Search

Thursday, August 9, 2018

সড়ক পরিবহন আইন - গণপরিবহনে শৃঙ্খলার বিষয়টি উপেক্ষিত


  • সোমবার মন্ত্রিসভায় অনুমোদন
  • সরকার বলছে, চালকের সাজা বেড়েছে
  • বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাজা কমেছে
  • মালিক-শ্রমিক প্রাধান্য
  • ভাড়া নির্ধারণে অস্পষ্টতা



বাস-মিনিবাস চলাচলের অনুমোদন প্রক্রিয়া সংস্কার ও ভাড়া নির্ধারণের মতো বিষয়গুলো প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইনে স্পষ্ট করা হয়নি। গণপরিবহনে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য এ দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞ ও সড়কে শৃঙ্খলার দাবিতে সোচ্চার সংগঠনগুলো বলছে, প্রস্তাবিত আইনে যাত্রীদের প্রতিনিধিত্ব উপেক্ষিতই থেকে গেল।

গত সোমবার মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া এই আইনে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকের সাজা বাড়ানোর কথা বলা হলেও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীরা বলছেন, সাজা বাড়ানো হয়নি, উল্টো কমানো হয়েছে। মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, আগে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০৪ (বি)-তে সাজা ছিল ৭ বছর। ১৯৮৫ সালে ৩ বছর করা হয়। এখন সাজা বাড়িয়ে ৫ বছর করা হয়েছে।

আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি জানিয়েছেন, ১৯৮৫ সালে সাজা কমিয়ে ৩ বছর করার পর তিনি জনস্বার্থে হাইকোর্টে একটি মামলা করেছিলেন। হাইকোর্ট ২০১৪ সালের নভেম্বরে দেওয়া রায়ে সাজা কমানোর বিষয়টি বাতিল করে দেন। ফলে দায়ী চালকের সর্বোচ্চ সাজা ৭ বছর বহাল আছে। কিন্তু আইনমন্ত্রী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ওনারা যেসব কথা বলছেন তা ঠিক নয়। কারণ, আইন প্রণয়ন করে সংসদ।

গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার বিষয়টি বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনের চাপেই সরকার তড়িঘড়ি সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করল। সংসদে পাস হলে এটি আইনে পরিণত হবে। কিন্তু বাস চলাচলের অনুমোদন প্রক্রিয়ার সংস্কারের দাবি এই আইনে উপেক্ষিত বলে সমালোচনা আছে। দাবি ছিল সব বাস-মিনিবাস অল্প কিছু কোম্পানির অধীনে নিয়ে আসা এবং তা কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনা করা। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘রুট ফ্রান্সাইজ’ পদ্ধতি। 

ঢাকার জন্য সরকারের করা ২০ বছরের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) এবং জাপানি সংস্থা জাইকার এক সমীক্ষাতেও গণপরিবহনে শৃঙ্খলার জন্য এই ব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করা হয়েছিল। এসটিপি করা হয় ২০০৫ সালে। আর জাইকার সমীক্ষা করা হয় ২০১৫ সালে। এসটিপির প্রতিবেদন ও জাইকার সমীক্ষায় ঢাকার সব বাস-মিনিবাস তিন-চারটি কোম্পানির অধীনে এনে পরিচালনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। ঢাকার প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর বিষয়টি আটকে যায়।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুর কৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার পরিবহনের বিশৃঙ্খলার জন্ম এর অনুমোদন প্রক্রিয়া থেকেই। অপেশাদার ও অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মালিক-শ্রমিকদের ইচ্ছা অনুযায়ী পরিবহনের অনুমোদন দেওয়া হয়। এটি গণপরিবহনে অসুস্থ প্রতিযোগিতার মূল উৎস। সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণও এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এই ভেজাল ব্যবস্থা দূর করার কোনো নির্দেশনা নেই প্রস্তাবিত আইনে। এই ব্যবস্থা রেখে কোনোভাবেই নিরাপদ সড়কের দাবি পূরণ হবে না। এটা সাংঘাতিক রকমের ভুল।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সূত্র বলছে, ঢাকায় ২৪৬টি কোম্পানির অধীনে বাস চলে প্রায় ৮ হাজার। আর বাসমালিকের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। প্রভাবশালী কিংবা রাজনীতিকেরা কোম্পানি খুলে পরিবহন কমিটির অনুমোদন নেন। এরপর নিজে দু-একটা বাস কিনে অন্যদের কাছ থেকে বাস নিয়ে চালানো শুরু করেন। এই প্রক্রিয়া অসুস্থ প্রতিযোগিতার পাশাপাশি চাঁদাবাজিকেও উৎসাহিত করে।

মালিক-শ্রমিক প্রাধান্য

ঢাকাসহ সারা দেশের প্রতিটি জেলা ও মহানগরে বাস চলাচলের অনুমোদন দিয়ে থাকে আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি (আরটিসি)। বিদ্যমান মোটরযান আইন, ১৯৮৩ অনুযায়ী কমিটিতে মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের একজন করে প্রতিনিধি থাকার কথা। কিন্তু সব স্থানেই তিন-চারজন করে মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধি আছেন। প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইনে এই কমিটিতে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের ন্যূনতম একজন করে প্রতিনিধি রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর অর্থ একাধিক প্রতিনিধিও রাখা যাবে। অথচ সেখানে যাত্রীদের কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়নি।

আরটিসি প্রায় ৩০ শর্তে বাস-মিনিবাস চলাচলের অনুমোদন দেয়। এর মধ্যে সরকার-নির্ধারিত ভাড়া আদায়, যাত্রীর সঙ্গে সদাচরণ, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হালনাগাদ থাকা, আইন মানার বিষয়টি রয়েছে। এর একটি শর্ত লঙ্ঘন করলেই অনুমোদন বাতিল করার ক্ষমতা আছে আরটিসির। কিন্তু এই ক্ষমতা প্রয়োগ করার কথা কখনো শোনা যায় না।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রস্তাবিত আইন নিয়ে নানা পরামর্শ আসছে। কোনো দুর্বলতা যদি থাকে এবং তা কাটানোর একটা সুযোগ আছে। সংসদীয় কমিটিতে আরও আলোচনা হবে।

ভাড়া নির্ধারণে অস্পষ্টতা

প্রস্তাবিত আইনে বলা আছে, সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গণপরিবহনের জন্য ভাড়ার হার ও সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ ও পুনর্নির্ধারণ করা যাবে। তবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল ও বিশেষ সুবিধার গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না।

এই ধারাটি আগের আইনেও ছিল। দীর্ঘদিন ধরেই যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। কারণ, ঢাকায় ‘সিটিং সার্ভিস’-এর মতো বিশেষ ব্যবস্থায় চলা বাসগুলোতে উঠলেই সর্বনিম্ন ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। অথচ সরকার ঢাকায় মিনিবাসের ন্যূনতম ভাড়া ৫ টাকা এবং বড় বাসের জন্য ৭ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এসব পরিবহনে সরকারি ভাড়ার হার মানা হচ্ছে না।

দূরপাল্লার পথে প্রচুর শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) বাস চলছে। ঢাকায়ও বেশ কিছু কোম্পানি এসি বাস নামিয়েছে। এরা নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া ঠিক করছে। এ ছাড়া বিআরটিএ ৩১ আসনের মিনিবাস ও ৫২ আসনের বড় বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু এখন ঢাকায় ৩১-৪০ আসনের বাস চলছে। দূরপাল্লার পথে ২৬, ৪০ ও ৫২ আসনের বাস চলাচল করে। এর মালিকেরা নিজেদের মতো করে ভাড়া নির্ধারণ করেন।

বাসের ভাড়া নির্ধারণে বিআরটিএর ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি রয়েছে। এই কমিটিতে সরকারি কর্মকর্তার বাইরে বেশির ভাগই মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধি। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) একজন প্রতিনিধি থাকলেও তাঁর খুব একটা ভূমিকা থাকে না। মালিক-শ্রমিকেরাই সেখানে প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি। বর্তমান আইনে ভাড়া নির্ধারণ কমিটি সম্পর্কে কিছু বলা নেই। প্রস্তাবিত আইনেও তা উল্লেখ নেই।

এ ছাড়া সড়ক নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরিষদে মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধি ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের রাখার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। কিন্তু যাত্রীদের প্রতিনিধি সম্পর্কে স্পষ্ট করা হয়নি।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আধুনিক আইন করার লক্ষ্যই হচ্ছে আগে যা ছিল না, তা অন্তর্ভুক্ত করা। কিন্তু গণপরিবহনের কমিটি ও শৃঙ্খলার ব্যাপারে প্রস্তাবিত আইন হতাশ করেছে।
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ আগস্ট ৯,২০১৮

No comments:

Post a Comment