Search

Tuesday, November 5, 2019

মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎ পেলে মানুষ হতবিহ্বল হয়ে পড়ত — সাদেক হোসেন খোকা

মাহবুব মোর্শেদ 


১৯৭১ সালে সাদেক হোসেন খোকা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেছেন। জড়িত ছিলেন বিভিন্ন সাহসী গেরিলা অপারেশনে। ১৬ ডিসেম্বর তিনি ও তার সহযোদ্ধারা মিলে টেলিভিশন ও রেডিওর নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশল, যুদ্ধে সাধারণ মানুষের সমর্থন ও ডিসেম্বরের ঢাকা নিয়ে ঢাকার বর্তমান মেয়র এবং মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা কথা বলেছেন। সাদেক হোসেন খোকার জন্ম ১ অক্টোবর ১৯৫১ সালে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগে শেষ বর্ষের ছাত্র। যুক্ত ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের সঙ্গে।

মাহবুব মোর্শেদ : নভেম্বরে গেরিলারা ঢাকার চারদিকে একটা প্রতিরোধবলয় গড়ে তুলেছিল। সে সময় আপনাদের ক্যাম্প কোথায় ছিল?
সাদেক হোসেন খোকা : প্রকৃতপক্ষে নভেম্বরের শেষদিক থেকেই গেরিলারা ঢাকার চারদিকে অবস্থান গ্রহণ করে। বিশেষ করে ঢাকার পূর্বাঞ্চলের প্রতিটি গ্রামেই মুক্তিযোদ্ধারা খুব শক্ত অবস্থানে ছিল। তখন বেশিরভাগ সময়ই আমরা মুক্তাঞ্চলে অবস্থান করতাম এবং ঢাকায় এসে অপারেশন করে আবার সেখানে চলে যেতাম। আমাদের যুদ্ধ তো কনভেনশনাল ছিল না। গেরিলা যুদ্ধের নিয়মে এটিই ছিল আমাদের কৌশল। তখন ক্যাম্পগুলো অস্থায়ীভাবে তৈরি হতো। অপারেশন করে এবং পারিপার্শ্বিকতার কথা বিবেচনা করে আমরা ক্যাম্পগুলো এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে সরিয়ে নিতাম। ক্যাম্পগুলো ছিল আমুলিয়া, মেন্দীপুর, মানিকদী- এসব জায়গায়।

মাহবুব মোর্শেদ : তখন কি দখলের উদ্দেশ্যে ঢাকার ভেতরে ঢোকার মতো পরিস্থিতি গেরিলাদের ছিল?
সাদেক হোসেন খোকা : সাধারণত দখলদার বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি থাকে রাজধানী শহরে। কারণ, সামরিক-বেসামরিক সব প্রতিষ্ঠানের হেডকোয়ার্টার থাকে। তাই রাজধানী শহরকে তারা শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। পাকিস্তানি দখলদাররাও তা-ই করেছিল। এছাড়া তাদের রেগুলার ফোর্সও ছিল অনেক বেশি। গেরিলা যুদ্ধের ধরনই হলো শত্রুর শক্ত ঘাঁটিতে চোরাগোপ্তা হামলার মধ্য দিয়ে তাদের বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ঘটানো। তাদের পরাস্ত করা। এমন ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে হবে, যাতে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমেও এটি গুরুত্বসহকারে প্রচার পায়। গেরিলা যুদ্ধের ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রচারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য তখন ঢাকা শহরের বাইরে অবস্থান নিয়ে আমরা গেরিলা অপারেশনগুলো পরিচালনা করতাম। সে সময় ঢাকা শহরে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন করি, প্রচারের দিক থেকে যেগুলো খুবই গুরুত্ব পায়। তাতে সারাদেশের মানুষসহ গোটা বিশ্ববাসী জানতে পারে পাকবাহিনী ঢাকায় দারুণভাবে পর্যুদস্ত হচ্ছে। তখন হানাদার বাহিনীর লক্ষ্য ছিল, বিশ্ববাসীকে দেখানো যে, সবকিছু ঠিকঠাকমতো চলছে। আর আমাদের লক্ষ্য ছিল এখানে প্রশাসনসহ কোনো কিছুই সঠিকভাবে চলছে না সেটা দেখানো। তাই এ ধরনের প্রচারণা তখন ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মাহবুব মোর্শেদ : আপনাদের বড় অপারেশনগুলো কী কী?
সাদেক হোসেন খোকা : আমার মনে পড়ে ঢাকা হলের (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল) কাছে এয়ার ফোর্সের যে রিক্রুটিং সেন্টার ছিল সেটি আমরা ধ্বংস করেছিলাম। এছাড়া শান্তিনগরের ডিএফপি ভবন, পিলখানাসহ ঢাকা শহরের আরও অনেক জায়গায় আমরা এ ধরনের গেরিলা অপারেশন করেছিলাম। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর যখন তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করল না তখন অনেক এমএনএ এবং এমপি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়ে মুক্তাঞ্চলে চলে যান। পাকিস্তান সরকার তখন সেই এমপিদের আসন শূন্য ঘোষণা করে। আসনগুলোতে উপ-নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে নির্বাচন ঠেকানো আমাদের একটি গ্রুপের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তখন আমরা রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উল্টো দিকে অবস্থিত প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অফিস উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমাদের অপারেশনের পর ভবনটা একেবারে ধসে পড়ে। তাতে নির্বাচন কমিশনের একজন কর্মচারীও মারা যায়। এমন সুরক্ষিত জায়গায় এ ধরনের একটি বড় অপারেশন পরিচালনা করে আমরা প্রমাণ করতে পেরেছিলাম, মুক্তিযোদ্ধারাও ঢাকায় শক্ত অবস্থানে আছে। প্রচারের দিক থেকেও এটি বেশ গুরুত্ব পেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাই বিভিন্ন গ্রুপ ঢাকায় এসে এ ধরনের অপারেশন করেছে। এ ধরনের অপারেশনের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল পাক হানাদার বাহিনীকে এখানেই ব্যস্ত রাখা। যাতে তারা বাইরের দিকে মনোযোগ কম দিতে পারে।

মাহবুব মোর্শেদ : কোন ক্যাম্প থেকে আপনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন?
সাদেক হোসেন খোকা : মেলাঘর ক্যাম্প থেকে। সম্ভবত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি মেলাঘরে যাই। আমি ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। আমাদের গ্রুপ থেকে অনেকেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। এপ্রিলের প্রথম দিকে আমি আমার গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার নেতৃবৃন্দের দিকনির্দেশনা নেওয়া, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং গ্রুপিংয়েরও প্রয়োজন ছিল। এসব করতে করতে একটু দেরি হয়ে যায়। কমিউনিস্ট পার্টি তখন চীন এবং রাশিয়াপন্থি- এই দু'ভাগে বিভক্ত ছিল। আমাদের মধ্যেই অনেকগুলো দল ছিল। কেউ কেউ পাকিস্তানি বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী উভয়কেই প্রতিরোধ করতে শুরু করে। সিরাজ শিকদাররাও এক রকম লাইন নেয়। মতিন সাহেব, আলাউদ্দিন ভাই তারা এক রকম লাইন নেন। মেনন এবং জাফর ভাইরা ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন।

মাহবুব মোর্শেদ : প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর?
সাদেক হোসেন খোকা : প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর আমি কর্নেল গাফফারের নেতৃত্বে তিন সপ্তাহ সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। তারপর সেখান থেকে ভাগ করে আমাদের ঢাকায় পাঠানো হয়।

মাহবুব মোর্শেদ : ঢাকায় অন্য যে গেরিলা গ্রুপগুলো কাজ করত, তাদের সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ বা পারস্পরিক সমন্বয় কীভাবে হতো?
সাদেক হোসেন খোকা : ২ নং সেক্টরে আমরা যারা প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছি তারা একে অপরকে জানতাম। কোন গ্রুপে কে কে আছে, কমান্ডার কে- এসব আমরা জানতাম। তাছাড়া আমাদের নিজেদের মধ্যেও পারস্পরিক যোগাযোগ তো ছিলই। পারস্পরিক যোগাযোগের ভিত্তিতেই একটা শক্তিশালী অবস্থান গড়ে উঠেছিল। শেষ দিকে পাকিস্তানি বাহিনী দু'একবার পূর্বাঞ্চলে ঢোকার চেষ্টা করেছে। তখন আমাদের গেরিলা গ্রুপগুলো তাদের সে চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য সম্মিলিত প্রয়াস চালায়।

মাহবুব মোর্শেদ : ঢাকায় আপনারা যাওয়া-আসা করতেন কীভাবে?
সাদেক হোসেন খোকা : যেহেতু এটা ছিল গেরিলা যুদ্ধ। তাই আমাদের আলাদা কোনো পোশাক বা ইউনিফর্ম ছিল না। সাধারণ মানুষের মতোই আমরা যাতায়াত করতাম।

মাহবুব মোর্শেদ : ঢাকার অধিবাসীরা আপনাদের কীভাবে সাহায্য করত?
সাদেক হোসেন খোকা : ঢাকার শতকরা ৯৯.৯৯ ভাগ মানুষ যুদ্ধের পক্ষে ছিল। ডিএফপি ভবনে যখন আমরা অপারেশন করি তখন সেখানকার এক কর্মচারী আমাদের সাহায্য করে। এমন সাহায্য প্রচুর পেয়েছি। নির্বাচন কমিশন অফিসে অপারেশন করার সময় প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। অপারেশন শেষ করে শান্তিবাগের দিকে গিয়ে আমরা একটি মেসে আশ্রয় নিই। তারাও সেখানে আমাদের সানন্দে বরণ করে। তখন আকাশবাণী কিংবা বিবিসিতে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা প্রচারিত হতো। মানুষ সেসব শুনে মুক্তিযোদ্ধাদের কল্পিত ছবি আঁকত মনে মনে। হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎ পেলে মানুষ হতবিহ্বল হয়ে পড়ত। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কী করবে তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। সেই অভিজ্ঞতা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। তাই গেরিলা যুদ্ধে আমাদের যে সফলতা এর ক্রেডিট যদি কাউকে দিতে হয় তা এ দেশের সাধারণ মানুষকেই দিতে হবে। তাদের সমর্থন না পেলে আমাদের এই অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সদ্ভাব রাখার জন্য আমাদেরও নানা নির্দেশনা দেওয়া হতো। আমাদের ওপর কঠোর নির্দেশ ছিল, যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা না ঘটে। সাধারণ মানুষের সামান্যতম ক্ষতির কারণ যেন আমরা না হই।

মাহবুব মোর্শেদ : ডিসেম্বরে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণার পর পরিস্থিতিতে কী পরিবর্তন এলো?
সাদেক হোসেন খোকা : যুদ্ধ তখন একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে এসেছে। পাকিস্তানি বাহিনী একেবারে কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল। তারা কোনো অস্ত্র নিয়ে আসতে পারছিল না। বিমানও বন্ধ ছিল। গেরিলাদের আক্রমণে তারা বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। কোনো ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে যে সামরিক শক্তি দিয়ে দমানো যায় না তারই বড় প্রমাণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। শুরু থেকেই সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসিকতার সঙ্গে যেভাবে যুদ্ধ করেছে, তাদের সাহসিকতার কাছে পাকবাহিনীর শতকরা ৮৫-৯০ ভাগ পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। আর ডিসেম্বরের শুরুতে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ভারতের সামরিক অস্ত্রের সাপোর্ট আমরা পাই এবং যুদ্ধ আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তির দিকে এগোতে থাকে। যে কারণে মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই তারা সাড়া দেয়।

মাহবুব মোর্শেদ : ১৬ ডিসেম্বরের ঘটনা আপনার মনে আছে?
সাদেক হোসেন খোকা : আমার মনে পড়ে, আত্মসমর্পণের পর রেডিও-টেলিভিশন এগুলোর নিয়ন্ত্রণ আমরা গ্রহণ করি। শাহাদাত চৌধুরী, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, এখলাসউদ্দিন আহমদ প্রমুখের প্রচেষ্টায় টেলিভিশন অন এয়ারে আসে। পরে সেদিন রাতে মেজর হায়দার ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে বক্তব্য প্রদান করেন। টেলিভিশন ভবনে আমি যখন প্রথম লোক পাঠাই তখন দু'একজন কর্মী সেখানে ছিল। তারা ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের একত্র করে অন্যদের সহযোগিতায় টিভি চালানো সম্ভব হয়।

মাহবুব মোর্শেদ : প্রথম কী অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়?
সাদেক হোসেন খোকা : মেজর হায়দারের ভাষণ দিয়েই অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। বারবার সে ভাষণ প্রচার করা হয়।

মাহবুব মোর্শেদ : রেডিওতেও আপনি গিয়েছিলেন?
সাদেক হোসেন খোকা : হ্যাঁ, রেডিওতেও আমরা যাই এবং সেখানকার নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করি। সাভারের মেইন টাওয়ারের যন্ত্রপাতি তখন কে বা কারা খুলে নিয়ে গিয়েছিল। সেগুলো খুঁজে বের করে সেটিকে আমরা আবার চালু করার ব্যবস্থা করি।

মাহবুব মোর্শেদ : আত্মসমর্পণের খবর আপনি কখন শুনলেন?
সাদেক হোসেন খোকা : তখন মুক্তিযোদ্ধাদের নিজস্ব একটা নেটওয়ার্ক ছিল। সেই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমরা অবগত হই যে, ১৬ তারিখ পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করছে। আমি তখন মানিকনগরের দিক দিয়ে আসছি ঢাকার দিকে। সেখানে অনেক রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। আমার যতদূর মনে পড়ে, ওইদিন সকাল থেকেই আমরা ঢাকায় ছিলাম।

মাহবুব মোর্শেদ : ভারতীয় সেনারা ততক্ষণে ঢাকায় এসে পৌঁছেছিল?
সাদেক হোসেন খোকা : হ্যাঁ, ভারতীয় সেনারা ততক্ষণে ঢাকায় এসে পৌঁছেছে।

মাহবুব মোর্শেদ : আত্মসমর্পণের সময় আপনি কি রেসকোর্স ময়দানে ছিলেন?
সাদেক হোসেন খোকা : না, তখনও আমি রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছতে পারিনি।

মাহবুব মোর্শেদ : রেডিও-টেলিভিশনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য আপনারা কখন থেকে অপারেশন শুরু করলেন?
সাদেক হোসেন খোকা : মেজর হায়দারের নির্দেশেই আমরা অপারেশনটা শুরু করি। তখন ঢাকার অভ্যন্তরে আমাদের বাহিনী ছিল সবচেয়ে বেশি সুসংগঠিত এবং বেশি জনবল সম্পন্ন। তিনি আমাদের রেডিও-টেলিভিশনের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দিলেন। আমরা রেডিও-টেলিভিশনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে মেজর হায়দারকে আহ্বান জানাই। তিনি এসে মুক্তিযোদ্ধাদের করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। যাতে লুটপাট এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিশৃঙ্খলা এড়ানো সম্ভব হয়।

মাহবুব মোর্শেদ : ওইদিন কি ঢাকা শহরে গোলাগুলি হয়েছিল?
সাদেক হোসেন খোকা : হ্যাঁ, বিভিন্ন দিকে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু গোলাগুলি হয়েছিল। আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে অনেক বেসামরিক লোক কিছু গোলাগুলি করেছিল। আতঙ্কিত হয়ে পাকিস্তানি আর্মিও কিছু গুলি করেছিল। ১৬ তারিখ বিকেলেই আমরা জানতে পারি রায়েরবাজারে কিছু মানুষকে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়েছে।

মাহবুব মোর্শেদ : আপনি সেখানে গিয়েছিলেন?
সাদেক হোসেন খোকা : হ্যাঁ, সেখানে আমি গিয়েছিলাম। আমার তিন ঘনিষ্ঠ বন্ধু শাজাহান, বদিউজ্জামান এবং মনিরুজ্জামানের মৃতদেহ সেখান থেকে উদ্ধার করি। পরে আমরা তাদের বাড়িতে মৃতদেহ পেঁৗছে দিই।

মাহবুব মোর্শেদ : রায়েরবাজারে গিয়ে আপনি কী দেখলেন?
সাদেক হোসেন খোকা : সেখানে লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। তখন খবর সবেমাত্র ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ দেখার জন্য, তাদের হারানো স্বজনদের লাশ খোঁজার জন্য সেখানে ছুটে আসছে। পরে ১৭ তারিখ সবাই জেনে যায়।

 — সাক্ষাতকার গ্রহীতা সাংবাদিক, গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক । 

যুদ্ধদিনের খোকা


সুমন মাহমুদ


অন্য বন্ধুদের মতো বাড়িতে না জানিয়েই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন সাদেক হোসেন খোকা, তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য, একদল তরুণের ওই গেরিলা যুদ্ধ অনেকের কাছে ছিল বিস্ময়ের।
২০০১ সালে যখন মন্ত্রী, তখন এক আলাপে নিজের মুক্তিযুদ্ধের কিছু ঘটনার রোমন্থন করেছিলেন খোকা।
“আমি যুদ্ধে যাব- এটা মা-বাবা কাউকে জানাইনি। বলতে পার, একরম হঠাৎ করে বাসা থেকে চলে হয়ে গেলাম যুদ্ধের পথে।”
যুদ্ধে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছিলন, “পাকিস্তানিরা আমাদেরকে শোষণ করবে, নির্যাতন করবে, আমাদের সম্পদ লুট করে নিয়ে যাবে, এটা তো মনে নেওয়া যায় না। যুদ্ধ যাওয়ার প্রতীক্ষায় দিন গুণছিলাম, একদিন হঠাৎ করেই বন্ধু-বান্ধবসহ আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলাম। হয়ে গেলাম গেরিলা, ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য।”
‘লম্বা ইতিহাস’র খানিকটা সেই আলাপে বলেছিলেন এই গেরিলা যোদ্ধা।
“মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি দিককার কথা। বায়তুল মোকাররমই ঢাকার তখন একমাত্র বড় মার্কেট ছিল। একদিন দেখি দুপুরে বেলায় বায়তুল মোকাররমের সামনে বড় বড় ক্যামেরা দিয়ে শুটিং হচ্ছে। আমার একটু কিউরিসিটি হল, এখানে কী হচ্ছে? রোজার ঈদের আগে বড় বড় দোকানে দেখানো হচ্ছে যে, ঈদের মার্কেটিং হচ্ছে, বেচা-কেনা হচ্ছে, মানে দেশের আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিকভাবে চলছে। এটা দেখানোর জন্য পাকিস্তানিরা শুটিং করছে। শুনলাম ডিএফপি এই শুটিং করছে।
“তখন আমার মাথা ঢুকল, এই ডিএফপিকে তো তাহলে ধরতে হয়। কোথায় ডিএফপি? খোঁজ-খবর নিতে নিতে জানা গেল, শান্তিনগরে এসবি অফিসের পাশেই ডিএফপি (ডিপার্টমেন্ট অব ফিল্ম এন্ড পাবলিকেশন্স) অফিস। এই অফিস থেকেই এসব কাজ করা হয়। তখন আমরা পরিকল্পনা করলাম এই অফিসে অপারেশন চালাব।

“ক্র্যাক প্লাটুনের আমরা তিনজন ছুটির দিনে, মানে সেদিন হাফ অফিসের দিন ছিল, অপারেশনে বেরুলাম। দিনটি ছিল শুক্রবার। জুম্মার নামাজের পরে অপারেশন। আমরা একটা কালো ব্যাগের মধ্যে দুইটা স্টেনগান ও এক্সপ্লোসিভ নিয়ে যাই। ডিএফপির গেইটে গেলাম। যে দারোয়ান ডিউটিতে ছিল, তাকে অফিসের এক কর্মকর্তার নাম বলি যে, তার (ওই কর্মকর্তা) দেশের বাড়ি থেকে এক আত্মীয় উনার জন্য জিনিস পাঠিয়েছেন। এই কথায় দারোয়ান অফিসের গেইট খুলে ঢুকতে দেয়। ভেতরে ঢুকে আমরা ব্যাগ থেকে অস্ত্র বের করে তাকে নিয়ন্ত্রণে নিই, তাকে বোঝাই যে আমরা মুক্তিযোদ্ধা। এক পর্যায়ে দারোয়ান বলে যে, সে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক। তার ছোট ভাই একজন মুক্তিযোদ্ধা। বিষয়টা আমাদের জন্য ইজি হয়ে গেল।”
“তারপর একটা পর্যায়ে আমরা সেই ২০ পাউন্ড ওজনের এক্সপ্লোসিভটা রুমের ভেতরে রাখি। এক্সপ্লোসিভের বৈশিষ্ট্য হল, যত চাপ দিয়ে রাখা যাবে, এটার ক্যাপাসিটি তত বাড়বে। তখন কয়েকটা স্টিলের আলমারি দিয়ে ওই এক্সপ্লোসিভ চাপা দিলাম, তারপর বিস্ফোরণ ঘটাই। সেই বিস্ফোরণের পর সারা বিশ্বে শিরোনাম হয়েছিল- পূর্ব পাকিস্তানে দামাল মুক্তিযোদ্ধারা অশান্ত করে তুলেছে ঢাকাকে। এরকম বিস্ফোরণ এযাবত পাকিস্তানে আর হয়নি। এটা পাকিস্তানের সৈন্যদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এভাবে দিনে-দুপুরে এরকম একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধারা, এটা কী করে সম্ভব!”
ডিএফপি ছাড়া রাজারবাগের কাছে মোমিনবাগে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের প্রধান কার্যালয়, ঢাকা হলের পেছনে এয়ারফোর্সের রিক্রুটিং সেন্টারও খোকার নেতৃত্বে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে।
খোকা বলেছিলেন, “আমাদের অপারেশনের স্পিরিট ছিল শত্রুকে ব্যতিব্যস্ত রাখা। ঢাকার মানুষকে জানান দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধ ঢাকায়ও চলছে। আমাদের গ্রুপ বিশেষ করে ছোট-বড় অনেক অপারেশন আমরা করেছি ঢাকায়।”
মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার স্মৃতি তুলে ধরে খোকা বলেছিলেন, “মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপরই বাংলাদেশ থেকে আমরা কয়েকজন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা শহরে গিয়ে সিপিএম (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-মার্কসবাদী) অফিসে যাই। সেখানে আমাদের দেশের নেতৃবৃন্দকে পাই। সেখান থেকে আমাদের যাত্রা ২ নম্বর সেক্টরে। মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর এটিএম হায়দারের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য। সেখানে আমাদের শহীদুল্লাহ খান বাদল আমাদের বিভিন্ন গ্রুপে পাঠিয়ে দেন।
“ট্রেনিংয়ের পর মেজর হায়দারের নেতৃত্বে আমি কুমিল্লার সালদা নদীতে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেই। সেই দিন রাতে সেই দুঃসাহসিক অপারেশনের কথা স্মরণ করলে শরীর শিহরিত হয়ে ওঠে। মাথার উপর দিয়ে রাতের অন্ধকারে টমি গান-ব্যারেল গানের আগুনের স্ফূলিঙ্গের মতো কী যেন ছুটে যাচ্ছে। যেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। পাকিস্তানি সৈন্যদের আমরা সেই অপারেশনেই পিছু হটাতে বাধ্য করেছিলাম।”
খোকার ভাষায়, “মুক্তিযুদ্ধ ছিল সার্বজনীন। কোনো দল, কোনো গোষ্ঠি, কেনো ব্যক্তি, কোনো পরিবারের একক কারও অবদান ছিল না, এই অবদান বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের। এর সুফলও সার্বজনীন হওয়া উচিৎ।”

 — লেখক প্রধান রাজনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

সাদেক হোসেন খোকাকে যতটা তটস্থ রেখেছি, তা কি এখন পারতাম?

সুলতানা রহমান
সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে সুলতানা রহমান











মাস খানেক আগে খোকা ভাইয়ের সঙ্গে সবশেষ দেখা। ক্যান্সারের কারণে মলিন হয়ে আসা তার চেহারায় সেদিন সতেজতা দেখে উচ্ছসিত হয়ে বলেছিলাম, ‘আপনার আর কোনো অসুখ বিসুখ নেই। দিব্যি সুস্থ হয়ে গেছেন খোকা ভাই।’ তিনিও স্বভাবসুলভ মুচকি হেসে নিজের মুখে হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, সত্যি বলতেছো? ‘জ্বি খোকা ভাই, একদম ঠিক।

এর আগে নিউ ইয়র্কে যে কবার দেখেছি, আপনাকে দেখে মন খারাপ হয়ে যেতো, অচেনা লাগতো। এইবার একদম আগের মতো লাগছে-আগের মতোই জাঁদরেল। কিন্ত মাস খানেকের মধ্যেই তিনি চলে যাবেন সে ভাবনা আসেনি একবারের জন্যও।

ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর বছর তিনেক আগে নিউইয়র্কে তাকে দেখে আমি চমকে গেছিলাম, প্রতাপশালী একজন মানুষ কতটা গুটিয়ে যেতে পারেন, সার্বক্ষণিক জনমানুষ পরিবেষ্ঠিত একজন কতটা নির্জনে থাকতে পারেন খোকা ভাই তার প্রমাণ। 
আমার সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন, তোমার বিয়েতে গেছিলাম। আমি আরেক ধাপ এগিয়ে বলতাম- ‘শ্বশুর বাড়ির লোকদের মশার কামড় থেকে বাঁচাতে দু'একবার বাসার আশপাশে মশা মারার ওষুধও দিতে হয়েছে।’ খোকা ভাই হাসতেন! 

মাত্র ১০/১৫ বছর আগেও বাংলাদেশের রাজনীতি এতোটা অসহনশীল ছিলো না, এখন যতটা বোধ করি। ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং পেশাদারিত্ব দুটোই সমানে সমান চলতে পারতো। এক যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভারের অনিয়ম সংক্রান্ত যে পরিমাণ রিপোর্ট আমি করেছি কিংবা হাতির ঝিল প্রকল্পটিকে পরিবেশ বান্ধব রাখতে ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে যতটা তটস্থ রেখেছি, তা কি এখন পারতাম? পারলেও ব্যক্তিগত সম্পর্কটি কি থাকতো? কিংবা এখন যত উন্নয়ন প্রকল্প হচ্ছে তাতে অনিয়মের খবর সাংবাদিকরা কতটা তুলে ধরতে পারছেন? খোকা ভাইর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরছে। 

জামায়াত ঘেষা বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে খোকা ভাইয়ের রাজনৈতিক দর্শনে ভিন্নতা ছিলো। মান্নান ভূইয়া, সাদেক হোসেন খোকা যে ধারায় বিএনপি’র রাজনীতি পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন, দলটির হাইকমান্ড সে ধারায় অগ্রসর না হওয়ায় তার মাসুল গুনছে বিএনপি। একজন বীর মুক্তিযাদ্ধা হয়েও খোকা ভাইকে থাকতে হয়েছে পরবাসে। সে শুধুই ভিন্ন মতের জন্য নয়, কিংবা মামলা হামলার ভয়ে নয়, নয় শারীরিক অসুস্থতা। সাদেক হোসেন খোকা সাহসী মানুষ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় গুলিতে তার হাতের একটি আঙ্গুল উড়ে গিয়েছিলো, সেই অবস্থায়ও তিনি যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। দুর্ধর্ষ ক্রাকপ্লাটুনের সদস্য সাদেক হোসেন খোকা জেষ্ঠ রাজনীতিবিদ হিসেবেও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন বহুবার। কিন্ত অভিজ্ঞ নেতাদের যখন মতামতের কদর থাকেনা দলের ভেতর, তখন পরবাসই শ্রেয়। আর এখন সব মান অভিমান, নির্জনতা কিংবা পারাপারের সব আয়োজনের উর্ধে একজন সাদেক হোসেন খোকা, তিনি কেবল ইতিহাসের একটি অংশ। খোকা ভাইয়ের জন্য অনেক শ্রদ্ধা আর ভালবাসা।

  • (ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
  • কার্টসি — বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

খোকা — কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা রাজনীতিবিদ


সাদেক হোসেন খোকা। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা। সাবেক মন্ত্রী। অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র।

কিন্তু সব পরিচয় ছাপিয়ে খোকা খ্যাতিমান ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। মেয়র থাকাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ঢাকার বিভিন্ন সড়কের নামকরণ করেছিলেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধারা কে কোন দল করে তা কখনও দেখেননি খোকা।

একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ই ছিল সবচেয়ে বড়।

১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ছিলেন গেরিলা যোদ্ধা। পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিক অপারেশন পরিচালনা করেন সাদেক হোসেন খোকা।

নিজের লেখা একটি প্রবন্ধে খোকা লিখেছেন, পরিবারের অন্য কাউকে কিছু না জানিয়েই গোপনে মুক্তিযুদ্ধে চলে যান তিনি।

‘‘পরে মেলাঘরের ট্রেনিং ক্যাম্পে ট্রেনিং শেষে ঢাকায় অপারেশনের ফাঁকে গোপনে একবার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাই। কিন্তু তার মা বলে দিয়েছেন, ‘আর যুদ্ধে যেতে পারবে না। কারণ তোমার হাতে কোনো মানুষ খুন হোক তা আমি চাই না।’’

নিজের প্রবন্ধে খোকা লিখেন, ‘‘আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, মা আমাকে যেতে হবে। আর আমরা তো যুদ্ধই করছি পাকিস্তানি দখলদারদের মেরে ভয় দেখিয়ে এদেশ থেকে বিতাড়িত করতে। তিনি যখন দেখলেন আমাকে ফেরানো যাবে না তখন বললেন, ‘আমাকে কথা দাও অন্যায়ভাবে ঠাণ্ডা মাথায় কাউকে হত্যা করতে পারবে না।’ মায়ের কথায় রাজি হয়ে আবার ফিরে যাই রণাঙ্গনে।’’

১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথম সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং তার দল বিএনপি সরকার গঠন করলে তিনি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। পরবর্তীতে ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালেও তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ২০০১ সালে তিনি মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। তিনি সরাসরি নির্বাচনে জয় লাভের মাধ্যমে ২০০২ সালের ২৫শে এপ্রিল অভিবক্ত ঢাকার মেয়র নির্বাচিত হন। বামপন্থি রাজনীতি ছেড়ে আশির দশকে বিএনপির রাজনীতি শুরু করেন খোকা। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ঢাকার রাজপথে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন খোকা। ১৯৯০ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে পুরান ঢাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার চেষ্টা হলেও তা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন খোকা। এতে খোকা পুরান ঢাকাবাসীর আস্থা অর্জন করেন। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা-৭ আসন (সূত্রাপুর-কোতোয়ালি) থেকে শেখ হাসিনাকে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আলোচনায় আসেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ঢাকার আটটি আসনের মধ্যে সাতটিতে বিএনপি প্রার্থী পরাজিত হলেও একমাত্র খোকাই নির্বাচিত হন। পরে আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী আন্দোলনে প্রায় পাঁচ বছর একক নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতায় পরিণত হন। সেসময় ঢাকার রাজপথে রক্ত রঞ্জিত খোকার ছবি এখনও অনেকের চোখেই দৃশ্যমান। ২০০১ সালের নির্বাচনেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে মৎস্য ও পশুসম্পদমন্ত্রী হন। সাদেক হোসেন খোকা পুরান ঢাকার গোপীবাগে তার পৈতৃক বাড়িতে থেকেই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।

তিনি জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় বিএনপির ত্রাণবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। তিনি শুধু রাজনীতিতে নন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরেই ১৯৭২ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়নের দায়িত্ব নিয়ে ক্লাবকে তিন বছরের মধ্যে তৃতীয় থেকে প্রথম বিভাগে উন্নীত করেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা খোকা ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ও ফরাশগঞ্জ ক্লাবের গভর্নিংবডির চেয়ারম্যান ছিলেন। জনবান্ধব নেতা হিসেবে যথেষ্ট সুনাম ছিল খোকার। পুরান ঢাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ খোকাকে তারা সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে, দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পাশে পেতেন। যখনই ডাক পড়েছে, তখনই তিনি ছুটে গেছেন পুরান ঢাকাবাসীর কাছে। এজন্য তিনি পেয়েছেন ঢাকাবাসীর বিপুল সমর্থন।

সেই মাটিতে আমার কবর হবে না!

রেজাউল করিম লাবলু


প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা জাগদল থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিতে ডানপন্থিদের পাশাপাশি ছিলেন সক্রিয় বেশ কিছু বামপন্থি। মূলত ষাটের দশকে ভাগ হয়ে যাওয়া পিকিংপন্থিদের একটা অংশ যোগ দেন জিয়াউর রহমানের দলে। ডানপন্থিদের পাশাপাশি এই বামপন্থি অংশটিও বেশ প্রভাব রাখত দলটিতে। সর্বশেষ এই অংশের নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন প্রয়াত আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া ও সাদেক হোসেন খোকা। খোকার মৃত্যুর সঙ্গে দেশের অন্যতম প্রধান এই রাজনৈতিক শিবিরে প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত অংশটির অবসান ঘটল বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

পুরান ঢাকার নিজের এলাকা গোপীবাগসহ অন্যান্য এলাকায়ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে জনপ্রিয় সাদেক হোসেন খোকা ছিলেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকার গেরিলা যোদ্ধাদের অন্যতম।    

মুক্তিযুদ্ধে খোকা

নিজের লেখা একটি প্রবন্ধে খোকা লিখেছেন কীভাবে তিনি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়ে গোপনে মুক্তিযুদ্ধে চলে যান তিনি। পরে মেলাঘরের ট্রেনিং ক্যাম্পে ট্রেনিং শেষে ঢাকায় অপারেশনের ফাঁকে গোপনে একবার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যান। কিন্তু তার মা বলে দিয়েছেন, ‘আর যুদ্ধে যেতে পারবে না। কারণ তোমার হাতে কোনো মানুষ খুন হোক তা আমি চাই না।’

নিজের প্রবন্ধে খোকা লিখেন, “আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, মা আমাকে যেতে হবে। আর আমরা তো যুদ্ধই করছি পাকিস্তানি দখলদারদের মেরে ভয় দেখিয়ে এদেশ থেকে বিতাড়িত করতে। তিনি যখন দেখলেন আমাকে ফেরানো যাবে না তখন বললেন, ‘আমাকে কথা দাও অন্যায়ভাবে ঠা-া মাথায় কাউকে হত্যা করতে পারবে না।’ মায়ের কথায় রাজি হয়ে আবার ফিরে যাই রণাঙ্গনে।’’

১৯৭১-এর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন নেতা রুহুল আমীন এবং গোপীবাগের মাসুদসহ (বুড়া) বেশ কয়েকজন মিলে প্রথমে খোকারা যান নরসিংদীর শিবপুরে। সেখানে কয়েকদিন অবস্থানের পর যুদ্ধের ট্রেনিং নেওয়ার জন্য আগরতলায় পৌঁছলে তাদের রিসিভ করেন শহীদুল্লাহ খান বাদল (রাশেদ খান মেননের ছোট ভাই)।

খোকা তার বইয়ে লিখেন, ‘সেখান থেকে প্রথমে বটতলার সিপিএম অফিসে গিয়ে মেনন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে চলে যাই দুই নম্বর সেক্টরে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ছিলেন সেই সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার।’

মেজর হায়দারের (পরে কর্নেল হায়দার) নেতৃত্বে ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। দুই নম্বর সেক্টরের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের নাম ছিল ‘মেলাঘর’। মেলাঘরের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বসবাসের জন্য একেবারেই উপযুক্ত ছিল না। পাহাড় আর ঘন জঙ্গলে পূর্ণ ছিল চারদিক।

তিনি লিখেছেন, ‘লাল মাটির উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ একটু বৃষ্টি হলেই বেশ পিচ্ছিল হয়ে পড়ত। শৌচকর্ম সারতে যেতে হতো বনের ভেতরে। এ ক্যাম্পে বেশিরভাগই ছিল ঢাকা শহরের ছেলে, এ রকম পরিবেশে থাকতে তারা অভ্যস্ত ছিল না। আমি ও আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মরহুম মেসবাহ উদ্দিন সাবু এক সঙ্গে থাকতাম।

এ ক্যাম্পেই আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয় আবু সাইদ খান, শাহাদাত চৌধুরী, ফতেহ আলী চৌধুরী, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সুলতান উদ্দিন রাজা, আতিকুল্লাহ খান মাসুদ, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, পল্টনের মানিক (পরে শহীদ), গাজী গোলাম দস্তগীর, মিজান উদ্দিন আহমেদ, শহীদুল্লাহ, শিল্পী শাহাবুদ্দিন, মাসুদ, কাজী ভাই, উলফাৎ ও বাকী (পরে শহীদ) অন্যতম।’

মেজর হায়দারের অধীনে তিন সপ্তাহ গেরিলা ট্রেনিং শেষে খোকারা সম্মুখযুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করেন ক্যাপ্টেন গাফফারের (পরে জাতীয় পার্টি নেতা ও মন্ত্রী) নেতৃত্বাধীন সাব সেক্টরে। ওখানে ট্রেনিং শেষ করার পর প্রথমদিকে কসবা-মন্দভাগ (মির্জাপুর) যুদ্ধের ৯ মাসই প্রতিদিন এক বা একাধিক অপারেশনে অংশ নিয়েছেন সাদেক হোসেন খোকা।

এ প্রসঙ্গে ‘মুক্তিযুদ্ধের স্বর্ণালী দিনগুলো’ প্রবন্ধে সাদেক হোসেন খোকা লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের কথা ভাবলেই নস্টালজিক মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। মন শুধু রণাঙ্গনের সাহসী সহযোদ্ধাদের হারানোর কারণেই ভারাক্রান্ত হয় না, তার চেয়েও বেশি হয় মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন-চেতনার দুর্দশা দেখে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা স্বপ্ন যাই বলি না কেন সেটা শুধু একটি ভূখ-ের স্বাধীনতা নয়, একটি সার্বিক মুক্তিই ছিল এ মহান যুদ্ধের মূল স্পিরিট। সে কারণেই এর নাম হয়েছিল ‘মুক্তিযুদ্ধ’।

মূলত ব্রিটিশ বেনিয়াদের রেখে যাওয়া সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও মানবিক সমাজ গঠনই ছিল স্বপ্ন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল এ জাতির একটি সামষ্টিক মুক্তির লক্ষ্য থেকে। তবুও বলব, জাতীয় মুক্তি না এলেও একটি স্বাধীন দেশ তো আমরা পেয়েছি। যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা দেশকে গড়ে তোলার কথা ভাবতে পারছি, স্বপ্ন দেখতে পারছি সুন্দর আগামীর।’

সাদেক হোসেন ১৯৫২ সালের ১২ মে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্র থাকাবস্থায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন খোকা। তৃণমূল থেকে রাজনীতি শুরু করে উঠে এসেছিলেন বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে। ঢাকা শহরে জন্ম, বেড়ে ওঠার পর সেই অবিভক্ত ঢাকারই মেয়র হয়েছিলেন খোকা। সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে রাজপথ নিজের রক্তে রঞ্জিত করেছেন। ২০১৪ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি দিয়েছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। তখন থেকেই নিউইয়র্কে একটি ক্যানসার হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছিল।

মনোকষ্টের মৃত্যু

জীবন বাজি রেখে মাটির জন্য লড়াই করলেও ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে না পারার মনোকষ্ট ছিল তার। এ বিষয়ে খোকার বন্ধু ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু তার ফেইসবুকে লিখেছেন, আমেরিকা থেকে তার মোবাইলে ফোন এসেছিল। ফোন করেছিলেন খোকা। ফোনে খবর এলো ডাক্তার জানিয়েছে বন্ধু আর মাত্র কয়েক দিনের পথিক। সারা রাত ঘুম হলো না। কত স্মৃতি...ষাটের দশকে রাজপথ কাঁপানো মিছিল। স্টেডিয়ামে খেলা দেখার পর গোপীবাগের মোড়ে সাবুর সঙ্গে লুচি-সবজি খাওয়া। তারপর মুক্তিযুদ্ধের কত কথা।

মৃত্যুপথযাত্রী বন্ধুর সঙ্গে কথা হলো। একটা কথা, যতদিন বাঁচব কানে ভাসবে ‘দোস্ত চলে যাচ্ছি, ডাক্তার জবাব দিয়েছে। কষ্ট একটা বুকে... মৃত্যু জয় করে যে দেশ স্বাধীন করলাম, আজ সেই দেশের মাটিতে আমার কবর হবে না?’ জবাব দিতে পারিনি, বুকের মাঝে রক্ত ঝরছে। এই আজকের বাংলাদেশ!

শেষ ইচ্ছা

খোকার ছেলে ইশরাক হোসেন বলেছেন, বাবা ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন মৃত্যুর পর রাজধানীর জুরাইনে বাবা-মায়ের কবরের পাশে যেন তাকে দাফন করা হয়।

ছাত্ররাজনীত

সাদেক হোসেন খোকা ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা শাখার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ১৯৬৬-৬৯ আইযুববিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এবং সকল দলের স্টুডেন্ট অ্যাকশন কাউন্সিলের সেই সময়ের একজন অন্যতম নেতা হিসেবে ছাত্রদেরও আন্দোলনে সমবেত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।

১৯৭০ সালে তিনি পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সদস্য হয়েছিলেন এবং ১৯৭১ সালে সক্রিয়ভাবে সেক্টর-২ এ স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের মাঝামাঝি পর্যায়ে তিনি বৃহত্তর ঢাকার গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন এবং অনেক ছোট-বড় অপারেশনের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠক (খেলাধুলা) সাদেক হোসেন খোকা ১৯৭২ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়ন স্পোর্টস ক্লাবের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন এবং ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। খেলাধুলার ক্ষেত্রে অবদান থাকার কারণে তার সুখ্যাতি ছিল। ১৯৭৮ সালে তিনি প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগ কমিটির সম্পাদক এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৯-১৯৮৯ পর্যন্ত তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৭ সালে সাদেক হোসেন খোকা ঢাকা পৌর কমিশনার নির্বাচিত হয়েছিলেন।

বিএনপিতে যোগদান ও খোকার উত্থান

বামপন্থি রাজনীতি ছেড়ে ১৯৮৪ সালে বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দেন খোকা। সে সময় নয়াবাজার নবাব ইউসুফ মার্কেটে বিএনপির কার্যালয় থেকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করে সাতদলীয় জোটের নেতৃত্ব দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ওই অন্দোলনে ঢাকা মহানগর সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের দায়িত্ব খোকাকে দেওয়া হয়েছিল। তিনি স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। খোকা ১৯৯১ সালে ঢাকা-৭  থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন, একই বছর তিনি যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মনোনীত হয়েছিলেন। তিনি ১৯৯৬ সালের ৬ষ্ঠ এবং ৭ম উভয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন।

পরে আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রায় পাঁচ বছর একক নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতায় পরিণত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে মৎস্য ও পশুসম্পদমন্ত্রী হন। ওই সময় পুরান ঢাকায় বিএনপির রাজনীতিতে নিজস্ব বলয় তৈরির পাশাপাশি প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ডে দলকে শক্তিশালী করার পেছনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এর আগে ১৯৯৪ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হানিফের কাছে পরাজিত হন মির্জা আব্বাস। বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধী দল কঠোর আন্দোলন শুরু করলে ঢাকায় বিএনপি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় খোকাকে ১৯৯৬ সালে মহানগর বিএনপির আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। পাশাপাশি খোকাকে সভাপতি ও আবদুস সালামকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়। নতুন করে কমিটি গঠনের জন্য আবার ২০১১ সালে সাদেক হোসেন খোকাকে আহ্বায়ক ও আবদুস সালামকে সদস্য সচিব করে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। এই কমিটির বিরুদ্ধেও খোকার প্রতিদ্বন্দ্বী মির্জা আব্বাসের অনুসারীরা নানা অভিযোগ তোলেন।

১৯৯০ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে পুরান ঢাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার চেষ্টা হলেও তা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি।

ওয়ান-ইলেভেনে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তৎকালীন বিএনপি মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে দলে যে সংস্কারের দাবি উঠেছিল, তার প্রতি সাদেক হোসেন খোকার সমর্থন ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে সদস্য সচিব করে মহানগর কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি এরই মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে।

ফোনালাপ ফাঁস

বিএনপির আন্দোলনের সময় মান্নার সঙ্গে খোকার টেলিকথন নিয়ে দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এরপর তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে অনেক হুলিয়া জারি আছে। বিভিন্ন সময় সাদেক হোসেন খোকার বিরুদ্ধে ৩৪টি মামলা করা হয়েছে। সর্বশেষ ৫ মে ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে ১৩৮টি দোকান বরাদ্দের অভিযোগে খোকার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলাগুলোর বিচার চলছে।

এরই মধ্যে ২০১৫ সালের ২০ অক্টোবর সাদেক হোসেন খোকাকে ১৩ বছরের বিনাশ্রম কারাদন্ড দেয় নিম্ন আদালত। এ রায়কে প্রহসনমূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আখ্যায়িত করে ঢাকার সাবেক এই মেয়র বলেছিলেন, রাজনীতি থেকে তাকে বিদায় করতেই সরকারের চাপে আদালত এ রায় প্রদান করেছে। এই রায়কে তিনি বিচার বিভাগের ইতিহাসে প্রহসনের বিচার বলে অভিহিত করেন।

  • কার্টসি — দেশরূপান্তর / নভেম্বর ৫, ২০১৯  

Sunday, November 3, 2019

বিপ্লব ও সংহতি দিবস - ফিরে দেখা ৭ নভেম্বর

ড. মোর্শেদ হাসান খান


স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ৭ নভেম্বর একমাত্র দিন যেদিন সামরিক ও বেসামরিক জনগণ একত্রে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আনন্দ মিছিলে যোগ দেয়। সে দিন সিপাহি-জনতা এক কাতারে মিশে গিয়েছিল। কিশোর, তরুণ, যুবক, সামরিক, বেসামরিক কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সিপাহিরা তাদের সামরিক বাহন এবং সাঁজোয়া যানে সাধারণ মানুষকে হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়েছিল। এমন অভূতপূর্ব এবং অভাবনীয় ঘটনা আজ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে আর ঘটেনি। দুঃখজনক হলেও সত্যি- প্রথমবারের মতো এমন সিপাহি-জনতার ঢল বাংলাদেশে যে দিন দেখা উচিত ছিল, তা হলো আমাদের বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর। এটা ঘটেনি একমাত্র ভারতীয় সেনাবাহীনির হীনম্মন্যতা ও কূটকৌশলের কারণে। তারা একদমই চায়নি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করুক। অথচ এই মুক্তিযোদ্ধারা ৯ মাসের প্রতিরোধ যুদ্ধে অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পর্যুদস্ত পাকিস্তানি বাহিনীকে ভারতীয় সেনাবাহিনী খুব সহজে ঘায়েল করে ফেলে। অথচ শুধু হীনম্মন্যতার কারণে ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের সেনাবাহিনী পরিচালিত কোনো সেক্টরকে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় ঢাকায় থাকতে দেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীকে কোনো কারণ ছাড়াই সিলেট পাঠিয়ে দিয়েছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী আজ পর্যন্ত আমাদের বিজয় দিবসকে তাদের বিজয় হিসেবে পালন করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবসের উৎসব ম্লান হয়ে যায় তাদের সঙ্কীর্ণতার জন্য।

এরপর রাজপথে জনতার ঢল নামে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন। লাখো জনতা হাজির হয় বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। এই ঢল ছিল শুধু বেসামরিক জনগণের। এক বুকভরা আশা আর অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে বাংলার জনগণ তাকে মাথায় তুলে নেয়। অথচ অল্প কিছু দিনের মধ্যেই এই আনন্দ-বিষাদ, হতাশায় রূপ নেয়। ব্যাপক দুর্নীতিগ্রস্ত একটি সরকার এবং লাগামহীন অন্যায়, অত্যাচার এবং জুলুমে ভারাক্রান্ত একটি আশাহত জনপদ। 



পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয় যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দুর্ভিক্ষ হয় শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণের দুই বছরের মাথায়। যথারীতি আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমর্থকরা এই দুর্ভিক্ষের জন্য বাইরের শক্তিকে দোষারোপ করে। ড. অমর্ত্য সেনের গবেষণায় দেখিয়েছেন দেশে খাদ্যাভাব না থাকা স্বত্ত্বেও শুধু মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ছিল ১৯৭৩ সালের দুর্ভিক্ষ। শেখ মুজিবের শাসনামলে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা এতটাই হ্রাস পায়, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে তাদের ব্যাপক কারচুপি এবং ভোট ডাকাতির মাধ্যমে নির্বাচনে জিততে হয়।

আওয়ামী লীগ এতটাই নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ গড়তে পারেনি। অথচ যে জাতি মাত্র চার বছর আগে পাকিস্তানি হিংস্র হানাদারদের বিরুদ্ধে খালি হাতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর ক্ষমতায় একটা শূন্যতা বিরাজ করছিল। এ সময় আওয়ামী লীগেরই একজন জ্যেষ্ঠ নেতা রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পান। কিন্তু তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের নির্দেশনার বাইরে খুব একটা যেতে পারছিলেন না। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হয় যেটা ছিল খুবই স্বাভাবিক কারণ তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ অকর্মণ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন। একমাত্র জেনারেল ওসমানীর সুপারিশ এবং দলীয় আনুগত্যের কারণে তিনি এই পদ পেয়েছিলেন। অথচ জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন তার তুলনায় অনেক পেশাদার এবং সেনাবাহিনীতে জনপ্রিয়। হয়তো জেনারেল জিয়া সেনাপ্রধান থাকলে হয়তো শেখ মুজিবুর রহমানকে অকালে প্রাণ দিতে হতো না।




১৯৭৫ এর নভেম্বরের শুরুর দিক থেকে সেনাবাহিনীতে একদল উচ্চাভিলাসী কিন্তু বিভ্রান্ত জ্যেষ্ঠ অফিসার সক্রিয় হওয়া শুরু করে। তারা সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা আনার দোহাই দিয়ে আরো বিশৃঙ্খল কাজ শুরু করে। সেনাপ্রধান জিয়াকে গৃহবন্দী করে তাদের নেতা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশারফকে নেতৃত্বে আনার প্রচেষ্টা নেয়। এত কিছুর পরও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ তার সেনাপ্রধানের পদটা শুধু নিশ্চিত করেন। এ দিকে ঘটে যায় জেল হত্যার মতো ঘৃণ্য ঘটনা। আর খুনি বাহিনী নির্বিঘ্নে দেশ ছাড়ে। যে ব্যক্তি নিজের বাহিনী সামলানোর মতো যথেষ্ট নয়, তার সেনাপ্রধান হওয়ার উচ্চাভিলাস আসলেই বিস্ময়কর। এখানে বলে রাখা বাঞ্ছনীয়, আওয়ামী লীগ ঢালাওভাবে শেখ মুজিব হত্যা এবং জেল হত্যার জন্য জিয়াউর রহমানকে দায়ী করে। এটা আসলে একমাত্র তাদের হতাশা ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। এর কোনো ঘটনার সময় জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন না। আওয়ামী লীগের কাছে তার একমাত্র অপরাধ হলো তিনি দেশের মানুষকে সত্যিকার স্বাধীনতার স্বাদ দিতে পেরেছিলেন। আরো অপরাধ হলো সুশাসনের মাধ্যমে তিনি দেশকে সামনের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর শেখ মুজিবুর রহমান যে একজন ব্যর্থ শাসক, জনগণ তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিল।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এক বিপন্ন সময়ে জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বর বিভ্রান্ত জাতিকে পথ দেখিয়েছে। দৃঢ়চিত্তে হানাদার বাহিনীকে মোকাবিলা করেছে। সেই জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বর আবার জনগণকে বিভ্রান্তি এবং অনিশ্চয়তা থেকে আশার আলো দেখায় ৭ নভেম্বরে জিয়াউর রহমানের ভাষণ। জনগণ উপলব্ধি করতে পারে, দেশের শাসনভার এখন একজন দেশপ্রেমী, মুক্তিযোদ্ধা, নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল ব্যক্তির হাতে। আর তাই নতুন শাসককে বরণ করতে রাজপথে কাতারে কাতারে নেমে আশে সিপাহি-জনতা নির্বিশেষে। এই দিনই ৭ নভেম্বর। আমাদের নতুন করে পথ চলার অনুপ্রেরণা।

  • কার্টসি —  নয়াদিগন্ত/নভেম্বর ৬, ২০১৬। 

স্বাধীনতাযুদ্ধ ও দেশ গঠনে জিয়ার অবদান

ড. মো: মোর্শেদ হাসান খান


স্বাধীনতার চার দশক পর বাংলাদেশ আজ এক গভীর রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে পথ চলছে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আজ হুমকির মুখে। জাতীয় জীবনের এই সঙ্কটময় মুহূর্তে আজ এমন একজন মানুষ সম্পর্কে দু-চারটি কথা লিখতে যাচ্ছি, যিনি জড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের অস্তিত্বের সাথে। তিনি আর কেউ নন- তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক বলে সুপরিচিত, আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি জিয়াউর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বর্বর ঘৃণ্য হামলা চালিয়ে গণহত্যা শুরু করে। শেখ মুজিবুর রহমানের দিকনির্দেশনায় কিছুটা কমতি থাকায় পাক বাহিনীর গণহত্যা ও প্রচণ্ড নির্যাতনের মুখে জাতি যখন হতাশ ও বিভ্রান্ত, ঠিক তখনই আশার আলোকবর্তিকা হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন সে দিনের মেজর জিয়াউর রহমান। নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকি উপেক্ষা করে জাতির সঙ্কটময় মুহূর্তে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর আক্রমণের পর জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে বিদ্রোহ করেন এবং তিনি চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং দল, মত, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এতে জাতি উজ্জ্বীবিত হয়েছিল। তিনিই প্রথম পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত করেন। ২৫ মার্চ রাতে তিনি যখন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণার মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করলেন, তখন তিনি দেখলেন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যসংখ্যা মাত্র ৩০০। তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক ছিলেন। মাত্র সাতজন অফিসার এবং ৩০০ সৈন্য নিয়ে ছিল অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। এই স্বল্পসংখ্যক সৈন্য ও অপ্রতুল অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তিনি তার বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এই বিদ্রোহ ছিল এক দুঃসাহসিক কাজ, যা জিয়াউর রহমানের মতো নায়কের পক্ষেই সম্ভব ছিল। ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে জিয়াউর রহমান এক নম্বর সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন। তিনি সেনা সদস্যদের সংগঠিত করে পরবর্তী সময়ে তিনটি সেক্টরের সমন্বয়ে জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। রণাঙ্গনে তার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি সবসময় সামনে থাকতেন এবং কমান্ডারদের সৈনিকদের সামনে থাকতে পরামর্শ দিতেন। এভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি যুদ্ধ পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ এর জুন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ও তারপর জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে তিনি যুদ্ধে অংশ নেন।

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের দু’দিন আগে সিলেটের এমসি কলেজের পাশ দিয়ে সিলেট শহরে ঢোকার আগে পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্যাপক গোলাবর্ষণের শিকার হয়েছিল জিয়ার বাহিনী। এ পরিস্থিতিতে সহকর্মীরা তাকে পিছিয়ে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নেন সবাই মরে গেলেও সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ভূমিকা, বিশেষ করে রণক্ষেত্রে তিনি যে বীরত্ব দেখিয়েছেন, তা এক কথায় অতুলনীয়। রণক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতা অনেক আগের। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি অসাধারণ রণনৈপুণ্য দেখিয়ে সবার দৃষ্টি কাড়েন। তিনি প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে ওই যুদ্ধে অংশ নেন। পাক-ভারত যুদ্ধে তার আলফা কোম্পানি সবচেয়ে বেশি নৈপুণ্য দেখিয়েছিল। তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে এমন কেউ ছিলেন না, যিনি জিয়াকে চিনতেন না। ১৯৭১-এর আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল একটি ভিন্ন্ ধরনের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে তিনি অসীম সাহস ও বীরত্ব দেখান। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বের জন্য তাকে বীরউত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয়। যুদ্ধ শেষে তিনি আবার তার কর্মস্থলে ফিরে যান, যা ছিল বিশ্ব ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা।

স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমানকে কেউ খাটো করে দেখলে ভাবতে হবে সে একজন মূর্খ, সে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস জানে না এবং জানে কিন্তু অস্বীকার করে সে একজন জ্ঞানপাপী। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সে দিন জিয়ার অগ্রণী ভূমিকা এবং মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানকে স্বীকার না করা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জিয়াউর রহমানের অবদান অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

সিপাহি-জনতার বিপ্লব বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ‘জাতীয় ঐক্যের প্রতীক’-এর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে সিপাহি-জনতা। ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবের মাধ্যমে এদেশের রাজনীতির গতিপথ নতুন করে নির্মাণ করে। তৎকালীন সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য রাতের আঁধারে বিদ্রোহ করে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নিজেকে সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ৩ নভেম্বর সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দী করেন। ওই দিন জাতীয় চার নেতাকেও জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মুশতাককে পদচ্যুত করে বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। ৩ নভেম্বর জিয়াউর রহমান বন্দী হওয়ার পর ৭ নভেম্বর পর্যন্ত এ চার দিন দেশ ও দেশের জনগণ দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে। ৬ নভেম্বর রাত প্রায় ১টার সময় সশস্ত্রবাহিনীর পুনরুত্থানকারী চক্রের বিরুদ্ধে বীর জনগণ, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর সিপাহিরা বিপ্লব ঘটিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেন।সিপাহি-জনতার মিলিত বিপ্লবের চার দিনের দুঃস্বপ্নের ইতি হয়। আওয়াজ ওঠেন ‘সিপাহি-জনতা ভাই ভাই’, ‘জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ’। ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের ফলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিরাপদ হয়। 

জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধানের দায়িত্ব ফিরে পান। এরপর সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার যেমন উদ্যোগ নেন, তেমনি সময়ের প্রয়োজনে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, সমাজনীতি, নৈতিকতা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সব ক্ষেত্রেই তিনি সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। রাজনীতিকে অস্থিরতা কাটিয়ে একটি সমন্বিত সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। সামরিক বাহিনীর লোক হয়েও তিনি রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। সাধারণত মিলিটারি শাসকেরা রাজনীতিবিদদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন এবং সূক্ষ্ম রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে সামরিক সিদ্ধান্ত প্রয়োগের চেষ্টা করেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান রাজনীতি ও সমরনীতির প্রভেদ বুঝতেন। দেশের একটি অন্ধকার সময়ে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পেয়ে ১৯৭৫-এর ২৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া দ্বিতীয় ভাষণেই জেনারেল জিয়াউর রহমান অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেন।

জিয়াউর রহমান যখন জাতির হাল ধরেন, তখন জাতি হিসেবে আমরা ছিলাম বহুধাবিভক্ত। শেখ মুজিবুর রহমানের বাঙালি জাতীয়তাবাদ দেশের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মাঝে যে জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি করে, তা দেশের অর্থনৈতিক, উন্নয়ন, সামাজিক শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জাতীয়তার পরিচয়ের এক অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। জাতীয় জীবনের এই সঙ্কটময় মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন করেন।

‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে’র ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গঠনের মাধ্যমে তিনি রাজনীতিতে সব মতের মানুষের সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন। ‘দেশ’ ও ‘মানুষ’ই তার রাজনীতির প্রধান প্রতিপাদ্য ছিল। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও আদর্শের পরিচয় একটা বক্তৃতার মাধ্যমে আমি তুলে ধরছি। ১৯৭৬-এর ১৩ মার্চ রামপুরা টেলিভিশন ভবনে বেতার ও তথ্য বিভাগের পদস্থ অফিসারদের এক সমাবেশে জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেছিলেনÑ ‘আমরা সকলে বাংলাদেশী। আমরা প্রথমে বাংলাদেশী এবং শেষেও বাংলাদেশী। এই মাটি আমাদের, এই মাটি থেকে আমাদের অনুপ্রেরণা আহরণ করতে হবে। জাতিকে শক্তিশালী করাই আমাদের লক্ষ্য। ঐক্য, শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম, নিষ্ঠা ও কঠোর মেহনতের মাধ্যমেই তা সম্ভব।’ (দৈনিক বাংলা, ১৪ মার্চ, ১৯৭৬)

জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ‘জাতীয় সেনাবাহিনী’ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। প্রশিক্ষণ, কঠোর পরিশ্রম ও কর্তব্যনিষ্ঠা দিয়ে অফিসারদের নিজ নিজ পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও তাদের মাঝে দেশপ্রেম জাগাতে অসামান্য অবদান রাখেন তিনি। ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিয়ে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আত্মবিশ্বাসী করে তোলেন তাদের।

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সামরিক বাহিনীর একটা ক্ষুদ্র গ্রুপের সংঘটিত অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হলেও এটা সত্য যে, তিনিই সামরিক বাহিনীতে ঐক্য ও সংহতি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। উন্নত প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রশস্ত্রের সমন্বয়ে ও সম্মানজনক বেতন-ভাতা প্রদানের মাধ্যমে তিনি সামরিক বাহিনীর মনোবলকে উন্নত স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দুর্বল-শক্তিশালী সব দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। ভারত, চীন, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ সবার সাথে পারস্পরিক সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক স্থাপন করতে যথেষ্ট সফলতা দেখিয়েছেন। দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি বৈদেশিক নীতি নির্দিষ্ট ও বাস্তবায়ন করেন। জোট নিরপেক্ষ এবং ইসলামি দেশগুলো ও বিভিন্ন উন্নয়নকামী দেশের সম্মেলনে তার ব্যক্তিগত এবং সক্রিয় অংশগ্রহণে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে বিশেষ গতি সঞ্চারিত হয়। ব্যক্তিগত কূটনীতির মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতাকে কাটিয়ে তুলতে সক্ষম হন।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বৈদেশিক নীতির দীর্ঘমেয়াদি সফলতাকে তিন ভাগে আলোচনা করা যায়। প্রথমত, তিনি জাতিসঙ্ঘকে কেন্দ্র করে একটি বিশ্বব্যাপী শান্তির আবহ তৈরি করার লক্ষে বাংলাদেশের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদার উন্নয়ন ঘটান। ফলে বাংলাদেশ ১৯৮০ সালে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়। তিনি উপমহাদেশের জন্য একটি স্থানীয় শান্তি কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো নিয়ে আসিয়ানের মতো সংস্থা গড়ার উদ্যোগ নেন, যা পরবর্তীকালে সার্ক প্রতিষ্ঠা পায়। প্রেসিডেন্ট জিয়ার পররাষ্ট্রনীতির আরেকটা লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যকে বহুমুখীকরণ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ ও সাহায্যকে উৎসাহিত করা। তার শাসনকালে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার নিরলস প্রচেষ্টার প্রশংসা করে বিশ্বের বিভিন্ন পত্রিকা।
ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনালের সুজান গ্রিন ঢাকা থেকে পাঠানো এক ডেসপাচে লিখেছিলেন, ‘সাম্যের প্রতীক ও সৎ লোকরূপে ব্যাপকভাবে গণ্য জিয়াউর রহমান স্বনির্ভর সংস্কার কর্মসূচি শুরু করে বাংলাদেশের ভিক্ষার ঝুড়ি ভাঙার প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন।’ মালয়েশীয় দৈনিক ‘বিজনেস টাইমস’-এ প্রকাশিত ওই ডেসপাচে বলা হয়, ‘অতীতে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত করেছিল যে মহামারী সমস্যাগুলো, প্রেসিডেন্ট জিয়া কার্যত সেগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ নভেম্বর, ১৯৭৯)

এ সময় বাংলাদেশের নিরাপত্তা কৌশল নিয়েও বিশ্ববাসী উচ্চ ধারণা পোষণ করে। বাংলাদেশের নেতৃত্বের প্রতি বহির্বিশ্বের আস্থা সৃষ্টি হয়। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শহীদ জিয়ার আরেকটা অবদান হলো নাগরিক বাহিনী গঠনের চিন্তা বাস্তবায়ন করা। তিনি এক কোটি নারী ও পুরুষকে সাধারণ সামরিক প্রশিক্ষণ দানের লক্ষে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) গঠনের মাধ্যমে দেশ গঠন ও নিরাপত্তায় ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দেন। জিয়াউর রহমানের গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী করার পদক্ষেপ ছিল উল্লেখ করার মতো। কৃষকদের স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়ন প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বিশেষ প্রচার পেয়েছিল। জিয়াউর রহমান আমলানির্ভর প্রকল্প না করে স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এতে কৃষকদের মধ্যেও ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। এভাবে জিয়াউর রহমান ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে খ্যাত বাংলাদেশকে রফতানিমুখী বাংলাদেশে পরিণত করতে সক্ষম হন। তার যোগ্য ও ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় বন্ধুহীন বাংলাদেশ বন্ধুত্বের জাল বিস্তার করে বিশ্বে নেতৃত্বদানে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

এ বছরের ১৯ জানুয়ারি বিশ্বের নানা প্রান্তে নানান আয়োজনে জিয়াউর রহমানের ৮১তম জন্মদিন পালিত হতে যাচ্ছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জন্মদিনের এই মাহেন্দ্রক্ষণে তার ভক্ত-অনুরক্ত ও আদর্শের ধ্বজ্জাধারী ধারক ও বাহকদের জন্য রইল অশেষ ভালোবাসা ও আন্তরিক শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন।

  • লেখক অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ ও সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  • কার্টসিঃ নয়াদিগন্ত/জানুয়ারি ১৮, ২০১৭ 

জিয়ার অবদান : ইতিহাস যা বলে

নাজিম উদ্দিন আহমেদ পান্না


বাংলাদেশের অগ্রগতিকে থামিয়ে দিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফলে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে কিছু বিপথগামী সৈন্যের হাতে শহীদ হন। আমাদের ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণের এক ব্যতিক্রমী চরিত্র শহীদ জিয়া। বাংলাদেশের এই অমিততেজা বীর যোদ্ধা রাষ্ট্রনায়ক শুধু এ দেশের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কই নন, আধিপত্যবাদবিরোধী সংগ্রামের একজন কাণ্ডারিও।

জিয়াউর রহমানের মধ্যে অনেক বৈশিষ্ট্য ও গুণের সমাবেশ ছিল। স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুুদ্ধের সংগঠক ও সেক্টর কমান্ডার, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা, আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি, ইসলামি উম্মাহর ঐক্যপ্রচেষ্টার অগ্রদূত, সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা, তৃতীয় বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা ও আধিপত্যবাদবিরোধী বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর এবং সফল রাষ্ট্রনায়ক।

১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের পর সেনা আমলাতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। সামরিক আমলাতন্ত্রের সাথে ষড়যন্ত্রে মিতালি গড়ে তোলেন পিপিপি নেতা ভুট্টো। ক্ষমতার লড়াইয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ হয় অনিবার্য। মেজর জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন। ১৯৭৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমান ভারত সফরকালে ভোজসভায় ভারতের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট সঞ্জীব রেড্ডি বলেন, 'Your position is already assured in the annals of the history of your country as a brave freedom fighter, who was the first to declare the independence of Bangladesh. (সূত্র : অধ্যাপক শামসুল হকের Bangladesh in International politics, Page-96)

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণদানকালে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে বলেন, 'The other country has pushed across the border people who did not Vote for their Government, but voted for the regime they wanted. There is no other crime which these people have committed, because they cry for independence arose after Sheikh Mujib was arrrested and not before. He himself, so far as I know has not asked for independence even now.' (সূত্র : Bangladesh documents, Information ministry, Govt of India, Vol-ll, page-275)। এই বক্তব্যে ইন্দিরা উল্লেখ করেন মরহুম শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি।

প্রখ্যাত আইনজীবী এবং মুজিব সরকারের খাদ্য প্রতিমন্ত্রী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় পদ্মাতীরের আগারগাঁও গ্রামে বসে আমি এবং তাজউদ্দীন আহমদ জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেছিলাম। মেজর জিয়ার আহ্বান বেসামরিক-সামরিক তথা বাংলার সর্বশ্রেণীর মানুষকে উজ্জীবিত করে।’ (সূত্র : স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র, ১৫ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৯৫)। এ ছাড়া সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী ও জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের লেখনী ও বক্তব্যে শহীদ জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার প্রমাণ পাওয়া যায়।

মুক্তিযুদ্ধকালে শুধু সেক্টর কমান্ডার হিসেবে নন, তিনটি সেক্টর সমন্বয়ে গঠিত জেড-ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭২ সালের জুন মাসে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালে কর্নেল পদে এবং ১৯৭৩ সালের মধ্যভাগে ব্রিগেডিয়ার ও শেষভাগে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।

জিয়াউর রহমান বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ও দূরদর্শী ছিলেন। মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে তিনি ১৯৭৭ সালে ‘একুশে পদক’ প্রবর্তন করেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন আজকের শিশুই আগামী দিনের রাষ্ট্রনায়ক। তাই তিনি ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন শিশু একাডেমি। 

কৃষকবন্ধু জিয়াউর রহমান আধুনিক কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তন করায় কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটে। ১৯৭৪-৭৫ সালে সারা দেশে ধান উৎপন্ন হয়েছিল এক কোটি ১১ লাখ ৯ হাজার মেট্রিক টন। ১৯৮০-৮১ সালে সমগ্র দেশে ধান উৎপন্ন হয় এক কোটি ৩৬ লাখ ৬২ হাজার মেট্রিক টন। একটি নিরক্ষর জাতির পক্ষে উন্নয়ন অসম্ভব। ১৯৮০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জিয়াউর রহমান জাতীয়ভাবে নিরক্ষরতা দূরীকরণ কর্মসূচি চালু করেন। ১৯৭৬ সালে জিয়া সরকার আইন করে মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ মাসের শিক্ষকদের বকেয়া বেতন প্রদান করেন। স্বাধীনতার পর শাসকগোষ্ঠী দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। শহীদ জিয়া দুর্র্নীতির অবসান ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে চেষ্টা করে সফল হন। 




১৯৭৪-৭৫ সালে দেশে মোট খাদ্যসাহায্য এসেছিল ৫১ কোটি মার্কিন ডলারের ওপরে। তখন জনসংখ্যা ছিল সাত কোটি ৬০ লাখ। গাণিতিক হিসাবে মাথাপিছু বৈদেশিক সাহায্য ছিল প্রায় ৬.৭ মার্কিন ডলার। অন্য দিকে ১৯৮১ সালে দেশে জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৯ কোটি। খাদ্যসাহায্য এসেছিল ২৫ কোটি মার্কিন ডলারের সমমূল্যের। গাণিতিক হিসাবে মাথাপিছু ২.৮ মার্কিন ডলার। প্রধানত দুর্র্নীতির কারণে ৭৪ সালে দুর্ভিক্ষে লাখো আদমসন্তান প্রাণ হারায়। দুর্নীতিমুক্ত হওয়ায় ১৯৮১ সালে দেশে খাদ্যসঙ্কট ছিল না। এ দেশের কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে শহীদ জিয়া ‘খাল কাটা’ কর্মসূচি উদ্বোধন করেন। তার শাসনামলে ১৪০০ খাল খনন হয়। ফলে কৃষিতে বৈপ্লবিক উন্নয়ন সাধিত হয়। মুজিব সরকারের তুলনায় শহীদ জিয়ার সরকার আমলে জিডিপি ৩.৩৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে জিয়াউর রহমান উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পল্লীর জনগণ যেন সুচিকিৎসা পায় তার ব্যবস্থা করেন। তিনি পল্লী চিকিৎসক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। ফলে মাত্র এক বছরেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন ২৭ হাজার পল্লী চিকিৎসক।

১৯৭৬ সালে জিয়া ‘রাজনৈতিক দল বিধি ১৯৭৬’ জারি করেন। ফলে দেশে বহু দলের পুনরুজ্জীবন ঘটে। ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৮ সালে চারটি বিভাগীয় শহরে জিয়া সরকার ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন করে, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত করে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা শহীদ জিয়া। প্রথমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘ধর্ম বিভাগ’ গঠন করেছিলেন। এটা পূর্ণাঙ্গ ধর্ম মন্ত্রণালয়ে রূপান্তরিত হয়। জিয়াউর রহমান সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করেন। যুবসমাজকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়ার লক্ষ্যে জিয়া সরকার গঠন করেন যুব কমপ্লেক্স।

স্বাধীনতার পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের তেমন কোনো প্রাপ্তি বা অবদান ছিল না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ইসলামি দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে জিয়াউর রহমান সফর করেন সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ইরান, পাকিস্তান, মালি, সেনেগাল, সিরিয়া, তুরস্ক প্রভৃতি দেশ। মুসলিম দেশগুলোর স্বার্থরক্ষায় জিয়া বলিষ্ঠ ও স্বাধীনচেতা ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের ফলে ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। তদুপরি ইরানের বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘ নিষেধাজ্ঞা আরোপের উদ্যোগ নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কার্টার চাপ প্রয়োগ করেও ইরানের বিরুদ্ধে জিয়ার সমর্থন আদায় করতে পারেননি। ইরান-ইরাকের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ বন্ধে জিয়াউর রহমান বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ১৯৮১ সালে ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) অন্যতম সহসভাপতি পদ লাভ করে বাংলাদেশ। শহীদ জিয়ার সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণে সে সময় বাংলাদেশ ১৫ সদস্যবিশিষ্ট জেরুসালেম সমন্বয় কমিটি, ছয় সদস্যবিশিষ্ট জাতিসঙ্ঘের জেরুসালেম সমন্বয় কমিটি, তিন সদস্যবিশিষ্ট আল কুদস কমিটি ও তিন সদস্যবিশিষ্ট ইরান-ইরাক কমিটির সদস্য মনোনীত হয়। 

জিয়াউর রহমান শিল্পসংস্কৃতির উন্নয়নে সচেষ্ট ছিলেন। ১৯৮১ সালে ঢাকায় এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন তিনি। ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউট ছাত্রাবাস ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ শহীদ জিয়ার অবদানের সাক্ষ্য দেয়। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণের প্রয়োজনে তিনি সার্ক গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পারিষদের সদস্যপদ লাভ করে। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য বাংলাদেশের আপত্তির কারণেই ১৯৭৯ সালে জাতিসঙ্ঘ ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেনি। ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমান মক্কার কাছে তায়েফে ইসলামি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করেন।

নারীসমাজের কল্যাণসাধনে জিয়াউর রহমান মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত করেন। নারীসমাজকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে জিয়া প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয় মহিলা সংস্থা। স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান সর্বপ্রথম মহিলা রাষ্ট্রদূত ও মহিলা অডিটর জেনারেল নিয়োগ করেন। তিনি মহিলা পুলিশ, আনসার ও ভিডিপি বাহিনী গঠন করেন। মহিলা হোস্টেল প্রতিষ্ঠা করেন। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ১৫ থেকে ৩০-এ উন্নীত করেন। মহিলাদের জন্য চাকরির ক্ষেত্রে নন-জেগেটেড পদে ১৫ শতাংশ, গেজেটেড পদে ১০ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করেন। শহীদ জিয়ার মন্ত্রিসভায় মহিলা মন্ত্রী ছিলেন একাধিক। জিয়া ১৯৮০ সালে যৌতুকবিরোধী আইন প্রণয়ন করেন। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন। শাহাদতবার্ষিকীতে বিজয়ী জাতির বিজয়ী নেতার স্মৃতির প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।


