Search

Monday, March 29, 2021

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন জাতীয় কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত স্মরণিকা





















































































বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত হত্যার দায় নেবে কে?

— তাবিথ আউয়াল


দু'হাজার এগার সালের ৭ই জানুয়ারি বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে ভারতীয় রক্ষী বাহিনী-বিএসএফের গুলিতে নিহত হন ১৪ বছরের কিশোরী ফেলানি খাতুন।


ভারতের পক্ষে অনেকবার বলা হয়েছে- বাংলাদেশ সীমান্তে মৃত্যু শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হবে। ১০ বছর আগে ২০১১ সালে 'ট্রিগার হ্যাপি' শীর্ষক হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন প্রকাশের পরে ভারত সরকার প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়। পাচারকারী ও অবৈধ পথে সীমান্ত পার হওয়া নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার চুক্তি করে বিজিবি-বিএসএফ। সে দেশের সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে আমরা অঙ্গীকার শুনতে পেয়েছি। এরও আগে ২০০৮ সালে ভারত সরকার ও বিএসএফ বাংলাদেশের জনগণকে আশ্বস্ত করেছিল। এতসবের পরও বাস্তবতা ভিন্ন।

বস্তুত ২০ বছর ধরে শত-সহস্র অঙ্গীকার-আশ্বাস-প্রতিশ্রুতির পরও আমরা ফেলানীকে কাঁটাতারে ঝুলতে দেখেছি। দেখেছি এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের নামে প্রহসন। ফেলানীসহ আলোচিত সীমান্ত হত্যার একটিরও বিচার হয়নি। ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ফেলানী খাতুনের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সেটাও মানেনি। আর আমাদের কর্তাদের দেখেছি ফেলানীকে নিয়ে নিশ্চুপ থাকার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে।

কোনো দেশের সরকারের প্রতিশ্রুতি এলে এমনটা প্রত্যাশা করাই যায় যে, কার্যক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন হবে। অথচ এই ইস্যুতে দেওয়া ভারতের প্রতিশ্রুতি কোনোভাবেই বাস্তবে রূপ পাচ্ছে না। বারবার দেখা গেছে, সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কোনো ঘোষণা হওয়ার পরপরই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। প্রাণহানির পর প্রতিটি ক্ষেত্রে বিএসএফ আত্মরক্ষার যুক্তি তুলে 'সবকিছ' ভুলে যেতে চাচ্ছে। বিজিবি কিংবা সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রতিবাদ, উদ্বেগ বা অনুরোধ তখন খুব যে কাজে আসছে না, তা অনেকটাই স্পষ্ট। অবশ্য বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, সীমান্ত হত্যার ঘটনায় বিএসএফের যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। বাহিনীটি বলছে, সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বেড়ে যাওয়ায় তারা উদ্বিগ্ন এবং প্রতিটি হত্যার ক্ষেত্রেই জোরালো প্রতিবাদ করা হচ্ছে।

আমরা জানি, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা নেই। বরং দু'দেশই বিভিন্ন পর্যায় থেকে দাবি করে আসছে- এখনকার সম্প্রীতি আর সুসম্পর্ক গৌরব করার মতো। বর্তমান সময়ের সম্পর্ককে দু'দেশের জন্য যুগান্তকারী হিসেবে দাবি করা হচ্ছে। তাহলে মৃত্যুর হিসাবে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তরেখা কেন বিশ্বের অন্যতম প্রাণঘাতী- এই প্রশ্নের উত্তর জানা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বন্ধুরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করার এ ধরনের উদাহরণ খুব কম বলে দাবি করে আসছেন প্রতিবেশী দু'দেশের মানবাধিকার কর্মী এবং কূটনীতি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রকাশ্যে না এলেও সীমান্ত ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে বোঝাপড়ায় বাংলাদেশের রয়েছে দুর্বলতা। ভারতের সঙ্গে নেপাল, চীন, ভুটান, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে। এমনকি ওইসব দেশের সঙ্গে ভারতের উত্তপ্ত সম্পর্কও লোকচক্ষুর আড়ালে নয়। অথচ সেখানে এ ধরনের হত্যার ঘটনার খবর মেলা ভার। এমন প্রেক্ষাপটে এটা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে আলোচনা হওয়া উচিত।

জানুয়ারি ২০২০ থেকে নভেম্বর ২০২০ সালের পরিসংখ্যান বলছে, সীমান্তে মারা গেছেন ৪২ জন। এর মধ্যে বিএসএফের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে ৩৫ জনের আর শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছেন ছয়জন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবের বরাতে সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে সীমান্তে নিহতের সংখ্যা ছিল ১৪ জন। ২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩ জনে। আরেক পরিসংখ্যানে সংস্থাটি বলছে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে সীমান্তে ১৫৮ বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। এ হিসাবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে গড়ে প্রতি ১২ দিনে একজন বাংলাদেশি নাগরিকের মৃত্যু হয়। আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ২৬, ২০১৪ সালে ৩৩, ২০১৫ সালে ৪৬, ২০১৬ সালে ৩১, ২০১৭ সালে ২৪, ২০১৮ সালে ১৪ এবং ২০১৯ সালে ৪৩টি সীমান্ত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধে আমরা ভারত বা বিএসএফকে কতটা চাপের মধ্যে রাখতে পারি। বিএসএফের ওপর তেমন কোনো চাপ নেই বলে সংবাদমাধ্যমের বদৌলতে খোদ সে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাদের বয়ান থেকে অনেক সময় জানতে পারি। এমনকি আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ধারণা রয়েছে, সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে পতাকা বৈঠক করা এবং নিহতদের মরদেহ গ্রহণ করা ছাড়া বিজিবির কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না। সীমান্তে নাগরিকদের মৃত্যুতে সরকারের পক্ষ থেকে আগে জোরালো প্রতিবাদ জানানোর রেওয়াজ ছিল, এখন ততটা নেই।

এমন বাস্তবতায় কিছু বিষয় আমাদের আরও হতাশ করে তোলে। যেমন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন একবার বললেন, সীমান্ত হত্যায় ভারত একতরফাভাবে দায়ী নয়। আমাদের কিছু দুষ্টু ব্যবসায়ী অবৈধভাবে সীমান্তের ওপারে যায় এবং তাদের কাছে অস্ত্র থাকে। তখন ভারত বাধ্য হয়ে ভয়ে ওদের গুলি করে। এর আগে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছিলেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কাঁটাতারের বেড়া কেটে কেউ গরু আনতে গিয়ে ভারতের গুলি খেয়ে মারা যায়, তার জন্য দায়দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকার নেবে না। এসব মন্তব্য সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ করে দেয়- আমাদের সরকারি মহল বাংলাদেশিদের সুরক্ষার জন্য আন্তরিক কিনা?

আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সীমান্তে হত্যা বন্ধে বিজিবি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সরকারও কূটনৈতিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। সর্বশেষ বিজিবি দিবসে বাহিনীর মহাপরিচালকও সংবাদমাধ্যমের কাছে বলেছেন, সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার জন্য বিজিবি সবসময় চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ সময় তিনি একটি ব্যক্তিগত মতামত তুলে ধরেন। তার মতে, সীমান্তবর্তী জনগণকে শিক্ষা-দীক্ষায় এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে পারলে সেখানে হত্যা কমে যাবে। সর্বশেষ দু'দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বেশিরভাগ সীমান্ত হত্যা হয় ভারতের সীমানার অনেক ভেতরে। আমার জানামতে, ভারতের প্রচলিত আইন কাউকে হত্যার অনুমোদন দেয় না।

আমরা বলতে চাই, কারও অনুগ্রহ নয়; আমরা আমাদের অধিকারের প্রশ্নে আপসহীন থাকব। জোরালো ভাষায় স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেবো 'সীমান্ত হত্যা মানি না'।

 

— লেখক বিএনপি নেতা; সাবেক মেয়র প্রার্থী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন 


Monday, March 15, 2021

ফিরে দেখা: খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন




বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, ভাষা সৈনিক, জাতীয় নেতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বিএনপির সাবেক মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার খিরাই পাচুরিয়া গ্রামে ১৯৩৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা খোন্দকার আবদুল হামিদ ছিলেন একজন মশহুর আলেম এবং তাঁর মাতা আকতারা খাতুন। 

খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ১৯৪৭ সালে মানিকগঞ্জ হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯৪৯ সালে মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স), ১৯৫৩ সালে এমএ এবং ১৯৫৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে খোন্দকার দেলোয়ার বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থীর সপক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। 

খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি মানিকগঞ্জ মহকুমা আদালতে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। 

খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ১৯৫৭ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন এবং তখন থেকেই তাঁর সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনের শুরু। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধীদলের (কপ) প্রাথী ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে মানিকগঞ্জ মহকুমায় গঠিত ইলেকশন মনিটরিং কমিটির প্রধান ছিলেন খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পাটির মানিকগঞ্জ মহকুমা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। আইনজীবী সমিতিগুলোর কোর্ডিনেশন কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি ১৯৬৬ সালে ছয়দফা কর্মসূচি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তিনি ১৯৭০ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পাটির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেন। 

খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ছিলেন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক এবং তিনি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাক বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পরপরই মানিকগঞ্জে গঠিত বিপ্লবী কম্যান্ড কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন খোন্দকার দেলোয়ার।



খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কর্তৃক ১৯৭৮ সালে গঠিত জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলে যোগ দেন এবং দলের মানিকগঞ্জ জেলা শাখার আহবায়ক নিযুক্ত হন। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন দলের মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ সালে পুনরায় তিনি বিএনপির মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ সাল থেকে তিনি ছিলেন বিএনপির জাতীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য।

খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মানিকগঞ্জ-১ (ঘিওর-দৌলতপুর) নির্বাচনী এলাকা থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মানিকগঞ্জ-১ নির্বাচনী এলাকা থেকে পঞ্চম (১৯৯১), ষষ্ঠ (১৯৯৬), সপ্তম (১৯৯৬) ও অষ্টম (২০০১) সংসদে সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি পঞ্চম, ষষ্ঠ ও অষ্টম জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন সংসদীয় দলের চীফ হুইপ এবং সপ্তম জাতীয় সংসদে বিরোধী সংসদীয় দলের চীফ হুইপ ছিলেন। তিনি দুই মেয়াদে পার্লামেন্ট মেম্বার্স ক্লাবের সভাপতি এবং বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও সদস্য ছিলেন। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বেশসংখ্যক সামাজিক সাংস্কৃতিক ও জনকল্যাণমূলক সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তিনি ১৯৭৬-১৯৭৮ এবং ১৯৮৪-১৯৮৫ সালে মানিকগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং ১৯৭৯-১৯৮১ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় সিনেটের সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কোঅপারেটিভ ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন মানিকগঞ্জ খোন্দকার নূরুল হোসেন ল’ একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ। তিনি তাঁর নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন কলেজ এবং পাচুড়িয়া মাদ্রাসা। ঘিওর ও দৌলতপুর উপজেলার সার্বিক উন্নয়নে তাঁর ব্যাপক অবদান রয়েছে।

আশির দশকের শেষদিকে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের স্বৈরাচারী শাসন বিরোধী আন্দোলনে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। বিএনপি নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় মোর্চার লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। তত্বাবধায়ক সরকার কৃর্তক ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারীর পর বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হন। গ্রেফতার হওয়ার প্রাক্কালে তিনি দলের মহাসচিব আব্দল মান্নান ভূইয়াকে বহিস্কার করে তদস্থলে স্ট্যার্ন্ডি কমিটির সদস্য খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে দলের মহাসচিব পদে নিয়োগ দান করেন। এক-এগারোর পর যখন বেগম খালেদা জিয়াসহ দলের সিনিয়র নেতৃবর্গ আটক ছিলেন, খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন তখন অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে সঙ্কটের মোকাবেলা করে দলের ঐক্য ও অখন্ডতা অক্ষুন্ন রাখেন। ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত দলের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলের পর পুনরায় তিনি বিএনপির মহাসচিব নিযুক্ত হন।

খোন্দকার দেলোয়ার স্মরণীয় হয়ে থাকবেন জাতীয় স্বার্থে পালিত তাঁর সংগ্রামী ভূমিকার জন্য। তত্ত¡াবধায়ক সরকারের নামে ক্ষমতা দখলকারী সেনাসমর্থিত সরকারের দিনগুলোতে তাঁর ভূমিকার কথা স্মরণ করলে দেখা যাবে, গণতন্ত্র পুনরুদ্বারের সংগ্রামে তিনি ছিলেন আপসহীন এক দুর্দান্ত সাহসী নেতা। সেটা এমন এক সময় ছিল ওই সরকার যখন দুই নেত্রীকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়ার এবং রাজনীতিকদের উতখ্যাত করার ভয়ঙ্কর চেষ্টা চালাচ্ছিল। সরকার একদিকে দলীয় নেতাদের গ্রেফতার করেছিল, অন্যদিকে দলের ভেতর থেকে কোনো কোনো নেতা গোপনে সরকারকে সহযোগিতা দেয়ায় সে সময় বিশেষ করে বিএনপির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছিল। তেমন এক কঠিন সময়ে নিজে গ্রেফতার বরণ করার ঠিক আগমুহুর্তে খোন্দকার দেলোয়ারকে বিএনপির মহাসচিব পদে নিযুক্তি দিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। দলের জন্য তো বটেই, এই সিদ্বান্ত দেশ ও জাতির জন্যও অত্যন্ত সঠিক এবং সুফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হয়েছে। মামলা ও গ্রেফতারের হুমকি এবং দমন-পীড়নের ভয়-ভীতি দেখানোসহ সব পন্থাতেই তাকে বাগে আনার চেষ্টা পালিয়ে দেখেছে সরকার। কিন্তু মাথা নোয়ানো দূরে থাক, খোন্দকার দেলোয়ার এমনকি সামান্য নমনীয়তাও দেখাননি। দলীয় সভা-সমাবেশের পাশাপাশি সংবাদ সম্মেলন ও টিভির টকশোতে তিনি দুর্দান্ত সাহস বক্তব্য রেখেছেন, সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং জাতীয় নির্বাচন দেয়ার দাবিতে সোচ্চার থেকেছেন। প্রবীণ সাংবাদিক আতাউস সামাদ যথার্থই বলেছেন, খোন্দকার দেলোয়ার ছিলেন রাজনীতির দুঃসময়ের কাণ্ডারি। 

বলা বাহুল্য, গভীর দেশপ্রেম এবং গণতন্ত্রের জন্য আপসহীন মনোভাব ছিল বলেই খোন্দকার দেলোয়ারের পক্ষে অমন অনমনীয় অবস্থান নেয়া এবং বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করা সম্ভব হয়েছিল। একই কারণে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারসহ রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রতিপক্ষরা পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। 

আমরাও মনে করি, খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মনে-প্রাণে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। নিজে বিএনপি করলেও অন্য দলগুলোর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধ ছিল। ছিল পরমতসহিষ্ণুতা। প্রতিপক্ষের কঠোর সমালোচনা করতেন তিনি, কিন্তু বিদ্বেষ বা শত্রুতা নয়, সবকিছুর পেছনে থাকত কেবলই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে কখনও একচুল পরিমাণ ছাড় দেননি তিনি। নিখাদ ছিল তাঁর দেশপ্রেম।

ভাষা আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকার জন্য খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন একুশে পদকে ভূষিত হন। সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ২০১১ সালের ১৬ই মার্চ তাঁর মৃত্যু হয়।


মার্চ ১৬ — স্বৈরাচার পতন সংগ্রামের অগ্রনায়ক, ক্রান্তিকালের কান্ডারী ও বিএনপি'র প্রয়াত মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। 


খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন স্মৃতি ফাউন্ডেশন

আওয়ামী লীগের ‘মশারির ভেতরে মশারি’ টানানো জনিত সঙ্কট

— ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা

 

বিগত কয়েক দিন ধরে সকল গণমাধ্যম জুড়ে ছিলেন কিশোর। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শুধুমাত্র কার্টুন আঁকার অপরাধে ৬৯ ঘণ্টা তার নিখোঁজ থাকা, সেই সময়ে তার ওপর হওয়া নির্যাতন, মুশতাকের মৃত্যু, দফায় দফায় জামিন বাতিল, এ সবকিছুই কিশোরকে খবরের শিরোনাম করে রেখেছিল। তাকে নিয়ে লিখেছি আমিও। বলেছি বিভিন্ন টক শো, সেমিনার, মিটিং এ। কিশোর ‘ভাগ্যবান’ কারণ সে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছে। গণমাধ্যম তার পাশে দাঁড়িয়েছে।বর্তমান বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছরে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর যে বীভৎস নির্যাতন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করেছে, কিশোরের ওপরে চলা ৬৯ ঘণ্টার নির্যাতন তার আশপাশেও না। এখানে উল্লেখ করে রাখি, হেফাজতে শারীরিক নির্যাতন দূরেই থাকুক, ন্যুনতম মানসিক নির্যাতনও আইন বিরোধী।

একজন স্বনামধন্য সাংবাদিকের নেয়া সাক্ষাৎকার থেকে জানতে পারি ‘অজ্ঞাতস্থানে’ নেবার পর কিশোরকে প্রশ্ন করা হয়েছিল,

‘তোর পরিবারে কেউ আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে?’।

‘করে’ দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দিয়েছিল কিশোর।

‘কে?’

‘পিতা…এবং বোন…’

এরপর কিশোরের ওপর নেমে আসে ভয়ঙ্কর নির্যাতন। দুই হাত দিয়ে একসঙ্গে কানে তীব্রভাবে আঘাত করে, মূলত কানের পর্দা ফাটানোর জন্য এটা করা হয়। খুব লক্ষণীয় বিষয় হল, কিশোরের দৃঢ় উচ্চারণ তার পিতা এবং বোনের আওয়ামী লীগ করা দেখাই যাচ্ছে তাকে বাঁচাতে পারেনি।

কিশোরের বিরুদ্ধে আনা বেশ কিছু অভিযোগের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অভিযোগ ছিল সরকারের অতি ঘনিষ্ঠ বেসরকারি একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে নিয়ে কার্টুন আঁকা।তিনি ওই ব্যবসায়ীকে কীভাবে চেনেন, কেন ওই ব্যক্তির কার্টুন এঁকেছেন, সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। কিশোর যে কার্টুনটি এঁকেছিলেন সেটি পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিস শরাফত এর, যা মুশতাকের মৃত্যুর পর ফেইসবুকে ভেসে বেড়িয়েছে।কিশোরের পরিবার যতই আওয়ামী লীগ করুক, তার চেয়ে প্রভাবশালি আওয়ামী লীগ এই দেশে আছে, যাদের সাথে ঠোকাঠুকি করলে বরদাশত করবে না সরকার, লেলিয়ে দেয়া হবে সরকারি বাহিনী।

মজার বিষয় হল, কিছুদিন আগেই আওয়ামী লীগের আরেক প্রভাবশালী নেতা, ‘জনতার মঞ্চ’ এর উদ্যক্তা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি দিয়ে এই শরাফতের বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ আনেন। বসে নেই শরাফতও – একই দিনে তিনি দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে চিঠি পাঠান মইউদ্দিন খান আলমগীরের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তুলে। এখানে দুর্নীতির অভিযোগ আর শত কোটি টাকায় আটকে নেই, গড়িয়েছে হাজার কোটি টাকার ঘরে। শুধু তাইই নয়, দু’জনেই মিডিয়ায় একে অপরকে মিথ্যেবাদি বলে বক্তব্য দিচ্ছেন, যদিও তাদের অতি প্রিয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কেউ কারো বিরুদ্ধে সন্মানহানির মামলা করছেন না। দু’জনেই জানেন তারা কেউ কাউকে সহজে হজম করে ফেলতে পারবেন না, যতটা সহজে হজম করা যায় কিশোর কিংবা কাজলকে।

জনাব মহিউদ্দিন খান আলমগীর প্রসঙ্গে মনে পড়ল তার গুণধর ভাগ্নের কথা। বেশ কয়েক বছর ধরে ভিসিদের কেলেঙ্কারি প্রসঙ্গে মোটামুটি শীর্ষে অবস্থান করছেন বেগম রকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নাজমুল হাসান কলিমুল্লাহ। দুই দিন আগেই সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জনাব কলিমুল্লাহ এর দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছেন। ৭৯০ পৃষ্ঠার সেই শ্বেতপত্রে অভিযোগের সংখ্যা ১১১ টি। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, জনাব কলিমুল্লাহর বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ।

নিজে চরম বিপদে পড়ার অল্প কিছুদিন আগেই জনাব কলিমুল্লাহ মাঠে নেমেছিলেন আরেক জনের বিপদে সাহস যোগাতে।গবেষণা জালিয়াতির দায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিয়া রহমান তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সাফাই গাওয়ার সংবাদ সন্মেলনটি করেছিলেন জনাব কলিমুল্লাহ এবং ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে পাশে বসিয়ে। আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক এই আইনজীবীকে কিছু দিন আগেই দুর্নীতির অভিযোগে মানবতা বিরোধী অপরাধ বিচারের ট্রাইবুনাল থেকে অপসারণ করেছিল প্রসেকিউশন টিমের সরকার সমর্থক অন্য আইনজীবীরা।

সংবাদ সন্মেলনে সামিয়া রহমান তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বিকার করেন এবং বলেন সবকিছুই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। তার বয়ানমতে এই ষড়যন্ত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসন এবং একজন প্রতিশোধপরায়ন অতি ক্ষমতাধর উচ্চপদস্থ নারী শিক্ষক জড়িত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সব পদে আসীন শিক্ষকরা সবাই যে কেবল ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক তাই নয়, অধিকাংশের ক্ষেত্রে এটাই তাদের একমাত্র যোগ্যতা। সুতরাং সমস্যাটা যে ঘরের মধ্যে ঘরে সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

পৌর নির্বাচনের শুরু থেকেই পত্রিকা আলো করে আছেন, জনাব কাদের মির্জা। তিনি বসুরহাট পৌরসভার মেয়র, তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব ওবায়দুল কাদেরের আপন ভাই। পুরো সময়টাই দেখা গেছে বিভিন্ন উপলক্ষে তিনি আওয়ামী লীগের মন্ত্রী এমপি থেকে শুরু করে সাধারণ সম্পাদক পর্যন্ত সবার বিরুদ্ধে ‘সত্যবচন’ চালিয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগে তিনি একমাত্র ব্যক্তি, যিনি নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন আওয়ামী লীগ দেশে ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে পারে নাই, এবং সুষ্ঠু নির্বচন হলে আওয়ামী লীগের এমপিরা পালানোর পথ খুঁজে পাবে না। যাদের বিরুদ্ধে মির্জা সাহেবের এত রাগ, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ফেনীর সাংসদ নিজাম হাজারি, নোয়াখালীর সাংসদ একরামুল হক, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নিক্সন, চট্টগ্রামের নবনির্বাচিত মেয়র এবং সর্বোপরি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।দুই ভাইয়ের রেষারেষি এমন পর্যায়ের যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজের ভেরিফাইড ফেইসবুকে বুকের কষ্ট চেপে লিখেছেন, নোবডি নোজ দ্য রিজন বিহাইন্ড মাই সাইলেন্স। আর দুই ভাইয়ের সংকটের জন্য প্রকাশ্যে ভাবীকে দায়ী করা কাদের মির্জা ফেইসবুকে তাদের পারিবারিক ছবির পাশে লিখেছেন - ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধন, যদিও পৃথক হয় নারীর কারণ।

দীর্ঘ সময় জনগণের কাছে জবাবদিহিতাহীনভাবে ক্ষমতায় থাকলে, বিরোধী সকল দল মতকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চালালে একটা দলের কী পরিণতি হয়, আওয়ামী লীগ তার জ্বলন্ত উদাহরণ। দীর্ঘ ১২ বছরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থক এবং সুবিধাভোগীদের ভেতর অনেকগুলো ক্লাস্টার তৈরি হয়েছে যেটা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ভাষায় ঘরের ভেতরে ঘর, মশারির ভেতরে মশারি। এখানে প্রত্যেকেই প্রতি মুহূর্তে নিজের স্বার্থরক্ষা করতে এবং সুবিধার নিত্য নতুন পথ খুলতে এতটাই মরিয়া যে ন্যুনতম বিচার-বুদ্ধি, বিবেচনা, বিবেক কারো মধ্যে নেই।

এই কলামে বেশ কিছু ঘটনা উল্লেখ করলাম, কারণ সেগুলো খুব সাম্প্রতিক এবং আলোচিত। কিন্তু এমন ঘটনা গত কয়েক বছরে ঘটেছে অসংখ্য। এক বড় মশারির ভেতরে কতগুলো মশারি আরও টানানো হবে, টানালে কারা টানাবেন, পাশাপাশি থাকা মশারিগুলোর মধ্যে কোনটি গুরুত্ব বেশী পাবে, একই মশারির মধ্যে থাকা মানুষদের মধ্যে কে বা কারা নিয়ন্ত্রণে থাকবে সেসব নিয়েই চলছে এখন আওয়ামী লীগের সংকট। এর ফল সুদূর প্রসারী।এই ধরণের সংকট দলকে দুর্বল ও ভঙ্গুর করে নিশ্চিহ্নতার পথে নিয়ে যায়।

  •  লেখক জাতীয় সংসদ সদস্য ও আইনজীবী। 


Saturday, February 20, 2021

দুর্নীতিতে পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন বলছি

 — ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা


রাজনৈতিক বাকযুদ্ধে কিছু কথা এতবার এতভাবে বলা হয়েছে যে সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলার কথা এখন আর কেউ চিন্তাও করেনা। রাজনীতির মাঠে আওয়ামেলীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি’কে ঘায়েল করার জন্য গত এক যুগের বেশি সময় ধরে ব্যবহৃত সবচেয়ে ধারালো অস্ত্র ছিল সম্ভবত যে কোনো প্রসঙ্গে বলা – বিএনপি তার শাসন আমলে দুর্নীতিতে ৫ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ব্যাংক কেলেঙ্কারি,  শেয়ার বাজার লুট কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডাকাতি থেকে শুরু করে ৩৭ লাখ টাকার পর্দা, ১০ হাজার টাকার বটি মার্কা প্রকল্প-দুর্নীতি কিংবা বিদ্যুৎ খাতের মত হরিলুট নিয়ে যখনই প্রশ্ন তোলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ এক বাক্যে উত্তর দিয়েছে এসব বিষয়ে প্রশ্ন তোলা ৫ বারের দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নের মুখে মানায় না। এমনকি তথাকথিত শুদ্ধি অভিযানে যখন আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সংগঠনের দ্বিতীয়/তৃতীয় সারির নেতার ঘরে শত কোটি টাকার কাগজ, ঢাকায় শতাধিক ফ্ল্যাট/বাড়ির খবর পাওয়া গেছে তখনও সেটা নিয়ে টু শব্দটি করার আগেই বলা হয়েছে চোর ধরতে গিয়ে আমরাই চোর হয়ে গেলাম।   


বাংলাদেশ দুর্নীতিতে প্রথম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবার ‘গৌরব’ অর্জন করে ২০০১ সালে। ২০০১ সালে অষ্টম সংসদ নির্বাচনটি হয়েছিল বছরের শেষের দিকে, অক্টোবর মাসে। ওই বছরের প্রায় পুরোটা সময় ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। তাই বাংলাদেশের ওই বছরের আমলনামার পেছনে একমাত্র ভূমিকা ছিল আওয়ামী লীগের। বছরের শেষের দিকের তিন মাস তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল ক্ষমতায়। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক ধরণের সরকারগুলোর সময় দুর্নীতির প্রকোপ অনেক কম থাকে, কিন্তু এর আগেই আওয়ামী লীগ এত ভয়ঙ্কর পরিমাণ দুর্নীতি করেছে যে, বাংলাদেশের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া তাতে ঠেকে থাকেনি।  

 

দুর্নীতির এই ‘গৌরব’ বিএনপি’র ওপর আরোপিত হয় কারণ ২০০১ সালের রিপোর্টটি প্রকাশিত হয় ২০০২ সা্লে, বিএনপি’র শাসন আমলের প্রথম বছর। এই বছর, ২০২১ সালে ঠিক যেমন প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ সালের রিপোর্ট। আওয়ামী লীগের সৌভাগ্য যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল যখন বাংলাদেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে তখন মাত্রই জনগণের ভোটে ভূমিধস বিজয় নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসে বিএনপি।  



আওয়ামী লীগ যখন ২০০১ এ ক্ষমতা ছেড়ে যায়, তখন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের স্কোর ছিল ১০ এ ০.৪, অর্থাৎ একেবারে তলানিতে। এর পরের চার বছর বিএনপি’র শাসনামলে পরিস্থিতির অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। ২০০২ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্কোর ছিল যথাক্রমে ১.২, ১.৩, ১.৫ ও ১.৭। আর ২০০৬ সাল, বিএনপি সরকারের শেষ বছর বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২, অর্থাৎ বিএনপির পুরো সময়টি ব্যয় হয়েছে বীভৎস দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বাংলাদেশের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রনে। 


২০০২ সাল থেকে দুর্নীতির সূচকে সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকার পেছনে আওয়ামী লীগের চাপিয়ে দেয়া দুর্নীতির জঞ্জাল যেমন ছিল, তেমনি ছিল সেই সময়ে বাংলাদেশের চাইতে অনেক দুর্নীতি পরায়ন দেশ সেই সূচকে অন্তর্ভুক্ত না হওয়া। যেমন ২০২০ সালের সূচকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ১৭৯ টি দেশ, কিন্তু ২০০২ এর সূচকে অন্তর্ভুক্ত দেশের সংখ্যা ছিল ১০২ টি। সোমালিয়া, দঃ সুদান, সিরিয়া, ইয়েমেন, সুদান, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইকোয়েটরিয়াল গিনি, লিবিয়া, উত্তর কোরিয়া, গিনি বিসাউ, আফগানিস্তা্ন, তুর্কমেনিস্তা্ন, কঙ্গো, বুরুন্ডি, কোমরস, হন্ডুরাস, চাদ এর মতো কিছু দেশ এবারের সূচকে বাংলাদেশের নীচে আছে। কিন্তু এই দেশগুলো আজকের মত ২০০২ সালে দুর্নীতির সূচকে বিবেচিত হয়নি। হলে আর যাই হোক বাংলাদেশ ‘চ্যাম্পিয়ন’ হত না।  


ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এর রিপোর্টে সেই সময়ের স্কোরের প্রেক্ষাপটে বলা হয়েছিল, ১০ এর স্কেলে যে সব দেশের স্কোর ২ এর নীচে সেসব দেশের দুর্নীতি সবচেয়ে বীভৎস। বিএনপির শেষ বছরে বিএনপি ২ স্কোর করে সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছিল। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের নীচে ছিল মিয়ানমার। বাংলাদেশের স্কোর যখন ২ মিয়ানমারের স্কোর তখন ১.৯। এক যুগের বেশী একচ্ছত্রভাবে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের সময়ে ২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী মিয়ানমার আমাদের চাইতে দুই পয়েন্ট বেশি পেয়ে আমাদের চেয়ে নয় ধাপ উপরে আছে। অর্থাৎ যে মিয়ানমার ছিল বাংলাদেশের নিচের অবস্থানে সেও এই এক দশকে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে অনেক খানি।   


২০০১ সালের ০.৪ থেকে ২০০২ এ তিনগুন অর্থাৎ ১.২ স্কোর করা পরিষ্কারভাবে নির্দেশ করে যে মাত্র এক বছরের শাসনামলে বিএনপি বিস্ময়কর মাত্রায় দুর্নীতি কমিয়ে এনেছিল। এর পরবর্তী ইতিহাস কেবলই ধারাবাহিক উন্নতির। আওয়ামী লীগের সৌভাগ্য আর বিএনপির দুর্ভাগ্য যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এই সূচক ১৯৯৫ সালে চালু করলেও বাংলাদেশকে প্রথমবার এই সূচকে বিবেচনা করা হয় ২০০১ সালে। ফলে এর আগে কোনও তথ্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নেই। থাকলে আওয়ামী লীগ বিএনপি’র বিরুদ্ধে ‘পাঁচবারের দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন’ এই অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পেত কিনা সেটা ভীষণভাবে প্রশ্ন সাপেক্ষ। 



সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের রিপোর্টে আফগানিস্তান, মিয়ানমার এবং মালদ্বীপের ভূয়সী প্রশংসা করেছে। কারণ এই তিনটি দেশই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করে তাদের আগের স্কোর থেকে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। এর মধ্যে আফগানিস্তান আমাদের চাইতে কম স্কোর করা সত্ত্বেও (আমাদের স্কোর ২৬ এর বিপরীতে তাদের স্কোর ১৯) তাদের ক্রমাগত উন্নতি প্রসংসিত হয়েছে। বলা বাহুল্য গত এক যুগে বাংলাদের ইতিহাস ক্রমাবনতির। এই বছরও বাংলাদেশ নেমে গেছে আরও দুই ধাপ। এই প্রেক্ষাপটে ২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের উন্নতি ছিল অসাধারণ। আওয়ামে লীগ যে সূচক রেখে গিয়েছিল ০.৪ এ, বিএনপি তার পাঁচ বছরের শাসন আমলে সেটিকে নিয়ে গিয়েছিল ২ এ। কিন্তু প্রোপাগান্ডার এমনই শক্তি যে আওয়ামে লীগের রেখে যাওয়া অবস্থার যে বিস্ময়কর উন্নতি বিএনপির আমলে হয়েছিল সেটি ছাপিয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে চ্যাম্পিয়নের খবরটি যেটি আদতে আওয়ামে লীগের ৯৬ থেকে ২০০১ শাসন আমলের রেখে যাওয়া অবস্থার ফসল। 


বিএনপির সর্বশেষ সরকারটি দুর্নীতি দমন করে সুশাসন নিশ্চিত করার পথে একেবারেই সঠিক পথে ছিল। আওয়ামী লীগ যে বীভৎস দুর্নীতির জঞ্জাল রেখে গিয়েছিল, সেটাকে সাফ করার জন্য ৫ বছর কোনোভাবেই যথেষ্ট সময় ছিল না, কিন্তু বিএনপি তার সর্বোচ্চ চেষ্টাটি করে দেশকে একটা চমৎকার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। এই সময়ের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে উন্নতির গ্রাফটি প্রমাণ করে বিএনপি যদি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব চালিয়ে যেতে পারত, তাহলে দেশ দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে এক অসাধারণ পর্যায়ে চলে যেত। কিন্তু হয়নি সেটা। এরপর কেবলই পিছিয়ে যাবার গল্প। গত এক যুগের বেশী সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের ভয়াবহ দুর্নীতি বাংলাদেশকে লজ্জার মুখে ফেলে দেয় বিশ্ববাসীর সামনে। সরকারের নানা ব্যঙ্গ বিদ্রুপের শিকার পাকিস্তানের অবস্থান আমাদের চাইতে ২২ ধাপ উপরে। আর নেটিজেনরা বাংলাদেশের সাথে তুলনা করে যে দেশটি নিয়ে নানা রকম ট্রোল করে, সেই উগান্ডার অবস্থানও আমাদের চাইতে উপরে। 


বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের অতি উচ্চকিত প্রোপাগান্ডাগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ এবং ‘শুদ্ধি অভিযান’; যদিও এই অভিযানেই বেরিয়ে এসেছে ভয়ংকর সব তথ্য। তবে সত্যিকারের সদিচ্ছা থাকলে একটি দেশ যে বিস্ময়কর উন্নতি করতে পারে তার এক অসাধারণ উদাহরন হতে পারে মালদ্বীপ। এই বছরের দুর্নীতির সূচকে দেশটি যা দেখিয়েছে তা স্রেফ ম্যাজিক। গত বছরের তুলনায় এক বছরে এই দেশটি ১৪ পয়েন্ট বেশি পেয়েছে যাতে তার অবস্থানের উন্নতি হয়েছে ৫৫ ধাপ। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দেশটি ১৩০ থেকে ৭৫ এ উঠে এসেছে। মালদ্বীপই প্রমাণ করে রাজনৈতিক বুলির বাইরে গিয়ে কোন দেশ যদি দুর্নীতি দমনে সত্যিকারের সদিচ্ছা রাখে তাহলে ম্যাজিক ঘটানো সম্ভব।  


দেশের দুর্নীতি এখন কতটা ভয়াবহ পর্যায়ে গেছে সেটি বোঝানর জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের দুইজনের দুটি উক্তি পাঠকের জন্য রেখে যাচ্ছি। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি কিছু দিন আগে দুদকের সাথে বৈঠকে বলেছেন - দুর্নীতি উন্নয়নের বড় অন্তরায়। এর আগে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বলেছিলেন – দুর্নীতি না হলে দেশের চেহারা পাল্টে যেত। 



লেখক জাতীয় সংসদ সদস্য ও আইনজীবী। 



Wednesday, February 17, 2021

ব্যতিক্রমী সেক্টর কমান্ডার

— আসিফ নজরুল



১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে জিয়াউর রহমান ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন মেজর। সে রাতে চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র খালাসরত পাকিস্তানি এক জেনারেলের কাছে তাঁকে পাঠানো হচ্ছিল। পরিকল্পনা ছিল তাঁকে ‘গ্রেপ্তার বা হত্যা’ করার (গোলাম মুরশিদ, মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর: একটি নির্দলীয় ইতিহাস)। পথিমধ্যে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের সংবাদ শোনামাত্র বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নেন। চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ফিরে এসে তাঁর কমান্ডিং অফিসারসহ অন্যান্য পাকিস্তানি অফিসার ও সৈন্যকে বন্দী করেন। পরদিন তিনি প্রাণভয়ে পলায়নপর মানুষকে থামিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্দীপনাময় ভাষণ দিতে শুরু করেন (বেলাল মোহাম্মদ, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র)। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিনি বেতারে নিজ কণ্ঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

জিয়ার এই রূপান্তর বা উত্থান বিস্ময়কর হতে পারে, কিন্তু তা আকস্মিক ছিল না। বরং বাংলাদেশের মানুষের বঞ্চনা, স্বাধীনতার স্বপ্ন, সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একজন সৈনিককেও কীভাবে উদ্দীপিত করেছিল, এটি ছিল তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত (জিয়াউর রহমান, ‘একটি জাতির জন্ম’)।

জিয়া ছিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন অগ্রগণ্য সেনানায়ক। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ১১ জন সেক্টর কমান্ডারের একজন ছিলেন। ৪৯ জন যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধাকে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার সর্বোচ্চ বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করে। তিনি তাঁদের একজন ছিলেন। কিন্তু তিনি সেক্টর কমান্ডার ও বীর উত্তম খেতাবধারীদের মধ্যেও অনন্য ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে। ২৭ মার্চ এই ঘোষণা ‘মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের’ পক্ষে তিনি প্রদান করেন কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে।

এরপর জিয়া চট্টগ্রাম যুদ্ধাঞ্চল, ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক এবং পরে জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে বহু আলোচিত যুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদান করেন। যুদ্ধের শেষ ভাগে সিলেট অঞ্চলে তাঁর বাহিনীর কাছেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। তিনি সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের, এম এ জলিল বা খালেদ মোশাররফের মতো সম্মুখসমরের অসীম সাহসী যোদ্ধা ছিলেন না। সমশের মবিন চৌধুরী ও হাফিজ উদ্দিনের মতো তাঁর নিজস্ব বাহিনীর অফিসারদের মতো তিনি যুদ্ধ করতে গিয়ে আহতও হননি। কিন্তু ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী যুদ্ধে তাঁর বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম শক্তিশালী প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছে, কিছু ক্ষেত্রে তাঁকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে।



জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। তাঁর আগে মাওলানা ভাসানী স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, ছাত্রনেতারা স্বাধীন বাংলাদেশের স্লোগান দিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। একাত্তরের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতাসংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন, এ জন্য সবাইকে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনকি ২৫ মার্চ কালরাতের পর জিয়ার আগেই চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা এম এ হান্নান বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও বিভিন্ন কারণে জিয়াউর রহমানের ঘোষণার তাৎপর্য ছিল অন্য রকম।

প্রথমত, শক্তিশালী সম্প্রচারকেন্দ্রে বারবার সম্প্রচারিত হওয়ার ফলে জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাটিই কেবল দেশের সব অঞ্চল থেকে বহু মানুষ শুনতে পেয়েছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর আক্রমণের মুখে দিশেহারা ও পলায়নপর অবস্থায় এটি মানুষের কাছে পরম ভরসার বাণী হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, জিয়ার ঘোষণাটি ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন বিদ্রোহী বাঙালি অফিসারের এবং বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে। এটি মানুষকে প্রতিরোধের সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রবলভাবে আশান্বিতও করেছিল।



মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান এ কে খন্দকার ২০০২ সালে এক স্মৃতিচারণায় বলেন, ‘যুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীর একজন বাঙালি মেজরের কথা শোনা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। আমি নিজে জানি, যুদ্ধের সময় জানি, যুদ্ধের পরবর্তী সময়েও জানি যে মেজর জিয়ার এই ঘোষণাটি পড়ার ফলে সারা দেশের ভেতরে এবং সীমান্তে যত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সাংঘাতিক একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করল যে হ্যাঁ, এইবার বাংলাদেশ একটা যুদ্ধে নামল।’ (এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান ও এস আর মীর্জা, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর: কথোপকথন)। 

জিয়ার ঘোষণায় উৎসাহিত বা উদ্দীপিত হয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি), এইচ টি ইমাম (বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১), অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের (আমার একাত্তর) মতো আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও। তাঁর ঘোষণার গুরুত্বের উল্লেখ আছে মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের সক্রিয় কূটনীতিক জে এন দীক্ষিতসহ ট্রেভর ফিসলক, ডেভিড লুডেনের মতো বহু আন্তর্জাতিক ব্যক্তির ভাষ্যে (মাহফুজ উল্লাহ, প্রেসিডেন্ট জিয়া অব বাংলাদেশ)।

জিয়ার ঘোষণাটির অতুলনীয় প্রভাব পড়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে এটি দেওয়া হয়েছিল বলে। মুক্তিযুদ্ধের গবেষক মঈদুল হাসান লিখেছেন, ‘মেজর জিয়া তাঁর প্রথম বেতার বক্তৃতায় (২৭ মার্চ সন্ধ্যা) নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করলেও পরদিন স্থানীয় নেতাদের পরামর্শক্রমে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা প্রকাশ করেন। এই সব ঘোষণা লোকের মুখে মুখে বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ে, শেখ মুজিবের নির্দেশে সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালিরা স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই শুরু করেছে।’ (মূলধারা ’৭১)


২.

১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি অফিসারদের কাছে কোনো সুস্পষ্ট বা সরাসরি নির্দেশ ছিল না। কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী নেতা বঙ্গবন্ধুর কাছে পাকিস্তানের শাসনভার প্রদানে অনীহার ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁরা সচেতন ছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীতে তাঁদের প্রতি বৈষম্য ও বঞ্চনা নিয়েও প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল (রফিকুল ইসলাম, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে)। এ কারণে তাঁদের অনেকেই ২৫ মার্চে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যার সংবাদ শোনামাত্র বিদ্রোহ করেন। বাঙালি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যে জিয়া বিদ্রোহ করেন সবার আগে (মুরশিদ, পূর্বোক্ত)। ২৮ মার্চের মধ্যে বিদ্রোহ করেন সেক্টর কমান্ডারদের প্রায় সবাই। কিন্তু তাঁদের বিক্ষিপ্ত বিদ্রোহকে সমন্বিত, সুশৃঙ্খল ও কার্যকর করার প্রয়োজনীয়তা এবং এটিকে পরিপূর্ণ একটি স্বাধীনতাযুদ্ধে পরিণত করার ব্যাপারে জিয়াসহ প্রত্যেকে সচেতন ছিলেন। যুদ্ধের সময়ে বিভিন্ন ঘটনায় তাঁদের এই অসাধারণ প্রজ্ঞা, দায়িত্ববোধ ও রণকৌশলের পরিচয় পাওয়া। এবং এখানেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আমরা জিয়াকে অনন্য বা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে দেখি।

প্রথমত, ৩ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করার ঠিক পরদিন জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, কে এম সফি উল্লাহসহ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী ইউনিটগুলোর কমান্ডাররা তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে বৈঠক করেন। সেখানে তাঁরা ভারতের সামরিক সাহায্য এবং দেশের রাজনীতিবিদদের নিয়ে স্বাধীন সরকার গঠনের আবশ্যকতা প্রশ্নে একমত হন, বিদ্রোহী ইউনিটগুলো নিয়ে সম্মিলিত মুক্তিফৌজ গঠন করেন এবং এম এ জি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে স্থির করেন। ৪ এপ্রিলের এই বৈঠকই ছিল বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রথম সাংগঠনিক ভিত্তি।

দ্বিতীয়ত, যুদ্ধ সরঞ্জামের অভাব, কেন্দ্রীয় কমান্ডের নিষ্ক্রিয়তা এবং কূটনৈতিক স্বীকৃতি দানে ভারতের বিলম্বের কারণে একাত্তরের মে থেকে জুলাই মাসের প্রথম ভাগ পর্যন্ত হতোদ্যম পরিস্থিতিতে যুদ্ধাঞ্চলের অধিনায়কদের এক সম্মেলনে জিয়াই নতুন চিন্তা নিয়ে আসেন। ১০ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী সদর দপ্তরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে এটি অনুষ্ঠিত হয়। এর সূচনায় মুক্তিযুদ্ধের অধোগতি রোধ ও যৌথ কমান্ড-ব্যবস্থায় যুদ্ধ পরিচালনার জন্য যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব দেন জিয়া। তাঁর এই প্রস্তাবে একজন বাদে বাকি সব সেক্টর কমান্ডারের সম্মতি ছিল। মন্ত্রিসভার সমর্থন থাকলে এটি যুক্তিসংগত বলে মেনে নিতে পারতেন তাজউদ্দীন। তাতে যুদ্ধ আরও গতিশীল হতে পারত (এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান ও এস আর মীর্জা, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর: কথোপকথন)। তবে সেই সম্মেলনে গেরিলাযুদ্ধের পাশাপাশি সম্মুখসমর, মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং ভবিষ্যৎ সেনাবাহিনী গঠনের প্রস্তুতি হিসেবে ব্রিগেড গঠনের যে সিদ্ধান্ত হয়, তা রূপায়ণের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকেই।


সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে মেজর জেনারেল কে​ ভি কৃষ্ণ রাওয়ের সঙ্গে জেড ফোর্স কমান্ডার জিয়াউর রহমান (বাঁ থেকে দ্বিতীয়), ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ​ছবি: সংগৃহীত


তৃতীয়ত, জুলাই মাসের এই সম্মেলনে জিয়ার নেতৃত্বাধীন ব্রিগেড গঠনের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে নেওয়া হলেও পরে কর্নেল ওসমানীর একক সিদ্ধান্তে আরও দুটি ফোর্স গঠিত হয় (এ কে খন্দকার, পূর্বোক্ত)। জেড ফোর্স নামে পরিচিত জিয়ার ব্রিগেড একাত্তরে দ্রুত কাজ শুরু করে। ঢাকামুখী অভিযানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানি বাহিনীর কামালপুর ঘাঁটিতে তারা ৩১ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট কয়েক দফা হামলা চালায়। ১ আগস্ট জেড ফোর্স বাহাদুরবাদ এবং ৩ আগস্ট শেরপুরে নকশি বিওপিতে আক্রমণ করে। এসব দুঃসাহসিক সম্মুখসমরে অনেক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। কামালপুর যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন। জিয়াকে এ জন্য কিছু সমালোচনাও মেনে নিতে হয়। কিন্তু এসব যুদ্ধ মুক্তিবাহিনীর সামর্থ্য ও সাহসিকতা সম্পর্কে নতুন উপলব্ধির জন্ম দেয়।

চতুর্থত, মুক্তিযুদ্ধের শেষ ভাগে জিয়াকে আমরা দেখতে পাই সুনির্দিষ্ট অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণাত্মক যুদ্ধের অধিনায়ক হিসেবে। একাত্তরের অক্টোবরে যৌথ সামরিক নেতৃত্ব গঠনের পর যুদ্ধের নীতিনির্ধারণের দায়িত্ব চলে যায় ভারতের জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের কাছে। নভেম্বরে ভারতীয় বাহিনী নিজ দেশের সীমান্তে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় বাংলাদেশের সেক্টর ও ফোর্সগুলো আরও মুহুর্মুহু আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

ওসমানীর নিদের্শ অক্টোবর মাসে পুরো জেড ফোর্স নিয়ে মেজর জিয়া চলে আসেন সিলেটে। এর তিনটি ব্যাটালিয়ন শ্রীমঙ্গল, ছাতক ও কুলাউড়ায় অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনা ও ক্যাম্পে সরাসরি হামলা চালায়। ১০ ডিসেম্বর এই ফোর্স সিলেট আক্রমণ শুরু করে। ১৪ তারিখ তারা সিলেটে প্রবেশ করে। যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে তিনি একদিন বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, সিলেটে ১২৫ জন অফিসার, ৭০০ সৈন্যসহ সেই বাহিনীর একটি অংশ তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করে।


৩.

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদান ছিল অপরিসীম। স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করা ছাড়াও যুদ্ধ পরিচালনা ও যুদ্ধ প্রশাসনের নীতিনির্ধারণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। জিয়া ছিলেন এই যুদ্ধে মহানায়কের মতো। আরও ছিলেন খালেদ মোশাররফ, আবু তাহের, আবু ওসমান, এম এ জলিল, রফিকুল ইসলামসহ অন্যান্য সেক্টর কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধ সর্বোপরি ছিল একটি জনযুদ্ধ, বহু সাধারণ মানুষের অসাধারণ আত্মত্যাগ আর শৌর্য–বীর্যের এক অনুপম গৌরবগাথা।

বাংলাদেশের এই বীর সন্তানেরা ছিলেন অত্যুজ্জ্বল এক নক্ষত্রমণ্ডলীর মতো। সে নক্ষত্রমণ্ডলীর সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন বঙ্গবন্ধুই। কিন্তু তাই বলে অন্য কোনো নক্ষত্রের আলোও ম্লান হতে পারে না, অন্য কোনো নক্ষত্রও মুছে যেতে পারে না।

জিয়া আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের এমনই এক অবিনশ্বর নক্ষত্র। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে শুধু জিয়া নন, আরও অনেকের কিছু কর্মকাণ্ড নিয়ে পক্ষে–বিপক্ষে নানা আলোচনা রয়েছে। কিন্তু সেটি তাঁদের একাত্তরের ভূমিকাকে ম্লান করতে পারে না।


  • লেখক  অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  • কার্টসি — প্রথম আলো/ ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬



Wednesday, February 10, 2021

জিয়ার খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত হিংসার অপরাজনীতি

— ড. জাহিদ দেওয়ান শামীম 

 

স্বাধীনতার যুদ্ধের মাঠে বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান বীর উত্তম


স্বাধীন বাংলাদেশ ও জিয়া একে অপরের পরিপূরক। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার অপর নাম জিয়াউর রহমান। জিয়াকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়। জিয়া বাংলাদেশের আপামর জনগণের হৃদয়ে মেজর জিয়া নামে প্রতিষ্ঠিত। মেজর জিয়া ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক, রনাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সেনাপ্রধান এবং বাংলাদেশের একজন সফল রাষ্টনায়ক। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য স্বাধীনতা উত্তর সরকার ‘বীরউত্তম’ খেতাবে ভুষিত করেন জিয়াকে। স্বাধীনতার ঘোষণার আগেই ১৯৭১ সাল ২৫শে মার্চ রাজনৈতিক নেতারা গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন অথবা পালিয়ে যান। শহীদ জিয়া সংকট মূহুর্তে শুধু স্বাধীনতার ঘোষনা দেননি, সেক্টর কমান্ডার হিসেবে রনাঙ্গনে যুদ্ধে নেতৃত্বও দেন। মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদান অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে অস্বীকার করা হলে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অস্বীকার করা হবে। এটাই সত্য ও ইতিহাস। ইতিহাস তার নিজস্ব গতিতে চলে।  হিংসা ও বিদ্বেষের রাজনীতি এবং আদালতের রায় দিয়ে ইতিহাস বদলানো যায় না। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নাম ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সাথে শহীদ জিয়ার নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সুতরাং কখনোই স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ থেকে জিয়াকে বিচ্ছেদ করা যাবে না।

মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার স্বীকৃতিসরূপ স্বাধীনতার ঘোষক, রনাঙ্গনের যোদ্ধা জিয়াউর রহমানকে যে খেতাব দেওয়া হয় তা বাতিলের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা নিকৃষ্টতম সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ন ও হীনমন্যতার বহিঃপ্রকাশ। স্বীকৃত সত্য শহীদ জিয়া মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক ও রনাঙ্গনের যোদ্ধা। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর যারা জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত  নিয়েছে, তারা মূলত স্বাধীনতাকে অস্বীকার করছে। তাই জিয়াউর রহমানের খেতাব সরকার বাতিল বা যাই করুক না কেনো তিনি এদেশের মানুষের হৃদয়ের মধ্যে রয়েছেন। বাংলাদশের ইতিহাসও এটাই বলে। 

 

—   লেখক  সিনিয়র সায়েন্টিস্ট, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি 



মাফিয়াতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় পদক ছিনতাই

— মারুফ কামাল খান

 

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের অমর ঘোষক শহীদ জিয়াউর রহমান বীরউত্তম 

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত আমাদের এ জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুক্তিযোদ্ধারাই এ রাষ্ট্রের স্রষ্টা। তারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে এ ভূখণ্ডকে হানাদার শত্রুবাহিনীর কবলমুক্ত করে রাজনৈতিক নেতাদের হাতে উপহার দিয়েছিলেন। তারা এ দেশ মুক্ত করেছিলেন বলেই রাজনীতিকেরা এর শাসনক্ষমতা ও কর্তৃত্ব গ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারাই এ রাষ্ট্রের সব পদ-পদবি ও ক্ষমতার স্রষ্টা। এ রাষ্ট্র অস্তিত্বশীল না হলে এসবের কিছুই থাকতো না।

জিয়াউর রহমান স্বকণ্ঠে সদর্পে এই রাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে বিপ্লবে এবং প্রতিরোধ যুদ্ধকে স্বাধীনতার সশস্ত্র যুদ্ধে উন্নীত করেন। তিনি কেবল আমাদের স্বাধীনতার প্রথম কণ্ঠস্বরই নন, প্রথম মুক্তিযোদ্ধাও। তিনি আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডারই কেবল নন, তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্রবাহিনীর অস্থায়ী সর্বাধিনায়ক রূপে স্বাধীনতার ঘোষক এবং মুক্তিযুদ্ধের তিনটি ব্রিগেড ফোর্সের একটির অধিনায়ক ছিলেন। 

রাষ্ট্রের স্রষ্টারা এই রাষ্ট্রের আইন-আদালত, সংবিধান, ক্ষমতাকাঠামো, সব প্রথা-প্রতিষ্ঠান, রাজনীতি বা অন্য কোনো কিছুরই অনুকম্পানির্ভর নন। তারাই এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। বরং আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা যাদের হাতে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব এনে দিয়েছে তারাই মুক্তিযোদ্ধাদের করুণা নির্ভর ও কৃতজ্ঞতার ঋণে আবদ্ধ থাকার কথা ছিল।

বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান বীরউত্তম 

কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের দুর্বিনীত নব্য শাসকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের কর্তা সেজে বসেন। এমনকি তারা নিজেদেরকে সমগ্র জাতির উর্ধ্বে এবং জাতির চেয়েও বড় ভাবতে থাকেন। তারা প্রচার করতে থাকেন, এই দেশ ও স্বাধীনতা নাকি তাদেরই দয়ার দান। প্রকৃত জাতীয় বীরদের আড়াল করে মেকি বীরপূজা শুরু করা হয়। তারাই কৃতিত্বারোপ ও হরেক রকমের সার্টিফিকেট বিতরণের মালিক সেজে বসেন। তাদেরই হঠকারি তত্ত্বে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। অনেক  বড়ো হয়ে দাঁড়ায় স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তির আকৃতি। সেই রাজনৈতিক হঠকারিতার বিবরণ তুলে ধরে তখন সংবাদপত্রে 'সিক্সটি-ফাইভ মিলিয়ন কোলাবরেটর্স' শিরোনামে আর্টিকেল প্রকাশিত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অবহেলা উপেক্ষার পাশাপাশি তাদের মধ্যে বিভেদ ও বিভাজনও সৃষ্টি করা হয়।

এসবের ফলাফল শুভ হয়নি। রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করার এই রাজনৈতিক ধারা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে রক্তাক্ত এক বিদ্রোহের মধ্যদিয়ে এর পরিবর্তন ঘটে। সেই পরিবর্তন আসে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বিদ্রোহী অংশের হাত দিয়েই। সেই নির্মম অভিজ্ঞতা জাতিকে বিভাজনের বদলে ঐক্যবদ্ধ করার, সংহতি গড়ে তোলার অনিবার্য বাস্তবতা, প্রয়োজনীয়তা ও শিক্ষাকে সামনে তুলে ধরেছিল। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান সব চেয়ে বেশি উপলব্ধি করেছিলেন সময়ের এই দাবিকে। তাই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে কেন্দ্রে স্থাপন করে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। দ্বন্দ্ব-বিভাজনের রক্তাক্ত সব ক্ষত নিরাময় এবং জাতীয় সংহতি ও সমঝোতার মহাসড়ককে চলার পথ হিসেবে বেছে নিয়েছিল বাংলাদেশ।

জিয়াউর রহমানের আগে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানও সেই জাতীয় ঐক্যের পথে নানা পদক্ষেপে এগুবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে তার ব্যক্তিগত অনুপস্থিতিজনিত দুর্বলতা এবং যুদ্ধোত্তর জাতীয় পুনর্গঠনে নেতৃত্ব প্রদানে ব্যর্থতার কারণে দ্রুত জনপ্রিয়তা হ্রাস তাকে এ ক্ষেত্রে সফল হতে দেয়নি। মুজিবোত্তর কালে জিয়াউর রহমান এক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেন।

আজ বাংলাদেশকে আবার ইতিহাসের কানাগলিতে ঠেলে দেয়ার জন্য মূর্খতাপ্রসূত এক হঠকারি অন্ধ রাজনীতির ধারা প্রাধান্য পেয়েছে। বাংলাদেশ তার রাষ্ট্রীয় চরিত্র হারিয়েছে। এটি আজ আর কোনো রাষ্ট্র নয়, প্রজাতন্ত্র নয়, পরবাহুনির্ভর এক মাফিয়াতন্ত্র মাত্র। অধঃপতিত এই পদ্ধতিতে নীতি, আদর্শ, প্রজ্ঞা বা দূরদর্শিতা নয়, হঠকারিতা ও অবিমৃষ্যকারিতাই এখন এর চলার পথ নির্ধারক। পদ-পদবি-ক্ষমতা লোভী স্তাবকের দল বিশেষ কাউকে তুষ্ট করার অভিপ্রায়ে এখন পরিণাম-পরিণতির চিন্তা না করেই যা-খুশি তাই করে যাচ্ছে।

এরই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অর্জিত বীরত্বসূচক 'বীরউত্তম' পদক ছিনতাই করার সিদ্ধান্তের কথা জানা গেলো। মাফিয়াতন্ত্র সিদ্ধান্ত নিচ্ছে রাষ্ট্রীয় পদক ছিনিয়ে নেয়ার। বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে জাতির কৃতজ্ঞতার স্বীকৃতিস্বরূপ এসব পদকে ভূষিত করে আমাদের রাষ্ট্রই সম্মানিত হয়েছিল। এটা বুঝবার মতন ন্যূনতম যোগ্যতা ও শিক্ষা যাদের নেই তারাই নতুন করে কলঙ্কের এই ক্ষতচিহ্ন অঙ্কন করতে যাচ্ছে। গর্ত থেকে মুখ বের করে হুতোমপ্যাঁচা ভাবছে, সে সূর্যের প্রখর দীপ্তিকে আটকে দিতে সক্ষম। হিংসায় জর্জরিত এই অতিক্ষুদ্ররা বুঝতেও পারছে না যে, এর মাধ্যমে তারা প্রকারান্তরে আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে চ্যালেঞ্জ করার ধৃষ্টতাই প্রদর্শন করেছে। ঘৃণা-বিভাজনের এই বিষবৃক্ষ রোপণের ফলাফল কী হবে তা আগামী দিন বলবে।


লেখক সাংবাদিক।