— এ এম এম নাসির উদ্দিন
আজ বাংলাদেশের কিংবদন্তী সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমানের এগারোতম মৃত্যু বার্ষিকী। ২০০৯ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের খড়িয়াখাল এলাকায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করেন এ কীর্তিমান পুরুষ । দেশের উন্নয়ন একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরতে পরতে মরহুম এম সাইফুর রহমানের স্পর্শ রয়েছে যা অনস্বীকার্য। দেশের প্রায় প্রতিটি খাতের উন্নয়নে রয়েছে তাঁর অবদান। রয়েছে তাঁর হাতের ছোঁয়া। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় দু'মেয়াদে দশ বছর এবং মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও মরহুম বিচারপতি আব্দুস সাত্তার এর আমলে প্রায় এক বছর তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সংসদে ১২ টা জাতীয় বাজেট পেশ করেছেন মরহুম এম সাইফুর রহমান।
১৯৯২ সালে চরম প্রতিকূলতার মাঝেই তিনি এদেশে প্রথম VAT চালু করেন যা এখন সরকারের আয়ের মূল উৎস। সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় সামঞ্জস্য বিধান এবং শৃঙ্খলা আনয়ন এর লক্ষ্যে নানা বিপত্তির মধ্যেই তিনি Public Procurement Rules 2003 (যা পরবর্তীতে আইনে রুপান্তরিত হয়) চালুর ব্যবস্থা নেন। ১৯৮১ সালে বিচারপতি মরহুম আব্দুস সাত্তার এর আমলে ব্যাংকিং খাতে কর্মচারী ইউনিয়নের উশৃঙ্খলতা তিনি কঠোর হস্তে দমন করে ব্যাংকিং সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। আমলাতান্ত্রিক ঘোর বিরোধীতার মধ্যেই তিনি ১৯৯২ সালে আয়কর বিভাগে প্রথমবারের মত ব্যাপক সংস্কারের ব্যবস্হা নেন। দেশের সব সেক্টরের খুটিনাটি ছিলো তাঁর নখদর্পণে এবং নিয়মিতই তিনি সব সেক্টরের খোঁজ খবর রাখতেন।
সরকারি চাকরির সুবাদে তাঁকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে কাজ ছাড়াও পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজের সুযোগ আমি পেয়েছি। একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক, নিবেদিত প্রাণ, কর্মঠ এ কর্মবীর বিরামহীনভাবে দেশের জন্যেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। দুর্ণীতি ও দুর্ণীতিবাজদের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর সুস্পষ্ট অবস্থান। তিনি দেশ বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন,কানাডার বেগমপাড়া, আমেরিকা, লন্ডন, অস্ট্রেলিয়া বা মালয়েশিয়ায় বাড়ি করেছেন এমন অভিযোগ তাঁর চরম দুশমনরাও করতে পারবে না। সরকারি কাজ করতে গিয়ে আমি তাঁর ব্যাপক সহযোগিতা ও সমর্থন পেয়েছি। তাঁর কাছে আমি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞ এবং ঋণী।
কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় তিনি রাগারাগি করতেন। এটা ছিল তাঁর কাজের স্টাইল। অত্যন্ত ক্ষণস্হায়ী এ আপাত রাগের পিছনে তাঁর যে দরদী মন, কোমল হৃদয় ও পিতৃসুলভ আচরণ লুকিয়ে থাকত তা কাছে থেকে না দেখলে বুঝার উপায় ছিলো না। তিনি যা কিছু বলতেন এবং করতেন তা দেশের স্বার্থেই, নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণে তাঁর অনেক সরস মন্তব্য আমি খুবই উপভোগ করতাম।
একবার তথ্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ক্যামেরা ক্রয়ের জন্যে অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দ পেতে তাঁর সাথে দেখা করি। তিনি আমাকে বললেন,' তোমারে টেহা দিয়া লাভ কি? তোমার বিটিবি ত আমারে দেহায়না। ফারলামেন্টে আমারে এট্টু হানি দেহাইয়া কেমেরা ফুচুৎ কইরা ফরধান মন্ত্রীর দিকে গুরাইয়া দেয়।' আমি বললাম, স্যার, বিষয়টা এখন থেকে আমি মনিটর করব। আমি জানতাম, তিনি রসিকতা করে কথাগুলো বলেছেন।
একবার একনেক সভায় বাংলাদেশ রেলওয়ের এক প্রকল্প বিবেচনার সময় তিনি রেলওয়ের মহাপরিচালককে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'তুমি যে কি রেল চালাও,চা মুখে দিলে নাখে ডুখিয়া যায়। এটা কি বন্ধ খরতে ফারবা?' সভায় হাস্যরোল পড়ে যায়।এরকম অনেক স্মৃতি রয়েছে আমার মানষপটে। জ্বালানি সচিব হিসেবে আমি তাঁর ব্যাপক সহযোগিতা পেয়েছি। বিশেষ করে জ্বালানি তেল আমদানিতে তাঁর সহযোগিতা না পেলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন এর পক্ষে অব্যাহতভাবে তেল আমদানি ও সরবরাহ সম্ভবপর হত না। একবার তেল আমদানির একটা প্রস্তাব ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বিবেচনাধীন ছিল। দেশে তেলের মজুদ কমে এসেছে, ক্রয় কমিটির সভাও হচ্ছিল না। আমি একদিন সন্ধ্যার পর তাঁর বাসায় গেলাম ক্রয় কমিটির সভা আহ্বানের অনুরোধ জানাতে। আগে থেকেই বেশ কয়েকজন তাঁর সাথে কথা বলছিলেন। আমাকে উপরে ডেকে তাঁর বেডরুমের পাশের ড্রইং রুমে অপেক্ষা করতে বললেন। সবাইকে বিদায় করে আমাকে তাঁর ছোট অফিস কক্ষে ডেকে নানা বিষয় আলাপ করলেন। আমি বললাম, স্যার প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফরে আছেন। জ্বালানি উপদেষ্টাও দেশের বাইরে। দ্রুত তেল আমদানির অনুমোদন না পেলে দেশে জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দেবে। দ্রুত ক্রয় কমিটির সভা আহ্বান করা প্রয়োজন। তিনি তাঁর লুংগি ডান পায়ের হাঁটুর বেশ উপরে উঠিয়ে আমাকে বললেন, দেখ, আমার পায়ের অবস্থা। দেখলাম,পুরো পায়ের চামড়া খোস পাঁচড়ার মত ক্ষত বিক্ষত। তিনি আরো বললেন, চিকিৎসার সময়ও পাচ্ছিনা। আগামীকাল চিকিৎসার জন্যে সিংগাপুর যাচ্ছি। ফেরার বিষয়টা ডাক্তারের উপর নির্ভর করছে। তেল আমদানির কথা চিন্তা করে আমি ঘাবড়ে গেলাম। তিনি ক্রয় কমিটির সভাপতি , কমিটির সভা অনিশ্চয়তায় পড়ে যাচ্ছে। আমার অবস্থা বুঝতে পেরে তিনি সপ্তাহান্তে ক্রয় কমিটির সভার একটা তারিখ দিলেন এবং বললেন, চেষ্টা করব ফিরে এসে সভায় যোগ দিতে। সভার দিন আমার খুবই খারাপ লেগেছিল যখন তিনি জানালেন ডাক্তারের অমতে এবং চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখে তিনি ফিরে এসেছেন শুধুমাত্র ক্রয় কমিটির সভায় যোগ দিতে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে তেল কিনে ভর্তুকি মূল্যে বাজারজাত করে বিপিসি যেভাবে লোকসান দিচ্ছিল তা মোকাবিলায় মরহুম এম সাইফুর রহমান সাহেবের সহায়তা আমি কৃতার্থ চিত্তে স্মরণ করছি।
- লেখক - এ এম এম নাসির উদ্দিন, সাবেক সচিব
- কার্টসি - মানবজমিন, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২০
No comments:
Post a Comment