  • লেখক আইনজীবী
  • কার্টসি — নয়াদিগন্ত/ জুন ২, ২০১৫

শহীদ জিয়া এক মহান নেতা

ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান

বাংলাদেশের জননন্দিত মহান নেতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, রণক্ষেত্রের বীর সেনানী, সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের প্রধান ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নামে বর্বরোচিত আক্রমণ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতারের পর বাঙালি জাতির জীবনে এক চরম ক্রান্তিকাল উপস্থিত হয়। সেই ক্রান্তিলগ্নে সেনা কর্মকর্তা মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ‘We revolt’ বলে বিদ্রোহ এবং পকিস্তান বাহিনীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। শুধু তাই নয়, তিনি চট্টগ্রাম কালুরঘাটে স্থাপিত অস্থায়ী বেতারকেন্দ্র থেকে প্রথমে নিজ নামে এবং পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নিজের অক্ষয় স্থান নিশ্চিত করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ‘বীর উত্তম’ খেতাব অর্জন করেছিলেন।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এ মাটির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান। সৈনিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু হয়েছিল জিয়ার তাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্ফূরণ ঘটে ১৯৭৫ সালে। এ বছরের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্ট, ক্রমবর্ধমান অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান যুগপৎভাবে সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম পদত্যাগ করলে জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির দায়িত্বও গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম দলীয় ভিত্তিতে ও প্রত্যক্ষ ভোটে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন জিয়া। এভাবেই একজন সমর নেতা থেকে জিয়াউর রহমান একজন রাজনীতিবিদ জননেতায় রূপান্তরিত হয়েছিলেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ জিয়াউর রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনীতি নতুন পথনির্দেশ লাভ করে।

জিয়াউর রহমান দেশপ্রেমে উজ্জ্বল এক অনুভূতির নাম। বাংলাদেশের ইতিহাসে তার শাসনামল (১৯৭৫-১৯৮১ খ্রি.) সবিশেষ উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার সাফল্য ছিল বহুবিধ। তিনি ছিলেন আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার। তিনি নানা সঙ্কটে বিধ্বস্ত, ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যাপ্রাপ্ত বাংলাদেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে অধিষ্ঠিত করে দেশের ইতিহাসে একজন সফল ও মহান রাষ্ট্রনায়কের খ্যাতি লাভ করেছেন। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তক। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। শহীদ জিয়ার উদ্যোগে দেশে পুনরায় বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই রাষ্ট্রপতির জারিকৃত ‘রাজনৈতিক দল-বিধি’ (Political Parties Regulations- PPR)-এর আওতায় ২১টি রাজনৈতিক দল সরকারি নিবন্ধন লাভ করেছিল। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি নিজে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তার প্রতিষ্ঠিত দলটি বর্তমানে বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। জিয়া শুধু বহুদলীয় রাজনীতির পুনপ্রর্বতন করেননি, তিনি বাংলাদেশের গণমাধ্যমের হরণ করে নেয়া স্বাধীনতাও পুনপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফলে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে যেখানে সরকার নিয়ন্ত্রিত মাত্র চারটি সংবাদপত্র চালু ছিল, তার শাসনামলে এর সংখ্যা দাঁড়ায় কয়েক শ’তে। সাংবাদিকদের জন্য নতুন ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন, প্রশিক্ষণের জন্য প্রেস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা এবং বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য প্রেস কাউন্সিল গঠন জিয়ারই অবদান।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নকল্পে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। সমস্যা জর্জরিত এ দেশে দ্রুত সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন, আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন এবং জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে পল্লী উন্নয়ন, দ্রুততর প্রবৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ইত্যাদি লক্ষ্যকে সামনে রেখে জিয়া বিখ্যাত ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। দেশে আর্থসামাজিক পরিবর্তন ঘটাতে তিনি দেশের রাজনীতিকে উৎপাদনমুখী রাজনীতিতে রূপান্তরিত করেন। এ লক্ষ্যে তিনি যে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন, সেটিকে তিনি ঘোষণা করেন ‘বিপ্লব’ হিসেবে। ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জিয়া এক ভাষণে এ বিপ্লবের কথা বলেন। তিনি তার ঘোষিত ১৯ দফাকে এ বিপ্লবের কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করেন এবং দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ঐকান্তিকভাবে কাজ করতে উৎসাহিত করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন কৌশল হিসেবে বেসরকারি খাতকে উৎসাহ দান এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির দ্বার উন্মোচন করেন। বেসরকারি খাতকে উদ্বুদ্ধকরণে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করেন।

জিয়া সরকার জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে বাংলাদেশের ‘এক নম্বর জাতীয় সমস্যা’ হিসেবে ঘোষণা এবং এর নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে। এ উদ্দেশ্যে প্রথমে ‘জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট’ (NIPORT) এবং পরে ‘পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়’ নামে একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।

নারীসমাজের অবস্থার উন্নয়ন এবং জনজীবনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচিতে যুক্ত করার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ হাতে নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে মহিলা বিষয়ক একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। জাতীয় মহিলা সংস্থা ও নারী উন্নয়ন একাডেমির তত্ত্বাবধানে নানামুখী প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে নারীদের কর্ম উপযোগী করে তোলা হয়। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশ, যুবসমাজকে দেশপ্রেম, জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচি ও দায়িত্ববোধে উদ্দীপ্ত করার লক্ষ্য নিয়ে তাদের জন্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় যুবসংস্থা ও গ্রামে যুব কমপ্লেক্স গঠন করা হয়।

দেশের সামগ্রিক উন্নতির জন্য একটি শিক্ষিত মানবসম্পদ গড়ে তোলা শহীদ জিয়ার অন্যতম লক্ষ্য ছিল। স্বনির্ভরতা অর্জনের পরিপূরক হিসেবে গণস্বাক্ষরতা কর্মসূচি চালু করায় স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের প্রায় ৪০ লাখ নিরক্ষর লোককে স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়।

একটি বিভাজিত, স্থবির ও হতাশাগ্রস্ত জাতিকে অভিন্ন পরিচয়ে আবদ্ধ করে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জিয়া বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কথা বলেন। তিনি মনে করতেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন ভাষাভাষী ও ধর্মমতের জাতিগোষ্ঠী বাস করে। তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার ধরন বিভিন্ন। তাই শুধু ভাষা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে নয়, বরং ভূখণ্ডের ভিত্তিতেই জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করা উচিত। তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে ধর্ম-বর্ণ-জেন্ডার-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সব নাগরিকের ঐক্য ও সংহতির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। জাতীয়তাবাদের এ ধারণা বাংলাদেশে তৎকালে বিরাজমান কৃত্রিম রাজনৈতিক বিভেদের অবসান ঘটিয়েছিল।

একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জিয়াউর রহমান পারস্পরিক সমঝোতা ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে শান্তি ও অগ্রগতি অর্জনের লক্ষ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ার প্রয়াস নেন। বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করা, দেশের স্বার্থ সুরক্ষা, জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নতি ইত্যাদি উদ্দেশ্যে নতুন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেন। কোনো বিশেষ পথ-মতের রাষ্ট্রশক্তি নয়, বরং সব পথ-মতের অর্থাৎ দক্ষিণ, মধ্য ও বামপন্থী রাষ্ট্রগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠাই ছিল জিয়া সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বিশেষ দিক। তার সময়ে মুসলিম বিশ্ব, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও বিদ্যমান সম্পর্কের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। জিয়ার শাসনামলেই বাংলাদেশ আল কুদসের শীর্ষ কমিটি, ইসলামিক সলিডারিটি কমিটি, ইরাক-ইরান শান্তি কমিটিসহ মুসলিম ও আরব বিশ্ব সংক্রান্ত বিভিন্ন কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করে। তখন বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কার্যক্রমের সাথেও সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হয়। তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণা উদ্ভাবন করেন। ‘দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা’-সার্ক তার চিন্তা ও প্রয়াসের ফসল।

জিয়াউর রহমান ছিলেন সৎ, আদর্শবান ও নিরহঙ্কারী মানুষ। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার সাদাসিধে জীবন-যাপন মানুষের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। জিয়ার প্রতি মানুষের অপার ভালোবাসা, তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আর্থসামাজিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের উজ্জ্বল ভাবমর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠা অনেকেরই সহ্য হয়নি। তাই তার বিরুদ্ধে শুরু হয় সুগভীর ষড়যন্ত্র। এর শেষ পরিণতি ১৯৮১ সালের ৩০ মে কতিপয় বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে তার মর্মান্তিক শাহাদাতবরণ।

জিয়া একজন ক্ষণজন্মা ব্যক্তি ও মহান রাষ্ট্রনায়ক। জিয়া বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। জাতীয় ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে একজন পরিত্রাণকারী হিসেবে রাজনীতিতে জিয়ার আবির্ভাব। তিনি শতধা বিভক্ত জাতিকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করেছেন। জিয়া দেশপ্রেমে উজ্জ্বল এক অনুভূতির নাম। ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ’- ছিল জিয়ার বিশ্বাস ও ধ্যান। তিনি আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার। একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শুধু রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেননি, স্বাধীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতেও তার বলিষ্ঠ ভূমিকা ও অবদান রেখে গেছেন। ইতিহাস থেকে কারো অবদান জোর করে মুছে দেয়া যায় না। সাময়িকভাবে আজ জিয়াকে হেয় করা, তার সোনালি অবদানকে অস্বীকার করার অপতৎপরতা আমরা দেখছি। কিন্তু এ অপপ্রয়াস সফল হবে না। জিয়াকে ভুলিয়ে দেয়া, তার অবদানকে মুছে ফেলার সাধ্য এ দেশে কারো হবে না। জিয়া থাকবেন দেশপ্রেমিক বিবেকবান প্রতিটি মানুষের অন্তরে এক জীবন্ত প্রত্যয় হিসেবে।


  • লেখক অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
  • কার্টসি —  নয়াদিগন্ত/  মে ২৯, ২০১৮ 

সাংবাদিকতা এখন বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি — মাহ্ফুজ আনাম

মাহ্ফুজ আনাম

মাহ্ফুজ আনাম ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইল স্টার-এর সম্পাদক এবং বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদের সভাপতি। প্রথম আলোর ২১ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রাক্কালে তিনি বৈশ্বিক পরিসরে ও বাংলাদেশে সাংবাদিকতার বর্তমান অবস্থা, এর চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম।

প্রথম আলো: সাংবাদিকতার অবস্থা এখন কেমন?


মাহ্ফুজ আনাম: সাংবাদিকতা এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

প্রথম আলো: কী অর্থে?


মাহ্ফুজ আনাম: স্বাধীনতা চর্চার দিক থেকে সাংবাদিকতা এখন সারা বিশ্বে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। যেমন আমরা জানি আমেরিকা স্বাধীন সাংবাদিকতার দেশ হিসেবে সুপরিচিত। সে দেশে সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর মতো একটা অনন্য বিধান আছে, যা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। সেই দেশেই এখন প্রেসিডেন্ট কথায় কথায় সাংবাদিকদের বকাঝকা করেন। সংবাদমাধ্যমে যা কিছু তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশিত হয়, তাকেই তিনি ফেক নিউজ বলেন। তিনি প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের নিকৃষ্টতম জীবদের অন্যতম বলছেন। এভাবে সাংবাদিকদের ও সাংবাদিকতা পেশাকে হেয় করা হচ্ছে। শুধু আমেরিকা নয়, পশ্চিমা দেশগুলো ছিল স্বাধীন সাংবাদিকতার তীর্থস্থান; তাদের সাংবাদিকতার মূল্যবোধ ও স্বাধীনতার চর্চা থেকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের সাংবাদিকেরা অনুপ্রাণিত হতাম। সেটা এখন সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।

প্রথম আলো: স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতি ক্ষমতাধরদের দিক থেকে চ্যালেঞ্জ তো সব সময়ই কমবেশি ছিল।


মাহ্ফুজ আনাম: এখন সাংবাদিকতার স্বাধীনতা খর্ব করার উদ্দেশ্যে দেশে দেশে অত্যন্ত কঠোর আইন–বিধান প্রণয়ন করা হচ্ছে। এটা একটা বৈশ্বিক প্রবণতা। আরও এক দিক থেকে সাংবাদিকতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সেটা ঘটেছে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের ফলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসার ফলে একজন পাঠকের সামনে সংবাদের অনেক পথ উন্মোচিত হয়েছে। সে এখন আর খবরের কাগজ, টেলিভিশন ও রেডিওর ওপর নির্ভরশীল নয়। যেকোনো খবর সে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৎক্ষণাৎ জেনে ফেলছে। শুধু জেনে ফেলছে না, সে তাৎক্ষণিকভাবে নিজের অভিমত দেওয়ারও সুযোগ পাচ্ছে। খবরের কাগজের পাঠকের সেই সুযোগ ছিল না; তাকে সম্পাদক বরাবর চিঠি লিখতে হতো, সেই চিঠি ছাপা হতো কি হতো না, হলে কদিন পরে ছাপা হতো ইত্যাদি অনেক সমস্যা ছিল। কিন্তু এখন যার হাতেই একটা স্মার্টফোন আছে, সে তার মতামত প্রকাশ করতে পারছে এবং তার মতামত একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। সর্বসাধারণের মতপ্রকাশের এত ব্যাপক স্বাধীনতা পৃথিবীর ইতিহাসে কখনো ছিল না।

প্রথম আলো: এটাকে আপনি সাংবাদিকতার জন্য চ্যালেঞ্জ বলতে চাইছেন কেন?


মাহ্ফুজ আনাম: কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপকতার তুলনায় একটা সংবাদপত্র, একটা টিভি চ্যানেল বা একটা অনলাইন নিউজপোর্টালের অভিগম্যতা অত্যন্ত সীমিত। নাগরিক পর্যায়ে তথ্য আদান–প্রদান ও মতপ্রকাশের এমন স্বাধীনতা ও তার এত ব্যাপকতা সাংবাদিকতার ইতিহাসে কোনো সময়ই ছিল না; এমনকি সভ্যতার ইতিহাসেই ছিল না।

প্রথম আলো: কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাগরিকেরা তো সাংবাদিকদের বিকল্প ভূমিকা পালন করতে পারে না। মানে, আমি বলতে চাইছি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পেশাদার সাংবাদিকতার বিকল্প হতে পারবে না।


মাহ্ফুজ আনাম: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটা বড় দুর্বলতা হলো, সেখানে যেসব খবরাখবর আদান–প্রদান হয়, সেগুলোর সত্য–মিথ্যা যাচাই–বাছাই করা হয় না, সেগুলো অসম্পাদিত। কিছু বলায় বাছবিচার নেই, যার যা খুশি তাই বলে দিচ্ছে। এবং মিথ্যা কথাও বলছে, নিজেদের মনগড়া কথা বলছে; কাউকে হেয় করার জন্য বা বিপদে ফেলার জন্য বলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন কদিন আগেই আমরা ভোলায় দেখলাম; তার আগে দেখেছি রামুতে। এভাবে আমরা দেখছি যে এক সম্প্রদায়ের মানুষ আরেক সম্প্রদায়ের মানুষকে বিপদে ফেলার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করছে।

প্রথম আলো: অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা নেই, যা পেশাদার সাংবাদিকতার আছে।


মাহ্ফুজ আনাম: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যে ব্যাপক স্বাধীনতা ও বিস্তৃতি, সেই তুলনায় এর দায়িত্বশীলতার ঘাটতি বিরাট। সাংবাদিকতায় যেটাকে বলা হয় এডিটোরিয়াল কন্ট্রোল বা সম্পাদকীয় নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেটা নেই। ফলে এই মাধ্যমে খবর আদান–প্রদানের অভিজ্ঞতায় লোকজন আস্থার সংকটে ভোগে। ভাবে যে, আমি যে খবরটা পেলাম, এটা ঠিক না বেঠিক; এটা গুজব বা ফেক নিউজ কি না।

প্রথম আলো: ফেক নিউজ তো শুধু নাগরিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই, সংঘবদ্ধভাবেও তৈরি করা হচ্ছে, পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হচ্ছে।


মাহ্ফুজ আনাম: ২০১৬ সালে আমেরিকার নির্বাচনের সময় নির্বাচনকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে রুশরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করেছিল কি না, তা নিয়ে অনেক তর্ক–বিতর্ক হয়েছে; তদন্ত হয়েছে। আমেরিকানরা এখন নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে রাশিয়া একটা ভূমিকা পালন করেছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এখানে রাষ্ট্রেরও ভূমিকা চলে আসছে। এসব কারণে প্রথাগত সাংবাদিকতার ওপরই লোকজনের আস্থা আবার ফিরে আসছে। তারা ফেসবুকে কোনো সংবাদ পেলেই তা বিশ্বাস করছে না, সেটা যাচাই করার জন্য কোনো নির্ভরযোগ্য সংবাদ প্রতিষ্ঠানের কাছে ফিরে আসছে: দেখি তো প্রথম আলো কী বলছে, ডেইলি স্টার কী বলছে, বা অন্য কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত সংবাদ প্রতিষ্ঠান কী বলছে। এভাবে প্রতিষ্ঠিত সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো এখন হয়ে যাচ্ছে খবর সত্যায়ন করার জায়গা। কোটি কোটি মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছে, সে তুলনায় প্রথাগত সাংবাদিকতার পরিধি অতি সামান্য। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আস্থার সংকট বিরাট।

প্রথম আলো: এটা পেশাদার সাংবাদিকতার জন্য একটা সুযোগ?


মাহ্ফুজ আনাম: বিরাট সুযোগ। আমরা যদি পাঠক–দর্শকদের আস্থা আরও দৃঢ় করতে সঠিক সাংবাদিকতা করতে থাকি, তাহলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যতই ব্যাপক হোক না কেন, তারা আমাদের কাছেই ফিরে আসবে।

প্রথম আলো: আপনি বৈশ্বিকভাবে সাংবাদিকতার সামনে দুই ক্ষেত্রের চ্যালেঞ্জের কথা বললেন। এটা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, অন্যটা প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে। আর কোনো চ্যালেঞ্জ?


মাহ্ফুজ আনাম: তৃতীয় একটা বৈশ্বিক প্রবণতা আছে। সেটা হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দায়িত্বহীন তথ্য আদান–প্রদানের সুযোগ নিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের পদক্ষেপ নিচ্ছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ভোলা ও রামুর মতো ঘটনা যখন ঘটতে পারছে, যা বিদেশেও ঘটছে, তখন তো একটা নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। এটার একটা যৌক্তিকতা আছে। কিন্তু এটার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকার অত্যন্ত কঠোর আইনকানুন তৈরি করছে, কিছু কিছু দেশে প্রয়োগও করছে। তার ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতা ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এটা একটা বৈশ্বিক প্রবণতা; অনেক দেশ এটা করছে। কয়েক দিন আগে অস্ট্রেলিয়ায় এ রকম আইনের প্রতিবাদে সে দেশের সব সংবাদপত্রের প্রথম পাতা সাদা রেখে ছাপা হয়েছে। অর্থাৎ সাংবাদিকতার ওপর রাজনৈতিক আক্রমণ হচ্ছে এবং প্রযুক্তির অপব্যবহারের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণ আরোপের সুযোগ নিয়ে কঠোর কালাকানুন তৈরি করা হচ্ছে, যা স্বাধীন সাংবাদিকতাকে কঠিন করে তুলছে।

প্রথম আলো: এখন বাংলাদেশের সাংবাদিকতার অবস্থা নিয়ে কিছু বলুন।


মাহ্ফুজ আনাম: যে তিন ধরনের চ্যালেঞ্জের কথা বলা হলো, বাংলাদেশে আমরা এই তিনটারই শিকার। তবে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা বা রাষ্ট্রনেতারা এখনো আমাদের ট্রাম্পের ভাষায় আখ্যায়িত করেননি। কিন্তু আমাদের জন্য বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, এ দেশে ডিজিটাল ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যেসব আইন করা হয়েছে, সেগুলো স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য ভীষণ প্রতিকূল। সবচেয়ে কঠোর আইনটি হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে এবং সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে এর প্রবল প্রতিবাদ জানিয়েছি। এ আইনের প্রতিটি ধারা আমরা ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছি, এটা কী সাংঘাতিক আইন। সরকার যদি এ আইন প্রয়োগ না–ও করে, এ আইনের অস্তিত্বই সাংবাদিকদের সব উদ্যম নষ্ট করে দিতে পারে। এ আইনে ১৯ ধরনের শাস্তিযোগ্য অপরাধ আছে, সেগুলোর মধ্যে ১৪টাই জামিনের অযোগ্য। তাহলে একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে যদি মামলা হয়, যেহেতু তিনি জামিন পাবেন না, বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর আগেই তাঁকে ছয় মাস, এক বছর কারাগারে কাটাতে হবে। একজন সাংবাদিকের মাথায় যদি এই দুশ্চিন্তা থাকে, তাহলে তাঁর পক্ষে কীভাবে স্বাধীন সাংবাদিকতা করা সম্ভব। তা ছাড়া, এ আইনে পুলিশকে খুব বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কোনো অপরাধ সংঘটনের প্রয়োজন নেই, কোনো পুলিশ কর্মকর্তার যদি মনে হয় যে কোনো সংবাদ প্রতিষ্ঠানের দ্বারা সে রকম কিছু করার সম্ভাবনা আছে, তাহলেই তিনি সেই সংবাদ প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার ও অন্যান্য সরঞ্জাম জব্দ করে নিয়ে যেতে পারবেন।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে তো সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বেশি মামলা হয় মানহানির অভিযোগে।


মাহ্ফুজ আনাম: হ্যাঁ, এটা আগে থেকেই ছিল, কিন্তু এত ব্যাপকভাবে এটার প্রয়োগ হতো না। মানহানির মামলা দুই রকমের হয়—একটা ফৌজদারি মানহানি, অন্যটা দেওয়ানি আদালতে মানহানির মামলা। সাধারণ নাগরিক কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মানহানি মামলা করতে গেলে আদালত হয়তো মামলা গ্রহণ করবেন না; কিন্তু কোনো প্রভাবশালী বা টাকাওয়ালা লোক মামলা করতে যান, তাহলে তাঁর মামলা নেওয়া হবে এবং সেটা নেওয়া হবে ফৌজদারি আইনে; সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হবে। তা ছাড়া, আইনে স্পষ্ট লেখা আছে, মামলা করতে পারবেন শুধু সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি, অন্য কেউ নয়। যার মানহানির অভিযোগ উঠল, শুধু তিনিই মামলা করতে পারবেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তাঁর বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী, সমর্থক, অনুসারীরা মামলা করে এবং সেসব মামলা গ্রহণ করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেটরা কিন্তু এসব মামলা না নিলেও পারেন, আইনে তাঁদের সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁরা এসব মামলা গ্রহণ করেন। এতে একই অভিযোগে ১০–১৫–২০টা মামলা হয়। আমার বিরুদ্ধে হয়েছে ৮৪টা মামলা। আইনে আরও বলা হয়েছে যে একটা মানহানির ঘটনায় একের বেশি মামলা হতে পারবে না। সেখানে একাধিক মামলা হয় কীভাবে? কিন্তু আমাদের দেশে সেটাও হয়ে আসছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই মানহানির মামলা এখন এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আর মানহানির মামলা—এই দুটো জিনিস আমাদের সাংবাদিকতা জগতে বিরাট ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সে জন্য সাংবাদিকদের সেলফ সেন্সরশিপ সাংঘাতিক বেড়ে গেছে। এখন বেশির ভাগ সংবাদ আমরা ছাপি না

প্রথম আলো: বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রভাব কতটা পড়েছে।


মাহ্ফুজ আনাম: বিরাট প্রভাব পড়েছে। ডিজিটালাইজেশনের ফলে বিজ্ঞাপনদাতারা এখন বেশি করে ঝুঁকছে ডিজিটাল প্রকাশ মাধ্যমের দিকে। সারা বিশ্বেই এটা ঘটছে। এতে মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমের বিজনেস মডেল সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পৃথিবীর অনেক দেশে নামকরা অনেক সংবাদপত্রের ছাপা সংস্করণ বন্ধ হয়ে গেছে, তারা শুধু অনলাইন সংস্করণ প্রকাশ করছে। টেলিভিশনের দর্শকও ভীষণভাবে কমে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে সাংবাদিকতা এখন একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও ব্যবসায়িক—তিন দিক থেকেই একটা ক্রান্তিকাল।

প্রথম আলো: এই ক্রান্তিকাল থেকে উত্তরণ কীভাবে ঘটতে পারে?


মাহ্ফুজ আনাম: সাংবাদিকতার সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে, এর মধ্যেই বিরাট সুযোগ লুকিয়ে আছে। এখন আমাদের নৈতিক সাংবাদিকতা সুদৃঢ়ভাবে রক্ষা করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি মানুষ যে অনাস্থা বোধ করছে, সেই অনাস্থা যদি পেশাদার সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হয়, তাহলে আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ থাকবে না। তাই আমাদের আস্থা অটুট রাখা, বরং তা আরও বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। আমরা হলাম সঠিক সংবাদদাতা—এই অবস্থানে সম্পূর্ণভাবে অটল থাকতে হবে। এটা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে জনগণ সত্য সংবাদের জন্য, সঠিক তথ্যের জন্য আমাদের কাছেই ফিরে আসবে; পেশাদার সাংবাদিকতাই বিকল্পহীন বলে প্রমাণিত হবে।

প্রথম আলো: আগামীকাল ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।এ উপলক্ষেই আমাদের এই কথোপকথন। এ নিয়ে কিছু বলবেন?


মাহ্ফুজ আনাম: প্রথম আলো বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় বিরাট পরিবর্তন এনেছে, সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমি মনে করি, প্রথম আলো বাংলাদেশের সেরা সংবাদপত্র; শুধু পাঠকসংখ্যার দিক থেকেই নয়, সাংবাদিকতার গুণমানের দিক থেকেও। আমি প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানসহ সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।

প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

মাহ্ফুজ আনাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।

  • কার্টসি — প্রথম আলো/ নভেম্বর ৩, ২০১৯