অরুন রহমান
“আমরা ভাবতেই পারিনি ওর ডেঙ্গু। কারণ কোন লক্ষণই ছিল না। শুক্রবার দুপুরে ডেঙ্গু ধরা পড়ল। শনিবার সকালেই মারা গেল আমার ছোট্ট মুসা।”
— সানজীদা আলম আঁখি, ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ৩৪ দিনের শিশু মুসা মাহমুদের মা। Sarabangla.net, সোমবার, জুলাই ২৩, ২০১৯।
বিশ্বে জ্ঞানবিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য অগ্রগতি সত্ত্বেও মানবজাতিকে প্রতিনিয়তই আনপ্রেডিক্টেবল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হতে হচ্ছে। পূর্বাভাস ছাড়াই চলে আসে ভয়াবহ বিপদ, ঘটছে প্রাণহানি ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। তাই রাস্ট্রকে সর্বদা সবধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আগাম তৈরি থাকতে হয়। তবেই সেই রাস্ট্র সফল।
আজ থেকে ১৯ বছর পূর্বে ২০০০ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গুজ্বর সেই ধরনের সর্বনাশা বিপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়। দুঃখজনক হলো, সরকার ও সিটি কর্তৃপক্ষ এই রোগের ভাইরাসবাহী এডিসমশা নিধন করতে উদাসীনতার প্রমাণ রেখে চলেছে। ২০১৭ পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার মানুষ এতে আক্রান্ত হয়। আর মারা যায় ২৬৫ জন। গত বছরও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে ১০ হাজার ১৪৮ জন, যার মধ্যে মারা গেছে ২৬ জন।
জুলাই ২৪, ২০১৯, ভয়েস অব আমেরিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই বছর ইতোমধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৪ লাখ মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত। একাধিক সূত্র ৩০ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। চারজন চিকিৎসকও এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
এই রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি যেমন আছে, তেমনি এর চিকিৎসা খরচও ব্যয়বহুল।
প্রকৃতচিত্রে, এবার ঢাকা শহরের পাড়ায় পাড়ায় শিশু, নারী, বৃদ্ধ নির্বিশেষে মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। জুলাই ২৫, প্রথম আলোর হেডলাইন হচ্ছে, ডেঙ্গু রোগী নিয়ে হাসপাতালে হিমশিম অবস্থা। এই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, হাসপাতালের ওয়ার্ডের বিছানা, মেঝে ও বারান্দায় রোগী, তাও জায়গা হচ্ছে না। কি ভয়াবহ পরিস্থিতি, ডেঙ্গু রোগী নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে স্বজনেরা ছুটছেন, কিন্তু বারান্দায়ও জায়গা পাচ্ছেন না! ডাক্তার ও নার্সের অভাব। প্রথম আলোর এই রিপোর্টেই বলা আছে, নার্সেরা আদৌ ডেঙ্গুর চিকিৎসা সেবা সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন না। মরার উপর খাড়ার ঘা এর মত, ডেঙ্গু টেস্টের নামে অনেক টেস্ট দেয়া হচ্ছে যা প্রতিদিন করাতে বলা হচ্ছে। ডেঙ্গু চিকিৎসার জাতীয় কোন গাইডলাইনও করা হয়নি। ব্যয়বহুল টেস্টের খরচ কমানোর কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
অথচ, সরকার ও সিটি কর্পোরেশন এডিস মশা নির্মূলে চরম উদাসীনতা ও ব্যর্থতা দেখিয়ে চলেছে। আগাম কোন পরিকল্পনা এবং কার্যকর কর্মসূচী নেয়া হয়নি। ফলে কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েই চলেছে। ঢাকার মেয়রেরা স্বীকার করেছেন, মশা নিধনের ওষুধ কাজ করছে না। জনগুরুত্ব বিবেচনায় উচ্চ আদালতও মশা নিধন করতে বলেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পক্ষ থেকে জরিপে পাওয়া যায়, মে মাসের শুরুতে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ৯৭টি ওয়ার্ডের ১০০টি স্থানে এই মশার লার্ভার ব্যাপক অস্তিত্ব। অথচ কর্তৃপক্ষ মশা নিধন করেনি।
‘লোকদেখানো মশকনিধন’ শিরোনামে প্রথম আলোতে জুলাই ২৪, ২০১৯, এক রিপোর্টে দেখানো হয়েছে মশা নিধন কর্মসূচী চলছে নামে মাত্র এবং তা অকার্যকর। আর তাই ডেঙ্গু এবার আরো ভয়াবহতা নিয়ে ব্যাপক আকারে ঢাকাতে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায়ও এই জ্বরটি হচ্ছে এখন ।
এই বছর, ডেঙ্গু আক্রান্তদের অনেকের প্রথম দিকে রোগটির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, জ্বর শেষ হওয়ার পর দ্রুত শারিরীক বিপর্যয় দেখা দেয়। চিকিৎসকেরাও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। ব্রেনের প্রদাহ হয়, রোগীর খিঁচুনি হয়, রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়, রোগীর নার্ভে ইনফেকশন হয়ে প্যারালাইসিস (গুলেন বারি, স্কুইন্ট) হয়, হার্টে মায়োকার্ডিটিস হয়। সে ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থাকে। লিভারে প্রদাহের সঙ্গে অগ্ন্যাশয় ও পিত্তথলির (পাথর না থাকলেও) প্রদাহ হয়। কিডনি ফেইলুর হয়। রক্ত বমি, কালো পায়খানা, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যায়। চামড়ার নিচে রক্ত জমে। প্রস্রাব কমে যায়, লিভার বড় হয়, লিভারের এনজাইম অনেক বাড়ে। বুকে, পেটে পানি জমে, ফুসফুসে পানি জমে শ্বাসকষ্ট হয়। প্রেসার খুব নেমে যাওয়ার কারণে রোগী আবলতাবল বকে রেস্টলেস হয়। একই কারণে অর্গান বা মাল্টি অর্গান ফেইল করে।
ঢাকা শহরের খোলা জলাশয়, খাল, নদীপাড়, রেলপথ, সড়কপথ, নির্মাণাধীণ সড়ক, ড্রেন, ঝোপঝাড়, ডাস্টবিন, রাস্তাঘাট, অলিগলি সর্বদা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব। এই ছাড়া, নির্মাণাধীন ভবনের আশেপাশে জমানো পানি, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, প্লাস্টিক বালতি, পানির চৌবাচ্চা ও ফুলের টব, এসির পানিতে এডিস মশার প্রজনন বা বংশবিস্তার হয়ে থাকে। নাগরিকদের সচেতন করে তাঁদেরকে জড়িত করে কর্মসূচী নিতে সিটি কর্তৃপক্ষকে নেতৃত্ব দেয়ার কথা।
কিন্তু, পরিতাপের বিষয় ১০ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ভোট ডাকাতি করে পুলিশি শক্তি দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে। এই দীর্ঘ সময় ধরে তারা জনকল্যাণে যে কোন কাজ করছে না, তার প্রমাণ চার লাখ নাগরিকের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া। সরকার এবং তার বিনাভোটের দলীয় মেয়রেরা যদি নাগরিকদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকত, তাহলে এডিস মশা নির্মূলের মত সাধারণ একটি কাজ তারা করতে পারতেন। ভোট ছাড়া যেহেতু ক্ষমতায় থাকা যায়, মেয়র হওয়া যায়, তাই তারা আসলে জনসেবায় উদাসীন, আর ব্যস্ত থাকছেন ব্যাঙ্ক ডাকাতি, শেয়ারবাজার ডাকাতিতে। নাগরিকদের থেকে চুষে নেয়া হচ্ছে ভ্যাট ও ট্যাক্সের নামে তাঁদের কষ্টার্জিত অর্থ। বিনিময়ে, মশার কামড় থেকেও বাঁচতে পারছে না তারা।
মেয়রেরা আপনাদের এসব ব্যর্থতার দায় আর কতদিন এড়াবেন? উচ্চমূল্যে ঔষুধ কিনছেন, তাতে মশা মরছে না। আগে থেকেই জানতেন এডিশ মশার বিস্তার বাড়ছে ফি বছর, কিন্তু মশা মারছেন না। লোক দেখানো, ঔষধ ছিটানো, লিফলেট বিতরণ, মিডিয়ায় কথা আর এসএমএস বার্তা কিন্তু নগরবাসীকে রেহাই দিচ্ছে না। ভয়াবহ ডেঙ্গুতে মরছে মানুষ, ভুগছে সবাই। ঢাকা এখন ডেঙ্গু আতঙ্কে কাঁপছে।
— লেখক, ইন্টারনেট এক্টিভিস্ট ও সংগঠক ' অর্গানাইজিং ফর বেস্ট বাংলাদেশ'।
No comments:
Post a Comment