ড. আর এম দেবনাথ |
এটা কি অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নয়? এটা কি একতরফা সিদ্ধান্ত নয়? এ সিদ্ধান্তের দুটো ফল। প্রথমত, ৫ শতাংশের স্থলে সাধারণ সঞ্চয়কারীদের কাছ থেকে উৎসে অগ্রিম আয়কর কেটে নেয়া হবে ১০ শতাংশ হারে। এখানে সঞ্চয়কারীদের স্বার্থহানি হচ্ছে। তাদের আয় হ্রাস পাচ্ছে।দ্বিতীয়ত, বকেয়া সুদের ওপরও ১০ শতাংশ হারে কর কেটে নেয়া রীতিমতো জবরদস্তি। সঞ্চয় অধিদপ্তর আমার মনে হয় এক্ষেত্রে ‘ওভারস্টেপিং’ করছে। সিদ্ধান্তটি সঠিক হয়ে থাকলে তা পুনর্বিবেচনাযোগ্য।
আরো কথা আছে। এসব দুঃখের কথা। ধরা যাক একজনের ১০ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র আছে। তাহলে তার বার্ষিক সুদ আয় হবে ১ লাখ ৯ হাজার ৪৪০ টাকা। ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটা হলে তার পরিমাণ হবে ১০ হাজার ৯৪৪ টাকা। যদি ওই ব্যক্তির আরো ২ লাখ টাকা অন্যান্য সূত্রে আয় হয়, তাহলে তার মোট আয় হবে ৩ লাখ ৯ হাজার ৪৪০ টাকা। যেহেতু উৎসে কর কাটা চূড়ান্ত দায় হিসেবে বিবেচিত, তাই ব্যক্তির কোনো আয়করই হবে না। কিন্তু ‘ফাইল’ জমা দিলেই সর্বনিম্ন কর দিতে হবে। দেখা যাবে পাওনা করের চেয়ে আয়কর কাটা হয়েছে অনেক বেশি। এ টাকা আইনত ফেরতযোগ্য। কিন্তু সবাই জানে সরকারের কাছ থেকে টাকা ফেরত পাওয়া কতটা ঝামেলাপূর্ণ। মুশকিল হলো, এ সমস্যাটা হবে প্রতি বছর। সম্ভবত এ সমস্যার কথা বিবেচনা করেই তিন বছর আগে ১০ শতাংশের স্থলে করহার কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। কিন্তু বিধি বাম, নতুন অর্থমন্ত্রী এসেই পুরনো অর্থমন্ত্রীর বিধানটি তুলে দিলেন। এতে অবিচার বাড়ল কিনা তা বিবেচনার বিষয়। আরো মুশকিল আছে। এক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত সঞ্চয়কারী করদাতার আয় কমল। বিপরীতে তাকে কোনো কর রেয়াত দেয়া হলো না। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা সাধারণত করদাতাদের পক্ষে কথা বলেন না। তারা তাদের নিজেদের দাবি নিয়েই বাজেটের আগে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু এবার তারা বাজার সৃষ্টির কথা বিবেচনা করে করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধির কথা বলেন। সাধারণ করদাতারা এ দাবি করেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে তুলনা করে বিশেষজ্ঞরাও একই কথা বলেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী কারো কথা শুনলেন না। চার বছর আগের আয়করমুক্ত সীমাই রেখে দিলেন। অথচ চার বছরের প্রতি বছর মূল্যস্ফীতি হয়েছে কম করে হলেও ৫ শতাংশ হারে।
সরকারি কর্মচারীসহ বিভিন্ন অধিদপ্তরের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সুযোগ দ্বিগুণ করা হয়েছে। কিন্তু লাখ লাখ বেসরকারি করদাতার বেতন-ভাতা বাড়েনি। এ সত্ত্বেও করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হলো না। অধিকন্তু বাজারে দেখা যাচ্ছে সবকিছুর মূল্যে ঊর্ধ্বগতি। বাজেটের কারণে তেল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, চিনি থেকে শুরু করে বিরাটসংখ্যক দ্রব্যসামগ্রী ও সেবার মূল্য বেড়েছে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা আরেকটি এল বছরের প্রথম দিনেই।
২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম দিনেই বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম। সর্বোচ্চ হারে হয়েছে এই বৃদ্ধিটি। গড়ে প্রায় ৩৩ শতাংশ। গৃহস্থালি ব্যবহারের জন্যও দাম বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত হারে। এর ফল কী হবে তা নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। শিল্প উৎপাদনের খরচ বাড়বে, পরিবহন খরচ বাড়বে, বাড়িভাড়া বাড়বে। বড় কথা, গ্যাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হচ্ছে বিদ্যুৎ। এর দাম যেকোনো দিন বাড়বে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। অথচ যে যুক্তির বলে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে, তা কোনো যুক্তিই নয়। হিসাবে দেখা যাচ্ছে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে যে টাকা আদায় করা হবে, প্রায় সেই পরিমাণের টাকা ‘সিস্টেম লস’ দূর করে সাশ্রয় করা যায়। দেখা যাচ্ছে চুরি-দুর্নীতির বোঝাও সাধারণ মানুষকে বহন করতে হবে।
এভাবে দেখলে বোঝা যাবে একদিকে মানুষের আয় কমছে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ছিল ঊর্ধ্বমুখী। শুধু আয় কমের বিষয় নয়, লোকের চাকরিও যাচ্ছে। দৈনিক কাগজের খবর, ‘পাঠাও’ নামের রাইডশেয়ারিং কোম্পানি তার ৫০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করেছে। তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস এবং পুঁজির স্বল্পতাই নাকি ছাঁটাইয়ের কারণ। যেখানে পারছে সেখানেই মালিকরা রোবট বসাচ্ছেন। তৈরি পোশাক শিল্পে এর ব্যাপকতা বেশি। কয়েকদিন আগে দেখলাম একটা বিখ্যাত আসবাব কোম্পানিতেও রোবট বসেছে। বেসরকারি খাতে চাকরিচ্যুতি এখন যখন তখন। মধ্যবয়সে সন্তান-সন্ততিসহ লোকজন রাস্তায় পড়ছে। দুদিন আগে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম। একজন পুরনো কর্মী বললেন, প্রতিদিন সকালবেলা ওপরওয়ালার নাম নিয়ে অফিসে ঢুকি। রাত্রিবেলা আতঙ্কে থাকি। পরদিন সকালে আবার তা করি। হে ওপরওয়ালা, আমার চাকরিটা যাতে থাকে। এসব তো মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত কর্মী-কর্মচারীদের কথা, সাধারণ মানুষের দুঃখ আরো বেশি। গত সপ্তাহে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে দেখা। জিজ্ঞেস করেই বুঝলাম, দেশে কোনো কাজ নেই।
এখন বর্ষাকাল। করিমগঞ্জ, ইটনা, মিঠামইন, সুনামগঞ্জ ইত্যাদি এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এখন জল আর জল। এ অবস্থায় কাজ তারা কোথায় পাবেন। নীলফামারীর ‘কিশোরগঞ্জ’ এলাকার এক রিকশাওয়ালা বললেন তার দুঃখের কথা। তাদের রোজগার এখন কম। যানজটের কারণে ‘খেপ’ তাদের অনেক কম। একটা যাত্রাতেই এক-দেড় ঘণ্টা লেগে যায়। অথচ ‘মেসের’ খরচ বৃদ্ধির দিকে। বাজার খরচও বেশি। এসব নিয়ে দেশের বড় একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসাব করে দেখিয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে গড়ে মানুষের মাসিক প্রকৃত আয় ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। তাহলে সরকারি হিসাবে গড় আয় বাড়ছে কীভাবে? সেটাও সত্য! কারণ ওই হিসাবে ধনী-দরিদ্র সবারই হিসাব আছে। ওই হিসাবে গরিব, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের আয়ের প্রতিফলন হয় না। এ বাস্তবতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরটাই শুরু হয়েছে উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠার মধ্যে। সামনে পবিত্র ঈদ। ওই উপলক্ষে যে আরেক দফা মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কী?
- ড. আর এম দেবনাথ: সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- কার্টসিঃ বণিকবার্তা/ জুলাই ১১, ২০১৯
No comments:
Post a Comment