Search

Wednesday, August 29, 2018

কারাগারে নীরব চাঁদাবাজি!

ধারণক্ষমতার তিন গুণ বন্দী আছে পানির সমস্যা


মনির হোসেন 
কেরানীগঞ্জের নতুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে বেশির ভাগ বন্দী আরামে থাকা-খাওয়া সুবিধার পাশাপাশি টিভি বিনোদনেরও সুযোগ পাচ্ছেন। তবে তাদের প্রতি টিভির বিপরীতে মাসিক হারে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হচ্ছে।

কারাগারসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পুরো কারাগারে চার শতাধিক ওয়ার্ড (সেল) রয়েছে। বেশির ভাগ ওয়ার্ডে এলইডি টেলিভিশন আছে। আর এসব টেলিভিশন চালাতে ব্যবহার করা হচ্ছে পেনড্রাইভ। তবে প্রতিটি প্যান ড্রাইভ অনুমোদনের জন্য কারাগারের সুবেদারকে ৩০০০ হাজার করে টাকা দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া পেনড্রাইভ দিয়ে টেলিভিশন দেখার সুযোগ দেয়ার জন্য মাসিক ১৫০০ টাকা করে বন্দীদের পরিশোধ করতে হচ্ছে। ওই সুবেদারের চাহিদা মোতাবেক সব বন্দী নীরবে টাকা পরিশোধ করছেন বলে কারাগারে কর্তব্যরত একাধিক কারারক্ষী ও বন্দীর স্বজনদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু কি তাই, নিয়ম বহির্ভূতভাবে কারা অভ্যন্তরে টাকা পাঠাতেও চলছে বাইরের কারা ক্যান্টিন থেকে রমরমা বাণিজ্য।

অভিযোগ রয়েছে, বাইরে থেকে কোনো স্বজন বন্দীর কাছে ৫০০ টাকা পাঠালে ভেতরে সেই টাকা হয়ে যাচ্ছে ৪০০ টাকা। কমিশন বাবদ ১০০ টাকা কারাক্যান্টিনে কেটে নেয়া হচ্ছে। এভাবে প্রতিদিন নানা কৌশলে একটি চক্র লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অপর দিকে হাসপাতালে থাকতে হলেও একজন বন্দীকে গুনতে হচ্ছে প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। যদিও ধারণক্ষমতার প্রায় তিন গুণ বন্দী বর্তমানে কেরানীগঞ্জের কারাগারে অবস্থান করছে।

পেনড্রাইভের মাধ্যমে টেলিভিশন দেখা এবং অবৈধভাবে নগদ টাকা কারাগারে পাঠানোর অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যার আগে ও পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সদ্য যোগ দেয়া সিনিয়র জেল সুপার মো: ইকবাল কবীরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি টেলিফোন ধরেননি। সুবেদার হাবিবের সাথে যোগাযোগ করে তাকেও পাওয়া যায়নি।

গত শনিবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকা সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, কিছু দিন আগে ভেঙে পড়া নির্মাণাধীন কারাগারের গেটটি ওই অবস্থায় পড়ে আছে। পাশে ডিউটি করছিলেন কারারক্ষী হাসান। তিনি আগত বন্দীর স্বজনদের কাছে জানতে চান সাথে ক্যামেরা জাতীয় কিছু আছে কি না। এরপরই ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন। টিনশেড ঘেরা কারা ক্যান্টিন এলাকায় দেখা যায়, টেবিল চেয়ার নিয়ে পাঁচজন কারারক্ষী বন্দীর সাথে সাক্ষাৎ প্রার্থীদের নাম ঠিকানা লিখে বিনা টাকায় টিকিট দিচ্ছেন। আধঘণ্টা পর পর সাক্ষাৎ করার ডাক পড়ছে। এ সময় কারা ক্যান্টিন থেকে কয়েকজনকে মালামাল ক্রয় করতে দেখা যায়।

নিত্যপণ্যের দাম কেমন- জানতে চাইলে এক বন্দীর স্বজন বলেন, খুব একটা দাম তারা চাচ্ছে না। হাফ হাতা একটি নীল কালারের গেঞ্জি ২০০ টাকা চাচ্ছে। ফ্রুটো জুস ৭০ টাকা। বাইরেও একই দাম। তবে পেছনের কারা ক্যান্টিনে প্রতিটি জিনিসপত্রের দাম ৫-১০ টাকা বেশি বলে জানান বন্দীর স্বজনেরা।

টিনেশেডের পশ্চিম পাশে দেখা যায়, টেবিল চেয়ার নিয়ে কারারক্ষীরা বন্দীর কাছে পিসিতে টাকা পাঠাচ্ছে। এ সময় সাভার থেকে আসা রাজু নামে এক বন্দীর স্বজন শহীদ উদ্দিন (ছদ্মনাম) এ প্রতিবেদককে বলেন, ঈদের আগের দিন সাভারের ডিবি পুলিশ আমার শ্যালককে ইয়াবাসহ ধরে সরাসরি এই জেলে পাঠিয়ে দিয়েছে। এরপর থেকে কয়েকবার এসে তার সাথে সাক্ষাৎ করেছি।

তিনি বলেন, ভেতরে থাকার কোনো সমস্যা নেই। তবে খাবারের একটু সমস্যা আছে।

তিনি দাবি করেন, মিথ্যা মামলায় ডিবি পুলিশ তার শ্যালককে বাসা থেকে ডেকে ৪০ পিস ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। ‘সে ইয়াবা সেবন তো দূরের কথা, জীবনে সিগারেট পর্যন্ত খায়নি’। এখন তার জামিন করানোর চেষ্টা করছি। এ সময় তিনি তার মোবাইল ফোনটি ইউসুফের ক্যান্টিনে ১০ টাকার বিনিময়ে রেখে সাক্ষাৎ কক্ষে চলে যান।

খিলগাঁও থেকে আসা দুই যুবকের সাথে এক কারারক্ষী কথা বলছিলেন। পরে ওই যুবকের কাছে পরিচয় গোপন রেখে জানতে চাইলে তারা বলেন, আমরা সরাসরি দেখা করার কথা বলেছি। তখন ওই কারারক্ষী সরাসরি দেখা হবে, তবে তার জন্য আট হাজার টাকা দাবি করছে। এ সময় তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ট্যাকা এখন কাগজ হয়ে গেছে। আমার আসামির যে মামলা ওই টাকা দিয়ে তো তার জামিনই করাইয়্যা ফেলতে পারমু। দুই যুবকের একজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ভাই আর বইল্যান না, ঈদের আগের দিন হাট থেকে গরু কিনে রাত ২টায় বাড়িতে ফিরি। এরপর বাড়ির সামনে থেকে খিলগাঁও থানার দারোগা আমিনুল তাকে সন্দেহজনকভাবে ধরে থানায় নিয়ে যায়। তাকে ছাড়িয়ে দেবে বলে এলাকার এক ফর্মা আমাকে টেলিফোন করে ১০ হাজার টাকা দাবি করে। পরে ঈদের কথা চিন্তা করে ফর্মাকে পাঁচ হাজার টাকা দিতে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু ১০ হাজার টাকার কমে দারোগা ছাড়বেই না। ৫ হাজার টাকায় ছাড়তে রাজি হয়েছে। তবে আসামির নামে ছোট একটি ধারায় মামলা দেবে। কোর্ট থেকে তাকে ছাড়িয়ে আনতে হবে। তখন আমরা জেদ করে বলেছি, তাহলে তাকে কোর্ট থেকেই আনব। এখন কারাগারে আসছি আর আদালতে দৌড়াচ্ছি।

কারাগারে বন্দীর সাথে সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কী আর করুম। দেখা করতে আসি কিন্তু তার চেহারা দেখা ছাড়া কথা তেমন বুঝি না। তারা বলেন, শুনেছি ভেতরে খাবার পানির কিছুটা সমস্যা আছে।

বাইরের কারা ক্যান্টিনে স্লিপ আর কলম হাতে বসে আছেন আরিফ নামে এক কারারক্ষী। কারাগারে নগদ টাকা পাঠানোর জন্য তার কাছে জানতে চাইলে তিনি শুরুতেই বলেন, কত হাজার পাঠাবেন তাড়াতাড়ি বলেন। পিসির মাধ্যমে পাঠাতে চাইলে কোনো টাকা লাগবে না। এখান থেকে দুই ঘণ্টায় টাকা চলে যাবে আপনার লোকের কাছে। ৫০০ টাকা পাঠালে ভেতরে পাবে ৪০০ টাকা। এরপর তাকে জানালাম ১০ হাজার টাকা যদি পাঠাই তাহলে কত টাকা দিতে হবে। তখন তিনি বলেন, তাহলে এক হাজার টাকা দিলেই হবে। তখন তিনি তার মোবাইল নম্বর ও নাম চিরকুটে লিখে দেন এ প্রতিবেদকের হাতে।

জানা গেছে, শনিবার পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৯ হাজার ৬০৮ জন বন্দী অবস্থান করছিলেন। এরমধ্যে হাজতী ৭ হাজার ৮৯৯ জন, কয়েদী ১৫৭১ জন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ১২৩ জন, আরপি তিন জন, ৫৪ ধারার চারজন, ডিভিশনপ্রাপ্ত আটজন।

  • কার্টসিঃ নয়াদিগন্ত/ আগস্ট ২৯,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment