Search

Thursday, August 22, 2019

আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপির যত দায়

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ

‘চামড়ার দাম নেই। মানুষ রাগে ক্ষোভে চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলতে আহ্বান জানিয়েছেন। কেউ কেউ পুঁতে প্রতিবাদও জানিয়েছেন। কেউ ফেলে দিয়েছেন রাস্তায়। আশ্চর্যের বিষয়, এখনো সরকারের বিশিষ্টজনেরা বলে দেননি যে, এটা গুজব বা এটা বিএনপির ষড়যন্ত্র! তবে এখনো বলেননি বলেই যে বলবেন না তেমনটা বিশ্বাস করা কঠিন। এখনো সে সময় ফুরিয়ে যায়নি। এই সরকারে ক্রিয়েটিভ ব্রেইনের যে পরিমাণ কালেকশন! তারা যে কোনো সময় এই চামড়া কেলেঙ্কারির দায়ও বিএনপির ঘাড়ে চাপিয়ে দিতেই পারেন।
এই কথাগুলো লিখেছিলাম ১৮ আগস্ট দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত কলামে। যদিও লেখাটা পাঠিয়েছিলাম আরও চারদিন আগেই, ১৪ আগস্ট। শোক দিবস ও শুক্রবারের আয়োজনের নিচে চাপা পড়েছিল লেখাটা। লেখা প্রকাশিত হওয়ার দিনই দেখা গেল, মুখ খুলেছেন তারা। যা ভেবেছিলাম তাই বলেছেন। তবে প্রায় একটা সপ্তাহ যে অপেক্ষা করেছেন এই থিওরি দিতে সেটাও কম ধৈর্যের ব্যাপার নয়!


কোরবানির চামড়া নিয়ে একজন মন্ত্রী দেশবাসীকে জানিয়ে দিলেন, কোরবানির চামড়া রাস্তায় ফেলে দেওয়া ও পুঁতে ফেলার পেছনে বিএনপির ষড়যন্ত্র ছিল। তবে তাতেও বরাবরের মতোই বিএনপি ফেল করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, চামড়াশিল্প নিয়ে বিএনপির অপরাজনীতি সফল হয়নি। ব্যাপারটা আরও খোলাসা করেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। তিনি বলেছেন, বিএনপির লোকজন চামড়া কিনে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে। তিনি আরও বলেছেন, এক কোটির মধ্যে মাত্র ১০ হাজার চামড়া অবিক্রীত থেকেছে এবং চামড়া বিষয়ক সংকট নাকি কেটেও গেছে।

এটা কী বললেন তিনি! মাত্র ১০ হাজার চামড়া অবিক্রীত? তাহলে পত্রিকাগুলো কি ভুল লিখল? ভুল তথ্য প্রচার করল টিভি চ্যানেলগুলো? সংবাদমাধ্যমেই তো এসেছে, বিক্রি করতে না পেরে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকায় লাখখানেক কোরবানির পশুর চামড়া মৌসুমি ব্যবসায়ীরা  সড়কে ফেলে দিয়েছেন। সিলেটেও কোরবানির গরুর চামড়া বিক্রি করতে না পেরে রাস্তায় ফেলে দিয়েছেন সিলেট নগরীর কোরবানিদাতারা ও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। পরে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ২০ ট্রাক চামড়া ময়লার সঙ্গে সংগ্রহ করে ডাম্পিং স্পটে পুঁতে ফেলেছে সিলেট সিটি করপোরেশন। ন্যায্য দাম না পেয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে কোরবানির পশুর ৯০০টি চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেছে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার সৈয়দপুর হোসাইনিয়া হাফিজিয়া আরাবিয়া দারুল হাদিস মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষও।

এমন ঘটনা ঘটেছে দেশের প্রায় সব এলাকায়ই। অথচ মন্ত্রী বলে দিলেন, মাত্র ১০ হাজার চামড়া থেকেছে অবিক্রীত। আর কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ১০-২০ টাকা বা ৫০-১০০ টাকায় যে লাখ টাকা দামের গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে তাকে কি বিক্রি হওয়া বলা যায়? গত সোয়া দশক ধরে দেশে যা কিছু অনাচার ঘটছে তার সব কিছুর দায়ই সরকারের ক্রিয়েটিভ ব্রেইনের পলিটিশিয়ানরা বিএনপি বা জামায়াত-বিএনপির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলো ঢাকা। মানুষ মরছে। মহামারীর আতঙ্ক বিরাজ করছে। সিটি কর্তাদের অযোগ্যতা, দুর্নীতি ও দায়িত্বহীনতার সমালোচনা শুরু হলো। অমনি সরকারের কর্তারা বলে দিলেন, এটাও নাকি বিএনপির ষড়যন্ত্র। যদিও সরকারের একজন মন্ত্রী ডেঙ্গু আমদানির কৃতিত্বটা বিএনপিকে দিতে রাজি হননি। নিজেদের কৃতিত্ব দাবি করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘যে দেশ যত বেশি উন্নত হচ্ছে, সে দেশে তত বেশি রোগ-বালাইয়ের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডেঙ্গু এলিট শ্রেণির একটি মশা। এ মশা সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, কলকাতা শহরে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নত দেশ হতে যাচ্ছে। তাই এখন এ দেশে ডেঙ্গু এসেছে।’


কিছুদিন আগে দেশে গুজব ও গণপিটুনিতে নিরীহ মানুষ হত্যা করার হিড়িক পড়ে গেল। সরকার তা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে দায় চাপিয়ে দিল বিএনপির ওপর। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এর মধ্যে আবিষ্কার করলেন বিএনপির হাত। বলে দিলেন, ‘গুজব ছড়িয়ে মানুষ পিটিয়ে মারায় বিএনপি নেতাদের হাত আছে’।

আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকও কম যান না। তিনি বললেন, ‘সাম্প্রতিক খুন-ধর্ষণের ঘটনা বিএনপি-জামায়াতের নিখুঁত ষড়যন্ত্র। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে কোনো একটা ঘটনা ঘটলে তারপর কিছুদিন ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। যেমন পুরান ঢাকায় অগ্নিকা-ের পরবর্তী কিছুদিনের মধ্যে পর পর কয়েকটি অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটল। আবার পর পর কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটল। এখন আবার গণপিটুনি দিয়ে সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটছে। এগুলো নিছক দুর্ঘটনা নয়, এগুলো আসলে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের নিখুঁত ষড়যন্ত্র।’

গাইবান্ধা সুন্দরগঞ্জের আওয়ামী লীগ দলীয় বিনা ভোটের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যার দায়ে বর্তমানে জেলে আছেন আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন শরিক জাতীয় পার্টির এক সাবেক এমপি। কিন্তু হত্যাকা-ের পর পরই এখনকার এক মন্ত্রী বলে দিয়েছিলেন, লিটনকে হত্যার পেছনে বিএনপি-জামায়াতের হাত রয়েছে।

ছাত্ররা কোটা সংস্কার আন্দোলন করে। সেখানেও বিএনপির ষড়যন্ত্র আছে বলে দাবি করেন আওয়ামী লীগের নেতারা। স্পষ্ট বলে দেন, চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীর কোনো সম্পর্ক নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনে হামলা কোনো ছাত্র আন্দোলনের অংশ হতে পারে না। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্রের অপকৌশল। এই অভিযোগ থেকে বাদ যায়নি শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবিতে করা আন্দোলনও। সেখানেও সরকারের লোকজন বিএনপির হাত আবিষ্কারেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন।

দেশে যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখনই বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়ে শেয়ারবাজার। শেয়ারবাজার লুটপাটের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশে অপারগতা জানিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছিলেন, এর সঙ্গে এমন সব নাম যুক্ত আছে যে তা প্রকাশ করা যাবে না। অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য জানার পর আর কারও বুঝতে বাকি থাকে না শেয়ার মার্কেটের হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাটে কত বড় শক্তি জড়িত। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ডাকাতি হয়, সে দায়ও নিতে হয় বিএনপিকেই। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই বলেছেন, এটিএম বুথ জালিয়াতি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিতে বিএনপি-জামায়াতের হাত আছে। খাদ্যে ভেজাল। সেটার জন্যও নাকি বিএনপি দায়ী। তাও যেনতেন নেতার কথা নয়। আওয়ামী লীগের তুখোড় ও সিনিয়র নেতা সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম দিয়েছিলেন এই বাণী।  ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পর গড়িমসি করে এক পর্যায়ে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই আদালতের নির্দেশে সে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। অমনি আওয়ামী লীগের নেতারা বলে দেন, ডিএনসিসি নির্বাচন বন্ধের জন্য বিএনপি দায়ী। রানা প্লাজা ধসেও যে বিএনপি দায়ী সে বহুল আলোচিত পুরনো কথা। বিএনপির কর্মীরা যে ওই ভবনের পিলার ধরে নাড়াচাড়া করে রানা প্লাজা ধসিয়ে দিয়েছিল তার রাজসাক্ষী তো তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই।

এই যে ঈদে-পার্বণে তো বটেই সাধারণ সময়েও রেলের শিডিউল বিপর্যয় হয় তাও বিএনপির হাত ছাড়া হয় না। ‘পুরনো ইঞ্জিনে নতুন বগি’খ্যাত সাবেক রেলমন্ত্রী এমন বক্তব্য দিয়ে একাধিকবার বিখ্যাত হয়েছেন। নতুন রেলমন্ত্রীও কম যান না।   মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচালে বড়ছড়া ব্রিজের ওপর ট্রেন দুর্ঘটনা হয়। আর রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন এক যুগেরও বেশি আগে ক্ষমতা থেকে বিদায় হওয়া দলটির ঘাড়ে সব দোষ দিয়ে বলে দেন, বিএনপি রেল সেক্টর একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে। শুধু দেশের ভেতরেই নয়, দেশের বাইরেও যা কিছু ঘটে তার জন্যও কিন্তু বিএনপি-জামায়াতই দায়ী। বিশ্বাস না হলে দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের সাহায্য নিতে পারেন। তিনি জানেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড  ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা যে নালিশ দিয়েছেন সেটাও জামায়াত-বিএনপির ষড়যন্ত্র।

আওয়ামী লীগ সরকারের যা কিছু ব্যর্থতা তার সব দায় যদি বিএনপিরই হয় এবং সে ষড়যন্ত্র ধরতে ও রোধ করতেও যদি তারা ব্যর্থ হয়, তবে ক্ষমতায় থেকে তারা করছেনটা কী! আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে যত সব অনাচার, অবিচার, গুম-খুন, শেয়ারবাজারসহ আর্থিক খাতে লুটপাট, ভোটের অধিকার হরণ, দুর্নীতি-দুঃশাসন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ধানের দামে ধস, বন্যা-দুর্বিপাক, ঝড়-বৃষ্টি-খরা সব কিছুর জন্য তারা বিএনপির ঘাড়ে দায় চাপালেও একটা গুরুত্বপূর্ণ জেনুইন দায় এখনো চাপায়নি। এখনো তারা কেউ বলেননি, আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করে যে একদলীয় বাকশাল সৃষ্টি করা হয়েছিল সেখান থেকে আবার আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তনেও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দায় আছে।

লেখক —  চিকিৎসক ও কলামনিস্ট। 
কার্টসি —  দেশরূপান্তর/ আগস্ট ২২, ২০১৯।  
লিঙ্ক —  http://bit.ly/2zdrbzr 

Saturday, August 17, 2019

উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য খাতই উপেক্ষিত!

প্রফেসর ড. এম এ মান্নান


চলতি বছর বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৩০ জনের বেশি মারা গেছে (প্রথম আলো অনলাইন, ১৪ আগস্ট)। প্রতি বছর এই সময়টিতে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। তবে এবার পত্র-পত্রিকার খবর অনুযায়ী, এতে আক্রান্ত সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের চিকিৎসায় অবহেলা ও হয়রানি নিয়ে বিস্তর আলোচনা ও সমালোচনাও হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অন্যান্য খাতের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবুও আমরা প্রায়ই তা ভুলে যাই।

সুস্থ ও সবল স্বাস্থ্যের সাথে কর্মঠ জনশক্তি সরবরাহের বিষয়টি জড়িত। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে উৎপাদন যে ব্যাহত হবে, তা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হয় না। স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে দক্ষ ও মানসম্মত শ্রমশক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। আমরা যখন স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের কথা ভাবি, তখন এর বিশাল অর্থনৈতিক দিকটি খতিয়ে দেখি না। অথচ স্বাস্থ্য খাতে যথাযথ বিনিয়োগ ও দূরদর্শী নীতিমালা প্রণয়ন করা হলে এটি আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের যে উদ্বৃত্ত শ্রম রয়েছে, তা বিভিন্ন দেশে উন্নয়নের সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে।

অসুস্থ ব্যক্তিকে ঘরের বাইরে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার উদ্যোগ অটোম্যান সাম্রাজ্য তথা তুরস্কে প্রথম সূচনা হয়েছিল। তখন হাসপাতালে চিকিৎসা করাকে সেবার প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হতো, পণ্য হিসেবে নয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যসেবা একটি অস্বাস্থ্যকর দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে, যা পরিণত হয়েছে সেবা না হয়ে শোষণের পণ্যে। অহেতুক নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে দিয়ে রোগীদের হয়রানি করার অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। চিকিৎসা চালানো প্রায়ই ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিষেধক অপেক্ষা প্রতিরোধ উত্তম- কথাটি আমাদের হাসপাতালগুলো যেন প্রায় ভুলেই গেছে।

