— সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
ঠিক এক বছর দুই মাস আগে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজের আলোড়ন তোলা কথাগুলো কি মনে পড়ে! একটু মনে করিয়ে দিই। তার ভাগ্নে গুম হওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের আইজির কাছে আবেদন করেও কোনো কূল কিনারা না পেয়ে তিনি আসেন প্রেস কনফারেন্স ও ফেইসবুক লাইভে। তখন তার যে কথাটি সবার মনে দাগ কেটেছিল তা হলো, ‘আজ হয়তো আমার ভাগ্নের ক্ষেত্রে হয়েছে, কাল হয়তো আপনার ভাইয়ের ক্ষেত্রেও হতে পারে। এটা আরেকদিন আপনার সন্তান হতে পারে। কার কী পরিচয় সেটা মুখ্য বিষয় নয়, আমার কী পরিচিতি আছে, সেটা মুখ্য বিষয় নয়। আইনের শাসন রাখতে হবে এবং ন্যায়বিচার এবং সুবিচারের রাষ্ট্রে কোনো নাগরিকের এরকম একটি পরিণতির সম্মুখীন হওয়া উচিত নয়। আমি আশা করব, আইনবহির্ভূত এবং ক্ষমতার অপব্যবহার যদি কেউ করে থাকে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যেন উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।’ সোহেল তাজের ভাগ্নের বিষয়ে হয়তো উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। সোহেল তাজ ফিরে পেয়েছিলেন তার ভাগ্নেকে। তারপর আরও কত মামার কত ভাগ্নে নিখোঁজ হয়ে গেল, কত মায়ের বুক খালি হলো, কত সন্তান হলো পিতৃহারা আর কত স্ত্রী হলেন স্বামীহারা তার খোঁজ হয়তো রাখেননি এই সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
কিন্তু গুম থেমে নেই। ৩০ আগস্ট গুমের শিকার ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবসকে সামনে রেখে ১২টি মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশের গুম বিষয়ে এক যৌথ বিবৃতি দিয়েছে ২৮ আগস্ট ২০২০। এতে যেমন বাংলাদেশে দুটি সংগঠন ‘অধিকার’ ও ‘মায়ের ডাক’ আছে। তেমনি আছে অ্যাডভোকেট ফর হিউম্যান রাইটস, অ্যান্টি-ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক, এশিয়ান ফেডারেশন এগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিসএপেয়ারেন্সেস (এএফএডি), এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি), এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন (এনফ্রেল), এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআর ডব্লিউ), রবার্ট এফ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস, ওয়ার্ল্ড আরগানাইজেশন এগেইনস্ট টর্চার-এর মতো সংগঠনও। যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেছে, বর্তমান সরকারের ১ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ৩১ জুলাই ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অন্তত ৫৭২ জন মানুষকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে গুম করেছে। এরমধ্যে কিছু সংখ্যককে ছেড়ে দিয়েছে বা গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, কিছু মানুষকে তথাকথিত ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে। আর বড় একটা অংশ এখনো নিখোঁজ! যদিও বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য মতে এই সময়ে গুমের শিকার মানুষের সংখ্যা ৬০৩ জন। যৌথ বিবৃতিতে গুরুতর যে তথ্যটি উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো, গুমের বেশিরভাগ ঘটনাগুলো ঘটেছে ২০১৪ এবং ২০১৮ এর নির্বাচনকে ঘিরে। সবচেয়ে বেশি গুম করা হয়েছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে। আর ২০২৮ সালের নির্বাচনের সময় গুম করা হয়েছে অন্তত ৯৮ জনকে। আরেকটি বিষয়ও লক্ষণীয়। তা হলো, দেশের যে সব এলাকায় সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরালো ছিল, সেখানে গুমের সংখ্যাও বেশি। এ পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশে গুমের ঘটনাগুলো রাজনৈতিক।
বর্তমান সরকারের শাসনামলে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, সাইফুল ইসলাম ও হুমায়ুন কবীরের মতো আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিরা গুম হয়েছেন। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে এ সরকারের সময়ে বাংলাদেশে গুমের শিকার ছয়শ জনের বেশি হলেও বিএনপির মতে এ সংখ্যা সহস্রাধিক। গুমের শিকার ব্যক্তিদের কারও লাশ পাওয়া গেছে। আর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বা গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে কিছু মানুষকে। এখনো নিখোঁজ কয়েকশ মানুষ! সবগুলো গুমের ঘটনায় অভিযোগের তীর নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দিকেই। কিন্তু সরকার সব সময়ই অস্বীকার করে আসছে এ অভিযোগ। এমনকি এই জঘন্যতম অপরাধ নিয়ে সরকারের তরফ থেকে কখনো কখনো নির্মম রসিকতাও করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তারা নাকি পাওনাদারের ভয়ে বা প্রেমের কারণে আত্মগোপন করে আছেন। গুমের কয়েকটি ঘটনা পর্যালোচনা করলেই অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে মানবাধিকার সংগঠন ও গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের অভিযোগ ভিত্তিহীন কিনা।
অতিসাম্প্রতিক ঘটনা। ফটোসাংবাদিক ও পক্ষকাল পত্রিকার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজল ১০ মার্চ ২০২০ বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি। দুই মাস পরে তাকে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি আটক করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে। নিজ দেশে অনুপ্রবেশ করার অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার দেখায় বেনাপোল থানা পুলিশ। তিনি এখনো জেলে। বাংলাদেশের আলোচিত রাজনীতিবিদ বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমেদকেও ভারতের শিলংয়ে অনুপ্রবেশের দায়ে আটক করেছিল সে দেশের পুলিশ। অনেকেরই হয়তো মনে আছে, ২০১৫ সালে বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিল। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তার গুলশানের কার্যালয়ে অন্তরীণ। সে সময় দলের পক্ষ থেকে যিনি প্রেস ব্রিফিং করেন, তাকেই গ্রেপ্তার করা হয়। তাই দলের মুখপাত্র হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে অজ্ঞাত স্থানে থেকে প্রতিদিন দলের কর্মসূচি ও নেতাকর্মীদের জন্য শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশনা সংবাদমাধ্যমের কাছে পাঠাতেন তিনি। সে সময় হঠাৎ নিখোঁজ হন সালাহ উদ্দিন আহমেদ। পরিবার, দল ও প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে। তার দুই মাস পরে তাকে অসুস্থ উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় হাঁটাহাঁটি করতে দেখে গ্রেপ্তার করে শিলং পুলিশ। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর মুবাশ্বার হাসান সিজারকে নিখোঁজের ৪৪ দিন পর রাতে ছেড়ে দেওয়া হয় বিমানবন্দর এলাকায়। নারায়ণগঞ্জের সাতখুনের ঘটনার সূত্রপাত কিন্তু গুম দিয়েই। তাদের লাশ পাওয়া না গেলে সে গুমের সঙ্গে যে একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য ও একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর জামাই জড়িত তা জানাই যেত না।
পরিবেশবাদী আইনজীবী সমিতি ‘বেলা’র নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান অপহরণের ৩৫ ঘণ্টা পরে স্বামী এবি সিদ্দিককে ফেরত পেয়ে বলেছিলেন, ‘টাকার জন্য এই অপহরণ করা হয়েছে বলে আমি প্রাথমিকভাবে মনে করছি না। প্রচন্ড চাপের মধ্যে পড়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। গণমাধ্যমের চাপ তো ছিলই। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী নিজে নির্দেশনা দিয়ে পুরো বিষয়টি তদারকি করছিলেন।’ বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমানকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধেই। কিন্তু যথারীতি তা অস্বীকার করেছিল সবগুলো বাহিনী। শেষ পর্যন্ত ৩৬ ঘণ্টা গুম করে রাখার পর পুলিশ গ্রেপ্তার দেখায় তাকে। সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামানকে অপহরণ করা হয়েছিল ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। গুমের অভিযোগের তীরটি ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকেই। নিখোঁজের ১ বছর ৩ মাস পরে বাবাকে ফিরে পাওয়ার পর সাবেক এই রাষ্ট্রদূতের মেয়ে বলেছিলেন, বাবার গুমের বিষয়ে তারা বিস্তারিত কিছু বলতে চান না।
গুমের মতো ভয়াবহ পরিণতির অভিজ্ঞতা নিয়ে যারা ফেরত আসতে পেরেছেন তারা আর কেউ মুখ খুলছেন না। মানবাধিকারকর্মীরা নানাভাবে আশ্বস্ত করেও ভীতসন্ত্রস্ত মানুষগুলোর মুখ থেকে কিছুই বের করতে পারে না। তারা হয়তো দ্বিতীয়বার সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে চান না। এমনকি ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সংঘটিত বিশিষ্ট লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহারকে অপহরণ বিষয়টিও রয়ে গেল অন্ধকারেই। কিন্তু সরকারি বাহিনীগুলো যদি এর সঙ্গে জড়িত না থাকত, তবে তো তারাই ফেরত আসা ব্যক্তিদের অভয় ও নিরাপত্তা দিয়ে তাদের থেকে তথ্য বের করতে পারত। দায়ীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারত। কিন্তু গত একযুগে এমন একটি ঘটনাও ঘটেনি। শুরুতে তুলে নেওয়ার কথা অস্বীকার করে পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে অনেককে। এই মানুষগুলোকে গ্রেপ্তার না দেখালে তারাও হয়তো থেকে যেত গুমের তালিকায়। ফলে এই প্রশ্নও উঠতে পারে যে, গুমবিরোধী সনদ ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রোটেকশন অব অল পারসন্স এগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসএপেয়ারেন্স’-এ কেন সই করেনি বাংলাদেশ?
- লেখক চিকিৎসক ও কলামনিস্ট
- কার্টসি — দেশ রূপান্তর/ সেপ্টেম্বর ৪, ২০২০
No comments:
Post a Comment