এম সাখাওয়াত হোসেন
এ বছরের মাঝামাঝি থেকে আগামী বছরের মাঝামাঝি উপমহাদেশের তিনটি বড় দেশ বাংলাদেশ, ভারত আর পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে পাকিস্তানে নির্বাচনের তারিখ হচ্ছে এ বছরের ২৫ জুলাই। বাংলাদেশের নির্বাচনও এ বছরের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করা যায়। ভারতে নির্বাচন তো সারা বছরই লেগে থাকে। হয় স্থানীয় না হয় রাজ্য বিধানসভার আর না হয় বিধানসভা ও লোকসভার উপনির্বাচন। এরই মধ্যে আগাম নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে। কয়েকটি রাজ্যে ভালো করলেও হালের কয়েকটি নির্বাচনে বিজেপির জনপ্রিয়তা কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
কর্ণাটকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার পরও মিত্রহীন বিজেপি সরকার গঠন করতে পারেনি। রাজ্যপাল সরকার গঠনে গড়িমসি করার কারণে সুপ্রিম কোর্ট মাত্র এক দিনের সময় বেঁধে দিয়েছিল। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা সব সময় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে যেমন সমুন্নত রেখেছে, তেমনি নির্বাচন কমিশনকে তার কাজে সহযোগিতা করে গেছে। এবং এ কারণেই ভারতীয় নির্বাচন কমিশন আফ্রো-এশিয়ান দেশগুলোর মধ্যে স্বাধীন ও শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টও স্বপ্রণোদিত হয়ে নির্বাচন কমিশনের কাজকে সহায়তা করে। হালে পাকিস্তানের কোর্ট বলেছেন, রাষ্ট্রীয় খরচে নির্বাচন প্রচারণা চালানোর অনুমতি দেওয়া হবে না। আদেশে আরও বলা হয়েছে যে রাজনীতিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব তাঁদের নিজেদেরই (প্রথম আলো, ৭ জুন ২০১৮)।
এ ধরনের আদেশ নির্বাচন কমিশনের হাতকে শক্তিশালী করে।
উপনিবেশ-উত্তর আফ্রো-এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রথম স্বাধীন নির্বাচন কমিশন হিসেবে ভারতের নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং নির্বাচনী আইনসমূহ অন্তত এই উপমহাদেশের প্রায় সব কটি দেশই অনুসরণ করেছে। সর্বশেষ নেপাল। নেপালের আইন ভারতের অনুসরণে হলেও ওই দেশের আর্থসামাজিক পরিবেশের কারণে কিছুটা তফাত রয়েছে। তবে নেপালের স্বাধীন নির্বাচন কমিশনও ভারতের অনুসরণে তিনটি ভালো নির্বাচন উপহার দিয়েছে।
২০১৭ সালের নেপালের সংবিধানের প্রথম নির্বাচনটি দেশে-বিদেশে যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছে। ওই নির্বাচনে শাসক দল নেপালি কংগ্রেস তৃতীয় স্থানে থাকার কারণে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মতে, নেপালের নির্বাচন কমিশন ওই নির্বাচনে যথেষ্ট বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিল। নেপালে একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ও প্রথমবারের মতো প্রাদেশিক নির্বাচন হয়েছিল।
আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্বাচনী আইন তৈরি হয়েছিল ভারতের অনুসরণে। একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী আইন আরপিও ১৯৭২-এর বহু ধারা হুবহু ভারতের মতো। অবশ্য পরে আরপিওতে অনেক সংশোধনী হয়েছে। বড় ধরনের সংশোধনী প্রথমে আসে ২০০১-এ এবং সবচেয়ে কার্যকর সংশোধনী আনা হয় ২০০৮ সালে। ওই সময়ে ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের আচরণবিধি এবং নির্বাচনী আইনের বহু কার্যকর ধারাকে আমাদের দেশের উপযোগী করে সংযোজন করা হয়েছিল। এ ধরনের আদান-প্রদান এবং একে অপরের ‘ভালো দিকগুলো’ গ্রহণ করার প্রথা সমগ্র বিশ্বেই রয়েছে।
ভারতের নির্বাচন এবং নির্বাচনী আইন ও তার প্রয়োগ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয় পাকিস্তানে। পাকিস্তানের আইন বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘পিলদাত’ পাকিস্তানের স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কার্যক্ষমতা এবং নির্বাচনী আইন সংস্কার করে প্রায়োগিক ক্ষমতা বাড়ানোর সুপারিশ করে আসছে। অন্যদিকে নির্বাচনের সময় পাকিস্তানের সংসদ অনেকটা বাংলাদেশের বর্তমানে বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গ্রহণ করে, যাতে নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে। অভিজ্ঞতার আলোকে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিরপেক্ষ ও কার্যকর রূপ দিতে পাকিস্তানের সংবিধানে ২০১২ সালে ২০তম সংশোধনী আনা হয়। যার মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ২২৪ (এ) সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়োগের রাষ্ট্রপতি ক্ষমতা রদ করে সংসদে দেওয়া হয়। অনুচ্ছেদ ২২৪ (বি) সংযুক্ত করা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়োগের প্রক্রিয়া সংবিধানে যুক্ত করা হয়। এই বিধান অনুযায়ী সংসদের নেতা, প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদে বিরোধী দলের নেতা মিলে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের জন্য চারটি নামের মধ্যে একজনকে সর্বসম্মতিক্রমে নিয়োগের জন্য নির্ধারিত করবেন। যদি মতৈক্য না হয়, তবে সংসদের উভয় পক্ষ থেকে সমসদস্যের সমন্বয়ে কমিটি গঠিত হবে এবং তাদের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হবে। সেখানেও যদি মতৈক্যে পৌঁছাতে না পারে, সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন ওই লিস্ট থেকে একজনকে নিয়োগের জন্য নির্ধারণ করে রাষ্ট্রপতির নিকট পাঠাবে নিয়োগের জন্য। সংসদীয় কমিটি অথবা দুই বেঞ্চের নেতাদের মতৈক্যে পৌঁছার জন্য তিন দিনের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে নির্ধারণ করতে হলে মোট চার দিনের সময়ের মধ্যেই নিয়োগ দিতে হবে।
২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে সংসদ বিলুপ্ত হওয়ার পর সর্বসম্মতিক্রমে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নাসিরুল মূলক তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী নিয়োজিত হয়েছেন। অনেক আলোচনা, গবেষণা এবং বিতর্কের পর সংবিধানে দুই সংশোধনীর মাধ্যমে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের কাঠামোতে যেমন পরিবর্তন আনা হয়েছে, তেমনি নির্বাচন কমিশনের হাতকে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে। এককথায়, পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনী সময়ের জন্য ‘সুপার ইমপোজড’ সরকারের তদারকির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যেমনটা ভারতীয় নির্বাচন কমিশন করে থাকে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন ২০১১ সালে এ ধরনের সুপারিশ করেছিল, যা আলোর
মুখ দেখেনি।
পাকিস্তানের নতুন আইনে সমগ্র নির্বাচন-প্রক্রিয়াকে আরও আয়ত্তে রাখার জন্য জেলা অথবা সম অঞ্চলে একজন জেলা রিটার্নিং অফিসারকে নিয়োগ দেওয়া হয়। অন্যদিকে প্রতিটি সংসদীয় আসনের জন্য একজন রিটার্নিং অফিসার এবং একজন সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়। জেলা রিটার্নিং অফিসার পদে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা অথবা জেলা পর্যায়ের বিচারককে নিয়োগ দেওয়ার বিধান রয়েছে। অন্যদিকে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয় নিজেদের কর্মকর্তা অথবা সরকারি কর্মকর্তা এবং সরকার-নিয়ন্ত্রিত সংস্থা থেকে।
জেলা রিটার্নিং অফিসার সব রিটার্নিং অফিসারের সমন্বয়, পোলিং স্টেশন স্থাপন, প্রিসাইডিং অফিসার ও অন্যান্য অফিসার নিয়োগ এবং তাঁর আওতাধীন নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা করেন। রিটার্নিং অফিসার তাঁর অধীনের সংসদীয় আসনের প্রচারণা থেকে ভোট গ্রহণ এবং ফলাফল একত্রীকরণের দায়িত্ব সম্পাদন করেন। এ ব্যবস্থায় রিটার্নিং কর্মকর্তা একটি আসনের নির্বাচন-প্রক্রিয়াকে অধিকতর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত হয়েছে যে ২০১৮ সালের নির্বাচনে জেলার অতিরিক্ত দায়রা বিচারককে জেলা রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দেওয়া হতে পারে। বাংলাদেশ ছাড়া উপমহাদেশের তিনটি দেশেই অনুরূপভাবে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের নির্বাচনী আইনেও বর্তমান অবস্থায় নির্বাচন কমিশন যেকোনো সরকারি কর্মকর্তা অথবা প্রয়োজনে বিচার বিভাগের জেলার বিচারককে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই বিচার বিভাগের সঙ্গে আগাম পরামর্শের প্রয়োজন হবে। একই আইনে একটি জেলায় একাধিক রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের অবকাশ রয়েছে। প্রতিটি সংসদীয় আসনের জন্য আলাদা রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের প্রবিধান রয়েছে আরপিওর ধারা ৭ অনুযায়ী।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ভবিষ্যতে যেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক এবং সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও সর্বজনগৃহীত করতে হলে আরপিওর অধিক সংস্কারের প্রয়োজন যেমন রয়েছে, তেমনি বিভিন্ন ধারা প্রয়োগ করার পরিকল্পনা এখনই করতে হবে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশের আইন ও বিধির অনুসরণীয় ধারাগুলোকে খতিয়ে দেখা এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। যদিও সময় কম, তবে নির্বাচন কমিশন বর্তমান আইনের আওতায় এবং আচরণবিধিকে আরও যুগোপযোগী করে কিছু ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে হবে। উপমহাদেশের অন্যান্য দেশ নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠু করতে পারলে আমরা পারব না কেন? বর্তমান অবস্থাতেই আইনিভাবে নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট শক্তিশালী। তবে প্রয়োজন আরও কিছু সংস্কারের এবং কঠোর ও নির্মোহভাবে আইনের প্রয়োগ।
- Courtesy: Prothom Alo /June 08, 2018