আমাদের স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের দিকে তাকালে দেখা যায়, এটা কোনো সুস্থ বিনিয়োগ নয়। আর্ত মানবতার সেবায় জীবন উৎসর্গ করেছেন- এমন চিকিৎসকের উদাহরণ আমাদের দেশে কম নেই। পাশাপাশি, আরেক দল চিকিৎসকের প্রসঙ্গ উঠলে তাদের নামের পাশে নানা নেতিবাচক বিশেষণ যোগ করা হয়। আমাদের স্বাস্থ্য খাতে যে সুষ্ঠু বিনিয়োগ হয় না, সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। দেশে হাসপাতাল নির্মাণের পেছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। অথচ সেই হাসপাতালে না আছে পর্যাপ্ত ডাক্তার, না আছে পর্যাপ্ত চিকিৎসাসামগ্রী। হাসপাতালে ড্রাইভারবিহীন অ্যাম্বুলেন্স ও অ্যাম্বুলেন্সবিহীন ড্রাইভার খুবই সাধারণ ঘটনা। মোট কথা, আমাদের জাতীয় দিকনির্দেশনায় যুগোপযোগী স্বাস্থ্য পরিকল্পনার অভাব প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ প্রায়ই রূপ নেয় অপচয়ে।

আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে অ্যালোপ্যাথিক পদ্ধতির চিকিৎসার ওপর, যা অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায়, সবচেয়ে ব্যয়বহুল। এই সুযোগে এক শ্রেণীর চিকিৎসক সঙ্ঘবদ্ধ অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন। এতে শুধু সম্পদের অপচয় নয়, স্বাস্থ্যসেবা থেকেও মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। ২০১৭ সালের এপ্রিলে বেসরকারি সংস্থা ‘বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ’-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৭৫ শতাংশ মানুষই স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তা ছাড়া, বাজেট ব্যয়ে দুর্নীতি, অবস্থাপনা এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব স্বাস্থ্যসেবাকে দিন দিন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে।

চিকিৎসা প্রসঙ্গ এলে আমরা সবসময় নিরাময়যোগ্য (কিউরেটিভ) প্রতিষেধক নিয়ে আলোচনা করি; প্রতিরোধমূলক (প্রিভেনটিভ) ব্যবস্থা নিয়ে তেমন আলোচনা করা হয় না। শুধু উপদেশ বা কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা দিয়ে আমরা যে অনেককে বহু জটিল ও কঠিন রোগ থেকে বাঁচাতে পারি, সে কথা খুব কমই ভেবে থাকি। কিউবা সরকার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে স্বাস্থ্যসেবায় অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছে। এর মাধ্যমে সেখানে স্বাস্থ্যসেবার যে উন্নতি হয়েছে, তাতে ৪০০ ডলারে যে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যায়, তা পেতে শক্তিধর ও উন্নত প্রতিবেশী দেশ আমেরিকায় ২২ গুণ বেশি অর্থ, অর্থাৎ ৯ হাজার ডলার খরচ করতে হয়।

হিসাব করে দেখা গেছে, রোগের চিকিৎসার চেয়ে রোগের প্রতিরোধ শতকরা ২০০ ভাগ বেশি সাশ্রয়ী। কারো যক্ষ্মা হলে তার চিকিৎসা করা হয়; কিন্তু তার পরিবার ও প্রতিবেশীদের যাতে এই রোগ না হয়, সে ব্যবস্থা নেয়া হয় না। আমরা সহজেই এমন হাসপাতালের কথা ভাবতে পারি যেখানে প্রতিরোধমূলক চিকিৎসার ওপর জোর দেয়া হবে। যে এলাকায় যে রোগের প্রকোপ বেশি, সে এলাকায় সে ধরনের প্রতিরোধমূলক হাসপাতাল স্থাপন করা গেলে সংশ্লিষ্ট রোগের প্রকোপ কমে আসবে। আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থায় বিষয়টি থাকলেও তা এত বেশি অবহেলিত ও অনুল্লেখযোগ্য অবস্থায় রয়েছে, যা না থাকারই নামান্তর। আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থায় আরো যে বিষয়টির অভাব তা হলো হলিস্টিক অ্যাপ্রোচ বা সার্বিক চিকিৎসাব্যবস্থা। যেমন- কেউ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলে তার পরিবার ও প্রতিবেশীরা যেন এই রোগে আক্রান্ত না হয়, সে ধরনের ‘ফলোআপ চিকিৎসা’র ব্যবস্থা হলো হলিস্টিক অ্যাপ্রোচ।

স্বাস্থ্যসেবা অধিকসংখ্যক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে আরেকটি বিষয় বিবেচনা করা যায়। আমাদের দেশের সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে প্রায় বিনাখরচে শিক্ষা নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। পশ্চিমা দেশগুলোতে এটা অকল্পনীয়। আমাদের এসব শিক্ষার্থীর কাছ থেকে দেশ ও সমাজ কী পাচ্ছে, তা ভেবে দেখা দরকার। গরিব মানুষের করের পয়সায় ডাক্তার হয়ে তাদের খুব কমজনই সেই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। আমরা কি এমন হাসপাতালের কথা চিন্তা করতে পারি যেখানে কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসক থাকবেন না? আমাদের মেডিক্যাল কলেজগুলো থেকে পড়াশোনা শেষ করে সনদ নিয়ে যারা বের হন, তারা এখানে বিনামূল্যে বা নামেমাত্র মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেবেন।

বিষয়টি এমন হবে যে, কেউ চিকিৎসক হয়ে বের হওয়ার পর কিছু দিন তাকে সমাজসেবা করতে হবে এবং এটা হবে বাধ্যতামূলক। সরকারি ভর্তুকি দিয়ে শিক্ষা গ্রহণের ফলে তাদের যে সামাজিক দায়ভার তৈরি হয়েছে, তার কিছুটা কমানোর প্রক্রিয়া হিসেবেও একে দেখা যেতে পারে। ধারাবাহিকভাবে প্রত্যেক নবীন ও প্রবীণ চিকিৎসক এখানে সেবা দিয়ে যাবেন। পাশ্চাত্যের অনেক দেশে কেউ মেডিক্যাল স্কুলে ভর্তি হতে চাইলে তাকে কোনো হাসপাতালে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা রোগী সেবার পেছনে ব্যয় করতে হয়। এটা তার বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে যোগ হয়ে থাকে। আবার শিক্ষাগ্রহণ শেষে ইন্টার্নশিপ বা এ ধরনের সোস্যাল সার্ভিসের ব্যবস্থা রয়েছে।

তবে এর জন্য মটিভেশনের প্রয়োজন। মটিভেট বা উদ্বুদ্ধ করা গেলে এমন কাউকে পাওয়া যাবে না যিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে জনকল্যাণে সময় ব্যয় করতে রাজি হবেন না। এর জন্য অবশ্য ব্যাকআপ সুবিধাও থাকতে হবে। প্রত্যেক জেলা সদরে যদি এ ধরনের একটি নির্দিষ্ট ডাক্তারবিহীন হাসপাতাল করা যায় এবং সেখানে জনসেবায় উদ্বুদ্ধ স্বাস্থ্যকর্মীদের শ্রমদানের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে এ দেশের স্বাস্থ্য খাতে অভূতপূর্ব বিপ্লব সাধিত হতে পারে। দুঃখজনক হলো, আমরা বিনিয়োগ করছি নিছক বস্তুগত সুবিধা হাসিলের জন্য, রোগীর মানসিকতার দিকটি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।

আমাদের দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় আরেকটি বিষয় চরম উপেক্ষিত বলা চলে। তা হলো প্রচলিত বা দেশীয় চিকিৎসাপদ্ধতি যাকে বলে ‘কমপ্লিমেন্টারি অ্যান্ড অল্টারনেটিভ মেডিসিন’। প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ায় এবং অনিশ্চয়তার কারণে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের অসংখ্য মানুষ এখন বিকল্প এই চিকিৎসাপদ্ধতির দিকে ঝুঁকছে। এই পদ্ধতি অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য ও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াবিহীন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে রোগী পুরোপুরি ওষুধ ও চিকিৎসকের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজের মধ্যে লুক্কায়িত প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে রোগ নিরাময়ে নিজেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।

‘কমপ্লিমেন্টারি অ্যান্ড অল্টারনেটিভ মেডিসিন’ দুনিয়াজুড়ে একটি বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতি হিসেবে গবেষক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এবং এটি বেশ বিস্তৃতি লাভ করেছে। নানা রকম ভেষজ ওষুধ, যোগব্যায়াম, মেডিটেশন, আকুপাংচার, ফিজিওথেরাপি, মিউজিক থেরাপিসহ বিভিন্ন কমপ্লিমেন্টারি পদ্ধতিই এখন রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ক্ষেত্রে মানুষের আগ্রহের বিষয় ও শেষ ভরসাস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের নিজস্ব জীবন ও জগৎ সম্পর্কে বিস্তৃত জ্ঞান, খাদ্যাভ্যাস, শরীর ও মনের স্বাভাবিক বিন্যাস এবং সেই সাথে প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসাপদ্ধতির সমন্বয় সাধন এই চিকিৎসার বৈশিষ্ট্য। নিউ ইয়র্কে এ ধরনের একটি কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার মিচেল গেইনার এই পদ্ধতিকে বলেছেন ‘সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে এক বিস্ময়কর উপহার’। জীবনের অনেক নিগূঢ় রহস্য রয়েছে, যা মেডিক্যাল ল্যাবরেটরির চৌহদ্দিতে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মেডিক্যাল কলেজে এই ইন্টিগ্রেটেড মেডিসিনের কোর্স চালু করেছে।

অল্টারনেটিভ মেডিসিনের বহু পদ্ধতি হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের সমাজে চালু রয়েছে। ভেষজ, ইউনানী বা হেকিমি, কবিরাজি বা আয়ুর্বেদিক ইত্যাদি চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি আমরা তেমন দৃষ্টি দিতে পারিনি।

স্বল্পব্যয়ের আরেকটি কার্যকর চিকিৎসাপদ্ধতি হচ্ছে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাপদ্ধতি। আমরা অনেকেই হয়তো জানি না এটি পাশ্চাত্যজগতের একটি চিকিৎসাপদ্ধতি। জার্মানির মতো সূক্ষ্ম প্রযুক্তির জন্য খ্যাতিমান দেশও চিকিৎসার জন্য এই পদ্ধতির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করছে। অথচ আমাদের বাংলাদেশের স্বাস্থ্যনীতিতে বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না আজো। এসব চিকিৎসাপদ্ধতি ও ওষুধগুলো আধুনিক করার কোনো উদ্যোগ আমাদের নেই। অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার ওপর জোর দিতে গিয়ে আমাদের দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতির মতো অমূল্য সম্পদ ও জ্ঞান বিলুপ্ত হতে চলেছে। আমরা ভেষজ চিকিৎসার উন্নয়ন ও গবেষণায় বিনিয়োগ করছি না বললেই চলে। এই চিকিৎসা ক্ষেত্রে মেধাবী শিক্ষার্থীদের আগমনকে উৎসাহিত করার মতো কোনো উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা আমাদের নেই।

সরকার এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে কিছু অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন তেমন দেখা যায় না। জাতীয় বাজেটে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয় তার ভগ্নাংশও দেশীয় বা হোমিও চিকিৎসার জন্য দেয়া হয় না। এমন অনেক রোগ আছে যার চিকিৎসায় অ্যালোপ্যাথির তুলনায় হোমিও বা ভেষজ পদ্ধতিতে অনেক বেশি সুফল পাওয়া যায়। আমরা অনেকেই হয়তো জানি না, অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের ৪০ শতাংশই ভেষজনির্ভর। পশ্চিমা চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাথে সমন্বিতভাবে ভেষজ ও অন্যান্য দেশীয় চিকিৎসাপদ্ধতি প্রয়োগ করা গেলে জনগণকে অনেক সস্তায় চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব।

কিন্তু আমরা সস্তায় চিকিৎসাসেবা দেয়ার কথা ভাবি না। আমরা হাসপাতাল তৈরি করছি, রোগী আসবে এই আশায়। হাসপাতাল স্থাপনের আগে আমরা ভাবি, যত বেশি রোগী তত বেশি লাভ বা ব্যবসার প্রসার। আমরা কখনো এমন হাসপাতাল তৈরি করার কথা ভাবি না যেখানে এমন চিকিৎসা দেয়া হবে যেন রোগীর আসা ক্রমেই বন্ধ হয়ে যায়। আমরা কি কখনো এমন হাসপাতাল তৈরির কথা ভেবেছি যেখানে রোগীর ভিড় বৃদ্ধি না পেয়ে কেবল কমতে থাকবে? সম্ভবত কেউ ভাবিনি। অথচ এই ভাবনাই একটি সুস্থ জাতি গঠনের দিকনির্দেশ দিতে পারত। এই ভাবনা সমাজের সার্বিক উন্নয়নের আলোকবর্তিকা হতে পারে।

  • লেখক  —  প্রফেসর ড. এম এ মান্নান,  প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা। 
  • কার্টসি  —  নয়াদিগন্ত/ আগস্ট ১৬, ২০১৯।  

Tuesday, July 30, 2019

বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার লড়াই আপনারও


রুমিন ফারহানা 
আমরা প্রায়ই বলি ‘পৃথিবীতে কেউ অপরিহার্য নয়’। প্রায় সব ক্ষেত্রে কথাটা সত্যিও। কিন্তু একজন নোয়াম চমস্কি কিংবা অনেক ক্ষেত্রেই তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করা স্লোভো জিজেক যখন থাকবেন না, তখন পৃথিবীতে তৈরি হওয়া নতুন কোনও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক-সামাজিক ঘটনা বা প্রেক্ষাপট নিয়ে বিশ্লেষণ করার মতো মানুষ থাকবেই, কিন্তু চমস্কি কিংবা জিজেকের বিশ্লেষণের অভাব কি আমরা বোধ করবো না? কীর্তি এভাবেই কিছু মানুষকে ‘অপরিহার্য নয়’-এর সীমা ছাড়িয়ে নিয়ে যায়।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এই দেশে একজন বেগম জিয়া আমাদের প্রায় সবার জন্য প্রযোজ্য ‘কেউ অপরিহার্য নয়’ এর সীমা পেরিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে অপরিহার্য করে তুলেছেন। এটা প্রমাণ করা খুব সহজ—একটা চরম কর্তৃত্ববাদী সরকার তার অনৈতিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ মনে করেছে বেগম জিয়াকে কারারুদ্ধ করে রাখাকে। শুধু কারারুদ্ধ করে রাখাই যথেষ্ট হয়নি, একজন খালেদা জিয়া এরপরও এতই ভীতি ছড়ান যে, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা এবং শরিক দলের চাটুকাররা ক্রমাগত বিষোদগার করেই যাচ্ছেন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে। এতেই প্রমাণিত হয়, এই রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের জন্য একজন বেগম খালেদা জিয়া কতটা অপরিহার্য।

