রুমিন ফারহানা
বাংলাদেশের একটি সুবিখ্যাত গাড়ির ব্যাটারি কোম্পানি ভারতে রপ্তানি করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে। ২০০৪ সালে ভারত অভিযোগ করে সেই ব্যাটারি কোম্পানি নিজেদের উৎপাদন মূল্যের চেয়েও কমমূল্যে পণ্যটি ভারতে রপ্তানি করছে (বাণিজ্যের ভাষায় ডাম্পিং)। এতে ভারতের ব্যাটারি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা রোধকল্পে তারা অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করে। ডাম্পিংয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিযোগীদের প্রতিযোগিতা থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজের পণ্যকে একচেটিয়া করে ফেলে তারপর সুবিধাজনক সময়ে অনেক চড়া দামে পণ্য বিক্রি করে অনেক বেশি মুনাফা করে সেটা পুষিয়ে ফেলা। এটা বাজারের প্রতিযোগিতা নষ্ট করে শেষ পর্যন্ত জনস্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বলে এটা বন্ধের জন্য অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপের কথা ওঠে।
বাংলাদেশ এর প্রতিবাদ করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) অভিযোগ জানায়। সেখানে ওই ব্যাটারি কোম্পানিকে উৎপাদনের যাবতীয় তথ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে যে দামে তারা পণ্যটি বিক্রি করছে তাতে তারা লোকসান দেয়নি, লাভ করছে। এরপর ২০০৬ সালে ওই ব্যাটারি কোম্পানি ডব্লিউটিও থেকে নিজেদের পক্ষে রায় পায়। পাঠক এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, ব্যাটারি কোম্পানিটি নিজেদের উৎপাদিত পণ্য অতি কম দামে দিচ্ছে কেবলমাত্র এই কারণেই শুল্কের মুখোমুখি হয়েছিল। এমন নয়, যে তারা মিডিয়া বা মাধ্যম হিসেবে মূল উৎপাদনকারী এবং ক্রেতার মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছিল যেমনটি আমরা দেখেছি ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ এবং এদের মতো আরও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে। যেহেতু বিখ্যাত এই ব্যাটারি কোম্পানি প্রমাণ করতে পেরেছিল যে তুলনামূলকভাবে কম মূল্যে ব্যাটারি বিক্রি করলেও তারা লোকসানে নয়, লাভে আছে, সে কারণেই শেষ পর্যন্ত মামলা জিতে অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক থেকে মুক্ত হতে পেরেছিল তারা।
ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ কিংবা তারও আগে যুবক, ইউনিপে-টু-ইউ, ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর শুরু থেকেই ব্যবসা করার ন্যূনতম কোনো ইচ্ছে ছিল না। প্রতারণার মাধ্যমে লাখো মানুষের হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎই ছিল এই প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্য। মজা হচ্ছে এই প্রতারণা তারা লুকিয়ে চুরিয়ে রাখঢাক করে করেনি। রীতিমতো বিশাল বিশাল ব্যানার-বিলবোর্ড টানিয়ে প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দিয়ে, বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের স্পন্সর হয়ে, বিখ্যাত সব তারকাদের খ্যাতির দ্যুতি ছড়িয়ে, র্যাবের তৈরি সিনেমায় আর্থিক সহায়তা করে, সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে টাকা ঢেলে, ই-ক্যাবের নানা অনুষ্ঠানেরও পৃষ্ঠপোষক হয়ে মাঠে নেমেছিল তারা। মন্ত্রীদের নিয়েও নানান অনুষ্ঠান করে ই-ভ্যালি। সবার চোখের সামনে ওয়েবসাইট খুলে গ্রাহককে বিশাল ছাড়ে পণ্য দেওয়ার লোভ দেখিয়েছে তারা, বিপুল অংকের টাকা তুলেছে, লেনদেন হয়েছে ব্যাংক ও মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এত বড় পরিসরে নামার পর সাধারণ মানুষের সন্দেহ করার কী কারণই বা থাকতে পারে? আর প্রতারণার জাল তো বিস্তার করা হয়েছে ধীরে ধীরে, শুরুতে ওয়াদা মতো পণ্য মানুষের ঘরে পৌঁছে দিয়ে। মানুষের অবিশ্বাসের কোনো কারণ তো ছিল না। মানুষ দেখেছে তার পরিচিতজনরা টাকা দিয়েছে, পণ্য পেয়েছে এবং সেই পণ্যও পেয়েছে অর্ধেক বা তারও কম দামে। কিন্তু এই বিশ্বাসের মাশুল গুনেছে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। অনেকেই শুনলাম বলছেন, মানুষের লোভের রাশ টানা উচিত, বেশি লোভ করলে এমনই ঘটে, ইত্যাদি ইত্যাদি। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, এই প্রশ্ন কেউ তুলছেন না, কী করে সরকারের এতগুলো সংস্থার নাকের ডগা দিয়ে মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছর এ ধরনের ব্যবসা চালালেন এই প্রতারকরা। কী করে গত ১৫ বছরে ২৮০টি প্রতিষ্ঠান মিলে মানুষের অন্তত ২১ হাজার ১৭ কোটি টাকা লোপাট করে, কী করে যুবক, ইউনিপে-টু-ইউ, ডেসটিনির তিক্ত অভিজ্ঞতার পর আবারও ই-অরেঞ্জ, ই-ভ্যালি, ধামাকা, এহসান গ্রুপ ধরনের প্রতারক কোম্পানিগুলো সরকারের সব প্রতিষ্ঠানের সামনে দিয়ে দিনের পর দিন এমন সন্দেহজনক ব্যবসা চালিয়ে গেল। এটি পানির মতো পরিষ্কার যে সরকারের পক্ষ থেকে যদি পরিবীক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যেত তাহলে আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি হয় না।
সংসদে এই বিষয়ে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছিলাম আমি। তারপরই দেখলাম সরকারের যেন কিছুটা ঘুম ভাঙল, নড়েচড়ে বসল প্রতিযোগিতা কমিশনও। এই ফাঁকে বলে রাখি, পশ্চিমের ‘অ্যান্টিট্রাস্ট ল’-এর ধারায় বাংলাদেশে প্রতিযোগিতা আইন হয়েছে ২০১২ সালে। সেই আইনে প্রতিযোগিতা কমিশনের কাজের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে (৮.১.ক) বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব বিস্তারকারী অনুশীলনসমূহকে নির্মূল করা, প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করা ও বজায় রাখা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। এরপর আইনের ১৫ এবং ১৬ ধারায় উল্লেখ আছে বাজারে প্রতিযোগিতা ক্ষুন্ন করতে পারে এমন কোনো পদক্ষেপ কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিতে পারবে না। ২১ সেপ্টেম্বর প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান ই-কমার্স ব্যবসার লোকজনের সঙ্গে বসে বলেন, ‘গ্রাহকদের প্রতারিত করার লক্ষ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান অস্বাভাবিক ডিসকাউন্ট দিয়ে পণ্য বিক্রি করেছে। ব্যবসাও করছে গ্রাহকের টাকায়। আগামীতে আর কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমন প্রতিযোগিতা বিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পেলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন স্বপ্রণোদিত হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করবে।’ এই আইনের ১৯ ধারা অনুযায়ী কমিশন কোনো ব্যবসা জনগণের বড় ক্ষতি করতে পারে এমন সন্দেহ করলে দুই দফায় ৬০ দিন করে মোট ১২০ দিন অর্থাৎ ৪ মাস ব্যবসাটি বন্ধ করে রাখার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। অর্থাৎ এই আইনের অধীনে প্রতিযোগিতা কমিশন এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনেক আগেই বন্ধ করে দিতে পারত। তাহলে অসংখ্য মানুষ চরম ঝুঁকিতে পড়া থেকে বেঁচে যেত।
সংসদে এই বিষয় কথা বলতে গিয়ে আমি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলাম এই টাকা জনগণের টাকা এবং এর দায় সরকারকে নিতে হবে। অর্থাৎ প্রাথমিকভাবে জনগণের টাকা ফেরত দিতে হবে সরকারকে, পরে পারলে সরকার এই সব প্রতারক কোম্পানির কাছ থেকে অর্থ আদায় করে নেবে। পরে দেখলাম একই ধরনের কথা বলছেন অর্থমন্ত্রীও। তার ই-কমার্সের নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণার দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। যেহেতু এখানে ছাড়পত্র দিচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, তাই প্রাথমিকভাবে তাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। আইটির বিষয়ও যেহেতু এখানে জড়িত তাই আইসিটি মন্ত্রণালয়ও দায় এড়াতে পারে না। অর্থাৎ অর্থ, বাণিজ্য, আইসিটি, স্বরাষ্ট্র প্রতিটি মন্ত্রণালয়েরই দায় আছে এই ধরনের ব্যবসা চলতে পারার পেছনে এবং তারা কেউ-ই সে দায় এড়াতে পারে না।
বাণিজ্যমন্ত্রী অবশ্য দায় নিতে নারাজ। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষতিপূরণে সরকার কিছুই করবে না। তিনি বরং আরেক কাঠি সরেস হয়ে বিষয়টিকে হালকা করে ফেলার চেষ্টা করছেন। অনলাইনে কোরবানির গরু কিনতে গিয়ে তিনি হয়রানির শিকার হওয়ার কথা জানিয়ে এমনভাবে কথা বলেছেন যেন ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জের মতো ঘটনা বাংলাদেশের সব ই-কমার্সেই হয়। বাংলাদেশের ই-কমার্স ব্যবসায় পণ্য কিনতে গিয়ে অর্ডার দেওয়া পণ্যের সঙ্গে প্রাপ্ত পণ্য নিম্নমানের হওয়া, বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে পণ্য বিক্রি, ডেলিভারি পেতে দেরি হওয়ার মতো অভিযোগ ক্রেতাদের দিক থেকে আছে; দেশের ই-কমার্সের ভবিষ্যতের স্বার্থে সেগুলো নিয়ে কাজ করতেই হবে। কিন্তু সেগুলো কোনোটি কি এই আলোচিত ‘পঞ্জি স্কিম’ প্রতারণাগুলোর সঙ্গে তুলনীয় কোনো দিক থেকে? এটা করে তিনি কি সাধারণভাবে ই-কমার্সের প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থা তৈরি করছেন না?
হালের ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ ও এদের মতো কিছু ই-কমার্স সাইট এবং আগের ডেসটিনি, যুবক, ইউনিপে-টু-ইউ এগুলো কোনোভাবেই ব্যবসা নয়, এগুলো আসলে ‘পঞ্জি স্কিম’। বড় স্কেলে এমন প্রতারণা করা ব্যক্তি চার্লস পঞ্জি’র নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে। এটা হচ্ছে এক ধরনের প্রতারণামূলক কার্যক্রম, যেখানে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের তুলনায় বিশাল অংকের একটি লভ্যাংশ (ই-কমার্স সাইটগুলোর ক্ষেত্রে অতি অস্বাভাবিক কম মূল্যে পণ্য) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, যেটা বাজারের প্রচলিত হারের চাইতে অনেক বেশি। কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠানটি মানুষের কাছ থেকে নেওয়া টাকা দিয়ে কোনো মূল্য সংযোজন না করে তারা নতুন বিনিয়োগকারীদের থেকে প্রাপ্ত টাকা দ্বারাই পুরনো বিনিয়োগকারীদের কাউকে কাউকে লাভ/পণ্য প্রদান করে। এতে শুরুতে নিজে পেয়ে বা আশপাশের কাউকে লাভ পেতে দেখে অনেক মানুষ আকৃষ্ট হয়ে তাদের টাকা দেয় এবং এক পর্যায়ে অনিবার্যভাবেই দেখা যায় মানুষ প্রতিশ্রুত লাভ/পণ্য আর পাচ্ছে না। তখন এই প্রতারকরা বহু মানুষের টাকা নিয়ে চলে যায়। এই কারণেই সভ্য দেশে ‘পঞ্জি স্কিম’ অল্প সময়ের জন্যও চলতে পারে না, কারণ এটা কোনোভাবেই ব্যবসা নয়, স্রেফ প্রতারণা।
তাহলে টাকা হারানো সাধারণ মানুষের দায় নিয়ে তাদের ক্ষতিপূরণ দেবে না কেন সরকার? জানি সরকারের টাকা মানেই জনগণের টাকা। জনগণের টাকা দিয়ে কারও প্রতারণার মাশুল সরকার দেবে কেন, এই প্রশ্ন আসতে পারে, আসছেও সেটা। কিন্তু আমি মনে করি জনগণকে প্রকাশ্য প্রতারণার জালে আটকে ফেলে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনায় সরকারকে যেহেতু কোনো আর্থিক দায় নিতে হয় না, তাই এসব ঘটনা বারবার ঘটার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো ভ্রুক্ষেপও থাকে না। সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং দলের ক্ষমতাবান মানুষ এসব প্রতারকের কাছ থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হয় বলে এসব প্রতারণা ভিন্ন ভিন্ন চেহারা নিয়ে বারবার আসে, আসতেই থাকে। এই কারণেই আমি বিশ্বাস করি এসব প্রকাশ্য প্রতারণার ক্ষেত্রে সরকারকে আইনগতভাবেই আর্থিক দায়ে যুক্ত করার মাধ্যমেই এটা রোধ করা সম্ভব হতে পারে।
- লেখক আইনজীবী, সংসদ সদস্য ও বিএনপিদলীয় হুইপ
লেখাটি প্রথমে দৈনিক দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত হয়েছে।