শিরোনামের উক্তিটি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) ছাত্রনেতা উমর খালিদের। ১৩ আগস্ট আততায়ীদের আক্রমণ থেকে বেঁচে ওঠার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে তিনি এই মন্তব্য করেন। কী পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সুপরিচিত এক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পিএইচডির গবেষক-শিক্ষার্থী এইরূপ ভয়াবহ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন, সেটা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যদেরও শোনা-বোঝা দরকার।
এ রকম কাহিনি বাংলাদেশের নুরুল হক নুরু কিংবা রাশেদ খানকে নিয়েও লেখা যেত। বিভিন্ন হাসপাতালে পুনঃপুন চিকিৎসা প্রত্যাখ্যানের শিকার আহত ছাত্রনেতা নুরু জুলাই মাসে ধানমন্ডির এক হাসপাতালের ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে সংবাদকর্মীদের উপস্থিতিতেই করুণ আরজি জানাচ্ছিলেন, ‘প্লিজ, আমাকে সেভ করেন।’ নুরুর আরেক সহযোগী রাশেদ খানের মা সালেহা বেগমকে ১২ জুলাই শহীদ মিনারে এক সমাবেশে বলতে দেখা যায়, ‘আমার মনির চাকরির দরকার নাই, আমি সন্তানকে ভিক্ষা চাই।’
উমর খালিদ, নুরু বা রাশেদদের এই কাহিনির মিলের দিক হলো, শেষোক্তরা রাস্তায় নেমেছিল শিক্ষা ও কাজে সম–অধিকারের দাবিতে; আর উমর খালিদদের লড়াই ছিল ক্যাম্পাসে মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য। নুরুরা ক্যাম্পাসে মার খেয়েছেন চাকরিব্যবস্থার সংস্কার চেয়ে। উমর প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছেন সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে। নুরু-রাশেদ-ফারুকদের জন্য কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে, সেটা আমরা জানি না। তাঁদের অনেকে সবে জামিন পেয়েছেন, খালাস নয়। কিন্তু উমর খালিদের জন্য পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে প্রকৃতই ভয়াবহ।
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছর ধরে বিস্তর হেনস্তার শিকার হচ্ছেন উমর ও তাঁর সমচিন্তার বন্ধু অনির্বাণ ভট্টাচার্য, শিহলা রশিদ সোহরা, কানাইয়া কুমার প্রমুখ। তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মোকদ্দমা হয় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। অভিযোগ হলো, উমররা ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ স্লোগান দিয়েছেন। কথিত এই ‘রাষ্ট্রবিরোধিতা’ আসলে ছিল বিজেপির সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নীতির বিরোধিতা এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগ্রামের সঙ্গে সংহতি মাত্র। কিন্তু ভারতের সব প্রান্তেই অধিকারবাদী তরুণদের এখন ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ গালি শুনতে হয়। বিজেপি ও ‘নেশন’ সেখানে একাকার হয়ে গেছে। আর ‘বলার স্বাধীনতা’ হয়ে গেছে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’।
বাংলাদেশেও আমরা দেখেছি কোটার সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবি তোলা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে বাধা দান’, ‘ভাঙচুর’, ‘সংঘর্ষে উসকানি প্রদান’ ইত্যাদি অভিযোগ আনা হয়েছে। আদালতে এসব অভিযোগ তোলার আগেই তাঁদের অনেককে প্রকাশ্যে পেটানো হয়েছে, অনেকে অপহৃত হয়েছেন। অনেকের পরিবার নাজেহাল হয়েছে। এসবের কোনো প্রতিকার হয়নি। ভিন্নমতাবলম্বীদের ক্ষেত্রে এসব জুলুম ‘জায়েজ’, অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
ভারতে উমর সর্বশেষ পিস্তলধারীদের আক্রমণের শিকার হন রাজধানীতে পার্লামেন্ট সন্নিহিত ‘কনস্টিটিউশন ক্লাব’-এর পাশে। উমর সেখানে গিয়েছিলেন ‘ভয়মুক্ত পরিবেশে—স্বাধীনতার পানে’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। ‘ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট হেইট’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা এই সেমিনারের আয়োজন করে ভারতের ৭১তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে।
হামলার পর সবচেয়ে বিস্ময়কর যেটা ঘটেছে, সেটি হলো একদল সাংবাদিক এটা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন যে, উমর মোটেই আক্রান্ত হননি। ব্যাপারটি সাজানো ঘটনা ছিল। বহুল প্রচারিত হিন্দি দৈনিক ভাস্কর-এর একজন সংবাদকর্মী প্রথম এ নিয়ে টুইট করেন। পরে তা শত শতবার রি-টুইট হয়েছে। রি-টুইটকারীরা অধিকাংশই টুইটারে বিজেপির মতাদর্শের সমর্থক বা প্রচারক। এভাবেই ভিন্নমতাবলম্বীদের সহিংসভাবে মোকাবিলার সযত্ন এক মৈত্রী গড়ে উঠেছে রাজনীতি ও মিডিয়ার একাংশের মধ্যে। জনৈক রাজনৈতিক ভাষ্যকার এটিকে বলেছেন, ‘কাল্ট অব ভায়োলেন্স’। বাংলাদেশে আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে আটকের পর তাঁর পরিবারের মৃত ও জীবিত সদস্যদের ঠিকুজি অনুসন্ধানচেষ্টার সঙ্গে এটা বেশ মেলে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, এরূপ প্রচারযুদ্ধে নিজেদের মান-ইজ্জত বাঁচাতে আক্রান্ত ব্যক্তি বা তাঁর স্বজনদেরই এগিয়ে আসতে হচ্ছে। যারা তাঁকে গুলি করেছিল, ১৬ আগস্ট উমর টুইটারে তাদের ছবি দিয়েছেন। সেই টুইটটি প্রায় ৮ হাজার বার রি-টুইট হয়েছে। দেশটির বিপুল মানুষ হত্যাচেষ্টাকারীকে দেখেছে। সুতরাং দেশটির নেতাদের তা না দেখার কারণ নেই। হামলাস্থলটি দিল্লির হাই-সিকিউরিটি জোন। সেখানে সিসি ক্যামেরার নজরদারি ছিল। সেই ফুটেজেও হামলাকারীর সদম্ভ উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। দৌড়ে পালাতে গিয়ে হামলাকারীর হাত থেকে পড়ে যাওয়া একটি পিস্তলও মিলেছে সেখানে। দিল্লি পুলিশের বিশেষ সেল ১৬ আগস্ট এরূপ দুই ব্যক্তিকে আটকও করেছে হরিয়ানা থেকে।
কিন্তু এতসব সত্ত্বেও উমরবিরোধী প্রচারণা থেমে নেই; অর্থাৎ তাঁকে শারীরিকভাবে হত্যাচেষ্টার পাশাপাশি সক্রিয় আছে তাঁর চরিত্র হননও। ভারতে এমন প্রগতিশীল সাংবাদিক, অ্যাকটিভিস্ট এই মুহূর্তে বিরল, যাঁরা অল্পবিস্তর এইরূপ দ্বিমুখী আক্রমণের মুখে নেই। টুইটারে গুলিবর্ষণকারীদের ছবি প্রকাশের আগের দিন, ১৫ আগস্ট উমর ভারতবাসীকে এইরূপ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘প্রতিবাদ হওয়া উচিত—আমার ওপর হামলা হয়েছে বলে নয়, কাল অপর কারও ওপর অনুরূপ হামলা হতে পারে। হামলাকারীরা মূলত গণতন্ত্রকে খুন করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে।’
জেএনইউতে উমর খালিদ ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্ট ইউনিয়নের একজন জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। বিহার ও গুজরাটের দলিতদের সংগ্রাম, ঝাড়খন্ড-ওডিশায় আদিবাসীদের টিকে থাকার লড়াই থেকে শুরু করে কাশ্মীরিদের আজাদির আন্দোলনে উমর ও জেএনইউর শিক্ষার্থীদের সংহতি জানাতে দেখা যায়। ভারতের তরুণদের কাছে জেএনইউ তাই সাহসের এক প্রতীক। বিজেপি ও তার মিত্রদের এটা অপছন্দ। রাজনৈতিক চাপে তাই এই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উমর-শিহলা-কানাইয়া-অনির্বাণের মতো তরুণদের স্তব্ধ করতে তৎপর। গত জুলাইয়ে উমরসহ দুজনের পিএইচডি থিসিস গ্রহণ করতে অস্বীকার করে জেএনইউ। অথচ উচ্চতর গবেষণার সব স্তরে থিসিসগুলো অনুমোদিত হয়েছে। উমর পিএইচডি করেছেন ঝাড়খন্ডের আদিবাসীদের অবস্থা নিয়ে। তাঁর ওপর শাসকদের রুষ্ট হওয়ার এটাও একটা কারণ।
রাষ্ট্রবিরোধিতার অভিযোগে হয়রানি এবং ঘৃণাবাদী অপপ্রচার সত্ত্বেও উমরসহ তাঁর সতীর্থদের তরুণসমাজ সভা-সেমিনারে ডেকে থাকে নিয়মিত। কিন্তু দুই বছর যাবৎ তাঁরা যেখানে যাচ্ছেন, সেখানেই সরকারি দলের ছাত্র শাখা ‘নিখিল ভারত বিদ্যার্থী পরিষদ’ হাঙ্গামা বাধাচ্ছে। কেবল জেএনইউর নেতারাই নন, প্রগতিশীল তরুণদের মধ্যে যাঁরাই সাহস নিয়ে সরকারের বিভিন্ন নীতিকৌশলের সমালোচনা করছেন, তাঁদের কোথাও বক্তৃতা দিতে দেওয়া হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কে কী লিখছেন, তার ওপরও চলে তীক্ষ্ণ নজরদারি। অনেক সময়ই ফেসবুক, টুইটার থেকে মতামত প্রত্যাহারে বাধ্য করা হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে। এভাবে অধিকাংশ নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে গত চার বছরে কারাগারতুল্য পরিবেশ বানিয়ে ফেলেছে বিদ্যার্থী পরিষদ।
জেএনইউর ছাত্র সংসদ সরাসরি এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করেছে দেশটির শাসকদের ঘৃণাবাদী প্রচার রাজনীতিকে। ভারতের এই সময়কার অন্যতম আলোচিত লেখক শিখ তরুণী গুরমেহার কাউরের মন্তব্যটি ছিল বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণীয়। তিনি বলেন, প্রচারমাধ্যমে ও অনলাইনে যদি শাসকেরা সারাক্ষণ ভিন্নমতাবলম্বীদের বিপক্ষে ঘৃণা প্রকাশ করতে কর্মীদের অবারিত সুযোগ করে দেয়, সেই ঘৃণা একসময় বিরুদ্ধমত দমন করতে রাজপথে পিস্তল হাতে নেমে আসবে—এ আর আশ্চর্য কী!
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীন মতামত পোষণকারী শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়নের একটি ব্যাখ্যাও গুরমেহারের মন্তব্যে মেলে।
শাসকদের বিরোধিতা করলেই মেরে বা বাধা দিয়ে সেই কণ্ঠ থামাতে হবে—এই মানসিকতারই সর্বশেষ ক্রুদ্ধ নিশানা উমর। তাই সংবাদ সম্মেলন করে তাঁকে ‘উদারবাদী’ ‘গণতান্ত্রিক’ ভারতের বাসিন্দাদের জানাতে হচ্ছে, ‘আই র্যান ফর মাই লাইফ!’ উমরের উচ্চারিত ওই পাঁচটি ইংরেজি শব্দ যেন মোদি-জমানার চুম্বক এক পরিচয় তুলে ধরছে। একই সঙ্গে এটা দক্ষিণ এশিয়ায় জাতীয়তাবাদী শাসক মতাদর্শের ফ্যাসিবাদে রূপান্তরের কথাও জানাচ্ছে আমাদের।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, বিরোধীকে পরাজিত করার এটিই কি একমাত্র পথ? এই পথ কোন গন্তব্যে নিয়ে চলেছে ভারত এবং বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে?
- আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ আগস্ট ২৮,২০১৮
No comments:
Post a Comment