২০১৬ সালে দেশের ব্যাংকগুলোর ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছিল ১৫ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। সেখান থেকে প্রায় ২৪ শতাংশ বেড়ে গত বছর এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৯ হাজার ১২০ কোটি টাকায়। সব মিলিয়ে গত বছর মোট ঋণের ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ পুনঃতফসিল করতে বাধ্য হয়েছে ব্যাংকগুলো। এভাবে গত পাঁচ বছরে মোট ৮৪ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টে এ তথ্য উঠে এসেছে।
ঋণ পুনঃতফসিলের পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার জারি হয় ২০১২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। পরবর্তী সময়ে আরো দুই দফায় সার্কুলার জারি করে ওই নীতিমালার কিছু শর্ত শিথিল করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নীতিমালার সুবিধা নিয়ে ২০১২ সালে মোট ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে ব্যাংকগুলো। এর পরের বছর থেকে ব্যাংকগুলোর ঋণ পুনঃতফসিলের গতি বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। ২০১৩ সালে ১৮ হাজার ২০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পেয়েছিলেন খেলাপি গ্রাহকরা। এরপর ২০১৪ সালে ১২ হাজার ৩৫০ কোটি ও ২০১৫ সালে ১৯ হাজার ১৪০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। ২০১৬ সালে ১৫ হাজার ৪২০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করার পর গত বছর আরো ২৪ শতাংশ বেড়ে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৯ হাজার ১২০ কোটি টাকায়। সব মিলিয়ে শুধু গত পাঁচ বছরেই ব্যাংকগুলো থেকে ৮৪ হাজার ৫০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা পেয়েছেন খেলাপি গ্রাহকরা। নির্বাচনী বছর হওয়ায় চলতি বছর দেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ আরো বাড়বে বলে মনে করছেন ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা।
ব্যাংকাররা বলছেন, গ্রাহক ও ব্যাংক উভয়ের স্বার্থেই ঋণ পুনঃতফসিল করতে হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে চাপের মুখে প্রভাবশালী গ্রাহকদের পুনঃতফসিল সুবিধা দিতে বাধ্য হচ্ছে ব্যাংক। এমনকি একই গ্রাহকের কোনো কোনো ঋণ ১০ বারও পুনঃতফসিল করতে হয়েছে। এর পরও এসব গ্রাহকের কাছ থেকে ব্যাংকের টাকা আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য হলো, বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তা ও প্রভাবশালী কিছু গ্রাহককে অনৈতিক সুবিধা দিতে গিয়েই ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধার অপব্যবহার করছে। বছরের পর বছর ধরে একই গ্রাহককে নানা ধরনের সুবিধা দেয়া হচ্ছে।
ব্যালান্সশিটে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে গিয়েই ব্যাংকগুলো ঢালাওভাবে বড় কিছু গ্রাহককে ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা দিচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের ঘাটতির কারণে বিশৃঙ্খলা চলছে। এ সুযোগে অসৎ ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা জনগণের আমানতের অর্থ তছরুপ করছেন। ঋণের নামে ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। এর দায় এসে পড়ছে সৎ ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, আমানতকারীসহ সাধারণ মানুষের ওপর।
তিনি বলেন, নানা কারণে ব্যাংকগুলো কিছু গ্রাহককে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। সে ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ায় ব্যাংক ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এখন ঝুঁকি কমাতে গিয়ে ওই গ্রাহকদের বারবার পুনঃতফসিল সুবিধা দিতে বাধ্য হচ্ছে। ভালো গ্রাহকরা ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা পেলে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। আর খারাপ গ্রাহকরা এটিকে অর্থ আত্মসাতের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। ঢালাওভাবে পুনঃতফসিল সুবিধা না দিয়ে ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব হবে অর্থ আদায়ে মনোযোগী হওয়া। বড় ঋণ থেকে বেরিয়ে এসএমই, কৃষিসহ উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগ বাড়ালে ব্যাংক ঝুঁকিমুক্ত হবে।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ঋণ পুনঃতফসিল করার বিষয়টি ব্যাংকিং খাতের নতুন কোনো ধারণা নয়। তবে ঢালাওভাবে এ সুবিধা দেয়ার পক্ষপাতী আমি নই। ব্যাংকের ব্যালান্সশিট পরিচ্ছন্ন রাখতে অনেক সময় ঋণ পুনঃতফসিল করতে হয়। তবে ক্যাশ ফ্লো দেখে তবেই গ্রাহকদের ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা দেয়া উচিত। অন্যথায় একই সুবিধা বারবার দিয়েও গ্রাহকদের কাছ থেকে ব্যাংকের অর্থ আদায় সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের ৫৩ দশমিক ১ শতাংশই দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর। ৪১ দশমিক ৯ শতাংশ ঋণ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো পুনঃতফসিল করেছে। এক্ষেত্রে সরকারি বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের অবদান ৪ দশমিক ১ শতাংশ। যদিও বিদেশী ব্যাংকগুলো ১ শতাংশেরও কম ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা দিয়েছে।
তবে কোন শ্রেণীর ব্যাংকঋণের কত শতাংশ পুনঃতফসিল করেছে, এমন পরিসংখ্যানে সবচেয়ে এগিয়ে আছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। ২০১৭ সালে এ ব্যাংকগুলো ঋণের ২৩ দশমিক ২ শতাংশই পুনঃতফসিল করতে বাধ্য হয়েছে। বিশেষায়িত দুটি ব্যাংকের ক্ষেত্রে এ হার ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ। বেসরকারি ৪০টি ব্যাংক বিতরণকৃত ঋণের ৬ দশমিক ৯ শতাংশ পুনঃতফসিল করেছে। যদিও বিদেশী ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এ হার মাত্র ২ দশমিক ৩ শতাংশ।
২০১৭ সালে ঋণ পুনঃতফসিলকৃত ঋণের অর্ধেকের বেশি বা ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশই করেছে মাত্র পাঁচটি ব্যাংক। এ তালিকায় নাম রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত তিনটি ও বেসরকারি দুটি ব্যাংকের। একইভাবে পুনঃতফসিল করা ঋণের ৭০ দশমিক ৬ শতাংশই মাত্র ১০টি ব্যাংকের। এ তালিকায় রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংকের পাশাপাশি নাম রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংকের।
বিশেষ শ্রেণীর গ্রাহকের ঋণ প্রতি বছর পুনঃতফসিল করা হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা। তারা বলছেন, নীতিমালায় কোনো ঋণ সর্বোচ্চ তিন দফায় পুনঃতফসিলের কথা উল্লেখ থাকলেও ১০-১৫ বারও এ সুবিধা পাচ্ছেন কোনো কোনো গ্রাহক। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর আবদার ও প্রভাবশালীদের চাপের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক নতি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকও চায় দেশে খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে থাকুক। এজন্য বছরের শেষের দিকে বাছবিচার ছাড়াই ঋণ পুনঃতফসিল আবেদনের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা, যা ব্যাংকিং খাতে ঋণের ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এর বাইরে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করে ব্যালান্সশিট থেকে বাদ দিয়েছে ব্যাংকগুলো।
কার্টসিঃ বনিক বার্তা/ আগস্ট ৮,২০১৮
No comments:
Post a Comment