Search

Monday, August 27, 2018

জনতা ব্যাংকে ক্রিসেন্ট গ্রুপের ৫ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি

পর্দার আড়ালে জাজ মাল্টিমিডিয়া


ভুয়া রফতানি নথি তৈরি করে জনতা ব্যাংক থেকে গত পাঁচ বছরেই ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বের করে নিয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপ। এ কেলেঙ্কারির বড় অংশই হয়েছে রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটির কাছে জনতা ব্যাংকের খেলাপি হয়ে পড়েছে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ। আর রিমেক্সের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন আবদুল আজিজ, যিনি জাজ মাল্টিমিডিয়ারও কর্ণধার। জনতা ব্যাংক কেলেঙ্কারির পর্দার আড়ালের প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাই জাজ মাল্টিমিডিয়াকে দেখছেন ব্যাংকাররা।

দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে জাজ মাল্টিমিডিয়ার আবির্ভাব ২০১১ সালে। এরপর একের পর এক ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে থাকে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটি। নবাব, শিকারি ও অগ্নি এর মধ্যে অন্যতম। এর বাইরে বস ২, পোড়ামন ২, বাদশা-দ্য ডনের মতো ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেছে তারা। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ প্রযোজনায় তৈরি বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রেও বিনিয়োগ করেছে জাজ মাল্টিমিডিয়া। মাহি, নুসরাত ফারিয়ার মতো নায়িকার উত্থান এ প্রতিষ্ঠানের হাতেই। শাকিব খানের ব্যবসাসফল অনেক চলচ্চিত্রও জাজ মাল্টিমিডিয়ার ব্যানারে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাজ মাল্টিমিডিয়ার চেয়ারম্যান আবদুল আজিজের বড় ভাই এমএ কাদের। কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত, পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও রফতানিকারক একাধিক প্রতিষ্ঠান আছে তার। এর মধ্যে রয়েছে— ক্রিসেন্ট লেদার প্রডাক্টস, ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ, ক্রিসেন্ট ফুটওয়্যার, রূপালী কম্পোজিট লেদার, লেক্সকো লিমিটেড ও গ্লোরী এগ্রো। সব প্রতিষ্ঠানই গড়ে তোলা হয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপের নামে। গ্রুপটির চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে রয়েছেন এমএ কাদের। আর রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের চেয়ারম্যান এমএ আজিজ। মূলত চামড়াজাত পণ্যের এ ব্যবসা পৈতৃক সূত্রে পেয়েছেন তারা।

চামড়াজাত পণ্যের ব্যবসায় দুই ভাইকে উদার হাতে ঋণ দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। ২০১০ সালের পর ঋণপ্রবাহের লাগাম ছিঁড়ে যায়। ২০১৩ সাল-পরবর্তী পাঁচ বছরেই জনতা ব্যাংক থেকে ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছেন এমএ কাদের ও এমএ আজিজ। এর মধ্যে পণ্য রফতানির বিপরীতে নগদ সহায়তা তহবিল থেকে তুলে নেয়া হয়েছে ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। দুই ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বর্তমানে ২ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে জনতা ব্যাংকের। এর বাইরে পণ্য রফতানির ১ হাজার ২৯৫ কোটি টাকাও আটকে গেছে।

ক্রিসেন্ট গ্রুপ কেলেঙ্কারির বড় অংশই হয়েছে জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার এমএ আজিজের মালিকানাধীন রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটির কাছে জনতা ব্যাংকের হাজার কোটি টাকার বেশি পাওনা রয়েছে।

জনতা ব্যাংক সূত্রমতে, ব্যাংকটি থেকে বের করে নেয়া এ ঋণই জাজ মাল্টিমিডিয়ার অর্থের মূল উৎস। রিমেক্স ফুটওয়্যার নামে একটি অখ্যাত চামড়াজাত পণ্যের কোম্পানির মাধ্যমে জনতা ব্যাংক থেকে এ অর্থ বের করে নেয়া হয়েছে। চলতি বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত রিমেক্স ফুটওয়্যারের কাছে ব্যাংকটির পাওয়া দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৬ কোটি ৮৪ লাখ ৪০ হাজার ৬২৩ টাকা। বৈদেশিক বাণিজ্যের ঋণ হিসেবে নেয়া এ অর্থের প্রায় পুরোটাই এখন খেলাপি।

জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজের ব্যবসায়িক পরিচিতি এমএ আজিজ নামে। জনতা ব্যাংকের নথিপত্রে রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবে এমএ আজিজ নামটিই রয়েছে। যদিও ১৫ আগস্ট বণিক বার্তার কাছে রিমেক্স ফুটওয়্যারের মালিকানার কথা অস্বীকার করেন জাজ মাল্টিমিডিয়ার চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ। তিনি বলেন, রিমেক্স ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান এমএ আজিজ তিনি নন। ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ কাদেরকেও তিনি চেনেন না। প্রতিবেদক এমএ আজিজ ও জাজ মাল্টিমিডিয়ার আবদুল আজিজকে ভুলবশত এক করে ফেলছেন। গতকালও একই দাবি করেন তিনি। তবে ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ কাদের জানান, আবদুল আজিজ তারই ভাই। তিনি জাজ মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে চলচ্চিত্র অঙ্গনে আছেন। রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড আমাদের পৈতৃক ব্যবসা।

এমএ আজিজ যে এমএ কাদেরের ভাই, সেটা জানিয়েছেন জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আব্দুছ ছালাম আজাদও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, রিমেক্স ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান এমএ আজিজকে আমরা এমএ কাদেরের ভাই বলেই জানি। এমএ আজিজ সিনেমা তৈরি করেন বলে শুনেছি।

ভুয়া রফতানি নথিপত্র তৈরি করেই মূলত জনতা ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ তুলে নিয়েছেন তারা। ব্যাংকটির পুরান ঢাকার ইমামগঞ্জ শাখার কয়েক কর্মকর্তাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বৃহৎ এ ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকের অনুসন্ধানে এরই মধ্যে জালিয়াতির বিষয়টি চিহ্নিত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইমামগঞ্জ শাখার এডি লাইসেন্স বাতিলের পাশাপাশি জনতা ব্যাংক ও দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। রফতানির আড়ালে ক্রিসেন্ট গ্রুপের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের প্রাথমিক প্রমাণও পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

দেশের ব্যাংকিং খাতের অন্যতম বৃহৎ এ ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তারা। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, পুরো ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঋণ নিয়ে আমরা খারাপ সময় পার করছি। এরই মধ্যে দায়ী ব্যাংকারদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ব্যাংকের প্রতিটি পর্ষদ সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ রফতানি বিলসহ অন্য ঋণগুলো আদায়ের জন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আমরা দফায় দফায় বৈঠক করছি। একটি যৌক্তিক সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।

চলতি বছরের ৩১ জুলাই রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের চেয়ারম্যান এমএ আজিজের নামে একটি চিঠি ইস্যু করে জনতা ব্যাংক। চিঠিতে এমএ আজিজের ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করা হয়, হাউজ নং-৫৩৬, রোড নং-১১, বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটি, আদাবর-১১, মোহাম্মদপুর, ঢাকা। ব্যাংকটির বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের (এফটিডি) উপমহাব্যবস্থাপক মো. রূহুল আমীন খান স্বাক্ষরিত চিঠিতে রিমেক্স ফুটওয়্যারের সব দায়-দেনা পুরান ঢাকার ইমামগঞ্জ থেকে লোকাল অফিসে স্থানান্তর করার বিষয়টি জানানো হয়। 

এমএ আজিজকে উদ্দেশ করে এতে লেখা হয়েছে, আপনি অবগত আছেন যে, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রধান কার্যালয়, ঢাকার ২৪ শে জুন, ২০১৮ তারিখের পত্র (সূত্র নং-এফইপিডি(এফইএমপি/০৩/(এ)/২০১৮-৫৬৩৩) এবং জনতা ব্যাংক লিমিটেড প্রধান কার্যালয়ের ফরেন ট্রেড ডিপার্টমেন্ট-এক্সপোর্ট-এর পত্র (সূত্র নং-এফটিডি/ইমামগঞ্জ/এডি লাইসেন্স/স্থগিত/১৮, তারিখ ২৫ জুন-২০১৮) মোতাবেক জনতা ব্যাংক লিমিটেড ইমামগঞ্জ করপোরেট শাখায় পরিচালিত আপনার প্রতিষ্ঠানের দায়-দেনা জনতা ব্যাংক লিমিটেড লোকাল অফিস, ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে।

রিমেক্স ফুটওয়্যারের দায়-দেনার একটি হিসাবও উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে। তাতে দেখা যায়, গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত রিমেক্স ফুটওয়্যারের কাছে রফতানি বিল ক্রয় (এফডিবিপি) বাবদ জনতা ব্যাংকের পাওনা রয়েছে ৫৩৫ কোটি ৮৫ লাখ ৭৪ হাজার ২৯০ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি প্যাকিং ক্রেডিট (পিসি) বাবদ ১৬৬ কোটি ৮৬ লাখ ৮০ হাজার ৪৫৭ টাকা ঋণ নিয়েছে। সাধারণত রফতানি পণ্য শিপমেন্টের জন্য এ ধরনের ঋণ দেয়া হয়। রিমেক্স ফুটওয়্যার রফতানির জন্য অগ্রিম ক্যাশ সাবসিডি হিসেবে নিয়েছে ১৪ কোটি ৮৩ লাখ ৪৪ হাজার ৩৪২ টাকা।

এছাড়া রফতানি বিল প্রত্যাবাসন না হওয়ায় প্রায় ১০৪ কোটি টাকা ফোর্সড লোন সৃষ্টি হয়েছে। রিমেক্স ফুটওয়্যারের অন্য দায়গুলো হলো— সিসি হাইপো ৯৪ কোটি ৩৮ লাখ ৪৫ হাজার ৬৭০ টাকা, সিসি প্লেজ ১০৮ কোটি ৯০ লাখ ৭ হাজার ৮৬৪ টাকা, আইএফডিবিসি ৭১ লাখ ৫ হাজার টাকা এবং এলসি বাবদ ১ কোটি ৩২ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে চলতি বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত রিমেক্স ফুটওয়্যারের কাছে জনতা ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৬ কোটি ৮৪ লাখ ৪০ হাজার ৬২৩ টাকা।

মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও জনতা ব্যাংকের কেনা রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের রফতানি বিলের অর্থ দেশে আসছে না। বিষয়টি উদ্ধৃত করে এমএ আজিজকে দেয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের দায়-দেনাগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে অপ্রত্যাবাসিত এফডিবিপি দায় ও এফডিবিসি রয়েছে, যা প্রত্যাবাসন করা অতীব জরুরি। এফডিবিপি ও এফডিবিসি সংশ্লিষ্ট বায়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করে অতিসত্বর এর মূল্য সংশ্লিষ্ট হিসাবে প্রত্যাবাসনের জন্য অনুরোধ করা হলো।

চিঠিতে বলা হয়েছে, পিসি ঋণ অগ্রিম ক্যাশ সাবসিডি, পিএডি ক্যাশ ও লোন জেনারেল (ফোর্সড)— এ ঋণ হিসাবগুলো দ্রুত সমন্বয় করা অপরিহার্য। তাছাড়া সীমাতিরিক্ত ইসিসি হাইপো, ইসিসি প্লেজ, সিসি হাইপো, সিসি প্লেজ দায় সমন্বয় করে ওই হিসাবগুলো নিয়মিত রাখা অত্যাবশ্যক। অন্যদিকে আমদানি বিল বাবদ অপরিশোধিত আইএফডিবিসি ও এলসি (যেসব ডকুমেন্ট ব্যাংকে জমা রয়েছে) দায়গুলো দ্রুত সমন্বয় করা আবশ্যক। এমএ আজিজকে দেয়া চিঠিতে ব্যাংকের সব দায় পরিশোধের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধও করা হয়েছে।

জনতা ব্যাংক এমডি এ প্রসঙ্গে বলেন, রিমেক্স ফুটওয়্যারের কাছ থেকে পাওনা অর্থ আদায়ের জন্য প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান এমএ আজিজকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তিনি ব্যাংকের পাওনা টাকা দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফেরত দেবেন বলে প্রত্যাশা করছি।

সূত্র বলছে, জনতা ব্যাংক থেকে অবাধে ঋণপ্রাপ্তির সময় থেকেই জাজ মাল্টিমিডিয়ার উত্থান। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার আবদুল আজিজ নিজেও বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমকে বলেছেন, দেশের চলচ্চিত্র শিল্প জাজ মাল্টিমিডিয়াই বাঁচিয়ে রেখেছে। জাজ না থাকলে বাংলা চলচ্চিত্র থাকবে না।

তবে তার এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়ক ফারুক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দেশের চলচ্চিত্র শিল্প শিশু নয়। এ শিল্পের সঙ্গে বহু মানুষ জড়িত। তারাই এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। জাজ না থাকলে চলচ্চিত্র থাকবে না, এটা অবান্তর।
  • কার্টসিঃ বনিক বার্তা/ আগস্ট ২৭,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment