Search

Sunday, August 26, 2018

গরিবের চাল লুটপাট!


ইত্তেফাক ডেস্ক 

ঈদ উপলক্ষে গরিব ও দুঃস্থ জনসাধারণের জন্য সরকারের দেওয়া ভিজিএফের চাল বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর পাওয়া গেছে। বিভিন্ন স্থানে চাল আত্মসাত্ করে কালোবাজারে বিক্রি, পাচারের চেষ্টা, ওজনে কম দেওয়া, ভুয়া কার্ড তৈরি, স্লিপ বিক্রি, প্রকৃত গরিবদের না দিয়ে অন্যদের মধ্যে বিতরণের অভিযোগ উঠেছে জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে। চাল আত্মসাতের অভিযোগে গতকাল রবিবার দিনাজপুর পৌরসভার মেয়র সৈয়দ মো. জাহাঙ্গীর আলমকে আটক করেছে পুলিশ। চুয়াডাঙ্গা পৌরভবন থেকে শনিবার রাতে ট্রাক বোঝাই করে পাচারকালে ৩২৫৬ কেজি চাল জব্দ করা হয়েছে। এ ঘটনায় পৌর মেয়রের অপসারণ চেয়ে বিক্ষোভ করেছেন দুঃস্থ নারীরা। এছাড়া জামালপুরের বকশীগঞ্জে ৭৮ বস্তা চাল উদ্ধারের ঘটনায় একজন ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বাঘায় আওয়ামী লীগ নেতার ভাইয়ের বাসা থেকে ১০ বস্তা চাল উদ্ধার করেছে পুলিশ।

 
দিনাজপুর অফিস জানায়, শনিবার সকালে দিনাজপুর পৌরসভায় আকষ্মিক উপস্থিত হয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. খায়রুল ইসলাম চাল বিতরণে অনিয়ম দেখতে পান। পৌর মেয়র সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলমের উপস্থিতিতে প্রতি ব্যাগে ২০ কেজির পরিবর্তে ১৮.৪০ কেজি চাল পাওয়ায় তাত্ক্ষণিকভাবে পৌরসভার স্টোর কিপার মজিবর রহমান বাচ্চুকে আটক করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এ ঘটনায় গতকাল রবিবার সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আলতাফ হোসেন বাদী হয়ে দিনাজপুর পৌরসভার গুদামরক্ষক ও বিতরণকারী মো. মজিবর রহমান বাচ্চু (৫০), মেয়র সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম (৫০) ও ৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মাসুদুর রহমান মাসুদের (৪৪) বিরুদ্ধে কোতয়ালী থানায় মামলা করেন। পরে পুলিশ পৌর মেয়রকে আটক করে। কোতয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ রেদওয়ানুর রহিম জানান, মেয়রকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।

 
চয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি জানান, শনিবার দিবাগত রাত ১০টার দিকে চাল বোঝাই একটি মিনি ট্রাক চুয়াডাঙ্গা পৌরসভা কার্যালয়ের ভিতর থেকে প্রধান প্রবেশদ্বার অতিক্রম করে রাস্তায় উঠতে দেখে জনগণের সন্দেহ হয়। লোকজন দ্রুত একত্রিত হয়ে ট্রাকটি আটক করে। খবর পেয়ে চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কলিমুল্লা ঘটনাস্থলে পৌঁছান। পরে পুলিশ সুপারের নির্দেশে চাল বোঝাই ট্রাকটি থানায় নিয়ে যান। এসময় ট্রাকচালক খোকন জানান, সে এর আগেও গত ২ রাতে এই আবর্জনা ফেলার ট্রাকে করে পৌরসভার ভিজিএফের চাল নিয়ে গেছে।

 অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানান, চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার আটক ওই ট্রাকে ৪৪ কেজি ওজনের মোট ৭৪ বস্তা চাল পাওয়া গেছে। ট্রাকের সমুদয় চাল জব্দ করা হয়েছে। জব্দকৃত ওই চালের ওজন দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২৫৬ কেজি। তবে ট্রাকটি আটক রাখা হলেও চালককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

এদিকে ভিজিএফের চাল পাচারের ঘটনার বিচার দাবি করে রাতেই ছাত্র-জনতা শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। পরদিন দুঃস্থ নারীরা ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ করেন। এছাড়া তারা পৌরসভার মেয়রের অপসারণ ও বিচার দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বরাবর জেলা প্রশাসকের নিকট স্মারকলিপি প্রদান করেন।

 মেলান্দহ (জামালপুর) সংবাদদাতা জানান, উপজেলার চরবানিপাকুরিয়া ইউনিয়ন বিএনপি’র অফিস থেকে ভিজিএফ’র ১০০ বস্তা (প্রতিবস্তা ৫০ কেজি হিসেবে ১ মে.টন) চাল জব্দ করা হয়েছে। চাল কালোবাজারে পাচার হচ্ছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে গতকাল বিকেল ৪টার দিকে ইউএনও তামিম আল ইয়ামীন অভিযান চালিয়ে চালগুলো জব্দ করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কারসাজিতে হতদরিদ্রদের চাল কালোবাজারে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছিল।

 বকশীগঞ্জ (জামালপুর) সংবাদদাতা জানান, উপজেলার ধানুয়া কামালপুর ইউনিয়নে ভিজিএফের ৭৮ বস্তা চাল উদ্ধার করা হয়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় অভিযান চালিয়ে চালগুলো উদ্ধার করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু হাসান সিদ্দিক। ভিজিএফের চাল কালোবাজারে বিক্রির অভিযোগে ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান ফারুক ও ইউপি সদস্যসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

 
জানা গেছে, ঈদ উপলক্ষে ধানুয়া কামালপুর ইউনিয়নে ৪ হাজার ১৫৯ টি ভিজিএফ কার্ড বরাদ্দ দেয় সরকার। ওইদিন সকালে প্রায় ২ শতাধিক কার্ডধারী চাল না পেয়ে ফিরে যান এবং বিকালে চাল না পাওয়ায় পরিষদের সামনে বিক্ষোভ করেন তারা। খবর পেয়ে  সন্ধ্যায় ওই এলাকায় অভিযান চালান ইউএনও। এ ব্যাপারে অভিযুক্ত চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান ফারুক বলেন, ভিজিএফের চাল বিতরণে কোন অনিয়ম হয়নি। কার্ডধারীরা চাল না পাওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়।

 
বাঘা (রাজশাহী) সংবাদদাতা জানান, শনিবার রাতে উপজেলার গড়গড়ি ইউনিয়নের (৪ নম্বর) ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি আরব মাস্টারের ভাই লালনের বাড়ি থেকে ১০ বস্তা চাল উদ্ধার করেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইমরুল কায়েস । এ ঘটনায় পরদিন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম ওই দু’জনকে অভিযুক্ত করে বাঘা থানায় মামলা করেন। ফরিদুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্যর প্রতিনিধি হিসাবে আরব আলী মাস্টার ১০ বস্তা চাল গোপনে তার ভাই লালনের বাড়িতে রাখেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই গ্রামের একাধিক ব্যক্তি জানান,  আরব আলীর হাত দিয়ে যে ৩৮ টি কার্ড তৈরি হয়েছিল তার মধ্যে ২৫ টি ছিল ভুয়া। তিনি ওই ২৫ টি কার্ডের বিপরীতে ১০ বস্তা চাল  সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন।

 
বাসাইল (টাঙ্গাইল) সংবাদদাতা জানান, ভিজিএফের চাল বিতরণে টাঙ্গাইলের বাসাইলে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে কাউন্সিলর হাফিজুরের বিরুদ্ধে। জানা গেছে, বাসাইল পৌরসভার উদ্যোগে শনিবার খাদ্যগুদাম থেকে এসব চাল বিতরণ করা হয়। প্রত্যেকের জন্য ২০ কেজি করে চাল বরাদ্দ থাকলেও ১৬ থেকে ১৭ কেজি করে চাল দেওয়ার অভিযোগ উঠে। কোন বাটখাড়া দিয়ে না মেপে বালতি দিয়ে আনুমানিক মাপে চাল বিতরণ করা হয়। বিষয়টি নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে। অভিযুক্ত কাউন্সিলর জানান, চক্রান্ত করে আমার মানহানি করার চেষ্টা করছে একটি মহল। ২০ কেজির মধ্যে সাড়ে ১৯ কেজি হতে পারে। তবে ১৬ থেকে ১৭ কেজি হতে পারে না।

 
গঙ্গাচড়া (রংপুর) সংবাদদাতা জানান, উপজেলার আলমবিদিতর ইউনিয়নের ভিজিএফ চাল বঞ্চিত হয়েছেন প্রায় ৫০ জন নারী-পুরুষ। গতকাল রবিবার উপজেলার আলমবিদিতর ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, প্রখর রোদে লোকজন চালের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। ইউনিয়নের আহমদপাড়া গ্রামের মর্জিনা, মোসলেমা, আর্জিনা, ব্যাংকপাড়া গ্রামের রোসনা, পারুল, সালেমা, হাসিনাসহ প্রায় ৫০জন হতদরিদ্র নারী-পুরুষ জানান, ‘তিন/চার দিন থাকি হামরা চেয়ারম্যানের বাড়িত ঘুরিচোল, তাও এখান ছিলিপ দেয় নাই। হামাক এখান ছিলিপ দেন।’ কেউবা বলছেন ‘মোরও নামটা নেখো বাহে।’ তাদের চেহারায় কষ্টের ছাপ। মলিন বসন। অনেক দুঃস্থ পরিবার চাল পায় নাই এমন অভিযোগের জবাবে আলমবিদিতর ইউপি চেয়ারম্যান আফতাবুজ্জামান বলেন, যারা পায়নি তাদেরকে দেওয়ার চেষ্টা করব। এ সময় তার পকেটে অনেক স্লিপ দেখা যায়।

 
রৌমারী (কুড়িগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, রবিবার সরেজমিনে উপজেলার যাদুরচর, দাঁতভাঙ্গা, বন্দবেড়, শৌলমারী, রৌমারী ও চরশৌলমারী ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, ভিজিএফ কর্মসূচির চাল বিতরণের তালিকায় নাম আছে কিন্তু তারা চাল না পেয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। এসব চালের স্লিপ অন্যদের কাছে বিক্রির অভিযোগ ওঠেছে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। যাদুরচর ইউনিয়নের চাল নিতে আসা ধনারচর গ্রামের হযরত আলী,আবু সমা, বাইমমারী গ্রামের শুকুর আলী ও ইসরাফিল বলেন, ‘তালিকায় নাম আছে চালের জন্য আসছিলাম। কিন্তু আমাদের নামের স্লিপ বিক্রি হয়ে গেছে। ইউএনও ও উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে বিচার দিলাম কোন লাভ হয় নাই। আমরা না খাইয়া থাকুম। আল্লাহর্ কাছে বিচার দিলাম, একদিন গরিবের চাল খাওয়ার হিসাব হবে।’

 

Courtesy: Ittefaq Aug 20, 2018

 

 

No comments:

Post a Comment