Search

Wednesday, August 29, 2018

ফারমার্স ব্যাংক বাঁচাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সহায়তা শেষ হচ্ছে না

হাছান আদনান

ফারমার্স ব্যাংককে বাঁচাতে ৭১৫ কোটি টাকার মূলধন এরই মধ্যে জোগান দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। আগে থেকেই মেয়াদি আমানত ও কলমানি হিসেবে ফারমার্সকে ধার দেয়া চার ব্যাংকের প্রায় ৫৫০ কোটি টাকাও আটকে আছে। কেলেঙ্কারিতে বিপর্যস্ত ব্যাংকটি বন্ড ছেড়ে ১ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের উদ্যোগ নিলেও কোনো বেসরকারি ব্যাংক এতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। প্রথম ধাপে ৫০০ কোটি টাকার বন্ড কেনার মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংকে আরো অর্থ ঢালার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক এবং আইসিবি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ব্যাংকিং খাতের নীতিনির্ধারণী নানা বিষয়ে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) ভূমিকা রাখলেও ফারমার্স ব্যাংক উদ্ধার প্রক্রিয়ায় তারা নীরব। এ অবস্থায় ডুবন্ত ব্যাংকটিকে টেনে তোলার দায়িত্ব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ওপরই পড়ছে।

সূত্রমতে, ফারমার্স ব্যাংকের মূলধন বাড়াতে ১ হাজার কোটি টাকার বন্ড ছাড়ার অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুই দফায় ৫০০ কোটি টাকা করে বাজার থেকে এ টাকা সংগ্রহ করবে ব্যাংকটি। এর অংশ হিসেবে প্রথম দফায় ৫০০ কোটি টাকার বন্ড বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করেছে ফারমার্স ব্যাংক। এ বন্ডের ক্রেতা হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক এবং সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) বেছে নেয়া হয়েছে। ৩০০ কোটি টাকার বন্ড কেনার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংককে প্রস্তাব দিয়েছে ফারমার্স ব্যাংক। প্রস্তাবটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির আগামী পর্ষদ সভায় উপস্থাপনের জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। একইভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা, অগ্রণী ও রূপালী প্রতিটি ব্যাংকের কাছে ১০০ কোটি টাকার বন্ড বিক্রির প্রস্তাব পাঠিয়েছে ফারমার্স ব্যাংক। এরই মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ফারমার্স ব্যাংকের ১০০ কোটি টাকার বন্ড কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শামস-উল-ইসলাম ফারমার্স ব্যাংকেরও পরিচালক। ব্যাংকটির বন্ড কেনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ফারমার্স ব্যাংক উদ্ধার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অগ্রণী ব্যাংক এরই মধ্যে ১৬৫ কোটি টাকা মূলধন জোগান দিয়েছে। ব্যাংকটির কাছে মেয়াদি আমানত (এফডিআর) ও কলমানি হিসেবে আমাদের ১৫০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ আছে। তার পরও আমরা ১০০ কোটি টাকার বন্ড কেনার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছি। মূলধন জোগান দেয়ার মাধ্যমে এখন আমরাও ফারমার্স ব্যাংকের অংশীজন। এজন্যই ব্যাংকটির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বন্ড কিনতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের বন্ড শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক কিনবে কেন? বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কাছেও ফারমার্সের বন্ড বিক্রি করতে হবে। পরিচালক হিসেবে বিষয়টি আমি ফারমার্সের পর্ষদ সভায় উত্থাপন করেছি। আশা করছি, ফারমার্স ব্যাংককে সুস্থ করতে বেসরকারি ব্যাংকগুলো এগিয়ে আসবে।

তবে বন্ড কেনার আগে কয়েকটি বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা চেয়ে ফারমার্সকে চিঠি দিয়েছে রূপালী ব্যাংক। চিঠির জবাব পেলে তবেই বন্ড কেনার বিষয়টি পর্ষদে উত্থাপন করা হবে বলে ব্যাংকটি নিশ্চিত করেছে।

