— মোঃ তাইফুল ইসলাম টিপু
তরিকুল ইসলাম ছিলেন শতভাগ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, সৎ ও সাচ্চা দেশপ্রেমিক জননেতা। শত নির্যাতনের মাঝেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন থেকেছেন তরিকুল ইসলাম। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস এবং নেতাকর্মীদের প্রতি কমিটমেন্ট তাঁর নেতৃত্বকে উদ্ভাসিত করেছে। তিনি দলমত নির্বশেষে সর্বমহলে ছিলেন জনপ্রিয়। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন স্বাধীন মতপ্রকাশে বিশ্বাসী একজন সৃষ্টিশীল গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বও। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির হাতেখড়ি, দীর্ঘ অবিজ্ঞতা সম্পন্ন পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদ তরিকুল ইসলাম বিশ্বাস করতেন,
‘রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব সৃষ্টি যখন বিলীন হবে দেশের স্বাধীনতা-গণতন্ত্র ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাসহ শোষিত মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের পথও ততোটাই রুদ্ধ হবে।’
একজন পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদ হওয়া যে কতো কঠিন তা তরিকুল ইসলাম এর রাজনৈতিক জীবনাদর্শ বিশ্লেষণ করলে তা পরতে পরতে অনুধাবন করা যায়। একজন রাজনীতিবিদের যে সংজ্ঞা ও গুণাবলী থাকা দরকার ছিল তরিকুল ইসলামের মাঝে কোনটারই কমতি ছিল না, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশিই ছিল।
১৯৬১ সালে তরিকুল ইসলাম, যশোর জিলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা, ১৯৬৩ সালে যশোর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয় থেকে আইএ এবং ১৯৬৮ সালে একই কলেজ থেকে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) পাশ করেন। ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে তার রাজনীতি শুরু। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হিসেবে যশোর এমএম কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বৃহত্তর যশোর জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতিও ছিলেন তিনি। তিনি ১৯৬৩ সালে সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দেলনের যুগ্ম-আহবায়ক ছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি তৎকালীন মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচনে পাকিস্তান মুসলিম লীগের বিপরীতে ফাতেমা জিন্নাহ-এর অনুকূলে জনমত সৃষ্টির জন্য অধ্যাপক শরীফ হোসেনের সহযোদ্ধা হিসেবে গ্রামে গ্রামে গমন এবং মানুষকে সংগঠিত করেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই শোষিত ছাত্র জনতার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেকে সর্বোচ্চ বিলিয়ে দিয়ে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। শোষিত মানুষের পক্ষে সংগ্রাম করতে গিয়ে কখনও ইটের ভাটায়, কখনও গরিব মানুষের কুঁড়ে ঘরে এবং কখনও কলার ভেলায় রাত্রি যাপন করেছেন। তিনি মাইলের পর মাইল ক্লান্তিহীনভাবে কর্দমাক্ত পথ পায়ে হেঁটেছেন।
বিচিত্রময় রাজনৈতিক জীবনে তরিকুল ইসলাম বহুবার কারাবরণ করেন ও নির্যাতনের শিকার হন। যশোর এমএম কলেজে শহীদ মিনার তৈরির উদ্যোগ নিতে গিয়েও তিনি কারাবরণ করেন। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন স্থানীয় এমএনএ কর্তৃক দায়েরকৃত মিথ্যা মামলায় তরিকুল ইসলামকে বেশ কিছুদিন কারাবরণ করতে হয়। ১৯৬৮ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের জন্য তাঁকে রাজবন্দী হিসাবে দীর্ঘ নয় মাস যশোর ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকতে হয়েছে। সাবেক পাকিস্তান আমল ও পরবর্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনসহ ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছাত্র গণআন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্য পুলিশ কর্তৃক নির্যাতিত হন এবং বেশ কিছুদিন হাজতবাস করেন। জাতীয় রাজনীতিতে তরিকুল ইসলাম ছিলেন একজন প্রথম সারির নেতা। ১৯৭০ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগদান করেন তিনি। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী আহুত ফারাক্কা লং মার্চে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বীরত্বের সহিত দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করেন।
১৯৭৩ সালে তরিকুল ইসলাম যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলে তিনি তিন মাস কারাভোগ করেন। ১৯৭৮ সালে তরিকুল ইসলাম যশোর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালে তিনি ফ্রন্টের হ্যাঁ/না নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। মরহুম মশিউর যাদু মিয়ার নেতৃত্বে ন্যাপ (ভাসানী) বিলুপ্ত হলে তিনি ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির বৃহত্তর যশোর জেলা শাখার আহবায়ক ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যশোর সদর নির্বাচনী এলাকা (যশোর-৩) থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সাবেক প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান বীরউত্তম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটিতে বিশেষ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি যে সারাজীবনই রাজনীতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন তার প্রমাণ-সেই সময় একটি দলীয় মিটিংয়ে দলের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান বলেছিলেন সবাই মন্ত্রী হতে চায়, দল করবে কে ? তখন তরিকুল ইসলাম দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘আমি দল করতে চাই।’ ১৯৮২ সালের ৫ মার্চ বিচারপতি সাত্তার সাহেব এর মন্ত্রী পরিষদে জনাব তরিকুল ইসলাম সড়ক ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। নির্বাচিত একটি সরকারকে বন্দুকের নলের জোরে ১৯৮২ সালে স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর তরিকুল ইসলাম কারারুদ্ধ হন। দীর্ঘ তিন মাস তাঁকে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখে প্রতিদিন তাঁর হাত পা বেঁধে ঝুলিয়ে তাঁর শরীরে প্রহার করা হতো। তাঁর চোখ মুখে গরম পানি ঢেলে দেয়াসহ তাঁর সকল দাঁত উপড়িয়ে ফেলা হয়। শুধুমাত্র তরিকুল ইসলামকে এরাশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগাদানে রাজি করাতেই এসব ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়। এই নির্যাতনের ভয়াবহতা এমনই ছিল যে, সেই সময় কারাগারে তাঁর স্বজনেরা প্রথম দর্শণে তাকে চিনতে পর্যন্ত পারেননি। তাঁর মুখমণ্ড সহ সারা শরীর ছিল ক্ষত-বিক্ষত। কিন্তু তিনি এতো নির্যাতনের পরেও তাঁর রাজনৈতিক নীতি ও আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। অতঃপর তথাকথিত এরশাদ হত্যা প্রচেষ্টা মামলার প্রধান আসামি হিসেবে দীর্ঘ নয় মাস ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ থাকেন। সেখানেও তাকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়। জেলখানা থেকে মুক্ত হয়ে তিনি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তৎকালীন যে কয়জন নেতা দেশনেত্রী ও গণতন্ত্রের মাতা বেগম খালেদা জিয়াকে দল এবং দেশের প্রয়োজনে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে উৎসাহিত করেছেন তার মধ্যে তরিকুল ইসলাম অন্যতম। স্বৈরাচার এরশাদের সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনেকেই লোভ-লালসায় পড়ে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করলেও ব্যতিক্রম ছিলেন তরিকুল ইসলাম।
তিনি সকল ধরণের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পাশে থেকে বিএনপি’র পতাকাকে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথরিয়া অর্থাৎ দেশের সর্বত্র উড্ডীন রেখেছেন। ১৯৮৬ সালে তরিকুল ইসলামকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়। এ সময়ে তিনি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৯০'র গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তরিকুল ইসলাম অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উত্তরণের পর ১৯৯১ এর সংসদ নির্বাচনে তাকে ১০৩ ভোটে পরাজিত দেখানো হলেও পরবর্তীতে পুনর্গণনায় তিনি বিজয়ী হন। কিন্তু ওই নির্বাচনে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়। সেসময় অনেকেই মন্ত্রী হওয়ার জন্য তদবিরে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এখানেও তরিকুল ইসলাম ছিলেন ব্যতিক্রম। কিন্তু তার অবদান দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভুলে যাননি। তরিকুল ইসলামের প্রতি শীর্ষ নেতৃত্বের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা থেকে তাঁকে ১৯৯১ সালে সরকারের