বড়পুকুরিয়া খনি থেকে প্রায় দেড় লাখ টন কয়লা ‘গায়েবের’ ঘটনায় গঠিত দুটি তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন দিলেও তা প্রকাশ করা হবে না বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
তিনি বলেন, আমরা তদন্তের দুটি রিপোর্ট পেয়ে গেছি ইতিমধ্যে। কারা কারা জড়িত এবং কীভাবে হয়েছে বা কীভাবে করতে যাচ্ছে সেটা রিপোর্টে জেনেছি। তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। আমরা আগেই বলেছি কোনোরকম দুর্নীতিকে আমরা প্রশ্রয় দেবো না। গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রতিমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
ঈদের পর প্রথম কর্মদিবসে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। দুটি তদন্ত রিপোর্টে কতজনকে দোষী পেয়েছেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, যেহেতু মামলা করেছি, মামলার তদন্তের ওপর এখন নির্ভর করছে। এই তদন্তগুলো হয়ত সাপোর্টিভ হবে মামলার জন্য। আর দুদকও যেহেতু মামলা করছে, আর আমি প্রকাশ্যে এগুলো বলতে চাই না। কারণ, এগুলো মামলাকে আরো বেশি অন্যদিকে নিয়ে যাবে। নসরুল হামিদ বলেন, যেহেতু দুদক করছে, মামলার তদন্ত পুলিশ করবে, আমাদের ইনিশিয়াল একটা তদন্ত আছে মন্ত্রণালয়ের। এই বিষয়গুলো ওই অবস্থায় থাকলে আরও বেটার হবে তারা যদি আরও ডিটেইলে যায়। এটা তো মন্ত্রণালয়ের বিষয় না, মন্ত্রণালয়ের অধীনে যে কোম্পানি থাকে পেট্রোবাংলা-এটা তাদের বিষয়। সেখানে আমরা কোনোভাবে দুর্নীতির ছিঁটেফোটা হলেও তা প্রশ্রয় দেয়া হবে না। সে অনুপাতে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কয়লাখনিতে দুর্নীতি অনেক আগে থেকে সে দিকে ইঙ্গিত করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এটা তো আজকে এক দিনের ব্যাপার না। কারণ, এক লাখ ৪০ হাজার টন কয়লা যদি সরাতে হয় তাহলে ৩০ হাজার ট্রাক লাগবে। এটা তো আর একদিনে হয়নি, এটা ২০০৫ সাল থেকে স্টকে বিল্ডআপ করে করে দেখিয়েছে।
একটা দিক অন্তত ভালো হয়েছে যে, শেখ হাসিনা সরকারের সময় এই দুর্নীতিটা ধরা পড়েছে। বিদ্যুৎ বন্ধ থাকুক আর শেষ হয়ে যাক, যেটাই হোক না কেন, ধরা তো পড়েছে আমাদের হাতে। আমরা বিদ্যুৎ বিভাগকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম তদন্ত করার জন্য। তারা সেখানে গিয়ে রিপোর্ট দিয়েছে। রিপোর্ট দেয়াতে তো ধরা পড়েছে, আর যদি ধরা না পড়ত, তাহলে তো আপনারা জানতে পারতেন না। বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ না হলে কেউ জানতে পারত না- তেল-গ্যাস কমিটির এই মন্তব্যের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, যদি ওটা বন্ধ না হতো, তাহলে আমরা জানতে পারতাম না, এটা সত্য কথা, এটা সবাই জানে। এটা ওনাদের আলাদা করে বলতে হবে না, এখানে আমরাই কথাটা বলেছি।
ঈদে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়েও কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা মনে করছি যে, গতবারের চেয়ে এবারের অবস্থা অনেক ভালো ছিল, বিশেষ করে বিদ্যুৎ ডাউনের ক্ষেত্রে। আমাদের সেন্ট্রাল রিপোর্টে আমরা দেখছি যে, বেশ ভালো ছিল। কিছু গ্রাম পর্যায়ে একদম ইনটেরিওরে অনেক সময় বিদ্যুতের বিভ্রাট হয়েছে, এটা লোকালি হয়েছে। কোনো এলাকায় হয়ত টান্সফরমার পুড়ে গেছে, সেখানে হয়ত বিদ্যুতের কিছু ঘাটতি ছিল। একমাত্র আমাদের ঘাটতি হয়েছে রংপুরে। যেহেতু ওখানে বিদ্যুতের পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো বন্ধ হয়েছিল। আমরা একটা ছোট একটা প্ল্যান্ট চালু রেখেছিলাম যাতে আমাদের ভোল্টেজটা ঠিক থাকে। এছাড়া আর বড় বিষয় ছিল না। তবে আশা করছি আগামী মাসে পরিস্থিতি আরও ভালো হবে। কারণ জেনারেশন আমাদের হাতে যথেষ্ট আছে। নসরুল হামিদ বলেন, আমরা আশা করছি সেপ্টেম্বর নাগাদ আমরা অল্প পরিসরে চালু করতে পারব যেভাবে কয়লা উঠছে। আমরা কিছু কয়লা দিয়ে কিন্তু চালু করেছিলাম একটা প্ল্যান্ট। গত পাঁচ দিন যাবত ওখানে কিন্তু একটা প্ল্যান্ট চালু ছিল। আমরা ইতিমধ্যে সেটাকে কভারআপ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। একটা স্টক বিল্ডআপ করার জন্য। বাকিটা ওখানকার কয়লা দিয়ে হবে।
কয়লা আমদানি প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, কয়লার খনিতে সাধারণত অনেক সময় ওয়াটার বিল্ডআপ করে যায়, খনি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তখন কী করবেন? আবার অনেক দেশে অনেক সময় ধস নামতে পারে, অনেক মানুষ মারা গেছে। খনিতে এই ধরনের পরিস্থিতি হতে পারে। সেগুলোর সময় কী করবেন। সেই ইমার্জেন্সি সময়ের জন্য আমরা একটা স্টক বিল্ডআপ করা দরকার বলে আমরা কিছু ইমপোর্ট করতে যাচ্ছি। কী পরিমাণ ইমপোর্ট করা হবে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, লাখখানেক টনের মতো হবে। এই ইমপোর্ট করার জন্য সবচেয় বড় চ্যালেঞ্জ হলো ক্যারিং করা, চিটাগাং পোর্ট থেকে বা মোংলা পোর্ট থেকে বড় পুকুরিয়াতে নিয়ে আসাটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কোন্ দেশ থেকে আনা হবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা এখনও ঠিক হয়নি। টেন্ডার দেয়া হয়েছে। যারা পার্টিসিপেট করবে, তারা প্রস্তাব দেবে। বড়পুকুরিয়ায় কবে নাগাদ পুরো মাত্রায় উৎপাদন শুরু হবে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা আশা করছি, অক্টোবর নাগাদ পুরো মাত্রায় যেতে পারব। এখন যে কয়লা উঠছে আস্তে আস্তে বিল্ডআপ হচ্ছে। প্রতিদিন হয়ত তিন হাজার টন দিতে পারবে। হয়তো সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে আমরা পুরোপুরি কয়লাটা পাব।
সামনে নির্বাচন- একে সামনে রেখে তেল বা বিদ্যুতের দাম কমানোর কোনো পরিকল্পনা আছে কি না? এমন প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকারের পরিকল্পনার ব্যাপারে বলতে পারি না। আমরা যা দিয়েছি বহু আগে, ছয় মাস আগে দিয়ে ফেলেছে বার্কে (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন)। বার্কের ওপর ডিপেন্ড করে প্রাইস কী হবে, এটা সম্পূর্ণভাবে বার্কের আয়ত্তে প্রাইসের ব্যাপারে। এলএনজি বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এলএনজি পাইপলাইনে শুরু হয়ে গেছে, আমরা আস্তে আস্তে এটা বিল্ডআপ করবো। এখন আমাদের ৭৫ থেকে ১০০ এমএমসিএফ নেয়ার মতো ক্যাপাসিটি বিল্ডআপ হয়ে গেছে পাইপলাইনে এবং সেটা যাচ্ছে।
এলএনজির জন্য কী পরিমাণ ভর্তুকি লাগবে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ভর্তুকি এখানে খুব বেশি লাগবে না, কারণ আমাদের যে পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো ডুয়েল ফুয়েল অর্থাৎ যেগুলো তেলে চলছিল, যেগুলো আমরা গ্যাসে চালাতে পারি, সেগুলোকে আমরা শিফট করে ফেলব।
প্রসঙ্গত, গত জুলাইয়ের শেষ দিকে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির বিপুলসংখ্যক কয়লার হদিস না পাওয়ার কথা জানা যায়। এই ঘটনায় বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির (বিসিএমসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও একজন মহাব্যবস্থাপককে প্রত্যাহার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আরো একজন মহাব্যবস্থাপক ও উপ-মহাব্যবস্থাপককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে কয়লাখনি কোম্পানিটির নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তারা নির্ধারিত সময়ে প্রতিবেদনও জমা দেয়।
- কার্টসিঃ মানবজমিন/ আগস্ট ২৭, ২০১৮
No comments:
Post a Comment