Search

Thursday, July 25, 2019

ডেঙ্গুজ্বর — দায় এড়াতে পারবে না সরকার ও মেয়রদ্বয়

অরুন রহমান 




“আমরা ভাবতেই পারিনি ওর ডেঙ্গু। কারণ কোন লক্ষণই ছিল না। শুক্রবার দুপুরে ডেঙ্গু ধরা পড়ল। শনিবার সকালেই মারা গেল আমার ছোট্ট মুসা।”
—  সানজীদা আলম আঁখি, ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ৩৪ দিনের শিশু মুসা মাহমুদের মা।  Sarabangla.net, সোমবার, জুলাই ২৩, ২০১৯।  

বিশ্বে জ্ঞানবিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য অগ্রগতি সত্ত্বেও মানবজাতিকে প্রতিনিয়তই আনপ্রেডিক্টেবল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হতে হচ্ছে। পূর্বাভাস ছাড়াই চলে আসে ভয়াবহ বিপদ, ঘটছে প্রাণহানি ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। তাই রাস্ট্রকে সর্বদা সবধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আগাম তৈরি থাকতে হয়। তবেই সেই রাস্ট্র সফল। 

আজ থেকে ১৯ বছর পূর্বে ২০০০ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গুজ্বর সেই ধরনের সর্বনাশা বিপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়। দুঃখজনক হলো, সরকার ও সিটি কর্তৃপক্ষ এই রোগের ভাইরাসবাহী এডিসমশা নিধন করতে উদাসীনতার প্রমাণ রেখে চলেছে।  ২০১৭ পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার মানুষ এতে আক্রান্ত হয়। আর মারা যায় ২৬৫ জন। গত বছরও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে ১০ হাজার ১৪৮ জন, যার মধ্যে মারা গেছে ২৬ জন। 

জুলাই ২৪, ২০১৯, ভয়েস অব আমেরিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই বছর ইতোমধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৪ লাখ মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত। একাধিক সূত্র ৩০ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। চারজন চিকিৎসকও এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

এই রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি যেমন আছে, তেমনি এর চিকিৎসা খরচও ব্যয়বহুল।

শহরজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ। শিশুর জ্বর কমছে না, শরীরেও প্রচণ্ড ব্যথা। জ্বরাক্রান্ত সন্তান নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকেরা চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভিড় করেছেন। গতকাল বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে শিশু হাসপাতালে। ছবি: জাহিদুল করিম/প্রথম আলো। 


প্রকৃতচিত্রে, এবার ঢাকা শহরের পাড়ায় পাড়ায় শিশু, নারী, বৃদ্ধ নির্বিশেষে মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। জুলাই ২৫, প্রথম আলোর হেডলাইন হচ্ছে, ডেঙ্গু রোগী নিয়ে হাসপাতালে হিমশিম অবস্থা। এই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, হাসপাতালের ওয়ার্ডের বিছানা, মেঝে ও বারান্দায় রোগী, তাও জায়গা হচ্ছে না। কি ভয়াবহ পরিস্থিতি, ডেঙ্গু রোগী নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে স্বজনেরা ছুটছেন, কিন্তু বারান্দায়ও জায়গা পাচ্ছেন না! ডাক্তার ও নার্সের অভাব। প্রথম আলোর এই রিপোর্টেই বলা আছে, নার্সেরা আদৌ ডেঙ্গুর চিকিৎসা সেবা সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন না। মরার উপর খাড়ার ঘা এর মত, ডেঙ্গু টেস্টের নামে অনেক টেস্ট দেয়া হচ্ছে যা প্রতিদিন করাতে বলা হচ্ছে। ডেঙ্গু চিকিৎসার জাতীয় কোন গাইডলাইনও করা হয়নি। ব্যয়বহুল টেস্টের খরচ কমানোর কোন ব্যবস্থা নেয়নি। 

অথচ, সরকার ও সিটি কর্পোরেশন  এডিস মশা নির্মূলে চরম উদাসীনতা ও ব্যর্থতা দেখিয়ে চলেছে। আগাম কোন পরিকল্পনা এবং কার্যকর কর্মসূচী নেয়া হয়নি। ফলে কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েই চলেছে। ঢাকার মেয়রেরা স্বীকার করেছেন, মশা নিধনের ওষুধ কাজ করছে না। জনগুরুত্ব বিবেচনায় উচ্চ আদালতও মশা নিধন করতে বলেছে। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পক্ষ থেকে জরিপে পাওয়া যায়, মে মাসের শুরুতে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ৯৭টি ওয়ার্ডের ১০০টি স্থানে এই মশার লার্ভার ব্যাপক অস্তিত্ব। অথচ কর্তৃপক্ষ মশা নিধন করেনি। 

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। প্রাণহানির সংখ্যাও উদ্বেগজনক। মশার কামড় থেকে বাঁচতে বাসাবাড়ির পাশাপাশি হাসপাতালেও মশারির ব্যবহার হচ্ছে। গতকাল শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
ছবি: সাজিদ হোসেন/ প্রথম আলো। 


‘লোকদেখানো মশকনিধন’ শিরোনামে প্রথম আলোতে জুলাই ২৪, ২০১৯, এক রিপোর্টে দেখানো হয়েছে মশা নিধন কর্মসূচী চলছে নামে মাত্র এবং তা অকার্যকর। আর তাই ডেঙ্গু এবার আরো ভয়াবহতা নিয়ে ব্যাপক আকারে ঢাকাতে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায়ও এই জ্বরটি  হচ্ছে এখন । 

এই বছর, ডেঙ্গু আক্রান্তদের অনেকের প্রথম দিকে রোগটির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, জ্বর শেষ হওয়ার পর দ্রুত শারিরীক বিপর্যয় দেখা দেয়। চিকিৎসকেরাও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারছেন না।  ব্রেনের প্রদাহ হয়, রোগীর খিঁচুনি হয়, রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়, রোগীর নার্ভে ইনফেকশন হয়ে প্যারালাইসিস (গুলেন বারি, স্কুইন্ট) হয়, হার্টে মায়োকার্ডিটিস হয়। সে ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থাকে। লিভারে প্রদাহের সঙ্গে অগ্ন্যাশয় ও পিত্তথলির (পাথর না থাকলেও) প্রদাহ হয়। কিডনি ফেইলুর হয়। রক্ত বমি, কালো পায়খানা, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যায়। চামড়ার নিচে রক্ত জমে। প্রস্রাব কমে যায়, লিভার বড় হয়, লিভারের এনজাইম অনেক বাড়ে। বুকে, পেটে পানি জমে, ফুসফুসে পানি জমে শ্বাসকষ্ট হয়। প্রেসার খুব নেমে যাওয়ার কারণে রোগী আবলতাবল বকে রেস্টলেস হয়। একই কারণে অর্গান বা মাল্টি অর্গান ফেইল করে। 

ঢাকা শহরের খোলা জলাশয়, খাল, নদীপাড়, রেলপথ, সড়কপথ, নির্মাণাধীণ সড়ক, ড্রেন, ঝোপঝাড়, ডাস্টবিন, রাস্তাঘাট, অলিগলি সর্বদা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব। এই ছাড়া,  নির্মাণাধীন ভবনের আশেপাশে জমানো পানি, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, প্লাস্টিক বালতি, পানির চৌবাচ্চা ও ফুলের টব, এসির পানিতে এডিস মশার প্রজনন বা বংশবিস্তার হয়ে থাকে। নাগরিকদের সচেতন করে তাঁদেরকে জড়িত করে কর্মসূচী নিতে সিটি কর্তৃপক্ষকে নেতৃত্ব দেয়ার কথা। 

কিন্তু, পরিতাপের বিষয় ১০ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ভোট ডাকাতি করে পুলিশি শক্তি দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে। এই দীর্ঘ সময় ধরে তারা জনকল্যাণে যে কোন কাজ করছে না, তার প্রমাণ চার লাখ নাগরিকের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া। সরকার এবং তার বিনাভোটের দলীয় মেয়রেরা যদি নাগরিকদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকত, তাহলে এডিস মশা নির্মূলের মত সাধারণ একটি কাজ তারা করতে পারতেন। ভোট ছাড়া যেহেতু ক্ষমতায় থাকা যায়, মেয়র হওয়া যায়, তাই তারা আসলে জনসেবায় উদাসীন, আর ব্যস্ত থাকছেন ব্যাঙ্ক ডাকাতি, শেয়ারবাজার ডাকাতিতে। নাগরিকদের থেকে চুষে নেয়া হচ্ছে ভ্যাট ও ট্যাক্সের নামে তাঁদের কষ্টার্জিত অর্থ। বিনিময়ে, মশার কামড় থেকেও বাঁচতে পারছে না তারা।  

মেয়রেরা আপনাদের এসব ব্যর্থতার দায় আর কতদিন এড়াবেন? উচ্চমূল্যে ঔষুধ কিনছেন, তাতে মশা মরছে না। আগে থেকেই জানতেন এডিশ মশার বিস্তার বাড়ছে ফি বছর, কিন্তু মশা মারছেন না। লোক দেখানো, ঔষধ ছিটানো, লিফলেট বিতরণ, মিডিয়ায় কথা আর এসএমএস বার্তা কিন্তু নগরবাসীকে রেহাই দিচ্ছে না। ভয়াবহ ডেঙ্গুতে মরছে মানুষ, ভুগছে সবাই। ঢাকা এখন ডেঙ্গু আতঙ্কে কাঁপছে।    

— লেখক, ইন্টারনেট এক্টিভিস্ট ও সংগঠক ' অর্গানাইজিং ফর বেস্ট বাংলাদেশ'। 

Saturday, July 20, 2019

শহীদ জিয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জয় — ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর, দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল (অব.) জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ২৬ অক্টোবর সকাল ৯টা ৫ মিনিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখার জন্য টিচার্স স্টুডেন্ট সেন্টার মিলনায়তনে (টিএসসি) আগমন করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে শিক্ষকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখার জন্য ক্যাম্পাসে আগমন করবেন, এ সংবাদ জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ফজলুল হালিম চৌধুরী শিক্ষকমণ্ডলীকে টিএসসিতে উপস্থিত থাকার জন্য একটি সার্কুলারের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রিত শিক্ষকদের মধ্যে আমিও সেদিন সময়মতো টিএসসিতে উপস্থিত হয়ে পেছন দিকের সারিতে আসন গ্রহণ করি।

কর্মকর্তাদের ব্যস্ততা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বুঝতে পারি যে, মাননীয় চ্যান্সেলর টিএসসিতে সময় মতোই এসে পৌঁছেছেন। সামরিক ব্যক্তি হিসেবে জিয়াউর রহমান সময়ের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন কিন্তু মিলনায়তনে প্রবেশে তার বিলম্ব হচ্ছিল। বিলম্বের কারণ পরে জানতে পেরেছি। চ্যান্সেলর ও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনে গাড়ি থেকে নেমেই পশ্চিমদিকে রোকেয়া হলের সামনে কিছুসংখ্যক ছাত্রীকে এবং রাস্তার উত্তর পাশে তৎকালীন পাবলিক লাইব্রেরির (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি) পাশে কিছুসংখ্যক ছাত্রকে কালো পতাকা হাতে বিক্ষোভ করতে দেখেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেন, তিনি বিক্ষোভরত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন ও কথা বলবেন। এ কথা জানতে পেরে উপাচার্য ফজলুল হালিম চৌধুরী বিচলিত হন এবং বিক্ষোভরত ছাত্রছাত্রীদের কাছে না যাওয়ার জন্য চ্যান্সেলরকে অনুরোধ করেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়া তার অনুরোধকে উপেক্ষা করে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের সঙ্গে না নিয়ে শুধু ভিসি ফজলুল হালিম চৌধুরী, ঢাকা সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত এবং প্রেসিডেন্টের পিএসওকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে রোকেয়া হলের সামনে বিক্ষোভরত ছাত্রীদের কাছে এবং পরে রাস্তার উত্তর পাশে অবস্থানরত ছাত্রদের কাছে যান। প্রেসিডেন্টের এহেন অপ্রত্যাশিত আচরণে তারা হতচকিত হয়ে যায়। কেন কালো পতাকা দেখানো হচ্ছে, কি তাদের বক্তব্য; তা জানতে চাইলে ছাত্রীরা তেমন কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি এবং কোনো অশোভন আচরণ করেনি। কিন্তু ছাত্রদের কাছে প্রেসিডেন্ট জিয়া কিছুটা প্রতিরোধ ও অশোভন আচরণের সম্মুখীন হন। ছাত্রদের মধ্য থেকে প্রথমে তাকে ধুলাবালি নিক্ষেপ এবং পরিবর্তীতে ধাক্কা দেওয়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটে বলে জানতে পারি। ছাত্ররা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এবং জিয়াউর রহমানকে ফিরে যাওয়ার দাবিতে তার সামনেই স্লোগান দেয় এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। প্রেসিডেন্ট জিয়া শান্তভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন এবং বিক্ষোভকারী ছাত্রছাত্রীদের তার সঙ্গে টিএসসিতে নিয়ে আসেন। টিএসসির উপরের ব্যালকনিতে ছাত্রছাত্রীদের জন্য ত্বরিত ব্যবস্থায় জায়গা করে দেওয়া হয়। টিএসসির অভ্যন্তরে অবস্থানরত শিক্ষকরা বিস্মিত হন ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি দেখে। চ্যান্সেলর শিক্ষকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখার কথা, সেখানে ছাত্রদের উপস্থিতি তো কাম্য নয়। আমরা তখন পর্যন্ত টিএসসির বাইরে কি ঘটেছে তা অবহিত ছিলাম না বলে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতির কারণ বুঝতে পারিনি।

মঞ্চে দুটি চেয়ার শোভা পাচ্ছিল। একটি প্রেসিডেন্ট ও চ্যান্সেলরের জন্য এবং অপরটি উপাচার্যের জন্য। মহামান্য প্রেসিডেন্ট ও চ্যান্সেলর মঞ্চে উপবিষ্ট হওয়ার পর যথারীতি জাতীয় সংগীত ও কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে মতবিনিময়ের ওই সভা শুরু হয়। উপাচার্য অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী স্বাগত ভাষণ শেষ করে চ্যান্সেলর ও প্রেসিডেন্টকে বক্তব্য রাখার আমন্ত্রণ জানান। প্রেসিডেন্ট জিয়া মঞ্চের টেবিলে তার সামনে স্থাপিত মাইক্রোফোনে উপাচার্যকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকে বক্তব্য রাখার আহ্বান জানাতে নির্দেশ দেন। তিনি অনেকক্ষণ থাকবেন, তাই শিক্ষকদের বক্তব্য তিনি শুনতে চান। প্রেসিডেন্ট জিয়ার এই আহ্বানে উপাচার্য সমস্যায় পড়ে যান। চ্যান্সেলর হিসেবে যেহেতু শিক্ষকদের উদ্দেশে শুধু প্রেসিডেন্ট জিয়ার বক্তব্য রাখার কথা, তাই সঙ্গত কারণেই সভায় বক্তব্য রাখার জন্য কোনো শিক্ষকের নামের তালিকা আগে থেকে প্রস্তুত ছিল না। সে কারণে উপাচার্য মঞ্চের সামনে এসে সম্মুখ সারিতে উপবিষ্ট প্রবীণ শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির তৎকালীন সভাপতি মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক বি. করিমকে আমন্ত্রণ জানান।

অপ্রস্তুত অবস্থায় প্রফেসর বি. করিম প্রায় ১০ মিনিট বক্তব্য রেখে শেষ করার মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট জিয়া প্রফেসর বি. করিম সাহেবকে আরও স্পষ্ট বক্তব্য, আরও কিছু সময় নিয়ে বলার আহ্বান জানান। প্রফেসর বি. করিম সাহেবের অনুরোধে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রেজিস্ট্রার বদরুদ্দিন আহম্মদ মঞ্চের দক্ষিণ পাশ থেকে এক গ্লাস পানি বক্তৃতা স্ট্যান্ডে নিয়ে এলে, সারা মিলনায়তনে একটু হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াকেও মৃদু হাসতে দেখা যায়। আমাদের অজান্তে সৃষ্ট টিএসসির বাইরের বিব্রতকর পরিস্থিতির পর এ ধরনের একটু হাস্যরস পরিবেশকে হালকা করতে সাহায্য করে বলে পরবর্তীতে আমার কাছে মনে হয়েছে। প্রফেসর বি. করিম আরও পাঁচ মিনিটের মতো বক্তব্য রেখে তার বক্তব্য শেষ করেন। এই পর্যায়ে মাইক্রোফোনে পুনরায় প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ ভেসে আসে। তিনি উপাচার্যের উদ্দেশে বলেন, প্রবীণ শিক্ষকরা বোধহয় সব কথা স্পষ্টভাবে বলতে চান না। তাই অপেক্ষাকৃত তরুণ শিক্ষকদের মধ্য থেকে বক্তব্য রাখার জন্য আহ্বান করুন। উপাচার্য পুনরায় দর্শক সারির সামনের কাতারের সিনিয়র প্রফেসরদের সঙ্গে পরামর্শ করে মাইকে গিয়ে বক্তব্য রাখার জন্য আমার নাম ঘোষণা করেন। প্রথমে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। দ্বিতীয় ঘোষণায় ভূতত্ত্ব বিভাগের নাম উল্লেখ করে ঘোষণা দেওয়ায় সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় মিলনায়তনের পেছনের দিক থেকে মঞ্চে ছুটে গেলাম। প্রেসিডেন্ট জিয়া আমাকে নির্ভয়ে বক্তব্য রাখার অভয় দিলেন।

অপেক্ষাকৃত তরুণ শিক্ষকদের মধ্যে আমার ডাক পড়ল কেন, তার একটু ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে তখন দুটি গ্রুপের অস্তিত্ব ছিল। শিক্ষকদের মধ্যে বিভিন্ন নির্বাচনের সময় শিক্ষকরা দুই ভাগে দুই রংয়ের কাগজে প্যানেল ছাপিয়ে নির্বাচন করতেন। একটি ছিল 'নীল দল' (আওয়ামী সমর্থিত) এবং অপরটি ছিল 'গোলাপি দল' (আওয়ামীবিরোধী)। বর্তমানে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীদের দল 'সাদা দল' নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি দলের অস্তিত্ব বিদ্যমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিতে তখন নির্বাচিত ছিল প্রফেসর বি. করিমের নেতৃত্বে 'নীল দল'। সেই সময় 'গোলাপি দল'-এর আহ্বায়ক ছিলেন প্রফেসর আহম্মদ শরীফ এবং আমি ছিলাম সদস্য সচিব। শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে 'নীল দল'-এর প্রতিনিধির বক্তব্য হওয়ার পর ভারসাম্যতা রক্ষার জন্য 'গোলাপি দল'-এর পক্ষে বক্তব্যের পালা। প্রেসিডেন্টের বক্তব্য প্রদানের আহ্বানে স্বাভাবিকভাবেই আমার নাম আসে। উল্লেখ্য, আমি তখন ভূতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মধ্যে ভালো বক্তা হিসেবেও আমার পরিচিতি ছিল।

আমি ওই সভায় সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যা ও দেশের বিরাজমান অবস্থার ওপর খোলাখুলি বক্তব্য উপস্থাপন করলাম। প্রায় ১৫ মিনিট বক্তব্য রাখার পর আমার বক্তব্য শেষ করতে যাচ্ছিলাম, তখন প্রেসিডেন্ট জিয়ার গম্ভীর কণ্ঠ মাইক্রোফোনে ভেসে এলো। শেষ করবেন না, আরও বলুন। আপনি স্পষ্টভাবে বলছেন, আরও বলুন। প্রেসিডেন্টের এ আহ্বানে আবার ১৫ মিনিটের মতো বক্তব্য রাখার পর শেষ করতে চাইলে, পুনরায় প্রেসিডেন্ট একই নির্দেশ প্রদান করেন। আমি তিন ধাপে প্রায় ৪৫ মিনিট বক্তব্য রেখে বক্তব্য শেষ করি। মঞ্চ ত্যাগ করার প্রাক্কালে প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ আবার ভেসে এলো। যাবেন না, আপনি বহু জরুরি বিষয় উত্থাপন করেছেন, সমস্যার সমাধানে সুপারিশ করেছেন। কিন্তু এখনো আপনার উত্থাপিত অনেক প্রশ্নের জবাব মেলেনি। আপনার কাছে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। আপনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকমণ্ডলী দেশ ও জাতি সম্পর্কে অনেক ভাবেন। আপনার উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর আপনাকেই দিতে হবে।

আমার প্রায় ৪৫ মিনিটের বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাজমান পরিস্থিতি, ছাত্ররাজনীতির অবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে গোলাগুলির ঘটনা ও তার সম্ভাব্য সমাধানের প্রস্তাবনা, শিক্ষক-ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্নমুখী সমস্যা, ডাকসু নির্বাচনসহ দেশের চলমান সামরিক শাসন প্রত্যাহার, আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষাব্যবস্থা এবং তার সমাধানের সম্ভাব্য প্রস্তাব উপস্থাপন করি। আমার বক্তব্যের বিষয়বস্তু, ব্যাখ্যা ও মন্তব্যের মধ্যে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সন্তুষ্ট হওয়ার মতো কোনো উপাদান ছিল না। আমার স্পষ্ট ও সাহসী বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট জিয়া অসন্তুষ্ট না হয়ে বরং প্রশংসা করেন।

আমার তিন দফায় বক্তৃতার পর শুরু হয় প্রশ্নোত্তরের পালা। প্রেসিডেন্ট জিয়া আমাকে প্রশ্ন করেন শিক্ষাদানের শ্রেষ্ঠ এই বিদ্যাপীঠে অস্ত্রের উপস্থিতি কেন? আমি এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন রাখি। যে অস্ত্র সশস্ত্র বাহিনীর জন্য বিদেশ থেকে আমদানি হয় অথবা গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে প্রস্তুত হয়, সেসব অস্ত্র সশস্ত্র বাহিনীর চার দেয়াল অতিক্রম করে কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে তার জবাব দেবেন দেশের মহামান্য প্রেসিডেন্ট, দেশের সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাপ্রধান, না কি আমার মতো একজন নিরীহ শিক্ষক? প্রেসিডেন্ট জিয়া এ ধরনের জবাব হয়তো প্রত্যাশা করেননি বা পছন্দ করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মধ্যে কেন গোলাগুলির ঘটনা ঘটে প্রেসিডেন্টের এ প্রশ্নের জবাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসুসহ বিভিন্ন হলের নির্বাচন ১৯৭৩-এর পর থেকে না হওয়ার কারণে গণতন্ত্রের চর্চার অভাবে ছাত্রদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের প্রক্রিয়া হিসেবে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। এ প্রসঙ্গে আমি ডাকসু ও বিভিন্ন হলের ছাত্র সংসদ নির্বাচনসহ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনঃ চালু করার দাবি উত্থাপন করি। উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সময়কালে ছাত্রলীগ ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রলীগের সমর্থকদের মধ্যে প্রতিনিয়তই সংঘর্ষ ও অস্ত্রের মহড়া চলত।

দেশ থেকে চলমান সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবিতে তখন সারা দেশের জনগণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা সোচ্চার ছিল। আমি এই সর্বজনীন দাবিটি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে প্রেসিডেন্টের সামনে উপস্থাপন করি। আমি নির্ভয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে উদ্দেশ করে এ কথাও বলি যে, আপনি যখন জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, তখন কি ধারণা করেছিলেন, এ স্বাধীন দেশে পুনরায় পাকিস্তানের মতো সামরিক আইন জারি হবে? দেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সামনে সামরিক আইনের এ ধরনের কঠোর সমালোচনা কেউ প্রত্যাশা করেননি। হয়তো দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও চ্যান্সেলর জিয়া একজন তরুণ শিক্ষকের মুখ থেকে এ ধরনের সাহসী উচ্চারণ আশা করেননি। এ ধরনের আরও অনেক বিষয়ে প্রাসঙ্গিক অথচ অপ্রিয় কথা সেদিন প্রেসিডেন্ট জিয়ার সামনে বলেছিলাম। প্রশ্নোত্তর চলেছিল প্রায় আধা ঘণ্টার মতো। আমার বক্তব্য ও প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হওয়ার পর সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আবুল কালাম আজাদ এবং সাংবাদিকতা বিভাগের তৌহিদুল আনোয়ার আমার বক্তব্যের সমর্থনে মিলনায়তনের ফ্লোর থেকেই কিছু বক্তব্য রাখেন। এ পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট জিয়া মন্তব্য করেন যে, এরই মধ্যে সব বলা হয়ে গেছে। আর কারও বক্তব্য রাখার প্রয়োজন নেই।