রূপালী ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ফারমার্স ব্যাংকের বন্ড কেনার প্রস্তাবে বেশকিছু অসংলগ্নতা রয়েছে। বন্ড কেনার পর সেটির এক্সিট পলিসির বিষয়টি সুস্পষ্ট নয়। ট্রাস্টির ফি বেশি হওয়া, বন্ডের ক্রেডিট রেটিংসহ কয়েকটি বিষয়ে সমস্যা রয়েছে। এজন্য রূপালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে ফারমার্সে চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠির জবাব সন্তোষজনক হলে তবেই রূপালী ব্যাংকের পর্ষদে বন্ড কেনার প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে।

জনতা ব্যাংকের প্রস্তাবটিও পর্ষদ সভায় উত্থাপনের জন্য নথিভুক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ এ প্রসঙ্গে বলেন, মূলধন জোগান দেয়ায় আমরাও এখন ফারমার্স ব্যাংকের অংশ। ব্যাংকটিকে দাঁড় করাতে বন্ড ছাড়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমরা ১০০ কোটি টাকার বন্ড কেনার প্রস্তাব পেয়েছি। জনতা ব্যাংকের পর্ষদ সভায় বিষয়টি উত্থাপন করার প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া আইসিবিকে ২০০ কোটি টাকার বন্ড কেনার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে ফারমার্স ব্যাংক। এ প্রস্তাবও প্রতিষ্ঠানটির পর্ষদ সভায় অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।

২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়া ফারমার্স ব্যাংকের যাত্রা হয় ৪০১ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে। এর মধ্যে ৩৯ জন ব্যক্তি-উদ্যোক্তার বিনিয়োগের পরিমাণ ২৯৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা, যা ব্যাংকটির মোট মূলধনের ৭৩ দশমিক ১১ শতাংশ। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে ১০টি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ১০০ কোটি টাকা, যা মোট মূলধনের ২৮ দশমিক ৯০ শতাংশ। এছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক ৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ ছিল ফারমার্স ব্যাংকে। ৩৯ জন ব্যক্তি-উদ্যোক্তার মধ্যে ১৬ জন ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে থেকে পরিচালক ছিলেন সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সারাফাত, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হাসান তাহের ইমাম এবং আইসিবির প্রতিনিধি।

অনিয়ম-দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত ফারমার্স ব্যাংককে টেনে তুলতে গত বছরের শেষের দিকে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২৭ নভেম্বর ব্যাংকটির পর্ষদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তিনি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। একই দিন ব্যাংকটির অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীও পদচ্যুত হন।

আরেক পরিচালক ড. মোহাম্মদ আতাহার উদ্দিন ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়ান। এরপর বৈঠকে ব্যাংকের পরিচালক মোহাম্মদ মাসুদকে চেয়ারম্যান ও মারুফ আলমকে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। নতুন করে ব্যাংকটির সবক’টি কমিটি পুনর্গঠন করে ঢেলে সাজানো হয়।

ব্যাংকটির পুনর্গঠিত পর্ষদের সঙ্গে গত বছরের ২৯ নভেম্বর বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই বৈঠক থেকে সাতদিনের মধ্যে পরিচালকদের অন্তত ২০০ কোটি টাকার জোগান দিতে গভর্নর ফজলে কবির নির্দেশ দেন। একই দিন ব্যাংকটিকে টেনে তুলতে নতুন পর্ষদকে তিন মাস সময় বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু পরিচালকরা টাকা না দেয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এরপর মোহাম্মদ মাসুদকে সরিয়ে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে চৌধুরী নাফিজ সারাফাত দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

দেশের পুরো ব্যাংকিং খাতে ক্ষত সৃষ্টি করা ফারমার্স ব্যাংককে টেনে তোলার দায়িত্ব এককভাবে কাঁধে তুলে নেয় সরকার। ডুবন্ত ব্যাংকটি উদ্ধারে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৭১৫ কোটি টাকা জোগান দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী এবং রূপালী ব্যাংক ১৬৫ কোটি টাকা করে মূলধন জোগান দেয়। এর বাইরে আইসিবি দিয়েছে ৫৫ কোটি টাকা। যদিও প্রতিষ্ঠালগ্নেই ফারমার্স ব্যাংকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আইসিবি ৬০ কোটি টাকা মূলধন জোগান দিয়েছিল। সব মিলিয়ে চলতি বছরের মে মাসে ফারমার্স ব্যাংকে ৭১৫ কোটি টাকা মূলধন জোগান দেয় রাষ্ট্রায়ত্ত এ পাঁচ প্রতিষ্ঠান। নতুন করে জোগান দেয়া মূলধন যুক্ত হয়ে ফারমার্স ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা।

মূলধন জোগান দেয়ার বিপরীতে চার ব্যাংক ও আইসিবি ফারমার্স ব্যাংকে পরিচালক পদ পায়। বর্তমানে ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করছেন চৌধুরী নাফিজ সারাফাত। তিনি ফার্স্ট জনতা ব্যাংক মিউচুয়াল ফান্ডের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যাংকটির পর্ষদে আছেন। ব্যাংকটির অন্য পরিচালকরা হলেন— ইবিএল এনআরবি মিউচুয়াল ফান্ডের প্রতিনিধি হাসান তাহের ইমাম, সোনালী ব্যাংকের প্রতিনিধি মো. ওবায়েদ উল্লাহ্ আল্ মাসুদ, জনতা ব্যাংকের প্রতিনিধি মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ, অগ্রণী ব্যাংকের প্রতিনিধি মো. শামস-উল-ইসলাম, রূপালী ব্যাংকের প্রতিনিধি মো. আতাউর রহমান প্রধান, আইসিবির প্রতিনিধি কাজী সানাউল হক, ট্রাস্ট ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ডের প্রতিনিধি মো. আবু কায়সার, ফার্স্ট বাংলাদেশ ফিক্সড ইনকাম ফান্ডের প্রতিনিধি তামিম মারজান হুদা।

মেয়াদি আমানত ও কলমানি হিসেবে ফারমার্স ব্যাংকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে জনতা ব্যাংকের। পরবর্তী সময়ে ব্যাংকটি উদ্ধার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৬৫ কোটি টাকা মূলধন জোগান দিয়েছে জনতা ব্যাংক। তার পরও নতুন করে ফারমার্সের ১০০ কোটি টাকার বন্ড কিনতে হচ্ছে ব্যাংকটিকে।

চলতি বছরের মার্চ শেষে ফারমার্স ব্যাংকের আমানত ছিল ৪ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। একই সময়ে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণ ছিল ৫ হাজার ২৮ কোটি টাকা। আমানতের চেয়ে ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় মুখ থুবড়ে পড়ে ফারমার্স ব্যাংক। এর মধ্যে ৯৬৭ কোটি টাকার ঋণ নাম লিখিয়েছে খেলাপির খাতায়, যা ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ১৯ শতাংশ। বিপর্যস্ত ব্যাংকটি ২০১৭ সালে ৫৩ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। ফারমার্স ব্যাংকে আমানত জমা রেখে ফেরত পায়নি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এ প্রতিষ্ঠানগুলো টাকা না পেয়ে এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দফায় দফায় অভিযোগ জানিয়েছে। আমানত তুলতে মুখিয়ে আছে বেসরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসহ ফারমার্স ব্যাংকে টাকা রাখা গ্রাহকরাও।

এ বিষয়ে ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সারাফাত ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. এহসান খসরুর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তাদের উভয়ের মোবাইল নম্বরই বন্ধ পাওয়া গেছে।

  • কার্টসিঃ বনিক বার্তা/ আগস্ট ২৯,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment