সম্পাদকীয়
প্রস্তাবিত আইনটি ঠেকানোর চেষ্টা করুন
‘সরকারি চাকরি আইন’ শিরোনামে যেই আইনের খসড়াটি মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেয়েছে, তা যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ক্ষমতা খর্ব করবে—সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সরাসরি আইনটির বিরোধিতা করেননি। অনেকটা রাজনৈতিক নেতাদের সুরে সুর মিলিয়ে তিনি বলেছেন, ‘যেসব অসৎ ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা রয়েছেন, তাঁদের উচ্ছ্বসিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। দুদক যত দিন স্বাধীন আছে, তত দিন তারা স্বাধীনভাবেই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবে।’
দুদকের বিদ্যমান আইনের ২৮-এর ১ ধারা অনুযায়ী, যেকোনো সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজ বা মামলার আসামিকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা যায়। দুদক এই আইনি ক্ষমতাবলে গত আড়াই বছরে ৬ শতাধিক আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে চার শতাধিক সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন। ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে হাতেনাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৬০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। একে দুদকের অতীতের গ্লানি ও নিষ্ক্রিয়তা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। যদিও তারা বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু এবং এ ধরনের আরও অনেক অভিযুক্ত বড় বড় দুর্নীতিবাজকে আইনের আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে।
উল্লেখ্য, সরকারি কর্মকর্তারা শুরু থেকেই দুদকের সংশ্লিষ্ট আইন নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন। এত দিন সরকার সাড়া না দিলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কেন আইনটি সংশোধনের প্রয়োজন পড়ল, তা মস্ত বড় প্রশ্ন বটে। বিদ্যমান আইনে কোনো সৎ সরকারি কর্মকর্তা নাজেহাল হয়েছেন, এ রকম একটি উদাহরণও নেই। দুদক গোয়েন্দা সূত্রে খবর নিয়ে হাতেনাতে অনেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে ধরেছে। নতুন আইন কার্যকর হওয়ার পর সেই সুযোগ আর থাকবে না। কিন্তু যাঁরা সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী নন, এমন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার আগেও দুদক ধরতে পারবে। সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে এক নিয়ম আর সরকারি কর্মকর্তাদের বেলায় অন্য নিয়ম হতে পারে না। এটা নাগরিকদের সমানাধিকারের পরিপন্থী।
দুদক চেয়ারম্যান অবশ্য আশা করছেন, দুদক যত দিন স্বাধীন আছে, তত দিন স্বাধীনভাবে কাজ করবে এবং দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তাঁরা মোটেই দ্বিধা করবেন না। যেখানে আইনটি করাই হচ্ছে দুদকের ক্ষমতা খর্ব করতে, সেখানে তাঁর এই আশাবাদের আদৌ কোনো ভিত্তি আছে কি? টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, এ ধরনের আইন পাস হলে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান দুদকের ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে যেখানে সংশ্লিষ্ট আইনগুলো আরও শক্ত করা প্রয়োজন, সেখানে এ ধরনের উদ্যোগ দুর্নীতিবাজদের দায়মুক্তি দেওয়ারই নামান্তর। মন্ত্রিপরিষদ সচিব পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার করতে হলে চার্জশিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে; অর্থাৎ দুদকের বর্তমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযান বাস্তবে অকার্যকর হয়ে পড়বে। বিশেষজ্ঞরা যখন বুঝতে পারছেন প্রস্তাবিত আইনটি দুদকের ক্ষমতা মারাত্মকভাবে খর্ব করবে, তখন দুদক চেয়ারম্যানের উপলব্ধি না করা দুর্ভাগ্যজনক।
রাজনীতিকদের ভাষায় কথা না বলে দুদক চেয়ারম্যানের উচিত হবে আইনটি যাতে জাতীয় সংসদে পাস না হয়, সে ব্যাপারে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। দুদক যে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, সে কথা শুধু মুখে বললেই হবে না, কাজেও প্রমাণ করতে হবে। প্রয়োজনে তিনি উচ্চ আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন। কেননা, প্রস্তাবিত আইনটি ২০০৪ সালের দুদক আইনের পরিপন্থী। দুদকের সাবেক চেয়ারম্যানের ভাষায় দেশবাসী এই প্রতিষ্ঠানটিকে আর ‘নখদন্তহীন বাঘ’ হিসেবে দেখতে চায় না; তারা দেখতে চায় সত্যিকার দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান হিসেবে।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ আগস্ট ২৯,২০১৮
No comments:
Post a Comment