সমাজকল্যাণ ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং ১৯৯২ সালে ওই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেন। এ সময়ে তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসাবেও অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি ঐ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ সালের উপ-নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি যশোর-৩ আসনের এমপি নির্বাচিত হন। বিএনপি’র মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হলে তিনি বাংলাদেশ সরকারের খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি তথ্য মন্ত্রণালয় এবং পরে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৯২ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি দলের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত দলের ৫ম কাউন্সিলে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য পদ পান। তিনি কখনোই পদের জন্য রাজনীতি করেনি। তার প্রমাণ- ১৯৮৮ সালে দলের চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাঁকে বিএনপি’র মহাসচিব হওয়ার জন্য প্রস্তাব করেছিলেন। ওই সময়ে তাঁর ঢাকাতে থাকা ও যাতায়াতের জন্য নিজের কোনো বাড়ী-গাড়ী না থাকায় তিনি সেই প্রস্তাব বিনয়ের সহিত প্রত্যাখান করেন। তরিকুল ইসলামের জন্য সেই ব্যবস্থাও করতে চেয়েছিলেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। শীর্ষ নেতৃত্বকে ওয়াদা করে তিনি বলেছিলেন,‘আমি যেখানেই থাকি আমার উপর অর্পিত সকল দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবো।’
২০০৯ সালে জাতীয় কাউন্সিলের সময় তাঁকে আবারও মহাসচিব করার বিষয়ে আলোচনা শুরু হলে তিনি এ্যাড. খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে দলের চেয়ারপারসনকে বলেছিলেন যে, ‘দলের দু:সময়ে খোন্দকার সাহেব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন বিধায় তাঁকেই পুনরায় মহাসচিব রাখা হোক।’
তরিকুল ইসলাম অনেক আগেই দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। রাজনীতিতে অনেক জুনিয়র তাঁর চাইতে বড় পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু তিনি তাতে দলের প্রতি রাগ-অভিমান করেননি। সকল সময়ে দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে তাঁর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা ছিল বিধায় যখনই দলের সংঙ্কট দেখা দিয়েছে ঠিক তখনই সংঙ্কট মোকাবেলায় তাঁকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি যথাযথভাবে সংঙ্কট মোকাবেলা করে স্ব-স্থানে ফিরে গিয়েছেন। দলের প্রায় সকল সম্মেলনে তাঁকে দলের গঠনতন্ত্র সংশোধনের চেয়ারম্যান মনোনিত করা হতো। তরিকুল ইসলাম সদালাপি ও জনবান্ধব নেতা ছিলেন। তিনি সারাজীবনই জনতার মাঝে থাকতে পছন্দ করতেন। সারাদেশসহ খুলনা বিভাগের এমন কোন ইউনিয়ন ও থানা নেই যেখানে তাঁর পদার্পণ ঘটেনি। তিনি শেষ বয়সে অসুস্থ অবস্থাতেও খুলনা বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি অধিকাংশ সময় যশোরে থাকতেন, দলের প্রয়োজনে ঢাকায় আসলেও কাজ শেষে আবার ফিরে যেতেন গ্রামজনপদের মানুষের কাছে। তাঁকে কখনোই কোন ব্যক্তি বা বলয় প্রভাবিত করতে পারতেন না। তিনি নিজে যা ভাল মনে করতেন তা নেতাকর্মীদের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন। এমনকি তাঁর পরিবারের সদস্যরাও দলীয় সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন না।
কর্মীদের প্রতি তাঁর ভালবাসা ছিল অগাধ। কাউকে কখনো কোন দায়িত্ব দিলে তার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি সার্বক্ষণিক খবর রাখতেন। দলের কোন নেতাকর্মীই তাঁর কাছে দূরের কেউ ছিলনা, কারণ যিনি ভাল কাজ করতেন তাকেই তিনি সেই কাজের বিষয়ে যথাযথ মূল্যায়ন করতেন। তিনি সদা স্পষ্টবাদী নেতা ছিলেন। তিনি অকপটে দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বস্তরের নেতাকর্মীদেরকে সত্য কথা বলতেন। দলের যেকোন নেতাকর্মীই বিপদে পড়লেই তাঁর কাছে ছুটে যেতেন, তিনি যথাযথ সমাধান দেয়ার চেষ্টা করতেন। এই কারণেই তিনি বিএনপি’র সকল নেতাকর্মীর কাছে সম্মানের পাত্র ছিলেন। তিনি অনেক সময় প্রচণ্ড রেগে যেতেন, নেতাকর্মীদেরকে শাসন করতেন আবার কিছুক্ষণ পরেই মনের গভীর থেকে মায়া মমতা দিয়ে আদর করতেন।
তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল অপরিসীম। তিনি সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরকে বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ রাখার কাজে ছিলেন দক্ষ সংগঠনের ন্যায় পারদর্শী। তিনি একজন নির্লোভ সাদামাটা প্রকৃতির নেতা ছিলেন। তিনি ৪ বার মন্ত্রী থাকার পরেও ঢাকা শহরে ১টি সীমিত আকারের ফ্ল্যাট ছাড়া তাঁর আর কিছুই নেই। পারিবারিক ব্যবসা থাকার পরেও রাজনৈতিক কারণে সেই ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ততার মুখে পড়েছে। তিনি একজন দূরদর্শী নেতৃত্বের অধিকারী ছিলেন, ১/১১’র তথাকথিত সরকার অনেককেই যখন কারাগারে নিয়েছিলেন তখন জিয়া পরিবারকে রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করার প্রক্রিয়ার সাথে যারা জড়িত ছিল তাদের এই প্রক্রিয়ার বিরোধীতা করার কারণে তাকে কারাগারে নেয়া হয়েছিলো। কারাগারে সকলেই যখন উদ্বিগ্ন তখন তিনি সকলকে বলতেন সর্বোচ্চ ২ বছরের বেশি এই সরকার টিকে থাকতে পারবে না, ঠিক তেমনটাই হয়েছে।
তিনি স্বৈরাচারের নির্যাতনে শারীরিকভাবে ভীষণ অসুস্থ হওয়ার পরও তাঁর মেধা ছিল অপরিসীম। কারণ একবার কোন কথা শুনলে সেটি আর ভুলতেন না এবং কোন কর্মীকে একবার দেখলে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মনে রাখতে পারতেন। তিনি কখনোই স্বজনপ্রীতিকে প্রশ্রয় দিতেন না। সেটির উদাহরণ মিলে তার ছেলেকে গত ২০১৬ সালের কাউন্সিলে পদ দেয়ার বিষয়ে তাঁর সম্মতি নিতে অনেক নেতাই চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি সম্মতি দেননি। এমনকি তিনি তাদের বলেছেন আমি এ বিষয়ে কাউকে বলতে পারবো না। তিনি মিতব্যয়ী ছিলেন, কারণ তাঁকে কোন দায়িত্ব দিলে যে পরিমান খরচ হতো অন্যদের দায়িত্ব দিলে তার চেয়ে অনেক বেশি খরচ হতো। তিনি কখনোই অর্থের জন্য কারো কাছে মাথানত করেননি। অনেক সময় অর্থের অভাবে তাঁর চিকিৎসা বিলম্বিত হয়েছে, দলের চেয়ারপারসন অনেক সময় তাঁর চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা করতে চেয়েছিলেন সেটিও তিনি বিনয়ের সহিত গ্রহণ করেননি। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ২০১৪ সালের আন্দোলন পর্যন্ত বিভিন্ন কৌশলে যে কয়জন নেতা আন্দোলনের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখেছিলেন তরিকুল ইসলাম ছিলেন তার মধ্যে অন্যতম। তিনি যখনই কোন গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে যাওয়ার আগে তৃণমূল থেকে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সহিত আলাপ করে তাদের মনোভাব জানার চেষ্টা করতেন এবং মিটিংয়ে সে সকল নেতাদের মতামতকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করতেন। তাঁর বাসা বাড়ীতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সদালাপ ও চা পান ব্যতিত কেউ ফিরতেন না।
দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তথা জিয়া পরিবারের প্রতি তাঁর আনুগত্য ছিল অপরিসীম। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেতে থাকে, তখনও তিনি বিছানায় শুয়ে নেতাকর্মীদেরকে নেত্রীর জন্য কিছু করার পরামর্শ দিতেন। দেশনেত্রীর যেদিন মামলার তারিখ থাকতো সেদিন শুয়ে শুয়ে টেলিভিশনের দিকে লক্ষ্য রাখতেন, মাঝে মাঝে নেতাকর্মী এবং আইনজীবীদের ফোন করে খবর নিতেন। যখনই শুনতেন নেত্রীর জামিন হয়নি তখনই তিনি নীরব-নিথর হয়ে যেতেন। অবশেষে নেত্রীকে শেষ বারের মতো মুক্ত না দেখার যন্ত্রণা নিয়েই পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছেন তিনি।
আজ দেশে বিভিন্নভাবে অনেকেই নেতা হচ্ছেন কিন্ত তরিকুল ইসলামের মতো ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাজপথে সংগ্রাম করে নেতৃত্ব সৃষ্টি এখন প্রায় বিলীনের পথে বিধায় রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মীদের মধ্যে মমত্ববোধ এবং ভ্রাতৃত্ব নি:শেষের পথে। আগামি দিনে তরিকুল ইসলামের মতো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব সৃষ্টি যতো বিলীন হবে দেশের স্বাধীনতা গণতন্ত্র ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাসহ শোষিত মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের পথ ততো বেশি বিলীন হবে। তাই দেশ ও দলকে এগিয়ে নিতে তাঁর মতো একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ তৈরি করতে হবে বার বার।
সহদপ্তর সম্পাক
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি