— সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের লুটপাট, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, খুন, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন, জালিয়াতি বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে কথা বললে সমর্থকরা বলেন এদের তো সরকারই গ্রেপ্তার করছে। যুক্তির বিচারে এটি খুবই হাস্যকর কথা। সরকার ছাড়া অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার আর কেউ থাকে কোন দেশে? অপরাধীদের গ্রেপ্তার তো সরকারই করবে। কিন্তু কথা হলো, আসলেই কি সরকার অপরাধীদের স্বপ্রণোদিত হয়ে গ্রেপ্তার করছে? নাকি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হাতেগোনা কিছু অপরাধীকে ধরতে বাধ্য হচ্ছে?
সর্বশেষ দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ইউএনও ওয়াহিদা খানম হত্যাচেষ্টার বিষয়টিই দেখা যাক। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে যাকে ধরা হয়েছে সেই জাহাঙ্গীর স্থানীয় যুবলীগের আহ্বায়ক। যুবলীগের নেতা হওয়ার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করেছে এটা তো নিঃসন্দেহে বিরাট খবর। তাকে নাও তো ধরতে পারত। সুতরাং এর কৃতিত্ব সরকার দাবি করতেই পারে। কিন্তু জাহাঙ্গীরকে আরো আগে কেন গ্রেপ্তার করা হয়নি এ প্রশ্নের উত্তর কি আছে আমাদের কাছে? তিন-চার বছর আগে থেকেই জাহাঙ্গীরের দাপটে খোদ সরকারি দলের নেতারাই অতিষ্ঠ ছিলেন। তার মাদকদ্রব্য সেবন ও মাদক ব্যবসার কথা তো স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের সবাই জানত। স্থানীয় আওয়ামী লীগ দলীয় এমপির ওপর হামলার চেষ্টা করায় এই জাহাঙ্গীরকে দল থেকে বহিষ্কারের জন্য কেন্দ্রীয় যুবলীগকে চিঠি দিয়েছিলেন এমপি নিজেই। পৌর মেয়রের ওপর হামলার অভিযোগও আছে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে। তার নামে চারটি মামলা। এত কিছুর পরেও জাহাঙ্গীর না হয়েছে গ্রেপ্তার, না হয়েছে বহিষ্কার। এখন সেই জাহাঙ্গীর যখন দলবল নিয়ে রাতের বেলা ঘরে ঢুকে উপজেলার সর্বোচ্চ প্রশাসনিক অফিসার ও তার বাবাকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যার চেষ্টা করে, তখন গ্রেপ্তার করে কৃতিত্ব দাবি করতে চায় সরকার? অথচ এই জাহাঙ্গীরকে আরও আগে সে যে সব অপরাধ করেছে তার জন্য গ্রেপ্তার বা দল থেকে বহিষ্কার করলে হয়তো একজন ইউএনও’র এ মর্মান্তিক পরিণতি হতো না।
কিছুদিন আগে ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিশান মাহমুদ শামীম, শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও তার ভাই ফরিদপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান রুবেলকে গ্রেপ্তার করা হলো। গ্রেপ্তারের পর জানা গেল এই চক্রটি অন্তত দুই হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। আর নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছে। সেটা নিয়েও কত দাবি! তাদের দলের নেতা। তবুও ছাড় দেওয়া হয়নি। গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একেই বলে আইনের শাসন। কিন্তু এখানেও সেই একই প্রশ্নটা যদি করি? এদের ধরা হলো কখন? জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল সাহার বাসায় যদি তারা হামলা না করত, তাহলে কি এই নেতাদের পাকড়াও করা হতো? তারা যে এত টাকা পাচার করল, এত ধন-সম্পদের মালিক হলো তা কি কারও নজরেই আসেনি? আওয়ামী লীগের নেতা, স্থানীয় প্রশাসন এমনকি গোয়েন্দা বিভাগ কেউই কি জানত না তাদের এসব কর্মকা-ের কথা?
এই যে চৌকস জালিয়াত রিজেন্ট সাহেদ। প্রায় অর্ধশত মামলা ঘাড়ে নিয়ে তরতর করে কোথায় উঠে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক কমিটির সদস্যপদ বাগিয়ে নিয়েছিল। কেউ জানল না এই হীরের টুকরো জালিয়াতকে? সবাইকে ফাঁকি দিয়ে সে একাই এ কাজ করল? এত বছর ধরে এভাবে লালন পালন করে আজ যখন করোনার ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াল তখন গ্রেপ্তার করে বলা হলো, সব কৃতিত্ব সরকারের।
সবার চোখের সামনে এই ঢাকা শহরে ফাইভস্টার হোটেলে রঙমহল বানিয়ে দিনে লাখ লাখ টাকা রুমভাড়া ও বারের বিল দিত যুব মহিলা লীগ নেত্রী পাপিয়া। কত রথি-মহারথিদের যাতায়াত ছিল সে রঙমহলে। পাপিয়ার সে রাজত্বে কী কারবার চলে, কারা এসে আতিথেয়তা নিত সেটাও কি আওয়ামী লীগ নেতা, প্রশাসন ও গোয়েন্দাদের নজরে আসেনি কোনো দিন? কক্সবাজারের টেকনাফের ওসি প্রদীপের হাতে যে এতগুলো মানুষ বছরের পর বছর খুন হলো তা কি জানত না আমাদের পুলিশ বা গোয়েন্দা বিভাগ?
এই আলো ঝলমল ঢাকায় বছরের পর বছর জুড়ে চলল ক্যাসিনোকা-। কেউ জানল না? হঠাৎ করেই আবিষ্কৃত হলো জি কে শামীম, সম্রাট, এনু-রূপন? আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা এনু-রূপনের বাড়িতে ক্যাশ টাকাই পাওয়া গেছে ২৭ কোটি টাকা। আর সোনা ছিল বেশুমার। যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের টাকার খনি কি হঠাৎ করেই তৈরি হয়েছে? তাদের কেন আগে ধরা হয়নি? আর এত ঢাকঢোল পিটিয়ে তাদের কয়েকজনকে ধরেই অভিযানটি বন্ধ করে দেওয়া হলো কেন? যে কয়জনকে ধরা হয়েছে তারাও আরাম-আয়েশেই আছে হাসপাতালের বেডে।
এই যে ভয়াবহ সব দুর্নীতির খবর আসছে সংবাদমাধ্যমে, তার কয়টাকে সরকার নিজ দায়িত্বে ও উদ্যোগে ধরেছে? আইসিইউ’র পর্দাকান্ড, বালিশকান্ড, বঁটি-দা কান্ড, গগলসকান্ড, ল্যাকটোমিটারকান্ড, মাস্ক জালিয়াতিকান্ড হাজার হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট। নয় কোটি টাকার করোনার সরঞ্জাম কেনার কথা বলে তার থেকে আট কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে বলে সংবাদপত্রে এসেছে। বাঁশের সাঁকো মেরামতের কথা বলে মেরে দিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এর কোনোটাই কিন্তু সংবাদমাধমে প্রকাশ হওয়ার আগে সরকার ধরেনি। সংবাদমাধমে প্রকাশ হওয়ার পর ভার্চুয়াল মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনা হওয়ায় সরকার কাউকে কাউকে ধরতে বাধ্য হয়েছে।
সরকারি দল যা-ই বলুক না কেন, এটা সবাই জানেন যে দেশে সংবাদমাধ্যম মোটেও স্বাধীনতা ভোগ করছে না। এর মধ্যেও যারা সরকারের সমালোচনা কিছুটা করছেন, তারা কী ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সেটা করছেন তা তারা আর তাদের কাছের মানুষরা জানেন। ‘জ্যোতির্ময় জিয়া’ শিরোনামে পত্রিকায় নিবন্ধ লেখার ‘অপরাধে’ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর মোর্শেদ হাসান খানকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। করোনার সময়ে কার্টুন আঁকার ‘অপরাধে’ জেলে যেতে হয়েছে কার্টুনিস্ট কিশোরকে। অনেকেই প্রশ্ন করেন, তাহলে এত দুর্নীতির খবর আসছে কী করে? আসলে দুর্নীতির যে খবরটুকু আমরা পাচ্ছি তা একেবারেই নগণ্য। যেখানে বণ্টনে গ-গোল লাগে, তখন বঞ্চিতজন সেই দুর্নীতির খবরটা জানিয়ে দেন। আবার প্রশাসনের কিছু সৎ কর্মকর্তা ভেতরে দুর্নীতি ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে পরে সংবাদমাধ্যমে জানিয়ে দেন। এভাবেই খুব সামান্য অংশই সংবাদমাধ্যমে আসে। বেশিরভাগই থেকে যায় আড়ালে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে এলেও যে সব ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাও নয়। সেই দুর্নীতির পরিমাণ কত আর তার ভাগ কতদূর পৌঁছেছে তার ওপরও অনেক সময় নির্ভর করে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, কিংবা আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না।
আর সরকারি দলের প্রভাবশালী কেউ বা অন্যায্য কাজের সহযোগী কোনো সরকারি অফিসার হলে তো কোনো কথাই নেই। তারা থাকবে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে ধরা পড়ে গেলেও তাকে রক্ষা করার লোকের অভাব নেই। প্রয়োজনে নির্বিঘ্নে দেশত্যাগের ব্যবস্থাও করে দেওয়ার লোকও আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আফজাল নামে একজন কর্মচারীর দেড় হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি ধরা পড়ার পর নিরাপদে বিদেশে চলে যেতে পারার কথা হয়তো অনেকেরই মনে আছে।
- লেখক- চিকিৎসক ও কলামনিস্ট
- কার্টসি - দেশরূপান্তর/ সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২০
No comments:
Post a Comment