সোহরাব হাসান
প্রথম আলো/১৩ জুলাই ২০১৯
গত ৩০ জুন ঢাকার লালবাগ সরকারি মডেল স্কুল ও কলেজে ভোটার তালিকা হালনাগাদ প্রশিক্ষণের উদ্বোধনকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, ‘নির্বাচনে শতভাগ ভোট পড়া স্বাভাবিক নয়। তবে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের করণীয় কিছু নেই। ভোটের পরই প্রিসাইডিং কর্মকর্তা কেন্দ্রভিত্তিক সব নিষ্পত্তি করেন। একীভূত ফল রিটার্নিং কর্মকর্তা আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। তখন ওই বিষয়ে আমাদের কিছু জানায়নি; তাই এখন ইসির কিছু করার নাই।’ (ইত্তেফাক, ১ জুলাই ২০১৯)
জাতীয় নির্বাচনের ছয় মাস পর নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে কেন্দ্রভিত্তিক যে পূর্ণাঙ্গ ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যায় ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। এটি কোনো বিশেষ আসনের হিসাব নয়। দেশের ৩০০ আসনের মধ্যে ১০৩টি আসনে এ অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে। সিইসিও স্বীকার করেছেন, শতভাগ ভোট পড়া স্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর কোনো দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এ রকম ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয় না। ঘটা সম্ভব নয়। কেননা ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন হয় না। নির্বাচন হয় কয়েক মাস পর।এ সময়ের মধ্যে কেউ মারা যেতে পারেন, কেউ অসুস্থ থাকতে পারেন, কেউ এলাকার বাইরে বা বিদেশে যেতে পারেন। এঁরা কীভাবে ভোট দিলেন?
সে ক্ষেত্রে শতভাগ ভোট পড়া শুধু অস্বাভাবিক নয়, অবাস্তবও। নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম অবশ্য একটি অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছেন। বলেছেন, উল্লিখিত কেন্দ্রগুলোয় শতভাগ ভোট পড়েছে, এ কথা বলা যাবে না। কেননা ওসব কেন্দ্রে কিছু ভোট বাতিলও হয়েছে। তিনি বলতে চাইছেন, ‘আগে যেকোনো উপায়ে ভোটের বাক্স শতভাগ ব্যালট ভরে ফেলো। এরপর তাঁরা পরখ করে দেখবেন, কোনটি আসল আর কোনটি নকল।’
কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণ করে আরও অনেক বিস্ময়কর তথ্য পাওয়া গেছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ১২৭টি ভোটকেন্দ্রে, ৯৮ শতাংশ ভোট পড়েছে ২০৪টি ভোটকেন্দ্রে, ৯৭ শতাংশ ভোট পড়েছে ৩৫৮ ভোটকেন্দ্রে এবং ৯৬ শতাংশ ভোট পড়েছে ৫১৬ ভোটকেন্দ্রে। অর্থাৎ ৯৬-১০০ শতাংশ ভোট পড়েছে ১ হাজার ৪১৮টি কেন্দ্রে। অন্যদিকে ৪০-৪৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ৫৯৯টি ভোটকেন্দ্রে, ২০-৩৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ৩০১টি ভোটকেন্দ্রে, ১০-১৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ২০টি ভোটকেন্দ্রে এবং ১০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে ১১টি ভোটকেন্দ্রে। ভোট পড়ার এই বিপরীত হারও বিশ্বাসযোগ্য নয়।
নির্বাচন কমিশন একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করবে, কেন্দ্রে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের এজেন্ট থাকবেন, যাঁরা ভোটারকে চিহ্নিত করবেন, তিনি আসল ভোটার কি না। ভোট গ্রহণ শেষে প্রার্থীর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতেই নির্বাচনী কর্মকর্তারা ভোট গণনা করবেন এবং প্রার্থীদের প্রতিনিধির সইসহ ফল রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠাবেন। এরপর রিটার্নিং কর্মকর্তা সব কেন্দ্রের ফল সমন্বয় করে নির্বাচন কমিশনে পাঠাবেন। এটাই নির্বাচনের স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অধিকাংশ কেন্দ্রে এই নিয়ম মানা হয়নি। কেন্দ্রে বিরোধী দলের প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের যেতে দেওয়া হয়নি। সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকেরা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে যে চিত্র দেখেছেন, ঘোষিত ফলের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। ছবি মিথ্যা বলে না।
নির্বাচনের পর ৩০০ আসনের মধ্যে ৫০টি আসনে জরিপ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৪৭ আসনে কোনো না কোনো অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছে তারা। অনিয়মের ধরনের মধ্যে আছে ৪১টি আসনে জাল ভোট; ৪২টি আসনে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকা; ৩৩টি আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল; ২১টি আসনে আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা; ৩০টি আসনে বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মেরে জাল ভোট; ২৬টি আসনে ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা; ২০টিতে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা; ২২টিতে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া; ২৯টিতে প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেওয়া ইত্যাদি।
সিইসি বলেছেন, রিটার্নিং কর্মকর্তারা যেহেতু কেন্দ্রগুলোর ফল একীভূত করে নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দিয়েছেন এবং গেজেট হয়ে গেছে, সেহেতু তাঁদের আর কিছু করার নেই। তাহলে প্রশ্ন আসে, ইসির দায়িত্ব কি শুধু রিটার্নিং কর্মকর্তার পাঠানো কাগজটিতে সিল মারা? সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভোটারদের প্রতি তাদের কোনো কর্তব্য নেই? নির্বাচন কমিশনের কাজ হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা, যাতে প্রতিটি ভোটার নির্বিঘ্নে ও নির্ভয়ে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেন। ইসির পদাধিকারীরা সেটি পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। ২০০০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ নির্বাচনী বিরোধসংক্রান্ত এক মামলায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান, বিচারপতি বিবি রায় চৌধুরী, বিচারপতি এ এম এম রহমান এবং বিচারপতি কাজী এবাদুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ নির্বাচন কমিশনকে ‘ফেয়ার, জাস্টলি ও অনেস্টলি’ দায়িত্ব পালন করার কথা বলেছিলেন। এখন সিইসি তাঁর বিবেককে (যদি থেকে থাকে) জিজ্ঞেস করুন তিনি ফেয়ার, জাস্টলি ও অনেস্টলি সেই দায়িত্ব পালন করেছেন কি না?
এবারের জাতীয় নির্বাচনে যে অগণিত অসংগতি ও অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল, তার কিছু কিছু নির্বাচনের পর প্রথম আলোসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এখন পুরোটা জানা গেল কেন্দ্রভিত্তিক ফল প্রকাশের পর। আইন অনুযায়ী নির্বাচনের পরপরই কেন্দ্রভিত্তিক ফল ইসির ওয়েবসাইটে দেওয়ার কথা থাকলেও তারা সেটি তারা দেয়নি। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল চেয়ে গত ৭ মার্চ প্রথম ইসিকে চিঠি দেয়। সাড়া না পেয়ে ৩০ মে ও ১১ জুন আরও দুটি চিঠি দেয়। এরপরও প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার গত ১৩ জুন তথ্য অধিকার আইনের আওতায় তথ্যের জন্য আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ জুন ইসি ৩০০টি সংসদীয় নির্বাচনী এলাকার কেন্দ্রভিত্তিক ও একীভূত নির্বাচনী ফলাফল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে।
কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো এবারের নির্বাচন ব্যালট পেপারে হওয়ায় ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়া দেখাতে পারলেও ইভিএম পরিচালিত ৬টি আসনের কোনো কেন্দ্রে সেটি ঘটেনি। ইভিএমে ভোট পড়ার গড় ৫১ দশমিক ৪২ শতাংশ। আর ব্যালট পেপারে ভোট হওয়া আসনের গড় ভোট ৮০ দশমিক ৮০ শতাংশ। ভোটের পার্থক্য ২৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন, তার আগে ও পরের সব নির্বাচনে ইসি অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে ৫৭৬টি কেন্দ্রে নৌকার প্রার্থীর বাইরে কেউ একটি ভোটও পাননি। ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি যত নগণ্যই হোক না কেন, ঘোষিত ফলাফলে দেখা যায় বিপুল সংখ্যায় ভোট পড়েছে। মহাবিশ্বে একমাত্র পৃথিবীতে মানুষ আছে বলে প্রমাণিত। অন্য গ্রহেও মানবসদৃশ কোনো প্রাণী বা এলিয়েন থাকতে পারে। হুদা কমিশনের দৌলতে ভোটের দিন ওই এলিয়েনরা এসেই ভোট দিয়ে গেছে। না হলে শতভাগ ভোট পড়ল কীভাবে?
যখন নির্বাচন কমিশনের কেন্দ্রভিত্তিক ফল বিশ্লেষণ করছিলাম তখনই সাবেক মন্ত্রী, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাংসদ রাশেদ খান মেননের একটি মন্তব্য চোখে পড়ল। গত বৃহস্পতিবার সংসদে আলোচনাকালে তিনি বলেছেন, ‘সাংসদেরা হচ্ছেন বকাউল্লাহ, তাঁরা বকে যান, ক্ষমতাসীনেরা শোনাউল্লাহ, শুনে যান। আর সংসদ হচ্ছে গরিবউল্লাহ।’ তিনি আরও বলেছেন, গ্যাসের দাম নিয়ে আলোচনা না হলে এই সংসদ আরও গরিব হয়ে যাবে। আমাদের অর্থনৈতিক সূচক যত বাড়ছে, রাজনৈতিক সূচক তত নিচে নামছে।
এর আগে রাশেদ খান মেনন বরিশালে দলের সভায় বলেছেন, রাজনীতি আর রাজনীতিকদের হাতে নেই। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির আরও কয়েকজন নেতা রাজনীতি রাজনীতিকদের হাতে নেই বলে হতাশা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তাঁদের মনে রাখা উচিত রাজনীতি তখনই রাজনীতিকদের হাতে থাকে, যখন জনগণ ভোট দেওয়ার সুযোগ পান। মেনন ও মইন উদ্দীন খান বাদলেরা সরকারকে শোনাউল্লাহ, সংসদকে গরিবউল্লাহ এবং নিজেদের বকাউল্লাহ বলে উল্লেখ করেছেন। সংসদ কখন গরিব হয়? যখন সেই সংসদে জনগণের পক্ষে কথা বলা যায় না। এ অবস্থা চলতে থাকলে তাঁরা সরকারের নীতি পরিবর্তন দূরের কথা, নিজের বকাউল্লাহর ভূমিকাটিও রাখতে পারবেন না।
অতএব রাজনীতিকে রাজনীতিকদের হাতে ফিরিয়ে আনতে হলে সবার অাগে জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। তবে সেই কাজটি হুদা কমিশন করতে পারবে—এ কথা কেউ বিশ্বাস করে না।
- সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
- লিঙ্ক - shorturl.at/kqIW1
No comments:
Post a Comment