— অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাত মোহাঃ শামীম
সম্পাদনায় অধ্যাপক ড. মোঃ মোর্শেদ হাসান খান
মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে এসে বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্ত তারা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছে একটি বিষয় তা হচ্ছে ‘জিয়া এমনই এক নাম যাকে শত-সহ¯্র প্রচেষ্টার পরেও বাংলার ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা অসম্ভব’। স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে এই মহান রাষ্ট্রনায়কের গৃহীত অনেকগুলো উদ্যোগের মধ্যে একটি ছিল ১৯ দফা কর্মসূচি। মুক্তিযুদ্ধের পর প্রায় ৫০ বছর পার করে এসে আজও এই ১৯ দফা কতটা প্রাসঙ্গিক, কত গুরুত্ববহ আর যৌক্তিকতার মানদণ্ডের অপরিহার্য বাস্তব তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মুক্তিযুদ্ধ উত্তরকালের স্বাধীন একটি জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য জাতীয়তাবাদী চেতনা খুব বেশি প্রয়োজন তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু ক্ষুধার্ত মানুষের নিকট তা অর্থহীন। তাইতো প্রেসিডেন্ট জিয়া ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির উদ্দেশ্যে ১৯-দফা কর্মসূচি দেন। এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ছিল সাধারন মানুষ, কৃষক, শ্রমিক এবং সরকারি কর্মচারি সকলেরই ভাগ্যোন্নয়নের ব্যবস্থা। তার অসামান্য মেধা, প্রজ্ঞা ও শ্রম দিয়ে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তলাবিহীন ঝুড়িকে পরিণত করলেন অপার সম্ভাবনার দেশ হিসেবে। এ প্রসঙ্গে ইরানের বহুল প্রচারিত ফারসি ভাষার দৈনিক এতেলাত-এ এক নিবন্ধে বলা হয়, ‘চল্লিশ বছর বয়স্ক জেনারেল এক বছর তিন মাস ধরে দায়িত্বে রয়েছে। এই সময় বাংলাদেশের অবস্থা পাল্টে গেছে। দারিদ্র ও আশ্রয়হীনতার অসুরটাকে জিয়াউর রহমান থামিয়ে দিয়েছে।’ এ নিবন্ধটি রচনা করেন হংকংস্থ সংবাদদাতা সাফাহেরী (দৈনিক বাংলা, ৭ মার্চ ১৯৭৭)।
জিয়াউর রহমানের চরিত্রের একটি অনন্য দিক এই যে, তিনি দেশের সমস্যা অনুধাবন করার জন্য এবং এগুলোর সমাধানের পথ খোঁজার জন্য যথেষ্ট সময় ব্যয় করতেন। জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির উদ্দেশ্যে তিনি যে ১৯-দফা কর্মসূচি দেন তা তাঁর এই চিন্তারই ফসল। এই ১৯-দফা কর্মসূচিকে দেশের মানুষ তাদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির সনদ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। অনেক রাষ্ট্রনীতিবিদরা এ ১৯-দফা কর্মসূচিকে একটি যুগোত্তীর্ণ‘ভিশন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। শহীদ জিয়ার নেতৃত্বে ১৯-দফা কর্মসূচি খুব অল্প সময়ে সরকার ও সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি প্রাণের সেতুবন্ধন তৈরি করেছিল যা তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়।
১৯-দফা কর্মসূচির প্রত্যেক দফা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে রাষ্ট্রনায়ক জিয়ার অসামান্য দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞা। পাঁচ (০৫) দশক পরেও ১৯ দফা এখনও আমাদের দেশের জন্য সমান প্রাসঙ্গিক। জিয়াউর রহমানের ১৯-দফাকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য অনুসরণযোগ্য গাইড হিসেবে দেখলেই শুধু এর প্রতি সুবিচার করা সম্ভব। জিয়াউর রহমানের শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে তার ১৯-দফা বাধাগ্রস্থ হয়েছিল নিঃসন্দেহে, তবে থেমে থাকেনি। এরশাদের ০৯ (নয়) বছরের স্বৈরাচারী শাসনের পর ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসলে ১৯-দফার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া আরও বেগবান হয়। খালেদা জিয়া ১৯৯১-৯৬ মেয়াদে নারী শিক্ষাজগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। এই মেয়াদ বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য স্মরণীয়। এছাড়াও সুশাসন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ও অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়নের জন্য খালেদা জিয়ার এই সময়ের শাসনামল দেশে বিদেশে প্রশংসিত হয়। ১৯৯৬-২০০১ সালের সন্ত্রাসের শাসনামলের বিভীষিকা কাটিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার ২০০১-২০০৬ মেয়াদের রাষ্ট্র পরিচালনা পরিচিতি পেয়েছে মূলতঃ সন্ত্রাস দমনে সফলতা, পরিবেশ সংরক্ষণে প্রশংসণীয় উদ্যোগ, গণমুখী পররাষ্ট্রণীতি, তথ্য প্রযুক্তির সম্প্রসারণ, স্থিতিশীল আর্থিক কাঠামোর জন্যই।
১৯-দফা
১। সর্বতোভাবে দেশের স্বাধীনতা, অখন্ডতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। ভূ-রাজনৈতিক কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় তার স্বাধীনতা, অখন্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও সীমান্তে নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে প্রথম দফাতেই তার সুস্পষ্ট উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরিণ ও আন্তর্জতিক ভিত্তি মূলতঃ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানই গড়ে তুলেছেন। এজন্য তিনি একদিকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও অন্যদিকে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব নীতিতে কাজ করেছেন।
২। শাসনতন্ত্রের চারটি মূলনীতি অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি সর্বাত্মক বিশ্বাস ও আস্থা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র জাতীয় জীবনে সর্বাত্মক প্রতীফলন। দেশের সংখ্যাগুরু মানুষের আদর্শকে শ্রদ্ধা করে জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ (পরম দয়ালু, দয়াময় আল্লাহর নামে) সংযোজন করেছিলেন। ১৯৭২ সালের সংবিধানের একটি মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিস্থাপন করে সংবিধানের ৮(১) এবং ৮(১ক) অনুচ্ছেদে মহান আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস অংশটিও যুক্ত করেছিলেন জিয়াউর রহমান।
১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ রামপুরা টেলিভিশন ভবনে বেতার ও তথ্য বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তাদের এক সমাবেশে শহীদ জিয়া বলেছিলেন, “আমরা সকলেই বাংলাদেশী। আমরা প্রথমে বাংলাদেশী এবং শেষেও বাংলাদেশী”। এই মাটি আমাদের, এই মাটি থেকে আমাদের অনুপ্রেরণা আহরণ করতে হবে। জাতিকে শক্তিশালী করাই আমাদের লক্ষ্য। ঐক্য, শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম, নিষ্ঠা ও কঠোর মেহনতের মাধ্যমেই তা সম্ভব (দৈনিক বাংলা, ১৪ মার্চ ১৯৭৬)।
প্রেসিডেন্ট জিয়া সবসময় ধর্ম নিয়ে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি কিংবা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে নিষেধ করতেন। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে একটি কর্মশালা উদ্বোধনকালে তিনি দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক আদশর্, ধর্মকে ভিত্তি করে হতে পারেনা। একটা অবদান থাকতে পারে কিন্তু ধর্মকে কেন্দ্র করে কখনই রাজনীতি করা যেতে পারেনা। এটা মনে রাখবেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
৩। সর্ব উপায়ে নিজেদেরকে একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসাবে গঠন করা। আন্তর্জাতিক দরবারে বাংলাদেশকে একটি সম্মানজনক আসনে সমাসীন করা এবং তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে বাংলাদেশের ভুমিকাকে অর্থবহ করে তোলার জন্য তিনি নিরলস ও অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৮০ সালে জাতিসংঘের বিশেষ সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দেন। মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। ফলে বাংলাদেশ জাপানকে হারিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়।
৪। প্রশাসনের সর্বস্তরে, উন্নয়ন কার্যক্রমে ও আইন শৃংখলা রক্ষার ব্যাপারে জনগণের অংশগ্রহন নিশ্চিত করা। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শহীদ জিয়ার আরেকটি অবদান হলো নাগরিক বাহিনী গঠনের চিন্তা বাস্তবায়ন করা। গ্রামোন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ ও চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বন্ধ করতে এক কোটি নারী ও পুরুষকে সাধারণ সামরিক প্রশিক্ষণদানের লক্ষ্যে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) গঠনের মাধ্যমে দেশগঠন ও নিরাপত্তায় ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দেন।
৫। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার-এর ভিত্তিতে কৃষি উন্নয়ন-এর মাধ্যমে গ্রামীণ তথা জাতীয় অর্থনীতিকে জোরদার করা। সেচ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাশ্রম ও সরকারি সহায়তার সমন্বয় ঘটিয়ে ১৪০০ খাল খনন ও পূনর্খনন করে দেশে কৃষি বিপ্লব ঘটান। কাজের জন্য জনগণকে সংগঠিত ও অনুপ্রাণিত করতে প্রেসিডেন্ট জিয়া প্রায়ই গ্রামে-গঞ্জে সফর করতেন। ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনালের সুজান গ্রিন ঢাকা থেকে পাঠানো এক ডেসপাচে লিখেছিলেন, ‘সাম্যের প্রতীক ও সৎ লোকরূপে ব্যাপকভাবে গণ্য জিয়াউর রহমান স্বনির্ভর সংস্কার কর্মসূচি শুরু করে বাংলাদেশের ভিক্ষার ঝুড়ি ভাঙার প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন।’
৬। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা এবং কেউ যেন ক্ষুধার্ত না থাকে তা নিশ্চিত করা। ১৯৭৯ সালে বিচিত্রার সাথে আলাপকালে দেশপ্রেমিক জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, তাঁর রাজনীতির মূল লক্ষ্য হবে মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন। তাঁর ভাষায়, “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদই হবে রাজনীতির মূল ভিত্তি, জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনই হবে রাজনীতির মূল লক্ষ্য।” শহীদ জিয়া বিশ্বাস করতেন বাংলাদেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া কোনো কঠিন কাজ নয়, চাই শুধু অদম্য ইচ্ছা। মালয়েশিয়ার দৈনিক ‘বিজনেস টাইমস’-এ প্রকাশিত এক ডেসপাচে বলা হয় “অতীতে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত করেছিল যে মহামারী সমস্যাগুলো, প্রেসিডেন্ট জিয়া কার্যতঃ সেগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।” (দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ নভেম্বর ১৯৭৯)।
৭। দেশে কাপড়ের উৎপাদন বাড়িয়ে সকলের জন্য অন্তত মোটা কাপড় নিশ্চিত করা। ১৯৮০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম বোর্ডের হস্তচালিত তাঁতবস্ত্র ও সরঞ্জামাদির উন্নত কেন্দ্র উদ্বোধনকালে প্রেসিডেন্ট জিয়া বলেন,“...বর্তমানে দেশের বস্ত্রশিল্প সম্পূর্ণভাবে বিদেশ থেকে আমদানি করা তুলার উপর নির্ভরশীল। এ অবস্থায় বস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে আমাদের অবশ্যই দেশের ভিতর প্রয়োজন অনুযায়ী তুলা উৎপাদন করতে হবে। এছাড়া বস্ত্রের সামগ্রিক চাহিদা মেটাতে আমাদের তাঁতজাত পণ্যের উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে। প্রতিটি গ্রামে তুলা উৎপাদনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন যে, হস্তচালিত তাঁতে এসব তুলা দিয়ে গ্রামাঞ্চলেই কাপড় তৈরি করা যায় এবং এভাবে দেশের কাপড়ের মৌলিক চাহিদা পূরণ হতে পারে।”
৮। কোন নাগরিক যেন গৃহহীন না থাকে তার যথাসম্ভব ব্যবস্থা করা। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসা এই পাঁচটি মৌলিক বিষয়ের মধ্যে গৃহ বা বাসস্থান অন্যতম। দেশে বসবাসরত প্রত্যেক নাগরিকদের জন্য গৃহ থাকা বাঞ্ছনীয়-এ সত্য উপলব্ধি করে শহীদ জিয়া সবার জন্য তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, থাকার জায়গা হলে মানুষ তার জীবন জীবিকার ব্যবস্থা করতে পারবে।
৯। দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৮০ সালে সরকারি উদ্দ্যোগে দেশব্যাপী চালু করেছিলেন গণশিক্ষা। নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছেপেছিলেন ০১ (এক) কোটি বই। গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করে মাত্র দেড় বছরে ৪০ (চল্লিশ) লাখ বয়স্ক মানুষকে নতুন করে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র পড়াশোনার পরিবেশ ফিরিয়ে এনেছিলেন।
১০। সকল দেশবাসীর জন্য ন্যূনতম চিকিৎসার ব্যাবস্থা করা। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে জনগণের স্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত ২০০০ সালের মধ্যে “সবার জন্য স্বাস্থ্য” এই অংগীকার বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পল্লীর জনগণ যেন সুচিকিৎসা পায় সেজন্য তিনি পল্লী চিকিৎসক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। মাত্র ১ বছরেই ২৭৫০০ পল্লী চিকিৎসক প্রশিক্ষণ শেষে নিয়োগ করে গ্রামীন জনগণের চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধি করেন।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আগ্রহ ও ঐকান্তিক ইচ্ছায় বিশেষ অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ডায়রিয়া চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য গবেষণায় অনন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর,বি। এটি কলেরা হাসপাতাল নামেও সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত। এছাড়া জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, নিপসম ((NIPSOM: National Institute of Preventive and Social Medicine)) এবং সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি, ইপিআই (EPI: Expanded Program on Immunization) প্রতিষ্ঠিত হয় প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতাতেই। ১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল ইপিআই থেকে বাংলাদেশে এক (০১) বছরের কম বয়সী সকল শিশুদের বহুল সংক্রামক রোগ যক্ষা, ডিপথেরিয়া, হুপিংকাশি, হাম, পোলিও-মায়েলাইটিস এবং মা ও নবজাতকের ধনুষ্টংকার রোগের টিকা দেওয়া শুরু হয়।
শহীদ জিয়া উপলব্ধি করেছিলেন যে, আলমা আতা ঘোষণার আলোকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা (চঐঈ) বাস্তবায়নের মূল লক্ষ্য হলো গ্রামীন জনগণের স্বাস্থ্যের উন্নয়ন। ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণের ধারনাটির প্রবর্তন এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ তিনিই প্রথম নিয়েছিলেন। গ্রামীন জনগণের স্বাস্থ্য উন্নয়নে তৎকালীন থানা ডিসপেন্সারিসমূহকে আধুনিক থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন শহীদ জিয়া।
১১। সমাজে নারীর যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা এবং যুব সমাজকে সুসংহত করে জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করা। রাষ্ট্রীয় চাকরিতে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ পদ সংরক্ষিত রাখার বিধান করেছিলেন জিয়াউর রহমান। যুবসমাজকে সুসংগঠিত এবং উৎপাদনমূখী শক্তিতে রূপান্তর ও জাতীয় উন্নয়নের মূল ধারায় অবদান রাখার জন্য জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে যুব মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীতে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় হিসেবে পুনঃনামকরণ করা হয়।
১২। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতে প্রয়োজনীয় উৎসাহ দান। বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করার জন্য ১৯৭৬ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ চালু করেন শহীদ জিয়া। তিনি ১৯৭৯ সালে জাতীয়কৃত শিল্পকারখানাকে বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করেন। শিল্প-কারখানাগুলো ফিরে পায় প্রাণ, কর্মসংস্থান হয় লক্ষাধিক মানুষের। ১৯৮০ সালে বিরাষ্ট্রীয়করণ আইন পাশ করেন। বিরাষ্ট্রীয়করণের ফলে জাতীয় লোকসান সেই সময়ে সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে। অভ্যন্তরীণ জাতীয় উৎপাদন, জাতীয় প্রবৃদ্ধি, জাতীয় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পায়।
১৩। শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি সাধন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে সুস্থ শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকারি কলকারখানায় ০৩ (তিন) শিফ্টে কাজ শুরু হয় শহীদ জিয়ার সময়েই। তিনি শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো এবং বছরে ছুটি ও বোনাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। শ্রমিক-মালিকদের অধিকার নিয়ে শহীদ জিয়ার আদর্শ বাস্তবায়িত হলে আজকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরো শক্তিশালী হতো।
১৪। সরকারি চাকুরীজীবিদের মধ্যে জনসেবা ও দেশ গঠনের মনোবৃত্তি উৎসাহিত করা এবং তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন করা। শহীদ জিয়া উপলব্ধি করেছিলেন যে, জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস, যদি জনগণ শক্তিশালী হয় রাষ্ট্রও শক্তিশালী হবে। তিনি এটাও বিশ্বাস করতেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারিগণকে জনগণের সেবক হিসেবে যথাযথভাবে নিয়োজিত করতে পারলেই দেশ গঠনে তাদের যে ভূমিকা তা যথাযথ হবে।
১৫। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ করা। জিয়াউর রহমানই প্রথম জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তাঁর শাসনামলেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম সারাদেশে মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তিনি গ্রাম এলাকায় ৩৮ হাজার পরিবার পরিকল্পনাকর্মী নিয়োজিত করেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকল্পে তিনি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ((NIPORT: National Institute of Population Research and Training প্রতিষ্ঠা করেন।
১৬। সকল বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করা। শহীদ জিয়া বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে তুলে ধরেন এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নিজের সরব উপস্থিতির প্রমান রাখেন। মুসলিম বিশ্ব ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। এছাড়া ১৯৮১ সালের জানুয়ারিতে তৃতীয় ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে তিন সদস্য বিশিষ্ট ‘আল-কুদ্স’ কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন জিয়া। ইরাক-ইরান যুদ্ধাবসানের উদ্দেশ্যে গঠিত নয় সদস্য বিশিষ্ট ইসলামী শান্তি মিশনের তিনি ছিলেন অন্যতম সদস্য। ফিলিস্তিন জনগণের প্রতি অবিচল সমর্থন এবং ওআইসি-কে একটি কার্যকরি সংগঠনে পরিণত করার ক্ষেত্রে শহীদ জিয়ার ভূমিকা মুসলিম বিশ্ব আজও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। এখন শান্তিরক্ষী বাহিনীর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের নির্ভিক সেনানীরা যে ভূমিকা পালন করে চলেছেন, তার সূচনা তখন থেকেই।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার এক প্রতিক্রিয়ায় শহীদ জিয়াকে বাংলাদেশের সেরা নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, “জনগণকে সাহসী নেতৃত্বদানের মধ্য দিয়ে তিনি গোটা বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করেছেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার নেতৃত্বের প্রশংসা করে কার্টার আরো বলেছিলেন, শুধু মুসলিম দেশ ও সমাজের মধ্যেই নয়, প্রকৃতপক্ষে গোটা বিশ্বসমাজে তিনি ব্যক্তিগতভাবে যে নেতৃত্ব দিয়েছেন আমরা তার জন্য কৃতজ্ঞ।”
১৭। প্রশাসন এবং উন্নয়ন ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা। তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামের জনগণকে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা ও উন্নয়ন কর্মকান্ডে সম্পৃক্তকরণ এবং সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে দেশ গড়ার কাজে নেতৃত্ব সৃষ্টি করার লক্ষ্যে গ্রাম সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন জিয়াউর রহমান। পঁয়ষট্টি হাজার গ্রামে শান্তিশৃংখলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি ১৯৭৬ সালের ৫ জানুয়ারি গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী (ভিডিপি) গঠন করেন। ৮০ লাখ গ্রাম প্রতিরক্ষাকর্মী নিয়োজিত করেন। ১৯৭৬ সালেই প্রথম মহিলা আনসার’ গঠন করে তাদের জেলা পর্যায়ে নিয়োগ দেয়া হয়।
১৮। দূর্নীতিমুক্ত, ন্যায়নীতি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা। স্বাধীনতা পরবর্তী তৎকালীন সরকার সর্বগ্রাসী দূর্নীতির মাধ্যমে দেশকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছিল। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালে অর্থাৎ ক্ষমতায় আসার পরপরেই উপলব্ধি করেছিলেন দুর্র্নীতিমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ছাড়া ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নতি কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন সমাজে সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হলেই শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে। তাই তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম পর্যায়ে দুর্র্নীতিমুক্ত সরকার, প্রশাসন ও সমাজ কায়েমের লক্ষ্যে নানা রকম উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
১৯। ধর্ম, গোত্র ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণ করা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করা। দেশের সকল মানুষের স্ব স্ব ধর্ম পালনের সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি ও বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৮০ সালের ২৫ জানুয়ারি ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন জিয়াউর রহমান। ধর্মের সত্যিকার শিক্ষা ও মূল্যবোধকে অবলম্বন করে প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ নিজ পরিচিতিতে জাতীয় উন্নয়নে যেন অবদান রাখতে পারে এ মন্ত্রণালয় সৃষ্টির পেছনে তাও ছিল একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। এ প্রসঙ্গে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার একটি উক্তি খুবই প্রাসঙ্গিক, ‘আমাদের সকলকে এক জাতি, এক মানুষ হিসেবে কাজ করতে হবে।’
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে সদ্য স্বাধীন একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের কা-ারি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ভঙ্গুর অর্থনীতি, ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দারিদ্র, আইন-শৃঙ্খলার যাচ্ছেতাই অবস্থা, কর্মহীন বেকার মানুষের আধিক্য আর স্বাস্থ্যখাতের বেহাল দশা তিনি লাভ করেছিলেন ক্ষমতার উত্তরাধিকার হিসেবে। তাই রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর সাধারণ মানুষের সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিতকরণ হয়ে উঠেছিল তাঁর জন্য সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে গিয়ে তিনি প্রস্তাব করেছিলেন ১৯ দফার। একটি পর্যায়ে তাঁর যোগ্য নেতৃত্ব, সুশাসন আর নৈতিকতানির্ভর প্রশাসন পরিচালনায় আলোর মুখ দেখেছিল দেশবাসী। আর এক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা রাখে এই ১৯ দফা কর্মসূচি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার করে এলেও এখনও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, সুশাসন ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে ১৯ দফার থেকে গ্রহণযোগ্য, বাস্তবসম্মত ও নির্ভরযোগ্য কোনো মডেল বাংলাদেশে তৈরি করা সম্ভব হয়নি।
— লেখক অধ্যাপক, কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন অনুষদ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং সম্পাদক অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিধ্যালয়, ঢাকা-১০০০