ড. বদিউল আলম মজুমদার
সাম্প্রতিক কিশোর-তরুণ বিক্ষোভ শুধু নিরাপদ সড়কের দাবিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তারা আমাদের বিরাজমান দুর্নীতিগ্রস্ত, নিবর্তনমূলক ও অসম রাষ্ট্রকাঠামোর ‘মেরামতের’ও তাগিদ দিচ্ছিল। কারণ বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামো যে সাধারণ নাগরিকের পরিবর্তে কোটারি স্বার্থই সংরক্ষণ করে, পরিবহন খাত যার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। তবে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আমূল পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন কতগুলো সর্বব্যাপী গভীর সংস্কার। আর এমন সংস্কারের জন্য প্রয়োজন হবে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা ও ঐকমত্য। কারণ, এসব সংস্কার হতে হবে ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি’।
এক দশকের বেশি সময় ধরে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) পক্ষ থেকে আমরা কতগুলো সুদূরপ্রসারী সংস্কার প্রস্তাবসংবলিত একটি ‘জাতীয় সনদ’ নিয়ে জনমত সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছি, যা আমাদের রাজনৈতিক দল ও অন্য স্বার্থসংশ্লিষ্টদের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস। জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলো হলো:
১. কার্যকর জাতীয় সংসদ: জাতীয় সংসদকে একটি স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা, যাতে এটি নির্বাহী বিভাগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে। সংসদ সদস্যদের জন্য একটি আচরণবিধি আইন ও সাংবিধানিক নির্দেশানুযায়ী একটি ‘সংসদ ও সংসদ সদস্যদের অধিকার ও দায়মুক্তি আইন’ প্রণয়ন করা।সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো কার্যকর করা।
২. স্বাধীন বিচার বিভাগ: সত্যিকারের পৃথক্করণের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং আইনের শাসন কায়েম করা। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ ও অপসারণের জন্য একটি আইন প্রণয়ন করা। আদালতকে, বিশেষ করে নিম্ন আদালতকে প্রভাবিত করার, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা রুজু ও রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারের সংস্কৃতির অবসান করা।
৩. নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন: সঠিক ব্যক্তিদের স্বচ্ছতার সঙ্গে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের লক্ষ্যে সাংবিধানিক নির্দেশনা অনুযায়ী একটি আইন প্রণয়ন এবং তা অনুসরণে কমিশনে নিয়োগ প্রদান করা। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কমিশনকে প্রয়োজনীয় আর্থিক এবং জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা প্রদান ও আইনি কাঠামোতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করা।
৪. সাংবিধানিক সংস্কার: সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য সৃষ্টি, সংসদে এক-তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণ, ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান, গণভোটের বিধানের পুনঃপ্রবর্তন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য একটি বড় আকারের ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ গঠন, সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা এবং ‘টার্ম লিমিটে’র বিধান ইত্যাদি হতে পারে সম্ভাব্য সাংবিধানিক সংস্কারের ক্ষেত্র।
৫. গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক দল: গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ রাজনৈতিক দল গঠনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন, দলের মনোনয়ন ও অর্থায়নে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা এবং দলীয়করণের সংস্কৃতির অবসান করা। রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে উগ্রবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, পরিচয়ভিত্তিক বিদ্বেষ ও সহিংসতা পরিহার করার অঙ্গীকার নিশ্চিত করা। দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন বিলুপ্ত করা।
৬. স্বাধীন বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান: সঠিক ব্যক্তিদের নিয়োগ ও যথাযথ আইনি সংস্কারের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশনের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করা।
৭. দুর্নীতিবিরোধী সর্বাত্মক অভিযান: বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা। বিদেশে অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা এবং বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ন্যায়পাল নিয়োগ করা।
৮. যথাযথ প্রশাসনিক সংস্কার: একটি যুগোপযোগী জনপ্রশাসন আইন প্রণয়ন এবং মান্ধাতার আমলের পুলিশ আইনের সংস্কার করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা ও পেশাদারি নিশ্চিত এবং নিয়োগ-বাণিজ্যের অবসানের মাধ্যমে এগুলোকে সত্যিকারের সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। সরকারি কর্ম কমিশনের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করা।
৯.বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকার: একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদের আলোকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন ও কার্যকর করা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৫০ শতাংশ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যয় এবং উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী স্থানীয় সরকারে সাংসদদের ভূমিকার অবসান করা।
১০. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা: যথাযথ আইনি সংস্কারের মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের লক্ষ্যে যোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি জাতীয় সম্প্রচার বোর্ড গঠন করা।
১১. মানবাধিকার সংরক্ষণ: মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারাসহ সব নিবর্তনমূলক আইনের সংস্কার করা। গুম, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অবসানের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংস্কৃতির অবসান করা।
১২. একটি নতুন সামাজিক চুক্তি: সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদে তাদের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাদের ঋণ প্রদানে ভর্তুকি দেওয়াসহ প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য যুগোপযোগী শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত এবং তাদের জন্য শস্য ও স্বাস্থ্যবিমার প্রচলন করা ইত্যাদি।
১৩. পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা: জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। সম্ভাব্য পরিবেশবিধ্বংসী উন্নয়ন প্রকল্প পুনর্মূল্যায়ন করা।
১৪. আর্থিক খাতের সংস্কার: আর্থিক খাতে লুটপাট প্রতিরোধে ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কার এবং লুটপাটকারীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা। ব্যাংকিং খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা ও নিবিড় তদারকি নিশ্চিত করা।
১৫. তরুণদের জন্য বিনিয়োগ: জনসংখ্যাজনিত সুযোগ বা ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’কে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে তরুণদের জন্য আরও বিনিয়োগ করা। তাদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা নিশ্চিত ও সুযোগ সৃষ্টি করা। এসবের অভাবে তরুণেরা বিপথগামী হলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ‘ডেমোগ্রাফিক নাইটমেয়ার’ বা দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে।
উপরিউক্ত ১৫ দফাবিশিষ্ট জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলেই রাষ্ট্র মেরামতের তথা সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে। তবে জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন হবে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকার। তাই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সম্পর্কেও আমাদের ঐকমত্য সৃষ্টি হতে হবে।
সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর নির্বাচন কমিশন আবশ্যক। তবে একটি সর্বাধিক শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভবপর নয়, যদি সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সরকার তথা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কমিশনকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান না করে; অর্থাৎ একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আবশ্যক (necessary), কিন্তু যথেষ্ট (sufficient) নয়। ১৯৯১ সালের পর থেকে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রমাগত ও লাগামহীন দলীয়করণের ফলে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা এখন আর সম্ভব নয়। তাই নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার সম্পর্কেও আমাদের রাজনৈতিক ঐকমত্য সৃষ্টি হতে হবে।
সাম্প্রতিক পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে আমাদের বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই নির্বাচনের আগে কমিশনের পুনর্গঠন জরুরি। ‘না ভোট’–এর বিধান ও হলফনামায় কিছু পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও তা যাচাই-বাছাইয়ের বাধ্যবাধকতার বিধানসহ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে ১৯৭২-এ কিছু পরিবর্তনও আবশ্যক। তবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আরও প্রয়োজন হবে নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া।
আশা করি, কিশোর-তরুণদের রাষ্ট্র মেরামতের দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে আমাদের সম্মানিত রাজনীতিবিদেরা জাতীয় পর্যায়ে আলাপ-আলোচনায় আগ্রহী হবেন। এ ধরনের যেকোনো পর্যায়ের আলোচনায় প্রস্তাবিত জাতীয় সনদটি প্রাথমিক অ্যাজেন্ডা হিসেবেব্যবহৃত হতে পারে। আমরা আরও আশা করি, তাঁরা একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাবেন, একটি জাতীয় সনদ স্বাক্ষর করবেন এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের গণতান্ত্রিক উত্তরণ ঘটাবেন। তাহলেই সব ধরনের সংঘাত-সহিংসতা এবং অনিশ্চয়তা এড়িয়ে জাতি হিসেবে আমরা শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারব।
- ড. বদিউল আলম মজুমদার সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ আগস্ট ২৯, ২০১৮