Search

Wednesday, August 29, 2018

৪২ সেকেন্ডে ফিটনেস পাচ্ছে যানবাহন!

সামছুর রহমান

  • মিরপুর কার্যালয় ফিটনেস সনদ দিচ্ছে অস্বাভাবিক দ্রুততায়
  • প্রতি ঘণ্টায় দেওয়া হয়েছে গড়ে ৮৬টি সনদ
  • ১৬ কার্যদিবসে দেওয়া হয়েছে সাড়ে ১৬ হাজার সনদ
  • নির্দেশনা মেনে সনদ দিতে লাগার কথা এক থেকে দেড় ঘণ্টা
  • তাড়াহুড়োয় ফিটনেস পরীক্ষা হলে মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়
  • দায়সারা পরীক্ষায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াবে



রাজধানীর মিরপুরের বিআরটিএ কার্যালয়ে গতকাল দুপুরে ডিজিটাল নম্বরপ্লেট, লাইসেন্স ডেলিভারি বুথের সামনে ভিড় ছিল। তবে নতুন আবেদনের বুথগুলো তুলনামূলক ফাঁকা ছিল।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ের চেহারাই বদলে গেছে। ফিটনেস সনদ নিতে যানবাহনের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। সংস্থাটি কাজও করছে বিদ্যুৎ গতিতে। যেমন ১ থেকে ২০ আগস্ট এই ২০ দিনে মিরপুর কার্যালয় থেকে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়েছে। কর্মঘণ্টা ধরে হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে, গড়ে ৪২ সেকেন্ডেই একটি করে যানবাহনকে ফিটনেস সনদ দিয়ে দিয়েছে বিআরটিএ।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিতভাবেই বলছেন, সব প্রক্রিয়া শেষ করে এত কম সময়ে যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক। তাড়াহুড়ো করে ফিটনেস পরীক্ষা সম্পন্ন করা হলে পরীক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। দায়সারা পরীক্ষায় ফিটনেস সনদ পাওয়া যানবাহন দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াবে।

গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে র‍্যাডিসন হোটেলের সামনে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। সেদিন থেকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর থেকে বিআরটিএর কার্যালয়ে ফিটনেস নবায়নের বিপুলসংখ্যক আবেদন জমা পড়ছে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে বিআরটিএ বাড়িয়েছে দিনের কর্মঘণ্টা। ৪ আগস্ট থেকে বিআরটিএ কার্যালয়ে লাইসেন্স নবায়ন, গাড়ির ফিটনেস ও নবায়ন কার্যক্রম প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত চালু থাকছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনিবারও খোলা রাখা হচ্ছে বিআরটিএ কার্যালয়।

বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার যানবাহনের। সরকারি ও সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে এই ২০ দিনে কর্মদিবস ছিল ১৬টি। দৈনিক ১২ কর্মঘণ্টা হিসাবে বিআরটিএর কার্যালয় খোলা ছিল ১৯২ ঘণ্টা। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় দেওয়া হয়েছে গড়ে ৮৬টি ফিটনেস সনদ।

বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ফিটনেস সনদ দিতে হলে সংশ্লিষ্ট যানবাহন কারিগরি ত্রুটিমুক্ত হতে হবে। কারিগরি ও বাহ্যিক অন্তত ৬০টি বিষয় বিবেচনায় আনার কথা বলা হয়েছে আইনে। ফলে একটি যানের সনদ দিতে ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা লেগে যাওয়া স্বাভাবিক। এক মিনিটের কম সময়ে ফিটনেস সনদ দেওয়া অসম্ভব। শুধু চোখে দেখা ছাড়া এত অল্প সময়ে ফিটনেস সনদ দেওয়া সম্ভব নয়।

তবে এ বিষয়ে বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) মাহবুব-ই-রব্বানি প্রথম আলোকে বলেন, একটি স্ট্যান্ডার্ড (মান) রক্ষা করেই ফিটনেস সনদ দেওয়া হচ্ছে। যে গাড়ির ফিটনেস সনদ দেওয়া হচ্ছে, তার অধিকাংশ প্রাইভেট কার। এসব গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষায় বেশি কিছু দেখা লাগে না। অনেকে গাড়ি মেরামত ও রং করে ফিটনেস পরীক্ষার জন্য আসছেন। এটিও দ্রুত পরীক্ষার কাজ শেষ করতে ভূমিকা রাখছে।

বিআরটিএর তথ্য অনুসারে, বর্তমানে ঢাকায় যানবাহন আছে প্রায় ১৩ লাখ। মোটরযান আইন অনুযায়ী চাকা, ইঞ্জিনক্ষমতা ও ধরন বিবেচনায় নিয়ে যানের নিবন্ধন দিয়ে থাকে বিআরটিএ। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের ফিটনেস সনদ দরকার হয় না। কারসহ অবাণিজ্যিক যানবাহনের বেলায় তৈরির সাল থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরের ফিটনেস সনদ একসঙ্গেই দেওয়া হয়। বাস, ট্রাকসহ আর সব যানবাহনের ফিটনেস সনদ নিতে হয় প্রতিবছর।

বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকায় নিবন্ধিত যানবাহনের মধ্যে মোটরসাইকেল রয়েছে ৫ লাখ ৭০ হাজার। আর ১০ শতাংশ গাড়ি নতুন। ফলে কমবেশি ৬ লাখ যানবাহনের প্রতিবছরই ফিটনেস সনদের প্রয়োজন হয়।

ফিটনেস পরীক্ষার সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন রয়েছে বিআরটিএর। গাইডলাইন অনুসারে যানবাহনের মালিক প্রথমে আবেদন করেন। আবেদনপত্র গ্রহণের পর তা যাচাই-বাছাই করা হয়। এরপর আবেদন করা যানবাহনটি পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনের কাজ শেষ হলে যাচাই করা হয় যানবাহনের উপযুক্ততা।

বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ে দুই ধরনের পদ্ধতিতে যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা করা হয়। ডিজিটাল ভেহিকল ইন্সপেকশন সেন্টারে (ভিআইসি) পরীক্ষা করা হয় গণপরিবহন ও ভারী যানবাহনের ফিটনেস। ব্যক্তিগত ও হালকা যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা করা হয় খালি চোখে।

গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, ভিআইসির সামনে ফিটনেস পরীক্ষার জন্য লাইনে দাঁড়ানো একটি কাভার্ড ভ্যান। একজন পরিদর্শনকর্মী চালকের আসনে বসে ওজন, টায়ারের বিট বা ঘনত্ব, গতি ও গতিরোধক বা ব্রেক পরীক্ষা দেড় মিনিটের মধ্যে শেষ করেন। নামার আগে ভেতরের আসন, রং ঠিক আছে কি না, সেটি পরীক্ষা করে নেন।

বুথে দায়িত্ব পালনকারী বিআরটিএর একজন মোটরযান পরিদর্শক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ভিআইসিতে পরিদর্শনের ধাপে চার ধরনের পরীক্ষা হয়। ওজন স্কেলে ‘এক্সেল লোড’ পরীক্ষা করা হয়। টায়ারের ঘনত্ব পরীক্ষা করা হয়। এরপর পরীক্ষা করা হয় গতি। সবশেষে গাড়ির গতিরোধক বা ব্রেক পরীক্ষা করা হয়। সব মিলিয়ে পরিদর্শন ধাপটি শেষ করতে ১৮-২০ মিনিট লাগার কথা।

যদিও বিআরটিএর নির্দেশনা অনুযায়ী, পরিদর্শন ধাপটি শেষ করতে কমপক্ষে ৩০ মিনিট, প্রয়োজনে ১ ঘণ্টা সময় উল্লেখ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, একটি গাড়ির ফিটনেস যথাযথভাবে পরীক্ষা করতে ন্যূনতম ১ ঘণ্টা লাগে। এত কম সময়ে ফিটনেস দেওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি মনে করেন, বিআরটিএ একদিকে টাকা নিয়ে যথাযথভাবে ফিটনেস পরীক্ষা না করে সঠিক সেবা দিচ্ছে না, অন্যদিকে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ফিটনেস সনদ পাওয়ায় জনগণের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ছে।
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ আগস্ট ২৯, ২০১৮

No comments:

Post a Comment