বেগম খালেদা জিয়া
আমরা নিশ্চয়ই এটা ভুলে যাইনি, স্বৈরাচারী এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান সরকারি দল নির্বাচিত সরকার হটিয়ে তার ক্ষমতা দখলকে সানন্দে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলেছিল তারা অসুখী নন। আমরা ১৯৮৬ সালকেও ভুলে যাইনি। নির্বাচনে অংশ নিয়ে স্বৈরাচারী এরশাদকে বৈধতা দিয়ে আরও অনেক দিন ক্ষমতায় রেখে দেওয়ায় তাদের যে চেষ্টা সেটি কাজ করেনি একজন খালেদা জিয়ার আপসহীন গণতান্ত্রিক সংগ্রামের কারণে। এরপর বর্তমান সরকারের ‘আন্দোলনের ফল’ এক এগারোর সরকারের সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিদেশে চলে গেলেও, খালেদা জিয়া তাতে রাজি হননি। অসাংবিধানিক সরকারের বিরুদ্ধে আবার রুখে দাঁড়ান বেগম জিয়া, যেটা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে দেশে ফিরে আসতে সাহস জোগায়। জনগণের সামনে আবারও প্রমাণ হয়, বর্তমান বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের একমাত্র প্রতীক বেগম খালেদা জিয়া।

খালেদা জিয়ার প্রতি স্বৈরাচার, কর্তৃত্ববাদের ভীতি ছিল, আছে সব সময়ই। তাই রাষ্ট্রে স্বৈরাচারী বা কর্তৃত্ববাদী শাসন চালিয়ে যাওয়ার পূর্বশর্তই হচ্ছে তাকে জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করা। বেগম জিয়ার এই চরিত্র এরশাদ জানতো, জানতো মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং জানে বর্তমান সরকারও। তাই মিথ্যা মামলায় বেগম জিয়া আজ কারারুদ্ধ।

কীভাবে মিথ্যা অভিযোগে বেগম জিয়াকে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে, সেটার খুঁটিনাটি তথ্য এই দেশের মানুষ জানে। সেই বিষয়ে তাই আর বিস্তারিত আলোচনা অপ্রয়োজনীয়। শুধু এটুকু বলি, একজন আইনজীবী হিসেবে আমি নিজে দুদকের মামলায় ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত অভিযুক্তদের মামলায় কাজ করেছি এবং আপিল গ্রহণকালেই জামিন পেতে দেখেছি। স্থায়ী জামিন নিয়ে তাদের অনেকেই এখন বিদেশেও আছেন। এটা যদি হয় একজন সাধারণ অভিযুক্তের ক্ষেত্রে, তাহলে বেগম জিয়ার মতো একজন মানুষের ক্ষেত্রে কী হওয়ার কথা ছিল?

জামিন লাভের ক্ষেত্রে প্রধান যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়, তার মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ হলো—ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা এবং সামাজিক অবস্থান। আর যে বিষয় আদালত দেখে তা হলো—অভিযুক্তের পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে কিনা এবং সাক্ষীকে ভয়ভীতি দেখানো বা আলামত নষ্ট করার ভয় আছে কিনা। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে আদালত যেকোনও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তাৎক্ষণিক জামিন দিতে পারেন। এই আশঙ্কাগুলোর কোনটি বেগম জিয়ার ক্ষেত্রে সত্য, সেটা বিচারের ভার আমি পাঠকদের ওপরই ছেড়ে দিলাম।

তাই আমার আইনের জ্ঞান, অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, বেগম জিয়ার মামলার মেরিট, তার শারীরিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থান, বয়স, জেন্ডার সবকিছু বিবেচনায় বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী তিনি তাৎক্ষণিক জামিন লাভের যোগ্য। জামিন পাওয়া তার অধিকার। আর সবকিছু বাদ দিলেও বর্তমানে তার যে শারীরিক অবস্থা, শুধু সেটাও যদি বিবেচনায় নিই, তাহলে আদালত যদি ন্যূনতম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারতেন, তাহলে তাকে জামিন দিতে বাধ্য হতেন।
 
শনিবার, জুলাই ২৭, ২০১৯, দুপুর দেড়টায় গণতন্ত্রের মা বেগম খালেদা জিয়াকে ভয়াবহ অসুস্থ অবস্থায় বিএসএমএমইউ'র কেবিন ব্লক থেকে চিকিৎসার জন্য এ ব্লকে নেয়া হয়। এ সময় অত্যন্ত অসুস্থ দেখায়, কয়েক জন তাঁকে ধরে দাঁড়াতে সাহায্য করছে। বেগম জিয়ার চোখে মুখে তীব্র কষ্টের অভিব্যক্তি দেখা যায়। 

তার সাম্প্রতিক শারীরিক অবস্থা নিয়ে আমাদের দলের মহাসচিব দুই দিন আগে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, তার শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে অনেক বেশি খারাপ হয়েছে। তিনি এখন বিছানা থেকেই উঠতে পারছেন না। তাকে সবসময় দু’জন সাহায্য করতে হয়। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, সম্প্রতি তার জিহ্বায় ক্ষত তৈরি হয়েছে। তিনি ভালোভাবে খেতে পারেন না; তীব্র দাঁতের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন। তার নতুন শারীরিক জটিলতা হিসেবে যুক্ত হয়েছে ডায়াবেটিস, যা একেবারেই নিয়ন্ত্রণহীন। সঙ্গে তার হাত-পায়ে আগের তীব্র ব্যথা তো আছেই। তার বর্তমান শারীরিক অবস্থায় অনেকেই আশঙ্কা করছেন, তিনি হয়তো আর কখনোই পুরোপুরি সুস্থ হবেন না।

বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০১৮, বিকেলে কারাগারে যাওয়ার সময় সুস্থ শরীরে হেঁটে আদালত থেকে গাড়িতে উঠেন বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। 

গ্রেফতারের পর যখন আদালত থেকে তাকে কারাগারে নেওয়া হচ্ছিল তখনও তিনি সুস্থ শরীরে হেঁটে গাড়িতে ওঠেন, তারপর ক্রমান্বয়েই তার অবস্থার অবনতি হতে থাকে। যেহেতু কারাগারে তিনি সম্পূর্ণ সরকারের হেফাজতে ছিলেন, সুতরাং তার স্বাস্থ্যের এই ক্রমাবনতির জন্য একমাত্র দায়ী করা যায় সরকারকে।

এটা একেবারেই স্পষ্ট, বেগম জিয়া ন্যূনতম প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও পাচ্ছেন না। শুরু থেকেই সরকার তার পছন্দের হাসপাতালে তাকে চিকিৎসা নিতে দিচ্ছে না। কারা অন্তরীণ অবস্থায়ও চিকিৎসার খরচ নিজে বহন করার শর্তে ব্যক্তিগত পছন্দের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার নজির অনেক আছে। এক এগারোর সরকারের সময় আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিল ও মোহাম্মদ নাসিমকে ল্যাবএইড হাসপাতালে আর শেখ ফজলুল করিম সেলিমকে বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও এই সুবিধা গ্রহণ করে স্কয়ার হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিয়েছিলেন।

এমনকি বর্তমান অবস্থায় পছন্দের হাসপাতালে চিকিৎসার অনুমতিও কোনোভাবেই যথেষ্ট না। বেগম জিয়ার শরীর এখন এতটাই ভেঙে পড়েছে যে, যদি বেঁচে থাকতে হয় তাহলে চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে মুক্ত জীবনে ফিরে আসতেই হবে। আবারও বলছি, শুধু তার বর্তমান শারীরিক অবস্থাই তাকে জামিন দেওয়ার জন্য যথেষ্টের বেশি।

সরকারকে এভাবে দোষারোপ করতে দেখে সরকার এবং তার ‘উচ্ছিষ্টভোগী’ বুদ্ধিজীবীরা যে কুতর্ক করে, সেটা কেউ করতে চাইতে পারেন, যুক্তি দিতেই পারেন—বেগম জিয়ার জামিন তো আদালতের এখতিয়ার, এখানে সরকারের কিছুই করার নেই। মজার ব্যাপার হলো, এই দেশের অতি সাধারণ মানুষও জানে, দেশে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা বলে আদৌ কিছু বিরাজ করে না। এজন্যই এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কোনও অপরাধ ঘটলে আমরা দেখি ভুক্তভোগীর স্বজন প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চান। এতে এটা প্রমাণিত হয়, যে বিচার একটা স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার হওয়ার কথা, সেটাও এই দেশে চাইতে হয়। আরও কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো, বিচার চাইতে হয় নির্বাহী বিভাগের প্রধান প্রধানমন্ত্রীর কাছে। ওই মানুষগুলোও জানেন, বিচার বিভাগ বলে স্বাধীন কোনও প্রতিষ্ঠান নেই বাংলাদেশে, সবকিছুই আসলে সরকারের হাতে।

এক এগারোর  অবৈধ সরকার বেগম খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করে। 
এক এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একই ধরনের মামলা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও হয়েছিল। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর সেইসব মামলা হাইকোর্টে ‘খারিজ করানো’ হয়। কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মে সেই মামালার আপিল করা হয়নি। কেন আপিল করা হয়নি, এমন প্রশ্নের জবাবে দুদকের আইনজীবী মিডিয়ায় জানান, দুদক থেকে তাকে আপিল করতে বলা হয়নি। সেই আপিল করা হলেও কী হতে পারতো, সেই বিষয়ে কথা না হয় না-ই বললাম। এদিকে বেগম জিয়ার মূল মামলা তো বটেই, এমনকি তার জামিন ঠেকানোর জন্য পর্যন্ত সরকার সর্বোচ্চ আদালতে ‘যুদ্ধ করে’ যাচ্ছে। এই সরকারের সময়ে এই দেশের বিচার বিভাগ, ‘All are equal but some are more equal than others’ উক্তিটির এক দুর্দান্ত প্রতিচ্ছবি।

সরকারের হাত থেকে নিম্ন আদালতকে মুক্ত করে প্রকৃত অর্থেই স্বাধীন করার চেষ্টার মাশুল দিয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি জনাব এসকে সিনহা। শুধু যে তার নামে যে শুধু মামলা দেওয়া হয়েছে তা নয়, পরিস্থিতি তাকে ভিনদেশে অ্যাসাইলাম চাইতেও বাধ্য করেছে। এ ধরনের নজিরবিহীন ঘটনা দেশের নিম্ন থেকে সর্বোচ্চ সব আদালতকেই একটা স্পষ্ট বার্তা দেয়। এ প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ করবো নিম্ন আদলতের বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতির নীতিমালা সংক্রান্ত শুনানিতে প্রধান বিচারপতির সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘দেশে আইনের শাসন নেই’, ‘সরকার নিম্ন আদালত কব্জা করার পর উচ্চ আদালতের দিকেও হাত বাড়িয়েছে’।

বেগম জিয়ার জেলে থাকা মানে শুধু একজন ব্যক্তির জেলে থাকা না, তার জেলে থাকা মানে দেশের আপসহীন গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতীকে পরিণত হওয়া মানুষটির জেলে থাকা। তার জেলে থাকা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় অনেক ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন করা আমাদের দেশটির সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মতো বিচার বিভাগও একেবারেই ভেঙে পড়েছে। এই রাষ্ট্র এখন কার্যত টোটালিটারিয়ান চেহারা নিয়েছে।

বেগম জিয়ার জেলে থাকা আসলে একটি উপসর্গ, যেটা আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভেঙে পড়াকেই প্রমাণ করে। তাই বেগম জিয়ার অধিকারের পক্ষে কথা বলা মানে আসলে আমাদের রাষ্ট্রটির কাঠামো টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে শামিল হওয়া। বেগম জিয়ার রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে যে কারো দ্বিমত থাকতেই পারে, তার কাজের সমালোচনাও থাকতে পারে যে কারো মনে। সেই দ্বিমত প্রকাশিত হোক, সমালোচনা হোক। কিন্তু তারপরেও সব শ্রেণি-পেশার মানুষের তার মুক্তির সংগ্রামে যুক্ত হওয়া জরুরি। এই লড়াই শুধুমাত্র একটি বিশেষ দল বা মতাদর্শের মানুষের নয়।

আমাদের এটা বোঝা দরকার, এটা শুধু বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার লড়াই না, এটা আসলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আর ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাতে উপর্যুপরি রুদ্ধ হওয়া গণতন্ত্রকে মুক্ত করার সংগ্রাম, আইনের শাসন আর ন্যায়বিচার কায়েমের সংগ্রাম, নির্বাহী বিভাগের কড়াল থাবা থেকে বিচার বিভাগকে মুক্ত করার সংগ্রাম, রাষ্ট্রের মালিকানা গণমানুষের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার সংগ্রাম। তাই এই সংগ্রাম আপনার, আমার, আমাদের সবার।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য। 

Thursday, July 25, 2019

ডেঙ্গুজ্বর — দায় এড়াতে পারবে না সরকার ও মেয়রদ্বয়

অরুন রহমান 




“আমরা ভাবতেই পারিনি ওর ডেঙ্গু। কারণ কোন লক্ষণই ছিল না। শুক্রবার দুপুরে ডেঙ্গু ধরা পড়ল। শনিবার সকালেই মারা গেল আমার ছোট্ট মুসা।”
—  সানজীদা আলম আঁখি, ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ৩৪ দিনের শিশু মুসা মাহমুদের মা।  Sarabangla.net, সোমবার, জুলাই ২৩, ২০১৯।  

বিশ্বে জ্ঞানবিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য অগ্রগতি সত্ত্বেও মানবজাতিকে প্রতিনিয়তই আনপ্রেডিক্টেবল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হতে হচ্ছে। পূর্বাভাস ছাড়াই চলে আসে ভয়াবহ বিপদ, ঘটছে প্রাণহানি ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। তাই রাস্ট্রকে সর্বদা সবধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আগাম তৈরি থাকতে হয়। তবেই সেই রাস্ট্র সফল। 

আজ থেকে ১৯ বছর পূর্বে ২০০০ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গুজ্বর সেই ধরনের সর্বনাশা বিপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়। দুঃখজনক হলো, সরকার ও সিটি কর্তৃপক্ষ এই রোগের ভাইরাসবাহী এডিসমশা নিধন করতে উদাসীনতার প্রমাণ রেখে চলেছে।  ২০১৭ পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার মানুষ এতে আক্রান্ত হয়। আর মারা যায় ২৬৫ জন। গত বছরও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে ১০ হাজার ১৪৮ জন, যার মধ্যে মারা গেছে ২৬ জন। 

জুলাই ২৪, ২০১৯, ভয়েস অব আমেরিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই বছর ইতোমধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৪ লাখ মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত। একাধিক সূত্র ৩০ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। চারজন চিকিৎসকও এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

এই রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি যেমন আছে, তেমনি এর চিকিৎসা খরচও ব্যয়বহুল।

শহরজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ। শিশুর জ্বর কমছে না, শরীরেও প্রচণ্ড ব্যথা। জ্বরাক্রান্ত সন্তান নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকেরা চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভিড় করেছেন। গতকাল বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে শিশু হাসপাতালে। ছবি: জাহিদুল করিম/প্রথম আলো। 


প্রকৃতচিত্রে, এবার ঢাকা শহরের পাড়ায় পাড়ায় শিশু, নারী, বৃদ্ধ নির্বিশেষে মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। জুলাই ২৫, প্রথম আলোর হেডলাইন হচ্ছে, ডেঙ্গু রোগী নিয়ে হাসপাতালে হিমশিম অবস্থা। এই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, হাসপাতালের ওয়ার্ডের বিছানা, মেঝে ও বারান্দায় রোগী, তাও জায়গা হচ্ছে না। কি ভয়াবহ পরিস্থিতি, ডেঙ্গু রোগী নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে স্বজনেরা ছুটছেন, কিন্তু বারান্দায়ও জায়গা পাচ্ছেন না! ডাক্তার ও নার্সের অভাব। প্রথম আলোর এই রিপোর্টেই বলা আছে, নার্সেরা আদৌ ডেঙ্গুর চিকিৎসা সেবা সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন না। মরার উপর খাড়ার ঘা এর মত, ডেঙ্গু টেস্টের নামে অনেক টেস্ট দেয়া হচ্ছে যা প্রতিদিন করাতে বলা হচ্ছে। ডেঙ্গু চিকিৎসার জাতীয় কোন গাইডলাইনও করা হয়নি। ব্যয়বহুল টেস্টের খরচ কমানোর কোন ব্যবস্থা নেয়নি। 

অথচ, সরকার ও সিটি কর্পোরেশন  এডিস মশা নির্মূলে চরম উদাসীনতা ও ব্যর্থতা দেখিয়ে চলেছে। আগাম কোন পরিকল্পনা এবং কার্যকর কর্মসূচী নেয়া হয়নি। ফলে কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েই চলেছে। ঢাকার মেয়রেরা স্বীকার করেছেন, মশা নিধনের ওষুধ কাজ করছে না। জনগুরুত্ব বিবেচনায় উচ্চ আদালতও মশা নিধন করতে বলেছে। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পক্ষ থেকে জরিপে পাওয়া যায়, মে মাসের শুরুতে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ৯৭টি ওয়ার্ডের ১০০টি স্থানে এই মশার লার্ভার ব্যাপক অস্তিত্ব। অথচ কর্তৃপক্ষ মশা নিধন করেনি। 

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। প্রাণহানির সংখ্যাও উদ্বেগজনক। মশার কামড় থেকে বাঁচতে বাসাবাড়ির পাশাপাশি হাসপাতালেও মশারির ব্যবহার হচ্ছে। গতকাল শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
ছবি: সাজিদ হোসেন/ প্রথম আলো। 


‘লোকদেখানো মশকনিধন’ শিরোনামে প্রথম আলোতে জুলাই ২৪, ২০১৯, এক রিপোর্টে দেখানো হয়েছে মশা নিধন কর্মসূচী চলছে নামে মাত্র এবং তা অকার্যকর। আর তাই ডেঙ্গু এবার আরো ভয়াবহতা নিয়ে ব্যাপক আকারে ঢাকাতে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায়ও এই জ্বরটি  হচ্ছে এখন । 

এই বছর, ডেঙ্গু আক্রান্তদের অনেকের প্রথম দিকে রোগটির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, জ্বর শেষ হওয়ার পর দ্রুত শারিরীক বিপর্যয় দেখা দেয়। চিকিৎসকেরাও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারছেন না।  ব্রেনের প্রদাহ হয়, রোগীর খিঁচুনি হয়, রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়, রোগীর নার্ভে ইনফেকশন হয়ে প্যারালাইসিস (গুলেন বারি, স্কুইন্ট) হয়, হার্টে মায়োকার্ডিটিস হয়। সে ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থাকে। লিভারে প্রদাহের সঙ্গে অগ্ন্যাশয় ও পিত্তথলির (পাথর না থাকলেও) প্রদাহ হয়। কিডনি ফেইলুর হয়। রক্ত বমি, কালো পায়খানা, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যায়। চামড়ার নিচে রক্ত জমে। প্রস্রাব কমে যায়, লিভার বড় হয়, লিভারের এনজাইম অনেক বাড়ে। বুকে, পেটে পানি জমে, ফুসফুসে পানি জমে শ্বাসকষ্ট হয়। প্রেসার খুব নেমে যাওয়ার কারণে রোগী আবলতাবল বকে রেস্টলেস হয়। একই কারণে অর্গান বা মাল্টি অর্গান ফেইল করে। 

ঢাকা শহরের খোলা জলাশয়, খাল, নদীপাড়, রেলপথ, সড়কপথ, নির্মাণাধীণ সড়ক, ড্রেন, ঝোপঝাড়, ডাস্টবিন, রাস্তাঘাট, অলিগলি সর্বদা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব। এই ছাড়া,  নির্মাণাধীন ভবনের আশেপাশে জমানো পানি, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, প্লাস্টিক বালতি, পানির চৌবাচ্চা ও ফুলের টব, এসির পানিতে এডিস মশার প্রজনন বা বংশবিস্তার হয়ে থাকে। নাগরিকদের সচেতন করে তাঁদেরকে জড়িত করে কর্মসূচী নিতে সিটি কর্তৃপক্ষকে নেতৃত্ব দেয়ার কথা। 

কিন্তু, পরিতাপের বিষয় ১০ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ভোট ডাকাতি করে পুলিশি শক্তি দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে। এই দীর্ঘ সময় ধরে তারা জনকল্যাণে যে কোন কাজ করছে না, তার প্রমাণ চার লাখ নাগরিকের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া। সরকার এবং তার বিনাভোটের দলীয় মেয়রেরা যদি নাগরিকদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকত, তাহলে এডিস মশা নির্মূলের মত সাধারণ একটি কাজ তারা করতে পারতেন। ভোট ছাড়া যেহেতু ক্ষমতায় থাকা যায়, মেয়র হওয়া যায়, তাই তারা আসলে জনসেবায় উদাসীন, আর ব্যস্ত থাকছেন ব্যাঙ্ক ডাকাতি, শেয়ারবাজার ডাকাতিতে। নাগরিকদের থেকে চুষে নেয়া হচ্ছে ভ্যাট ও ট্যাক্সের নামে তাঁদের কষ্টার্জিত অর্থ। বিনিময়ে, মশার কামড় থেকেও বাঁচতে পারছে না তারা।  

মেয়রেরা আপনাদের এসব ব্যর্থতার দায় আর কতদিন এড়াবেন? উচ্চমূল্যে ঔষুধ কিনছেন, তাতে মশা মরছে না। আগে থেকেই জানতেন এডিশ মশার বিস্তার বাড়ছে ফি বছর, কিন্তু মশা মারছেন না। লোক দেখানো, ঔষধ ছিটানো, লিফলেট বিতরণ, মিডিয়ায় কথা আর এসএমএস বার্তা কিন্তু নগরবাসীকে রেহাই দিচ্ছে না। ভয়াবহ ডেঙ্গুতে মরছে মানুষ, ভুগছে সবাই। ঢাকা এখন ডেঙ্গু আতঙ্কে কাঁপছে।    

— লেখক, ইন্টারনেট এক্টিভিস্ট ও সংগঠক ' অর্গানাইজিং ফর বেস্ট বাংলাদেশ'। 

Saturday, July 20, 2019

শহীদ জিয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জয় — ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর, দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল (অব.) জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ২৬ অক্টোবর সকাল ৯টা ৫ মিনিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখার জন্য টিচার্স স্টুডেন্ট সেন্টার মিলনায়তনে (টিএসসি) আগমন করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে শিক্ষকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখার জন্য ক্যাম্পাসে আগমন করবেন, এ সংবাদ জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ফজলুল হালিম চৌধুরী শিক্ষকমণ্ডলীকে টিএসসিতে উপস্থিত থাকার জন্য একটি সার্কুলারের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রিত শিক্ষকদের মধ্যে আমিও সেদিন সময়মতো টিএসসিতে উপস্থিত হয়ে পেছন দিকের সারিতে আসন গ্রহণ করি।

কর্মকর্তাদের ব্যস্ততা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বুঝতে পারি যে, মাননীয় চ্যান্সেলর টিএসসিতে সময় মতোই এসে পৌঁছেছেন। সামরিক ব্যক্তি হিসেবে জিয়াউর রহমান সময়ের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন কিন্তু মিলনায়তনে প্রবেশে তার বিলম্ব হচ্ছিল। বিলম্বের কারণ পরে জানতে পেরেছি। চ্যান্সেলর ও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনে গাড়ি থেকে নেমেই পশ্চিমদিকে রোকেয়া হলের সামনে কিছুসংখ্যক ছাত্রীকে এবং রাস্তার উত্তর পাশে তৎকালীন পাবলিক লাইব্রেরির (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি) পাশে কিছুসংখ্যক ছাত্রকে কালো পতাকা হাতে বিক্ষোভ করতে দেখেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেন, তিনি বিক্ষোভরত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন ও কথা বলবেন। এ কথা জানতে পেরে উপাচার্য ফজলুল হালিম চৌধুরী বিচলিত হন এবং বিক্ষোভরত ছাত্রছাত্রীদের কাছে না যাওয়ার জন্য চ্যান্সেলরকে অনুরোধ করেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়া তার অনুরোধকে উপেক্ষা করে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের সঙ্গে না নিয়ে শুধু ভিসি ফজলুল হালিম চৌধুরী, ঢাকা সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত এবং প্রেসিডেন্টের পিএসওকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে রোকেয়া হলের সামনে বিক্ষোভরত ছাত্রীদের কাছে এবং পরে রাস্তার উত্তর পাশে অবস্থানরত ছাত্রদের কাছে যান। প্রেসিডেন্টের এহেন অপ্রত্যাশিত আচরণে তারা হতচকিত হয়ে যায়। কেন কালো পতাকা দেখানো হচ্ছে, কি তাদের বক্তব্য; তা জানতে চাইলে ছাত্রীরা তেমন কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি এবং কোনো অশোভন আচরণ করেনি। কিন্তু ছাত্রদের কাছে প্রেসিডেন্ট জিয়া কিছুটা প্রতিরোধ ও অশোভন আচরণের সম্মুখীন হন। ছাত্রদের মধ্য থেকে প্রথমে তাকে ধুলাবালি নিক্ষেপ এবং পরিবর্তীতে ধাক্কা দেওয়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটে বলে জানতে পারি। ছাত্ররা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এবং জিয়াউর রহমানকে ফিরে যাওয়ার দাবিতে তার সামনেই স্লোগান দেয় এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। প্রেসিডেন্ট জিয়া শান্তভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন এবং বিক্ষোভকারী ছাত্রছাত্রীদের তার সঙ্গে টিএসসিতে নিয়ে আসেন। টিএসসির উপরের ব্যালকনিতে ছাত্রছাত্রীদের জন্য ত্বরিত ব্যবস্থায় জায়গা করে দেওয়া হয়। টিএসসির অভ্যন্তরে অবস্থানরত শিক্ষকরা বিস্মিত হন ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি দেখে। চ্যান্সেলর শিক্ষকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখার কথা, সেখানে ছাত্রদের উপস্থিতি তো কাম্য নয়। আমরা তখন পর্যন্ত টিএসসির বাইরে কি ঘটেছে তা অবহিত ছিলাম না বলে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতির কারণ বুঝতে পারিনি।

মঞ্চে দুটি চেয়ার শোভা পাচ্ছিল। একটি প্রেসিডেন্ট ও চ্যান্সেলরের জন্য এবং অপরটি উপাচার্যের জন্য। মহামান্য প্রেসিডেন্ট ও চ্যান্সেলর মঞ্চে উপবিষ্ট হওয়ার পর যথারীতি জাতীয় সংগীত ও কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে মতবিনিময়ের ওই সভা শুরু হয়। উপাচার্য অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী স্বাগত ভাষণ শেষ করে চ্যান্সেলর ও প্রেসিডেন্টকে বক্তব্য রাখার আমন্ত্রণ জানান। প্রেসিডেন্ট জিয়া মঞ্চের টেবিলে তার সামনে স্থাপিত মাইক্রোফোনে উপাচার্যকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকে বক্তব্য রাখার আহ্বান জানাতে নির্দেশ দেন। তিনি অনেকক্ষণ থাকবেন, তাই শিক্ষকদের বক্তব্য তিনি শুনতে চান। প্রেসিডেন্ট জিয়ার এই আহ্বানে উপাচার্য সমস্যায় পড়ে যান। চ্যান্সেলর হিসেবে যেহেতু শিক্ষকদের উদ্দেশে শুধু প্রেসিডেন্ট জিয়ার বক্তব্য রাখার কথা, তাই সঙ্গত কারণেই সভায় বক্তব্য রাখার জন্য কোনো শিক্ষকের নামের তালিকা আগে থেকে প্রস্তুত ছিল না। সে কারণে উপাচার্য মঞ্চের সামনে এসে সম্মুখ সারিতে উপবিষ্ট প্রবীণ শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির তৎকালীন সভাপতি মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক বি. করিমকে আমন্ত্রণ জানান।

অপ্রস্তুত অবস্থায় প্রফেসর বি. করিম প্রায় ১০ মিনিট বক্তব্য রেখে শেষ করার মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট জিয়া প্রফেসর বি. করিম সাহেবকে আরও স্পষ্ট বক্তব্য, আরও কিছু সময় নিয়ে বলার আহ্বান জানান। প্রফেসর বি. করিম সাহেবের অনুরোধে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রেজিস্ট্রার বদরুদ্দিন আহম্মদ মঞ্চের দক্ষিণ পাশ থেকে এক গ্লাস পানি বক্তৃতা স্ট্যান্ডে নিয়ে এলে, সারা মিলনায়তনে একটু হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াকেও মৃদু হাসতে দেখা যায়। আমাদের অজান্তে সৃষ্ট টিএসসির বাইরের বিব্রতকর পরিস্থিতির পর এ ধরনের একটু হাস্যরস পরিবেশকে হালকা করতে সাহায্য করে বলে পরবর্তীতে আমার কাছে মনে হয়েছে। প্রফেসর বি. করিম আরও পাঁচ মিনিটের মতো বক্তব্য রেখে তার বক্তব্য শেষ করেন। এই পর্যায়ে মাইক্রোফোনে পুনরায় প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ ভেসে আসে। তিনি উপাচার্যের উদ্দেশে বলেন, প্রবীণ শিক্ষকরা বোধহয় সব কথা স্পষ্টভাবে বলতে চান না। তাই অপেক্ষাকৃত তরুণ শিক্ষকদের মধ্য থেকে বক্তব্য রাখার জন্য আহ্বান করুন। উপাচার্য পুনরায় দর্শক সারির সামনের কাতারের সিনিয়র প্রফেসরদের সঙ্গে পরামর্শ করে মাইকে গিয়ে বক্তব্য রাখার জন্য আমার নাম ঘোষণা করেন। প্রথমে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। দ্বিতীয় ঘোষণায় ভূতত্ত্ব বিভাগের নাম উল্লেখ করে ঘোষণা দেওয়ায় সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় মিলনায়তনের পেছনের দিক থেকে মঞ্চে ছুটে গেলাম। প্রেসিডেন্ট জিয়া আমাকে নির্ভয়ে বক্তব্য রাখার অভয় দিলেন।

অপেক্ষাকৃত তরুণ শিক্ষকদের মধ্যে আমার ডাক পড়ল কেন, তার একটু ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে তখন দুটি গ্রুপের অস্তিত্ব ছিল। শিক্ষকদের মধ্যে বিভিন্ন নির্বাচনের সময় শিক্ষকরা দুই ভাগে দুই রংয়ের কাগজে প্যানেল ছাপিয়ে নির্বাচন করতেন। একটি ছিল 'নীল দল' (আওয়ামী সমর্থিত) এবং অপরটি ছিল 'গোলাপি দল' (আওয়ামীবিরোধী)। বর্তমানে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীদের দল 'সাদা দল' নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি দলের অস্তিত্ব বিদ্যমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিতে তখন নির্বাচিত ছিল প্রফেসর বি. করিমের নেতৃত্বে 'নীল দল'। সেই সময় 'গোলাপি দল'-এর আহ্বায়ক ছিলেন প্রফেসর আহম্মদ শরীফ এবং আমি ছিলাম সদস্য সচিব। শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে 'নীল দল'-এর প্রতিনিধির বক্তব্য হওয়ার পর ভারসাম্যতা রক্ষার জন্য 'গোলাপি দল'-এর পক্ষে বক্তব্যের পালা। প্রেসিডেন্টের বক্তব্য প্রদানের আহ্বানে স্বাভাবিকভাবেই আমার নাম আসে। উল্লেখ্য, আমি তখন ভূতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মধ্যে ভালো বক্তা হিসেবেও আমার পরিচিতি ছিল।

আমি ওই সভায় সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যা ও দেশের বিরাজমান অবস্থার ওপর খোলাখুলি বক্তব্য উপস্থাপন করলাম। প্রায় ১৫ মিনিট বক্তব্য রাখার পর আমার বক্তব্য শেষ করতে যাচ্ছিলাম, তখন প্রেসিডেন্ট জিয়ার গম্ভীর কণ্ঠ মাইক্রোফোনে ভেসে এলো। শেষ করবেন না, আরও বলুন। আপনি স্পষ্টভাবে বলছেন, আরও বলুন। প্রেসিডেন্টের এ আহ্বানে আবার ১৫ মিনিটের মতো বক্তব্য রাখার পর শেষ করতে চাইলে, পুনরায় প্রেসিডেন্ট একই নির্দেশ প্রদান করেন। আমি তিন ধাপে প্রায় ৪৫ মিনিট বক্তব্য রেখে বক্তব্য শেষ করি। মঞ্চ ত্যাগ করার প্রাক্কালে প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ আবার ভেসে এলো। যাবেন না, আপনি বহু জরুরি বিষয় উত্থাপন করেছেন, সমস্যার সমাধানে সুপারিশ করেছেন। কিন্তু এখনো আপনার উত্থাপিত অনেক প্রশ্নের জবাব মেলেনি। আপনার কাছে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। আপনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকমণ্ডলী দেশ ও জাতি সম্পর্কে অনেক ভাবেন। আপনার উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর আপনাকেই দিতে হবে।

আমার প্রায় ৪৫ মিনিটের বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাজমান পরিস্থিতি, ছাত্ররাজনীতির অবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে গোলাগুলির ঘটনা ও তার সম্ভাব্য সমাধানের প্রস্তাবনা, শিক্ষক-ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্নমুখী সমস্যা, ডাকসু নির্বাচনসহ দেশের চলমান সামরিক শাসন প্রত্যাহার, আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষাব্যবস্থা এবং তার সমাধানের সম্ভাব্য প্রস্তাব উপস্থাপন করি। আমার বক্তব্যের বিষয়বস্তু, ব্যাখ্যা ও মন্তব্যের মধ্যে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সন্তুষ্ট হওয়ার মতো কোনো উপাদান ছিল না। আমার স্পষ্ট ও সাহসী বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট জিয়া অসন্তুষ্ট না হয়ে বরং প্রশংসা করেন।

আমার তিন দফায় বক্তৃতার পর শুরু হয় প্রশ্নোত্তরের পালা। প্রেসিডেন্ট জিয়া আমাকে প্রশ্ন করেন শিক্ষাদানের শ্রেষ্ঠ এই বিদ্যাপীঠে অস্ত্রের উপস্থিতি কেন? আমি এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন রাখি। যে অস্ত্র সশস্ত্র বাহিনীর জন্য বিদেশ থেকে আমদানি হয় অথবা গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে প্রস্তুত হয়, সেসব অস্ত্র সশস্ত্র বাহিনীর চার দেয়াল অতিক্রম করে কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে তার জবাব দেবেন দেশের মহামান্য প্রেসিডেন্ট, দেশের সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাপ্রধান, না কি আমার মতো একজন নিরীহ শিক্ষক? প্রেসিডেন্ট জিয়া এ ধরনের জবাব হয়তো প্রত্যাশা করেননি বা পছন্দ করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মধ্যে কেন গোলাগুলির ঘটনা ঘটে প্রেসিডেন্টের এ প্রশ্নের জবাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসুসহ বিভিন্ন হলের নির্বাচন ১৯৭৩-এর পর থেকে না হওয়ার কারণে গণতন্ত্রের চর্চার অভাবে ছাত্রদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের প্রক্রিয়া হিসেবে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। এ প্রসঙ্গে আমি ডাকসু ও বিভিন্ন হলের ছাত্র সংসদ নির্বাচনসহ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনঃ চালু করার দাবি উত্থাপন করি। উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সময়কালে ছাত্রলীগ ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রলীগের সমর্থকদের মধ্যে প্রতিনিয়তই সংঘর্ষ ও অস্ত্রের মহড়া চলত।

দেশ থেকে চলমান সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবিতে তখন সারা দেশের জনগণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা সোচ্চার ছিল। আমি এই সর্বজনীন দাবিটি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে প্রেসিডেন্টের সামনে উপস্থাপন করি। আমি নির্ভয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে উদ্দেশ করে এ কথাও বলি যে, আপনি যখন জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, তখন কি ধারণা করেছিলেন, এ স্বাধীন দেশে পুনরায় পাকিস্তানের মতো সামরিক আইন জারি হবে? দেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সামনে সামরিক আইনের এ ধরনের কঠোর সমালোচনা কেউ প্রত্যাশা করেননি। হয়তো দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও চ্যান্সেলর জিয়া একজন তরুণ শিক্ষকের মুখ থেকে এ ধরনের সাহসী উচ্চারণ আশা করেননি। এ ধরনের আরও অনেক বিষয়ে প্রাসঙ্গিক অথচ অপ্রিয় কথা সেদিন প্রেসিডেন্ট জিয়ার সামনে বলেছিলাম। প্রশ্নোত্তর চলেছিল প্রায় আধা ঘণ্টার মতো। আমার বক্তব্য ও প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হওয়ার পর সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আবুল কালাম আজাদ এবং সাংবাদিকতা বিভাগের তৌহিদুল আনোয়ার আমার বক্তব্যের সমর্থনে মিলনায়তনের ফ্লোর থেকেই কিছু বক্তব্য রাখেন। এ পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট জিয়া মন্তব্য করেন যে, এরই মধ্যে সব বলা হয়ে গেছে। আর কারও বক্তব্য রাখার প্রয়োজন নেই।

বক্তব্য শেষ করে নিজের আসনে বসে প্রেসিডেন্ট জিয়ার বক্তব্য শোনার জন্য অপেক্ষা করি। আমার ধারণা ছিল, তিনি আমার বক্তব্য এবং টিএসসির বাইরের ঘটনা নিয়ে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ও রূঢ় বক্তব্য রাখবেন। আমার মতো মিলনায়তনে উপস্থিত সব শিক্ষক ও ভ্যালকনিতে উপস্থিত সব ছাত্রছাত্রী (যারা আমার বক্তৃতার সময় মুহুর্মুহু করতালি দিয়েছিলেন) সবার আশঙ্কা আমার মতোই ছিল। কিন্তু আমাদের সবাইকে বিস্মিত করে প্রেসিডেন্ট জিয়া আমার বক্তব্যের বিভিন্ন ইস্যুতে সমর্থন এবং প্রশংসা করেন। টিএসসির বাইরের ঘটনার কোনো উল্লেখও করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সভায় প্রেসিডেন্ট জিয়া ১৯৭৯-এর প্রথমাংশে সাধারণ নির্বাচন এবং সামরিক আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য দুটি হল, ছাত্রীদের জন্য একটি হল এবং শিক্ষকদের জন্য আবাসিক সুবিধা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ প্রদানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার ঘোষিত বরাদ্দ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরবর্তীতে ছাত্রদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হল এবং ছাত্রীদের জন্য সামসুন্নাহার হল নির্মাণ করা হয়। শিক্ষকদের জন্য সেই বরাদ্দ থেকে উদয়ন স্কুলের দক্ষিণ পাশে ও ফুলার রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়া তার বক্তৃতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের গণতান্ত্রিক চর্চার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আশ্বাস প্রদান করেন। তার প্রতিশ্রুত ডাকসু নির্বাচন কয়েক মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৪৫ মিনিটের বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের কিছু সত্য ঘটনা উল্লেখ করে দেশের জনগণ এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে খাটো করে দেখার অপপ্রয়াসের সমালোচনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের মানুষ যে দেশপ্রেম, সাহসিকতা ও ত্যাগী মনোভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, ঠিক সেই মনোভাব নিয়ে দেশ গড়ার লক্ষ্যে সবাইকে এগিয়ে আসার জন্য দেশবাসীকে তিনি আহ্বান জানান। তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে বলেন, বিশ্ব আগে আমাদের যে চোখে দেখত, এখন আর সে চোখে দেখে না। আজ বিশ্বের মধ্যে আগের চেয়ে আমাদের অনেক বেশি বন্ধু দেশ রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট জিয়া বলেন, আমাদের দেশ আকারে ছোট কিন্তু সমস্যা বিরাট। কোনো বিদেশি নীতি-রীতি ও তন্ত্র আমাদের দেশের সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, দেশকে উন্নত করতে হলে আমাদের যে চারটি বিষয়ে আন্তরিক হতে হবে। তা হলো- ১. জাতীয় চেতনা ২. একতা, ৩. কঠোর পরিশ্রম ও ৪. আত্দবিশ্বাস। তিনি পুরনো চিন্তার বদলে নতুন চিন্তা এনে সমাজ প্রগতিতে সবাইকে নিজ নিজ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান।

প্রেসিডেন্ট জিয়া বক্তব্য শেষে টিএসসি ত্যাগ করার পর প্রায় সব শিক্ষক আমাকে স্পষ্ট সাহসী বক্তব্য রাখার জন্য অভিনন্দন জানানোর সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার এড়ানোর জন্য ক্যাম্পাস ছেড়ে আত্দগোপনে যাওয়ার পরামর্শ দেন। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে অশোভন আচরণকারী ছাত্রদেরও ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য সবাই পরামর্শ দেন। শিক্ষকদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে টিএসসির বাইরে কালো পতাকা প্রদর্শন, অশোভন আচরণ এবং আমার সামরিক শাসনবিরোধী কঠোর বক্তব্যের জন্য আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার। সবাই বলাবলি করছিল, দিবাগত রাতেই ক্যাম্পাস ঘেরাও হবে, আমাকে এবং বিক্ষোভে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের গ্রেফতার করা হবে।

কিন্তু কয়েক দিন কেটে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস রেইড হলো না। আমার বা অশোভন আচরণে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের গ্রেফতার তো দূরের কথা কোনো মামলা হলো না। ২৬ অক্টোবরের পর বেশ কয়েক দিন প্রেসিডেন্ট জিয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন এবং এত বড় ঘটনা ঘটার পর আমার ও ছাত্রদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করার বিষয়টি ক্যাম্পাসে সপ্তাহব্যাপী আলোচনার বিষয়ে (Talk of the Week) পরিণত হয়। সামরিক আইনবিরোধী এবং প্রেসিডেন্ট জিয়ার বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক বক্তব্য প্রদানের জন্য নিশ্চিত খারাপ পরিণতির জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে অশোভন আচরণকারীরাও নিশ্চিত গ্রেফতারের ভয়ে আত্দগোপন করেছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেদিনের সব ঘটনায় যে অপরিসীম ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা নজিরবিহীন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যক্কারজনক ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট জিয়া কোনো ধরনের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে প্রকৃতপক্ষে সেদিনই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীদের মন জয় করে গিয়েছিলেন। তিনি জীবিত থাকাকালীনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শে দীক্ষিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের যাত্রা শুরু হয়। জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবরণের পর ক্রমান্বয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমগ্র বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্র সংগঠন হিসেবে আত্দপ্রকাশ করে। প্রেসিডেন্ট জিয়া ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে যে শিক্ষকদের মন জয় করে গিয়েছিলেন সেই শিক্ষকরা পরিবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শের সংগঠন 'সাদা দলের' প্রতিষ্ঠা করেন। 'সাদা দল' বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষকদের জনপ্রিয় আদর্শ সংগঠনে পরিণত হয়েছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আমাদের মাঝে নেই। ১৯৭৮ সালের ২৬ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট জিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ঘটনায় বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশের সব ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকের মনের মধ্যে স্থায়ী অবস্থান সৃষ্টি করে অমর হয়ে আছেন।

  • লেখক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক মন্ত্রী।   
     


Saturday, July 13, 2019

হুদার ‘অস্বাভাবিক’ ভোট ও ‘বকাউল্লাহর’ সংসদ

সোহরাব হাসান
প্রথম আলো/১৩ জুলাই ২০১৯

গত ৩০ জুন ঢাকার লালবাগ সরকারি মডেল স্কুল ও কলেজে ভোটার তালিকা হালনাগাদ প্রশিক্ষণের উদ্বোধনকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, ‘নির্বাচনে শতভাগ ভোট পড়া স্বাভাবিক নয়। তবে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের করণীয় কিছু নেই। ভোটের পরই প্রিসাইডিং কর্মকর্তা কেন্দ্রভিত্তিক সব নিষ্পত্তি করেন। একীভূত ফল রিটার্নিং কর্মকর্তা আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। তখন ওই বিষয়ে আমাদের কিছু জানায়নি; তাই এখন ইসির কিছু করার নাই।’ (ইত্তেফাক, ১ জুলাই ২০১৯)

জাতীয় নির্বাচনের ছয় মাস পর নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে কেন্দ্রভিত্তিক যে পূর্ণাঙ্গ ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যায় ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। এটি কোনো বিশেষ আসনের হিসাব নয়। দেশের ৩০০ আসনের মধ্যে ১০৩টি আসনে এ অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে। সিইসিও স্বীকার করেছেন, শতভাগ ভোট পড়া স্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর কোনো দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এ রকম ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয় না। ঘটা সম্ভব নয়। কেননা ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন হয় না। নির্বাচন হয় কয়েক মাস পর।এ সময়ের মধ্যে কেউ মারা যেতে পারেন, কেউ অসুস্থ থাকতে পারেন, কেউ এলাকার বাইরে বা বিদেশে যেতে পারেন। এঁরা কীভাবে ভোট দিলেন?

সে ক্ষেত্রে শতভাগ ভোট পড়া শুধু অস্বাভাবিক নয়, অবাস্তবও। নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম অবশ্য একটি অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছেন। বলেছেন, উল্লিখিত কেন্দ্রগুলোয় শতভাগ ভোট পড়েছে, এ কথা বলা যাবে না। কেননা ওসব কেন্দ্রে কিছু ভোট বাতিলও হয়েছে। তিনি বলতে চাইছেন, ‘আগে যেকোনো উপায়ে ভোটের বাক্স শতভাগ ব্যালট ভরে ফেলো। এরপর তাঁরা পরখ করে দেখবেন, কোনটি আসল আর কোনটি নকল।’

কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণ করে আরও অনেক বিস্ময়কর তথ্য পাওয়া গেছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ১২৭টি ভোটকেন্দ্রে, ৯৮ শতাংশ ভোট পড়েছে ২০৪টি ভোটকেন্দ্রে, ৯৭ শতাংশ ভোট পড়েছে ৩৫৮ ভোটকেন্দ্রে এবং ৯৬ শতাংশ ভোট পড়েছে ৫১৬ ভোটকেন্দ্রে। অর্থাৎ ৯৬-১০০ শতাংশ ভোট পড়েছে ১ হাজার ৪১৮টি কেন্দ্রে। অন্যদিকে ৪০-৪৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ৫৯৯টি ভোটকেন্দ্রে, ২০-৩৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ৩০১টি ভোটকেন্দ্রে, ১০-১৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ২০টি ভোটকেন্দ্রে এবং ১০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে ১১টি ভোটকেন্দ্রে। ভোট পড়ার এই বিপরীত হারও বিশ্বাসযোগ্য নয়।

নির্বাচন কমিশন একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করবে, কেন্দ্রে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের এজেন্ট থাকবেন, যাঁরা ভোটারকে চিহ্নিত করবেন, তিনি আসল ভোটার কি না। ভোট গ্রহণ শেষে প্রার্থীর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতেই নির্বাচনী কর্মকর্তারা ভোট গণনা করবেন এবং প্রার্থীদের প্রতিনিধির সইসহ ফল রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠাবেন। এরপর রিটার্নিং কর্মকর্তা সব কেন্দ্রের ফল সমন্বয় করে নির্বাচন কমিশনে পাঠাবেন। এটাই নির্বাচনের স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অধিকাংশ কেন্দ্রে এই নিয়ম মানা হয়নি। কেন্দ্রে বিরোধী দলের প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের যেতে দেওয়া হয়নি। সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকেরা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে যে চিত্র দেখেছেন, ঘোষিত ফলের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। ছবি মিথ্যা বলে না।

নির্বাচনের পর ৩০০ আসনের মধ্যে ৫০টি আসনে জরিপ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৪৭ আসনে কোনো না কোনো অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছে তারা। অনিয়মের ধরনের মধ্যে আছে ৪১টি আসনে জাল ভোট; ৪২টি আসনে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকা; ৩৩টি আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল; ২১টি আসনে আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা; ৩০টি আসনে বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মেরে জাল ভোট; ২৬টি আসনে ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা; ২০টিতে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা; ২২টিতে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া; ২৯টিতে প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেওয়া ইত্যাদি।

সিইসি বলেছেন, রিটার্নিং কর্মকর্তারা যেহেতু কেন্দ্রগুলোর ফল একীভূত করে নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দিয়েছেন এবং গেজেট হয়ে গেছে, সেহেতু তাঁদের আর কিছু করার নেই। তাহলে প্রশ্ন আসে, ইসির দায়িত্ব কি শুধু রিটার্নিং কর্মকর্তার পাঠানো কাগজটিতে সিল মারা? সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভোটারদের প্রতি তাদের কোনো কর্তব্য নেই? নির্বাচন কমিশনের কাজ হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা, যাতে প্রতিটি ভোটার নির্বিঘ্নে ও নির্ভয়ে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেন। ইসির পদাধিকারীরা সেটি পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। ২০০০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ নির্বাচনী বিরোধসংক্রান্ত এক মামলায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান, বিচারপতি বিবি রায় চৌধুরী, বিচারপতি এ এম এম রহমান এবং বিচারপতি কাজী এবাদুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ নির্বাচন কমিশনকে ‘ফেয়ার, জাস্টলি ও অনেস্টলি’ দায়িত্ব পালন করার কথা বলেছিলেন। এখন সিইসি তাঁর বিবেককে (যদি থেকে থাকে) জিজ্ঞেস করুন তিনি ফেয়ার, জাস্টলি ও অনেস্টলি সেই দায়িত্ব পালন করেছেন কি না?

এবারের জাতীয় নির্বাচনে যে অগণিত অসংগতি ও অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল, তার কিছু কিছু নির্বাচনের পর প্রথম আলোসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এখন পুরোটা জানা গেল কেন্দ্রভিত্তিক ফল প্রকাশের পর। আইন অনুযায়ী নির্বাচনের পরপরই কেন্দ্রভিত্তিক ফল ইসির ওয়েবসাইটে দেওয়ার কথা থাকলেও তারা সেটি তারা দেয়নি। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল চেয়ে গত ৭ মার্চ প্রথম ইসিকে চিঠি দেয়। সাড়া না পেয়ে ৩০ মে ও ১১ জুন আরও দুটি চিঠি দেয়। এরপরও প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার গত ১৩ জুন তথ্য অধিকার আইনের আওতায় তথ্যের জন্য আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ জুন ইসি ৩০০টি সংসদীয় নির্বাচনী এলাকার কেন্দ্রভিত্তিক ও একীভূত নির্বাচনী ফলাফল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে।

কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো এবারের নির্বাচন ব্যালট পেপারে হওয়ায় ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়া দেখাতে পারলেও ইভিএম পরিচালিত ৬টি আসনের কোনো কেন্দ্রে সেটি ঘটেনি। ইভিএমে ভোট পড়ার গড় ৫১ দশমিক ৪২ শতাংশ। আর ব্যালট পেপারে ভোট হওয়া আসনের গড় ভোট ৮০ দশমিক ৮০ শতাংশ। ভোটের পার্থক্য ২৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন, তার আগে ও পরের সব নির্বাচনে ইসি অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে ৫৭৬টি কেন্দ্রে নৌকার প্রার্থীর বাইরে কেউ একটি ভোটও পাননি। ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি যত নগণ্যই হোক না কেন, ঘোষিত ফলাফলে দেখা যায় বিপুল সংখ্যায় ভোট পড়েছে। মহাবিশ্বে একমাত্র পৃথিবীতে মানুষ আছে বলে প্রমাণিত। অন্য গ্রহেও মানবসদৃশ কোনো প্রাণী বা এলিয়েন থাকতে পারে। হুদা কমিশনের দৌলতে ভোটের দিন ওই এলিয়েনরা এসেই ভোট দিয়ে গেছে। না হলে শতভাগ ভোট পড়ল কীভাবে?

যখন নির্বাচন কমিশনের কেন্দ্রভিত্তিক ফল বিশ্লেষণ করছিলাম তখনই সাবেক মন্ত্রী, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাংসদ রাশেদ খান মেননের একটি মন্তব্য চোখে পড়ল। গত বৃহস্পতিবার সংসদে আলোচনাকালে তিনি বলেছেন, ‘সাংসদেরা হচ্ছেন বকাউল্লাহ, তাঁরা বকে যান, ক্ষমতাসীনেরা শোনাউল্লাহ, শুনে যান। আর সংসদ হচ্ছে গরিবউল্লাহ।’ তিনি আরও বলেছেন, গ্যাসের দাম নিয়ে আলোচনা না হলে এই সংসদ আরও গরিব হয়ে যাবে। আমাদের অর্থনৈতিক সূচক যত বাড়ছে, রাজনৈতিক সূচক তত নিচে নামছে।

এর আগে রাশেদ খান মেনন বরিশালে দলের সভায় বলেছেন, রাজনীতি আর রাজনীতিকদের হাতে নেই। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির আরও কয়েকজন নেতা রাজনীতি রাজনীতিকদের হাতে নেই বলে হতাশা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তাঁদের মনে রাখা উচিত রাজনীতি তখনই রাজনীতিকদের হাতে থাকে, যখন জনগণ ভোট দেওয়ার সুযোগ পান। মেনন ও মইন উদ্দীন খান বাদলেরা সরকারকে শোনাউল্লাহ, সংসদকে গরিবউল্লাহ এবং নিজেদের বকাউল্লাহ বলে উল্লেখ করেছেন। সংসদ কখন গরিব হয়? যখন সেই সংসদে জনগণের পক্ষে কথা বলা যায় না। এ অবস্থা চলতে থাকলে তাঁরা সরকারের নীতি পরিবর্তন দূরের কথা, নিজের বকাউল্লাহর ভূমিকাটিও রাখতে পারবেন না।

অতএব রাজনীতিকে রাজনীতিকদের হাতে ফিরিয়ে আনতে হলে সবার অাগে জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। তবে সেই কাজটি হুদা কমিশন করতে পারবে—এ কথা কেউ বিশ্বাস করে না।

  • সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
  • লিঙ্ক - shorturl.at/kqIW1

Thursday, July 11, 2019

সঞ্চয়পত্রে বাড়তি কর, বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও নিম্নবিত্তের জীবন




ড. আর এম দেবনাথ
সরকারি বিভাগ, মন্ত্রণালয় যদি অবিবেচক হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের করার আর কিছু থাকে না। সরকারি সিদ্ধান্ত তাদের মানতেই হবে, শত হোক তা সরকারি আইন বা বিধান। এখন ১ জুলাই থেকে যে বিধান হয়েছে, তা মানতে গিয়ে অযৌক্তিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোনো উপায় নেই। এই যেমন সঞ্চয়পত্র। আশা ছিল মাননীয় সংসদ সদস্যদের আপত্তি, জনসাধারণের আপত্তির কথা শুনে অর্থমন্ত্রী সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর যে অধিকতর করারোপ করেছেন, তা তিনি তুলে নেবেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা ছিল ৫ শতাংশ, এটাই বহাল থাকবে এই ছিল লাখ লাখ সঞ্চয়ীর প্রত্যাশা। সাধারণ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের প্রত্যাশা। নতুন অর্থমন্ত্রী তা করেননি। সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম দিন থেকেই ১০ শতাংশ অগ্রিম আয়কর উৎসেই কেটে নেয়া হবে। এবারে প্রশ্ন, আগে যারা কিনেছেন, তার বেলায় এ বিধান প্রযোজ্য কিনা? তিন বছর আগে কেনা, আরো দুই বছর পরে তা নগদায়নযোগ্য হবে এমন সঞ্চয়পত্রের বেলায়ও কি তা প্রযোজ্য? মাসে মাসে বা তিন মাস অন্তর যাদের সুদের টাকা তোলার কথা, অথচ নানা কারণে কয়েক মাসের টাকা তোলা হয়নি, এমন বকেয়া ক্ষেত্রেও কি নতুন বিধান প্রযোজ্য? খবরের কাগজে প্রকাশিত সংবাদ যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে ওইসব ক্ষেত্রেও ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটা হবে। একটি কাগজের খবরের শিরোনাম: ‘উৎসে কর ১০% সবার জন্যই’। একজন অর্থনীতিবিদ আন্তর্জাতিক কররীতির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘কারো পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ যদি আগামী দুই বছর পরে শেষ হয়, তাহলে ১ জুলাইয়ে আগের তিন বছরের মুনাফার ওপর ৫ শতাংশ এবং ১ জুলাইয়ের পরের সময়ের মুনাফার ওপর উৎসে কর ১০ শতাংশ আরোপই যৌক্তিক হবে।’ এটি ন্যায্য প্রশ্ন। এর পরেও প্রশ্ন আছে। ব্যাংকে মেয়াদি আমানত রাখলে যে তারিখে রাখা হয়, সেই তারিখের সুদহারই কার্যকর থাকে, পরবর্তী সময়ে সুদের হার কমানো-বাড়ানো হলেও। কারণ এটা ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি। চুক্তি একতরফাভাবে ভঙ্গ করা যায় না। আমার প্রশ্ন, সঞ্চয়পত্র কি ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে একটা চুক্তি নয়? আমার জানা নেই। তবে সাধারণ বুদ্ধিতে বলে, গচ্ছিত টাকা রাখার সময় যে শর্তাবলি থাকে, সেটিই উভয় পক্ষের কাছে মান্য। এ অবস্থায় সঞ্চয় অধিদপ্তর কী করে বলে যে ‘উৎসে কর ১০% সবার জন্যই।’


এটা কি অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নয়? এটা কি একতরফা সিদ্ধান্ত নয়? এ সিদ্ধান্তের দুটো ফল। প্রথমত, ৫ শতাংশের স্থলে সাধারণ সঞ্চয়কারীদের কাছ থেকে উৎসে অগ্রিম আয়কর কেটে নেয়া হবে ১০ শতাংশ হারে। এখানে সঞ্চয়কারীদের স্বার্থহানি হচ্ছে। তাদের আয় হ্রাস পাচ্ছে।দ্বিতীয়ত, বকেয়া সুদের ওপরও ১০ শতাংশ হারে কর কেটে নেয়া রীতিমতো জবরদস্তি। সঞ্চয় অধিদপ্তর আমার মনে হয় এক্ষেত্রে ‘ওভারস্টেপিং’ করছে। সিদ্ধান্তটি সঠিক হয়ে থাকলে তা পুনর্বিবেচনাযোগ্য। 

আরো কথা আছে। এসব দুঃখের কথা। ধরা যাক একজনের ১০ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র আছে। তাহলে তার বার্ষিক সুদ আয় হবে ১ লাখ ৯ হাজার ৪৪০ টাকা। ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটা হলে তার পরিমাণ হবে ১০ হাজার ৯৪৪ টাকা। যদি ওই ব্যক্তির আরো ২ লাখ টাকা অন্যান্য সূত্রে আয় হয়, তাহলে তার মোট আয় হবে ৩ লাখ ৯ হাজার ৪৪০ টাকা। যেহেতু উৎসে কর কাটা চূড়ান্ত দায় হিসেবে বিবেচিত, তাই ব্যক্তির কোনো আয়করই হবে না। কিন্তু ‘ফাইল’ জমা দিলেই সর্বনিম্ন কর দিতে হবে। দেখা যাবে পাওনা করের চেয়ে আয়কর কাটা হয়েছে অনেক বেশি। এ টাকা আইনত ফেরতযোগ্য। কিন্তু সবাই জানে সরকারের কাছ থেকে টাকা ফেরত পাওয়া কতটা ঝামেলাপূর্ণ। মুশকিল হলো, এ সমস্যাটা হবে প্রতি বছর। সম্ভবত এ সমস্যার কথা বিবেচনা করেই তিন বছর আগে ১০ শতাংশের স্থলে করহার কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। কিন্তু বিধি বাম, নতুন অর্থমন্ত্রী এসেই পুরনো অর্থমন্ত্রীর বিধানটি তুলে দিলেন। এতে অবিচার বাড়ল কিনা তা বিবেচনার বিষয়। আরো মুশকিল আছে। এক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত সঞ্চয়কারী করদাতার আয় কমল। বিপরীতে তাকে কোনো কর রেয়াত দেয়া হলো না। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা সাধারণত করদাতাদের পক্ষে কথা বলেন না। তারা তাদের নিজেদের দাবি নিয়েই বাজেটের আগে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু এবার তারা বাজার সৃষ্টির কথা বিবেচনা করে করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধির কথা বলেন। সাধারণ করদাতারা এ দাবি করেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে তুলনা করে বিশেষজ্ঞরাও একই কথা বলেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী কারো কথা শুনলেন না। চার বছর আগের আয়করমুক্ত সীমাই রেখে দিলেন। অথচ চার বছরের প্রতি বছর মূল্যস্ফীতি হয়েছে কম করে হলেও ৫ শতাংশ হারে। 


সরকারি কর্মচারীসহ বিভিন্ন অধিদপ্তরের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সুযোগ দ্বিগুণ করা হয়েছে। কিন্তু লাখ লাখ বেসরকারি করদাতার বেতন-ভাতা বাড়েনি। এ সত্ত্বেও করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হলো না। অধিকন্তু বাজারে দেখা যাচ্ছে সবকিছুর মূল্যে ঊর্ধ্বগতি। বাজেটের কারণে তেল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, চিনি থেকে শুরু করে বিরাটসংখ্যক দ্রব্যসামগ্রী ও সেবার মূল্য বেড়েছে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা আরেকটি এল বছরের প্রথম দিনেই। 

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম দিনেই বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম। সর্বোচ্চ হারে হয়েছে এই বৃদ্ধিটি। গড়ে প্রায় ৩৩ শতাংশ। গৃহস্থালি ব্যবহারের জন্যও দাম বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত হারে। এর ফল কী হবে তা নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। শিল্প উৎপাদনের খরচ বাড়বে, পরিবহন খরচ বাড়বে, বাড়িভাড়া বাড়বে। বড় কথা, গ্যাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হচ্ছে বিদ্যুৎ। এর দাম যেকোনো দিন বাড়বে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। অথচ যে যুক্তির বলে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে, তা কোনো যুক্তিই নয়। হিসাবে দেখা যাচ্ছে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে যে টাকা আদায় করা হবে, প্রায় সেই পরিমাণের টাকা ‘সিস্টেম লস’ দূর করে সাশ্রয় করা যায়। দেখা যাচ্ছে চুরি-দুর্নীতির বোঝাও সাধারণ মানুষকে বহন করতে হবে।

এভাবে দেখলে বোঝা যাবে একদিকে মানুষের আয় কমছে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ছিল ঊর্ধ্বমুখী। শুধু আয় কমের বিষয় নয়, লোকের চাকরিও যাচ্ছে। দৈনিক কাগজের খবর, ‘পাঠাও’ নামের রাইডশেয়ারিং কোম্পানি তার ৫০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করেছে। তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস এবং পুঁজির স্বল্পতাই নাকি ছাঁটাইয়ের কারণ। যেখানে পারছে সেখানেই মালিকরা রোবট বসাচ্ছেন। তৈরি পোশাক শিল্পে এর ব্যাপকতা বেশি। কয়েকদিন আগে দেখলাম একটা বিখ্যাত আসবাব কোম্পানিতেও রোবট বসেছে। বেসরকারি খাতে চাকরিচ্যুতি এখন যখন তখন। মধ্যবয়সে সন্তান-সন্ততিসহ লোকজন রাস্তায় পড়ছে। দুদিন আগে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম। একজন পুরনো কর্মী বললেন, প্রতিদিন সকালবেলা ওপরওয়ালার নাম নিয়ে অফিসে ঢুকি। রাত্রিবেলা আতঙ্কে থাকি। পরদিন সকালে আবার তা করি। হে ওপরওয়ালা, আমার চাকরিটা যাতে থাকে। এসব তো মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত কর্মী-কর্মচারীদের কথা, সাধারণ মানুষের দুঃখ আরো বেশি। গত সপ্তাহে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে দেখা। জিজ্ঞেস করেই বুঝলাম, দেশে কোনো কাজ নেই।

এখন বর্ষাকাল।  করিমগঞ্জ, ইটনা, মিঠামইন, সুনামগঞ্জ ইত্যাদি এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এখন জল আর জল। এ অবস্থায় কাজ তারা কোথায় পাবেন। নীলফামারীর ‘কিশোরগঞ্জ’ এলাকার এক রিকশাওয়ালা বললেন তার দুঃখের কথা। তাদের রোজগার এখন কম। যানজটের কারণে ‘খেপ’ তাদের অনেক কম। একটা যাত্রাতেই এক-দেড় ঘণ্টা লেগে যায়। অথচ ‘মেসের’ খরচ বৃদ্ধির দিকে। বাজার খরচও বেশি। এসব নিয়ে দেশের বড় একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসাব করে দেখিয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে গড়ে মানুষের মাসিক প্রকৃত আয় ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। তাহলে সরকারি হিসাবে গড় আয় বাড়ছে কীভাবে? সেটাও সত্য! কারণ ওই হিসাবে ধনী-দরিদ্র সবারই হিসাব আছে। ওই হিসাবে গরিব, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের আয়ের প্রতিফলন হয় না। এ বাস্তবতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরটাই শুরু হয়েছে উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠার মধ্যে। সামনে পবিত্র ঈদ। ওই উপলক্ষে যে আরেক দফা মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কী?

  • ড. আর এম দেবনাথ: সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  • কার্টসিঃ বণিকবার্তা/ জুলাই ১১, ২০১৯

হঠাৎ পিয়াজের দাম দ্বিগুণ!


মানবজমিন/ জুলাই ১১, ২০১৯



ঈদুল ফিতরের পর স্থিতিশীল থাকলেও হঠাৎ করেই রাজধানীর বাজারগুলোতে পিয়াজের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। গত দুই দিনে খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে অস্বাভাবিকভাবে দ্বিগুনের বেশি দাম বেড়েছে। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পিয়াজের দাম গড়ে ১৫ থেকে ২৫ টাকা বেড়েছে। খুচরা বাজারে এমন অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির তেমন কোন কারণ নেই বলে জানিয়েছেন পাইকারি বিক্রেতারা। কাওরান বাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীরা পিয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। সরবরাহ ও আমদানি মূল্য কম থাকার পরও বাড়তি মুনাফা করার জন্য দাম বাড়িয়েছেন চক্রটি। অন্যদিকে, ভোক্তারা মনে করেন, বাজার পর্যবেক্ষণ না থাকার কারণে এরকম দাম বেড়েছে। এখনি বাজার পর্যবেক্ষণ জোরদার না করা গেলে পিয়াজসহ অন্য মসলারও দাম বৃদ্ধি পেতে পারে বলে জানান তারা।

দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ সাধারণ ক্রেতারা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, উৎপাদন মৌসুমে পিয়াজ তোলার সময় বৃষ্টি ছিল। এতে নষ্ট হওয়ার ভয়ে দেশি পিয়াজ আগাম বেশি বিক্রি হয়ে গেছে। ফলে, আড়তগুলোতে এখন দেশি পিয়াজ কম সরবরাহ হচ্ছে। তাছাড়া সামনে কোরবানির ঈদ এবং ভারতীয় বাজারে পিয়াজের দাম বৃদ্ধির কথা বলেন তারা।

কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাত দেখালেও পিয়াজ কিনতে এসে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ব্যবসায়ীদের ওপর। 

বাজারে গত শুক্রবার পর্যন্ত দাম অপরিবর্তিত থাকলেও রোববার হঠাৎ করে পিয়াজের দাম কেজিতে ১৮ থেকে ২০ টাকা বেড়ে ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতিপাল্লা (৫ কেজি) বিক্রি হয়েছে ২২৫ টাকায়। শুক্রবার প্রতিকেজির দাম ছিল ২৫ থেকে ২৭ টাকা এবং পাল্লা ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। গত রোববার থেকে রাজধানীর খুচরা দোকান ও মুদি দোকানগুলোয় পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে, শুক্রবারেও যা ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি।

বেসরকারি চাকরিজীবী হাসনাত রিপন রাগান্বিত স্বরেই বললেন, গত শুক্রবারও যে পিয়াজ কিনেছি ২৮-৩০ টাকা কেজি, তা এখন হয়ে গেল ৫০ টাকা। এটা কি মগের মুল্লুক নাকি! পিয়াজ ছাড়া রান্না চলে না তো, তাই জেনেশুনে এমন সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো হয়। এটা সাধারণ ক্রেতাদের ওপর অত্যাচার ছাড়া কিছু না। 

কাওরান বাজারের পিয়াজ ব্যবসায়ী ফয়েজ আহমেদ বলেন, ভারতীয় পিয়াজের আমদানি খরচ হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় বাজারে পিয়াজ সরবরাহের ঘাটতি রয়েছে। তাই পাইকারি বাজারে পিয়াজের দাম বেড়ে গেছে, যার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। আরেক ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন বলেন, বৃষ্টির কারণে গত কয়েক দিনে পাইকারি বাজারে পিয়াজের দাম হঠাৎ বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, গত কয়েক দিনে কেজিপ্রতি পিয়াজের দাম পড়েছে ৩৮ থেকে ৩৯ টাকা। এর সঙ্গে খরচ যোগ করে আমাদের ৪৫ টাকা দামে বিক্রি করতে হয়েছে। 

শ্যামবাজার ব্যবসায়ী সমিতির প্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, আগে দিনে ভারত থেকে ২০০ পিয়াজের গাড়ি ৪টি স্থল বন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ করতো। কিন্তু এখন সেখানে ১০০ থেকে ১২০টি গাড়ি ঢুকছে বাংলাদেশে। আমদানি সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বাড়ছে বলে জানান তিনি। 

খুচরা বাজারে দেখা গেছে, মানভেদে দেশি পিয়াজ কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকা। গত রোববার থেকে এই দামে পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে। তবে গত শুক্রবার প্রতি কেজি ভালো মানের দেশি পিয়াজ বিক্রি হয় ৩০-৩৫ টাকা। অর্থাৎ খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পিয়াজের দাম বেড়েছে ২০-২৫ টাকা। রোববার পাইকারিতে দাম বাড়ার প্রভাবে ওই দিন থেকেই খুচরা বাজারে পিয়াজের দামে বড় ধরনের উত্থান হলেও, মঙ্গলবার পাইকারিতে দাম কমার প্রভাব এখনও খুচরা বাজারে পড়েনি। খুচরা বাজারে এখনও বাড়তি দামেই পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে।

কাওরানবাজারের পিয়াজ ব্যবসায়ী হাসান মিয়া বলেন, বৃষ্টির কারণে গত দুদিনে পিয়াজের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়। ওই সময় আমাদের প্রতি মণ পিয়াজ কেনা পড়ে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ প্রতি কেজির দাম পড়ে ৩৮-৩৯ টাকা। এর সঙ্গে খরচ যোগ করে আমাদের ৪৫ টাকা দামে বিক্রি করতে হয়েছে।

তবে পাইকারি বাজারে পিয়াজের দাম কিছুটা কমেছে। প্রতি মণ কেনা পড়ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি কেজির দাম পড়ছে ৩০-৩২ টাকা। এই পিয়াজ আমরা ৩৫-৩৬ টাকা কেজি বিক্রি করছি। এ হিসাবে এখন পিয়াজের দাম প্রতি কেজিতে কমেছে ১০ টাকা করে। কিন্তু খুচরা বাজারে চিত্র ঠিক উল্টো। 


উৎস লিঙ্ক — http://bit.ly/2YQruve

Sunday, July 7, 2019

চোখের সামনে হলুদ জামা পরা সায়মার মুখ


শাহানা হুদা

দিনে দিনে কি অসুস্থ হয়ে পড়ছি, তা না হলে কেন চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই, একটি শিশু ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে, আর কতগুলো দানবীয় হাত তার দিকে এগিয়ে আসছে। কোন শিশুর দিকে চোখ পড়লেই কেন মনে হচ্ছে এই বাচ্চাটি কি নিরাপদে থাকতে পারবে? ও কি জানে ওর চারপাশে মানুষরূপী দানবরা ঘুরে বেড়াচ্ছে? এরা আর কেউ নয় তার পরিবারের সদস্য, বা শিক্ষক বা পাড়ার ছেলে বা আত্মীয় নামক মানুষরূপী একদল জীব। মাঝেমাঝে ভাবছি খবরে চোখ রাখা কি বন্ধ করে দেব? উটপাখি হয়ে যাব? যতগুলো শিশু বা মেয়ের ছবি দেখছি, সেখানেই আমার মেয়ের বা আমার ছোট্ট নন্নার মুখ ভেসে উঠছে। মনে হচ্ছে এই বাচ্চাগুলোকে আমরা হত্যা করছি।



স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

আমার চোখের সামনে হলুদ জামা পরা সায়মার মুখ, মাথায় লাল ফিতা দিয়ে চুল বাঁধা। কানে বাজছে সায়মার বাবার কান্নাজড়ানো কণ্ঠ - দেশবাসীকে একটা কথা বলতে চাই, যাদের মেয়ে বাচ্চা আছে, তারা তাদের আগলে রাখবেন। এক মুহূর্তের জন্যও আলগা হতে দেবেন না। এইসব নরপিশাচদের হাত থেকে এদের রক্ষা করবেন।     

কিন্তু এভাবে তো চলা যায় না। আরও দমবন্ধ লাগছে এজন্য যে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে আমি, আপনি, সমাজ, সরকার কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করছি না। আমি, আপনি ফেসবুকে ইমো দিচ্ছি, অধিকাংশ মানুষ নির্বিকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চুপচাপ এবং সরকার কোনো দায় অনুভব করছে না। তারা উন্নয়ন নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে সারাক্ষণ সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, আমেরিকার অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা ভাবছে, অথচ নিজের দেশে যে ছোট ছোট শিশুরা, নারীরা অব্যাহতভাবে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, সেটা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাই নেই।

আমরা ভাবতেই পারি না গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত - এই ছয় মাসে সারাদেশে ৩৯৯ শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ছেলে শিশুর সংখ্যা আট। ধর্ষণের পর এক ছেলে শিশুসহ মারা গেছে আরও ১৬ শিশু। এদের মধ্যে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছিল ৪৪ জনের ওপর। এছাড়া যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ৪৯ শিশু। যৌন হয়রানির ঘটনায় আহত হয়েছে ৪৭ মেয়েশিশু ও দুই ছেলেশিশু। মানে দাঁড়াচ্ছে ১৮২ দিনে ৩৯৯ শিশু ধর্ষণের শিকার। মাত্র ছয়টি পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে এই সংখ্যাটি পাওয়া গেছে। সারাদেশে আরও অসংখ্য নারী, মেয়ে ও ছেলে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। যেগুলোর খবর গণমাধ্যমে আসে, আমরা শুধু সেগুলোই জানি। বাকি সব থেকে যাচ্ছে চোখের অন্তরালে।

পরপর কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা আমাদের চমকে দিয়েছে। স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষক, পরিবারের একদম ঘনিষ্ঠ জন কেউ বাদ নেই। আগে আমাদের ধারণা ছিল গুণ্ডা-মাস্তানরা ধর্ষণ করে তরুণী এবং কিশোরীদের। এখন দেখছি এই ধারা একেবারে পাল্টে গেছে। শিশুরাই এখন বড় টার্গেট। কারণ শিশুরা দুর্বল, শিশুদের খুব সহজে ভোলানো যায়, পথেঘাটে শিশুরাই খেলে বেড়ায় এবং শিশুরা কাউকে কোনো অভিযোগ জানাতে ভয় পায়। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো শিশুরা কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও তাকে গুরুত্ব দেয় না পরিবারের লোকজন। বিশেষ করে সেই ব্যক্তি যদি হয় পরিবারেরই কোনো বয়স্ক ব্যক্তি বা সদস্য। উল্টো শিশুকে চাপের মধ্যে রাখে। আমরা যদি শিশুদের ধর্ষিত হওয়ার খণ্ডচিত্রগুলো লক্ষ্য করি দেখব যে এরা কেউ বাসায় গিয়ে কারও বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেনি কখনো। এই যে নুসরাতকে পুড়িয়ে মারা হলো, এই নুসরাত যখন তার পরিবারের কাছে বারবার এইসব নিপীড়নের কথা বলেছিল, পরিবার খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি।

নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে শিশুদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। বাবা-মায়েরা যখন কাজে যায়, তখন শিশুরা থাকে একেবারে অভিভাবকহীন। দেখা যায় ১২/১৩ বছরের বোনটি তার আরও দুটি ভাই-বোনকে দেখভাল করছে। এরা সবাই অনিরাপদ। এসব পরিবারে শিশুদের নিরাপত্তার কোনো ধারণা দেওয়া হয় না। এরকম অগণিত বাচ্চা একদম অযত্নে অবহেলায় শহরের বস্তিতে বেড়ে উঠছে। এরা পথে পথে ঘুরে, হাটে-বাজারে-পথের পাশে ঘুমায়। এদের জীবনে নিরাপত্তা বলে কোনো শব্দই নেই। এই শিশুগুলোকে দেখলে আমার শুধু মনে হয় খাদ্য-বস্ত্র-শিক্ষা-বাসস্থানের পাশাপাশি এরা নিরাপত্তা থেকেও বঞ্চিত। যেকোনো সময়, যে কেউ এদের ধর্ষণ করে মেরে ফেলে রেখে যাতে পারে এবং যায়ও। প্রতিবন্ধী শিশুর নিরাপত্তা আরও কম। যাদের দায়িত্ব পরিবার, সমাজ, সংসার কেউ নেয় না, তাহলে কেনইবা এদের জন্ম হয়, কেনইবা এরা ঝরে যায়?

যে শিশুটি আমাদের ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে আছে, যে শিশুটি যত্রতত্র ঘুরেও বেড়ায় না, পরিবারেই থাকে তারও বিপদ কিন্তু কম না। এই পরিবারগুলোতেই এমন সব মানুষরূপী প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে --- যাদের কথা আমরা ভাবতেও পারব না, অথচ এই অমানুষগুলোই বাচ্চাদের সারল্য ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে অত্যাচার করে চলেছে সবার অগোচরে। আসলে যে লোকটি বিকৃত রুচির, তার সামাজিক পরিচয় যাই-ই হোক সে কিন্তু ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেই। সে হতে পারে কারো বাবা, ভাই, চাচা, মামা বা দাদা। কিন্তু সে আসলে মনের দিক থেকে একজন ধর্ষক। সে পথেঘাটে মেয়েদের দেখে, উত্যক্ত করে আর ঘরে এসে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি করে। আর তাই ৯ মাসের নবজাতককে যখন তার চাচা ধর্ষণ করেছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়, তা দেখে আমরা আঁতকে উঠি। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে এরাই সেই বিকৃত মনের পিশাচ।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বলছে, শতকরা ৮৭ ভাগ নারী তাদের পরিবারেই যৌন হয়রানির শিকার হয়। পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, যখন রক্ষকই ভক্ষক হয়ে যায়।

কেন ধর্ষণের ঘটনা দিনে দিনে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে? সবার মুখে এখন এই একই কথা। অধিকাংশ মানুষ মনে করে অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয় না বলে, তারা এই ধরনের অপরাধ করতেই থাকে। অপরাধী যখন জানে অপরাধ করলে সে পার পেয়ে যাবে, তখন তার বারবার অপরাধ করতেও ভয় হয় না। দেশে নানা ধরনের যৌন উত্তেজক মাদক ও পর্নোগ্রাফির ছড়াছড়ি। সববয়সের পুরুষ এই মাদক গ্রহণ করছে এবং পর্নোগ্রাফি দেখছে এবং যার তার ওপর এর প্রয়োগ ঘটাচ্ছে। মাদক এবং পর্নো সাইট দুটোই নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন হলেও অসাধ্য নয়। সরকার যদি সত্যিই চায় এগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে, তাহলে সেটা খুব কঠিন হবে না।

এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রচারণা চালানো। শিশুদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাদের শেখাতে হবে কোনটা ভালো স্পর্শ, কোনটা মন্দ স্পর্শ। তাদের শেখাতে হবে কিভাবে তারা প্রতিবাদ করবে এবং অন্যায়কারীকে চিনিয়ে দেবে। তাদের জানাতে হবে তাদের পক্ষে আছে তাদের অভিভাবকরা। কেউ যদি আদরের নামে তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করে, তাকে কিভাবে শায়েস্তা করতে হবে, সেটাও শিশুদের শেখাতে হবে। শিশুদের শেখাতে হবে তারা যেন পরিচিত, অপরিচিত কারও সঙ্গে কোথাও একা একা চলে না যায়, কেউ কিছু খাবারের প্রলোভন দেখালে তারা যেন সেই ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে চলে না যায়। শিশুকে ঘুরে দাঁড়ানো শেখাতে হবে।

আর বাবা মা, অভিভাবককেও শিশুর নিরাপত্তার প্রতি সচেতন হতে হবে। বস্তিবাসী, দরিদ্র, অসহায় বাবা মায়েরা অনেকসময় পারেন না তাদের সন্তানের দেখভাল করতে। কিন্তু এরপরও সন্তানের কথা বিবেচনা করে খুব সচেতন হতে হবে সব অভিভাবককে। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, কী করছে, সন্তানের সঙ্গে কে কীরকম ব্যবহার করছে এসবে দৃষ্টি দিতে হবে। আমাদের সবাইকে একসঙ্গে সমাজ সচেতনতার কাজ শুরু করতে হবে। তা না হলে একটি শিশুকেও আমরা সুস্থ রাখতে পারব না।

  • শাহানা হুদা: যোগাযোগকর্মী, লেখকের ইমেইল —  ranjana@manusher.org 

  • উৎস লিঙ্ক —  http://bit.ly/30kZ8cR