Search

Wednesday, August 29, 2018

আইনের শাসন - সরকারের ‘মহানুভবতা’র রাজনীতি!

কামাল আহমেদ  

অনেক মা-বাবার কান্না, সহপাঠীদের চাপা ক্ষোভ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিবাদের মুখে প্রথমে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সমর্থক ছাত্রছাত্রীদের অনেকে এবং পরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের কয়েকজন নেতা বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। ঈদের আগে তাঁদের মুক্তিলাভ পরিবারগুলোতে স্বস্তি এবং আনন্দ এনে দিয়েছে, সন্দেহ নেই। আদালত তাঁদের জামিন দেওয়ার পর আইনমন্ত্রী বলেছেন, সরকার মানবিক কারণে ‘মহানুভবতা’ দেখিয়ে তাঁদের মুক্তি দিয়েছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘আমরা মহানুভবতা দেখিয়েছি। এখন আমরা আশা করছি, ওরা আর কোনো গুজবে কান দেবে না, গুজব ছড়াবে না, কোনো গুজবে বিভ্রান্ত হবে না। একই সঙ্গে একজন নাগরিক হিসেবে দেশের প্রতি দরদ, ভালোবাসা, মমতা ও দেশাত্মবোধ দেখাবে।’ (বাংলা ট্রিবিউন, ২০ আগস্ট, ২০১৮)।

ব্যক্তিজীবনে ত্যাগের শিক্ষা দেয় যে ঈদ, সেই উৎসবের আগে সরকারের এই কথিত মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে অনেকে সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আবার অনেকে এর মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য খুঁজেছেন। যাঁরা এর মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছেন, তাঁদের বক্তব্য নিরাপদ সড়কের দাবি মানার পাশাপাশি এসব আটক কিশোর-তরুণের প্রতি উদারতা দেখানোর মধ্য দিয়ে সরকার আন্দোলনকারীদের আস্থায় নিতে চাইছে।

সরকার যে কত মহানুভব, তার বিশদ বিবরণ তুলে ধরতে গিয়ে আনিসুল হক বলেছেন, ‘ওদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলেই আমরা এ ক্ষেত্রে মহানুভবতা দেখিয়েছি। সরকারের পক্ষ থেকে আমরা সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম যে আদালত যদি ওদের জামিন দেন, তাহলে প্রসিকিউশন থেকে আমরা এ বিষয়ে আপত্তি করব না। শুধু তা-ই নয়, জামিন পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২০ জন শিক্ষার্থীর পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। সরকারের পক্ষ থেকে ওদের পক্ষে প্রসিকিউশন নিয়োগ করে ওদের জামিনের কাগজপত্র জমা দিয়েছি।’



যাঁদের কারণে এসব কিশোর-তরুণ মুক্তি পেলেন, তাঁদের ধন্যবাদ জানানোয় কার্পণ্য করা কোনো কাজের কথা নয়। কিন্তু সরকারের মানবিকতা জাগ্রত হওয়া এবং মহানুভবতা দেখানোর দাবির কারণে এই প্রশ্নটি না করলেই নয়। ধন্যবাদ আমরা কাকে দেব? আদালত নাকি সরকারকে? সরকার যদি অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিত, তাহলে আর এই প্রশ্নটি উঠত না। কিন্তু অভিযোগ বা মামলা প্রত্যাহারের মতো কোনো পদক্ষেপের কথা তো আমরা শুনিনি।

আমরা জেনেছি যে আদালত তাঁদের জামিন দিয়েছেন। এখন আদালতের সিদ্ধান্তের কৃতিত্ব যদি আইনমন্ত্রী দাবি করেন, তাহলে তার মানে কী দাঁড়ায়? সরকারের এই দাবির পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকলে তা আদালতের স্বাধীনতা সম্পর্কে কী ধারণা দেয়? রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, বিএনপি এত দিন ধরে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছে যে আদালত স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না-সেই দাবি বিশ্বাসযোগ্য করায় মন্ত্রীর এই বক্তব্যে দলটি খুশি হবে বৈকি। বিএনপির নেত্রীর জামিনের প্রশ্নে সরকারের কঠোর বিরোধিতা কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় দুদকের আইনজীবী থাকলেও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলের চোখে পড়ার মতো উদ্যোগী ভূমিকায় ক্ষুব্ধ বিএনপি কয়েক মাস ধরে এই কথাটিই বলে আসছে। তাদের বক্তব্য, সরকারের কারণেই বিএনপির নেত্রী সুবিচার পাচ্ছেন না।

আদালতকে কোনো মামলার ক্ষেত্রে প্রভাবিত করার চেষ্টা হয়েছে কি না, তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু মন্ত্রীর বক্তব্য সত্য হলে সরকার মহানুভবতা না দেখালে এসব ছাত্রছাত্রীর জামিন হয়তো হতো না। অভিজ্ঞতা বলে, রাষ্ট্রপক্ষের আপত্তি না থাকলে আদালত সাধারণত জামিন দিতে কসুর করেন না। জামিন এবং রিমান্ডের প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা নিম্ন আদালতে অব্যাহতভাবে উপেক্ষিত হওয়ার পটভূমিতে সরকারের মহানুভবতার দাবি হয়তো যৌক্তিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আইনমন্ত্রী এদের প্রতি মহানুভবতা দেখিয়ে থাকলে যাঁরা ঈদের আগে জামিন পেলেন না, তাঁদের প্রতি তিনি কি কঠোরতা দেখালেন? আলোকচিত্রী শহিদুল আলম যে জামিন পেলেন না, তা যদি তাঁর এই কঠোরতার কারণে হয়ে থাকে, তাহলে মন্ত্রী হিসেবে তিনি যে শপথ নিয়েছেন, তার বিচ্যুতির অভিযোগ কি নাকচ করা যায়? মন্ত্রী হিসেবে তিনি তো কারও প্রতি রাগ বা অনুরাগের বশবর্তী না হওয়ার শপথ নিয়েছেন। কথিত মহানুভবতার জন্য ছাত্রছাত্রীদের কাছে তাঁর যেমন প্রত্যাশা আছে, তেমনি কি মন্ত্রীর বিরুদ্ধে শপথ ভঙ্গের অভিযোগ উঠলে তাঁর পদত্যাগ আশা করা যাবে?

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের জন্য আটক ছাত্রছাত্রীদের আইনজীবীরা জামিন চাওয়ার সময়ে আদালতে বলেছেন, এজাহারে তাঁদের কারও নাম নেই এবং এ কারণে সন্দেহের বশে আটক কিশোর-তরুণদের জামিন না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এই আন্দোলনের কারণে যে শতাধিক ব্যক্তি আটক হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সহিংসতার সময়ে ঘটনাস্থল থেকে আটক হয়েছেন, এমন কেউ আছেন কি না সন্দেহ। যদি থেকেও থাকেন তা একেবারেই নগণ্য। অর্থাৎ আইন ভঙ্গ বা শান্তিরক্ষার প্রয়োজনে এঁদের গ্রেপ্তার করতে হয়েছে-ব্যাপারটা এমন নয়। অভিযোগ আছে, অনেককেই ছাত্রলীগের কর্মীরা লাঞ্ছিত করার পর পুলিশের কাছে দিয়েছেন এবং থানা তাঁদের বিরুদ্ধেই মামলা দিয়েছে। যে ৫৭ ধারা বাতিল হওয়ার কথা, সেটিরই সর্বোচ্চ অপপ্রয়োগ ঘটছে।

সবচেয়ে বড় কথা, আসল অশান্তি সৃষ্টিকারী হেলমেট বাহিনীর অনেকের পরিচয় প্রকাশের পরও গত দুই সপ্তাহে তাঁদের কেউই গ্রেপ্তার হননি। পুলিশ হামলাকারীদের খোঁজে না, কিন্তু আন্দোলনকারীদের ধরপাকড়ের জন্য সবাইকে তৎপর দেখা গেছে। থানা-পুলিশের পাশাপাশি বিশেষ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য গড়ে তোলা চৌকস বাহিনী র‍্যাব, সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের জন্য গঠিত অ্যান্টি-টেরর ইউনিট এবং সাইবার অপরাধ দমনের সাইবার ক্রাইম ইউনিট-সবাই নেমে পড়েছে আন্দোলনকারীদের ধরতে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন অথবা কোটা সংস্কারের আন্দোলন মোকাবিলায় র‍্যাব কিংবা সন্ত্রাস দমন ইউনিট নিয়োগের কী যৌক্তিকতা থাকতে পারে? একজন বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রীকে রাতের বেলায় তাঁর দাদাবাড়ির দরজা ভেঙে ঘুম থেকে উঠিয়ে ধরে নিয়ে আসার মতো ‘মহানুভবতা’ এসব ছাত্র-তরুণদের আজীবন মনে থাকবে, সন্দেহ নেই। জুলুম-নির্যাতন আবার ফিরে এসেছে এবং তা এখন নতুন ফ্যাশন বলে জাতিসংঘের বিদায়ী মানবাধিকার প্রধান জেইদ রাদ আল হুসেইন সম্প্রতি যে বৈশ্বিক প্রবণতার কথা বলেছেন, মনে হয় বাংলাদেশ তার এক বড় দৃষ্টান্ত।

ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন মোকাবিলায় সরকারের দমননীতি শুধু যে আন্দোলনকারীদের মধ্যেই আবদ্ধ থেকেছে, তা নয়। প্রথমে তা বিস্তৃত হয়েছে বিরোধী দল বিএনপির দিকে। একটি ন্যায্য দাবির আন্দোলন সমর্থনের ‘অপরাধে’ তাদের বিরুদ্ধে সরকার পতনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে। কথিত টেলিফোন সংলাপ ফাঁস এবং তাকে কেন্দ্র করে মামলাও হয়েছে। সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব বিস্তৃত হয়েছে নাগরিক সমাজের একটি অংশ এবং যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত। তথ্যপ্রযুক্তি আইনে আটক করা হয়েছে নন্দিত আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে। তাঁর মুক্তির জন্য নোবেল বিজয়ী থেকে শুরু করে বিশ্বের তাবৎ বুদ্ধিজীবীরা বিবৃতি দিচ্ছেন, পত্রপত্রিকায় নিবন্ধ লিখছেন।

মাত্র মাস চারেকের মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য একটি সম্ভাব্য রাজনৈতিক সমঝোতার প্রসঙ্গ যখন জন-আলোচনায় প্রাধান্য পাওয়ার কথা, তখন সবার মনোযোগ ও দৃষ্টি হচ্ছে শহিদুল আলমসহ গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মুক্তির বিষয়টিতে। বলতেই হবে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য এটি হচ্ছে মন্দের ভালো। কেননা, ২০১৪-র বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন যে রাজনৈতিক সংকটের উৎস, সেই সংকট নিরসনের রাজনৈতিক সমাধান আওয়ামী লীগের জন্য সুখকর না-ও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে নানা ধরনের অস্থিরতার কারণে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়াই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার দোহাই দিয়ে আরও একটি নির্বাচন নিজেদের মনের মতো করিয়ে নেওয়া অপেক্ষাকৃতভাবে সহজ।

পছন্দমতো নির্বাচন আয়োজনে যাঁদের সহায়তা প্রয়োজন, তাঁদের খুশি রাখার আয়োজনগুলো সম্পন্ন করার উদ্যোগগুলোতে সেই আলামতই মেলে। পুলিশ বাহিনীর প্রধানকে সচিব পদে উন্নীত করার যে ধারা আওয়ামী লীগ শুরু করেছিল, তা এবার নতুন মাত্রা পেয়েছে একসঙ্গে চার পুলিশকর্তার অস্বাভাবিক পদোন্নতিতে। এক দেশে আইনের দুই ধারা-সাধারণ নাগরিক হলে সন্দেহের বশেও গ্রেপ্তার এবং রিমান্ড চলবে, কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা হলে মামলা হলেও অনুমতি ছাড়া গ্রেপ্তার নিষিদ্ধ হচ্ছে। এটাই এখন চৌকস (স্মার্ট) রাজনীতি।


  • কার্টসি ঃ প্রথম আলো/ আগস্ট ২৯,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment