Search

Friday, November 19, 2021

বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বরপুত্র তারেক রহমান

—  ড. মোর্শেদ হাসান খান 

দেশনায়ক তারেক রহমান


১৯৮৯ সালে বগুড়া জেলা বিএনপি’র প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণের মাধ্যমে জনাব তারেক রহমানের রাজনৈতিক পথচলার শুরু। কালক্রমে তিনি এখন এই দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় কারান্তরীণ দেশমাতা বেগম খালেদা জিয়া এবং বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ জিয়াউর রহমানের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে তিনি বিগত কয়েকবছর যাবত বিএনপিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সুদূর লন্ডনে থেকেও তিনি দিবানিশি অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিএনপি’র কার্যক্রমকে সচল রাখছেন। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্তরণ এবং সংগ্রামে জিয়া পরিবার এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি- এর রয়েছে গৌরবোজ্জল ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে যতবারই সংকট ঘনীভূত হয়েছে, ততবারই আমরা জিয়া পরিবারকে এগিয়ে আসতে দেখেছি। এদেশের জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক জনতাকে সাথে নিয়ে এ পরিবার জাতির ঘোর সংকটকালে ত্রাতার ভূমিকায় আভির্ভূত হয়েছে। জনাব তারেক রহমান তার চেতনায় সেই উত্তরাধিকারই বহন করছেন।

জার্মান দার্শনিক কার্ল স্মিথ বলেছিলেন, Sovereign is a decision making power specially on exceptional moments, অর্থাৎ ক্রান্তিকালে ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতাই স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম মর্যাদা। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালরাতে পাক হানাদার বাহিনী যখন তৎকালীন পূর্ব বাংলার নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, জিয়া তখন ‘We Revolt’ বলে বিদ্রোহের সূচনা করেন। কেবল তাই নয়; তিনি ২৭শে মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মহান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিশেহারা জাতির সামনে আলোকবর্তিকা হিসেবে আভির্ভূত হন। সাহসী জিয়া জাতির ক্রান্তিলগ্নে ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আমাদের ভূখণ্ডের সার্বভৌম মর্যাদা রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। একাত্তরের মতই পঁচাত্তরের ৭ই নভেম্বর জাতীয় জীবনের আরেক দুঃসময়ে জিয়া কণ্ডারি হিসেবে আবির্ভূত হলেন। জাতীয় সংকটকালীন মূহুর্তে মানুষ যেমন সাহসী উচ্চারণ শুনতে চায়, জিয়া সেই প্রত্যাশা পূরণ করলেন। তিনি সেদিন জাতিকে সকল আধিপত্যবাদি শক্তি ও তাদের দোসরদের ষড়যন্ত্রের কবল থেকে বেরিয়ে আসার পথ বাতলে দিয়েছলেন। জিয়ার আহবানে দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে একটি গণতান্ত্রিক ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ বিনির্মাণের সঙ্গী হতে অনুপ্রেরণা পেয়েছিল। এভাবেই জিয়া এদেশের মানুষকে সাথে নিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। কিন্তু ১৯৮১ সালের ৩০ মে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জিয়ার ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ আন্দোলনকে থামিয়ে দেয়ার জন্য আঘাত হানা হয়। জিয়ার শাহাদাতবরণের মাধ্যমে জাতি হয়ে পড়ে অভিভাবকশুণ্য। নতুন করে সংকটের ঘূর্ণাবর্তে পতিত হয় বাংলাদেশ। কিন্তু জাতির সেই সংকটে আলোর দিশারি হয়ে আবির্ভূত হন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি জিয়ার রেখে যাওয়া বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ঝাণ্ডা হাতে তুলে নিলেন, জিয়ার বাতলে যাওয়া পথ ধরেই জাতিকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চললেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের পথে। স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে বেগম খালেদা জিয়ার সেই সংগ্রাম সাফল্যের মুখ দেখে ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারি এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গৃহবধু বেগম খালেদা জিয়া গণমানুষের নেত্রীতে পরিণত হলেন। এদেশের আপামর জনতা ভালবেসে তাকে ভূষিত করলো ‘আপসহীন নেত্রী’ উপাধিতে। কালক্রমে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এই মহীরূহ এদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতীকে পরিণত হলেন। মানুষের মাঝে তিনি ‘দেশনেত্রী’, ‘দেশমাতা’, ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ নামে খ্যাত হলেন। কিন্তু আধিপত্যবাদি শক্তির এদেশীয় দোসররা তাকে বারবারই আঘাত করেছে। আজ তিনি নব্য স্বৈরাচারের মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক প্রহসনের শিকার হয়ে কারাপ্রকোষ্ঠে বন্দি। আর তার সাথে সাথে বন্দি হয়ে গিয়েছে এদেশের মানুষের সার্বভৌম মর্যাদাও।  জাতীয় জীবনে পুনর্বার নেমে এসেছে এক ঘোরতর সংকট। মানুষের সর্বপ্রকারের মৌলিক অধিকারসমূহ আজ ভূলুণ্ঠিত। ভোটের অধিকারকে পদদলিত করে, নির্বাচনী ব্যবস্থাকে গুম করে দিয়ে জবরদখল করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছে আধিপত্যবাদি শক্তির এদেশীয় দোসররা।

কিন্তু জাতীয় জীবনে নেমে আসা এমন ঘোরতর অন্ধকারের মাঝে আবারো কাণ্ডারি হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন জিয়া পরিবারের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, দেশাত্ববোধ এবং দূর্বিনীত জাতীয়তাবাদী চেতনার উত্তরাধিকার বহনকারী জনাব তারেক রহমান। সুদূর লন্ডনে নির্বাসিত থেকেও তিনি দিবানিশি অক্লান্ত পরিশ্রম করে এদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাধনায় রত রয়েছেন। জনাব তারেক রহমান ১৯৮৯ সালে বগুড়া জেলা বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। কালক্রমে তিনি এদেশের গণতন্ত্রমনা মানুষের নির্ভরতার প্রতীক এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ দর্শনের ধারক ও বাহক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি-এর সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদ অলংকৃত করেছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের বৃহত্তম জনসমর্থনপুষ্ট এ দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।

জনাব তারেক রহমান ‘তারুণ্য ও তৃণমূল’-কে উপজীব্য করে তার রাজনৈতিক পথচলার শুরু করেন। বাংলাদেশের সমস্যা ও সম্ভাবনাকে জানার উদ্দেশ্যে তিনি মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন, প্রান্তিক মানুষের কথা শুনেছেন, সমস্যার স্বরূপ জেনেছেন, এবং সমাধানে করনীয় নির্ধারণ করে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। শহিদ জিয়া ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে উন্নয়ন এবং উৎপাদনের রাজনীতিতেই তিনি  আত্মনিয়োগ করেছেন। তারেক রহমানের ভিশনারি রাজনীতির অন্যতম এক দৃষ্টান্ত হচ্ছে ‘তৃণমূল প্রতিনিধি সম্মেলন’। ২০০২ সালে তৃণমূল পর্যন্ত শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শকে ছড়িয়ে দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে আগামী বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রাণশক্তিতে রূপান্তরের এক মহাযজ্ঞ নিয়ে তিনি বাংলাদেশের নানা প্রান্ত চষে বেড়ান। তিনি বিশ্বাস করেন, এদেশের তরুণ সমাজের কাছে দেশের সঠিক ইতিহাস, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বাংলাদেশবাদি রাজনীতির বার্তা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হলে একদিন এদের মাধ্যমেই বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে এক রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হবে। তার রাজনৈতিক ভাবনা ও কর্মসূচির মধ্যে জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে যা ব্যাপকতর ভূমিকা রাখছে তা হলো জাতীয় ঐক্য ও সংহতি। চিন্তাশীল, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন  জনাব তারেক রহমান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, একটি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদের অনল জ্বেলে দিয়ে কখনো শান্তি প্রতিষ্ঠা কিংবা উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন সর্বপর্যায়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। যারা যত বেশি ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে, তারা তত দ্রুত সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে। তাই সমবেত প্রচেষ্টার ধারণা থেকে তিনি আহবান জানালেন, ‘রাজনৈতিক মতপার্থক্য মঞ্চে থাকুক; মানুষের কল্যাণ ও উন্নয়নে নয়’।

তারেক রহমানের জন্ম একটি রাজনৈতিক পরিবারে। রাজনীতি তাই মিশে আছে তার রক্তের সাথে। তথাপি প্রকাশ্যে রাজনীতিতে আসার আগেই তিনি সামাজিক উন্নয়ন ও সেবামূলক কর্মকাণ্ডে নিজেকে যুক্ত করেন। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি ‘জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন’ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের আওতায় তিনি ‘কমল বীজ প্রকল্প’ ‘ছাগল পালন কর্মসূচি’, ‘অ্যাজমা কেয়ার এন্ড প্রিভেনশন সেন্টার’, ‘বৃত্তি প্রকল্প’, ‘বন্যা পুনর্বাসন কার্যক্রম’, ‘কমল পানি প্রকল্প’, ও ‘সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি’সহ বেশ কিছু কর্মসূচি ও প্রকল্প শুরু করেন। এ ছাড়া জাতীয় ও দলীয় বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন স্বাস্থ্য ক্যাম্প ও প্লাস্টিক সার্জারি ক্যাম্পের আয়োজন করে। ঐ হেলথ ক্যাম্পগুলোয় বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবাসহ ওষুধ বিতরণ করা হয়। বর্তমানে বিদেশে চিকিৎসারত অবস্থায় থেকেও জনাব তারেক রহমান দেশের মানুষের কল্যাণে তার কর্মযজ্ঞ অব্যহত রাখছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে রাজনৈতিক যোগাযোগের পাশাপাশি সামাজিক ও জনকল্যাণমুখী কর্মকাণ্ডে নিরন্তর উৎসাহ, অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন। করোনা মহামারির সময়গুলোতে ‘জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন’-এর উদ্যোগে ত্রাণ কার্যক্রম, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবাসামগ্রী, অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ বিভিন্ন সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। নতুন প্রজন্মকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উৎসাহী করণার্থে ‘বিজ্ঞান মেলা’- এর মত প্রতিযোগীতামূলক অনুষ্ঠান আয়োজনে উপস্থিত থেকে ক্ষুদে বিজ্ঞানীদেরকে উৎসাহ যোগাচ্ছেন। এছাড়াও গণতন্ত্রের সংগ্রামে আহত, নিহত ও গুম হয়ে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। এভাবেই জনাব তারেক রহমান রাজনীতিকে সেবায় পরিণত করেন। তার এই সেবামূলক রাজনৈতিক ভাবনা ও কর্মসূচি তাকে দেশব্যপী যতটা না রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত করেছে, তার চেয়ে বেশি পরিচিত করেছে সেবক হিসেবে।

কিন্তু তারেক রহমানের দেশপ্রেম, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান, অন্যের সেবাদাসে পরিণত না হওয়ার মানসিকতা এবং কল্যাণমুখী রাজনীতি আধিপত্যবাদি শক্তি ও তাদের এদেশীয় দোসরদের সহ্য হয় নি। জিয়া পরিবারের বাংলাদেশবাদি রাজনীতি তাদের জন্য মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের এই ধারাকে প্রতিহত করার জন্য তারা তাদের ষড়যন্ত্র অব্যহত রেখেছে। ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ ধারণার প্রবর্তক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যার পর তারা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি খড়গহস্ত হয়। তারা বারবার আঘাত করেছে দেশনেত্রীকে, মনোবলে চিড় ধরানোর চেষ্টা করেছে। রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে গিয়ে আঘাত করতে সচেষ্ট হয়েছে। অবশেষে প্রহসনের মামলায় তাকে কারারুদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছে। চক্রান্তকারীদের এবারের লক্ষ্য তারেক রহমান। তাকে লক্ষ্য করে তাই চলছে নানামুখী ষড়যন্ত্র। অবশ্য তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের এ উপাখ্যান নতুন নয়। কায়েমি স্বার্থবাদি বিদেশি প্রভু ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের আশীর্বাদপুষ্ট ১/১১- এর সেনাসমর্থিত, সাংবিধানিকভাবে অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নৃশংস প্রতিহিংসার শিকার হন তারেক রহমান। কোন প্রকার মামলা ছাড়াই ২০০৭ এর ৭ মার্চ তাকে গ্রেপ্তার করে যৌথবাহিনী। পর্যায়ক্রমে তারেক রহমানের নামে ১৩টি মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করার পাশাপাশি ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ডিটেনশনও দেয়া হয়। তাকে ৬ দফায় ১৩ দিনের রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি মানসিক নির্যাতনও চালানো হয়। চাপ প্রয়োগ করা হয় দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য, রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু তিনি দেশের কথা, দেশের জনগণের কথা ভেবে তাদের কোন প্রস্তাবেই রাজি হন নি। ক্রমাগত নির্যাতনে তার স্বাস্থ্যের আরো অবনতি হতে থাকলে তার নিঃশর্ত মুক্তি লাভ ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবিতে রাজপথে শুরু হয় উত্তাল আন্দোলন। টনক নড়ে ফ্যাসিবাদি সরকারের। তারা তারেক রহমানকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিতে রাজি হয়। কিন্তু আত্মপ্রত্যয়ী ও নির্ভীক তারেক রহমান নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে অনড় থাকেন এবং এক পর্যায়ে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান উন্নত চিকিৎসার জন্য। বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পান ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর।

এরপর থেকে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে জনাব তারেক রহমান লন্ডনে চিকিৎসারত রয়েছেন। তবে এ কারণে তার সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা আসেনি। তিনি দেশ থেকে অনেক দূরে থেকেও নিয়মিত দেশ ও দলের খোঁজখবর রাখছেন। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে তিনি সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ তৃণমূল নেতাকর্মীদের সাথে ভার্চুয়াল মিটিংয়ের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকছেন। কর্মবীর তারেক রহমানের এই কর্মোদ্দীপনা ঠেকাতে প্রতিপক্ষ শক্তি নানারকম অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। তারা নানারূপ মিথ্যা মামলা, প্রোপাগাণ্ডার মাধ্যমে তার অগ্রযাত্রাকে ব্যহত করতে চায়; তারা তাকে এদেশের জনগণ ও দলীয় নেতাকর্মীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। কিন্তু তার অফুরান প্রাণশক্তিকে রোধ করা যায় নি। সাম্প্রতিক করোনা মহামারীকালীন সময়ে তিনি ব্যক্তিগত ও দলীয়ভাবে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে থাকছেন। এছাড়াও দেশের নানা সংকটে সুদূর লন্ডন থেকেও তিনি ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হচ্ছেন। তারেক রহমান নিজে স্বপ্ন দেখেন এবং দেশবাসীকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন সকল জুলুমের অবসান ঘটিয়ে এক সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের। গণতন্ত্র হরণকারি শক্তির হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার এক দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে তার মাঝে। তাই তো তার কণ্ঠে আমরা দৃঢ় উচ্চারণ শুনি, ‘Take back Bangladesh’।

তারুণ্য আর তৃণমূলকে উপজীব্য করে যে রাজনীতির সূচনা করেছেন তারেক রহমান, সেটা ধ্বংস হবার নয়। কোন অর্বাচীন শক্তির নীল চোখ তাকে রুদ্ধ করতে পারে নি, কোন অপলাপ তার জনপ্রিয়তায় বাঁধ সাধতে পারে নি। তিনি আছেন, থাকবেন; উজ্জ্বল, দেদীপ্যমান, স্বমহিমায় ভাস্বর; লক্ষ-কোটি জাতীয়তাবাদী মনে সাহসের বাতিঘর হয়ে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বরপুত্র তারেক রহমান আসবেন। সকল অনিশ্চয়তা, কণ্টকাকীর্ণ, বন্ধুর পথের গতিরোধক ভেঙে তিনি আবার মঞ্চে ফিরবেন; এই চিরসবুজ বাংলার প্রান্তরসমূহ আবারো তার পদধ্বনিতে মুখরিত হবেই! সব অন্ধকার, সব কলুষতা, সমস্ত মলীনতার অবসান হবেই।  

 

—  লেখক শিক্ষক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রশিক্ষণ বিষয়ক সহসম্পাদক, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। 


তারেক রহমান হয়ে উঠেছেন জনগণের ঐক্যের প্রতীক

আসাদুল করিম শাহীন

দেশনায়ক তারেক রহমান 


তারেক রহমান বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ব্যক্তিত্বের নাম। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। উন্নয়ন সমৃদ্ধি ও জাতীয়তাবাদী শক্তির ‘সোনালি ফিনিক্স’ তিনি। অনুকরণ ও অনুসরণীয় এক মহান নেতা। জনসাধারণের আশা আকাঙ্ক্ষার মূর্তপ্রতীক আগামী বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক। আমার এই প্রিয়নেতার শুভ জন্মদিনে তাঁর প্রতি জানাচ্ছি প্রাণঢালা অভিনন্দন এবং সংগ্রামী শুভেচ্ছা।

বাংলাদেশের রাজনীতির এক চরম সংকটময় সন্ধিক্ষণে প্রিয়নেতার জন্মদিন। তাঁর জন্মদিন আমাদের কাছে আন্দোলনের নতুন বার্তা নিয়ে এসেছে। চারিদিকে অস্থির রাজনৈতিক শুন্যতা বিরাজ করছে। কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠী এবং আমাদের দেশের শত্রুরা তৎপর হয়ে উঠেছে। নবরূপী বাকশালী কুচক্রী মহল নতুন নতুন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গুম-হত্যা ও নিপীড়ন চালিয়ে সারাদেশের মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করেছে ব্যাপক আতঙ্ক। একটি অনিশ্চিত গন্তব্যের কালো অধ্যায় নিয়ে এ দেশের মানুষ অস্থির চিত্তে পরিবর্তনের অপেক্ষায়। গ্রাম গঞ্জে সর্বত্র জনমনে প্রশ্ন কবে হবে একটি জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আধিপত্যবাদী বিদেশী আগ্রাসী শক্তির ছত্রছায়ায় অবৈধ পুতুল সরকারের বিদায় ঘন্টা বাজিয়ে কবে প্রতিষ্ঠিত হবে জনপ্রত্যাশিত সেই জাতীয়তাবাদী সরকার — যার নেতৃত্ব দেবেন জননেতা তারেক রহমান। সবার দৃষ্টি এখন ভয়ঙ্কর এই পরিস্থিতিতে দেশনায়ক তারেক রহমানের দিকে। কী হবে তাঁর কর্মসূচি, দেশের ১৮ কোটি মানুষ গভীর আগ্রহ ও প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। দেশ ও জাতিকে অশুভ নির্যাতনকারী অবৈধ সরকারের হাত থেকে তিনি রক্ষা করবেন। জনগণের এমন অনিশ্চিত সময়ে রাজপথের সংগ্রামের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী লুটেরা অপশক্তি পরাজিত হবে আর তার নেতৃত্ব দেবেন দেশের অভিজ্ঞ তারুন্যের আলোয় দীপ্ত তারেক রহমান।

জনাব তারেক রহমান-এর প্রতি জনপ্রত্যাশা আকাশচুম্বি। তাঁর নেতৃত্বের দৃঢ়তার কারণে বিএনপি’র কর্মী-সমর্থক ও সাধারণ মহলে তাঁর প্রতি আস্থা-বিশ্বাস হতবাক করার মতো। প্রিয় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অনুপস্থিতিতে জনাব তারেক রহমান দৃঢ় হাতে বিএনপি’র হাল ধরেন। নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করেন। দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা ষড়যন্ত্রকারী বিশৃঙ্খলাকারীদের দল থেকে বহিষ্কারেও তিনি দ্বিধা করেন না। ইতোমধ্যে, আগামীদিনের দেশনায়ক তারেক রহমান হয়ে উঠেছেন জনগণের ঐক্যের প্রতীক। স্মর্তব্য দলের অতীতের সকল দুর্দিনে দলের ছাত্র-যুব তথা সবাইকে তিনি সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। অতীত নির্বাচনে ও সংগ্রামে তিনি ছিলেন রাজপথের সেনানায়ক।

জনআকাংক্ষা ধারণ ও বাস্তবায়নই হচ্ছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রধান কর্তব্য। রাজনীতি পরিবর্তনশীল। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বর্তমানের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়। জনাব তারেক রহমানের রাজনৈতিক দর্শন ও অবস্থান পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হবে যে, নৈতিকতা ও জনকল্যাণের চেতনাকে ধারণ করে বর্তমানের সঙ্গে তিনি নিপুণভাবে মানিয়ে নিয়েছেন। নিজেকে পর্যায়ক্রমে তৈরি ও বিকাশিত করেছেন। দল পরিচালনায় রেখেছেন পারঙ্গমতার সাক্ষর। নিঃসন্দেহে জনাব তারেক রহমান বর্তমান বাংলাদেশের পজেটিভ রাজনীতির প্রধান চরিত্র, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রূপকার এবং নিরলস কর্মী।

সমাজ জীবনের আশা-আকাংক্ষা এবং বাংলাদেশের গণমানুষের হৃদয়ে গণতন্ত্রের স্বপ্ন ছড়িয়ে, তারেক রহমান রাজনৈতিক পরিমন্ডলে মাথা উঁচু করে আছেন এক বিরাট বটবৃক্ষের মত। দেশের জন্য, দেশের মাটি ও মানুষের জন্যে যেমন তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা, দেশের জনগণের মনেও তেমনি তাঁর প্রতি অপরিসীম ভালবাসা ও শ্রদ্ধা। জনগণের আকাংক্ষা ধারণ করাই হলো রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রধান দায়িত্ব। জনগণের চাহিদা মতো কর্মসূচিই হলো রাজনৈতিক কর্মসূচি। জনগণের স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ করে তাদের মধ্যে বলিষ্ঠ জীবনবোধের উন্মেষ সৃষ্টিই হলো রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য। রাজনীতির বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে তারেক রহমানের পদক্ষেপ সঠিক এবং সঠিক বলেই তাঁর উচ্চারণ আজ জনগণের সুস্পষ্ট উচ্চারণ জনগণের আশা-আকাংক্ষা মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে।

কঠিন দুঃসময়ে তারেক রহমান রাজনীতিতে আগমন করেন, তাঁর সেই আগমন ছিল রাজনীতির বদ্ধঘরে খোলা জানালার মত, যে জানালা দিয়ে রাজনীতির বদ্ধঘরে ঢুকতে পেরেছিল একমুঠো মিষ্টি সুবাতাস। রাজনীতিতে তারেক রহমানের আগমনে তখনকার ছাত্র-যুবক-শ্রমিক তথা সকল তরুণ কর্মীদের মাঝে উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল, জাতীয়তাবাদী আদর্শের  সৈনিকেরা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতিচ্ছবি দেখেছিলেন তাঁর মধ্যে। কর্মে-কথায়-আচরণে তৃণমূলের নেতাকর্মী, সাধারণ মানুষের মনে আশা-ভালবাসার সঞ্চার করেছিলেন তিনি। যে ভালবাসা এখনও অটুট অম্লান রয়েছে। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর গোলাম আলী ফকির তাঁকে মূল্যায়ন করেছেন এই ভাবে—

“ঐক্যবদ্ধ অগ্রগতির অমোঘ দাবি উৎপাদনের রাজনীতি এবং জনগণের গণতন্ত্র। এই কর্মসূচি নিয়ে একদিন গ্রামের পর গ্রামে ছুটে গেছেন বাংলাদেশের সফল রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান। তারই প্রদর্শিত পথে পা রাখলেন তারেক রহমান এবং গণমানুষের প্রাণের ছোঁয়া পেয়ে তিনিও উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন। সেই থেকে তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেন তারেক রহমান। সাধারণ মানুষের সমস্যার কথা সরাসরি শোনা এবং সমাধানের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে এক নতুন ইতিহাস গড়ে তুলতে তৎপর হন। তারেক রহমান নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধকে ফিরিয়ে আনতে এক অনন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাঝে গড়ে তোলেন ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। এক একটি সাধারণ হাত হয়ে ওঠে তখন কর্মীর হাতিয়ার।”

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে যোগ্য মেধাবী দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা তারেক রহমান। ১৯৮৮ সালে নিজ জেলা বগুড়ার গাবতলী থানা বিএনপি’র একজন সাধারণ সদস্য হিসাবে তাঁর আনুষ্ঠানিক রাজনীতি শুরু। যদিও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী হিসাবে, কখনও বা পরামর্শদাতা হিসেবে মাঝে মাঝে তাঁকে দেখা যেত। তিনি আগে বিএনপি পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এছাড়া ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিশেষ অবদান রাখেন দেশবরেণ্য এই তরুণ নেতা। ১৯৮২ সনের ২৪ মার্চ স্বৈরাচার হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ নির্বাচিত বিএনপি সরকারকে বন্দুকের নলে উৎখাত করে ক্ষমতার মসনদে বসেন, বিএনপি’র সেই চরম ক্রান্তিকালে আপোসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিএনপি’র হাল ধরেন। বিএনপি’র অনেক নেতাই সেদিন বিএনপি ত্যাগ করে ক্ষুদ্র ব্যক্তি স্বার্থে জেনারেল এরশাদের অবৈধ সরকারে যোগ দেয়। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এবং জাতীয়তাবাদী যুবদলকে সাথে নিয়ে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, অগ্নিঝরা দুঃসময়ে স্বৈরাচার বিরোধী শাসনের বিরুদ্ধে মহাসংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। সেই কঠিন সময়ে সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ তারেক রহমান ছাত্রাবস্থায় তাঁর মা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পাশে থেকে বিএনপি পুনর্নির্মাণে অনেক সহযোগিতা করেন, যা বিএনপি’র ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

জাতীয়তাবাদী শক্তিকে গতিশীল করার জন্য তাঁর রাজনীতিতে আবির্ভাব। তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে বুকের গভীরে লালন করেন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। আব্রাহাম লিঙ্কন এর প্রদর্শিত গণতন্ত্রই তাঁর প্রথম পছন্দ, “জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের শাসন, যা কখনো পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবে না। তাঁর স্বপ্ন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তিনি শুরুতেই ছুটে গিয়েছেন সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়। পথে প্রান্তরে হেঁটে বেরিয়েছেন তিনি। এই আদর্শ অনুপ্রেরণা তিনি লাভ করেছেন তাঁর পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীরউত্তম -এর কাছ থেকে। পিতার আদর্শ ও কর্মসূচি হৃদয়ে ধারণ করে দেশপ্রেমের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে সত্য-ন্যায় ও কল্যাণের পথে এগিয়ে যাবার প্রত্যয় নিয়েছেন আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা তারেক রহমান। তিনি রাজনীতিতে আসার আগে ও পরে একাধিকবার উল্লেখ করেছেন, তাঁর পিতাই তাঁর শিক্ষক। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদৎবরণের কিছু পরে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘আমার শিক্ষক’ শিরোনামে, তাতে তাঁর পিতার সাথে কিছু স্মৃতির উল্লেখ করেছেন। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, “১৯৮১ সালের ৩০ মে বহুবার এসেছে জীবনে। যতদিন বেঁচে থাকব ঘুরে ঘুরে প্রতিবছর দিনটি আসবে। কিন্তু আমরা তো কখনও ১৯৮১ সালের ২৯ মে’তে ফিরে যেতে পারবো না। ৩০ মে’র পর যখন দেখলাম লাখ লাখ মানুষ চোখের পানি নিয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে একটি কফিনের পেছনে দাঁড়িয়ে তাদের নেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন, তখন শুধু এইটুকুই মনে হয়েছিল, একটি মানুষ কিভাবে এত লাখো কোটি মানুষকে আপন করে নিতে পারেন, কেমন করে পারেন কোটি মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই নিতে। সেই লাখো কোটি মানুষের প্রিয় জিয়াউর রহমানের সন্তান আমি, এটি মনে হলে বাবাকে হারানোর ব্যথা একটু হলেও লাঘব হয়। যখন মনে পড়ে, লাখ লাখ লোক জানাজায় এবং রেডিও-টিভির সামনে বসে কোটি কোটি মানুষ আল্লাহর দরবারে তাদের প্রিয় মানুষটির জন্য দোয়া করছে, তখন পিতার মৃত্যুর বেদনা অল্প হলেও প্রশমিত হয়।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ স্মৃতিকথায় লিখেছেন— “আমি তারেককে ভালবাসি। তারেক রহমানকে আমি দেখি একজন শিক্ষকের দৃষ্টি দিয়ে। ভাল ছেলে। বিনয়ী, সদাশয়, মৃদুভাষী। নন্দিত জাতীয় নেতা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। নেতা-নেত্রীর কাতারে বুদ্ধিদীপ্ত অগ্রগামী তারুণ্যের প্রতীক। দীর্ঘজীবী হোক এই কামনা প্রতি মুহূর্তের। তাঁকে চিনি দীর্ঘদিন ধরে। কোন আলোচনা সভা বা সেমিনার নয় বরং ঘরোয়া পরিবেশে। সুশীল তরুণ হিসাবে। তাঁর বক্তব্য ঋজু। চিন্তা-ভাবনা সুস্পষ্ট। কৃত্রিমতা এখনো তাকে স্পর্শ করেনি। স্পর্শ করেনি দুর্বুদ্ধিপ্রসূত কোন জটিলতা।”

বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির মানসপুত্র তারেক রহমান। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন সকাল সৃষ্টির জন্য তাঁর আগমন। তারেক রহমান এবং দেশের সকল জাতীয়তাবাদী শক্তির চাওয়া নির্বাচন কেন্দ্রিক বহুদলীয় গণতন্ত্র। আজ বাংলাদেশে গণতন্ত্র অবরুদ্ধ। দেশে চলছে একদলীয় ফ্যাসিবাদী শাসন। এই ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন থেকে আমরা মুক্ত হতে চাই। তারুণ্যের প্রতীক বুদ্ধিদীপ্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তারেক রহমান আমাদের মুক্ত করবেন, নতুন আলোর পথ দেখাবেন। বাংলাদেশের ধ্বংসপ্রাপ্ত গণতন্ত্রের ভগ্নস্তুপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো তাঁর উত্থান হোক জন্মদিনে এই প্রবল প্রত্যাশা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী আপামর মানুষের।

জননেতা তারেক রহমানের মতে, একটি জাতি ও দেশের মূল স্রোতধারা হচ্ছে জাতীয়তাবাদী চেতনা সম্পন্ন জনসম্পষ্টি। তিনি মনে করেন  অন্যায়, অবিচার, শোষণের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর জন্য যারা গণতান্ত্রিক ইনস্টিটিউশনগুলোকে জোরদার করার পক্ষে, পুঁজি ও প্রযুক্তির স্বাধীন বিকাশ ও অর্থনৈতিক মুক্তির পক্ষে, যারা নতজানু পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তে স্বাধীন জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাসী, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখবেন, যারা ন্যায়বিচার ভিত্তিক শোষণমুক্ত সমাজ কায়েমের লক্ষ্যে লড়াই করবেন, মাটি ও মানুষকে নিয়ে যাদের রাজনীতি আমাদের চোখে তারাই জাতীয়তাবাদী শক্তি।

দেশের এই চরম ক্রান্তিলগ্নে সব দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে সব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকে পরাস্ত করে জাতীয় স্বাধীনতা ও সর্বভৌমত্বের পক্ষে, জনগণের গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করাই জাতীয়তাবাদী শক্তির কর্তব্য। দেশ ও জাতির এই দুর্দিনে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে জাতিকে সব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের নাগপাশ থেকে উদ্ধার করে মুক্তির সাধ দিতে হবে, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান ও আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে জাতীয়তাবাদী শক্তির দৃঢ় ঐক্য বিশেষভাবে প্রয়োজনীয় মনে করেন দেশনায়ক তারেক রহমান। তিনি অনুভব করেন, আমরা আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখার এবং আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ার স্বপক্ষের শক্তিই জাতীয়তাবাদী শক্তি। এই শক্তি ছড়িয়ে আছে আমাদের চেতনায় ও সকল প্রেরণায়।

জননেতা তারেক রহমান বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে, তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন “সকল ধর্মের মানুষ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠিসহ সকল ধর্ম, বর্ণ, সকল মানুষের চিন্তা-চেতনা এবং আশা আকাংক্ষা ধারণ করে একটি অংশীদারিত্বমূলক সামাজিক ও অর্থনৈতিক, ন্যায়বিচার সম্পন্ন, জনকল্যাণমূলক, সহিষ্ণু, মানবিক, শান্তিকামী ও সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন তাঁর দলের লক্ষ্য। তিনি বলেছেন, বিএনপি বিশ্বাস করে, জনগণ সকল উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু এবং জনগণই সকল ক্ষমতার মালিক। বিএনপি জনগণের শ্রম, উদ্যোগ, উৎসাহ এবং আগ্রহের পথের সকল বাধা প্রতিবন্ধকতা দূর করে বাংলাদেশকে একটি সুখী, সমৃদ্ধ, আধুনিক এবং আত্মমর্যদাশীল জাতিতে পরিণত করার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাবে। তিনি বলেন, বহুধা বিভক্ত জাতীয় জনসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে সকল মতাদর্শের ঐকতান রচনা করে পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে জাতীয় পর্যায়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার এক উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করতে। তিনি এ-ও বলেন, বাংলাদেশ থেকে গণতন্ত্র এখন নাই হয়ে গেছে। বাংলাদেশের জনগণ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল সে রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের হাতে এখন আর নেই।

দেশনায়ক তারেক রহমান সভা সেমিনারে তাঁর ভবিষ্যৎ নানামুখি পরিকল্পনার বিষয় তুলে ধরেন। তাঁর লক্ষ্য ভবিষ্যতে বাংলাদেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি সহ অর্থনীতির আমূল সংস্কার এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে সকল মানুষকে শিক্ষিত করে তোলা। তাঁর মতে, শিক্ষাসহ সকল শিক্ষা হওয়া উচিত জীবনমুখি। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় ব্যাপক উন্নয়নে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা। সাম্প্রতিক এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, “আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, হারানো গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য আমি দেশপ্রেমিক সকল ব্যক্তি, গ্রুপ ও দল তথা জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই। আমাদের সকলের লৌহদৃঢ় ঐক্য ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে অবৈধ, তাঁবেদার সরকারকে হটিয়ে একটি নির্বাচিত জনগণের পছন্দের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।” জননেতা তারেক রহমানের শুভ জন্মদিনে আমাদের প্রত্যয় হোক— একটি কাঙ্খিত পরিবর্তনের জন্য, আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য, একটি নতুন স্বপ্ন বির্নিমানের জন্য। আমরা ফিরে পেতে চাই হারানো গণতন্ত্র, আমরা গণমানুষের নেতা আধুনিক গণতন্ত্রের প্রবক্তা জননেতা তারেক রহমানের নির্দেশিত পথে এগিয়ে যেতে চাই। বাংলাদেশ- জিন্দাবাদ, শহীদ জিয়া অমর হোক, বেগম খালেদা জিয়া জিন্দাবাদ, তারেক রহমান জিন্দাবাদ।

লেখক সহপ্রচার সম্পাদক, বিএনপি। 


Thursday, November 11, 2021

গণতন্ত্র মুক্তি পাক

—  মোঃ মিজানুর রহমান

১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মহান স্বাধীনতার ঘোষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম স্বপদে ফিরে যান। ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানী পার্সপোট ব্যবহার করে লন্ডন ও ভারত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং একদিন পর ১২ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর দুর্নীতি, লুটপাটের ফলে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এরই মাঝে দেখা যায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ গণপরিষদ (বর্তমান জাতীয় সংসদ)-এ এই সংবিধান গৃহীত হয় ও একই বছর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সংবিধান কার্যকর হয় এবং সংবিধান কার্যকরের দুই বছর একমাস দশদিনের মধ্যেই শেখ মুজিবুর রহমান এর শাসনামলেই সংবিধান চারবার সংশোধন করে, এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক দলকে বিলুপ্ত করে একদলীয় ‘বাকশাল’ শাসন কায়েম করেন শেখ মুজিবুর রহমান-ই এবং আওয়ামী লীগ নেতারা হয়ে যান বাকশাল এর নেতা। সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী ছিল-‘সংসদীয় শাসন পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন পদ্ধতি চালু এবং বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় রাজনীতির  প্রবর্তন ও বাকশাল গঠন’। এটি ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদে উত্থাপিত হয়; ঐ একই দিন পাস হয় এবং ঐ দিনই রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দেন। 

দুর্নীতি, লুটপাট, ক্ষুধা-দারিদ্র্র্য তথা দুর্ভিক্ষ আর সংবিধানের কাটা-ছেঁড়ায় একদলীয় বাকশাল শাসনের ফলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অস্থিরতা দেখা যায়। সেই সাথে এসব খবর যেনো প্রকাশ না পায় সেজন্য সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি পত্রিকা-দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, The Bangladesh Observer, The Bangladesh Times, বাদে দেশের সব পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয় ঐ একই বছর ১৬ জুন। স্বাধীন দেশে যেনো স্বাধীনভাবে রাজনীতি করা বন্ধ, সংবাদপত্রে লেখা বন্ধ। ফলে অস্থিতিশীলতা ও অস্থিরতাই শুধু নয় যেনো মাৎসনালয়ের রূপ ধারণ হয়েছিল। এমন অরাজকতার মাঝেই শেখ মুজিবুর রহমান পরিবার-(দুইমেয়ে ছাড়া) পরিজনসহ নিহত হন ঐ একই বছর ১৫ আগস্ট এবং ক্ষমতা নেন শেখ মুজিবুর রহমান’রই রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠ সহচর খন্দকার মোশতাক; ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই খন্দকার মোশতাক ঐ বছরই ২৬ সেপ্টেম্বর ‘ইনডেমনিটি’ অধ্যাদেশ জারি করেন। ক্ষমতার জন্য মাথাচড়া দিয়ে উঠেন খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল তাহেরও প্রভাব খাটাতে থাকেন। খালেদ মোশাররফ তেসরা নভেম্বর  মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম-কে শহীদ মইনুল রোডের ৬ নং বাড়ীতে বন্দি করে কর্তৃত্ববাদি হয়ে উঠেন। সেনাসদস্যসহ দেশের সকল শ্রেণী পেশার মানুষের মাঝে অসন্তোষ বেড়ে যেতে লাগলো। এমন অবস্থায় দেশজনতা ও সিপাহী সেনারা ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত হয়ে স্লোগানে স্লোগানে সঠিক নেতৃত্বের জন্য মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তমকে মুক্ত করে আনেন ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর এবং ক্ষমতার সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেন। ৭ই নভেম্বর হলো ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’।  




শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, কৃষি, শিল্প-কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, কারিগরি, বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, আর্ন্তজাতিক বিভিন্ন বিষয়ারলী ইত্যাদি অথাৎ স্বাধীন দেশ ও জাতিকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র অপবাদ থেকে আত্মনির্ভরশীল জাতিতে পরিণত করতে- এমন কোন খাত নেই যে অল্প সময়ের মধ্যেই সেখানে তিনি কাজ করেননি। শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম এর রেখে যাওয়া সে বাংলাদেশকে স্বৈরশাসন ও স্বৈরাশাসকের বিরুদ্ধে আপসহীন থেকে মুক্ত করেন তারই সহধর্মিনী বধূ থেকে রাজনীতিতে আসা গণতন্ত্রের মাতা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া-যিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। তিনি জিয়াউর রহমান এর উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখেন এবং নারীশিক্ষা, যুব উন্নয়ন, বিধবা ও বয়স্কভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, আইন করে সারাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, শিক্ষাক্ষেত্রে উপবৃত্তি, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়ন, সংসদীয় গণতন্ত্র পদ্ধতি চালু, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় চালু, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে কম্পিউটার শিক্ষা কোর্স চালু, সরকারী চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ থেকে ৩০ বছরে উন্নীত করণ, ‘শিক্ষার জন্য খাদ্য’ কর্মসূচির প্রচলন, দেশে সর্বপ্রথম কার্ড ফোন চালু, সেলুলার ফোন-আইএসডি ফোন চালু, ‘দুস্থ মহিলাদের ঋণদান’ কর্মসূচি চালু, অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারীদের মৃত্যু হলে প্রথম বারের মতো তাদের স্ত্রী ও প্রতিবন্দী সন্তানদের জন্য আজীবন পেনশনের ব্যবস্থা করণ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন, মানুষের ভোটের অধিকার তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা, উপকূলীয় এলাকায় কোস্টগার্ড প্রতিষ্ঠা করণ, মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা ইত্যাদি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত করেন। 

গণতন্ত্রের মা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা ছাড়েন ২৮ অক্টোবর, ২০০৬ সালে। তারপর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ১/১১’র চক্রান্তমূলক সরকার নিয়ে আসেন-যা ছিল তাদেরই ফসল ও অসাংবিধানিক। ১/১১’র চক্রান্তমূলক সরকার সংবিধান লংঘন করে দুই বছর ক্ষমতায় থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসান। ক্ষমতায় বসেই সরকার প্রধানের সুপ্ত মনের গুপ্ত লালসা উন্মোচিত হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার [৩০ জুন, ২০১১] বাতিলের মাধ্যমে। তার আগে গণতন্ত্রের মা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে প্রথমে শহীদ মইনুল রোডের বহু স্মৃতিজড়িত বাড়ী থেকে উচ্ছেদ করেন ১৩ নভেম্বর, ২০১০।  ক্ষমতায় থেকেই ৫ই জানুয়ারী, ২০১৪ জবর-দখল নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকেন আওয়ামী লীগ। তারপর প্রহসনের রায়ে সাজা দিয়ে গণতন্ত্রের মা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কারাবন্ধী করে রেখে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর মধ্যরাতের ভোট ডাকাতির নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকেন। এসব কাজে প্রশাসনিক অনিয়মতান্ত্রিক সহযোগিতা পুরোটাই ভোগ করেন আওয়ামী লীগ। এসব ভোটের চিত্র এমনিই ছিল যে মোট ভোটের চেয়ে প্রাপ্ত ভোটের পরিমান বেশী। মৃত মানুষের ভোটও অবৈধভাবে দেয়া হয় ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় থাকার অভিলিপ্সায়। কেন্দ্রে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীনরা ত্রাস সৃষ্টি করে যেনো বিরোধী দলের কেউ ভোট দিতে না পারে। বিরোধী দলের এজেন্টদের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না; এমনকি তুলে নিয়ে গিয়ে অন্য জায়গায় রাখা হয়। জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস হলেও জনগণ এই আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিজেদের ভোট নিজেরা দিতে পারেন না। ফলে গণতন্ত্রেরর নামে একক কর্তৃত্ববাদ স্বৈরাশাসন চলমান। এমন শাসনের ফলেই দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করে আওয়ামী সৈন্যরা। নারায়ণগঞ্জে সাত খুন করেন ক্ষমতাসীনদের লালিত-পালিত বাহিনী। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হতে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। শেয়ার বাজারের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া, হলমার্কের টাকা, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বছরে বছরে বাজেট বাড়িয়ে টাকা ক্ষমতাসীনরা নিজেদের পকেটে ভরান। ক্যাসিনোর মহানায়ক লীগ নেতারা। শাহেদ-পাপিয়াদের হোতা তারা? কিছু দিন পর পর তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ এর দাম বাড়ানোয় টাকাগুলো যায় ক্ষমাসীনদের পকেটে। বালিশকাণ্ড-পর্দাকাণ্ড মাধ্যমে দুর্নীতির যেনো মহোৎসব চলছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পরীক্ষার পূর্বে প্রশ্ন আউট যেনো রীতি; এমনকি ২য় শ্রেণীর পরীক্ষারও প্রশ্ন আউট হয়। আর এখন একদিকে এ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয় অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাথে সাথে উত্তর পাওয়া যায়। এই সরকারের সময় জেনারেশনটা মেধায় পিছনে রয়ে গেলো। বিশ্ব জ্ঞান সূচকে বায়লাদেশের অবস্থান ১৩৮ টি দেশের মধ্যে ১১২ তম। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তো আরো বিপর্যয়। ঘরে ঘরে টিভিতে ভারতীয় সিরিয়ালের তামাশা। সিনেমা হলের বেহাল দশা। দেশীয় হলে কলকাতার সিনেমা চালানো এখন তো একপ্রকার রীতি। আমাদের সংস্কৃতিকে ওরা কালো মেঘ হয়ে ঘিরে ধরেছে। ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় থাকতে ও বিরোধীদল দমনে ব্যস্ত-ঐদিকে খেয়াল নেই না-কি শুভংকরের ফাঁকি। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি মারাত্মক বিপর্যয়ে এবং ইউএনডিপি আর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে বাংলাদেশর অবস্থান ১৩৫। চলতি বছরের অক্টোবরেই ধর্ষণের শিকার শিশুসহ ১০০ জন [সূত্রঃ ০৩ নভেম্বর, ২০২১ দিনকাল]। সেই সাথে লুটপাট, দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি চলমান। করোনা মহামারীতে ঘরে ঘরে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই লাজুক। তার উপর নিত্যপণ্যের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। জীবন যাপনে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। লেখক, গবেষক, শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সুশীল, জনগণ কেউ কিছু বলতে বা লেখতে পারেন না। কেননা, ক্ষমতাসীনরা তাদের তৈরী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কালা-কানুনতে নিপীড়ন, নির্যাতন, জেল-জুলুম করে দাবিয়ে রাখেন। 

এই যখন দেশের অবস্থা তখন জনগণের ভাবনায় গ্রোথিত যে  সংকটকালীন সময়ে দেশ-বিদেশের সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে ’৭১ এর ২৬ মার্চ, ’৭৫ এর ৭ নভেম্বর যে বীর দেশ ও জাতিকে রক্ষা করে সঠিক পরিচয় দিয়ে এবং সঠিক নির্দেশনায় স্বনির্ভর আর উন্নতির দরজা দেখিয়ে;  আত্মনির্ভরশীল করে দেশ-জাতিকে নিয়ে গেছেন এগিয়ে। তার এগিয়ে নেয়া দেশকে শিক্ষাক্ষেত্রে জাগরণ ঘটিয়ে সার্বিকভাবে ইমার্জিং টাইগারে পরিণত করেছেন তার সহধর্মিনী দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের মাতা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তাদেরই যোগ্যতম উত্তরসূরি তারুণ্যের অহংকার দেশনায়ক তারেক রহমান-ই পারবেন দেশের এই আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংকটকে বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল দিয়ে মোকাবেলা করে একক কর্তৃত্ববাদের ফ্যাসিবাদ থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে এবং নিয়ন্ত্রিত চাপ উপেক্ষা করে সময়ান্তে সেই যোগ্য উত্তরসূরির পতাকার তলে জনগণ একাত্মতা হয়ে দুঃশাসনের বেড়াজাল ছিন্ন-বিছিন্ন করে দিয়ে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে। তাই আজ ধ্বণিতেছে এক সুর- “৭ নভেম্বরের প্রেরণায়-জাগ্রত হোক জনতা,  সময়োপযুক্ত সঠিক দিক-নির্দেশনায় তারুণ্যের অহংকার জাতীয়তাবাদী নেতা। দুঃশাসন ছিন্ন করে হোক মানবাধিকার আর ভোটের নিশ্চয়তা এবং নিঃশর্ত মুক্তি পাক গণতন্ত্র।”

  • লেখক সাংবাদিক ও কলামিস্ট  


Sunday, November 7, 2021

৭ নভেম্বর: জাতি গঠনের মহান স্মারক

ড. মাহবুব উল্লাহ 



১৯৭৫’র ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অনন্য দিন। এই দিনে সিপাহী জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থান বাংলাদেশকে ঘিরে আধিপত্যবাদের ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দেয়। এই দিবসটি এদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রতি বছর এই দিবসটি আমাদের নতুন করে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করে। দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণতার ফলে কখনো কখনো এই দিবসটি রাষ্ট্রীয় মর্যাদালাভে ব্যর্থ হয়। আবার কখনো কখনো যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে।

জাতি গঠনের পথ আকাবাঁকা রেখার মতো এগিয়ে চলে। কোন জাতির ইতিহাসই সরল রেখার মতো একমুখী হয় না। জাতি গঠনের পরম লক্ষ্য হল সমগ্র জাতিসত্তার ঐক্য ও সংহতি অর্জন। এই ঐক্য ও সংহতি অর্জনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে অনেক চড়াই-উৎরাই। পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা অতিক্রম করেই একটি জাতি গ্রানাইট পাথরের মতো মজবুত দৃঢ়তা অর্জন করে। মাঝখানের চড়াই-উৎরাইগুলো অনেক অশ্রু এবং রক্ত ঝরানো হলেও শেষ পর্যন্ত জাতীয় ঐক্য ও সংহতিকে অধিষ্ঠানের শিখরে প্রস্থাপিত করে। সমকালীন বিশ্বে মার্কিন জাতির জাতি হিসেবে গড়ে ওঠা এক চমকপ্রদ ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা বর্ণের নানা দেশের অভিবাসীদের নিয়ে গঠিত হয়েছে। ধর্মীয় বৈচিত্র্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণাঢ্যরূপে বিরাজমান। অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গের মধ্যে  বর্ণবৈষম্য জাতিসত্তাকে খন্ডিত করে রেখেছিল। মার্কিন জাতির এই খন্ড বিখন্ড অবস্থা আজ আর  নেই বললেই চলে। এ কারণেই বলা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হল melting pot of history। কিছু কিছু ক্ষুদ্র বিচ্যুতিকে পেছনে ফেলে রেখে মার্কিনীরা গর্ব করে বলে ‘গ্রেট আমেরিকান নেশন’। এরই অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ইতিহাসের এই মহান অর্জনের পথ দুর্ভাগ্যক্রমে পিচ্ছিল হয়েছিল গৃহযুদ্ধের রক্তপাতে। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের নাগরিক অধিকার অর্জনের জন্য মিছিলে, সমাবেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুখর হয়েছিল গত শতাব্দীর ৬০’র দশকে। মহান কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র  ‘I have a dream’ বলে সাদা ও কালো মানুষের বিভেদ দূর করতে শেষ পর্যন্ত আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন। মার্কিন জাতি গঠনে এগুলো ছিল বেদনাদায়ক অধ্যায়। আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনীতি, সমরশক্তি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে পৃথিবীর সেরা দেশ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আচরণ অনেক সময় অগ্রহণযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও নিজ দেশে মার্কিনীরা টেকসই প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়ে এবং সেগুলোকে কার্যকর করে দেশের ভেতরে এক সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণই আমাদের বলে দেয় ভাষা, বর্ণ, ধর্ম এবং জাতিসত্তার উত্তরাধিকারকে অতিক্রম করে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীও শেষ পর্যন্ত জাতিতে পরিণত হতে পারে, যদি তারা সম্মিলিতভাবে অনুভব করে তাদের সত্তা এক ও অভিন্ন রূপ পেয়েছে।

১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব। বীরের রক্তের স্রোত এবং মায়ের অশ্রুধারার মধ্য দিয়ে যে জাতি এবং যে রাষ্ট্রের উত্থান, তার ফলে আমরা ধরে নিয়েছিলাম আমাদের জাতি গঠনের কাজটি সমাপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু রাষ্ট্র হিসাবে উদ্ভবের পর আমরা দেখেছি আমাদের বিপদের বন্ধু হিসেবে যারা হাত বাড়িয়েছিল তারা সে কাজটি নিছক পরার্থপরতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে করেনি। সম্ভবত এই অভিজ্ঞতা পৃথিবীর অনেক জাতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। গণতন্ত্র ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা। গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের মহাসড়কে। কিন্তু সেই গণতন্ত্র স্বাধীনতার ৩ বছরের মাথায় মুখ থুবড়ে পড়লো। জাতির ওপর চেপে বসলো একদলীয় শাসনের জগদ্দল পাথর। সুবিচার ও ন্যায়পরায়নতার আদর্শও জলাঞ্জলি দেয়া হল। পাঠক যদি একটু কষ্ট স্বীকার করে সাংবাদিক মাসুদল হকের গবেষণা সমৃদ্ধ গ্রন্থ ‘মুক্তি যুদ্ধে ‘র ও সিআইএ’ পাঠ করেন এবং এই গ্রন্থের পরিশিষ্টে যুক্ত করা হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকারটিও পাঠ করেন তাহলে সহজেই বুঝতে পারবেন আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে কীভাবে শৃঙ্খলিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এসব দৃষ্টান্ত নেতিবাচক হলেও এর ইতিবাচক দিকটি হল স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের মানুষ প্রকৃত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অন্বেষায় উদ্বেল হয়ে উঠেছিল। জাতি হিসেবে এদেশের ৯৯% মানুষ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির নির্ঝরণীতে প্রতিদিন অবগাহন করলেও জাতিসত্তার দিক থেকে একাত্মতা অর্জন করতে তাকে অতিক্রম করতে হচ্ছে অমসৃণ ও পদতল বিদীর্ণকারী পথ। এমন পথ চলা হয়তো আরও অনেক বছর চলবে। এরই মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে জাতি গঠন প্রক্রিয়া একটি পরিণত রূপ লাভ করবে।

১৯৭৫’র ৩ নভেম্বর তৎকালীন সেনাবাহিনীর চীফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে এবং সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দি করা হয়। খালেদ মোশাররফ যে অজুহাতে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন তা ছিল সেনাবাহিনীতে ‘চেইন অব কমান্ড’ প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এধরনের প্রয়াসের সঙ্গে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের কোন সম্পর্ক ছিল না অথচ তাকে সঙ্গে না পেলে চেইন অব কমান্ডের অজুহাতটি চুপসে যায়, তাই তাকে বন্দি করে পরবর্তী জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা হিসেবে খালেদ মোশাররফ ক্যু করে বসেন। 

সেদিন যেসব সেনা কর্মকর্তা তার সঙ্গে ছিলেন এবং তার মধ্যে যারা বেঁচে আছেন তাদের কাছ থেকে জানা যায় সেনাবাহিনীতে জিয়া ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। তার এই জনপ্রিয়তার কারণ ১৯৭১’র মুক্তিযুদ্ধে তার সাহসী ভূমিকা এবং সততার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন। জিয়াকে বন্দি করার ফলে সৈনিকরা সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে তখন জাসদ সহ কিছু বাম রাজনৈতিক দল সেনাবাহিনীতে রাজনৈতিক অনুপ্রবেশে জড়িত ছিল। এদের মধ্যে জাসদপন্থীরা আলোচ্য পরিস্থিতিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান ঘটানোর পর মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। কিন্তু সেই সময় বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন থেকে কোনরূপ রাষ্ট্রীয় ঘোষণা ও বক্তব্য প্রচারিত না হওয়ায় জনগণ চরম বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। বস্তুত ৩ থেকে ৬ নভেম্বর মধ্য রাত পর্যন্ত জনগণের বুঝে উঠতে পারা সম্ভব হয়নি আসলে রাষ্ট্র ক্ষমতা কার হাতে। জনগণের মধ্যে চরম শংকার সূত্রপাত হয়। তারা শংকিত বোধ করে, বুঝি আবার বাকশাল ফিরে আসছে, আবারও হয়তো দুর্ভিক্ষের দুর্দিন ফিরে আসছে। 

এমনই এক পরিস্থিতিতে সৈনিকরা ‘সিপাহী বিপ্লব জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে রাজপথে নেমে আসে। জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্ত হন। জনগণ হাজারে হাজারে ঢাকার রাজপথে নেমে বিপ্লবী সৈনিকদের অভিনন্দিত করে এবং তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে শ্লোগান তোলে ‘সিপাহী বিপ্লব জিন্দাবাদ, জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ।’

জনগণ আবারো রেডিও টেলিভিশনে জিয়ার কণ্ঠস্বর শুনে আশ্বস্ত হয়। দেশ নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পাদপ্রদীপের নিচে এসে দাঁড়ান জিয়া। তিনি এই দায়িত্বভার সৈনিক ও জনগণের ব্যক্ত ইচ্ছার মধ্য দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ক্ষমতার জবরদখলকারী ছিলেন না। রাষ্ট্রের এক ঐতিহাসিক সংকট মুহূর্তে দ্বিতীয়বারের মত তিনি জনগণের পাশে এসে দাঁড়ান। ৭ নভেম্বর ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে আমাদের জাতীয় জীবনে এক অমোচনীয় পথচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৭ নভেম্বর দেশপ্রেমিক সৈনিক এবং জনগণের ঐক্যের স্মারক।


  • লেখক - বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Tuesday, November 2, 2021

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে শহীদ জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার অবদান

 প্রফেসর ড. নুরুল ইসলাম ও ফারহান আরিফ

 

জলবায়ু সমস্যা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংকট। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা যে টেকসই অর্থনীতির কথা বলে থাকি, তা বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন। গত কয়েক দশক ধরে গ্রীণহাউজ ইফেক্টের পাশাপাশি জলবায়ু সংকটের নানাবিধ বহিঃপ্রকাশ আমাদের পৃথিবীকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে, উচ্চ তাপমাত্রা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং নদীভাঙ্গনসহ বিভিন্ন সমস্যা আমাদের বাস্তুসংস্থান পদ্ধতিকে অস্বাভাবিক করে তুলেছে। অন্যদিকে জনসংখ্যার ক্রমশঃ উচ্চহার ও সংকটকে ঘনীভূত করছে। জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে United Nations Framework Convention on Climate Change বা UNFCCC। পরিবেশ সুরক্ষার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯২ সালের ৩ জুন থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত ব্রাজিলের রাজধানি রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত ধরিত্রি সম্মেলনের মাধ্যমে UNFCCC প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলতঃ এটি একটি চুক্তি, যার আওতায় বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং টেকসই উন্নয়ন ও নিরাপদ পরিবেশ ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সভা, পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। প্রতিষ্ঠাকালে এ চুক্তিপত্রে ১৫৪টি দেশ সাক্ষর করেছিল। বর্তমানে UNFCCC তে অংশগ্রহণকারি সদস্য দেশের সংখ্যা ১৯৭ টি। উল্লেখ্য যে, এই চুক্তির আওতাতেই সাধারণত প্রতিবছর Conference of the Parties বা COP Summit অনুষ্ঠিত হয়। এ বছরের ৩১ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের Conference of the Parties বা COP- 26।

বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট নিরসনের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত  এ সম্মেলনের পূর্বে জলবায়ু ঝুঁকির সম্মুখীন রাষ্ট্রসমূহের অন্যতম বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণে সাড়াদানের বিষয় নিয়ে আলোচনা করা আবশ্যক। বাংলাদেশ ১৯৯২ সালেই UNFCCC চুক্তিতে সাক্ষর করে এবং ১৯৯৪ সালে তা অনুসমর্থন করে। তাছাড়া ২০০১ সালের ২২ শে অক্টোবর বাংলাদেশ ১৯৯৫ সালে গৃহীত কিয়েটো প্রটোকল অনুসমর্থন করে। উল্লেখ্য যে, জলবায়ু সংকটে ঝুঁকিতে পড়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশ্বব্যপী গ্রীণহাউজ গ্যাস নির্গমনের প্রভাবে বাংলাদেশ এই মূহুর্তে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ক্রমশঃ ঝুঁকি বাড়ছে। সুপেয় পানির অভাব, অতিরিক্ত লবণাক্ততার প্রভাবে কৃষিজমির উর্বরতা হ্রাস এবং জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক প্রভাবের ফলে বাংলাদেশ এই মূহুর্তে মানবিক সংকটের মুখোমুখি।


নব্বই দশক থেকে বৈশ্বিক জলবায়ু সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। আগামী বিশ্বের নিরাপত্তার স্বার্থে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে সাথে বাংলাদেশও সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে শুরু করে। তৎকালীন বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিল বেগম খালেদা জিয়া পরিচালিত বিএনপি সরকার। জলবায়ু সংকটের ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পেরে খালেদা জিয়ার সরকার এ বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। বিশেষ করে, উন্নত রাষ্ট্রসমূহের ঔদাসীন্যের ফলে সৃষ্ট এ সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ প্রথম থেকেই উচ্চকিত থাকে। পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পেরেই খালেদা জিয়ার সরকার বাংলাদেশের পক্ষে ১৯৯২ সালেই UNFCCC চুক্তিতে অনুসাক্ষর করে এবং পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে এর কার্যকারিতাকে সমর্থন করে। তৎকালীন বিএনপি সরকার বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় ভূমিকা রাখার পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরেও পরিবেশ সংরক্ষণে জোর দেয়। ১৯৯২ সালে বেগম খালেদা জিয়ার আন্তরিকতাতেই জাতীয় সংসদে পাস করা হয় বাংলাদেশের পরিবেশ নীতি- ১৯৯২। রিও ডি জেনিরিওতে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনের প্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ তৎকালীন বাস্তবতা অনুযায়ি বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বিবেচনায় এই নীতি গ্রহণ করে। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার তখন থেকেই টেকসই উন্নয়ন নীতির উপর গুরুত্বারোপ করে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাস্তুসংস্থান পদ্ধতি বজায় রেখে পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়ননীতিতে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। কৃষিজমির অনুর্বরতা রোধ, সুপেয় পানির সহজলভ্যতা নিশ্চিতকরণ, বায়ুদূষণ রোধ, বন সংরক্ষণ, বন্য জীবজন্তু ও মৎস্য সংরক্ষণ ও এদের প্রজনন সুরক্ষাসহ নিরাপদ বাস্তুসংস্থান নিশ্চিত করার উপর পরিবেশ নীতিতে গুরুত্বারোপ করা হয়। মোটকথা বিএনপি সরকারের গৃহীত পরিবেশ নীতির সারকথাই ছিল পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং টেকসই উন্নয়নকল্পে যথাযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ১৯৯২ সালে গৃহীত এই পরিবেশ নীতির উপর ভিত্তি করেই ১৯৯৫ সালে পাস করা হয় ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন- ১৯৯৫’। এছাড়াও ১৯৯৫ সালে গৃহীত হয় National Environment Management Action Plan (NEMAP)। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন- ১৯৯৫ এ উক্ত কর্মপরিকল্পনারও প্রভাব ছিল। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে মূলতঃ তিনটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়ঃ পরিবেশ সংরক্ষণ, পরিবেশ মানোন্নয়ন এবং পরিবেশ দূষণ রোধ ও হ্রাসকরণ। উক্ত আইনের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতিসাধন করার ক্ষেত্রে শাস্তি বিধানও করা হয়।

বিএনপি সরকারের পরিবেশ নীতির এই ধারাবাহিকতা পরবর্তী সময়েও চালু থাকে। বিশেষ করে, ২০০১ সালের অক্টোবরে তৃতীয়বারের মত ক্ষমতায় এসে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার দেশের পরিবেশ সংরক্ষণে যুগান্তকারি নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ২০০৪ সালে বেগম জিয়ার সরকার ওজোনস্তর ক্ষয়কারি দ্রব্য (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা প্রণয়ন করে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন- ১৯৯৫ এর ২০ নং ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই বিধিমালা আরোপ করা হয়। এই বিধিমালাতে ওজোনস্তর ক্ষয়কারি দ্রব্যসামগ্রীকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ধারা ৬ক- কে এই বিধিমালার মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়। এর ফলে ওজোনস্তর ক্ষয়কারী দ্রব্যের উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানী, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপিত হয়।

তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর বেগম খালেদা জিয়া সরকারের একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধকরণ। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার সকল প্রকার পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। জীবাণু বিনষ্টকরণ ক্ষমতার অভাব এবং অপচনশীল হবার ফলে এটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক হিসেবে দেখা দেয়। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে পলিথিন ব্যাগ পরিবেশের স্বাভাবিক বিকাশ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মারাত্মক বাঁধা হিসেবে প্রতীয়মান হয়। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার পূর্বে তার গৃহীত পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের প্রতিশ্রুতির আলোকে পলিথিন ব্যাগের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পাশাপাশি কাগজ, পাট ও কটনের মাধ্যমে প্রস্তুতিকৃত ব্যাগ ব্যবহারে উৎসাহিত করে। পরিবেশ সংরক্ষণের এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তৎকালীন সরকার ব্যাপক প্রচারণা চালায়। বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হচ্ছে ডিজেল বা পেট্রোল চালিত থ্রি হুইলার নিষিদ্ধকরণ এবং সিএনজি চালু করা। বায়ুদূষণের জন্য দায়ী কালো ধোঁয়া নির্গমন রোধে ঢাকা নগরীতে ২০০৩ সালে টু-স্ট্রোক পেট্রোল বা ডিজেল চালিত থ্রি হুইলার বাহন নিষিদ্ধ করা হয়। এর বদলে ১৩,০০০ টি সিএনজি চালিত থ্রি হুইলার বাহন চালু করা হয়। খালেদা জিয়া সরকারের এই উদ্যোগের ফলে নগরীতে বায়ুদূষণ বহুগুণে হ্রাস করা সম্ভব হয়। তার সে উদ্যোগের সুফল এখন দেশব্যপি সকলেই ভোগ করছে।

বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার UNFCCC এর আওতাভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক আয়োজিত সপ্তম অধিবেশন তথা কপ-৭ কে গুরুত্ব সহকারে নেয়। এর প্রতি সাড়া দিয়ে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় National Adaptation Programme of Action for Bangladesh (NAPA) –এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। এর আগে ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত National Adaptation Programme of Action (NAPA) প্রস্তুতকরণের লক্ষ্যে আয়োজিত এক ওয়ার্কশপে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন কিছু দেশের মানুষের জন্য জীবনযাত্রার সংকট; আর কিছু দেশের মানুষের জন্য খোদ জীবনের জন্যেই সংকট বয়ে আনছে।’ তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু পরিবর্তনকে বিশেষ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করে। এ বিবেচনায় উন্নয়ন নীতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যাচাই করা হয়। বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটের ফলে বাংলাদেশের মত ঝুঁকিতে থাকা রাষ্ট্রগুলোর জন্য টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনার উপর জোর দেয়া আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের পরিকল্পনা প্রণয়নে উদ্যোগ নেয়া হয়। এরই বহিঃপ্রকাশ ২০০৫ সালে প্রকাশিত National Adaptation Programme of Action (NAPA)। একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এ পরিকল্পনার আলোকে বেশ কিছু আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতী গ্রহণ করে। মূলতঃ NAPA –ই হচ্ছে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনকার দায়ী উপাদানসমূহ হ্রাসকরণের সূচনা। পরবর্তীতে এর উপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় নিজেদের ভূমিকা রাখতে শুরু করে। এ পরিকল্পনা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ United Nations Framework Convention on Climate Change (UNFCCC) এবং কিয়েটো প্রটোকলের প্রতি নিজেদের কৃত অঙ্গীকার বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়। বেগম খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে স্বল্পোন্নত দেশসমুহের জন্য জলবায়ু সংকট মোকাবিলার্থে, বিশেষ করে NAPA –এর সফল প্রয়োগের জন্য প্রত্যাশিত বরাদ্দ পাওয়ার দাবী জানায়।

খালেদা জিয়া সরকার ২০০৬ সালে শব্দদূষণ রোধে আরেকটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। এই নীতিমালা ‘শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা- ২০০৬’ নামে পরিচিত। উক্ত নীতিমালার আলোকে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ, যানবাহনের হর্ণ ব্যবহারের বিধিমালা, বিভিন্ন শব্দযন্ত্রের ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্থানাবিশেষ নীতিমালা ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয়।

পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণে বেগম খালেদা জিয়ার আন্তরিকতা প্রণিধাণযোগ্য। তিনি সর্বপ্রথম সামাজিক বনায়ন কর্মসূচী গ্রহণ করেন। তার সরকারের আমলে ব্যাপকহারে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। স্কুল, কলেজসমূহের পাঠ্যসূচীতে বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতায় গাছের চারা উপহার দিতে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলার উপর জোর দেয়া হয়। এছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ির আঙিনাসহ উপযুক্ত স্থানে বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে গণমাধ্যমে সরকারিভাবে সচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে ব্যাপকতর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বেগম খালেদা জিয়ার বৃক্ষরোপণের প্রতি আগ্রহ ও আন্তরিকতার প্রভাব এখনো জাগ্রুক রয়েছে। তার নেতৃত্বাধীন দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনসমূহকে বিভিন্ন উপলক্ষে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্যোগ নিতে দেখা যায়। এছাড়াও জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় খালেদা জিয়ার সরকার ক্লিন এনার্জি প্রকল্প (বিশেষ করে সোলার বিদ্যুৎ প্রকল্প) এবং বর্জ্য রিসাইক্লিং প্রকল্প গ্রহণ করে। যার সুফল বাংলাদেশের মানুষ এখন ভোগ করছে।

বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধকল্পে ঢাকার হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি অপসারণ তার শাসনামলেই শুরু হয়। যানজট এবং এর দ্বারা সৃষ্ট বায়ু ও শব্দদূষণ রোধের লক্ষ্যে তিনি ঢাকা শহরকে ঘিরে চারদিকে ওয়াটার সার্কুলার ওয়ে গড়ে তোলার প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।

ভৌগলিক অবস্থানের নিরিখে বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দূর্যোগ প্রবণ দেশ। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এখানে প্রচুর ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত গ্রীণহাউজ গ্যাস নির্গমনের ফলে এ অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপকতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার এ সকল প্রাকৃতিক দূর্যোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে ব্যাপক ভূমিকা নেয়। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলসমূহে সাইক্লোন রোধে এক কোটি নারকেলের চারা রোপন করা হয়। এছাড়াও উপকূলীয় অঞ্চলসমূহে কয়েক হাজার সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ করা হয়। খালেদা জিয়া সরকারের একটি অভিনব উদ্যোগ হচ্ছে স্কুল ভবন কাম সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ। তার শাসনামলে উপকূলীয় এলাকাসমূহে প্রায় প্রতিটি স্কুলকেই সাইক্লোন শেল্টারে রূপান্তরিত করা হয়।

বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপি সরকারের পরিবেশবান্ধব এসব উদ্যোগ একেবারেই নতুন নয়। এর পথিকৃৎ ছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তিনি তার শাসনামলে নদী ও খালখনন কর্মসূচী চালু করেছিলেন। বাংলাদেশের কৃষিবান্ধব অর্থনীতির সমৃদ্ধি অর্জনের পথে জিয়ার খালখনন কর্মসূচি এক বিরাট মাইলফলক। এছাড়াও তিনি তুরাগ নদীসহ অসংখ্য খালবিল দখলমুক্ত করেছিলেন। জিয়াউর রহমান বৃক্ষপ্রেমী ছিলেন। তিনি সড়ক ও রেলপথের দুই ধারে ফলের গাছ লাগান এবং এতে সকলকে উৎসাহিত করেন। শহীদ জিয়ার বৃক্ষপ্রেমের এক সুমহান স্মারক হয়ে আছে পবিত্র আরাফাতের ময়দান। প্রতিবছর হজ্বব্রত পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে গমনকারি লাখো-কোটি হাজীদের আরাফাতের ময়দানে প্রখর রৌদ্রতাপে শীতল ছায়া দিয়ে যাচ্ছে জিয়ার নিজের হাতে রোপন করা কয়েক লক্ষ নিমগাছ। সৌদি আরবের আরাফাতের ময়দানে শীতল ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেসব নিমগাছ হাজীদের কাছে ‘জিয়া ট্রি’ নামে খ্যাত।

বস্তুতঃ পরিবেশ খাতে বাংলাদেশের বুনিয়াদি সকল পদক্ষেপই বেগম খালেদা জিয়া সরকার কর্তৃক গৃহীত। এদেশের পরিবেশ উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় বেগম খালেদা জিয়ার গৃহীত উদ্যোগসমূহ রোল মডেল হয়ে আছে। এর উপর ভিত্তি করেই বর্তমান সময়ে দেশে প্রচলিত টেকসই উন্নয়নের ধারা অব্যহত রয়েছে। সাধারণতঃ জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের মত স্বল্পোন্নত এবং ঝুকিপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর তেমন বৃহৎ কিছু করার থাকে না। উন্নত দেশগুলোর ভূমিকা এখানে বড় নিয়ামক। তথাপিও বাংলাদেশের জন্য যা করা উচিত, সেটা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ সমস্যা রোধে আন্তরিক হওয়া। বিশ্ব দরবারে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নিজেদের ঝুঁকিসমূহকে যৌক্তিক ও দালিলিকভাবে তুলে ধরে ধনী রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে নিজেদের প্রাপ্য বুঝে নিতে হবে। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে চলমান কপ-২৬ সম্মেলনে বাংলাদেশের জন্য বেগম খালেদা জিয়ার তিনবারের শাসনামলে গৃহীত বিভিন্ন পরিকল্পনাসমূহ পথিকৃৎ হতে পারে। একইসাথে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে শহীদ জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার উদ্যোগসমূহ যে কোন সরকারের জন্যই অনুসরণীয়।

 

লেখক পরিচিতি

  • ড. নুরুল ইসলাম, অধ্যপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
  • ফারহান আরিফ, সদস্য (আহবায়ক কমিটি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল। 


Thursday, October 28, 2021

আর কতো গোঁজামিল দিবেন?

ফাইজ তাইয়েব আহমেদ

জুন ২০২১ এর শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৫% বর্ধিত দেখিয়ে $৪৬ বিলিয়ন দেখানো হয়েছিল। আইএমএফ’র হিসাব অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হয়েছে $৩৯ বিলিয়ন, অর্থাৎ ৭.২ বিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে দেখানো হয়েছিল।

রিজার্ভের যে অংশ অর্থায়ন হয়ে গেছে, আবাসিক ব্যাংকে জমা হয়েছে, নন ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড বন্ডে বিনিয়োগ হয়েছে এবং শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, তা এডজাস্ট করা হয়নি।

এক বছরের বেশি সময় পার করার পর ২০১৯-২০ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধির তথ্য প্রকাশ করলো সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো- বিবিএস। সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩.৫১ শতাংশ। যদিও সরকারের দাবি ছিল ওই অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫.২৪ শতাংশ।

প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে যত গোঁজামিল বিবিএস তৈরি করেছে, তার কয়াটা ধরা খাওয়ার পর ঠিক করবে?

আর দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, বিদেশী সংস্থার কি ঠেকা পড়েছে এভাবে বার বার বিবিএস এর জালিয়াতি ধরে দিবে?

জনসংখ্যা, জাতীয় আয়, প্রবৃদ্ধি, ফরেক্স রিজার্ভ, মাথাপিছু ঋণ, মোট বৈদেশিক ঋণ, মোট খেলাপি ঋণ, কৃষি-শিল্প-রপ্তানী প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, আয়কররের হিসেব ইত্যাদি খাতে আর কতদিন গোঁজামিল চালিয়ে যাবে বিবিএস? গোঁজামিল ডেটার উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা কি সুস্থ ও সুষ্ঠু হয়?

দেশী অর্থনীতিবিদ, সিপিডি, ব্রাক-বিআইজিডি, পিপিআরসি ইত্যাদি বেসরকারি সংস্থা কিংবা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা বিয়াইডিএস এর কাজটা আসলে কি? শুধু তেল্বাজি করা? সরকারের সেট করে দেয়া ডেভেলপমেন্ট ন্যারেটিভের পক্ষে গোঁজামিলে ভরা ম্যানিপুলেটেড ডেটা উৎপাদনের পক্ষে সমর্থন দিয়ে যাওয়া? 

সূত্র    — দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড/ অক্টোবর ২৩, ২০২১


  • লেখক নেদারল্যান্ডসের ভোডাফোনে কর্মরত প্রকৌশলী এবং টেকসই উন্নয়নবিষয়ক বিশেষজ্ঞ।   

Friday, October 22, 2021

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সর্বাত্মক সংগ্রামই হওয়া উচিত বিএনপির একমাত্র অঙ্গিকার

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান

 


পরাজয় হলে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্রে যান এবং স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষনা দিয়েছিলেন, যা তাকে অসীম সাহসী দেশ প্রেমিক হিসেবে অসামান্য উচ্চতা দান করেছে। স্বাধীনতার ঘোষণার দিনক্ষণ সংক্রান্ত একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া দরকার। জিয়াউর রহমানের সহকর্মীদের ভাষ্য অনুযায়ী ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী রাতে তিনি সর্বপ্রথম তার সৈনিকদের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন; পরবর্তীতে ২৬ তারিখে আরেকবার এবং ২৭ মার্চ পুনরায় রেডিওতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। শ্বাসরুদ্ধকর মুক্তিযুদ্ধের অবসান হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে লাখো মা বোনের ইজ্জত ও শহীদের রক্তের বিনিময়ে । রণাঙ্গনে অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ জিয়াউর রহমানকে ১৯৭২ সালে যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ ”বীর উত্তম” খেতাবে ভূষিত করা হয়। 

সন্দেহাতীত ভাবেই তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। পেশাদারিত্ব তাঁর চারিএিক বৈশিষ্ঠের অন্যতম প্রধান একটি দিক। দেশ প্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ জিয়াউর রহমান নিজ পেশায় ফিরে যান। তারপর প্রায় চার বছর গত হয়।

১৯৭৫ এর ১৫ ই আগস্টে পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন খন্দকার মোস্তাক এবং সামরিক আইন জারি করেন। সংবিধান বলবৎ রাখলেও সংশোধনী এনে নাগরিক অধিকারের পরিধি আশঙ্কাজনক ভাবে সংকুচিত করেন। রাষ্ট্রপতি মোশতাক আহমেদ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫-এ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করার মাধ্যমে ১৫ই আগষ্টে অভ্যুত্থান ও হত্যাকান্ডে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের আইনি সুরক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। 

এ আদেশে বলা হয়েছিলো, ১৫ই আগস্ট অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত কারো বিচার করা যাবেনা (মহিউদ্দিনআহমদ, ২০১৭, পৃ-৬৪), যা প্রমান করে, বাকশাল সরকারের তৎকালীন বানিজ্য মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে ১৫ই আগষ্টের অভ্যুত্থানকারী ও হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের আইনি সুরক্ষা দিয়েছেন; জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সবৈব মিথ্যা। 


রাজনীতির এই চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার দৃশ্যপটে চলে আসেন। সঙ্কট, সন্দেহ, পারস্পরিক দোষারোপ, কু ও পাল্টাকু এর অগ্নিঝরা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সিপাহি-জনতা অবরুদ্ধ জিয়াকে মুক্ত করে কিভাবে দেশ পরিচালনা গুরু দায়িত্ব প্রদান করেছেন সে সম্পর্কে ইতিহাস সচেতন দেশবাসী অবগত আছেন। এই ইতিবাচক ঘটনাটিকে যথাযথ মর্যাদা দানের লক্ষ্যে ৭ নভেম্বরকে ”জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস' হিসেবে পালন করা হয়। জিয়াউর রহমান যখন সেনাপ্রধান হন তখন সামরিক বাহিনী ছিল নানা দল উপদলে বিভাজিত। রাজনৈতিক দলগুলো ছিল পরস্পর বৈরী। সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং রাষ্টক্ষমতা প্রয়োগের আইনি ভিত্তি তৈরী করার জন্য রাজনৈতিক দল তৈরী করে রাজনীতিকে সেনা ছাউনি থেকে জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার আন্তরিক চেষ্টায় নিমগ্ন ছিলেন। ফলাফল হিসেবে ১৯৭৮ সালে ১লা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠিত হয়। 

অনেকের সংশয় ছিল যে, তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন না। ঐতিহাসিক গওহর আলী তার সন্দেহের কারণ হিসেবে চার ভাগে বিভক্ত সামরিক বাহিনীকে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে মন্তব্য করেছেন (১৯৭৬ সালে নিউজিল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিভিউতে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে)। অনেকের সংশয়ের আরও একটি কারণ হল, সাধারনত ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে থেকে, রাজপথে কিংবা আলোচনার টেবিলে এদেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ব্যতীক্রমধর্মী। এটি ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে থাকা জিয়াউর রহমানের মস্তিস্কজাত রাজনৈতিক মতাদর্শ। সংগত কারণে অনেকের মধ্যে সংশয় ছিলো এটি কি রাজনৈতিক দল নাকি একটা ‘প্রবনতা’। এছাড়াও রাজনীতির অঙ্গনের অনেকের ধারণা ছিল সরকারের মেয়াদ শেষ হলেই বিএনপি দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যাবে। দল হিসেবে বিএনপি টিকে থাকবে কিনা সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে রাজনৈতিক দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ”সরকার চলে গেলে এই দল থাকবে বলে মনে হয় না” ( বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, ১৯৭৮, পৃ.৫)। 

সব সন্দেহ ও সমালোচনাকে ভুল প্রমাণ করে জিয়াউর রহমান সামাল দিয়েছিলেন, সফল হয়েছিলেন। এই সাফল্যের পিছনে ভুমিকা রেখেছে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে গণমুখী এবং গণনির্ভর করাতে তাঁর সদিচ্ছা ও কার্যকর পদক্ষেপ। জাতির জীবনে এ ধরনের সাফল্য বয়ে নিয়ে আসার কারণে অনেক গবেষক জিয়াউর রহমানকে তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, মেক্সিকোর প্লুতার্ক এলিয়স কামেল ও লজারো কার্দেনাস এবং দক্ষিণ কোরিয়ার পার্ক চুংহি এর সাথে তুলনা করেন (Hossain, Golam, General Ziaur Rahman and the BNP: Political Transformation of a Military Regime, UPL,  Dhaka, P.17)। বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোন্দল ও স্থবিরতার বিপরীতে তিনি  দেশের জন্য সময় উপযোগী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বিষয়ক ইশতেহার প্রণয়ন ও ঘোষনা করেন। এভাবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) একক বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়।

জিয়াউর রহমান দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে কেবল শাসক পরিবর্তন হয়েছে তা নয় বরং বাংলাদেশ রাষ্ট্র কেমন হবে; এর দার্শনিক ভিত্তি কি হবে, তার একটি সুনির্দিষ্ট ও প্রায়োগিক রূপরেখা পাওয়া গিয়েছে। জিয়াউর রহমান প্রতিশোধ পরায়ান ছিলেন না। বহুবার বৈষম্য ও অবজ্ঞার শিকার হয়েও তিনি শত্রু চিহ্নিত করে নির্মুল করার পথে না হেটে বাংলাদেশকে একটি কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করার নিমিত্তে  সর্বস্থরের জ্ঞাণী-গুনী মানুষের সম্মেলন ঘটিয়েছেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দার্শনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেছেন, যা পর্যায় ক্রমে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ মানুষের মিলন মেলায় পরিনত হয়েছে। সমালোচকদের ভুল প্রমান করে এই দলটি জনগণের সমর্থন আদায় করে প্রভাবশালী দল হিসেবে শুধুমাত্র স্থায়ীত্বই অর্জন করেনি বরং জিয়া পরবর্তী সময়ে তিনবার গ্রহনযোগ্য অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয় লাভ করে সরকার পরিচালনা করেছে। 

এরশাদের আমলে বিএনপিকে ভাঙ্গার চেষ্টা হয়েছিল। আবার ২০০৭ সালের ওয়ান ইলেভেনের পরে বিএনপিতে সংস্কারপন্থী সৃষ্টি করে দলটিকে ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সব সংকট মোকাবেলা করেই বিএনপি এগিয়েছে। এখন জিজ্ঞাসা হল এই দলের গ্রহনযোগ্যতা তথা টিকে থাকার পেছনের কারণ কি? অনেক  কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি হলোঃ (১) বহুদলীয় গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, (২) দলের সুদৃঢ় দার্শনিক ভিত্তি রচনা করা, ও (৩)কার্যকর উন্নয়ন মূলক অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ। বাকশাল নামের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছিল আওয়ামী লীগ, যা ব্যাপক ভাবে সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর একদলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলন জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সময়েই ভারতের নির্বাসন থেকে ফিরে দলের হাল ধরেন। 

বাহাত্তরের সংবিধানে আমাদের পরিচয় “বাঙালি” হিসেবে ধার্য্য  করা হলেও রাষ্ট্র ক্ষমতা অধিষ্ঠিত হওয়ার পর জিয়াউর রহমান এই ধারনায় পরিবর্তন আনা জরুরী বলে মনে করেন। নাগরিক হিসেবে সকলের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে জাতি হিসেবে আমাদের পরিচয় কি তা স্পষ্ট হতে হবে। তিনি বলেন, “যদি আমরা জাতীয় পরিচয় নির্ধারনের ক্ষেত্রে “বাঙালি” পরিভাষাটি ব্যবহার করি তাহলে বাংলাদেশের ভূখন্ডে বসবাসরত অবাঙালি বাংলাদেশী নাগরিকগণ (যেমন-আদিবাসীগণ) জাতীয় পরিচয়ের বলয় থেকে ছিটকে পড়বে। এটি আমাদের জাতিসত্বার একটি খন্ডিত পরিচয় তুলে ধরে। 

জিয়াউর রহমান তাই বাংলাদেশের বাঙালি ও অবাঙালিসহ সকল নাগরিকের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্যে জাতীয় পরিচয়ের মাধ্যম হিসেবে “বাঙালির” স্থলে “বাংলাদেশী” পরিভাষা ব্যবহার করার প্রস্তাব করেন। আমাদের জাতীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে এ ধরনের একটি তাত্ত্বিক বিচ্যুতি দূর করার লক্ষ্যে কালক্ষেপণ না করে তিনি একে আইনি কাঠামোর মধ্যে স্থিত করেন”, ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’, জিয়াউর রহমান। বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাবনার তুলনায় জিয়ার রাষ্ট্র দর্শন 'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ' অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রয়োগিক।এভাবেই জিয়াউর রহমান দলেকে 'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী' একটি সুদৃঢ়  দার্শনিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্টিত করেছিলেন এবং একটি জাতিরাষ্ট্র তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। 

বিশিষ্ট সাংবাদিক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন,“আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতির নিষ্পত্তি হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার মধ্য দিয়েৃ...বায়ান্ন, ছেষট্টি , উনসত্তরের স্মৃতি নিয়ে বসে থেকে তো আর জাতিরাষ্ট্র তৈরি করা যায় না। এ জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের প্রয়োজনে সমঝোতা ও ঐক্যের রাজনীতি এবং জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। বলা চলে, আওয়ামী লীগ সরকার দেশের বৃহত্তর নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের আকাঙ্খার সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি। ঐক্যের বদলে গোষ্ঠীতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। জাতীয় ঐক্য তো দূরের কথা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রধান শক্তিটিও বিভক্ত হয়ে পড়েছিল...বাহাত্তরে প্রয়োজন ছিল নতুন রাজনীতি, নতুন কৌশল। একটি জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান তার কার্যকরিতা সম্পন্ন করেছিল। আওয়ামী লীগ এরপর পুরনো মনস্তত্ত্বের ঘেরাটোপ থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারেনি, এর ধারাবাহিকতা চলছে আজও (মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি: সময়-অসময়, ২০১৭, পৃ-১৩৪-১৩৫)।


‘উন্নয়ন মূলক অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ’ এর বিষয়টি যথাযথ ভাবে ব্যাখ্যার জন্য বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন যা এইস্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। সংক্ষেপে বললে, জিয়াউর রহমান খাল খনন, তৈরি পোশাক শিল্প রপ্তানিমুখিকরণ এবং এই শিল্প বিকাশের জন্য সর্ব প্রথম স্পেশাল বন্ডেড ওয়ারহাউজ স্কিম চালু করা, গ্রামীন ব্যাংক চালু করা, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট পদ্ধতির উদ্ভাবনসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে নানা ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করেছেন। বিশেষ করে পোশাক শিল্প ও রেমিটেন্স, যার ওপর আজ দেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে, তার উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছিল জিয়াউর রহমানের আমলেই। তার সময়ে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রকৃত পক্ষেই জনসাধারনের জন্য সুফল বয়ে এনেছিল। ক্ষমতায় গিয়ে চটকদার কিছু কর্মসূচি বা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু করে জনসাধারণকে গণতন্ত্রের দাবি থেকে সরিয়ে রাখাই হল সামরিক শাসকদের সাধারণ বৈশিষ্ট, কিন্ত জিয়াউর রহমান সেই তুলনায় ছিল এর এক অনন্য সাধারণ ব্যতিক্রমধর্মী উদাহরণ। 

জাতীয়তাবাদী দলের জনপ্রিয়তার পেছনে জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রেস সচিব কাফি খান (যিনি এক সময়ে ”ভয়েজ অব আমেরিকার” সংবাদ পাঠক ছিলেন) জিয়ার সততা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, “আত্মীয় স্বজনদের কেউ কোন তদবিরের জন্য বঙ্গভবনে বা তাঁর বাসায় আসার সাহস পায়নি... তিন-চার হাজার টাকার মতো বেতন পেতেন। সেখান থেকে ১৫০ টাকা রাষ্ট্রপতির রিলিফ ফান্ডে জমা দিতেন। বাকি টাকাটা দিয়ে সংসার চালাতেন” (সৈয়দ আবদাল আহমেদের নেওয়া কাফি খানের সাক্ষাৎকার, www.bnpbd.org)। জিয়াউর রহমানের যুদ্ধ দিনের সঙ্গী ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানে ছিলেন স্বাধীনচেতা ও প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন । তার আশে পাশে মৌমাছির মতো অনেক চাটুকারের সমাবেশ ঘটেছিল। কিন্তু তার ছিল সজাগ দৃষ্টি। জিয়াউর রহমান মীর শওকতকে একদিন বলেছিল, ‘‘মীর, যতদিন আমাদের দেশের দশ হাজার টাউট ও চামচা নিশ্চিহ্ন না হবে, তত দিন আমাদের কষ্ট থাকবে’’ (লেপ্টেনেন্ট জেনারেল (অব) মীর শওকত আলী, যুদ্ধের কথা কষ্টের কথা, আমাদের একাত্তর, আহমদ, এম সম্পাদিত গণউন্নয়ন, গ্রন্থাগার, ঢাকা পৃষ্ঠা,৪৫)।

১৯৮১ সালের ৩০ মে চক্রান্তকারীদের হাতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অনাকাঙ্খিত হত্যার শিকার হন। দেশ ও জাতির সংকটময় মুহূর্তে সংসারের করিডোর অতিক্রম করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম জিয়ার আবির্ভাব ঘটে ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি দলের প্রাথমিক সদস্য হবার মাধ্যমে। ১৯৮২ সালের শুরুর দিক থেকে দীর্ঘ নয় বছর জগদ্দল পাথরের মত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন জেনারেল এরশাদ। বেগম খালেদা জিয়া সামরিক জান্তা এরশাদের জুলুম নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্ট জাতির আরেক ক্রান্তিলগ্নে জনগনের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। দলের ভিতরের ষড়যন্ত্র (অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের নায়ক ছিল এরশাদের সাথে গোপনে আঁতাতকারী ‘হুদা-মতিন’ চক্র) ও দলের বাইরের ষড়যন্ত্রকে নস্যাত করে বেগম জিয়া ৭ দলীয় ঐক্যজোট তৈরি করেন। ১৯৮৩ সালের ৪ ও ৫ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ এর নেতৃত্বে গঠিত ১৫ দলীয় জোটের সাথে বৈঠক করেন এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ৫ দফা ঘোষণা দেন। ১৯৮৬ সালে সামরিক জান্তা এরশাদ তার দু:শাসনকে বৈধতা দেবার এক দূরভিসন্ধিমূলক কূট চালের অংশ হিসেবে সংসদ নির্বাচনের ঘোষনা দিলে ৭ দল ও ১৫ দল যৌথভাবে এই ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ধূর্ত সামরিক জান্তা এরশাদের পাতানো নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। যদিও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সহ অন্য দলগুলো বিএনপির সঙ্গে এসে আন্দোলনে যোগ দেয়। 


নেতৃত্বের অসাধারণ দক্ষতা ও আপোষহীন মনোভাব প্রদর্শন করে বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরাচারী এরশাদের সামরিক শাসন বিরোধী গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের নেতৃত্বের মূল চালিকা শক্তি হয়ে উঠেন। হরতাল, সচিবালয় ঘেরাও ও আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি লাঠি চার্জ ও কাঁদানি গ্যাসে আহত হন। কোন নির্যাতন তাঁকে রুখতে পারেনি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নেতা কর্মীদের সাহস ও অনুপ্রেরণার মধ্যমণি হয়ে সকল বাধা অতিক্রম করে স্বৈরাচারী সামরিক জান্তা এরশাদ-এর কবল থেকে ১৯৯০ এর ৬ ডিসেম্বরে দেশবাসীকে মুক্ত করেছেন। এই আপোষহীন নেতৃত্বের মাধ্যমে তিনি বিএনপি-কে শক্তিশালী ও মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করাবার পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের প্রত্যয়দীপ্ত ছাত্রদের বিশাল এক অংশ নিয়ে গঠিত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ এবং ছাত্রদের অধিকার আদায়ে লড়াকু এক ছাত্র সংগঠনে রূপান্তরিত করেন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বরের গণ অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী এরশাদের পতনে এই আত্মবিশ্বাসী লড়াকু ছাত্রদের ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের ভূমিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৯১ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে খালেদা জিয়ার আপোষহীন নেতৃত্বের প্রতিদান স্বরূপ বিএনপি বিজয় অর্জন করে। পরবর্তীতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিন মেয়াদে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি কিছু সেনা কর্মকর্তাসহ সেনাপ্রধান মঈন উদ্দিন ক্ষমতা দখল করেন এবং ২২ জানুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন বাতিল করেন। ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বে অসাংবিধানিকভাবে সেনাসমর্থিত এক সরকার প্রতিষ্ঠা করে দেশে জরুরী অবস্থা জারী করা হয়। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে  দখলদারবাহিনী বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবার এবং বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে কল্পকাহিনী প্রচার শুরু করে। চাপের মুখে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার জরুরী অবস্থা বহাল রেখে নির্বাচন দেয়ার প্রস্তাব করলে বেগম খালেদা জিয়া তা প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেই স্বৈরাচারী এরশাদের ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ৭ দল ও ১৫ দলীয় জোটের সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে যে প্রক্রিয়ায় শেষ মুহূর্তে অংশগ্রহণ করেছিল ঠিক সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটালো। অজ্ঞাত কারণে আওয়ামী লীগ জরুরী অবস্থার মধ্যেই নির্বাচন করার প্রস্তাব মেনে নেয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনর্বহাল করার স্বার্থে বেগম খালেদা জিয়া মঈন উদ্দিন - ফখরুদ্দিনের সেনা সমর্থিত সরকারের (যারা জিয়া পরিবার কে ধ্বংস করার জন্য বিরতিহীন ভাবে সকল প্রকার জুলুম ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছিল) অধীনে জরুরী অবস্থার মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহন করতে রাজী হননি। 

পরবর্তীতে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার করা হলে বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং নানামুখী ষড়যন্ত্রের মুখে পরাজয় বরণ করে। নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এর পর যা ঘটে যাচ্ছে তা সবার জানা। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ভোটার বিহীন নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ ২য় ও ৩য় মেয়াদে সরকার গঠন করেছে। এ দীর্ঘ সময়ে বেগম জিয়াকে বাড়ী ছাড়া করেই তারা ক্ষ্যান্ত হয়নি, গত ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে  বর্তমান সরকার তাঁকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে। মিথ্যা মামলায় তিনি এখন বন্দি। প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হলেও জামিন দেওয়া হচ্ছেনা। বেগম খালেদা জিয়া কারামুক্ত হলে বিদেশে গিয়ে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করে সুস্থ হয়ে উঠবেন; তাঁর আপোষহীন নেতৃত্বে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এই প্রাণের দাবী আদায় হবে সেই আতংকে সরকার তাঁর ওপর এই মিথ্যে মামলা-হামলা ও জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।  

বর্তমানে গুম-খুন, নারী-শিশু নির্যাতন, অপহরণ, গুপ্তহত্যা ইত্যাদি অনাচার ও আতঙ্ক মানুষের নিত্যসঙ্গী। গণতন্ত্রের চর্চা নেই, আইনের শাসন নেই, জীবনের নিরাপত্তা নেই। জিজ্ঞাসা হল, এ অবস্থায় বিএনপি'র করণীয় কি? মূলত রাজনৈতিক সংকট রাজনীতিক ভাবেই মোকাবেলা করতে হয়। আমরা লক্ষ্য করেছি, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বিএনপির আপোষহীন সংগ্রাম ও নেতৃতের ধারাবাহিক একটি ঐতিহ্য রয়েছে। জিয়াউর রহমান একদলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করেছে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরশাসক এরশাদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে নিরলস সংগ্রাম করে 'আপোষহীন নেত্রী' হিসেবে উপাধি লাভ করেছন। আজ সময় আসছে বিএনপির নিজ দলের রচিত সংগ্রামের অতীত ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বিরতিহীন সংগ্রামের পুনারাবৃত্তি করা। 

এই সংগ্রামে জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের চেতনাকে অন্তরে ধারণ করে বেগম খালেদা জিয়া প্রদর্শিত আপোষহীন নেতৃত্বের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অনুসরণে বহুদলীয় ঐক্য তৈরি করে দেশকে দু:শাসন মুক্ত করার রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা। বর্তমানে করোনা মহামারির এই দু:সময়ে জাতির প্রয়োজনে গণতন্ত্রের চর্চা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার জন্য আদর্শিক জোটের পাশাপাশি বহুদলীয় ঐক্য তথা রাজনৈতিক মোর্চা গঠন করা জরুরী। 

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের কোন বিকল্প নেই। ঐক্য তথা রাজনৈতিক মোর্চা গঠন করার ক্ষেত্রে দেশে বিরাজমান বর্তমান ভয়াবহ দুরবস্থায় রাজনৈতিক মতাদর্শগত অভিন্নতা বিবেচনায় নেওয়া খুব জরুরি বিষয় নয়। বাংলাদেশের গণতন্ত্র- পুনরুদ্ধারের ইতিহাস তারই স্বাক্ষর বহন করে। সামরিক জান্তা এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ৭ দল ও ১৫ দল যৌথভাবে করেছিল। বিএনপির নেতৃত্বধীন ১৮ দলীয় জোটের শরিক ছিল জামায়াতে ইসলামী, এটি যেমন একটি বাস্তবতা, তেমনি আওয়ামী লীগ তৎকালীন জামায়তে ইসলামীর দুই শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের সাথে মতবিনিময় করে স্বৈরাচারী এরশাদের ষড়যন্ত্রমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৯৮৬ সালে) অংশগ্রহণের বিষয়টিও ইতিহাসের আরেকটি অংশ। তাই বহুদলীয় ঐক্য তথা মোর্চা গঠন করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার সংগ্রামের বিরোধিতা করার যোক্তিক কিংবা নৈতিক কোন অধিকার আওয়ামী লীগ কিংবা বর্তমান সরকারের নেই, কিংবা রাখেনা। 

ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সমালোচনা কিংবা ষড়যন্ত্রের  শিকার হয়ে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ না করা কিংবা এক্ষেত্রে বিলম্ব করা হবে ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করার শামিল। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ভবিষ্যতের বহুদলীয় রাজনৈতিক মোর্চার প্রথম শর্ত হওয়া উচিত বেগম খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য জামিন চাওয়া ও স্থায়ী ভাবে কারা মুক্তি। এই দাবী বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। কারণ এই সংগ্রামে বিজয়ের জন্য প্রয়োজন আপোষহীন নেতৃত্ব। বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ করে, এ ধরনের নেতৃত্বের জন্য বেগম খালেদা জিয়া তুলনাহীন। 

অতীতের ন্যায় তার আপোষহীন নেতৃত্বেই নির্দলীয় সরকারের দাবী আদায় করে একটি অবাধ ও সুষ্ঠনির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব। একথা সত্য যে, বিগত একযুগ যাবৎ নিষ্ঠুরতম রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে আসছেন  বিএনপির চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনসহ  কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ের কর্মী -সমর্থক পর্যন্ত। কিন্তু দেশের স্বার্থে হাল ধরতে হবে। হাল ছাড়া যাবেনা, সে জন্য সাংগঠনিক ভাবে বিএনপিকে অধিকতর সক্রিয় এবং সফল হতে হবে। প্রয়োজন নেতৃত্বের পুনর্বিন্যাস ও সাংগঠনিক কার্যক্রম সক্রিয়ভাবে পরিচালনা করা। প্রত্যাশিত ইতিবাচক ফলাফল পেতে হলে, বর্তমান নেতৃত্বকে এক্ষেত্রে ধারণ ও অনুসরণ করতে হবে জিয়াউর রহমানের সেই ”বৈষম্যহীন” অথচ ”বিচক্ষন” সাংগঠনিক দৃষ্টিভঙ্গি। কর্মকান্ড ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদায়ন ও দলের জন্য নিবেদিত এমন একধিক সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে নেতৃত্ব সৃষ্টি করা ছিল জিয়াউর রহমানের কর্মপন্থা।

এই নীতি অনুসরণ করলেই চাটুকার কিংবা সুযোগ সন্ধানীরা দল কিংবা দেশের ক্ষতি করতে পারবেনা; মূল্যায়িত হবে পরীক্ষিত নেতা-কর্মী-সমর্থক, এবং তাদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমেই গণতন্ত্র মুক্তি পাবে। বর্তমান সরকার জনগণের জান মালের নিরাপত্তা প্রদানে ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। এর অন্যতম  প্রধান কারণ হচ্ছে, দেশ গণতান্ত্রিক ভাবে পরিচালিত হচ্ছেনা। জনগণের নিরাপত্তা বিধানের জন্যই গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে, নির্দলীয় সরকারের দাবী আদায় করে একটি অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বর্তমান সরকারকে বাধ্য করতে হবে। তাই জনপ্রিয়, দায়িত্বশীল ও নেতৃত্ব প্রদানে ঐতিহ্যবাহী একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সর্বাত্মক সংগ্রাম রচনাই হওয়া উচিত বিএনপির ৪৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর একমাত্র অঙ্গিকার।

  • লেখক শিক্ষক দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। 


Sunday, October 17, 2021

প্রাসঙ্গিকতা

শায়রুল কবির খান

 


প্রাসঙ্গিকতা একটি চিন্তাশীল প্রশ্ন। সবকিছু প্রবাহিত হয় এবং পরিবর্তিত হয়। সবকিছু অবিচ্ছিন্নভাবে প্রায় চলমান। স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী বছর ২০২১ সাল।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সূদুর প্রসারী চিন্তার ফলেই তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। তার বাস্তবতা ভারত ও বাংলাদেশের সকল চিন্তাশীল ব্যক্তি স্বীকার করেন।

তবে পশ্চিমবঙ্গের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সাহায্য এবং সমর্থন জানিয়ে ছিলেন। এর ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিক একটা কারণও ছিল। বাঙালির মনে মনে একধরনের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা ছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলার মুসলমানদের অবদান সবচেয়ে অগ্রগামী ছিল। এই অহঙ্কার বোধটা দুই অঞ্চলের বাংলা ভাষাভাষীদের ভাবনার মধ্যে ছিল।

স্বাধীন বাংলাদেশের সুচনালগ্নেই এই সামগ্রিক স্রোতধারায় বিচ্যুতি ঘটল, যার রেশ আজ অবধি বয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা একটা কুয়াশাচ্ছন্ন কাব্যিক দৃষ্টিতে দেখছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তীকালে অনেকের মনোভাবের একটা গুণগত পরিবর্তন হয়। যারা মনে করেছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এখানে একটা কল্পস্বর্গ প্রতিষ্ঠা হবে। নদীতে মধুর দুধ বইবে, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বত্র নবীনকালের রবিন্দ্রনাথ, নজরুল ও জগদীশ চন্দ্র বসুরা জন্ম গ্রহণ করতে আরম্ভ করবে। কিন্তু এর কিছুই হলো না।

বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। তাদের প্রত্যাশিত কিছুই ঘটেনি। অধিকন্ত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় মানবেতর সঙ্কট সর্বত্রই। প্রতিহিংসা পারায়ণ খুনোখুনি, অভাব, দুর্ভিক্ষ, দুর্নীতি- এসবই একটার পর একটা বেড়েই চলছে। এই আকাঙ্ক্ষা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে রূপায়িত ছিল না।

তাদের জীবন রূপায়িত ছিল সুন্দর স্বাভাবিক একটা সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্র থাকবে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায়।

স্বাধীন বাংলাদেশের হালহকিকত দেখে পশ্চিমবঙ্গের সেই নাগরিকদের একটা অংশ আশাহত হয়েছেন, এটাই স্বাভাবিক ছিল।

বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতি পশ্চিমবাংলার শিক্ষত নাগরিকদের একটা অংশ যুগপৎ বিতৃষ্ণা ও ভালোবাসা দু’টিই পোষণ করেন। বাংলাদেশে যদি বলার মতো উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটে, তারা গলা উঁচিয়ে ঘোষণা করেন ওপার বাংলার আমার ভাইয়েো এটা করেছে, ওটা করেছে। আর যদি খারাপ কিছু হয়, তখন তারা বলতে দ্বিধা করেন না, আর কি করবে! ওরা তো সারা যুগ ধরে তাই করে আসছে। অন্য রকম কোনো একটা করবে কী করে?

নাগরিকদের যুগপৎ বিতৃষ্ণা আর ভালোবাসার মধ্যে বাংলাদেশ যদি জনগণের সপক্ষে অর্থপূর্ণ কোনো কর্মসূচি সংযোজিত হয়, তার প্রভাব ফেলবেই বিস্তৃতভাবে।

বাংলাদেশের মানুষ মনস্তাত্ত্বিকভাবেই স্বাধীনচেতা, উদার মনোভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী। এই চেতনার চিন্তা শক্তি থেকেই প্রতিবেশীদের প্রতি সবসময় সহনশীল।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া যুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যের পরাজয়। 

স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার।

যুদ্ধ পরবর্তীকালে নির্বাচনে ভারতের প্রায় সবগুলো রাজ্য শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়।

কংগ্রেস বামপন্থী রাজনীতির প্রসার ঠেকিয়ে নিজেদের আসন ও শাসন অটুট রাখার জন্য প্রতিবেশী দেশে অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল মূল লক্ষ্য।

আওয়ামী লীগ সরকারের একনায়কতন্ত্র দখলদারিত্বে বাংলাদেশে বামপন্থী ও ইসলামী অনুশাসনের রীতি মেনে যে রাজনীতির চর্চা আছে তার কোনো জায়গায় শক্তিশালী সংগঠন নেই। আছে একধরনের আত্মঘাতী কলহ, বঞ্চনা ও বিভক্ততা।

তার মাঝেও বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আগামীর লক্ষ্যকে স্থির রেখে রাজনৈতিক সাংগঠনিক শক্তিগুলো একটা সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্য বদ্ধ হবে, তেমন আশা করা কি অন্যায় হবে?

সকল রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশকে সামনে রেখে জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিবেচনায় সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দর্শন ও সুনির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলো উপদলসমূহ ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে অচিরেই জনগণকে জাগ্রত করে তোলা সম্ভব হবে।

সময় নষ্ট হলে এই সরকারের আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে জনগণের আকাঙ্ক্ষা হারিয়ে যাবে। কথায় বলে ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়’।

  • লেখক সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী   

Thursday, October 14, 2021

রামু ট্র্যাজেডির নয় বছর

ড. সুকোমল বড়ুয়া 



রামু ট্র্যাজেডির নয় বছর পূর্ণ হলো। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বৌদ্ধদের শুভ মধু পূর্ণিমার আগের রাতে রামু-উখিয়া-পটিয়াবাসীর বৌদ্ধদের ওপর ওই জঘন্য ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। এ ঘটনায় বিশ্বের নানা স্থানে, নানা রাষ্ট্রে, এমনকি জাতিসংঘের সদর দফতরের সামনে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

দল-মত, জাতি-গোষ্ঠী, সম্প্রদায় এবং নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষ সেদিন বৌদ্ধদের পক্ষে এক কাতারে দাঁড়িয়ে রাস্তায় নেমেছিল। সেদিন দেখেছি বিপন্ন মানবতার পক্ষে মানুষের সহমর্মিতা। সেই স্মৃতি বৌদ্ধরা এখনো ভোলেনি।

উত্তম বড়ুয়া নামে এক যুবকের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিথ্যা একটি স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে রামু ট্র্যাজেডির সূত্রপাত। এটি ছিল সম্পূর্ণ পরিকল্পিত, যা পরবর্তী সময়ে সরকারি-বেসরকারি নানা তদন্তেও প্রমাণিত হয়েছে। অথচ এ মিথ্যা ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেদিন শত শত বছরের প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার, স্থাপনা ও প্যাগোডা আগুন জ্বালিয়ে ধ্বংস করা হয়েছিল। আগুনের লেলিহান শিখার ধোঁয়ায় ওই জনপদ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। স্বর্ণ, ব্রোঞ্জ ও অষ্টধাতু নির্মিত বহু মূল্যবান বুদ্ধমূর্তি, প্রাচীন পুঁথি-পুস্তক ও পাণ্ডুলিপিসহ বৌদ্ধ কৃষ্টি-সংস্কৃতির বিভিন্ন অমূল্য সম্পদ সেদিন পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। মোট ২১টি গৃহ ভস্মীভূত হয়েছিল, যেখানে ছিল অতিদরিদ্র ও নিঃস্ব বৌদ্ধ পরিবারের বসতি।

অথচ রাত পোহালেই মধু নিয়ে বিহারে যাওয়ার কথা ছিল শত শত শিশু-কিশোর-কিশোরীসহ নানা বয়সের নারী-পুরুষের। এর মধ্য দিয়ে মধু দানোৎসবের আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি হতো। এ দান সারা দিন চলত, বুদ্ধপূজা হতো, পঞ্চশীল-অষ্টশীল নেওয়া হতো। ভিক্ষুসংঘকে পিণ্ডদান করা হতো, প্রদীপ জ্বালানো হতো, সমবেত প্রার্থনা করা হতো, আরও কত কিছু করা হতো ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে। কিন্তু পূর্ণিমার রাতেই সব শেষ হয়ে গেল।

সরকার এ ঘটনার বিচারের আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত অপরাধীদের সাজা হয়নি আজও। জানা গেছে, সে সময় কক্সবাজার ও নিকটবর্তী অন্যান্য জায়গায় যারা প্রশাসনের উচ্চপদে ছিলেন, বর্তমানে তারা পদোন্নতি নিয়ে আছেন ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে। ভস্মীভূত সেই প্রাচীন বৌদ্ধ ঐতিহ্যগুলো দেশ-বিদেশের পর্যটকদের জন্য কত মূল্যবান ও আকর্ষণীয় ছিল, তা বলাই বাহুল্য। পরবর্তী সময়ে সরকার আধুনিক নির্মাণশৈলীতে অনেক কিছু তৈরি করে দিলেও ওই প্রাচীন ঐতিহ্য আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্যও দেশ-বিদেশ থেকে পণ্ডিত-গবেষকরা আর আসবেন না।

বৌদ্ধদের প্রশ্ন-সেই উত্তম বড়ুয়া এখন কোথায়? জীবিত না মৃত? ওই ঘটনার বিচার দৃশ্যমান হলো না কেন? ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার ও শাস্তি হলো না কেন? প্রশাসনের এত নজরদারি থাকতে সেদিন গানপাউডারসহ এত রাসায়নিক দ্রব্য কীভাবে, কোত্থেকে আনা হয়েছিল? গোটা কক্সবাজারের প্রশাসন সেদিন নীরব ছিল কেন? পরদিন আবার রামু, উখিয়া ও পটিয়ার কয়েকটি বিহারসহ ধর্মীয় স্থাপনা কীভাবে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো? আমরা আর এ রকম বর্বরতা দেখতে চাই না। এ দেশ সবার। এ দেশকে অসাম্প্রদায়িক বলে দাবি করি আমরা। আমাদের প্রার্থনা-সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক। ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’-এ নীতি যেন আমরা সবাই পালন করি। আবারও বলতে চাই, হাজার বছরের আমাদের সম্প্রীতির বন্ধন যেন অটুট থাকে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে-সুখ সঙ্ঘসস সামগ্গি সামগ্গনং তপো সুখো। অর্থাৎ একত্রে বসবাস করা সুখকর, একত্রে মিলন সুখকর এবং একসঙ্গে তপস্যাজনিত সর্বতো কল্যাণসাধনও সুখকর। অতএব চলুন আমরা আজ সবাই এ শিক্ষায় নিজেদের গড়ে তুলি, শান্তি-শৃঙ্খলায় এবং দেশ, সমাজ ও জাতির উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে একত্রে কাজ করি এবং ঐক্যবদ্ধ হই। সব্বে সত্তা সুখিতা ভবন্তু-জগতের সব জীব সুখী হোক। জয় হোক মানবতার। বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক।

লেখক সাবেক চেয়ারম্যান, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন-বাংলাদেশ চ্যাপ্টার 

skbaruadu@gmail.com

Sunday, October 10, 2021

দামে দিশাহারা ক্রেতা, এখন সংসার চালানোই দায় — ফাইজ তাইয়েব আহমেদ

সূত্র প্রথম আলো 



দামে দিশাহারা ক্রেতা, এখন সংসার চালানোই দায়। মূল্যস্ফীতি অসহনীয় এবং সরকারের মূল্যস্ফীতির তথ্য ডাহা মিথ্যা।

করোনাভাইরাস মহামারি মাঝামাঝি স্তর পার হবার পর থেকেই আমি বলে আসছি বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি প্রায় দুই অঙ্কের কাছাকাছি। ছবির দুটি তালিকা মিলিয়ে দেখুন, বাৎসরিক হিসেবে মূল্যস্ফীতি সরকার ঘোষিত সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ। খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভুত উভয় মূল্যস্ফিতিই ৯% এর উপরে। অর্থাৎ সরকার ও বিবিএস এর মূল্যস্ফীতির (৪,৫% থেকে ৫%) হিসাব মিথ্যা। 

সরকারের অর্থাৎ পরিসংখ্যান ব্যুরো মূল্যস্ফীতি বের করার প্রক্রিয়াটা ভয়াবহ জালিয়াতিতে ভরা।

চালের দাম তিন মাসে কেজি প্রতি ১২ থেকে ১৫ টাকা করে বাড়লে, ভোজ্যতেলের দাম লিটার প্রতি ৩০-৪০ টাকা বাড়লে, এলপি গ্যাসের দাম সিলিন্ডার প্রতি ১৫০-২০০ টাকা বাড়লে, ঠিক কিভাবে খাদ্য ইনফ্লাশন ৫% এর মধ্যে থাকে? 

বাজার দরের যে অবস্থা, অবশ্যই মূল্যস্ফীতি দুই অংকের ঘরে অবস্থান করছে। এখানে দুটা বিষয়। প্রথমত সরকারের মূল্যস্ফীতি নির্ণয়ের কারিগরি পদ্ধতি ভুল। দ্বিতীয় হচ্ছে, সেকেলে যে পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি নির্ণয় করা হয় তাতে পর্যাপ্ত স্যাম্পল ও পণ্য কোনটাই থাকে না।

মূল্যস্ফীতি পরিমাপের নতুন পুরানো বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। পুরানো-ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) পদ্ধতি থেকে নতুন এভরিডে প্রাইস ইনডেক্স বা ইপিআই পদ্ধতিতে যেতে হবে। এতে গেলে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি দ্বিগুণের বেশি দেখাবে, যা প্রকৃত বাস্তবতা।

আমি মনে করি পুরানো হলেও খোদ সিপিআই ভিত্তিক হিসাবেই বড় জালিয়াতি করে সরকার ও বিবিএস। পুরানো মূল্যস্ফীতি পরিমাপের বাস্কেটেও অনেক পণ্যই সংযুক্ত করা হয়নি। ভ্যাট নীতিমালায় দেখাবেন প্রায় এগারশত পণ্যকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অথচ এরা সুবিধামত মাত্র কয়েকটা পণ্য দিয়ে সুবিধাজনক সময়ের আগে পরে (যখন দাম কিছুটা সহনীয় থাকে) শহরের আড়তের কাছাকাছি স্থানের কম দামের জায়গায় গিয়ে কয়েকটা মাত্র স্যাম্পল নিয়ে মূল্যস্ফীতি হিসাব করে ফেলে। অথচ একই পণ্যের খুচরা মূল্য পাড়া গ্রামে কিংবা মফস্বল অঞ্চলে বেশি। এরা এমনভাবে সার্ভে করে যাতে মূল্যস্ফীতি ৫% এর আশেপাশে দেখায় (সিলেকসান বায়াস)। এগুলা ডেটা ম্যানিপুলেটেড। যেখানে ডেটা বাড়িয়ে দেখালে সূচক ভালো দেখায় (জিডিপি, বাজেট, মাথাপিছু আয়) সেখানে এক্সেলে ইনপুট বাড়ায়ে দেখানো হয়। আর যেখানে ডেটা কমিয়ে দেখালে সূচক ভালো হয় (জনসংখ্যা, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি) সেখানে তথ্য চুরি করে সূচক জালিয়াতি করা হয়।

এখন আসেন, মূল জালিয়াতিটা কোথায়? মূল জালিয়াতিটা জিডিপির হিসাবে।

নমিনাল জিডিপি থেকে মূল্যস্ফীতি বাদ দিয়ে রিয়েল জিডিপি বের করা হয়। মুলত রিয়েল জিডিপি উপর দাঁড়িয়ে অর্থনৈতিক সূচক ক্যালকুলেশান করা হয়। আপনি যদি দেখেন, ক্যাবের হিসাবে খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভুত উভয় মূল্যস্ফীতিই এক থেকে দুই শতাংশ বেশি থাকে। কিন্তু অতীতে ক্যাবের সাথে সারকারের মূল্যস্ফীতি হিসাবের কখনো ৩% আবার কখনও বা ৭% পার্থক্য ছিল (২০১১ থেকে ২০১৪)। এখন আমরা যদি এক দশকের গড় বের করি তাইলে দেখবেন এই দশকে গড়ে ২,৫ থেকে ৩% মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দেখানো আছে। এর মানে হচ্ছে এই দশকে গড়ে জিডিপিও ২,৫ থেকে ৩% বাড়িয়ে দেখানো।

এসব জালিয়াতি নিয়ে দেশের সিনিয়র অর্থনীতিবিদরা কথা বলেন না কেন? উনাদের সমস্যা কোথায়? দুর্বৃত্ত সিস্টেম বুঝায়? নাকি সরকারের হয়রানির ভয়?

এটা বলার সময় হয়ে গেছে যে রেমিটেন্সে দেয়া ২% প্রণোদনা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে সাহায্য করছে। প্রনোদনা ১% এ নামিয়ে আনা উচিৎ। আমি আগে বলেছি, হুন্ডিদের বা পাচার কারীদের কারেন্সি কনভার্শন লস যা হয় তার কাছাকাছি থাকতে পারে প্রণোদনা। মূলত রেমিটেন্স আগমন হুন্ডির মত রিয়েল টাইম করতে পারাটাই মূল কাজ। বাংলাদেশের ব্যাংক গুলোর হাই কোর্ট দেখানোও হুন্ডির অন্যতম কারণ, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সচল হয়ে পড়ায় হুন্ডি চক্রও সচল হয়ে রেমিটেন্স কমে যেতে শুরু করেছে। রেমিটেন্সে দেয়া প্রণোদনা কত শতাংশ হবে এই বিষয়টা গবেষণার বিষয় হয়ে গেছে।

করোনার পরে ক্যাপিটাল মেশিনারির দাম বাড়তে কিছু বেড়েছে। সে হিসাবে নতুন উৎপাদিত খাদ্য বহির্ভুত পণ্যের দাম কিছু বাড়বে। কিন্তু তাতে সংগতি থাকা চাই। আমদানিহীন দেশীয় পণ্যে আন্তর্জাতিক হারের দ্বিগুণ হারে দাম বাড়ার যুক্তি কি?

সরকারের মনিটারি পলিসি অর্থাৎ বাজারে সস্তায় মুদ্রা সরবারহের নীতি এবং করোনা প্রণোদনা প্যাকেজের নামে নতুন টাকা ছাপানোর অভিযোগ মূল্যস্ফীতির লাগামহীনতার মাধ্যমে প্রমাণিত।

যেহেতু প্রণোদনা প্যাকেজ বিনিয়োগে আসেনি, বরং কম সুদের নতুন ঋণের মাধ্যমে উচ্চ সুদের পুরানো ঋণের অদলবদল হয়েছে (তারল্য বেড়েছে)। নতুন ঋণের একটা অংশও পাচারে পড়েছে তাই ঋণের মাধ্যমে নতুন সম্পদ তৈরি হয়নি। ফলে নিশ্চিত ভাবেই এটা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়েছে।

  • লেখক নেদারল্যান্ডসের ভোডাফোনে কর্মরত প্রকৌশলী এবং টেকসই উন্নয়নবিষয়ক বিশেষজ্ঞ।