছু করার নাই।’ (ইত্তেফাক, ১ জুলাই ২০১৯)

জাতীয় নির্বাচনের ছয় মাস পর নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে কেন্দ্রভিত্তিক যে পূর্ণাঙ্গ ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যায় ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। এটি কোনো বিশেষ আসনের হিসাব নয়। দেশের ৩০০ আসনের মধ্যে ১০৩টি আসনে এ অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে। সিইসিও স্বীকার করেছেন, শতভাগ ভোট পড়া স্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর কোনো দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এ রকম ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয় না। ঘটা সম্ভব নয়। কেননা ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন হয় না। নির্বাচন হয় কয়েক মাস পর।এ সময়ের মধ্যে কেউ মারা যেতে পারেন, কেউ অসুস্থ থাকতে পারেন, কেউ এলাকার বাইরে বা বিদেশে যেতে পারেন। এঁরা কীভাবে ভোট দিলেন?

সে ক্ষেত্রে শতভাগ ভোট পড়া শুধু অস্বাভাবিক নয়, অবাস্তবও। নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম অবশ্য একটি অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছেন। বলেছেন, উল্লিখিত কেন্দ্রগুলোয় শতভাগ ভোট পড়েছে, এ কথা বলা যাবে না। কেননা ওসব কেন্দ্রে কিছু ভোট বাতিলও হয়েছে। তিনি বলতে চাইছেন, ‘আগে যেকোনো উপায়ে ভোটের বাক্স শতভাগ ব্যালট ভরে ফেলো। এরপর তাঁরা পরখ করে দেখবেন, কোনটি আসল আর কোনটি নকল।’

কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণ করে আরও অনেক বিস্ময়কর তথ্য পাওয়া গেছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ১২৭টি ভোটকেন্দ্রে, ৯৮ শতাংশ ভোট পড়েছে ২০৪টি ভোটকেন্দ্রে, ৯৭ শতাংশ ভোট পড়েছে ৩৫৮ ভোটকেন্দ্রে এবং ৯৬ শতাংশ ভোট পড়েছে ৫১৬ ভোটকেন্দ্রে। অর্থাৎ ৯৬-১০০ শতাংশ ভোট পড়েছে ১ হাজার ৪১৮টি কেন্দ্রে। অন্যদিকে ৪০-৪৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ৫৯৯টি ভোটকেন্দ্রে, ২০-৩৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ৩০১টি ভোটকেন্দ্রে, ১০-১৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ২০টি ভোটকেন্দ্রে এবং ১০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে ১১টি ভোটকেন্দ্রে। ভোট পড়ার এই বিপরীত হারও বিশ্বাসযোগ্য নয়।

নির্বাচন কমিশন একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করবে, কেন্দ্রে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের এজেন্ট থাকবেন, যাঁরা ভোটারকে চিহ্নিত করবেন, তিনি আসল ভোটার কি না। ভোট গ্রহণ শেষে প্রার্থীর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতেই নির্বাচনী কর্মকর্তারা ভোট গণনা করবেন এবং প্রার্থীদের প্রতিনিধির সইসহ ফল রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠাবেন। এরপর রিটার্নিং কর্মকর্তা সব কেন্দ্রের ফল সমন্বয় করে নির্বাচন কমিশনে পাঠাবেন। এটাই নির্বাচনের স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অধিকাংশ কেন্দ্রে এই নিয়ম মানা হয়নি। কেন্দ্রে বিরোধী দলের প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের যেতে দেওয়া হয়নি। সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকেরা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে যে চিত্র দেখেছেন, ঘোষিত ফলের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। ছবি মিথ্যা বলে না।

নির্বাচনের পর ৩০০ আসনের মধ্যে ৫০টি আসনে জরিপ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৪৭ আসনে কোনো না কোনো অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছে তারা। অনিয়মের ধরনের মধ্যে আছে ৪১টি আসনে জাল ভোট; ৪২টি আসনে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকা; ৩৩টি আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল; ২১টি আসনে আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা; ৩০টি আসনে বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মেরে জাল ভোট; ২৬টি আসনে ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা; ২০টিতে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা; ২২টিতে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া; ২৯টিতে প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেওয়া ইত্যাদি।

সিইসি বলেছেন, রিটার্নিং কর্মকর্তারা যেহেতু কেন্দ্রগুলোর ফল একীভূত করে নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দিয়েছেন এবং গেজেট হয়ে গেছে, সেহেতু তাঁদের আর কিছু করার নেই। তাহলে প্রশ্ন আসে, ইসির দায়িত্ব কি শুধু রিটার্নিং কর্মকর্তার পাঠানো কাগজটিতে সিল মারা? সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভোটারদের প্রতি তাদের কোনো কর্তব্য নেই? নির্বাচন কমিশনের কাজ হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা, যাতে প্রতিটি ভোটার নির্বিঘ্নে ও নির্ভয়ে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেন। ইসির পদাধিকারীরা সেটি পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। ২০০০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ নির্বাচনী বিরোধসংক্রান্ত এক মামলায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান, বিচারপতি বিবি রায় চৌধুরী, বিচারপতি এ এম এম রহমান এবং বিচারপতি কাজী এবাদুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ নির্বাচন কমিশনকে ‘ফেয়ার, জাস্টলি ও অনেস্টলি’ দায়িত্ব পালন করার কথা বলেছিলেন। এখন সিইসি তাঁর বিবেককে (যদি থেকে থাকে) জিজ্ঞেস করুন তিনি ফেয়ার, জাস্টলি ও অনেস্টলি সেই দায়িত্ব পালন করেছেন কি না?

এবারের জাতীয় নির্বাচনে যে অগণিত অসংগতি ও অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল, তার কিছু কিছু নির্বাচনের পর প্রথম আলোসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এখন পুরোটা জানা গেল কেন্দ্রভিত্তিক ফল প্রকাশের পর। আইন অনুযায়ী নির্বাচনের পরপরই কেন্দ্রভিত্তিক ফল ইসির ওয়েবসাইটে দেওয়ার কথা থাকলেও তারা সেটি তারা দেয়নি। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল চেয়ে গত ৭ মার্চ প্রথম ইসিকে চিঠি দেয়। সাড়া না পেয়ে ৩০ মে ও ১১ জুন আরও দুটি চিঠি দেয়। এরপরও প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার গত ১৩ জুন তথ্য অধিকার আইনের আওতায় তথ্যের জন্য আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ জুন ইসি ৩০০টি সংসদীয় নির্বাচনী এলাকার কেন্দ্রভিত্তিক ও একীভূত নির্বাচনী ফলাফল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে।

কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো এবারের নির্বাচন ব্যালট পেপারে হওয়ায় ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়া দেখাতে পারলেও ইভিএম পরিচালিত ৬টি আসনের কোনো কেন্দ্রে সেটি ঘটেনি। ইভিএমে ভোট পড়ার গড় ৫১ দশমিক ৪২ শতাংশ। আর ব্যালট পেপারে ভোট হওয়া আসনের গড় ভোট ৮০ দশমিক ৮০ শতাংশ। ভোটের পার্থক্য ২৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন, তার আগে ও পরের সব নির্বাচনে ইসি অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে ৫৭৬টি কেন্দ্রে নৌকার প্রার্থীর বাইরে কেউ একটি ভোটও পাননি। ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি যত নগণ্যই হোক না কেন, ঘোষিত ফলাফলে দেখা যায় বিপুল সংখ্যায় ভোট পড়েছে। মহাবিশ্বে একমাত্র পৃথিবীতে মানুষ আছে বলে প্রমাণিত। অন্য গ্রহেও মানবসদৃশ কোনো প্রাণী বা এলিয়েন থাকতে পারে। হুদা কমিশনের দৌলতে ভোটের দিন ওই এলিয়েনরা এসেই ভোট দিয়ে গেছে। না হলে শতভাগ ভোট পড়ল কীভাবে?

যখন নির্বাচন কমিশনের কেন্দ্রভিত্তিক ফল বিশ্লেষণ করছিলাম তখনই সাবেক মন্ত্রী, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাংসদ রাশেদ খান মেননের একটি মন্তব্য চোখে পড়ল। গত বৃহস্পতিবার সংসদে আলোচনাকালে তিনি বলেছেন, ‘সাংসদেরা হচ্ছেন বকাউল্লাহ, তাঁরা বকে যান, ক্ষমতাসীনেরা শোনাউল্লাহ, শুনে যান। আর সংসদ হচ্ছে গরিবউল্লাহ।’ তিনি আরও বলেছেন, গ্যাসের দাম নিয়ে আলোচনা না হলে এই সংসদ আরও গরিব হয়ে যাবে। আমাদের অর্থনৈতিক সূচক যত বাড়ছে, রাজনৈতিক সূচক তত নিচে নামছে।

এর আগে রাশেদ খান মেনন বরিশালে দলের সভায় বলেছেন, রাজনীতি আর রাজনীতিকদের হাতে নেই। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির আরও কয়েকজন নেতা রাজনীতি রাজনীতিকদের হাতে নেই বলে হতাশা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তাঁদের মনে রাখা উচিত রাজনীতি তখনই রাজনীতিকদের হাতে থাকে, যখন জনগণ ভোট দেওয়ার সুযোগ পান। মেনন ও মইন উদ্দীন খান বাদলেরা সরকারকে শোনাউল্লাহ, সংসদকে গরিবউল্লাহ এবং নিজেদের বকাউল্লাহ বলে উল্লেখ করেছেন। সংসদ কখন গরিব হয়? যখন সেই সংসদে জনগণের পক্ষে কথা বলা যায় না। এ অবস্থা চলতে থাকলে তাঁরা সরকারের নীতি পরিবর্তন দূরের কথা, নিজের বকাউল্লাহর ভূমিকাটিও রাখতে পারবেন না।

অতএব রাজনীতিকে রাজনীতিকদের হাতে ফিরিয়ে আনতে হলে সবার অাগে জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। তবে সেই কাজটি হুদা কমিশন করতে পারবে—এ কথা কেউ বিশ্বাস করে না।

  • সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
  • লিঙ্ক - shorturl.at/kqIW1

Thursday, July 11, 2019

সঞ্চয়পত্রে বাড়তি কর, বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও নিম্নবিত্তের জীবন




ড. আর এম দেবনাথ
সরকারি বিভাগ, মন্ত্রণালয় যদি অবিবেচক হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের করার আর কিছু থাকে না। সরকারি সিদ্ধান্ত তাদের মানতেই হবে, শত হোক তা সরকারি আইন বা বিধান। এখন ১ জুলাই থেকে যে বিধান হয়েছে, তা মানতে গিয়ে অযৌক্তিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোনো উপায় নেই। এই যেমন সঞ্চয়পত্র। আশা ছিল মাননীয় সংসদ সদস্যদের আপত্তি, জনসাধারণের আপত্তির কথা শুনে অর্থমন্ত্রী সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর যে অধিকতর করারোপ করেছেন, তা তিনি তুলে নেবেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা ছিল ৫ শতাংশ, এটাই বহাল থাকবে এই ছিল লাখ লাখ সঞ্চয়ীর প্রত্যাশা। সাধারণ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের প্রত্যাশা। নতুন অর্থমন্ত্রী তা করেননি। সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম দিন থেকেই ১০ শতাংশ অগ্রিম আয়কর উৎসেই কেটে নেয়া হবে। এবারে প্রশ্ন, আগে যারা কিনেছেন, তার বেলায় এ বিধান প্রযোজ্য কিনা? তিন বছর আগে কেনা, আরো দুই বছর পরে তা নগদায়নযোগ্য হবে এমন সঞ্চয়পত্রের বেলায়ও কি তা প্রযোজ্য? মাসে মাসে বা তিন মাস অন্তর যাদের সুদের টাকা তোলার কথা, অথচ নানা কারণে কয়েক মাসের টাকা তোলা হয়নি, এমন বকেয়া ক্ষেত্রেও কি নতুন বিধান প্রযোজ্য? খবরের কাগজে প্রকাশিত সংবাদ যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে ওইসব ক্ষেত্রেও ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটা হবে। একটি কাগজের খবরের শিরোনাম: ‘উৎসে কর ১০% সবার জন্যই’। একজন অর্থনীতিবিদ আন্তর্জাতিক কররীতির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘কারো পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ যদি আগামী দুই বছর পরে শেষ হয়, তাহলে ১ জুলাইয়ে আগের তিন বছরের মুনাফার ওপর ৫ শতাংশ এবং ১ জুলাইয়ের পরের সময়ের মুনাফার ওপর উৎসে কর ১০ শতাংশ আরোপই যৌক্তিক হবে।’ এটি ন্যায্য প্রশ্ন। এর পরেও প্রশ্ন আছে। ব্যাংকে মেয়াদি আমানত রাখলে যে তারিখে রাখা হয়, সেই তারিখের সুদহারই কার্যকর থাকে, পরবর্তী সময়ে সুদের হার কমানো-বাড়ানো হলেও। কারণ এটা ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি। চুক্তি একতরফাভাবে ভঙ্গ করা যায় না। আমার প্রশ্ন, সঞ্চয়পত্র কি ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে একটা চুক্তি নয়? আমার জানা নেই। তবে সাধারণ বুদ্ধিতে বলে, গচ্ছিত টাকা রাখার সময় যে শর্তাবলি থাকে, সেটিই উভয় পক্ষের কাছে মান্য। এ অবস্থায় সঞ্চয় অধিদপ্তর কী করে বলে যে ‘উৎসে কর ১০% সবার জন্যই।’


এটা কি অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নয়? এটা কি একতরফা সিদ্ধান্ত নয়? এ সিদ্ধান্তের দুটো ফল। প্রথমত, ৫ শতাংশের স্থলে সাধারণ সঞ্চয়কারীদের কাছ থেকে উৎসে অগ্রিম আয়কর কেটে নেয়া হবে ১০ শতাংশ হারে। এখানে সঞ্চয়কারীদের স্বার্থহানি হচ্ছে। তাদের আয় হ্রাস পাচ্ছে।দ্বিতীয়ত, বকেয়া সুদের ওপরও ১০ শতাংশ হারে কর কেটে নেয়া রীতিমতো জবরদস্তি। সঞ্চয় অধিদপ্তর আমার মনে হয় এক্ষেত্রে ‘ওভারস্টেপিং’ করছে। সিদ্ধান্তটি সঠিক হয়ে থাকলে তা পুনর্বিবেচনাযোগ্য। 

আরো কথা আছে। এসব দুঃখের কথা। ধরা যাক একজনের ১০ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র আছে। তাহলে তার বার্ষিক সুদ আয় হবে ১ লাখ ৯ হাজার ৪৪০ টাকা। ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটা হলে তার পরিমাণ হবে ১০ হাজার ৯৪৪ টাকা। যদি ওই ব্যক্তির আরো ২ লাখ টাকা অন্যান্য সূত্রে আয় হয়, তাহলে তার মোট আয় হবে ৩ লাখ ৯ হাজার ৪৪০ টাকা। যেহেতু উৎসে কর কাটা চূড়ান্ত দায় হিসেবে বিবেচিত, তাই ব্যক্তির কোনো আয়করই হবে না। কিন্তু ‘ফাইল’ জমা দিলেই সর্বনিম্ন কর দিতে হবে। দেখা যাবে পাওনা করের চেয়ে আয়কর কাটা হয়েছে অনেক বেশি। এ টাকা আইনত ফেরতযোগ্য। কিন্তু সবাই জানে সরকারের কাছ থেকে টাকা ফেরত পাওয়া কতটা ঝামেলাপূর্ণ। মুশকিল হলো, এ সমস্যাটা হবে প্রতি বছর। সম্ভবত এ সমস্যার কথা বিবেচনা করেই তিন বছর আগে ১০ শতাংশের স্থলে করহার কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। কিন্তু বিধি বাম, নতুন অর্থমন্ত্রী এসেই পুরনো অর্থমন্ত্রীর বিধানটি তুলে দিলেন। এতে অবিচার বাড়ল কিনা তা বিবেচনার বিষয়। আরো মুশকিল আছে। এক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত সঞ্চয়কারী করদাতার আয় কমল। বিপরীতে তাকে কোনো কর রেয়াত দেয়া হলো না। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা সাধারণত করদাতাদের পক্ষে কথা বলেন না। তারা তাদের নিজেদের দাবি নিয়েই বাজেটের আগে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু এবার তারা বাজার সৃষ্টির কথা বিবেচনা করে করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধির কথা বলেন। সাধারণ করদাতারা এ দাবি করেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে তুলনা করে বিশেষজ্ঞরাও একই কথা বলেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী কারো কথা শুনলেন না। চার বছর আগের আয়করমুক্ত সীমাই রেখে দিলেন। অথচ চার বছরের প্রতি বছর মূল্যস্ফীতি হয়েছে কম করে হলেও ৫ শতাংশ হারে। 


সরকারি কর্মচারীসহ বিভিন্ন অধিদপ্তরের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সুযোগ দ্বিগুণ করা হয়েছে। কিন্তু লাখ লাখ বেসরকারি করদাতার বেতন-ভাতা বাড়েনি। এ সত্ত্বেও করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হলো না। অধিকন্তু বাজারে দেখা যাচ্ছে সবকিছুর মূল্যে ঊর্ধ্বগতি। বাজেটের কারণে তেল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, চিনি থেকে শুরু করে বিরাটসংখ্যক দ্রব্যসামগ্রী ও সেবার মূল্য বেড়েছে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা আরেকটি এল বছরের প্রথম দিনেই। 

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম দিনেই বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম। সর্বোচ্চ হারে হয়েছে এই বৃদ্ধিটি। গড়ে প্রায় ৩৩ শতাংশ। গৃহস্থালি ব্যবহারের জন্যও দাম বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত হারে। এর ফল কী হবে তা নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। শিল্প উৎপাদনের খরচ বাড়বে, পরিবহন খরচ বাড়বে, বাড়িভাড়া বাড়বে। বড় কথা, গ্যাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হচ্ছে বিদ্যুৎ। এর দাম যেকোনো দিন বাড়বে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। অথচ যে যুক্তির বলে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে, তা কোনো যুক্তিই নয়। হিসাবে দেখা যাচ্ছে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে যে টাকা আদায় করা হবে, প্রায় সেই পরিমাণের টাকা ‘সিস্টেম লস’ দূর করে সাশ্রয় করা যায়। দেখা যাচ্ছে চুরি-দুর্নীতির বোঝাও সাধারণ মানুষকে বহন করতে হবে।

এভাবে দেখলে বোঝা যাবে একদিকে মানুষের আয় কমছে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ছিল ঊর্ধ্বমুখী। শুধু আয় কমের বিষয় নয়, লোকের চাকরিও যাচ্ছে। দৈনিক কাগজের খবর, ‘পাঠাও’ নামের রাইডশেয়ারিং কোম্পানি তার ৫০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করেছে। তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস এবং পুঁজির স্বল্পতাই নাকি ছাঁটাইয়ের কারণ। যেখানে পারছে সেখানেই মালিকরা রোবট বসাচ্ছেন। তৈরি পোশাক শিল্পে এর ব্যাপকতা বেশি। কয়েকদিন আগে দেখলাম একটা বিখ্যাত আসবাব কোম্পানিতেও রোবট বসেছে। বেসরকারি খাতে চাকরিচ্যুতি এখন যখন তখন। মধ্যবয়সে সন্তান-সন্ততিসহ লোকজন রাস্তায় পড়ছে। দুদিন আগে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম। একজন পুরনো কর্মী বললেন, প্রতিদিন সকালবেলা ওপরওয়ালার নাম নিয়ে অফিসে ঢুকি। রাত্রিবেলা আতঙ্কে থাকি। পরদিন সকালে আবার তা করি। হে ওপরওয়ালা, আমার চাকরিটা যাতে থাকে। এসব তো মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত কর্মী-কর্মচারীদের কথা, সাধারণ মানুষের দুঃখ আরো বেশি। গত সপ্তাহে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে দেখা। জিজ্ঞেস করেই বুঝলাম, দেশে কোনো কাজ নেই।

এখন বর্ষাকাল।  করিমগঞ্জ, ইটনা, মিঠামইন, সুনামগঞ্জ ইত্যাদি এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এখন জল আর জল। এ অবস্থায় কাজ তারা কোথায় পাবেন। নীলফামারীর ‘কিশোরগঞ্জ’ এলাকার এক রিকশাওয়ালা বললেন তার দুঃখের কথা। তাদের রোজগার এখন কম। যানজটের কারণে ‘খেপ’ তাদের অনেক কম। একটা যাত্রাতেই এক-দেড় ঘণ্টা লেগে যায়। অথচ ‘মেসের’ খরচ বৃদ্ধির দিকে। বাজার খরচও বেশি। এসব নিয়ে দেশের বড় একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসাব করে দেখিয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে গড়ে মানুষের মাসিক প্রকৃত আয় ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। তাহলে সরকারি হিসাবে গড় আয় বাড়ছে কীভাবে? সেটাও সত্য! কারণ ওই হিসাবে ধনী-দরিদ্র সবারই হিসাব আছে। ওই হিসাবে গরিব, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের আয়ের প্রতিফলন হয় না। এ বাস্তবতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরটাই শুরু হয়েছে উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠার মধ্যে। সামনে পবিত্র ঈদ। ওই উপলক্ষে যে আরেক দফা মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কী?

  • ড. আর এম দেবনাথ: সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  • কার্টসিঃ বণিকবার্তা/ জুলাই ১১, ২০১৯

হঠাৎ পিয়াজের দাম দ্বিগুণ!


মানবজমিন/ জুলাই ১১, ২০১৯



ঈদুল ফিতরের পর স্থিতিশীল থাকলেও হঠাৎ করেই রাজধানীর বাজারগুলোতে পিয়াজের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। গত দুই দিনে খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে অস্বাভাবিকভাবে দ্বিগুনের বেশি দাম বেড়েছে। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পিয়াজের দাম গড়ে ১৫ থেকে ২৫ টাকা বেড়েছে। খুচরা বাজারে এমন অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির তেমন কোন কারণ নেই বলে জানিয়েছেন পাইকারি বিক্রেতারা। কাওরান বাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীরা পিয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। সরবরাহ ও আমদানি মূল্য কম থাকার পরও বাড়তি মুনাফা করার জন্য দাম বাড়িয়েছেন চক্রটি। অন্যদিকে, ভোক্তারা মনে করেন, বাজার পর্যবেক্ষণ না থাকার কারণে এরকম দাম বেড়েছে। এখনি বাজার পর্যবেক্ষণ জোরদার না করা গেলে পিয়াজসহ অন্য মসলারও দাম বৃদ্ধি পেতে পারে বলে জানান তারা।

দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ সাধারণ ক্রেতারা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, উৎপাদন মৌসুমে পিয়াজ তোলার সময় বৃষ্টি ছিল। এতে নষ্ট হওয়ার ভয়ে দেশি পিয়াজ আগাম বেশি বিক্রি হয়ে গেছে। ফলে, আড়তগুলোতে এখন দেশি পিয়াজ কম সরবরাহ হচ্ছে। তাছাড়া সামনে কোরবানির ঈদ এবং ভারতীয় বাজারে পিয়াজের দাম বৃদ্ধির কথা বলেন তারা।

কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাত দেখালেও পিয়াজ কিনতে এসে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ব্যবসায়ীদের ওপর। 

বাজারে গত শুক্রবার পর্যন্ত দাম অপরিবর্তিত থাকলেও রোববার হঠাৎ করে পিয়াজের দাম কেজিতে ১৮ থেকে ২০ টাকা বেড়ে ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতিপাল্লা (৫ কেজি) বিক্রি হয়েছে ২২৫ টাকায়। শুক্রবার প্রতিকেজির দাম ছিল ২৫ থেকে ২৭ টাকা এবং পাল্লা ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। গত রোববার থেকে রাজধানীর খুচরা দোকান ও মুদি দোকানগুলোয় পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে, শুক্রবারেও যা ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি।

বেসরকারি চাকরিজীবী হাসনাত রিপন রাগান্বিত স্বরেই বললেন, গত শুক্রবারও যে পিয়াজ কিনেছি ২৮-৩০ টাকা কেজি, তা এখন হয়ে গেল ৫০ টাকা। এটা কি মগের মুল্লুক নাকি! পিয়াজ ছাড়া রান্না চলে না তো, তাই জেনেশুনে এমন সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো হয়। এটা সাধারণ ক্রেতাদের ওপর অত্যাচার ছাড়া কিছু না। 

কাওরান বাজারের পিয়াজ ব্যবসায়ী ফয়েজ আহমেদ বলেন, ভারতীয় পিয়াজের আমদানি খরচ হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় বাজারে পিয়াজ সরবরাহের ঘাটতি রয়েছে। তাই পাইকারি বাজারে পিয়াজের দাম বেড়ে গেছে, যার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। আরেক ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন বলেন, বৃষ্টির কারণে গত কয়েক দিনে পাইকারি বাজারে পিয়াজের দাম হঠাৎ বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, গত কয়েক দিনে কেজিপ্রতি পিয়াজের দাম পড়েছে ৩৮ থেকে ৩৯ টাকা। এর সঙ্গে খরচ যোগ করে আমাদের ৪৫ টাকা দামে বিক্রি করতে হয়েছে। 

শ্যামবাজার ব্যবসায়ী সমিতির প্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, আগে দিনে ভারত থেকে ২০০ পিয়াজের গাড়ি ৪টি স্থল বন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ করতো। কিন্তু এখন সেখানে ১০০ থেকে ১২০টি গাড়ি ঢুকছে বাংলাদেশে। আমদানি সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বাড়ছে বলে জানান তিনি। 

খুচরা বাজারে দেখা গেছে, মানভেদে দেশি পিয়াজ কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকা। গত রোববার থেকে এই দামে পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে। তবে গত শুক্রবার প্রতি কেজি ভালো মানের দেশি পিয়াজ বিক্রি হয় ৩০-৩৫ টাকা। অর্থাৎ খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পিয়াজের দাম বেড়েছে ২০-২৫ টাকা। রোববার পাইকারিতে দাম বাড়ার প্রভাবে ওই দিন থেকেই খুচরা বাজারে পিয়াজের দামে বড় ধরনের উত্থান হলেও, মঙ্গলবার পাইকারিতে দাম কমার প্রভাব এখনও খুচরা বাজারে পড়েনি। খুচরা বাজারে এখনও বাড়তি দামেই পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে।

কাওরানবাজারের পিয়াজ ব্যবসায়ী হাসান মিয়া বলেন, বৃষ্টির কারণে গত দুদিনে পিয়াজের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়। ওই সময় আমাদের প্রতি মণ পিয়াজ কেনা পড়ে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ প্রতি কেজির দাম পড়ে ৩৮-৩৯ টাকা। এর সঙ্গে খরচ যোগ করে আমাদের ৪৫ টাকা দামে বিক্রি করতে হয়েছে।

তবে পাইকারি বাজারে পিয়াজের দাম কিছুটা কমেছে। প্রতি মণ কেনা পড়ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি কেজির দাম পড়ছে ৩০-৩২ টাকা। এই পিয়াজ আমরা ৩৫-৩৬ টাকা কেজি বিক্রি করছি। এ হিসাবে এখন পিয়াজের দাম প্রতি কেজিতে কমেছে ১০ টাকা করে। কিন্তু খুচরা বাজারে চিত্র ঠিক উল্টো। 


উৎস লিঙ্ক — http://bit.ly/2YQruve

Sunday, July 7, 2019

চোখের সামনে হলুদ জামা পরা সায়মার মুখ


শাহানা হুদা

দিনে দিনে কি অসুস্থ হয়ে পড়ছি, তা না হলে কেন চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই, একটি শিশু ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে, আর কতগুলো দানবীয় হাত তার দিকে এগিয়ে আসছে। কোন শিশুর দিকে চোখ পড়লেই কেন মনে হচ্ছে এই বাচ্চাটি কি নিরাপদে থাকতে পারবে? ও কি জানে ওর চারপাশে মানুষরূপী দানবরা ঘুরে বেড়াচ্ছে? এরা আর কেউ নয় তার পরিবারের সদস্য, বা শিক্ষক বা পাড়ার ছেলে বা আত্মীয় নামক মানুষরূপী একদল জীব। মাঝেমাঝে ভাবছি খবরে চোখ রাখা কি বন্ধ করে দেব? উটপাখি হয়ে যাব? যতগুলো শিশু বা মেয়ের ছবি দেখছি, সেখানেই আমার মেয়ের বা আমার ছোট্ট নন্নার মুখ ভেসে উঠছে। মনে হচ্ছে এই বাচ্চাগুলোকে আমরা হত্যা করছি।



স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

আমার চোখের সামনে হলুদ জামা পরা সায়মার মুখ, মাথায় লাল ফিতা দিয়ে চুল বাঁধা। কানে বাজছে সায়মার বাবার কান্নাজড়ানো কণ্ঠ - দেশবাসীকে একটা কথা বলতে চাই, যাদের মেয়ে বাচ্চা আছে, তারা তাদের আগলে রাখবেন। এক মুহূর্তের জন্যও আলগা হতে দেবেন না। এইসব নরপিশাচদের হাত থেকে এদের রক্ষা করবেন।     

কিন্তু এভাবে তো চলা যায় না। আরও দমবন্ধ লাগছে এজন্য যে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে আমি, আপনি, সমাজ, সরকার কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করছি না। আমি, আপনি ফেসবুকে ইমো দিচ্ছি, অধিকাংশ মানুষ নির্বিকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চুপচাপ এবং সরকার কোনো দায় অনুভব করছে না। তারা উন্নয়ন নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে সারাক্ষণ সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, আমেরিকার অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা ভাবছে, অথচ নিজের দেশে যে ছোট ছোট শিশুরা, নারীরা অব্যাহতভাবে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, সেটা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাই নেই।

আমরা ভাবতেই পারি না গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত - এই ছয় মাসে সারাদেশে ৩৯৯ শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ছেলে শিশুর সংখ্যা আট। ধর্ষণের পর এক ছেলে শিশুসহ মারা গেছে আরও ১৬ শিশু। এদের মধ্যে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছিল ৪৪ জনের ওপর। এছাড়া যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ৪৯ শিশু। যৌন হয়রানির ঘটনায় আহত হয়েছে ৪৭ মেয়েশিশু ও দুই ছেলেশিশু। মানে দাঁড়াচ্ছে ১৮২ দিনে ৩৯৯ শিশু ধর্ষণের শিকার। মাত্র ছয়টি পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে এই সংখ্যাটি পাওয়া গেছে। সারাদেশে আরও অসংখ্য নারী, মেয়ে ও ছেলে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। যেগুলোর খবর গণমাধ্যমে আসে, আমরা শুধু সেগুলোই জানি। বাকি সব থেকে যাচ্ছে চোখের অন্তরালে।

পরপর কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা আমাদের চমকে দিয়েছে। স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষক, পরিবারের একদম ঘনিষ্ঠ জন কেউ বাদ নেই। আগে আমাদের ধারণা ছিল গুণ্ডা-মাস্তানরা ধর্ষণ করে তরুণী এবং কিশোরীদের। এখন দেখছি এই ধারা একেবারে পাল্টে গেছে। শিশুরাই এখন বড় টার্গেট। কারণ শিশুরা দুর্বল, শিশুদের খুব সহজে ভোলানো যায়, পথেঘাটে শিশুরাই খেলে বেড়ায় এবং শিশুরা কাউকে কোনো অভিযোগ জানাতে ভয় পায়। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো শিশুরা কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও তাকে গুরুত্ব দেয় না পরিবারের লোকজন। বিশেষ করে সেই ব্যক্তি যদি হয় পরিবারেরই কোনো বয়স্ক ব্যক্তি বা সদস্য। উল্টো শিশুকে চাপের মধ্যে রাখে। আমরা যদি শিশুদের ধর্ষিত হওয়ার খণ্ডচিত্রগুলো লক্ষ্য করি দেখব যে এরা কেউ বাসায় গিয়ে কারও বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেনি কখনো। এই যে নুসরাতকে পুড়িয়ে মারা হলো, এই নুসরাত যখন তার পরিবারের কাছে বারবার এইসব নিপীড়নের কথা বলেছিল, পরিবার খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি।

নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে শিশুদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। বাবা-মায়েরা যখন কাজে যায়, তখন শিশুরা থাকে একেবারে অভিভাবকহীন। দেখা যায় ১২/১৩ বছরের বোনটি তার আরও দুটি ভাই-বোনকে দেখভাল করছে। এরা সবাই অনিরাপদ। এসব পরিবারে শিশুদের নিরাপত্তার কোনো ধারণা দেওয়া হয় না। এরকম অগণিত বাচ্চা একদম অযত্নে অবহেলায় শহরের বস্তিতে বেড়ে উঠছে। এরা পথে পথে ঘুরে, হাটে-বাজারে-পথের পাশে ঘুমায়। এদের জীবনে নিরাপত্তা বলে কোনো শব্দই নেই। এই শিশুগুলোকে দেখলে আমার শুধু মনে হয় খাদ্য-বস্ত্র-শিক্ষা-বাসস্থানের পাশাপাশি এরা নিরাপত্তা থেকেও বঞ্চিত। যেকোনো সময়, যে কেউ এদের ধর্ষণ করে মেরে ফেলে রেখে যাতে পারে এবং যায়ও। প্রতিবন্ধী শিশুর নিরাপত্তা আরও কম। যাদের দায়িত্ব পরিবার, সমাজ, সংসার কেউ নেয় না, তাহলে কেনইবা এদের জন্ম হয়, কেনইবা এরা ঝরে যায়?

যে শিশুটি আমাদের ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে আছে, যে শিশুটি যত্রতত্র ঘুরেও বেড়ায় না, পরিবারেই থাকে তারও বিপদ কিন্তু কম না। এই পরিবারগুলোতেই এমন সব মানুষরূপী প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে --- যাদের কথা আমরা ভাবতেও পারব না, অথচ এই অমানুষগুলোই বাচ্চাদের সারল্য ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে অত্যাচার করে চলেছে সবার অগোচরে। আসলে যে লোকটি বিকৃত রুচির, তার সামাজিক পরিচয় যাই-ই হোক সে কিন্তু ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেই। সে হতে পারে কারো বাবা, ভাই, চাচা, মামা বা দাদা। কিন্তু সে আসলে মনের দিক থেকে একজন ধর্ষক। সে পথেঘাটে মেয়েদের দেখে, উত্যক্ত করে আর ঘরে এসে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি করে। আর তাই ৯ মাসের নবজাতককে যখন তার চাচা ধর্ষণ করেছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়, তা দেখে আমরা আঁতকে উঠি। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে এরাই সেই বিকৃত মনের পিশাচ।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বলছে, শতকরা ৮৭ ভাগ নারী তাদের পরিবারেই যৌন হয়রানির শিকার হয়। পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, যখন রক্ষকই ভক্ষক হয়ে যায়।

কেন ধর্ষণের ঘটনা দিনে দিনে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে? সবার মুখে এখন এই একই কথা। অধিকাংশ মানুষ মনে করে অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয় না বলে, তারা এই ধরনের অপরাধ করতেই থাকে। অপরাধী যখন জানে অপরাধ করলে সে পার পেয়ে যাবে, তখন তার বারবার অপরাধ করতেও ভয় হয় না। দেশে নানা ধরনের যৌন উত্তেজক মাদক ও পর্নোগ্রাফির ছড়াছড়ি। সববয়সের পুরুষ এই মাদক গ্রহণ করছে এবং পর্নোগ্রাফি দেখছে এবং যার তার ওপর এর প্রয়োগ ঘটাচ্ছে। মাদক এবং পর্নো সাইট দুটোই নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন হলেও অসাধ্য নয়। সরকার যদি সত্যিই চায় এগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে, তাহলে সেটা খুব কঠিন হবে না।

এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রচারণা চালানো। শিশুদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাদের শেখাতে হবে কোনটা ভালো স্পর্শ, কোনটা মন্দ স্পর্শ। তাদের শেখাতে হবে কিভাবে তারা প্রতিবাদ করবে এবং অন্যায়কারীকে চিনিয়ে দেবে। তাদের জানাতে হবে তাদের পক্ষে আছে তাদের অভিভাবকরা। কেউ যদি আদরের নামে তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করে, তাকে কিভাবে শায়েস্তা করতে হবে, সেটাও শিশুদের শেখাতে হবে। শিশুদের শেখাতে হবে তারা যেন পরিচিত, অপরিচিত কারও সঙ্গে কোথাও একা একা চলে না যায়, কেউ কিছু খাবারের প্রলোভন দেখালে তারা যেন সেই ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে চলে না যায়। শিশুকে ঘুরে দাঁড়ানো শেখাতে হবে।

আর বাবা মা, অভিভাবককেও শিশুর নিরাপত্তার প্রতি সচেতন হতে হবে। বস্তিবাসী, দরিদ্র, অসহায় বাবা মায়েরা অনেকসময় পারেন না তাদের সন্তানের দেখভাল করতে। কিন্তু এরপরও সন্তানের কথা বিবেচনা করে খুব সচেতন হতে হবে সব অভিভাবককে। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, কী করছে, সন্তানের সঙ্গে কে কীরকম ব্যবহার করছে এসবে দৃষ্টি দিতে হবে। আমাদের সবাইকে একসঙ্গে সমাজ সচেতনতার কাজ শুরু করতে হবে। তা না হলে একটি শিশুকেও আমরা সুস্থ রাখতে পারব না।

  • শাহানা হুদা: যোগাযোগকর্মী, লেখকের ইমেইল —  ranjana@manusher.org 

  • উৎস লিঙ্ক —  http://bit.ly/30kZ8cR  

Saturday, July 6, 2019

উন্নয়নের অন্তরালে মানুষ ‘আর্তনাদ’ করছে


ঢাবি প্রতিনিধি/দেশরূপান্তর 

অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের কোনো মানুষ নিরাপদে নেই। এমন নিরাপত্তাহীনতা আমরা ৭১ সালেই দেখেছিলাম। এর বড় উদাহরণ হচ্ছে এই যে ধর্ষণ, এটি কেবল ধর্ষণ নয়, গণধর্ষণ । এসব অন্যায় রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আমরা দেখেছি, নুসরাত জাহানের ঘটনার সাথে পুলিশ জড়িত হয়ে পড়ল, আওয়ামী লীগ নেতা জড়িত ছিল এবং সকলে মিলে প্রমাণ করতে চাইল যে নুসরাত আত্মহত্যা করতে চেয়েছে। ইতিমধ্যে একজন নার্সকে বাসের মধ্যে ধর্ষণ করে হত্যা করা হলো। বলা হচ্ছে  উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু এই উন্নতির অন্তরালে মানুষ আর্তনাদ করছে।’

শুক্রবার, মে ১০, ২০১৯,  দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুল ইসলাম লেকচার হলে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির আয়োজনে ‘শ্রমিক আন্দোলনের একাল সেকাল’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি এসব কথা বলেন। 


বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থার বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন ‘আজকে দেশে যে রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে, তার চেয়ে খারাপ অবস্থা অতীত ইতিহাসে ছিল কিনা আমার জানা নেই। আমরা দুর্ভিক্ষ দেখেছি, যে দুর্ভিক্ষে অনেক মানুষ মারা গেছে। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে দৃশ্যমান কোনো দুর্ভিক্ষ না থাকলেও নীরবে দুর্ভিক্ষ আছে।


দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্নীতির বিষয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধের ভুয়া সনদ দিয়ে পদোন্নতি নিতে গিয়ে ধরা খেয়েছে। অথচ যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবে তারাই যদি দুর্নীতি করে, তাহলে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা অবস্থা কি তা সহজে অনুধাবন করা যাচ্ছে। আমরা পুঁজিবাদের অধীনে দাস হয়ে রয়েছি। এ ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভেঙে দিতে হবে। রাষ্ট্রের মালিক শ্রেণির সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণির যে শোষণের সম্পর্ক তা ভেঙে দিতে হবে। তাহলে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। বিপ্লবের মাধ্যমে পুরোনো রাষ্ট্রকে ভেঙে এমন রাষ্ট্র করতে হবে, যে রাষ্ট্র মানবিক হবে, যেখানে নারী ধর্ষিত হবে না, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের নামে প্রতারণা করবে না।’

Wednesday, July 3, 2019

মৃত ব্যক্তির ভোটদান ও ‘করণীয় কিছু নেই’ সমাচার



গোলাম মোর্তোজা
‘কোথায় যাই, কার কাছে যাই’- মহাদেব সাহার জনপ্রিয় কবিতার লাইন একটু পরিবর্তন করে বলা যায় ‘কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে’? ভরসার জায়গা কোথায়? বলছি বাংলাদেশের জনগণের কথা। বহুবিধ প্রশ্নের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে যেসব প্রশ্ন দৃশ্যমান হয়েছিলো, তার একটি এখন আবার আলোচনায়।





১. কিছু কেন্দ্রে ‘শতভাগ’ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। মৃত ব্যক্তি ভোট দিয়েছিলেন। মালয়েশিয়ায় বা সৌদি আরবে থাকেন যারা, তারা বাংলাদেশে না এসেও সশরীরে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে ভোট দিয়েছিলেন!

বগুড়ার কয়েকটি কেন্দ্রের ‘শতভাগ’ ভোটের সংবাদ দ্য ডেইলি স্টার প্রকাশ করেছিলো ১ জানুয়ারি, নির্বাচনের ১ দিন পর।

দ্য ডেইলি স্টারের বগুড়া প্রতিনিধি মোস্তফা সবুজ ‘শতভাগ’ ভোট দেওয়া এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধানে গিয়েছিলেন এ বছরের ১ জানুয়ারি। মৃত এবং প্রবাসে থাকা ব্যক্তিদের ভোট দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছিলেন তিনি। অনুসন্ধানে জানতে পারেন -

বগুড়ার চিকাশি মোহনপুর গ্রামের হজরত আলীর স্ত্রী জাহেদা খাতুনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৩ মার্চ। তার ভোটার নম্বর ১০১৪৮২২২৪৯৬৭ (ক্রমিক নম্বর: ২৩৩)। জাহেদার ছোট ছেলে আকবর আলী (৪০) জানান, ২০১৮ সালের জুনে তার মা পারিবারিক কলহের জেরে তার এক প্রতিবেশী আত্মীয়ের হাতে নিহত হন।

এই হত্যার পর মামলার প্রধান আসামি মেহের আলী কারাগারে রয়েছেন। অথচ এই কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে।

হত্যার দায়ে অভিযুক্ত মেহের আলীর বাবা ইউসুফ আলী জানান, তিনি ও তার স্ত্রী মেহেরুন্নেসা এবং মেহের আলীর স্ত্রী আরজিনা বেগম ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেননি। হত্যাকাণ্ডের পর আরজিনা বগুড়ায় থাকতে শুরু করেন এবং তিনি এখনো এই গ্রামে ফিরে আসেননি।

চিকাশি মোহনপুর গ্রামের মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের ছেলে মালয়েশিয়া প্রবাসী মোহাম্মদ মইনুল হাসান (ভোটার নম্বর: ১০১৪৮২০০০২৮৪) ভোট দিয়েছেন বলেও ভোটার তালিকার মাধ্যমে জানা যায়।

মইনুলের মা সালেহা বেগম বলেন, তার ছেলে মালয়েশিয়ায় গিয়েছে প্রায় ১ বছর হলো। সে সেখানে একজন শ্রমিক হিসেবে কাজ করে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

বিষয়টি দাঁড়ালো এমন, যিনি নিহত হয়েছেন ২০১৮ সালের জুন মাসে, তিনি ভোট দিয়েছেন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। হত্যাকারী জেলে, তিনিও ভোট দিয়েছেন। না, জেলে কোনো ভোটকেন্দ্র ছিলো না। ভোট দেওয়ার জন্যে মুক্তিও পাননি, কিন্তু ভোট দিয়েছেন। এক বছর ধরে যিনি মালয়েশিয়ায় আছেন, তিনিও ভোট দিয়েছেন। পোস্টাল ব্যালটের ব্যবস্থা ছিলো না, সেভাবে তিনি ভোট দেনওনি। ভোটার তালিকা অনুযায়ী তিনি সশরীর উপস্থিত হয়ে ভোট দিয়েছেন।

অনুসন্ধানে এ তথ্য জানার পর রিটার্নিং কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত কাগজ পেতে বেগ পোহাতে হয়। এবং তা দেরিতে পাওয়া যায়। ইতিমধ্যে নির্বাচন নিয়ে অসংখ্য অভিযোগ সামনে চলে আসায়, ‘শতভাগ’ ভোটের বিস্তারিত প্রতিবেদন আর প্রকাশিত হয়নি।

সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ফল তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যায়, ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ, ১২৭টি কেন্দ্রে ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে।

যে সংবাদ দ্য ডেইলি স্টারসহ দু-একটি গণমাধ্যম প্রকাশ করেছিলো ১ জানুয়ারি, সেই সংবাদের সত্যতা এখন স্বীকার করে নিলো নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, ‘১০৮টি আসনের ৮৮৯টি কেন্দ্রে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীরা একটি ভোটও পাননি।’ (কালের কণ্ঠ ২ জুলাই, ২০১৯)

প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, “শতভাগ ভোট পড়া কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়, তবে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের করণীয় কিছু নেই।”

কেনো ‘করণীয় কিছু নেই’ তার পক্ষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার যুক্তি দিয়েছেন এভাবে, “ভোটের পর পরই গেজেট আকারে ফল প্রকাশ হয়ে যায়। গেজেট প্রকাশের পর ইসির কিছু করার থাকে না। তাই খতিয়ে দেখার সুযোগ নেই। প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, রিটার্নিং কর্মকর্তা যেহেতু এ বিষয়ে আগে কিছু জানাননি, তাই এখন ইসির কিছু করার নেই।”

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আরো কিছু বিষয় পর্যালোচনার দাবি রাখে।

ক. নির্বাচন কমিশন যেদিন নির্বাচনের ফল গেজেট আকারে প্রকাশের জন্যে (১ জানুয়ারি) বিজি প্রেসে পাঠিয়েছিলো, সেদিনই (১ জানুয়ারি) শতভাগ ভোটের সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিলো।

খ. শতভাগ ভোট, রাতে ভোট, ভোটারের চেয়ে বেশি ভোট, নির্বাচন নিয়ে এমন বহুবিধ গুরুতর অভিযোগ আলোচনায় থাকলেও, তড়িঘড়ি করে গেজেট আকারে ফল ছাপানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো। যদিও আইনগতভাবে এতোটা তাড়াহুড়ার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিলো না। সুযোগ ছিলো অভিযোগগুলোর তদন্তের।

গ.  নির্বাচন কমিশন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ দেখেও তাদের কাছে সত্যতা জানতেও চায়নি। অর্থাৎ বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের ‘অজানা’ ছিলো না।

ঘ. ‘শতভাগ’ ভোট, মৃত বা প্রবাসে থাকা ব্যক্তির ভোট দেওয়াকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলছেন, ‘স্বাভাবিক নয়’। বিষয়টি কি আসলে এতো সহজ বা সরল? প্রথমত, প্রিজাইডিং অফিসার বা রিটার্নিং কর্মকর্তার উপর যে দায়িত্ব ছিলো, তারা তা পালন করেননি। দ্বিতীয়ত, তারা যে দায়িত্ব পালন করেননি বা করতে পারেননি, তা গণমাধ্যমকে বা নির্বাচন কমিশনকে যথা সময়ে জানাননি। নির্বাচন কমিশনের অধীনে থেকে দায়িত্ব পালন করেননি এসব কর্মকর্তারা। ‘দায়িত্ব পালন না করা’ এবং ‘না জানানো’র পক্ষে কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।
দায়িত্ব পালন না করে, তথ্য না জানিয়ে করা ‘অপরাধ’-কে কি ‘স্বাভাবিক নয়’ বলা যায়?

ঙ. প্রিজাইডিং অফিসার বা রিটার্নিং কর্মকর্তা কেনো আগে জানালেন না, তা নির্বাচন কমিশন জানতেও চাননি। গেজেট প্রকাশের পর ফল হয়তো পরিবর্তন করা যাবে না, কিন্তু ‘মৃত ব্যক্তি’র ভোট দেওয়ার অভিনব ঘটনার তদন্তে সমস্যা কী? আইনে কোনো বাধা আছে? ‘করণীয় কিছু নেই’- প্রধান নির্বাচন কমিশনার কি এমন কথা বলতে পারেন?

২. যুক্তি হিসেবে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যার বিষয়টি সামনে আনা হয়। মোট ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৪১ হাজার ১৫৫। শতভাগ ও ৯৯ ভাগ ভোট পড়া কেন্দ্রের সংখ্যা ৩৪০টি। প্রশ্ন হলো, এটি কি বড় কোনো অভিযোগ না ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’? ৪১ হাজারের বেশি কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ৩৪০টি কেন্দ্রে এমন অনিয়মের প্রেক্ষিতে কি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়?

চ. দেশে মোট ভোটার প্রায় ১০ কোটি ৪১ লাখ। নির্বাচন কেন্দ্রিক জরিপ করা হয় এক, দেড় বা দুইহাজার ভোটারের মতামতের ভিত্তিতে। গ্রহণযোগ্য কোনো প্রতিষ্ঠানের করা জরিপের ফলাফলে সাধারণত ভুল প্রমাণ হয় না। সাড়ে ১০ কোটির মধ্যে ২ হাজার মানুষের মতামতভিত্তিক জরিপ যদি গ্রহণযোগ্য হয়, তবে ৪১ হাজার কেন্দ্রের মধ্যে ৩৪০ কেন্দ্রের নজির ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলার সুযোগ থাকে না। ৪১ হাজার কেন্দ্রের অনিয়মের প্রমাণ সামনে আসবে বা আনতে হবে- এটা তো কোনো যৌক্তিক কথা হতে পারে না। তাহলে তো ১০ কোটি ভোটারের মতামত নিয়ে জরিপ করতে হবে। ৩৪০টি কেন্দ্রের ঘটনা তদন্ত করে নির্বাচন কমিশন বলতে পারতো, অন্যত্র এমন কিছু ঘটেছে বা ঘটেনি। কিন্তু, তখন নির্বাচন কমিশন তদন্ত না করে, এখন বলছে ‘করণীয় কিছু নেই’।

ছ. টিআইবি তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে ৫০টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪৭টিতে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছিলো। ৩৩টিতে রাতে সিল দেওয়ার তথ্য জানিয়েছিলো টিআইবি। বিবিসি তাদের সংবাদে একটি কেন্দ্রে আগে ভোটের ভিডিও চিত্র দেখিয়েছিলো। খুলনার একটি আসনে মোট ভোটারের চেয়ে ভোটের সংখ্যা বেশি উল্লেখ করে ফল প্রকাশ করেছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। সেই সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। ভোটারের চেয়ে বেশি ভোটের ভিডিওচিত্র বিশ্লেষণ করে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ করেছিলো ডয়চে ভেলে।

জ. টিআইবির রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচন কমিশন বলেছিলো, রিটার্নিং বা প্রিজাইডিং অফিসারদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করেনি টিআইবি। যাদের কাছে মৃত ব্যক্তিরা এসে ভোট দিয়েছেন, তাদের থেকে তথ্য নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হবে? নির্ভরযোগ্য বিকল্প পথে সংগৃহীত তথ্য গ্রহণযোগ্য হবে না? যারা নির্বাচন কমিশনকে সময়মতো তথ্য জানাননি, তারা টিআইবিকে সঠিক তথ্য জানাবেন, জানাতেন?

ঝ. ভোট শুরু হওয়ার আগে কী করে ব্যালট বাক্স ভরে গেলো? এই প্রশ্নের উত্তর জানার বা জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি নির্বাচন কমিশন। কেন্দ্রটির ভোটগ্রহণ স্থগিত করে দায়িত্ব সেরেছিলো তারা। ভোটারের চেয়ে ভোট বেশি, কী করে এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটলো, জানার প্রয়োজন মনে করেনি কমিশন।

৩. ‘করণীয় কিছু নেই’ বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, কেউ চাইলে আদালতে যেতে পারেন। ’সচিবরা কী করেন, প্রধানমন্ত্রীকে কেনো সবকিছু করতে হয়’, ‘গাড়ির হর্ন’ বা ‘সিজার রোধে নীতিমালা’ বা ‘এডিস মশা-ডেঙ্গু’ থেকে শুরু করে নিরাপদ খাবার, সব বিষয় নিয়েই আদালত কথা বলছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন। যার যা করার কথা তা করছে না বলে, কথা বলতে হচ্ছে, নির্দেশনা দিতে হচ্ছে আদালতকে। সেই নির্দেশনারও অনেকগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

এখন ’মৃত ব্যক্তি’ কেনো বা কীভাবে ভোট দিলেন, প্রতিকার চাইতে যেতে হবে আদালতে!

সাংবিধানিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন তাহলে কী করবে বা তাদের কাজ কী? নির্বাচন কমিশনাররা জনগণের অর্থে দেওয়া সুযোগ-সুবিধা, গাড়ি-বাড়ি-বেতন-ভাতা-প্রটোকল ভোগ করবেন, আর জনগণকে আদালতে যাওয়ার নির্দেশনা দিবেন?
যে নির্বাচন কমিশনের একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার কথা, তারা যদি বলেন ‘কিছু করণীয় নেই’ প্রশ্ন আসে মানুষ তাহলে কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে!

  •  লেখকের ইমেইল —   s.mortoza@gmail.com
  •  কার্টসি —  দি ডেইলি স্টার/ জুলাই ৩, ২০১৯  


Tuesday, July 2, 2019

ঋণের ফাঁদে বাজেট


রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর


রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর

বাজেটের পরিকল্পনা, বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া, খাতভিত্তিক বরাদ্দ ও সমস্যা নির্ধারণ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হচ্ছে। অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ অত্যধিক। প্রতিবছরই বাজেটে বিপুল পরিমাণ ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ঘাটতি মেটাতে ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। বাজেট বাস্তবায়নের হারেও দেখা যায় নিম্নমুখিতা।

চলমান আর্থিক বছরে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কর আদায়ের পরিমাণ যেমন কম, তেমনি করের আওতাও বাড়েনি। গত বছরের জুনে ঘোষিত এ বছরের বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বিধায় সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। ঘোষিত ও সংশোধিত বাজেটের কর আদায়ের পরিমাণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য বিদ্যমান। ২০১৮-১৯ সালে কর থেকে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৫ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। তার মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর কর্তৃক মোট রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। এ লক্ষ্যমাত্রা সংশোধিত হয়ে ২ লাখ ৩ হাজার ৮৪৪ দশমিক ৭৮ কোটি টাকা হলেও এনবিআর জানাচ্ছে, এ বছরের মার্চ নাগাদ ১ লাখ ৫৩ হাজার ৮৪৯ দশমিক ৮৯ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। অন্যদিকে একই অর্থবছরে এনবিআর–বহির্ভূত করের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। অতীত অভিজ্ঞতা বলে এ লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন সম্ভব হবে না।

মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ করদাতা। প্রতিবেশী দেশে অপেক্ষাকৃত কম হলেও করদাতার পরিমাণ ১৮ শতাংশের মতো। পরিসংখ্যান বলছে, সামর্থ্যবান মানুষের ৬৮ শতাংশই করের আওতায় নেই। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় কর-জিডিপি হারও কম। জাতীয় আয়ের যে প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়, তার সঙ্গে সংগতিহীন। একদিকে কর আদায় ঠিকমতো হচ্ছে না, অন্যদিকে টাকা চলে যাচ্ছে বিদেশে। ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেওয়ার প্রয়াস বিদ্যমান।

অন্যদিকে ব্যয় বেড়েই চলছে। ব্যয় দুই প্রকার—রাজস্ব ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাবদ ব্যয়। ঘোষিত বাজেট অনুযায়ী মোট ব্যয় ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। বিগত ১০ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাবদ ব্যয় ৫৫ শতাংশের কোঠায় থাকলেও মে ও জুন মাসে ব্যয়ের তথাকথিত উল্লম্ফন ঘটবে। রাজস্ব ব্যয় মোটামুটি ঘোষিত বাজেট অনুযায়ী হবে। অর্থাৎ ঘাটতি মোকাবিলায় ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাবে।

ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে সুদ-আসল পরিশোধ করতেই বিশাল ব্যয় হচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাতে রাজস্ব ব্যয়ের ১৮ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ফলে দেশের গুণগত সার্বিক রূপান্তরে অত্যধিক প্রয়োজনীয় মানব পুঁজি বা দক্ষ শ্রমশক্তি বিনির্মাণে, তথা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না। উপরন্তু ঋণের পরিমাণ সুদসহ জমতে জমতে পাহাড়সম হলে পরিশোধের কোনো দিকনির্দেশনাও বাজেটগুলোতে নেই।

বাজেট ঘাটতি মেনে নেওয়া যায়, যদি তা অর্থনীতিতে গুণক প্রভাব তৈরি করে। ঋণ বৃদ্ধির অন্যতম বড় কারণ সরকারি চাকরিতে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত পদ সৃষ্টি, গণহারে পদোন্নতির মাধ্যমে বেতনকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি। এ অর্থবছরে বেতন-ভাতার জন্য রাজস্ব ব্যয়ের ২০ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পত্রিকান্তরের হিসাব অনুযায়ী, উপসচিবের ৮৫০টি পদের বিপরীতে ১ হাজার ৫৫৪ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। যুগ্ম সচিবের ৪৫০টি পদের বিপরীতে ৭৮৭ জন, অতিরিক্ত সচিবের শতাধিক পদের বিপরীতে ৪৩৫ জন কর্মরত আছেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। ২০১৭ সালে বিভিন্ন সংস্থায় ১৪২ জন কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে কর্মরতদের মধ্যে ১২ জন সচিবকে অবসরের পর পুনরায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দকৃত ব্যয় কতটা গুণসম্পন্ন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় বারবার সংশোধনের ফলে ঋণের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে অস্বাভাবিক খরচও চোখে পড়ার মতো। পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রাক্কলিত ব্যয় বাড়তে বাড়তে ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। চার লেন সড়ক তৈরিতে যেখানে ভারতে ১১ থেকে ১৩ লাখ ও চীনে ১৩ থেকে ১৬ লাখ মার্কিন ডলার খরচ হয়, সেখানে বাংলাদেশে ৫০ লাখের বেশি। সম্প্রতি রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে অনিয়মের খবর জনসমক্ষে এসেছে। বিভিন্ন প্রকল্পে কোন পর্যায়ের দুর্নীতি হচ্ছে, সহজেই অনুমেয়। এ ছাড়া অর্থবছর শেষে জোড়াতালি দিয়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ৯০-৯২ শতাংশ দেখানো হয়, যা প্রথম ১০ মাসের হিসাবের সঙ্গে কোনোভাবেই সংগতিপূর্ণ নয়।

দেখা যাচ্ছে, দেশের সাধারণ করদাতারাই ঋণ শোধ ও উন্নয়নের মূল উৎস হিসেবে কাজ করছেন। বারবার বলা হলেও আয়কর এখনো কর আদায়ের প্রধান উৎস নয়। মূল্য সংযোজন করের মাধ্যমেই ব্যয় নির্বাহ করতে হচ্ছে। এই আয়-নিরপেক্ষ পরোক্ষ করের বোঝা পুরোটাই সাধারণ জনগণের কাঁধে চেপে বসে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জনগণের ওপর করের ভার বর্তাচ্ছে। বিপরীত দিকে উচ্চবিত্তদের কর পরিহার ও ফাঁকি দেওয়াটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে!২০০৯-১০ অর্থবছরের বাস্তবায়িত বাজেটে মূল্য সংযোজন করের পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। এ অর্থবছরের বাজেট পরিকল্পনায় ভ্যাটের পরিমাণ ধরা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯ বছরে ভ্যাটের হার প্রায় ৩৮০ শতাংশ বেড়েছে! ভ্যাট সরকারের কাছে সোনার ডিম পাড়া হাঁস! এ প্রক্রিয়ায় করব্যবস্থা আরও ব্যাপকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল (রিগ্রেসিভ) হয়েছে।

আবার সাধারণ জনগণকে বড় ঋণখেলাপিদের জন্যও প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে। গত কয়েক বছরে সরকারি ব্যাংকের মূলধন সংকট মেটাতে প্রায় ১৫ হাজার কোটি কর থেকে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ জনগণ করের বোঝা বহন করে চললেও এর বিনিময়ে জনসেবা পাওয়ার চিত্র হতাশাজনক। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে গুণগত উন্নয়ন প্রশ্নের সম্মুখীন। এ ছাড়া নিরাপদ সুপেয় পানি, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সুবিধাসহ অন্যান্য জনসেবামূলক কর্মকাণ্ড মন্থর গতিতে এগোচ্ছে।

৪ কোটি ৮২ লাখ তরুণ বেকার। ৪৭ শতাংশ স্নাতক বেকার।

বাজেটে মৌলিক সমস্যা সমাধানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে না। জিডিপিতে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ২৩ শতাংশে ঘুরপাক খাচ্ছে। নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে। বিপুলসংখ্যক চাকরিপ্রার্থীর জন্য চাকরির বাজার অপর্যাপ্ত। আবার চাকরির বাজারের সঙ্গে শিক্ষার মান সমানতালে বেড়ে উঠছে না। বিদেশ থেকে দক্ষতার ঘাটতি পূরণে জনবল আমদানি করতে হচ্ছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারত প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে। বর্তমানে ৪ কোটি ৮২ লাখের মতো তরুণ বেকার। ৪৭ শতাংশ স্নাতক বেকার। ২০১৬-১৭ সালের শ্রমজরিপ মতে, ১৪ লাখ মানুষ স্থানীয় শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছে, বিপরীতে ১৩ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা ও প্রার্থীদের দক্ষতার অভাব নিয়েও বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা নেই।

দারিদ্র্য কমার হার কমছে


অসমতা বাড়ছে হু হু করে। ২০১৬ সালে বৈষম্য পরিমাপকারী জিনি সূচক শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০১০ সালে শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশ ছিল। ২০১৬ সালে সবচেয়ে দরিদ্র ১০ শতাংশ মানুষের আয়ের অংশীদারত্ব ২০১০ সালের তুলনায় কমে ১ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ হয়েছে। ২০১০ সালে ২ শতাংশ ছিল। ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে প্রতিবছর দারিদ্র্য কমার হার ছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যবর্তী সময়কালে এ হার কমে ১ দশমিক ২ শতাংশে নেমেছে। দারিদ্র্য কমার হার কমছে, দরিদ্র আরও দরিদ্র হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ১৪৫টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চলমান থাকলেও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাভুক্ত লোকের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ। এ খাতে আর্থিক বরাদ্দ নেপাল ও ভুটান থেকেও কম।

উৎপাদনশীল খাতের পরিমাণ বাড়ছে না ও বহুমুখীকরণ হচ্ছে না। এক খাতকেন্দ্রিক নির্ভরতা অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। তৈরি পোশাকশিল্পের বাইরে নতুন কোনো নির্ভরযোগ্য উৎপাদনশীল খাত তৈরি হচ্ছে না। গত ছয় বছরে শিল্পকারখানার সংখ্যাও বাড়েনি, কমেছে ৬০৮টি। ২০১২ সালে বড় শিল্পকারখানা ছিল ৩ হাজার ৬৩৯টি, ২০১৯ সালে সংখ্যা কমে ৩ হাজার ৩১টি হয়েছে। মাঝারি শিল্পকারখানা ৬ হাজার ১০৩টি থেকে কমে ৩ হাজার ১৪টি হয়েছে। ক্ষুদ্র শিল্পকারখানার সংখ্যাও কমেছে। শিল্প খাতে বর্তমানে ১ লাখ ২৯ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। ২০-২২ লাখ চাকরিপ্রার্থী তরুণ-তরুণীর তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। মৌলিক সমস্যাগুলোর এরূপ প্রকটতার মুখ্য কারণ হলো প্রতিষ্ঠানগুলোর ভঙ্গুরতা, বিনিয়োগে আস্থাহীনতা ও পুঁজি পাচার।

বাংলাদেশের বাজেট–ব্যবস্থায় জবাবদিহির চর্চা নেই। বাজেট ঘোষিত হওয়ার পর আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংশোধিত হয়। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী সংশোধিত বাজেট সংসদে উপস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় আলোচনা ছাড়াই আইনে পরিণত হয়। কেন সংশোধনের প্রয়োজন হলো বা কেনই–বা বাস্তবায়িত হলো না, কোনো তর্কাতর্কি হয় না। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, কণ্ঠভোটে বাজেট পাস করা ছাড়া সাংসদদের কোনো প্রকৃত ক্ষমতাও নেই। বাজেট–ব্যবস্থার আমূল সংস্কার আশু প্রয়োজনীয়।

  • ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ও উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন। 
 কার্টসি —  প্রথম আলো/জুন ১৩, ২০১৯। 

Monday, July 1, 2019

জনগণকে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে হবে — মির্জা আলমগীর



হাসান মোল্লা/যায়যায়দিন 


বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, স্বৈরশাসন হঠিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণকে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে হবে। শোষণ, বৈষম্য ও দীর্ঘ মেয়াদের অবিচার, অপশাসনের কবল থেকে আর পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না মনে করে স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিলে কোনোদিনই পরিস্থিতির পরিবর্তন আসবে না। এজন্য প্রথমে জনগণকে স্বপ্ন দেখাতে হবে, আর বিএনপি দ্রুত সময়ের মধ্যেই সেই স্বপ্ন পূরণে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।

উত্তরার বাসবভনে যায়যায়দিনকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে মির্জা আলমগীর এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বিএনপি ও দেশের আগামী দিনের রাজনীতির নানা পরিকল্পনা ও সম্ভাবনা নিয়ে তিনি খোলামেলা আলোচনা করেন। রাজনৈতিক দল যতই চেষ্টা করুক অপশাসনের বিরুদ্ধে জনগণ যতক্ষণ মাঠে না আসবে ততক্ষণ কোনো পরিবর্তনই সম্ভব নয় বলেই মত দেন তিনি।

মির্জা ফখরুল বলেন, গত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগে বাংলার মানুষ সুখী সমৃদ্ধশালী সুশাসনের বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু অনিয়মের নির্বাচনের কারণে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এজন্য মানুষ চরম হতাশ। সেই হতাশা থেকে জনগণকে উজ্জীবিত করা বিএনপির প্রথম কাজ।

সাক্ষাৎকারের শুরুতেই কেমন আছেন জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল শারীরিকভাবে ভালো আছেন জানিয়ে বলেন, তবে অন্যায়ভাবে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়াকে বন্দি রাখা এবং বর্তমান সরকারের আমলে প্রতিটি ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ অধিকার বঞ্চিত হওয়ার কারণে মন ভালো নেই।

প্রশ্ন: দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার এক দশকের দাবি স্বল্পসময়ে কেন পরিবর্তন হয়েছিল? কেন নির্বাচনে গেলেন?

উত্তর: নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপির কাছে আর কোনো অপশন ছিল না। সেনাবাহিনী, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগসহ প্রশাসনের প্রতিটি সেক্টর সরকার নিয়ন্ত্রণ করেছে। চরম অনিয়মের আশঙ্কা দেখেও দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। কারণ সরকার কথা বলার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। সেখানে সংসদ কথা বলার একটা জায়গা হতে পারে। সেই ন্যূনতম সুযোগটা ব্যবহার করার জন্য বিএনপি নির্বাচনে গেছে।

প্রশ্ন: আপনাদের দাবি অনুযায়ী নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হয়েছিল। তাদের ভূমিকায় আপনারা সন্তুষ্ট ছিলেন?

উত্তর : একদম সন্তুষ্ট হতে পারিনি। খুবই হতাশ হয়েছি। তারা অনিয়ম দেখেও নির্বাক পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের কাছে অনিয়মের অভিযোগ করেও কোনো ফল পাইনি।

প্রশ্ন: নির্বাচনের আগে পুলিশ অফিসারদের অনিয়মের অভিযোগ করে তালিকা দেয়াটা কি বিএনপির সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল?

উত্তর :এটা এখনই বলা যাবে না। সময় বলে দেবে সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কিনা।

প্রশ্ন:নির্বাচনের পরই ফল প্রত্যাখ্যান করে শপথ না নেয়া এবং পরবর্তী সব ধরনের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েও পরে কেন তা পরিবর্তন করলেন?

উত্তর: সব কিছু দলীয় কৌশলের অংশ। ফল প্রত্যাখ্যানের বিষয় থেকে আমরা এখনো সরে আসিনি। যে নির্বাচনে ভোটারা ভোট দিতে পারেনি সেই নির্বাচনে ফল প্রত্যাখ্যান করাই স্বাভাবিক।

প্রশ্ন: নির্বাচিতরা সবাই শপথ নিলেন অথচ দলীয় সিদ্ধান্তের পরেও কেন আপনি শপথ নিলেন না ?

উত্তর: এটা অবশ্যই কৌশলগত কারণে। এই নির্বাচন দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণ মেনে নেয়নি। সংসদে বিএনপি যাক জনগণ তা চায়নি। কিন্তু কথা বলার নূ্যনতম স্থানের সুযোগ নিতে জনগণের স্বার্থে বিএনপি সংসদে গেছে। অন্যদিকে জনগণের আবেগকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তাই সংসদে যাওয়ার পক্ষে যেমন যুক্তি আছে তেমনি প্রতিবাদেরও দরকার আছে বলে মনে করেছেন। এজন্য শপথ নেননি। তাতে সংসদে গিয়ে বিএনপির কথা বলার সুযোগ রইলো। পাশাপাশি তার প্রতিবাদকেও নেতাকর্মী এবং জনগণ স্বাগত জানিয়েছেন। এসবের কোনো কিছুই দল ও হাইকমান্ডের সম্মতি ছাড়া হয়নি।

প্রশ্ন: শপথ নেয়া বিএনপির এমপিদের সংসদে এখন পর্যন্ত ভূমিকায় আপনি সন্তুষ্ট কিনা?

উত্তর:এখন পর্যন্ত তারা ভালো করছেন। তারা তাদের ভূমিকা পালনের চেষ্টা করছেন। সামনে যত আইন আসবে, কালাকানুন আসবে সেগুলোর বিষয়েও তারা জনগণের পক্ষে কথা বলবেন।

প্রশ্ন: বারবার নির্বাচনে অনিয়মের কথা বলছেন, অনিয়ম ঠেকাতে আপনাদের প্রস্তুতি ও কৌশল কি ছিল? কেন আপনারা ব্যর্থ হলেন?

উত্তর: নির্বাচনে প্রস্তুতি প্রধান বিষয় হচ্ছে জনগণের ভোট পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা। সেই প্রস্তুতি তাদের শতভাগ ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ভোটারদের ভোট কেন্দ্রেই আসতে দেয়া হয়নি। আর বিএনপি সশস্ত্র বিপস্নবী দল না যে, সন্ত্রাসী কায়দায় এর জবাব দেবে। তাই বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে তা বলা যাবে না।

প্রশ্ন: দশম সংসদে অংশ না নেয়া এবং একাদশ সংসদে অংশ নেয়ার দুটি সিদ্ধান্তই কী সঠিক ছিল?

উত্তর: দুটি সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। এ বিষয়টি প্রমাণ করতে একাদশ সংসদে অংশ নেয়েছেন। আর গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। এজন্য নির্দলীয় সরকারের অধীনে পরবর্তী নির্বাচন এটা জনগণের গণদাবিতে পরিণত হয়েছে।

প্রশ্ন: নির্বাচনে ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেছেন বলে আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিমের এ বক্তব্যে প্রতিক্রিয়া কি?

উত্তর: একটি মিথ্যা কথা কিভাবে কখন বললে জনগণ সত্য বলে মেনে নেবে এ কৌশল জানেন আওয়ামী লীগে কয়েকজন নেতা। সব ধরনের রাজনৈতিক কৌশল জানেন তারা। সেসব নেতাদের একজন মোহম্মদ নাসিম। যেহেতু ঐক্যফ্রন্টে অস্থিরতা চলছে একটি গুজব রাজনৈতিক মহলের আলোচনা হচ্ছে সেই সুযোগে নাসিম সাহেব এমন একটা বক্তব্য দিয়েছেন, যাতে সবাই বিশ্বাস করে।

প্রশ্ন: আসলে কামাল সাহেবের নির্বাচনে কি ভূমিকা ছিল?

উত্তর: গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে ড. কামাল হোসেনের ভূমিকা ছিল শতভাগ ইতিবাচক। ড. কামালের মতো ভদ্র, দেশপ্রেমিক, সৎ-সাহসী রাজনীতিবিদ খুব একটা পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের রাজনীতি গুণগত পরিবর্তন আনতে ড. কামালকে বিএনপি সামনের দিকে আনার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিএনপির রঙটা সবসময় জামায়াতের সঙ্গে লাগানোর চেষ্টা হয়েছে। সেই ষড়যন্ত্র রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে। সবমিলে বিএনপির সঙ্গে ড. কামাল, আ স ম বর, কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্নাদের আনতে পারাটা রাজনীতির জন্য টার্নিং পয়েন্ট হতে পারত। দেশ ও রাজনীতির স্বার্থে এটাকে সবার প্রশংসা করা উচিত।

প্রশ্নঃ ঐক্যফ্রন্টের ভবিষ্যৎ কি?

উত্তর : ভবিষ্যৎ ভালো মনে করি। শুধু ঐক্যফ্রন্ট নয় ২০ দলকে আরও সম্প্রসারিত করতে হবে। রাজনীতিতে সুস্থধারা আনতে হলে আওয়ামী লীগের অপশাসনের বিরুদ্ধে সমস্ত রাজনৈতিক দলকে এক সঙ্গে সোচ্চার হতে হবে।

প্রশ্ন: জামায়াত থাকবে জানলে ড. কামালরা আপনাদের সঙ্গে নির্বাচনে আসতেন না। এ ব্যাপারে বিএনপি প্রতারণা করেছে বলে তার অভিযোগ কতটা সত্য?

উত্তর: জামায়াতের সঙ্গে ড. কামাল রাজনীতি করতে চাননি এটা সত্য। রাজনীতির বৃহত্তর স্বার্থে তারা আলাদা জোট করেছেন। বিএনপি সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেছে। এটা অভিনব কৌশল ছিল। প্রতারণা করার কোনো কারণ নেই।

প্রশ্নঃ আগামী দিনের বিএনপির সাংগঠনিক ও আন্দোলনের পরিকল্পনা কি?



উত্তরঃ রাজপথের কঠোর আন্দোলনের পরিস্থিতি বা সুযোগ কোনোটাই এখন নেই। সংগঠন গোছানো হচ্ছে। ভুল বোঝাবুঝির অবসান এবং নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে অঙ্গ সংগঠনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা এখন প্রধান কাজ। পার্টির চেয়ারপারসন কারাগারে আছেন, এখন সেটাই দলের সবচেয়ে বড় সংকট। তিনি যতক্ষণ না বের হবেন ততদিন আন্দোলন গতি পাবে না। এজন্য তাকে কিভাবে বের করে আনা যায় সেজন্য চেষ্টা হচ্ছে। মানুষকে রাস্তায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ঠান্ডা মাথায় সামনের দিকে এগুতে হবে। তা না করা গেলে ফলপ্রসূ কিছু আসবে না।

প্রশ্ন: কবে নাগাদ এটা হতে পারে?

উত্তর:তা বলা মুশকিল। অবশ্যই রোডম্যাপ তৈরি করা হবে। এজন্য আগে দেখতে হবে তাদের সংগঠন আছে কিনা। পরিস্থিতি অনুকূল কি-না। কারণ বিএনপির ২৬ লাখ নেতাকর্মী আসামি। ১ লাখ মামলা। ১ হাজারের উপরে নেতাকর্মী জেলে আছেন। এই পরিস্থিতিতে হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত নিলে চলবে না। অনেকে '৯০ এর আন্দোলনের কথা বলেন। কিন্তু ১৯৯০ আর ২০১৯ এক না এটা মাথায় রাখতে হবে। '৯০ সালে এমন ভয়াবহ সরকার ছিল না। চরম নির্যাতনকারী সরকার ছিল না। তখন নির্বিচারে গুম, খুন, গুলি হতো না।

প্রশ্ন: ৬ষ্ঠ কাউন্সিলের অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ কি?

উত্তর: বিএনপি একটি বড় দল। সব সিদ্ধান্ত পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে হয়তো বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক দলের সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে- এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। এটা খুব বড় বিষয় নয়।

প্রশ্ন: কবে সপ্তম কাউন্সিল করত চান?



উত্তর :দ্রুত সময়ের মধ্যে দলের জাতীয় কউন্সিল করতে চায় বিএনপি। তবে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ ঠিক হয়নি। কাউন্সিলের আগে মূল কাজ হচ্ছে জেলা কমিটিগুলো আপডেট করা। এগুলো প্রায় শেষের দিকে। পুরোপুরি সম্পন্ন হলেই কাউন্সিল করা যাবে। এগুলো শেষ হলে কাউন্সিলের প্রস্তুতি এক মাসের মধ্যে সম্পন্ন করা যাবে।

প্রশ্ন: দল ৩০০ আসনে যাদের মনোনয়ন দিয়েছে তাদের অনেককেই সাংগঠনিক বা আন্দোলনে কর্মীরা পাচ্ছে না, এর কারণ কি?

উত্তর: এই অভিযোগ সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। অনেকেই আছেন দলের জন্য কাজ করছেন। গুটিকয়েক নেতার দায় সবার উপরে চাপানো ঠিক হবে না। যারা নির্বাচন করেন তাদের একটি দায়িত্ব থাকে নেতাকর্মীদের খোঁজ নেয়ার। সেই দায়িত্ব অনেকেই পালন করছেন। কিন্ত মামলা-মোকাদ্দমা এত বেশি হয়ে গেছে যে, সব চালিয়ে তারাও হিমশিম খাচ্ছেন। সবার প্রত্যাশা পূরণ করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য কিছু মান অভিমান থাকতেই পারে।

প্রশ্ন: বিগত সময়ে এমন আলোচনা ছিল আপনি খালেদা জিয়ার আর তারেক রহমানের আস্থাভাজন রুহুল কবির রিজভী। কিন্তু এখন বিভিন্ন কার্যক্রমে আপনাকে তারেক রহমানের সবচেয়ে আস্থাভাজন মনে করা হয়। আসল বিষয়টা ব্যাখ্যা করবেন কি?



উত্তর: মহাসচিব হিসেবে আমাকে দলের আস্থাভাজন হতেই হবে। দলীয় হাইকমান্ডের পাশাপাশি নেতাকর্মীদের আমার প্রতি আস্থা আছে বলেই আমি মহাসচিব। উনি হাইকমান্ডের আস্থাভাজন আর তিনি হাইকমান্ডের বিরাগভাজন এসব মিডিয়ার সৃষ্টি। এর সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই।

প্রশ্ন: রুহুল কবির রিজভীর দীর্ঘসময় দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান করা নিয়ে অনেকে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। আসলে কেন তিনি সেখানে আছেন?

উত্তর: রিজভী কিন্তু সেখানে আনন্দে নেই। অসুস্থ শরীর নিয়ে ছোট একটা রুমের মধ্যে থাকছেন। তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে। অন্যদিকে বিএনপি অফিসে সার্বক্ষণিক লোক দরকার। তাই দলের স্বার্থে দলীয় সিদ্ধান্তেই তিনি সেখানে আছেন।

প্রশ্ন: ১৯৭১ আর ২০১৯ এর জামায়াত এক নয়, বলার পাশাপাশি আলাদা মঞ্চ করেছেন কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ। এ বিষয়ে আপনার মত কি?

উত্তর: অলি সাহেব উনার ব্যক্তিগত অভিমত দিয়েছেন। নিজেরা কিছু করতে চাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি তো ২০ দল ছেড়ে যাননি। একমাত্র পার্থ বিৃবতি দিয়ে ২০ দল ছাড়ার কথা বলেছেন। অন্য কেউ বলেননি। তাই যারা আছেন তাদের একটি দল আছে। গণতান্ত্রিক যেকোনো উদ্যোগ যে কেউ নিতে পারেন তাতে সমস্যার কিছু দেখছি না।

প্রশ্ন: জামায়াত নিয়ে বিএনপির ভাবনা কি?

উত্তর: এর উত্তরে বরাবরের মতোই বলতে হয়, জামায়াত আর বিএনপির রাজনীতি আলাদা। নির্বাচনী ও জোট রাজনীতির অংশ হিসেবে তারা ২০ দলে আছে। এর বেশি কিছু নয়।

প্রশ্ন: দীর্ঘদিন ক্ষমতায় না থাকায় দলের কর্মকান্ডে আগের মতো শুভাকাঙ্ক্ষীরা পৃষ্ঠপোষকতা করছেন না বা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, এ তথ্যটি কি সঠিক? দলের ফান্ড ক্রাইসিস আছে কি?

উত্তর: এটা অস্বাভাবিক নয়। এদেশের রাজনৈতিক যে সংস্কৃতি তাতে এই পরিস্থিতিতে পৃষ্ঠপোষকের সংখ্যা কমবে তা স্বাভাবিক। তবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন এটা ভুল কথা। দলীয় ফান্ডেরও কোনো ক্রাইসিস নেই। লেকশোর-ওয়েস্টিনসহ বড় বড় সব স্থানেই বিএনপির অনুষ্ঠান হয়। ফান্ডে কোনো ক্রাইসিস কি কারো চোখে পড়ে? আর অর্থের জন্য দলের কোনো কর্মকান্ডও থেমে নেই।

প্রশ্নঃ খালেদা জিয়ার বয়স এখন প্রায় ৭৪। বর্তমান সরকার পূর্ণ মেয়াদে থাকলে খালেদা জিয়ার বয়স হবে ৭৮। বয়স ও শারীরিক অবস্থার বিবেচনায় খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আরও কতটা অবদান রাখতে পারবেন বলে আপনি মনে করেন?


উত্তর: ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথের বয়স ৯৩। তিনি এই বয়সেও দায়িত্ব পালন করছেন। দায়িত্বে থাকার সময় মার্গারেট থ্যাচার বয়স কত ছিল বা আঙ্গেলা মার্কেলের বয়সও একেবারে কম নয়। এছাড়া দেশনেত্রীর কাছাকাছি বয়সের আরও রাজনৈতিক নেত্রী আছেন এবং ছিলেন যারা রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড করে গেছেন এবং যাচ্ছেন। বেগম জিয়া শারীরিক অবস্থা বর্তমানে কিছুটা খারাপ হলেও পরবর্তীতে রাষ্ট্র পরিচালনা বা রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেয়ার সক্ষমতা তার আছে। বয়সের কারণে কোনো সমস্যা হবে না।

প্রশ্ন: শপথসহ বিভিন্ন ইসু্যতে সরকারের সঙ্গে খালেদার মুক্তি নিয়ে সমঝোতার গুঞ্জন কতটা সত্য?

উত্তর: কোনো ভিত্তি নেই।

প্রশ্ন: গঠনতন্ত্রের ৭ ধারা বাতিল কি সঠিক সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ছিল?

উত্তর: অবশ্যই। কাউন্সিলেই তা বাতিল করা হয়েছে।

প্রশ্ন: আন্দোলন ছাড়া সরকার পতনের আর কোনো উপায় আছে কিনা?

উত্তর: আন্দোলন লাগবে। নির্বাচনের মাধ্যমে তারা বর্তমান সরকারকে সরাতে চান। সে রকম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনও হবে না যদি আন্দোলন না হয়। মনে রাখতে হবে, তারা মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি করছেন না। তারা বলেছেন অবিলম্বে নির্বাচন দিতে। খুব শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে অবিলম্বে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানানো হবে।

 কার্টসি —  http://bit.ly/2XE6ISm 


Friday, May 31, 2019

পরিবর্তনের জন্য চাই চিন্তাশক্তির পরিবর্তন


শায়রুল কবির খান 

পুঁজিবাদী সভ্যতার নিয়ম অনুসারে পুষ্ট হতে থাকা শহরগুলোর নিষ্ঠুর, নির্দয় আক্রমণে গ্রামগুলোর অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে ধসে পড়েছে। কুটিরশিল্পের ভিত্তি ধ্বংস হয়ে গেছে। একটা ভেঙে পড়া ঘরের তলায় দম আটকানো মানুষের অবস্থা যেমন, বর্তমান অর্থনীতিতে কৃষকদের অবস্থাও ঠিক সে রকম। পক্ষান্তরে কৃষকদের যে অংশ শহরে এসে রিকশা চালায়, কলকারখানায় মজুরি করে, অফিসের পিয়ন-দারোয়ান অথবা ছোটখাটো কাজের ব্যবস্থা করে, তারা নিজেদের স্ব-গ্রামের আত্মীয়-স্বজনের চেয়ে মনে মনে ভাগ্যবান মনে করে। বেঁচে থাকার জন্য তারা শহরের ধনিক-শ্রেণির কাছ থেকে ছিটেফোঁটা যা পায়, প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই অল্প। তবু তা তুলনামূলকভাবে কৃষকদের চেয়ে অনেক বেশি। বর্তমান বাংলাদেশের শ্রেণিগুলোর বিন্যাস বিচার করে দেখলে কোন শ্রেণিটি সবচেয়ে বেশি লাঞ্ছিত-বঞ্চিত, তা বিচার করে দেখার জন্য কষ্ট করে গবেষণা প্রয়োজন হবে না।

এখন কথা হলো—গণতন্ত্রহীনতার মধ্যে যেখানে শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, সেখানে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় যে শ্রেণিটি বঞ্চিত ও নির্যাতিত, সেই সমাজের বাস্তব অবস্থার পরিবর্তন সাধনেই তো একটি সমাজের প্রধান লক্ষ্য।

আমি মনে করি শ্রমিক শ্রেণি পূর্ণভাবে বিকশিত না হওয়া পর্যন্ত, সামাজিক বিপ্লব সম্ভব নয়। আগে শিল্পায়িত হবে, শ্রমিক শ্রেণির সংখ্যা বাড়বে, তারা সত্যিকার সর্বহারায় পরিণত হবে, গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করার সুযোগ আসবে, তারপর সামাজিক পরিবর্তনের সংগ্রাম শুরু হবে, এটা একটা কষ্ট কল্পনা।

ধরে নিলাম আগামী কয়েক বছরেও কোনও রকমের কার্যকর শিল্পায়ন হলো না, রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্র চলমান থাকলো, তাহলে পরিবর্তনের মেয়াদ আরও বাড়িয়ে দিতে হবে, এভাবে সুযোগের আশায় থেকে থেকে একশ’ বছর কাটিয়ে দেওয়া যাবে, কোনও দিন সংগঠিতভাবে পরিবর্তন সম্ভব হবে না। কারণ, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সাম্রাজ্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী এবং উপনিবেশবাদী শক্তিগুলোর লেজুড়ে পরিণত হচ্ছে।

এরকম পরিস্থিতিতে যখন কৃষকদের মধ্যে তীব্র অভাববোধ তৈরি হবে, শ্রমিকদের মধ্যে শ্রমের ন্যায্যতার চেতনা জাগ্রত হবে, নালিশ থাকবে, তার বিরুদ্ধে লড়াই করবার স্পৃহা থাকবে এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করবে এখানে একটি বিশেষ শ্রেণি নেতৃত্ব দিতে পারে কিন্তু সমাজের অধিকাংশ মানুষ না চাইলে কিছুতেই সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে না।

আগামী দিনের বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সংগঠনটি শ্রেণিসংগ্রাম ভিত্তিতে একটা সামাজিক গুণগত পরিবর্তন সাধনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করবে, তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হবে বর্তমান সমাজ কাঠামোতে প্রকৃত বঞ্চিত এবং লাঞ্ছিত করা, কোন শ্রেণিটি সবচেয়ে বেশি সর্বহারা, সে বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে উপলব্ধি করা। যদি কৃষকশ্রেণি হয়ে থাকে তাহলে এই কৃষকশ্রেণিকে দিয়েই সামাজিক পরিবর্তনের কর্মসূচি রচনা করতে হবে, তাতে করে রাজনীতির চরিত্রের গুণ এবং কৌশলের আমূল পরিবর্তন দরকার হবে। এযাবৎকাল রাজনৈতিক আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী ছিল যে শ্রেণিটি, তাকে স্বজ্ঞানে এবং সচেতনতায় ধীরে ধীরে সমন্বয় করে নতুন কেন্দ্রিক সহায়ক শ্রেণিগোষ্ঠীর ওপর অর্পণ করতে হবে। এই শ্রেণিগোষ্ঠীর মধ্যে প্রকৃত সর্বহারা কারা, কাদের জন্য সামাজিক পরিবর্তন প্রয়োজন, কারা সমাজের এই পালাবদলে লাভবান হবে, তাদের বুঝিয়ে একটি গুণগত পরিবর্তনে বিশ্বাসী করে তুলতে হবে। গতানুগতিক রাজনীতিতে আছে দাম্ভিকতা, মিথ্যাচার, শঠতা এবং পোশাকী প্রচার। এ ধারার রাজনীতি দিয়ে গুণগত পরিবর্তন আনা যাবে না।

আজকের বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদের চেতনায় বিশ্বাসীদের কাছে শহীদ জিয়ার রাজনীতির প্রজ্ঞার প্রয়োজন সর্বাধিক। বর্তমানে ফ্যাসিবাদী মনোভঙ্গির স্থলে মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্য চিন্তা গ্রহণ করতে হবে।

উপসংহারে বলতে চাই, বাংলাদেশের কৃষকদের দুর্দশার আজ আর অন্ত নেই। তারা ঘরহারা, জমিহারা, সংস্থানহারা রুটি-রুজির কঠিন পরিস্থিতিতে। তারা এ অবস্থার নিশ্চয়ই পরিবর্তন চায়। কৃষকদের জীবনমান অবস্থার পরিবর্তন না হলে গোটা সমাজের পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না। এই কৃষকদের আকাঙ্ক্ষা ত্বরান্বিত করার জন্য সে অনুসারে প্রয়োজনীয় সকল কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংসদ