ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর, দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল (অব.) জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ২৬ অক্টোবর সকাল ৯টা ৫ মিনিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখার জন্য টিচার্স স্টুডেন্ট সেন্টার মিলনায়তনে (টিএসসি) আগমন করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে শিক্ষকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখার জন্য ক্যাম্পাসে আগমন করবেন, এ সংবাদ জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ফজলুল হালিম চৌধুরী শিক্ষকমণ্ডলীকে টিএসসিতে উপস্থিত থাকার জন্য একটি সার্কুলারের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রিত শিক্ষকদের মধ্যে আমিও সেদিন সময়মতো টিএসসিতে উপস্থিত হয়ে পেছন দিকের সারিতে আসন গ্রহণ করি।
কর্মকর্তাদের ব্যস্ততা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বুঝতে পারি যে, মাননীয় চ্যান্সেলর টিএসসিতে সময় মতোই এসে পৌঁছেছেন। সামরিক ব্যক্তি হিসেবে জিয়াউর রহমান সময়ের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন কিন্তু মিলনায়তনে প্রবেশে তার বিলম্ব হচ্ছিল। বিলম্বের কারণ পরে জানতে পেরেছি। চ্যান্সেলর ও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনে গাড়ি থেকে নেমেই পশ্চিমদিকে রোকেয়া হলের সামনে কিছুসংখ্যক ছাত্রীকে এবং রাস্তার উত্তর পাশে তৎকালীন পাবলিক লাইব্রেরির (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি) পাশে কিছুসংখ্যক ছাত্রকে কালো পতাকা হাতে বিক্ষোভ করতে দেখেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেন, তিনি বিক্ষোভরত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন ও কথা বলবেন। এ কথা জানতে পেরে উপাচার্য ফজলুল হালিম চৌধুরী বিচলিত হন এবং বিক্ষোভরত ছাত্রছাত্রীদের কাছে না যাওয়ার জন্য চ্যান্সেলরকে অনুরোধ করেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়া তার অনুরোধকে উপেক্ষা করে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের সঙ্গে না নিয়ে শুধু ভিসি ফজলুল হালিম চৌধুরী, ঢাকা সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত এবং প্রেসিডেন্টের পিএসওকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে রোকেয়া হলের সামনে বিক্ষোভরত ছাত্রীদের কাছে এবং পরে রাস্তার উত্তর পাশে অবস্থানরত ছাত্রদের কাছে যান। প্রেসিডেন্টের এহেন অপ্রত্যাশিত আচরণে তারা হতচকিত হয়ে যায়। কেন কালো পতাকা দেখানো হচ্ছে, কি তাদের বক্তব্য; তা জানতে চাইলে ছাত্রীরা তেমন কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি এবং কোনো অশোভন আচরণ করেনি। কিন্তু ছাত্রদের কাছে প্রেসিডেন্ট জিয়া কিছুটা প্রতিরোধ ও অশোভন আচরণের সম্মুখীন হন। ছাত্রদের মধ্য থেকে প্রথমে তাকে ধুলাবালি নিক্ষেপ এবং পরিবর্তীতে ধাক্কা দেওয়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটে বলে জানতে পারি। ছাত্ররা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এবং জিয়াউর রহমানকে ফিরে যাওয়ার দাবিতে তার সামনেই স্লোগান দেয় এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। প্রেসিডেন্ট জিয়া শান্তভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন এবং বিক্ষোভকারী ছাত্রছাত্রীদের তার সঙ্গে টিএসসিতে নিয়ে আসেন। টিএসসির উপরের ব্যালকনিতে ছাত্রছাত্রীদের জন্য ত্বরিত ব্যবস্থায় জায়গা করে দেওয়া হয়। টিএসসির অভ্যন্তরে অবস্থানরত শিক্ষকরা বিস্মিত হন ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি দেখে। চ্যান্সেলর শিক্ষকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখার কথা, সেখানে ছাত্রদের উপস্থিতি তো কাম্য নয়। আমরা তখন পর্যন্ত টিএসসির বাইরে কি ঘটেছে তা অবহিত ছিলাম না বলে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতির কারণ বুঝতে পারিনি।
মঞ্চে দুটি চেয়ার শোভা পাচ্ছিল। একটি প্রেসিডেন্ট ও চ্যান্সেলরের জন্য এবং অপরটি উপাচার্যের জন্য। মহামান্য প্রেসিডেন্ট ও চ্যান্সেলর মঞ্চে উপবিষ্ট হওয়ার পর যথারীতি জাতীয় সংগীত ও কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে মতবিনিময়ের ওই সভা শুরু হয়। উপাচার্য অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী স্বাগত ভাষণ শেষ করে চ্যান্সেলর ও প্রেসিডেন্টকে বক্তব্য রাখার আমন্ত্রণ জানান। প্রেসিডেন্ট জিয়া মঞ্চের টেবিলে তার সামনে স্থাপিত মাইক্রোফোনে উপাচার্যকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকে বক্তব্য রাখার আহ্বান জানাতে নির্দেশ দেন। তিনি অনেকক্ষণ থাকবেন, তাই শিক্ষকদের বক্তব্য তিনি শুনতে চান। প্রেসিডেন্ট জিয়ার এই আহ্বানে উপাচার্য সমস্যায় পড়ে যান। চ্যান্সেলর হিসেবে যেহেতু শিক্ষকদের উদ্দেশে শুধু প্রেসিডেন্ট জিয়ার বক্তব্য রাখার কথা, তাই সঙ্গত কারণেই সভায় বক্তব্য রাখার জন্য কোনো শিক্ষকের নামের তালিকা আগে থেকে প্রস্তুত ছিল না। সে কারণে উপাচার্য মঞ্চের সামনে এসে সম্মুখ সারিতে উপবিষ্ট প্রবীণ শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির তৎকালীন সভাপতি মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক বি. করিমকে আমন্ত্রণ জানান।
অপ্রস্তুত অবস্থায় প্রফেসর বি. করিম প্রায় ১০ মিনিট বক্তব্য রেখে শেষ করার মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট জিয়া প্রফেসর বি. করিম সাহেবকে আরও স্পষ্ট বক্তব্য, আরও কিছু সময় নিয়ে বলার আহ্বান জানান। প্রফেসর বি. করিম সাহেবের অনুরোধে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রেজিস্ট্রার বদরুদ্দিন আহম্মদ মঞ্চের দক্ষিণ পাশ থেকে এক গ্লাস পানি বক্তৃতা স্ট্যান্ডে নিয়ে এলে, সারা মিলনায়তনে একটু হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াকেও মৃদু হাসতে দেখা যায়। আমাদের অজান্তে সৃষ্ট টিএসসির বাইরের বিব্রতকর পরিস্থিতির পর এ ধরনের একটু হাস্যরস পরিবেশকে হালকা করতে সাহায্য করে বলে পরবর্তীতে আমার কাছে মনে হয়েছে। প্রফেসর বি. করিম আরও পাঁচ মিনিটের মতো বক্তব্য রেখে তার বক্তব্য শেষ করেন। এই পর্যায়ে মাইক্রোফোনে পুনরায় প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ ভেসে আসে। তিনি উপাচার্যের উদ্দেশে বলেন, প্রবীণ শিক্ষকরা বোধহয় সব কথা স্পষ্টভাবে বলতে চান না। তাই অপেক্ষাকৃত তরুণ শিক্ষকদের মধ্য থেকে বক্তব্য রাখার জন্য আহ্বান করুন। উপাচার্য পুনরায় দর্শক সারির সামনের কাতারের সিনিয়র প্রফেসরদের সঙ্গে পরামর্শ করে মাইকে গিয়ে বক্তব্য রাখার জন্য আমার নাম ঘোষণা করেন। প্রথমে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। দ্বিতীয় ঘোষণায় ভূতত্ত্ব বিভাগের নাম উল্লেখ করে ঘোষণা দেওয়ায় সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় মিলনায়তনের পেছনের দিক থেকে মঞ্চে ছুটে গেলাম। প্রেসিডেন্ট জিয়া আমাকে নির্ভয়ে বক্তব্য রাখার অভয় দিলেন।
অপেক্ষাকৃত তরুণ শিক্ষকদের মধ্যে আমার ডাক পড়ল কেন, তার একটু ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে তখন দুটি গ্রুপের অস্তিত্ব ছিল। শিক্ষকদের মধ্যে বিভিন্ন নির্বাচনের সময় শিক্ষকরা দুই ভাগে দুই রংয়ের কাগজে প্যানেল ছাপিয়ে নির্বাচন করতেন। একটি ছিল 'নীল দল' (আওয়ামী সমর্থিত) এবং অপরটি ছিল 'গোলাপি দল' (আওয়ামীবিরোধী)। বর্তমানে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীদের দল 'সাদা দল' নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি দলের অস্তিত্ব বিদ্যমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিতে তখন নির্বাচিত ছিল প্রফেসর বি. করিমের নেতৃত্বে 'নীল দল'। সেই সময় 'গোলাপি দল'-এর আহ্বায়ক ছিলেন প্রফেসর আহম্মদ শরীফ এবং আমি ছিলাম সদস্য সচিব। শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে 'নীল দল'-এর প্রতিনিধির বক্তব্য হওয়ার পর ভারসাম্যতা রক্ষার জন্য 'গোলাপি দল'-এর পক্ষে বক্তব্যের পালা। প্রেসিডেন্টের বক্তব্য প্রদানের আহ্বানে স্বাভাবিকভাবেই আমার নাম আসে। উল্লেখ্য, আমি তখন ভূতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মধ্যে ভালো বক্তা হিসেবেও আমার পরিচিতি ছিল।
আমি ওই সভায় সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যা ও দেশের বিরাজমান অবস্থার ওপর খোলাখুলি বক্তব্য উপস্থাপন করলাম। প্রায় ১৫ মিনিট বক্তব্য রাখার পর আমার বক্তব্য শেষ করতে যাচ্ছিলাম, তখন প্রেসিডেন্ট জিয়ার গম্ভীর কণ্ঠ মাইক্রোফোনে ভেসে এলো। শেষ করবেন না, আরও বলুন। আপনি স্পষ্টভাবে বলছেন, আরও বলুন। প্রেসিডেন্টের এ আহ্বানে আবার ১৫ মিনিটের মতো বক্তব্য রাখার পর শেষ করতে চাইলে, পুনরায় প্রেসিডেন্ট একই নির্দেশ প্রদান করেন। আমি তিন ধাপে প্রায় ৪৫ মিনিট বক্তব্য রেখে বক্তব্য শেষ করি। মঞ্চ ত্যাগ করার প্রাক্কালে প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ আবার ভেসে এলো। যাবেন না, আপনি বহু জরুরি বিষয় উত্থাপন করেছেন, সমস্যার সমাধানে সুপারিশ করেছেন। কিন্তু এখনো আপনার উত্থাপিত অনেক প্রশ্নের জবাব মেলেনি। আপনার কাছে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। আপনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকমণ্ডলী দেশ ও জাতি সম্পর্কে অনেক ভাবেন। আপনার উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর আপনাকেই দিতে হবে।
আমার প্রায় ৪৫ মিনিটের বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাজমান পরিস্থিতি, ছাত্ররাজনীতির অবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে গোলাগুলির ঘটনা ও তার সম্ভাব্য সমাধানের প্রস্তাবনা, শিক্ষক-ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্নমুখী সমস্যা, ডাকসু নির্বাচনসহ দেশের চলমান সামরিক শাসন প্রত্যাহার, আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষাব্যবস্থা এবং তার সমাধানের সম্ভাব্য প্রস্তাব উপস্থাপন করি। আমার বক্তব্যের বিষয়বস্তু, ব্যাখ্যা ও মন্তব্যের মধ্যে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সন্তুষ্ট হওয়ার মতো কোনো উপাদান ছিল না। আমার স্পষ্ট ও সাহসী বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট জিয়া অসন্তুষ্ট না হয়ে বরং প্রশংসা করেন।
আমার তিন দফায় বক্তৃতার পর শুরু হয় প্রশ্নোত্তরের পালা। প্রেসিডেন্ট জিয়া আমাকে প্রশ্ন করেন শিক্ষাদানের শ্রেষ্ঠ এই বিদ্যাপীঠে অস্ত্রের উপস্থিতি কেন? আমি এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন রাখি। যে অস্ত্র সশস্ত্র বাহিনীর জন্য বিদেশ থেকে আমদানি হয় অথবা গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে প্রস্তুত হয়, সেসব অস্ত্র সশস্ত্র বাহিনীর চার দেয়াল অতিক্রম করে কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে তার জবাব দেবেন দেশের মহামান্য প্রেসিডেন্ট, দেশের সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাপ্রধান, না কি আমার মতো একজন নিরীহ শিক্ষক? প্রেসিডেন্ট জিয়া এ ধরনের জবাব হয়তো প্রত্যাশা করেননি বা পছন্দ করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মধ্যে কেন গোলাগুলির ঘটনা ঘটে প্রেসিডেন্টের এ প্রশ্নের জবাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসুসহ বিভিন্ন হলের নির্বাচন ১৯৭৩-এর পর থেকে না হওয়ার কারণে গণতন্ত্রের চর্চার অভাবে ছাত্রদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের প্রক্রিয়া হিসেবে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। এ প্রসঙ্গে আমি ডাকসু ও বিভিন্ন হলের ছাত্র সংসদ নির্বাচনসহ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনঃ চালু করার দাবি উত্থাপন করি। উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সময়কালে ছাত্রলীগ ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রলীগের সমর্থকদের মধ্যে প্রতিনিয়তই সংঘর্ষ ও অস্ত্রের মহড়া চলত।
দেশ থেকে চলমান সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবিতে তখন সারা দেশের জনগণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা সোচ্চার ছিল। আমি এই সর্বজনীন দাবিটি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে প্রেসিডেন্টের সামনে উপস্থাপন করি। আমি নির্ভয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে উদ্দেশ করে এ কথাও বলি যে, আপনি যখন জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, তখন কি ধারণা করেছিলেন, এ স্বাধীন দেশে পুনরায় পাকিস্তানের মতো সামরিক আইন জারি হবে? দেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সামনে সামরিক আইনের এ ধরনের কঠোর সমালোচনা কেউ প্রত্যাশা করেননি। হয়তো দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও চ্যান্সেলর জিয়া একজন তরুণ শিক্ষকের মুখ থেকে এ ধরনের সাহসী উচ্চারণ আশা করেননি। এ ধরনের আরও অনেক বিষয়ে প্রাসঙ্গিক অথচ অপ্রিয় কথা সেদিন প্রেসিডেন্ট জিয়ার সামনে বলেছিলাম। প্রশ্নোত্তর চলেছিল প্রায় আধা ঘণ্টার মতো। আমার বক্তব্য ও প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হওয়ার পর সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আবুল কালাম আজাদ এবং সাংবাদিকতা বিভাগের তৌহিদুল আনোয়ার আমার বক্তব্যের সমর্থনে মিলনায়তনের ফ্লোর থেকেই কিছু বক্তব্য রাখেন। এ পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট জিয়া মন্তব্য করেন যে, এরই মধ্যে সব বলা হয়ে গেছে। আর কারও বক্তব্য রাখার প্রয়োজন নেই।
বক্তব্য শেষ করে নিজের আসনে বসে প্রেসিডেন্ট জিয়ার বক্তব্য শোনার জন্য অপেক্ষা করি। আমার ধারণা ছিল, তিনি আমার বক্তব্য এবং টিএসসির বাইরের ঘটনা নিয়ে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ও রূঢ় বক্তব্য রাখবেন। আমার মতো মিলনায়তনে উপস্থিত সব শিক্ষক ও ভ্যালকনিতে উপস্থিত সব ছাত্রছাত্রী (যারা আমার বক্তৃতার সময় মুহুর্মুহু করতালি দিয়েছিলেন) সবার আশঙ্কা আমার মতোই ছিল। কিন্তু আমাদের সবাইকে বিস্মিত করে প্রেসিডেন্ট জিয়া আমার বক্তব্যের বিভিন্ন ইস্যুতে সমর্থন এবং প্রশংসা করেন। টিএসসির বাইরের ঘটনার কোনো উল্লেখও করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সভায় প্রেসিডেন্ট জিয়া ১৯৭৯-এর প্রথমাংশে সাধারণ নির্বাচন এবং সামরিক আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য দুটি হল, ছাত্রীদের জন্য একটি হল এবং শিক্ষকদের জন্য আবাসিক সুবিধা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ প্রদানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার ঘোষিত বরাদ্দ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরবর্তীতে ছাত্রদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হল এবং ছাত্রীদের জন্য সামসুন্নাহার হল নির্মাণ করা হয়। শিক্ষকদের জন্য সেই বরাদ্দ থেকে উদয়ন স্কুলের দক্ষিণ পাশে ও ফুলার রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়া তার বক্তৃতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের গণতান্ত্রিক চর্চার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আশ্বাস প্রদান করেন। তার প্রতিশ্রুত ডাকসু নির্বাচন কয়েক মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৪৫ মিনিটের বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের কিছু সত্য ঘটনা উল্লেখ করে দেশের জনগণ এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে খাটো করে দেখার অপপ্রয়াসের সমালোচনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের মানুষ যে দেশপ্রেম, সাহসিকতা ও ত্যাগী মনোভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, ঠিক সেই মনোভাব নিয়ে দেশ গড়ার লক্ষ্যে সবাইকে এগিয়ে আসার জন্য দেশবাসীকে তিনি আহ্বান জানান। তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে বলেন, বিশ্ব আগে আমাদের যে চোখে দেখত, এখন আর সে চোখে দেখে না। আজ বিশ্বের মধ্যে আগের চেয়ে আমাদের অনেক বেশি বন্ধু দেশ রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট জিয়া বলেন, আমাদের দেশ আকারে ছোট কিন্তু সমস্যা বিরাট। কোনো বিদেশি নীতি-রীতি ও তন্ত্র আমাদের দেশের সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, দেশকে উন্নত করতে হলে আমাদের যে চারটি বিষয়ে আন্তরিক হতে হবে। তা হলো- ১. জাতীয় চেতনা ২. একতা, ৩. কঠোর পরিশ্রম ও ৪. আত্দবিশ্বাস। তিনি পুরনো চিন্তার বদলে নতুন চিন্তা এনে সমাজ প্রগতিতে সবাইকে নিজ নিজ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান।
প্রেসিডেন্ট জিয়া বক্তব্য শেষে টিএসসি ত্যাগ করার পর প্রায় সব শিক্ষক আমাকে স্পষ্ট সাহসী বক্তব্য রাখার জন্য অভিনন্দন জানানোর সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার এড়ানোর জন্য ক্যাম্পাস ছেড়ে আত্দগোপনে যাওয়ার পরামর্শ দেন। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে অশোভন আচরণকারী ছাত্রদেরও ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য সবাই পরামর্শ দেন। শিক্ষকদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে টিএসসির বাইরে কালো পতাকা প্রদর্শন, অশোভন আচরণ এবং আমার সামরিক শাসনবিরোধী কঠোর বক্তব্যের জন্য আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার। সবাই বলাবলি করছিল, দিবাগত রাতেই ক্যাম্পাস ঘেরাও হবে, আমাকে এবং বিক্ষোভে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের গ্রেফতার করা হবে।
কিন্তু কয়েক দিন কেটে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস রেইড হলো না। আমার বা অশোভন আচরণে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের গ্রেফতার তো দূরের কথা কোনো মামলা হলো না। ২৬ অক্টোবরের পর বেশ কয়েক দিন প্রেসিডেন্ট জিয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন এবং এত বড় ঘটনা ঘটার পর আমার ও ছাত্রদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করার বিষয়টি ক্যাম্পাসে সপ্তাহব্যাপী আলোচনার বিষয়ে (Talk of the Week) পরিণত হয়। সামরিক আইনবিরোধী এবং প্রেসিডেন্ট জিয়ার বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক বক্তব্য প্রদানের জন্য নিশ্চিত খারাপ পরিণতির জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে অশোভন আচরণকারীরাও নিশ্চিত গ্রেফতারের ভয়ে আত্দগোপন করেছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেদিনের সব ঘটনায় যে অপরিসীম ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা নজিরবিহীন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যক্কারজনক ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট জিয়া কোনো ধরনের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে প্রকৃতপক্ষে সেদিনই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীদের মন জয় করে গিয়েছিলেন। তিনি জীবিত থাকাকালীনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শে দীক্ষিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের যাত্রা শুরু হয়। জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবরণের পর ক্রমান্বয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমগ্র বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্র সংগঠন হিসেবে আত্দপ্রকাশ করে। প্রেসিডেন্ট জিয়া ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে যে শিক্ষকদের মন জয় করে গিয়েছিলেন সেই শিক্ষকরা পরিবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শের সংগঠন 'সাদা দলের' প্রতিষ্ঠা করেন। 'সাদা দল' বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষকদের জনপ্রিয় আদর্শ সংগঠনে পরিণত হয়েছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আমাদের মাঝে নেই। ১৯৭৮ সালের ২৬ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট জিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ঘটনায় বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশের সব ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকের মনের মধ্যে স্থায়ী অবস্থান সৃষ্টি করে অমর হয়ে আছেন।
- লেখক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক মন্ত্রী।