— ড. জাহিদ দেওয়ান শামীম
শীর্ষ জাতীয় পত্রিকা দৈনিক বাংলার ফ্রন্ট পেইজ, নভেম্বর ৮, ১৯৭৫ |
‘৭ই নভেম্বর — জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস. বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার দিন। বিপ্লব শব্দের অর্থ ব্যাপক পরিবর্তন, আর সংহতি শব্দের অর্থ মিলন ও ঐক্য। বিপ্লব হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে একটি মৌলিক সামাজিক পরিবর্তন, যখন জনগণ চলমান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জেগে ওঠে। অধিকাংশ সময় বিপ্লব শব্দটি সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহে একটি পরিবর্তন সূচিত করা বোঝায়। এরিস্টটল দুই ধরনের রাজনৈতিক বিপ্লবের বর্ণনা দিয়েছেন — ১. এক সংবিধান থেকে অন্য সংবিধানে পূর্ণাঙ্গ পরিবর্তন এবং ২. একটি বিরাজমান সংবিধানের সংস্কার। বিপ্লবের ফলে সংস্কৃতি, অর্থনীতি, এবং সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহে বিশাল পরিবর্তন সাধিত হয়। ডেভিসের মতে বিপ্লব হচ্ছে, হিংসার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত শাসকশ্রেণিকে উৎখাত করে জনসাধারণের অধিকাংশের সমর্থনপুষ্ট কোনো শ্রেণির রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস সামাজিক সম্পর্কসমূহের গুণগত পরিবর্তনকেই বিপ্লব আখ্যা দিয়েছেন। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় সামগ্রিক কাঠামোগত এবং ক্ষমতার আমূল রদবদলকে আমরা বিপ্লব বলে অভিহিত করতে পারি। শব্দটির সহজ সরল অর্থ হলো সম্পূর্ণ ভাবে ঘুরে দাড়ানো। অর্থনৈতিক অসাম্য দূর করাই শুধমাত্র বিপ্লবের একমাত্র লক্ষ্য নয়। সামাজিক সৃজনশীলতা এবং রাজনৈতিক মুক্তিও বিপ্লবের অংশ। গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থানকেও বিপ্লব বলা হয়। বিপ্লব সভ্যতার অগ্রগতির ধারক। এসব লক্ষ্যকে সামনে রেখেই মার্কিন স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৭৭৬), ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯), রুশ বিপ্লব (১৯০৫-১৯১৭) এবং ইরানের ইসলামী বিপ্লব (১৯৭৯) সংগঠিত হয়েছিল। আর ১৬৮৮ সালে ব্রিটেনে একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গৌরবময় বিপ্লব হয়েছিল। এসব বিপ্লবের মাধ্যমে অসম্ভব সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন সূচিত হয়। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর বাংলাদেশেও ব্রিটেনের মত এমন একটি বিপ্লব আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের পর থেকে জাতি এই দিবসটি পালন করে আসছে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শপথ গ্রহণ এবং সামরিক বাহিনী ও জনগণের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে। এই দিনটা অস্বীকার করা মানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা। জনগণ ও সাধারণ সৈনিক দেশের সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করার জন্য ৭ই নভেম্বর বিপ্লব করেছিলেন। এজন্যই এ দিনটিকে আমরা বিপ্লব ও সংহতি দিবস বলে থাকি।
১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লব দিবস নিয়ে জানতে বা লিখতে হলে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে কি ঘটেছিল সেখান থেকে শুরু করতে হবে। জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ ১৯৭৫ সাল বাংলাদেশে মুজিব সরকার আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশাল চালু করেছিল। এটা অত্যন্ত বিতর্কিত ও গণতন্ত্র হত্যাকারী কাজ ছিল। মানুষের বাক স্বাধীনতা ও মিডিয়ার স্বাধীনতা না থাকার কারনে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের আগ পর্যন্ত আপাতদৃষ্টিতে বা দৃশ্যমান ওপরের অংশ শান্ত বা সরকারের অনুকূলে বহমান ছিল বলে মুজিব সরকারের দৃঢ়বিশ্বাস ছিল। বাস্তবে তা ছিল না। অদৃশ্যমান পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভাবে সরকারের বিপরীতে। এই রকম পরিস্থিতিতে ১৫ই আগস্টের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছিল। ১৫ই আগস্টের ঘটনার সাথে সামরিক ও রাজনৈতিক দুই ধারার লোক জড়িত ছিল — এই ঘটনাবলিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন তৎকালীন কর্নেল শাফায়াত জামিল বীর বিক্রমের ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের অধীনে থাকা দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি। আর্টিলারি রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশীদ ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলের অগোচরে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেন এবং বিদ্রোহে সক্রিয় অংশগ্রহন করেন। সেনাবাহিনী সদর দফতরের চিফ অব দ্য জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমের অগোচরে বা গোপনে গোপনে তার অধীনস্থ একটি সাঁজোয়া ইউনিট প্রথম বেঙ্গল ল্যান্সার বিদ্রোহের প্রস্তুতি ও বিদ্রোহে অংশগ্রহন করেন। অর্থাৎ বেঙ্গল ল্যান্সারের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং গোয়েন্দাদের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেন। তাদের সাথে যুক্ত ছিলেন চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত অন্যান্য অফিসার। এটা গেল এক ধারার লোকদের কথা। অন্য ধারায় ছিলেন, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে শেখ মুজিবের বিশ্বস্ত মোশতাকসহ তার দলে নেতারা। মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবের নামের উপর প্রতিষ্ঠিত প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভারও অন্যতম সদস্য ছিলেন মোশতাক। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রী সভার অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। এই খন্দকার মোশতাকের সঙ্গী ছিলেন দুই শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য। ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর মোশতাকের নেতৃত্বে মুজিব সরকারের মন্ত্রীদের নিয়েই (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আবদুস সামাদ আজাদসহ হাতেগোনা কয়জন বাদে) নতুন সরকার গঠিত হয়। কিন্তু ক্ষমতার মূল চাবিকাঠি ছিল অভ্যুত্থানকারী ফারুক-রশিদের নেতৃত্বাধীন ‘মেজর’ গ্রুপের হাতে। ক্ষমতার এই পটপরিবর্তনকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ মেনে না নিয়ে, সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার নামে ৩রা নভেম্বর কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন ঢাকা ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের সহায়তায় এক পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটায়। মোশতাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে বিচারপতি সায়েমকে বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি করেন। তারপর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নিজেই সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে নিজেকে চীফ-অফ-আর্মি স্টাফ হিসেবে ঘোষনা করেন এবং জিয়াউর রহমানকে চীফ-অফ-আর্মি স্টাফ হিসেবে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং তাকে তাঁর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। নভেম্বর ৪ (নভেম্বর ৩ শেষ রাতে) ঢাকা জেলখানায় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই অবস্থায় খালেদ মোশাররফের সমর্থনে ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বরের একটি মিছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে। মিছিলে নেতৃত্ব দেন খালেদ মোশাররফের মা, তার ভাই আওয়ামী লীগ নেতা রাশেদ মোশাররফ। এর মধ্যে ক্ষমতা সংহত করার লক্ষ্যে বঙ্গভবনে নানা দেন-দরবারে ব্যস্ত থাকেন খালেদ মোশাররফ এবং তার সঙ্গীরা। ফারুক-রশিদ গ্রুপের সঙ্গে খালেদ মোশাররফ একটা আপসরফা করে তাদেরকে দেশের বাইরে লিবিয়ায় পাঠিয়ে দেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক হিসেবে সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল। তাই জিয়াকে অন্তরীণ রাখাকে সাধারণ সৈনিকেরা পছন্দ করেননি এবং এই ঘটনা সেনাবাহিনীর মধ্যে অত্যন্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। পাশাপাশি দেশের জনসাধারনের মধ্যে সৃষ্টি হয় চরম হতাশা ও আতঙ্ক। জনগন ভাবতে শুরু করে দেশে আবারও একদলীয় বাকশাল ও দুর্ভিক্ষের দিনগুলো বুঝি ফিরে আসছে এবং সেনানিবাসের ভিতরে-বাইরে ছড়িয়ে পড়ে যে খালেদ ভারতের পক্ষে ও ইন্ধনে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। এসময় কর্নেল তাহের, জাসদ ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা জেনারেল জিয়ার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে, তাকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল। কর্নেল তাহেরের পরিকল্পনা আগাম জানতে পেরে ২য় ফিল্ড আর্টিলারির সেনাসদস্যরা লেঃ কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ৬ই নভেম্বর রাত ১২টার দিকে জিয়াউর রহমানকে তাঁর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্ত করে ২য় ফিল্ড আর্টিলারির হেড কোয়ার্টারে আনা হয়। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান এইজন্য মাত্র ৩দিন স্থায়ী হয়। এর পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়।
বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতারা যখন জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে কর্নেল তাহেরের কাছে নিয়ে যাবার জন্য সেনানিবাসে আসে তখন তারা খুব হতাশ হয়। কর্নেল তাহের নিজেও হতাশ হয়ে পড়েন। তারপর শেষ কৌশল হিসেবে জেনারেল জিয়াকে ২য় ফিল্ড আর্টিলারির হেডকোয়ার্টার থেকে বের করে আনার জন্য সেখানে কর্নেল তাহের নিজেই উপস্থিত হন। কিন্তু পরিস্থিতি ততক্ষণে পাল্টে গেছে। সাধারণ সিপাহীদের সাথে জনতাও স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে যোগ দিয়েছে এক অভূতপূর্ব বিপ্লবে। বিনা রক্তপাতে স্বতঃস্ফুর্ত বিপ্লবের মাধ্যমে পালা বদলের পরও, এমনকি বঙ্গভবন থেকে ব্রিগেডিয়ার খালেদা মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিল পালিয়ে গেছেন এটা জানার পরও হাসানুল হক ইনু এবং কর্নেল তাহেরর নির্দেশে জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা মরিয়া হয়ে উঠে এবং সেনানিবাসের ভিতরে ৩০ জন সেনা কর্মকর্তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ২য় ফিল্ড আর্টিলারিতে কর্নেল তাহের সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে জেনারেল জিয়াকে বের করে আনার জন্য চেষ্টা করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী ও জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবার জন্য রেডিও স্টেশনে নেবার প্রস্তাব করেন। সেখানে উপস্থিত অন্যান্যরা ২য় ফিল্ড আর্টিলারিতেই রেডিও কর্মকর্তাদের ডেকে এনে জেনারেল জিয়ার ভাষণ রেকডিং করানোর পাল্টা প্রস্তাব দেন। এতে কর্নেল তাহের একাধারে আরো ক্ষিপ্ত ও হতাশ হন। এমতাস্থায় কর্নেল তাহের তার অনুগত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদেরকে যে কোন মূল্যে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিলকে হত্যার নির্দেশ দেন। কর্নেল শাফায়াত জামিল এই নির্দেশের কথা তার ব্রিগেড মেজর হাফিজের কাছ থেকে জেনে তা বঙ্গভবনে অবস্থানরত খালেদ মোশাররফকে অবহিত করেন। সেনানিবাসে ফোন করে খালেদ মোশাররফ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হন এবং কর্নেল শাফায়াত জামিলকে বঙ্গভবনে অবস্থান করত বলে কর্নেল হায়দার ও কর্নেল হুদাকে নিয়ে বঙ্গভবন ত্যাগ করেন। তারা প্রথমে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর প্রধান কর্নেল নুরুজ্জামানের বাসায় গিয়ে পোশাক পরিবর্তন করেন। সেখান থেকে তারা খালেদা মোশাররফের এক আত্মীয়ের বাসায় যান এবং কয়েক জায়গায় ফোন করার পর শেরে বাংলা নগর অবস্থানরত ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্নেল নওয়াজেশের সাথে কথা বলে নিরাপত্তার আশ্বাস পান এবং সেখানে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। পথিমধ্যে এক দুর্ঘটনায় তাদের গাড়িটি নষ্ট হয়ে গেলে প্রথমে তারা মোহাম্মদপুরের ফাতেমা নার্সিংহোমে যান। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাম্পে পৌছান। কর্নেল নওয়াজেশ আহমেদ টেলিফোনে জেনারেল জিয়াকে তার ক্যাম্পে খালেদ মোশাররফের উপস্থিতির কথা জানান। জেনারেল জিয়া ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নিরাপত্তার সকল ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কর্নেল নওয়াজেশকে নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি কর্নেল নওয়াজেশের ক্যাম্পে অবস্থানরত রেজিমেন্টের আরেকজন সেনা কর্মকর্তা মেজর জলিলের সাথে কথা বলে তাকে নির্দেশ দেন যেন তিন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ছাড়াও বাকি আরো দুজন সেনা কর্মকর্তাকে যথাযত নিরাপত্তা দেয়ার ক্ষেত্রে কর্নেল নওয়াজেশকে সাহায্য করেন।
কর্নেল হুদার স্ত্রী নিলুফার হুদার বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ঐই সময় ঢাকা সেনানিবাসের ২য় ফিল্ড আর্টিলারিতে অবস্থানরতদের কাছ থেকে জানা যায়, যথন জেনারেল জিয়া কর্নেল নওয়াজেশ ও মেজর জলিলের সাথে কথা বলছিলেন তখন কর্নেল তাহের কিছুক্ষনের জন্য বাহিরে যান। সেখান থেকে ফিরে তিনি জেনারেল জিয়ার কাছে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের সঠিক অবস্থান জানতে চান এবং আবারও কিছুক্ষনের জন্য বাহিরে চলে যান। সেনাপ্রধানর আদেশ ও নিশ্চয়তা পেয়ে কর্নেল নওয়াজেশ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও তার দুই সঙ্গীর জন্য নাস্তার আয়োজন করেন। তাদেরকে নাস্তার পরিবেশনের কিছুক্ষণের মধ্যে সামরিক বাহিনীর খাকি পোশাক পরিহিত কর্নেল তাহেরের অনুগত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বেশ কিছু সদস্য গান পয়েন্টে সেই রুমে প্রবেশ করে এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফসহ তিন সেনাকর্মকর্তাকে অস্ত্রের মুখে কক্ষের বাহিরে এনে গুলি করে হত্যা করে (‘বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায়: ১৯৭৫-৮১’)। সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে জানা যায় যে, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কিছু সদস্য কর্নেল আসাদুজ্জামানের নিকট ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও তার দুই সঙ্গীকে হত্যার জন্য কর্নেল তাহেরের নির্দেশ পৌছে দেয় এবং কর্নেল আসাদুজ্জামান নিজে এই হত্যাকান্ডে নেতৃত্ব দেন।
তাহের-ইনুর নেতৃত্বে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর আসলে একটি রক্তাক্ত ব্যর্থ অভ্যুথ্যান হয়েছিল, আর তারই সমন্তরালে সিপাহী-জনতার সম্মিলিত প্রয়াসে আরেকটি রক্তপাতহীন বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, যার নেতৃত্ব দিয়েছিল সেনাবাহিনীর ২য় ফিল্ড আর্টিলারি। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্ট থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ঘটে যাওয়া রক্তক্ষয়ী কয়েকটি অভ্যুথ্যান ও পাল্টা অভ্যুথ্যানের মাঝে সবার অলক্ষ্যে জন্ম নিয়েছিল ইতিহাসের মোড় ফেরানো এক অনন্য সাধারণ বিপ্লব যা আমুল পাল্টে দিয়েছিল বাংলাদেশের রাজনীতির ও সমাজের গতিপথ।
দেশ আজ আর গণতন্ত্র নেই। ভোটাধিকার পদদলিত। তাই, গণবিরোধী ও আগ্রাসনবাদী শক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে দেশকে এক ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এই চত্রুান্ত হাসিল করার জন্য বর্তমান সরকার সামরিক বাহিনী, আইনশৃঙ্খল বাহিনী, প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও জনতাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল লক্ষ্য ছিল — সুশাসন, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ, এক উদারচেতা, পরমতসহিষ্ণু, সংস্কৃতিমনা সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং সুখী-সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়া। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দেশ গড়তে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বর্তমান নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে, তানা হলে এসব থেকে কারও পরিত্রাণ নেই। এটা শুধু বিরোধী দলের একার কাজ নয়। ১৯৭৫ সালে ৭ই নভেম্বর সফল হয়েছিল সিপাহী জনতার ঐক্যের কারণে। তাই সকল দেশপ্রেমিক নাগরিকে ৭ই নভেম্বরের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সব ধরনের জাতিঘাতী এবং রাষ্ট্রঘাতী অপকৌশলের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে।
— লেখক সিনিয়র সাইন্টিস্ট, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।