বক্তব্য শেষ করে নিজের আসনে বসে প্রেসিডেন্ট জিয়ার বক্তব্য শোনার জন্য অপেক্ষা করি। আমার ধারণা ছিল, তিনি আমার বক্তব্য এবং টিএসসির বাইরের ঘটনা নিয়ে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ও রূঢ় বক্তব্য রাখবেন। আমার মতো মিলনায়তনে উপস্থিত সব শিক্ষক ও ভ্যালকনিতে উপস্থিত সব ছাত্রছাত্রী (যারা আমার বক্তৃতার সময় মুহুর্মুহু করতালি দিয়েছিলেন) সবার আশঙ্কা আমার মতোই ছিল। কিন্তু আমাদের সবাইকে বিস্মিত করে প্রেসিডেন্ট জিয়া আমার বক্তব্যের বিভিন্ন ইস্যুতে সমর্থন এবং প্রশংসা করেন। টিএসসির বাইরের ঘটনার কোনো উল্লেখও করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সভায় প্রেসিডেন্ট জিয়া ১৯৭৯-এর প্রথমাংশে সাধারণ নির্বাচন এবং সামরিক আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য দুটি হল, ছাত্রীদের জন্য একটি হল এবং শিক্ষকদের জন্য আবাসিক সুবিধা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ প্রদানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার ঘোষিত বরাদ্দ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরবর্তীতে ছাত্রদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হল এবং ছাত্রীদের জন্য সামসুন্নাহার হল নির্মাণ করা হয়। শিক্ষকদের জন্য সেই বরাদ্দ থেকে উদয়ন স্কুলের দক্ষিণ পাশে ও ফুলার রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়া তার বক্তৃতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের গণতান্ত্রিক চর্চার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আশ্বাস প্রদান করেন। তার প্রতিশ্রুত ডাকসু নির্বাচন কয়েক মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৪৫ মিনিটের বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের কিছু সত্য ঘটনা উল্লেখ করে দেশের জনগণ এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে খাটো করে দেখার অপপ্রয়াসের সমালোচনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের মানুষ যে দেশপ্রেম, সাহসিকতা ও ত্যাগী মনোভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, ঠিক সেই মনোভাব নিয়ে দেশ গড়ার লক্ষ্যে সবাইকে এগিয়ে আসার জন্য দেশবাসীকে তিনি আহ্বান জানান। তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে বলেন, বিশ্ব আগে আমাদের যে চোখে দেখত, এখন আর সে চোখে দেখে না। আজ বিশ্বের মধ্যে আগের চেয়ে আমাদের অনেক বেশি বন্ধু দেশ রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট জিয়া বলেন, আমাদের দেশ আকারে ছোট কিন্তু সমস্যা বিরাট। কোনো বিদেশি নীতি-রীতি ও তন্ত্র আমাদের দেশের সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, দেশকে উন্নত করতে হলে আমাদের যে চারটি বিষয়ে আন্তরিক হতে হবে। তা হলো- ১. জাতীয় চেতনা ২. একতা, ৩. কঠোর পরিশ্রম ও ৪. আত্দবিশ্বাস। তিনি পুরনো চিন্তার বদলে নতুন চিন্তা এনে সমাজ প্রগতিতে সবাইকে নিজ নিজ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান।

প্রেসিডেন্ট জিয়া বক্তব্য শেষে টিএসসি ত্যাগ করার পর প্রায় সব শিক্ষক আমাকে স্পষ্ট সাহসী বক্তব্য রাখার জন্য অভিনন্দন জানানোর সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার এড়ানোর জন্য ক্যাম্পাস ছেড়ে আত্দগোপনে যাওয়ার পরামর্শ দেন। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে অশোভন আচরণকারী ছাত্রদেরও ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য সবাই পরামর্শ দেন। শিক্ষকদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে টিএসসির বাইরে কালো পতাকা প্রদর্শন, অশোভন আচরণ এবং আমার সামরিক শাসনবিরোধী কঠোর বক্তব্যের জন্য আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার। সবাই বলাবলি করছিল, দিবাগত রাতেই ক্যাম্পাস ঘেরাও হবে, আমাকে এবং বিক্ষোভে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের গ্রেফতার করা হবে।

কিন্তু কয়েক দিন কেটে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস রেইড হলো না। আমার বা অশোভন আচরণে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের গ্রেফতার তো দূরের কথা কোনো মামলা হলো না। ২৬ অক্টোবরের পর বেশ কয়েক দিন প্রেসিডেন্ট জিয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন এবং এত বড় ঘটনা ঘটার পর আমার ও ছাত্রদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করার বিষয়টি ক্যাম্পাসে সপ্তাহব্যাপী আলোচনার বিষয়ে (Talk of the Week) পরিণত হয়। সামরিক আইনবিরোধী এবং প্রেসিডেন্ট জিয়ার বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক বক্তব্য প্রদানের জন্য নিশ্চিত খারাপ পরিণতির জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে অশোভন আচরণকারীরাও নিশ্চিত গ্রেফতারের ভয়ে আত্দগোপন করেছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেদিনের সব ঘটনায় যে অপরিসীম ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা নজিরবিহীন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যক্কারজনক ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট জিয়া কোনো ধরনের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে প্রকৃতপক্ষে সেদিনই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীদের মন জয় করে গিয়েছিলেন। তিনি জীবিত থাকাকালীনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শে দীক্ষিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের যাত্রা শুরু হয়। জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবরণের পর ক্রমান্বয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমগ্র বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্র সংগঠন হিসেবে আত্দপ্রকাশ করে। প্রেসিডেন্ট জিয়া ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে যে শিক্ষকদের মন জয় করে গিয়েছিলেন সেই শিক্ষকরা পরিবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শের সংগঠন 'সাদা দলের' প্রতিষ্ঠা করেন। 'সাদা দল' বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষকদের জনপ্রিয় আদর্শ সংগঠনে পরিণত হয়েছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আমাদের মাঝে নেই। ১৯৭৮ সালের ২৬ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট জিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ঘটনায় বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশের সব ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকের মনের মধ্যে স্থায়ী অবস্থান সৃষ্টি করে অমর হয়ে আছেন।

  • লেখক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক মন্ত্রী।   
     


Saturday, July 13, 2019

হুদার ‘অস্বাভাবিক’ ভোট ও ‘বকাউল্লাহর’ সংসদ

সোহরাব হাসান
প্রথম আলো/১৩ জুলাই ২০১৯

গত ৩০ জুন ঢাকার লালবাগ সরকারি মডেল স্কুল ও কলেজে ভোটার তালিকা হালনাগাদ প্রশিক্ষণের উদ্বোধনকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, ‘নির্বাচনে শতভাগ ভোট পড়া স্বাভাবিক নয়। তবে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের করণীয় কিছু নেই। ভোটের পরই প্রিসাইডিং কর্মকর্তা কেন্দ্রভিত্তিক সব নিষ্পত্তি করেন। একীভূত ফল রিটার্নিং কর্মকর্তা আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। তখন ওই বিষয়ে আমাদের কিছু জানায়নি; তাই এখন ইসির কিছু করার নাই।’ (ইত্তেফাক, ১ জুলাই ২০১৯)

জাতীয় নির্বাচনের ছয় মাস পর নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে কেন্দ্রভিত্তিক যে পূর্ণাঙ্গ ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যায় ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। এটি কোনো বিশেষ আসনের হিসাব নয়। দেশের ৩০০ আসনের মধ্যে ১০৩টি আসনে এ অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে। সিইসিও স্বীকার করেছেন, শতভাগ ভোট পড়া স্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর কোনো দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এ রকম ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয় না। ঘটা সম্ভব নয়। কেননা ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন হয় না। নির্বাচন হয় কয়েক মাস পর।এ সময়ের মধ্যে কেউ মারা যেতে পারেন, কেউ অসুস্থ থাকতে পারেন, কেউ এলাকার বাইরে বা বিদেশে যেতে পারেন। এঁরা কীভাবে ভোট দিলেন?

সে ক্ষেত্রে শতভাগ ভোট পড়া শুধু অস্বাভাবিক নয়, অবাস্তবও। নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম অবশ্য একটি অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছেন। বলেছেন, উল্লিখিত কেন্দ্রগুলোয় শতভাগ ভোট পড়েছে, এ কথা বলা যাবে না। কেননা ওসব কেন্দ্রে কিছু ভোট বাতিলও হয়েছে। তিনি বলতে চাইছেন, ‘আগে যেকোনো উপায়ে ভোটের বাক্স শতভাগ ব্যালট ভরে ফেলো। এরপর তাঁরা পরখ করে দেখবেন, কোনটি আসল আর কোনটি নকল।’

কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণ করে আরও অনেক বিস্ময়কর তথ্য পাওয়া গেছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ১২৭টি ভোটকেন্দ্রে, ৯৮ শতাংশ ভোট পড়েছে ২০৪টি ভোটকেন্দ্রে, ৯৭ শতাংশ ভোট পড়েছে ৩৫৮ ভোটকেন্দ্রে এবং ৯৬ শতাংশ ভোট পড়েছে ৫১৬ ভোটকেন্দ্রে। অর্থাৎ ৯৬-১০০ শতাংশ ভোট পড়েছে ১ হাজার ৪১৮টি কেন্দ্রে। অন্যদিকে ৪০-৪৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ৫৯৯টি ভোটকেন্দ্রে, ২০-৩৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ৩০১টি ভোটকেন্দ্রে, ১০-১৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ২০টি ভোটকেন্দ্রে এবং ১০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে ১১টি ভোটকেন্দ্রে। ভোট পড়ার এই বিপরীত হারও বিশ্বাসযোগ্য নয়।

নির্বাচন কমিশন একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করবে, কেন্দ্রে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের এজেন্ট থাকবেন, যাঁরা ভোটারকে চিহ্নিত করবেন, তিনি আসল ভোটার কি না। ভোট গ্রহণ শেষে প্রার্থীর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতেই নির্বাচনী কর্মকর্তারা ভোট গণনা করবেন এবং প্রার্থীদের প্রতিনিধির সইসহ ফল রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠাবেন। এরপর রিটার্নিং কর্মকর্তা সব কেন্দ্রের ফল সমন্বয় করে নির্বাচন কমিশনে পাঠাবেন। এটাই নির্বাচনের স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অধিকাংশ কেন্দ্রে এই নিয়ম মানা হয়নি। কেন্দ্রে বিরোধী দলের প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের যেতে দেওয়া হয়নি। সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকেরা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে যে চিত্র দেখেছেন, ঘোষিত ফলের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। ছবি মিথ্যা বলে না।

নির্বাচনের পর ৩০০ আসনের মধ্যে ৫০টি আসনে জরিপ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৪৭ আসনে কোনো না কোনো অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছে তারা। অনিয়মের ধরনের মধ্যে আছে ৪১টি আসনে জাল ভোট; ৪২টি আসনে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকা; ৩৩টি আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল; ২১টি আসনে আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা; ৩০টি আসনে বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মেরে জাল ভোট; ২৬টি আসনে ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা; ২০টিতে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা; ২২টিতে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া; ২৯টিতে প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেওয়া ইত্যাদি।

সিইসি বলেছেন, রিটার্নিং কর্মকর্তারা যেহেতু কেন্দ্রগুলোর ফল একীভূত করে নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দিয়েছেন এবং গেজেট হয়ে গেছে, সেহেতু তাঁদের আর কিছু করার নেই। তাহলে প্রশ্ন আসে, ইসির দায়িত্ব কি শুধু রিটার্নিং কর্মকর্তার পাঠানো কাগজটিতে সিল মারা? সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভোটারদের প্রতি তাদের কোনো কর্তব্য নেই? নির্বাচন কমিশনের কাজ হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা, যাতে প্রতিটি ভোটার নির্বিঘ্নে ও নির্ভয়ে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেন। ইসির পদাধিকারীরা সেটি পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। ২০০০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ নির্বাচনী বিরোধসংক্রান্ত এক মামলায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান, বিচারপতি বিবি রায় চৌধুরী, বিচারপতি এ এম এম রহমান এবং বিচারপতি কাজী এবাদুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ নির্বাচন কমিশনকে ‘ফেয়ার, জাস্টলি ও অনেস্টলি’ দায়িত্ব পালন করার কথা বলেছিলেন। এখন সিইসি তাঁর বিবেককে (যদি থেকে থাকে) জিজ্ঞেস করুন তিনি ফেয়ার, জাস্টলি ও অনেস্টলি সেই দায়িত্ব পালন করেছেন কি না?

এবারের জাতীয় নির্বাচনে যে অগণিত অসংগতি ও অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল, তার কিছু কিছু নির্বাচনের পর প্রথম আলোসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এখন পুরোটা জানা গেল কেন্দ্রভিত্তিক ফল প্রকাশের পর। আইন অনুযায়ী নির্বাচনের পরপরই কেন্দ্রভিত্তিক ফল ইসির ওয়েবসাইটে দেওয়ার কথা থাকলেও তারা সেটি তারা দেয়নি। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল চেয়ে গত ৭ মার্চ প্রথম ইসিকে চিঠি দেয়। সাড়া না পেয়ে ৩০ মে ও ১১ জুন আরও দুটি চিঠি দেয়। এরপরও প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার গত ১৩ জুন তথ্য অধিকার আইনের আওতায় তথ্যের জন্য আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ জুন ইসি ৩০০টি সংসদীয় নির্বাচনী এলাকার কেন্দ্রভিত্তিক ও একীভূত নির্বাচনী ফলাফল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে।

কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো এবারের নির্বাচন ব্যালট পেপারে হওয়ায় ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়া দেখাতে পারলেও ইভিএম পরিচালিত ৬টি আসনের কোনো কেন্দ্রে সেটি ঘটেনি। ইভিএমে ভোট পড়ার গড় ৫১ দশমিক ৪২ শতাংশ। আর ব্যালট পেপারে ভোট হওয়া আসনের গড় ভোট ৮০ দশমিক ৮০ শতাংশ। ভোটের পার্থক্য ২৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন, তার আগে ও পরের সব নির্বাচনে ইসি অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে ৫৭৬টি কেন্দ্রে নৌকার প্রার্থীর বাইরে কেউ একটি ভোটও পাননি। ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি যত নগণ্যই হোক না কেন, ঘোষিত ফলাফলে দেখা যায় বিপুল সংখ্যায় ভোট পড়েছে। মহাবিশ্বে একমাত্র পৃথিবীতে মানুষ আছে বলে প্রমাণিত। অন্য গ্রহেও মানবসদৃশ কোনো প্রাণী বা এলিয়েন থাকতে পারে। হুদা কমিশনের দৌলতে ভোটের দিন ওই এলিয়েনরা এসেই ভোট দিয়ে গেছে। না হলে শতভাগ ভোট পড়ল কীভাবে?

যখন নির্বাচন কমিশনের কেন্দ্রভিত্তিক ফল বিশ্লেষণ করছিলাম তখনই সাবেক মন্ত্রী, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাংসদ রাশেদ খান মেননের একটি মন্তব্য চোখে পড়ল। গত বৃহস্পতিবার সংসদে আলোচনাকালে তিনি বলেছেন, ‘সাংসদেরা হচ্ছেন বকাউল্লাহ, তাঁরা বকে যান, ক্ষমতাসীনেরা শোনাউল্লাহ, শুনে যান। আর সংসদ হচ্ছে গরিবউল্লাহ।’ তিনি আরও বলেছেন, গ্যাসের দাম নিয়ে আলোচনা না হলে এই সংসদ আরও গরিব হয়ে যাবে। আমাদের অর্থনৈতিক সূচক যত বাড়ছে, রাজনৈতিক সূচক তত নিচে নামছে।

এর আগে রাশেদ খান মেনন বরিশালে দলের সভায় বলেছেন, রাজনীতি আর রাজনীতিকদের হাতে নেই। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির আরও কয়েকজন নেতা রাজনীতি রাজনীতিকদের হাতে নেই বলে হতাশা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তাঁদের মনে রাখা উচিত রাজনীতি তখনই রাজনীতিকদের হাতে থাকে, যখন জনগণ ভোট দেওয়ার সুযোগ পান। মেনন ও মইন উদ্দীন খান বাদলেরা সরকারকে শোনাউল্লাহ, সংসদকে গরিবউল্লাহ এবং নিজেদের বকাউল্লাহ বলে উল্লেখ করেছেন। সংসদ কখন গরিব হয়? যখন সেই সংসদে জনগণের পক্ষে কথা বলা যায় না। এ অবস্থা চলতে থাকলে তাঁরা সরকারের নীতি পরিবর্তন দূরের কথা, নিজের বকাউল্লাহর ভূমিকাটিও রাখতে পারবেন না।

অতএব রাজনীতিকে রাজনীতিকদের হাতে ফিরিয়ে আনতে হলে সবার অাগে জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। তবে সেই কাজটি হুদা কমিশন করতে পারবে—এ কথা কেউ বিশ্বাস করে না।

  • সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
  • লিঙ্ক - shorturl.at/kqIW1

Thursday, July 11, 2019

সঞ্চয়পত্রে বাড়তি কর, বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও নিম্নবিত্তের জীবন




ড. আর এম দেবনাথ
সরকারি বিভাগ, মন্ত্রণালয় যদি অবিবেচক হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের করার আর কিছু থাকে না। সরকারি সিদ্ধান্ত তাদের মানতেই হবে, শত হোক তা সরকারি আইন বা বিধান। এখন ১ জুলাই থেকে যে বিধান হয়েছে, তা মানতে গিয়ে অযৌক্তিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোনো উপায় নেই। এই যেমন সঞ্চয়পত্র। আশা ছিল মাননীয় সংসদ সদস্যদের আপত্তি, জনসাধারণের আপত্তির কথা শুনে অর্থমন্ত্রী সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর যে অধিকতর করারোপ করেছেন, তা তিনি তুলে নেবেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা ছিল ৫ শতাংশ, এটাই বহাল থাকবে এই ছিল লাখ লাখ সঞ্চয়ীর প্রত্যাশা। সাধারণ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের প্রত্যাশা। নতুন অর্থমন্ত্রী তা করেননি। সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম দিন থেকেই ১০ শতাংশ অগ্রিম আয়কর উৎসেই কেটে নেয়া হবে। এবারে প্রশ্ন, আগে যারা কিনেছেন, তার বেলায় এ বিধান প্রযোজ্য কিনা? তিন বছর আগে কেনা, আরো দুই বছর পরে তা নগদায়নযোগ্য হবে এমন সঞ্চয়পত্রের বেলায়ও কি তা প্রযোজ্য? মাসে মাসে বা তিন মাস অন্তর যাদের সুদের টাকা তোলার কথা, অথচ নানা কারণে কয়েক মাসের টাকা তোলা হয়নি, এমন বকেয়া ক্ষেত্রেও কি নতুন বিধান প্রযোজ্য? খবরের কাগজে প্রকাশিত সংবাদ যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে ওইসব ক্ষেত্রেও ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটা হবে। একটি কাগজের খবরের শিরোনাম: ‘উৎসে কর ১০% সবার জন্যই’। একজন অর্থনীতিবিদ আন্তর্জাতিক কররীতির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘কারো পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ যদি আগামী দুই বছর পরে শেষ হয়, তাহলে ১ জুলাইয়ে আগের তিন বছরের মুনাফার ওপর ৫ শতাংশ এবং ১ জুলাইয়ের পরের সময়ের মুনাফার ওপর উৎসে কর ১০ শতাংশ আরোপই যৌক্তিক হবে।’ এটি ন্যায্য প্রশ্ন। এর পরেও প্রশ্ন আছে। ব্যাংকে মেয়াদি আমানত রাখলে যে তারিখে রাখা হয়, সেই তারিখের সুদহারই কার্যকর থাকে, পরবর্তী সময়ে সুদের হার কমানো-বাড়ানো হলেও। কারণ এটা ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি। চুক্তি একতরফাভাবে ভঙ্গ করা যায় না। আমার প্রশ্ন, সঞ্চয়পত্র কি ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে একটা চুক্তি নয়? আমার জানা নেই। তবে সাধারণ বুদ্ধিতে বলে, গচ্ছিত টাকা রাখার সময় যে শর্তাবলি থাকে, সেটিই উভয় পক্ষের কাছে মান্য। এ অবস্থায় সঞ্চয় অধিদপ্তর কী করে বলে যে ‘উৎসে কর ১০% সবার জন্যই।’


এটা কি অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নয়? এটা কি একতরফা সিদ্ধান্ত নয়? এ সিদ্ধান্তের দুটো ফল। প্রথমত, ৫ শতাংশের স্থলে সাধারণ সঞ্চয়কারীদের কাছ থেকে উৎসে অগ্রিম আয়কর কেটে নেয়া হবে ১০ শতাংশ হারে। এখানে সঞ্চয়কারীদের স্বার্থহানি হচ্ছে। তাদের আয় হ্রাস পাচ্ছে।দ্বিতীয়ত, বকেয়া সুদের ওপরও ১০ শতাংশ হারে কর কেটে নেয়া রীতিমতো জবরদস্তি। সঞ্চয় অধিদপ্তর আমার মনে হয় এক্ষেত্রে ‘ওভারস্টেপিং’ করছে। সিদ্ধান্তটি সঠিক হয়ে থাকলে তা পুনর্বিবেচনাযোগ্য। 

আরো কথা আছে। এসব দুঃখের কথা। ধরা যাক একজনের ১০ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র আছে। তাহলে তার বার্ষিক সুদ আয় হবে ১ লাখ ৯ হাজার ৪৪০ টাকা। ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটা হলে তার পরিমাণ হবে ১০ হাজার ৯৪৪ টাকা। যদি ওই ব্যক্তির আরো ২ লাখ টাকা অন্যান্য সূত্রে আয় হয়, তাহলে তার মোট আয় হবে ৩ লাখ ৯ হাজার ৪৪০ টাকা। যেহেতু উৎসে কর কাটা চূড়ান্ত দায় হিসেবে বিবেচিত, তাই ব্যক্তির কোনো আয়করই হবে না। কিন্তু ‘ফাইল’ জমা দিলেই সর্বনিম্ন কর দিতে হবে। দেখা যাবে পাওনা করের চেয়ে আয়কর কাটা হয়েছে অনেক বেশি। এ টাকা আইনত ফেরতযোগ্য। কিন্তু সবাই জানে সরকারের কাছ থেকে টাকা ফেরত পাওয়া কতটা ঝামেলাপূর্ণ। মুশকিল হলো, এ সমস্যাটা হবে প্রতি বছর। সম্ভবত এ সমস্যার কথা বিবেচনা করেই তিন বছর আগে ১০ শতাংশের স্থলে করহার কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। কিন্তু বিধি বাম, নতুন অর্থমন্ত্রী এসেই পুরনো অর্থমন্ত্রীর বিধানটি তুলে দিলেন। এতে অবিচার বাড়ল কিনা তা বিবেচনার বিষয়। আরো মুশকিল আছে। এক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত সঞ্চয়কারী করদাতার আয় কমল। বিপরীতে তাকে কোনো কর রেয়াত দেয়া হলো না। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা সাধারণত করদাতাদের পক্ষে কথা বলেন না। তারা তাদের নিজেদের দাবি নিয়েই বাজেটের আগে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু এবার তারা বাজার সৃষ্টির কথা বিবেচনা করে করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধির কথা বলেন। সাধারণ করদাতারা এ দাবি করেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে তুলনা করে বিশেষজ্ঞরাও একই কথা বলেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী কারো কথা শুনলেন না। চার বছর আগের আয়করমুক্ত সীমাই রেখে দিলেন। অথচ চার বছরের প্রতি বছর মূল্যস্ফীতি হয়েছে কম করে হলেও ৫ শতাংশ হারে। 


সরকারি কর্মচারীসহ বিভিন্ন অধিদপ্তরের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সুযোগ দ্বিগুণ করা হয়েছে। কিন্তু লাখ লাখ বেসরকারি করদাতার বেতন-ভাতা বাড়েনি। এ সত্ত্বেও করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হলো না। অধিকন্তু বাজারে দেখা যাচ্ছে সবকিছুর মূল্যে ঊর্ধ্বগতি। বাজেটের কারণে তেল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, চিনি থেকে শুরু করে বিরাটসংখ্যক দ্রব্যসামগ্রী ও সেবার মূল্য বেড়েছে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা আরেকটি এল বছরের প্রথম দিনেই। 

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম দিনেই বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম। সর্বোচ্চ হারে হয়েছে এই বৃদ্ধিটি। গড়ে প্রায় ৩৩ শতাংশ। গৃহস্থালি ব্যবহারের জন্যও দাম বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত হারে। এর ফল কী হবে তা নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। শিল্প উৎপাদনের খরচ বাড়বে, পরিবহন খরচ বাড়বে, বাড়িভাড়া বাড়বে। বড় কথা, গ্যাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হচ্ছে বিদ্যুৎ। এর দাম যেকোনো দিন বাড়বে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। অথচ যে যুক্তির বলে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে, তা কোনো যুক্তিই নয়। হিসাবে দেখা যাচ্ছে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে যে টাকা আদায় করা হবে, প্রায় সেই পরিমাণের টাকা ‘সিস্টেম লস’ দূর করে সাশ্রয় করা যায়। দেখা যাচ্ছে চুরি-দুর্নীতির বোঝাও সাধারণ মানুষকে বহন করতে হবে।

এভাবে দেখলে বোঝা যাবে একদিকে মানুষের আয় কমছে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ছিল ঊর্ধ্বমুখী। শুধু আয় কমের বিষয় নয়, লোকের চাকরিও যাচ্ছে। দৈনিক কাগজের খবর, ‘পাঠাও’ নামের রাইডশেয়ারিং কোম্পানি তার ৫০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করেছে। তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস এবং পুঁজির স্বল্পতাই নাকি ছাঁটাইয়ের কারণ। যেখানে পারছে সেখানেই মালিকরা রোবট বসাচ্ছেন। তৈরি পোশাক শিল্পে এর ব্যাপকতা বেশি। কয়েকদিন আগে দেখলাম একটা বিখ্যাত আসবাব কোম্পানিতেও রোবট বসেছে। বেসরকারি খাতে চাকরিচ্যুতি এখন যখন তখন। মধ্যবয়সে সন্তান-সন্ততিসহ লোকজন রাস্তায় পড়ছে। দুদিন আগে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম। একজন পুরনো কর্মী বললেন, প্রতিদিন সকালবেলা ওপরওয়ালার নাম নিয়ে অফিসে ঢুকি। রাত্রিবেলা আতঙ্কে থাকি। পরদিন সকালে আবার তা করি। হে ওপরওয়ালা, আমার চাকরিটা যাতে থাকে। এসব তো মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত কর্মী-কর্মচারীদের কথা, সাধারণ মানুষের দুঃখ আরো বেশি। গত সপ্তাহে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে দেখা। জিজ্ঞেস করেই বুঝলাম, দেশে কোনো কাজ নেই।

এখন বর্ষাকাল।  করিমগঞ্জ, ইটনা, মিঠামইন, সুনামগঞ্জ ইত্যাদি এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এখন জল আর জল। এ অবস্থায় কাজ তারা কোথায় পাবেন। নীলফামারীর ‘কিশোরগঞ্জ’ এলাকার এক রিকশাওয়ালা বললেন তার দুঃখের কথা। তাদের রোজগার এখন কম। যানজটের কারণে ‘খেপ’ তাদের অনেক কম। একটা যাত্রাতেই এক-দেড় ঘণ্টা লেগে যায়। অথচ ‘মেসের’ খরচ বৃদ্ধির দিকে। বাজার খরচও বেশি। এসব নিয়ে দেশের বড় একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসাব করে দেখিয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে গড়ে মানুষের মাসিক প্রকৃত আয় ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। তাহলে সরকারি হিসাবে গড় আয় বাড়ছে কীভাবে? সেটাও সত্য! কারণ ওই হিসাবে ধনী-দরিদ্র সবারই হিসাব আছে। ওই হিসাবে গরিব, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের আয়ের প্রতিফলন হয় না। এ বাস্তবতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরটাই শুরু হয়েছে উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠার মধ্যে। সামনে পবিত্র ঈদ। ওই উপলক্ষে যে আরেক দফা মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কী?

  • ড. আর এম দেবনাথ: সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  • কার্টসিঃ বণিকবার্তা/ জুলাই ১১, ২০১৯

হঠাৎ পিয়াজের দাম দ্বিগুণ!


মানবজমিন/ জুলাই ১১, ২০১৯



ঈদুল ফিতরের পর স্থিতিশীল থাকলেও হঠাৎ করেই রাজধানীর বাজারগুলোতে পিয়াজের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। গত দুই দিনে খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে অস্বাভাবিকভাবে দ্বিগুনের বেশি দাম বেড়েছে। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পিয়াজের দাম গড়ে ১৫ থেকে ২৫ টাকা বেড়েছে। খুচরা বাজারে এমন অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির তেমন কোন কারণ নেই বলে জানিয়েছেন পাইকারি বিক্রেতারা। কাওরান বাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীরা পিয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। সরবরাহ ও আমদানি মূল্য কম থাকার পরও বাড়তি মুনাফা করার জন্য দাম বাড়িয়েছেন চক্রটি। অন্যদিকে, ভোক্তারা মনে করেন, বাজার পর্যবেক্ষণ না থাকার কারণে এরকম দাম বেড়েছে। এখনি বাজার পর্যবেক্ষণ জোরদার না করা গেলে পিয়াজসহ অন্য মসলারও দাম বৃদ্ধি পেতে পারে বলে জানান তারা।

দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ সাধারণ ক্রেতারা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, উৎপাদন মৌসুমে পিয়াজ তোলার সময় বৃষ্টি ছিল। এতে নষ্ট হওয়ার ভয়ে দেশি পিয়াজ আগাম বেশি বিক্রি হয়ে গেছে। ফলে, আড়তগুলোতে এখন দেশি পিয়াজ কম সরবরাহ হচ্ছে। তাছাড়া সামনে কোরবানির ঈদ এবং ভারতীয় বাজারে পিয়াজের দাম বৃদ্ধির কথা বলেন তারা।

কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাত দেখালেও পিয়াজ কিনতে এসে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ব্যবসায়ীদের ওপর। 

বাজারে গত শুক্রবার পর্যন্ত দাম অপরিবর্তিত থাকলেও রোববার হঠাৎ করে পিয়াজের দাম কেজিতে ১৮ থেকে ২০ টাকা বেড়ে ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতিপাল্লা (৫ কেজি) বিক্রি হয়েছে ২২৫ টাকায়। শুক্রবার প্রতিকেজির দাম ছিল ২৫ থেকে ২৭ টাকা এবং পাল্লা ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। গত রোববার থেকে রাজধানীর খুচরা দোকান ও মুদি দোকানগুলোয় পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে, শুক্রবারেও যা ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি।

বেসরকারি চাকরিজীবী হাসনাত রিপন রাগান্বিত স্বরেই বললেন, গত শুক্রবারও যে পিয়াজ কিনেছি ২৮-৩০ টাকা কেজি, তা এখন হয়ে গেল ৫০ টাকা। এটা কি মগের মুল্লুক নাকি! পিয়াজ ছাড়া রান্না চলে না তো, তাই জেনেশুনে এমন সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো হয়। এটা সাধারণ ক্রেতাদের ওপর অত্যাচার ছাড়া কিছু না। 

কাওরান বাজারের পিয়াজ ব্যবসায়ী ফয়েজ আহমেদ বলেন, ভারতীয় পিয়াজের আমদানি খরচ হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় বাজারে পিয়াজ সরবরাহের ঘাটতি রয়েছে। তাই পাইকারি বাজারে পিয়াজের দাম বেড়ে গেছে, যার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। আরেক ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন বলেন, বৃষ্টির কারণে গত কয়েক দিনে পাইকারি বাজারে পিয়াজের দাম হঠাৎ বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, গত কয়েক দিনে কেজিপ্রতি পিয়াজের দাম পড়েছে ৩৮ থেকে ৩৯ টাকা। এর সঙ্গে খরচ যোগ করে আমাদের ৪৫ টাকা দামে বিক্রি করতে হয়েছে। 

শ্যামবাজার ব্যবসায়ী সমিতির প্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, আগে দিনে ভারত থেকে ২০০ পিয়াজের গাড়ি ৪টি স্থল বন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ করতো। কিন্তু এখন সেখানে ১০০ থেকে ১২০টি গাড়ি ঢুকছে বাংলাদেশে। আমদানি সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বাড়ছে বলে জানান তিনি। 

খুচরা বাজারে দেখা গেছে, মানভেদে দেশি পিয়াজ কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকা। গত রোববার থেকে এই দামে পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে। তবে গত শুক্রবার প্রতি কেজি ভালো মানের দেশি পিয়াজ বিক্রি হয় ৩০-৩৫ টাকা। অর্থাৎ খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পিয়াজের দাম বেড়েছে ২০-২৫ টাকা। রোববার পাইকারিতে দাম বাড়ার প্রভাবে ওই দিন থেকেই খুচরা বাজারে পিয়াজের দামে বড় ধরনের উত্থান হলেও, মঙ্গলবার পাইকারিতে দাম কমার প্রভাব এখনও খুচরা বাজারে পড়েনি। খুচরা বাজারে এখনও বাড়তি দামেই পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে।

কাওরানবাজারের পিয়াজ ব্যবসায়ী হাসান মিয়া বলেন, বৃষ্টির কারণে গত দুদিনে পিয়াজের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়। ওই সময় আমাদের প্রতি মণ পিয়াজ কেনা পড়ে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ প্রতি কেজির দাম পড়ে ৩৮-৩৯ টাকা। এর সঙ্গে খরচ যোগ করে আমাদের ৪৫ টাকা দামে বিক্রি করতে হয়েছে।

তবে পাইকারি বাজারে পিয়াজের দাম কিছুটা কমেছে। প্রতি মণ কেনা পড়ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি কেজির দাম পড়ছে ৩০-৩২ টাকা। এই পিয়াজ আমরা ৩৫-৩৬ টাকা কেজি বিক্রি করছি। এ হিসাবে এখন পিয়াজের দাম প্রতি কেজিতে কমেছে ১০ টাকা করে। কিন্তু খুচরা বাজারে চিত্র ঠিক উল্টো। 


উৎস লিঙ্ক — http://bit.ly/2YQruve

Sunday, July 7, 2019

চোখের সামনে হলুদ জামা পরা সায়মার মুখ


শাহানা হুদা

দিনে দিনে কি অসুস্থ হয়ে পড়ছি, তা না হলে কেন চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই, একটি শিশু ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে, আর কতগুলো দানবীয় হাত তার দিকে এগিয়ে আসছে। কোন শিশুর দিকে চোখ পড়লেই কেন মনে হচ্ছে এই বাচ্চাটি কি নিরাপদে থাকতে পারবে? ও কি জানে ওর চারপাশে মানুষরূপী দানবরা ঘুরে বেড়াচ্ছে? এরা আর কেউ নয় তার পরিবারের সদস্য, বা শিক্ষক বা পাড়ার ছেলে বা আত্মীয় নামক মানুষরূপী একদল জীব। মাঝেমাঝে ভাবছি খবরে চোখ রাখা কি বন্ধ করে দেব? উটপাখি হয়ে যাব? যতগুলো শিশু বা মেয়ের ছবি দেখছি, সেখানেই আমার মেয়ের বা আমার ছোট্ট নন্নার মুখ ভেসে উঠছে। মনে হচ্ছে এই বাচ্চাগুলোকে আমরা হত্যা করছি।



স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

আমার চোখের সামনে হলুদ জামা পরা সায়মার মুখ, মাথায় লাল ফিতা দিয়ে চুল বাঁধা। কানে বাজছে সায়মার বাবার কান্নাজড়ানো কণ্ঠ - দেশবাসীকে একটা কথা বলতে চাই, যাদের মেয়ে বাচ্চা আছে, তারা তাদের আগলে রাখবেন। এক মুহূর্তের জন্যও আলগা হতে দেবেন না। এইসব নরপিশাচদের হাত থেকে এদের রক্ষা করবেন।     

কিন্তু এভাবে তো চলা যায় না। আরও দমবন্ধ লাগছে এজন্য যে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে আমি, আপনি, সমাজ, সরকার কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করছি না। আমি, আপনি ফেসবুকে ইমো দিচ্ছি, অধিকাংশ মানুষ নির্বিকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চুপচাপ এবং সরকার কোনো দায় অনুভব করছে না। তারা উন্নয়ন নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে সারাক্ষণ সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, আমেরিকার অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা ভাবছে, অথচ নিজের দেশে যে ছোট ছোট শিশুরা, নারীরা অব্যাহতভাবে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, সেটা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাই নেই।

আমরা ভাবতেই পারি না গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত - এই ছয় মাসে সারাদেশে ৩৯৯ শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ছেলে শিশুর সংখ্যা আট। ধর্ষণের পর এক ছেলে শিশুসহ মারা গেছে আরও ১৬ শিশু। এদের মধ্যে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছিল ৪৪ জনের ওপর। এছাড়া যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ৪৯ শিশু। যৌন হয়রানির ঘটনায় আহত হয়েছে ৪৭ মেয়েশিশু ও দুই ছেলেশিশু। মানে দাঁড়াচ্ছে ১৮২ দিনে ৩৯৯ শিশু ধর্ষণের শিকার। মাত্র ছয়টি পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে এই সংখ্যাটি পাওয়া গেছে। সারাদেশে আরও অসংখ্য নারী, মেয়ে ও ছেলে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। যেগুলোর খবর গণমাধ্যমে আসে, আমরা শুধু সেগুলোই জানি। বাকি সব থেকে যাচ্ছে চোখের অন্তরালে।

পরপর কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা আমাদের চমকে দিয়েছে। স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষক, পরিবারের একদম ঘনিষ্ঠ জন কেউ বাদ নেই। আগে আমাদের ধারণা ছিল গুণ্ডা-মাস্তানরা ধর্ষণ করে তরুণী এবং কিশোরীদের। এখন দেখছি এই ধারা একেবারে পাল্টে গেছে। শিশুরাই এখন বড় টার্গেট। কারণ শিশুরা দুর্বল, শিশুদের খুব সহজে ভোলানো যায়, পথেঘাটে শিশুরাই খেলে বেড়ায় এবং শিশুরা কাউকে কোনো অভিযোগ জানাতে ভয় পায়। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো শিশুরা কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও তাকে গুরুত্ব দেয় না পরিবারের লোকজন। বিশেষ করে সেই ব্যক্তি যদি হয় পরিবারেরই কোনো বয়স্ক ব্যক্তি বা সদস্য। উল্টো শিশুকে চাপের মধ্যে রাখে। আমরা যদি শিশুদের ধর্ষিত হওয়ার খণ্ডচিত্রগুলো লক্ষ্য করি দেখব যে এরা কেউ বাসায় গিয়ে কারও বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেনি কখনো। এই যে নুসরাতকে পুড়িয়ে মারা হলো, এই নুসরাত যখন তার পরিবারের কাছে বারবার এইসব নিপীড়নের কথা বলেছিল, পরিবার খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি।

নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে শিশুদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। বাবা-মায়েরা যখন কাজে যায়, তখন শিশুরা থাকে একেবারে অভিভাবকহীন। দেখা যায় ১২/১৩ বছরের বোনটি তার আরও দুটি ভাই-বোনকে দেখভাল করছে। এরা সবাই অনিরাপদ। এসব পরিবারে শিশুদের নিরাপত্তার কোনো ধারণা দেওয়া হয় না। এরকম অগণিত বাচ্চা একদম অযত্নে অবহেলায় শহরের বস্তিতে বেড়ে উঠছে। এরা পথে পথে ঘুরে, হাটে-বাজারে-পথের পাশে ঘুমায়। এদের জীবনে নিরাপত্তা বলে কোনো শব্দই নেই। এই শিশুগুলোকে দেখলে আমার শুধু মনে হয় খাদ্য-বস্ত্র-শিক্ষা-বাসস্থানের পাশাপাশি এরা নিরাপত্তা থেকেও বঞ্চিত। যেকোনো সময়, যে কেউ এদের ধর্ষণ করে মেরে ফেলে রেখে যাতে পারে এবং যায়ও। প্রতিবন্ধী শিশুর নিরাপত্তা আরও কম। যাদের দায়িত্ব পরিবার, সমাজ, সংসার কেউ নেয় না, তাহলে কেনইবা এদের জন্ম হয়, কেনইবা এরা ঝরে যায়?

যে শিশুটি আমাদের ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে আছে, যে শিশুটি যত্রতত্র ঘুরেও বেড়ায় না, পরিবারেই থাকে তারও বিপদ কিন্তু কম না। এই পরিবারগুলোতেই এমন সব মানুষরূপী প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে --- যাদের কথা আমরা ভাবতেও পারব না, অথচ এই অমানুষগুলোই বাচ্চাদের সারল্য ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে অত্যাচার করে চলেছে সবার অগোচরে। আসলে যে লোকটি বিকৃত রুচির, তার সামাজিক পরিচয় যাই-ই হোক সে কিন্তু ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেই। সে হতে পারে কারো বাবা, ভাই, চাচা, মামা বা দাদা। কিন্তু সে আসলে মনের দিক থেকে একজন ধর্ষক। সে পথেঘাটে মেয়েদের দেখে, উত্যক্ত করে আর ঘরে এসে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি করে। আর তাই ৯ মাসের নবজাতককে যখন তার চাচা ধর্ষণ করেছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়, তা দেখে আমরা আঁতকে উঠি। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে এরাই সেই বিকৃত মনের পিশাচ।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বলছে, শতকরা ৮৭ ভাগ নারী তাদের পরিবারেই যৌন হয়রানির শিকার হয়। পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, যখন রক্ষকই ভক্ষক হয়ে যায়।

কেন ধর্ষণের ঘটনা দিনে দিনে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে? সবার মুখে এখন এই একই কথা। অধিকাংশ মানুষ মনে করে অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয় না বলে, তারা এই ধরনের অপরাধ করতেই থাকে। অপরাধী যখন জানে অপরাধ করলে সে পার পেয়ে যাবে, তখন তার বারবার অপরাধ করতেও ভয় হয় না। দেশে নানা ধরনের যৌন উত্তেজক মাদক ও পর্নোগ্রাফির ছড়াছড়ি। সববয়সের পুরুষ এই মাদক গ্রহণ করছে এবং পর্নোগ্রাফি দেখছে এবং যার তার ওপর এর প্রয়োগ ঘটাচ্ছে। মাদক এবং পর্নো সাইট দুটোই নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন হলেও অসাধ্য নয়। সরকার যদি সত্যিই চায় এগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে, তাহলে সেটা খুব কঠিন হবে না।

এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রচারণা চালানো। শিশুদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাদের শেখাতে হবে কোনটা ভালো স্পর্শ, কোনটা মন্দ স্পর্শ। তাদের শেখাতে হবে কিভাবে তারা প্রতিবাদ করবে এবং অন্যায়কারীকে চিনিয়ে দেবে। তাদের জানাতে হবে তাদের পক্ষে আছে তাদের অভিভাবকরা। কেউ যদি আদরের নামে তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করে, তাকে কিভাবে শায়েস্তা করতে হবে, সেটাও শিশুদের শেখাতে হবে। শিশুদের শেখাতে হবে তারা যেন পরিচিত, অপরিচিত কারও সঙ্গে কোথাও একা একা চলে না যায়, কেউ কিছু খাবারের প্রলোভন দেখালে তারা যেন সেই ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে চলে না যায়। শিশুকে ঘুরে দাঁড়ানো শেখাতে হবে।

আর বাবা মা, অভিভাবককেও শিশুর নিরাপত্তার প্রতি সচেতন হতে হবে। বস্তিবাসী, দরিদ্র, অসহায় বাবা মায়েরা অনেকসময় পারেন না তাদের সন্তানের দেখভাল করতে। কিন্তু এরপরও সন্তানের কথা বিবেচনা করে খুব সচেতন হতে হবে সব অভিভাবককে। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, কী করছে, সন্তানের সঙ্গে কে কীরকম ব্যবহার করছে এসবে দৃষ্টি দিতে হবে। আমাদের সবাইকে একসঙ্গে সমাজ সচেতনতার কাজ শুরু করতে হবে। তা না হলে একটি শিশুকেও আমরা সুস্থ রাখতে পারব না।

  • শাহানা হুদা: যোগাযোগকর্মী, লেখকের ইমেইল —  ranjana@manusher.org 

  • উৎস লিঙ্ক —  http://bit.ly/30kZ8cR  

Saturday, July 6, 2019

উন্নয়নের অন্তরালে মানুষ ‘আর্তনাদ’ করছে


ঢাবি প্রতিনিধি/দেশরূপান্তর 

অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের কোনো মানুষ নিরাপদে নেই। এমন নিরাপত্তাহীনতা আমরা ৭১ সালেই দেখেছিলাম। এর বড় উদাহরণ হচ্ছে এই যে ধর্ষণ, এটি কেবল ধর্ষণ নয়, গণধর্ষণ । এসব অন্যায় রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আমরা দেখেছি, নুসরাত জাহানের ঘটনার সাথে পুলিশ জড়িত হয়ে পড়ল, আওয়ামী লীগ নেতা জড়িত ছিল এবং সকলে মিলে প্রমাণ করতে চাইল যে নুসরাত আত্মহত্যা করতে চেয়েছে। ইতিমধ্যে একজন নার্সকে বাসের মধ্যে ধর্ষণ করে হত্যা করা হলো। বলা হচ্ছে  উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু এই উন্নতির অন্তরালে মানুষ আর্তনাদ করছে।’

শুক্রবার, মে ১০, ২০১৯,  দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুল ইসলাম লেকচার হলে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির আয়োজনে ‘শ্রমিক আন্দোলনের একাল সেকাল’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি এসব কথা বলেন। 


বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থার বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন ‘আজকে দেশে যে রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে, তার চেয়ে খারাপ অবস্থা অতীত ইতিহাসে ছিল কিনা আমার জানা নেই। আমরা দুর্ভিক্ষ দেখেছি, যে দুর্ভিক্ষে অনেক মানুষ মারা গেছে। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে দৃশ্যমান কোনো দুর্ভিক্ষ না থাকলেও নীরবে দুর্ভিক্ষ আছে।


দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্নীতির বিষয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধের ভুয়া সনদ দিয়ে পদোন্নতি নিতে গিয়ে ধরা খেয়েছে। অথচ যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবে তারাই যদি দুর্নীতি করে, তাহলে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা অবস্থা কি তা সহজে অনুধাবন করা যাচ্ছে। আমরা পুঁজিবাদের অধীনে দাস হয়ে রয়েছি। এ ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভেঙে দিতে হবে। রাষ্ট্রের মালিক শ্রেণির সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণির যে শোষণের সম্পর্ক তা ভেঙে দিতে হবে। তাহলে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। বিপ্লবের মাধ্যমে পুরোনো রাষ্ট্রকে ভেঙে এমন রাষ্ট্র করতে হবে, যে রাষ্ট্র মানবিক হবে, যেখানে নারী ধর্ষিত হবে না, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের নামে প্রতারণা করবে না।’

Wednesday, July 3, 2019

মৃত ব্যক্তির ভোটদান ও ‘করণীয় কিছু নেই’ সমাচার



গোলাম মোর্তোজা
‘কোথায় যাই, কার কাছে যাই’- মহাদেব সাহার জনপ্রিয় কবিতার লাইন একটু পরিবর্তন করে বলা যায় ‘কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে’? ভরসার জায়গা কোথায়? বলছি বাংলাদেশের জনগণের কথা। বহুবিধ প্রশ্নের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে যেসব প্রশ্ন দৃশ্যমান হয়েছিলো, তার একটি এখন আবার আলোচনায়।





১. কিছু কেন্দ্রে ‘শতভাগ’ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। মৃত ব্যক্তি ভোট দিয়েছিলেন। মালয়েশিয়ায় বা সৌদি আরবে থাকেন যারা, তারা বাংলাদেশে না এসেও সশরীরে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে ভোট দিয়েছিলেন!

বগুড়ার কয়েকটি কেন্দ্রের ‘শতভাগ’ ভোটের সংবাদ দ্য ডেইলি স্টার প্রকাশ করেছিলো ১ জানুয়ারি, নির্বাচনের ১ দিন পর।

দ্য ডেইলি স্টারের বগুড়া প্রতিনিধি মোস্তফা সবুজ ‘শতভাগ’ ভোট দেওয়া এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধানে গিয়েছিলেন এ বছরের ১ জানুয়ারি। মৃত এবং প্রবাসে থাকা ব্যক্তিদের ভোট দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছিলেন তিনি। অনুসন্ধানে জানতে পারেন -

বগুড়ার চিকাশি মোহনপুর গ্রামের হজরত আলীর স্ত্রী জাহেদা খাতুনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৩ মার্চ। তার ভোটার নম্বর ১০১৪৮২২২৪৯৬৭ (ক্রমিক নম্বর: ২৩৩)। জাহেদার ছোট ছেলে আকবর আলী (৪০) জানান, ২০১৮ সালের জুনে তার মা পারিবারিক কলহের জেরে তার এক প্রতিবেশী আত্মীয়ের হাতে নিহত হন।

এই হত্যার পর মামলার প্রধান আসামি মেহের আলী কারাগারে রয়েছেন। অথচ এই কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে।

হত্যার দায়ে অভিযুক্ত মেহের আলীর বাবা ইউসুফ আলী জানান, তিনি ও তার স্ত্রী মেহেরুন্নেসা এবং মেহের আলীর স্ত্রী আরজিনা বেগম ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেননি। হত্যাকাণ্ডের পর আরজিনা বগুড়ায় থাকতে শুরু করেন এবং তিনি এখনো এই গ্রামে ফিরে আসেননি।

চিকাশি মোহনপুর গ্রামের মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের ছেলে মালয়েশিয়া প্রবাসী মোহাম্মদ মইনুল হাসান (ভোটার নম্বর: ১০১৪৮২০০০২৮৪) ভোট দিয়েছেন বলেও ভোটার তালিকার মাধ্যমে জানা যায়।

মইনুলের মা সালেহা বেগম বলেন, তার ছেলে মালয়েশিয়ায় গিয়েছে প্রায় ১ বছর হলো। সে সেখানে একজন শ্রমিক হিসেবে কাজ করে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

বিষয়টি দাঁড়ালো এমন, যিনি নিহত হয়েছেন ২০১৮ সালের জুন মাসে, তিনি ভোট দিয়েছেন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। হত্যাকারী জেলে, তিনিও ভোট দিয়েছেন। না, জেলে কোনো ভোটকেন্দ্র ছিলো না। ভোট দেওয়ার জন্যে মুক্তিও পাননি, কিন্তু ভোট দিয়েছেন। এক বছর ধরে যিনি মালয়েশিয়ায় আছেন, তিনিও ভোট দিয়েছেন। পোস্টাল ব্যালটের ব্যবস্থা ছিলো না, সেভাবে তিনি ভোট দেনওনি। ভোটার তালিকা অনুযায়ী তিনি সশরীর উপস্থিত হয়ে ভোট দিয়েছেন।

অনুসন্ধানে এ তথ্য জানার পর রিটার্নিং কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত কাগজ পেতে বেগ পোহাতে হয়। এবং তা দেরিতে পাওয়া যায়। ইতিমধ্যে নির্বাচন নিয়ে অসংখ্য অভিযোগ সামনে চলে আসায়, ‘শতভাগ’ ভোটের বিস্তারিত প্রতিবেদন আর প্রকাশিত হয়নি।

সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ফল তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যায়, ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ, ১২৭টি কেন্দ্রে ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে।

যে সংবাদ দ্য ডেইলি স্টারসহ দু-একটি গণমাধ্যম প্রকাশ করেছিলো ১ জানুয়ারি, সেই সংবাদের সত্যতা এখন স্বীকার করে নিলো নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, ‘১০৮টি আসনের ৮৮৯টি কেন্দ্রে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীরা একটি ভোটও পাননি।’ (কালের কণ্ঠ ২ জুলাই, ২০১৯)

প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, “শতভাগ ভোট পড়া কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়, তবে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের করণীয় কিছু নেই।”

কেনো ‘করণীয় কিছু নেই’ তার পক্ষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার যুক্তি দিয়েছেন এভাবে, “ভোটের পর পরই গেজেট আকারে ফল প্রকাশ হয়ে যায়। গেজেট প্রকাশের পর ইসির কিছু করার থাকে না। তাই খতিয়ে দেখার সুযোগ নেই। প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, রিটার্নিং কর্মকর্তা যেহেতু এ বিষয়ে আগে কিছু জানাননি, তাই এখন ইসির কিছু করার নেই।”

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আরো কিছু বিষয় পর্যালোচনার দাবি রাখে।

ক. নির্বাচন কমিশন যেদিন নির্বাচনের ফল গেজেট আকারে প্রকাশের জন্যে (১ জানুয়ারি) বিজি প্রেসে পাঠিয়েছিলো, সেদিনই (১ জানুয়ারি) শতভাগ ভোটের সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিলো।

খ. শতভাগ ভোট, রাতে ভোট, ভোটারের চেয়ে বেশি ভোট, নির্বাচন নিয়ে এমন বহুবিধ গুরুতর অভিযোগ আলোচনায় থাকলেও, তড়িঘড়ি করে গেজেট আকারে ফল ছাপানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো। যদিও আইনগতভাবে এতোটা তাড়াহুড়ার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিলো না। সুযোগ ছিলো অভিযোগগুলোর তদন্তের।

গ.  নির্বাচন কমিশন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ দেখেও তাদের কাছে সত্যতা জানতেও চায়নি। অর্থাৎ বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের ‘অজানা’ ছিলো না।

ঘ. ‘শতভাগ’ ভোট, মৃত বা প্রবাসে থাকা ব্যক্তির ভোট দেওয়াকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলছেন, ‘স্বাভাবিক নয়’। বিষয়টি কি আসলে এতো সহজ বা সরল? প্রথমত, প্রিজাইডিং অফিসার বা রিটার্নিং কর্মকর্তার উপর যে দায়িত্ব ছিলো, তারা তা পালন করেননি। দ্বিতীয়ত, তারা যে দায়িত্ব পালন করেননি বা করতে পারেননি, তা গণমাধ্যমকে বা নির্বাচন কমিশনকে যথা সময়ে জানাননি। নির্বাচন কমিশনের অধীনে থেকে দায়িত্ব পালন করেননি এসব কর্মকর্তারা। ‘দায়িত্ব পালন না করা’ এবং ‘না জানানো’র পক্ষে কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।
দায়িত্ব পালন না করে, তথ্য না জানিয়ে করা ‘অপরাধ’-কে কি ‘স্বাভাবিক নয়’ বলা যায়?

ঙ. প্রিজাইডিং অফিসার বা রিটার্নিং কর্মকর্তা কেনো আগে জানালেন না, তা নির্বাচন কমিশন জানতেও চাননি। গেজেট প্রকাশের পর ফল হয়তো পরিবর্তন করা যাবে না, কিন্তু ‘মৃত ব্যক্তি’র ভোট দেওয়ার অভিনব ঘটনার তদন্তে সমস্যা কী? আইনে কোনো বাধা আছে? ‘করণীয় কিছু নেই’- প্রধান নির্বাচন কমিশনার কি এমন কথা বলতে পারেন?

২. যুক্তি হিসেবে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যার বিষয়টি সামনে আনা হয়। মোট ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৪১ হাজার ১৫৫। শতভাগ ও ৯৯ ভাগ ভোট পড়া কেন্দ্রের সংখ্যা ৩৪০টি। প্রশ্ন হলো, এটি কি বড় কোনো অভিযোগ না ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’? ৪১ হাজারের বেশি কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ৩৪০টি কেন্দ্রে এমন অনিয়মের প্রেক্ষিতে কি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়?

চ. দেশে মোট ভোটার প্রায় ১০ কোটি ৪১ লাখ। নির্বাচন কেন্দ্রিক জরিপ করা হয় এক, দেড় বা দুইহাজার ভোটারের মতামতের ভিত্তিতে। গ্রহণযোগ্য কোনো প্রতিষ্ঠানের করা জরিপের ফলাফলে সাধারণত ভুল প্রমাণ হয় না। সাড়ে ১০ কোটির মধ্যে ২ হাজার মানুষের মতামতভিত্তিক জরিপ যদি গ্রহণযোগ্য হয়, তবে ৪১ হাজার কেন্দ্রের মধ্যে ৩৪০ কেন্দ্রের নজির ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলার সুযোগ থাকে না। ৪১ হাজার কেন্দ্রের অনিয়মের প্রমাণ সামনে আসবে বা আনতে হবে- এটা তো কোনো যৌক্তিক কথা হতে পারে না। তাহলে তো ১০ কোটি ভোটারের মতামত নিয়ে জরিপ করতে হবে। ৩৪০টি কেন্দ্রের ঘটনা তদন্ত করে নির্বাচন কমিশন বলতে পারতো, অন্যত্র এমন কিছু ঘটেছে বা ঘটেনি। কিন্তু, তখন নির্বাচন কমিশন তদন্ত না করে, এখন বলছে ‘করণীয় কিছু নেই’।

ছ. টিআইবি তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে ৫০টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪৭টিতে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছিলো। ৩৩টিতে রাতে সিল দেওয়ার তথ্য জানিয়েছিলো টিআইবি। বিবিসি তাদের সংবাদে একটি কেন্দ্রে আগে ভোটের ভিডিও চিত্র দেখিয়েছিলো। খুলনার একটি আসনে মোট ভোটারের চেয়ে ভোটের সংখ্যা বেশি উল্লেখ করে ফল প্রকাশ করেছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। সেই সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। ভোটারের চেয়ে বেশি ভোটের ভিডিওচিত্র বিশ্লেষণ করে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ করেছিলো ডয়চে ভেলে।

জ. টিআইবির রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচন কমিশন বলেছিলো, রিটার্নিং বা প্রিজাইডিং অফিসারদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করেনি টিআইবি। যাদের কাছে মৃত ব্যক্তিরা এসে ভোট দিয়েছেন, তাদের থেকে তথ্য নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হবে? নির্ভরযোগ্য বিকল্প পথে সংগৃহীত তথ্য গ্রহণযোগ্য হবে না? যারা নির্বাচন কমিশনকে সময়মতো তথ্য জানাননি, তারা টিআইবিকে সঠিক তথ্য জানাবেন, জানাতেন?

ঝ. ভোট শুরু হওয়ার আগে কী করে ব্যালট বাক্স ভরে গেলো? এই প্রশ্নের উত্তর জানার বা জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি নির্বাচন কমিশন। কেন্দ্রটির ভোটগ্রহণ স্থগিত করে দায়িত্ব সেরেছিলো তারা। ভোটারের চেয়ে ভোট বেশি, কী করে এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটলো, জানার প্রয়োজন মনে করেনি কমিশন।

৩. ‘করণীয় কিছু নেই’ বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, কেউ চাইলে আদালতে যেতে পারেন। ’সচিবরা কী করেন, প্রধানমন্ত্রীকে কেনো সবকিছু করতে হয়’, ‘গাড়ির হর্ন’ বা ‘সিজার রোধে নীতিমালা’ বা ‘এডিস মশা-ডেঙ্গু’ থেকে শুরু করে নিরাপদ খাবার, সব বিষয় নিয়েই আদালত কথা বলছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন। যার যা করার কথা তা করছে না বলে, কথা বলতে হচ্ছে, নির্দেশনা দিতে হচ্ছে আদালতকে। সেই নির্দেশনারও অনেকগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

এখন ’মৃত ব্যক্তি’ কেনো বা কীভাবে ভোট দিলেন, প্রতিকার চাইতে যেতে হবে আদালতে!

সাংবিধানিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন তাহলে কী করবে বা তাদের কাজ কী? নির্বাচন কমিশনাররা জনগণের অর্থে দেওয়া সুযোগ-সুবিধা, গাড়ি-বাড়ি-বেতন-ভাতা-প্রটোকল ভোগ করবেন, আর জনগণকে আদালতে যাওয়ার নির্দেশনা দিবেন?
যে নির্বাচন কমিশনের একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার কথা, তারা যদি বলেন ‘কিছু করণীয় নেই’ প্রশ্ন আসে মানুষ তাহলে কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে!

  •  লেখকের ইমেইল —   s.mortoza@gmail.com
  •  কার্টসি —  দি ডেইলি স্টার/ জুলাই ৩, ২০১৯  


Tuesday, July 2, 2019

ঋণের ফাঁদে বাজেট


রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর


রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর

বাজেটের পরিকল্পনা, বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া, খাতভিত্তিক বরাদ্দ ও সমস্যা নির্ধারণ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হচ্ছে। অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ অত্যধিক। প্রতিবছরই বাজেটে বিপুল পরিমাণ ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ঘাটতি মেটাতে ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। বাজেট বাস্তবায়নের হারেও দেখা যায় নিম্নমুখিতা।

চলমান আর্থিক বছরে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কর আদায়ের পরিমাণ যেমন কম, তেমনি করের আওতাও বাড়েনি। গত বছরের জুনে ঘোষিত এ বছরের বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বিধায় সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। ঘোষিত ও সংশোধিত বাজেটের কর আদায়ের পরিমাণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য বিদ্যমান। ২০১৮-১৯ সালে কর থেকে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৫ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। তার মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর কর্তৃক মোট রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। এ লক্ষ্যমাত্রা সংশোধিত হয়ে ২ লাখ ৩ হাজার ৮৪৪ দশমিক ৭৮ কোটি টাকা হলেও এনবিআর জানাচ্ছে, এ বছরের মার্চ নাগাদ ১ লাখ ৫৩ হাজার ৮৪৯ দশমিক ৮৯ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। অন্যদিকে একই অর্থবছরে এনবিআর–বহির্ভূত করের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। অতীত অভিজ্ঞতা বলে এ লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন সম্ভব হবে না।

মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ করদাতা। প্রতিবেশী দেশে অপেক্ষাকৃত কম হলেও করদাতার পরিমাণ ১৮ শতাংশের মতো। পরিসংখ্যান বলছে, সামর্থ্যবান মানুষের ৬৮ শতাংশই করের আওতায় নেই। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় কর-জিডিপি হারও কম। জাতীয় আয়ের যে প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়, তার সঙ্গে সংগতিহীন। একদিকে কর আদায় ঠিকমতো হচ্ছে না, অন্যদিকে টাকা চলে যাচ্ছে বিদেশে। ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেওয়ার প্রয়াস বিদ্যমান।

অন্যদিকে ব্যয় বেড়েই চলছে। ব্যয় দুই প্রকার—রাজস্ব ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাবদ ব্যয়। ঘোষিত বাজেট অনুযায়ী মোট ব্যয় ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। বিগত ১০ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাবদ ব্যয় ৫৫ শতাংশের কোঠায় থাকলেও মে ও জুন মাসে ব্যয়ের তথাকথিত উল্লম্ফন ঘটবে। রাজস্ব ব্যয় মোটামুটি ঘোষিত বাজেট অনুযায়ী হবে। অর্থাৎ ঘাটতি মোকাবিলায় ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাবে।

ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে সুদ-আসল পরিশোধ করতেই বিশাল ব্যয় হচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাতে রাজস্ব ব্যয়ের ১৮ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ফলে দেশের গুণগত সার্বিক রূপান্তরে অত্যধিক প্রয়োজনীয় মানব পুঁজি বা দক্ষ শ্রমশক্তি বিনির্মাণে, তথা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না। উপরন্তু ঋণের পরিমাণ সুদসহ জমতে জমতে পাহাড়সম হলে পরিশোধের কোনো দিকনির্দেশনাও বাজেটগুলোতে নেই।

বাজেট ঘাটতি মেনে নেওয়া যায়, যদি তা অর্থনীতিতে গুণক প্রভাব তৈরি করে। ঋণ বৃদ্ধির অন্যতম বড় কারণ সরকারি চাকরিতে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত পদ সৃষ্টি, গণহারে পদোন্নতির মাধ্যমে বেতনকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি। এ অর্থবছরে বেতন-ভাতার জন্য রাজস্ব ব্যয়ের ২০ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পত্রিকান্তরের হিসাব অনুযায়ী, উপসচিবের ৮৫০টি পদের বিপরীতে ১ হাজার ৫৫৪ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। যুগ্ম সচিবের ৪৫০টি পদের বিপরীতে ৭৮৭ জন, অতিরিক্ত সচিবের শতাধিক পদের বিপরীতে ৪৩৫ জন কর্মরত আছেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। ২০১৭ সালে বিভিন্ন সংস্থায় ১৪২ জন কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে কর্মরতদের মধ্যে ১২ জন সচিবকে অবসরের পর পুনরায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দকৃত ব্যয় কতটা গুণসম্পন্ন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় বারবার সংশোধনের ফলে ঋণের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে অস্বাভাবিক খরচও চোখে পড়ার মতো। পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রাক্কলিত ব্যয় বাড়তে বাড়তে ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। চার লেন সড়ক তৈরিতে যেখানে ভারতে ১১ থেকে ১৩ লাখ ও চীনে ১৩ থেকে ১৬ লাখ মার্কিন ডলার খরচ হয়, সেখানে বাংলাদেশে ৫০ লাখের বেশি। সম্প্রতি রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে অনিয়মের খবর জনসমক্ষে এসেছে। বিভিন্ন প্রকল্পে কোন পর্যায়ের দুর্নীতি হচ্ছে, সহজেই অনুমেয়। এ ছাড়া অর্থবছর শেষে জোড়াতালি দিয়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ৯০-৯২ শতাংশ দেখানো হয়, যা প্রথম ১০ মাসের হিসাবের সঙ্গে কোনোভাবেই সংগতিপূর্ণ নয়।

দেখা যাচ্ছে, দেশের সাধারণ করদাতারাই ঋণ শোধ ও উন্নয়নের মূল উৎস হিসেবে কাজ করছেন। বারবার বলা হলেও আয়কর এখনো কর আদায়ের প্রধান উৎস নয়। মূল্য সংযোজন করের মাধ্যমেই ব্যয় নির্বাহ করতে হচ্ছে। এই আয়-নিরপেক্ষ পরোক্ষ করের বোঝা পুরোটাই সাধারণ জনগণের কাঁধে চেপে বসে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জনগণের ওপর করের ভার বর্তাচ্ছে। বিপরীত দিকে উচ্চবিত্তদের কর পরিহার ও ফাঁকি দেওয়াটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে!২০০৯-১০ অর্থবছরের বাস্তবায়িত বাজেটে মূল্য সংযোজন করের পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। এ অর্থবছরের বাজেট পরিকল্পনায় ভ্যাটের পরিমাণ ধরা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯ বছরে ভ্যাটের হার প্রায় ৩৮০ শতাংশ বেড়েছে! ভ্যাট সরকারের কাছে সোনার ডিম পাড়া হাঁস! এ প্রক্রিয়ায় করব্যবস্থা আরও ব্যাপকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল (রিগ্রেসিভ) হয়েছে।

আবার সাধারণ জনগণকে বড় ঋণখেলাপিদের জন্যও প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে। গত কয়েক বছরে সরকারি ব্যাংকের মূলধন সংকট মেটাতে প্রায় ১৫ হাজার কোটি কর থেকে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ জনগণ করের বোঝা বহন করে চললেও এর বিনিময়ে জনসেবা পাওয়ার চিত্র হতাশাজনক। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে গুণগত উন্নয়ন প্রশ্নের সম্মুখীন। এ ছাড়া নিরাপদ সুপেয় পানি, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সুবিধাসহ অন্যান্য জনসেবামূলক কর্মকাণ্ড মন্থর গতিতে এগোচ্ছে।

৪ কোটি ৮২ লাখ তরুণ বেকার। ৪৭ শতাংশ স্নাতক বেকার।

বাজেটে মৌলিক সমস্যা সমাধানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে না। জিডিপিতে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ২৩ শতাংশে ঘুরপাক খাচ্ছে। নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে। বিপুলসংখ্যক চাকরিপ্রার্থীর জন্য চাকরির বাজার অপর্যাপ্ত। আবার চাকরির বাজারের সঙ্গে শিক্ষার মান সমানতালে বেড়ে উঠছে না। বিদেশ থেকে দক্ষতার ঘাটতি পূরণে জনবল আমদানি করতে হচ্ছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারত প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে। বর্তমানে ৪ কোটি ৮২ লাখের মতো তরুণ বেকার। ৪৭ শতাংশ স্নাতক বেকার। ২০১৬-১৭ সালের শ্রমজরিপ মতে, ১৪ লাখ মানুষ স্থানীয় শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছে, বিপরীতে ১৩ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা ও প্রার্থীদের দক্ষতার অভাব নিয়েও বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা নেই।

দারিদ্র্য কমার হার কমছে


অসমতা বাড়ছে হু হু করে। ২০১৬ সালে বৈষম্য পরিমাপকারী জিনি সূচক শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০১০ সালে শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশ ছিল। ২০১৬ সালে সবচেয়ে দরিদ্র ১০ শতাংশ মানুষের আয়ের অংশীদারত্ব ২০১০ সালের তুলনায় কমে ১ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ হয়েছে। ২০১০ সালে ২ শতাংশ ছিল। ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে প্রতিবছর দারিদ্র্য কমার হার ছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যবর্তী সময়কালে এ হার কমে ১ দশমিক ২ শতাংশে নেমেছে। দারিদ্র্য কমার হার কমছে, দরিদ্র আরও দরিদ্র হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ১৪৫টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চলমান থাকলেও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাভুক্ত লোকের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ। এ খাতে আর্থিক বরাদ্দ নেপাল ও ভুটান থেকেও কম।

উৎপাদনশীল খাতের পরিমাণ বাড়ছে না ও বহুমুখীকরণ হচ্ছে না। এক খাতকেন্দ্রিক নির্ভরতা অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। তৈরি পোশাকশিল্পের বাইরে নতুন কোনো নির্ভরযোগ্য উৎপাদনশীল খাত তৈরি হচ্ছে না। গত ছয় বছরে শিল্পকারখানার সংখ্যাও বাড়েনি, কমেছে ৬০৮টি। ২০১২ সালে বড় শিল্পকারখানা ছিল ৩ হাজার ৬৩৯টি, ২০১৯ সালে সংখ্যা কমে ৩ হাজার ৩১টি হয়েছে। মাঝারি শিল্পকারখানা ৬ হাজার ১০৩টি থেকে কমে ৩ হাজার ১৪টি হয়েছে। ক্ষুদ্র শিল্পকারখানার সংখ্যাও কমেছে। শিল্প খাতে বর্তমানে ১ লাখ ২৯ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। ২০-২২ লাখ চাকরিপ্রার্থী তরুণ-তরুণীর তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। মৌলিক সমস্যাগুলোর এরূপ প্রকটতার মুখ্য কারণ হলো প্রতিষ্ঠানগুলোর ভঙ্গুরতা, বিনিয়োগে আস্থাহীনতা ও পুঁজি পাচার।

বাংলাদেশের বাজেট–ব্যবস্থায় জবাবদিহির চর্চা নেই। বাজেট ঘোষিত হওয়ার পর আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংশোধিত হয়। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী সংশোধিত বাজেট সংসদে উপস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় আলোচনা ছাড়াই আইনে পরিণত হয়। কেন সংশোধনের প্রয়োজন হলো বা কেনই–বা বাস্তবায়িত হলো না, কোনো তর্কাতর্কি হয় না। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, কণ্ঠভোটে বাজেট পাস করা ছাড়া সাংসদদের কোনো প্রকৃত ক্ষমতাও নেই। বাজেট–ব্যবস্থার আমূল সংস্কার আশু প্রয়োজনীয়।

  • ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ও উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন। 
 কার্টসি —  প্রথম আলো/জুন ১৩, ২০১৯।