Search

Saturday, August 18, 2018

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন - মুক্তি নেই, চলছে ধরপাকড়

এবার ঢাকার বাইরে মামলা ও গ্রেপ্তার। মোট ৫২ মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৯৯ স্বজনেরা মুক্তি চেয়ে মানববন্ধন করেছেন। 


এক মা তাঁর ছেলের সঙ্গে ঈদ করতে চান। আরেক মা চান তাঁর মেয়ে সুস্থভাবে ফিরে আসুক। রিকশাচালক বাবা তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরতে চান। বড় বোনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের বদলে তাঁর মুক্তি চান ছোট বোন। এভাবে নিরাপদ সড়ক এবং সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের ঈদের আগে মুক্তি চেয়েছেন তাঁদের স্বজনেরা।

তবে স্বজনেরা মুক্তি চাইলেও কোটা সংস্কার এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের বিষয়ে সরকার আরও কঠোর হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবারও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানির অভিযোগে ঢাকা ও খুলনা থেকে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আন্দোলন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরও যাঁরা মন্তব্য করেছেন, তাঁদেরও খুঁজছে পুলিশ। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলোর ভেতরেও রয়েছে আতঙ্ক।

জানতে চাইলে পুলিশের জনসংযোগ শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে যারা মিথ্যা রটিয়েছিল, গুজব ছড়িয়েছিল, পুলিশ শুধু তাদের বিরুদ্ধেই আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে। সব ক্ষেত্রেই আইনি প্রক্রিয়া যথাযথ অনুসরণ করা হচ্ছে।

গত ২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলায় বাসচাপায় নিহত হয় দুই কলেজশিক্ষার্থী। এরপর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ওই আন্দোলনে সহিংস ঘটনা ও উসকানির অভিযোগে দায়ের হওয়া ৫২টি মামলায় এখন পর্যন্ত ৯৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪ আগস্ট ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়সহ হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ অজ্ঞাতনামা কয়েক শ ব্যক্তিকে আসামি করে তিনটি মামলা করে। এসব মামলায় ৫ আগস্ট ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের ১২ জনই বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কারও বিরুদ্ধেই পুলিশের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তাঁদের মধ্যে ১৩ আসামিকে গত বৃহস্পতিবার থেকে ছয় দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে পুলিশ। এ ছাড়া কোটা আন্দোলনকারী সাত শিক্ষার্থী কারাগারে আছেন।

নারী উদ্যোক্তা আটক

ফেসবুকে উসকানিমূলক পোস্ট ও গুজব ছড়ানোর অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে ফারিয়া মাহজাবিন নামের এক নারী উদ্যোক্তাকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব-২। ফারিয়া খুলনার বেসরকারি নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। তিনি ধানমন্ডির একটি কফি হাউসের অন্যতম মালিক।

র‍্যাব-২-এর গণমাধ্যম শাখার জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক রবিউল ইসলাম বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র‍্যাব-২-এর একটি দল গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১১টার দিকে অভিযান চালিয়ে ধানমন্ডির আফসার উদ্দিন রোডের নিজেদের বাসা থেকে ফারিয়া মাহজাবিনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর কাছ থেকে একটি মুঠোফোন সেট, এক পাতা করে ফেসবুক আইডি প্রোফাইলের প্রিন্ট কপি ও অডিও ক্লিপের প্রিন্ট কপি জব্দ করা হয়।

ফারিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে ভবিষ্যতে এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানায় র‍্যাব।

এবার ঢাকার বাইরে গ্রেপ্তার

খুলনা প্রতিনিধি জানান, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন থেমে যাওয়ার ১৩ দিন পর বুধবার রাতে খুলনার সোনাডাঙ্গা থানায় মামলা করেছিল পুলিশ। এতে ১৩ জনের নামসহ অজ্ঞাতপরিচয় ১৫০ থেকে ২০০ শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়। তাঁদের মধ্যে চারজন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাঁরা হলেন স্থাপত্য বিভাগের ছাত্র আবদুল্লাহ আল নোমান, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের মো. নাবিদ হাসান, ফার্মেসি বিভাগের মো. নাহারুল ইসলাম এবং ইংরেজি বিভাগের মো. ইমরান হাসান। ঢাকার বাইরে খুলনাতেই আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা হলো।

সোনাডাঙ্গা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) অচিন্ত্য হালদার মামলাটি করেন। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, আন্দোলন চলার সময় ২ আগস্ট বেলা একটার দিকে নগরের শিববাড়ি মোড়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল্লাহ আল নোমানের নেতৃত্বে এজাহারভুক্ত আসামিসহ অজ্ঞাতনামা শিক্ষার্থীরা পুলিশের ব্যারিকেড সরিয়ে ফেলে। তারা সাধারণের ওপর হামলা, পুলিশের গাড়িসহ অন্যান্য যানবাহন ভাঙচুর, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের খেপিয়ে আন্দোলন উসকে দিয়ে ক্ষতি সাধন করে। এ ছাড়া তিন পুলিশ সদস্যকে লাঞ্ছিত করে এবং অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে সরকারি কাজে বাধা দেয়।

গত বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশ এই মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইবনে খালিদকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হলে আগামী রোববার রিমান্ডের শুনানির দিন ধার্য করে আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।

ঘটনার ১৩ দিন পর মামলা করা হলো কেন জানতে চাইলে নগরের সোনাডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মমতাজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের নাম-ঠিকানা, তথ্য বের করতে দেরি হয়েছে। তাই মামলা করতেও দেরি হয়েছে।

ঈদের আগে মুক্তির দাবি

‘নির্যাতন, নিপীড়ন বন্ধ করো, গ্রেপ্তার করা শিক্ষার্থীদের মুক্তি দাও’—এ ব্যানারে গতকাল শুক্রবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষার্থীদের পরিবারের সদস্যরা। এ সময় ইডেন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী লুৎফুন্নাহারের মা রাশিদা খাতুন ‘আমার মেয়েকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করছি’—এটুকু বলে কান্নার দমকে বক্তব্য শেষ করতে পারেননি।

পুলিশের সাইবার অপরাধ বিভাগের একটি দল সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানার গ্রামের বাড়ি থেকে লুৎফুন্নাহার ওরফে লুমাকে তুলে আনে। গত বৃহস্পতিবার তাঁকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

লুৎফুন্নাহারের বোন কেয়া সরকার বলেন, ‘আমার বোন কিছু করেনি। কোনো অন্যায় কাজের সঙ্গে জড়িত না। ইচ্ছাকৃতভাবে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এই পৃথিবীতে আমাদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই।’

ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার রিকশাচালক মজিবর রহমানের ছেলে মশিউর রহমান দেড় মাসের বেশি সময় ধরে কারাগারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী মশিউর কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা। মজিবর রহমান বলেন, ‘রিকশা চালিয়ে ছেলেকে লেখাপড়া করাইছি। বহু কষ্টে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাইছি। আমার ছেলে কোনো অন্যায়ে জড়িত ছিল না।’

সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানের মা সালেহা বেগম বলেন, ‘আমার বাবা কোনো অপরাধ করেনি। আমার বাবাকে ছেড়ে দিন। বাবাকে ছাড়া আমি ঈদ করতে পারব না। ঈদের আগে বাবাকে ছেড়ে দিন।’

গতকালের মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘হাতে দড়ি বেঁধে ছাত্রদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এটা সভ্য সমাজের লক্ষণ না।’ নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘মন্ত্রী, সাংসদ সবাই বলছেন, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের গ্রেপ্তার করা হবে। অথচ সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না।’ আন্দোলনের সময় দায়িত্বরত সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের বিচার দাবি করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান।

দাবি না মানলে আন্দোলন

কোটা সংস্কার আন্দোলনে গ্রেপ্তার হওয়া সব নেতার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচার ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে এক সংবাদ সম্মেলনে ৩১ আগস্টের মধ্যে দাবি মেনে না নিলে আবারও রাজপথে আন্দোলন শুরু করা হবে বলে জানান পরিষদের নেতারা। তাঁদের অন্য দাবিগুলোর মধ্যে আছে কোটা পদ্ধতির যৌক্তিক সংস্কার ও আন্দোলনকারীদের ওপর হামলাকারীদের বিচার।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক আতাউল্লাহ। এ সময় যুগ্ম আহ্বায়ক বিন ইয়ামিন বলেন, ‘গুজবে কান দেবেন না’ নামক একটি ফেসবুক পেজ থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের নামে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এসব তথ্য আমলে নিয়ে ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছেন। এই পেজটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ আগস্ট ১৮,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment