একান্ত সাক্ষাৎকারে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
হামিদ বিশ্বাস
বাজেট হতে হবে স্বচ্ছ, বস্তুনিষ্ঠ ও বাস্তবায়নযোগ্য। বেসরকারি ব্যাংকের মাত্র কয়েক উদ্যোক্তা পরিচালকের কাছে শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক নয়, অর্থ মন্ত্রণালয়; এমনকি সরকারও জিম্মি হয়ে পড়েছে। এভাবে জিম্মিদশা চলতে থাকলে পাকিস্তান আমলে ২২ পরিবারের মতো কয়েক ব্যক্তিবিশেষের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে ব্যাংকিং খাত, যা অর্থনীতির পরিপন্থী। যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ সংশয় প্রকাশ করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- হামিদ বিশ্বাস
যুগান্তর : বাজেট কেমন হওয়া উচিত?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : প্রতি বছর বিশাল বাজেট দেয়া হয়। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয় না। অবাস্তব বাজেট এক ধরনের চাটুকারিতা ও প্রতারণার শামিল। তাই বাজেট হতে হবে স্বচ্ছ, বস্তুনিষ্ঠ ও বাস্তবায়নযোগ্য।
যুগান্তর : বাজেটে জনগণের করের টাকা থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জন্য বরাদ্দ রাখার যৌক্তিকতা কী?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে লুটতরাজ করে, বছর শেষে বাজেট থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়া অনৈতিক ব্যবস্থা, যা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। এ ব্যবস্থার বিলোপ চাই। এসব ব্যাংককে মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। এর আগে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে সরকারি ব্যাংক কখনও লাভের মুখ দেখবে না।
যুগান্তর : বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকদের একের পর এক সুবিধা দেয়ার বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকদের আর কোনো সুবিধা দেয়া ঠিক হবে না। ধীরে ধীরে তারা গ্রাস করে ফেলছে ব্যাংকিং খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদ টাকা জমার হার (সিআরআর) বাবদ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা, সরকারি তহবিলের ৫০ শতাংশসহ চারটি সুবিধা নিয়েছে।
বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘ব্যাংক ঋণের সুদ সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে।’ কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কথা তারা শোনেনি। ঋণের সুদ এক টাকাও কমায়নি। উল্টো কোনো কোনো ব্যাংক সুদ আরও বাড়িয়েছে। এখন তারা রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের বিনিয়োগযোগ্য প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা নামমাত্র দেড় থেকে দুই শতাংশ সুদে নেয়ার ফন্দি করছে।
এটা দেয়া কিছুতেই ঠিক হবে না। এর আগে তারা নিজেদের প্রয়োজনে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করেছিলেন। যেখানে একই পরিবারের চারজন পরিচালক এবং টানা ৯ বছর থাকার বিধান রাখা হয়।
এতে করে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো মাত্র কয়েক উদ্যোক্তা পরিচালকের কাছে জিম্মি হয়ে গেল। খুব শিগগিরই আইনটি পরিবর্তন না হলে পাকিস্তান আমলের ২২ পরিবারের মতো গুটিকয়েকজনের হাতে চলে যাবে ব্যাংকিং খাতের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ, যা কিছুতেই শোভনীয় নয় এবং বঙ্গবন্ধুর অর্থনীতির পরিপন্থী।
যুগান্তর : ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম-দুর্নীতিরোধে বাজেটে কী ধরনের নির্দেশনা থাকা দরকার?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : এবারের বাজেটে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। এর অংশ হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে’ তুলে নিতে হবে। কারণ বিভাগটি চালু হওয়ার পর থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বেপরোয়া হয়ে যায়।
গত কয়েক বছরে রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা এমডি ও ডিএমডি নিয়োগ দিয়েছিল এ বিভাগ। ওইসব বোর্ড এবং ম্যানেজমেন্টের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ব্যাপক দুর্নীতি হয়। বিশেষ করে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি এবং বেসিক ব্যাংকে ভয়াবহ লুটপাট সংঘটিত হয়। এসব ঘটনায় উল্লেখযোগ্য কারও বিচার হয়নি।
বিচারহীনতার কারণে পরবর্তী সময়ে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতেও দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ব্যাংকিং খাতের আজকের করুণ পরিণতির দায়-ভার আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে নিতে হবে। এছাড়া কয়েক বছরে ব্যাংকিং খাতে যে লুটপাট হয়েছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে। এজন্য একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করা খুব জরুরি। পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতকে ঢেলে সাজানোর জন্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা যেতে পারে।
যুগান্তর : বাজেটে বড় চ্যালেঞ্জ কী?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : এবারের বাজেটে বেশ কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, টাকা-পয়সার অপব্যবহার হতে পারে। এর সদ্ব্যবহার নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অর্থের অপচয় রোধে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, সংসদ সদস্যরা নিজ এলাকায় জনতুষ্টির জন্য অনেক প্রকল্প নিতে পারেন। প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই হওয়া উচিত। তৃতীয়ত, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা। চতুর্থত, দেশে আয়-বৈষম্য দূর করা এবং শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।
যুগান্তর : সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : এবার বাজেটে এমন কিছু ব্যবস্থা থাকা উচিত, যা দুটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যা লাঘবে অবদান রাখতে পারে। সমস্যা দুটি হল মানুষে মানুষে আয় বৈষম্য হ্রাসকরণ এবং শিক্ষিত বেকারদের জন্য কর্মসৃজন।
এ উদ্দেশ্যে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। ধীরে ধীরে জাতীয় আয়ের ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত বরাদ্দ বাড়াতে হবে। বরাদ্দ অর্থের সুষ্ঠু ও যথার্থ বিতরণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
এছাড়া নিুবিত্তদের মধ্যবিত্তে উত্তরণ এবং মধ্যবিত্তদের উচ্চমধ্যবিত্তে উত্তরণের কৌশল গ্রহণ করতে হবে। এ লক্ষ্যে, সাবকন্ট্রাক্টিং পদ্ধতিকে উৎসাহিত করতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সম্প্রসারণে ফলপ্রসূ প্রণোদনা দিতে হবে। এছাড়া মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করযোগ্য ব্যক্তি আয়ের সীমা বাড়াতে হবে।
আয়হীন বৃদ্ধ ব্যক্তিদেরও পর্যাপ্ত রেয়াত দিতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে কাজের পরিমাণ ও অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ নির্ধারণ করে মনিটরিং করতে হবে। যাতে বছর শেষে দুতিন মাসে ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতা রোধ করা যায়।
- কার্টেসিঃ যুগান্তর/ মে ৩০,২০১৮