Search

Thursday, August 30, 2018

‘গুম হওয়ার চেয়ে কারাবাস ভালো’

শেখ সাবিহা আলম

  • আজ আন্তর্জাতিক গুম দিবস
  • ২০০৯ সাল থেকে এ বছরের জুলাই পর্যন্ত ‘গুম’ হয়েছেন ৪৩২ জন
  • ফিরে আসা ব্যক্তিরা অপহরণকারীদের ব্যাপারে মুখ খোলেননি
  • গুমের শিকার পাঁচ ব্যক্তি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে

বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল সেদিন। গাড়ি ধরবেন বলে রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন কেবল, হঠাৎ ছয়-সাতজন লোক কিছু না বলে একরকম ছোঁ মেরে তাঁকে মাইক্রোবাসে তুলে ফেলেন। চোখ আর হাত দুটো বাঁধা হয়ে যায় মুহূর্তে। কিন্তু ব্যাপারটা কী? কেউ কোনো কথার জবাব দিচ্ছেন না। রাতের ঢাকার ফাঁকা রাস্তায় শুধু গাড়িটা ছুটছে। একপর্যায়ে তিনি কোনো এক গন্তব্যে পৌঁছালেন। তখনো জানতেন না এই অজ্ঞাতবাসেই ছয় মাস কাটাতে হবে তাঁকে।

যাঁর কথা বলা হচ্ছে, তিনি ২০১৬ সালে ছয় মাসের বেশি সময় গুম হয়েছিলেন। আজ আন্তর্জাতিক গুম দিবস। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের হিসাবে ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত এমন মানুষের সংখ্যা ৪৩২। তাঁদের মধ্যে খোঁজ পাওয়া গেছে ২৫০ জনের। অজ্ঞাতবাস থেকে যাঁরা ফিরেছেন, তাঁরা আর অপহরণকারীদের ব্যাপারে মুখ খোলেননি। অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে চিকিৎসাধীন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলেছে, পরিবার, স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছেন, র‍্যাব, ডিবি ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে তাঁদের স্বজনদের তুলে নেওয়া হয়েছে। অনেক সময় তাঁরা জিডিও করতে পারেননি। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বরাবর গুমের অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, যখনই কোনো নিখোঁজ সংবাদ আসে, তখনই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আইনি পন্থায় তাঁকে খুঁজে দিতে বাংলাদেশ পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করে।

গুমের শিকার হওয়া পাঁচ ব্যক্তি সম্প্রতি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। এই পাঁচজনই ২০১৬ ও ২০১৭ সালের বিভিন্ন সময় গুমের শিকার হন। জীবন নিয়ে ফিরে আসা এই মানুষগুলো বলেছেন, গুম হওয়ার চেয়ে তাঁদের কাছে কারাবাস ভালো।

গুমের শিকার ব্যক্তিদের কথা 

প্রথমে যাঁর কথা বলা হলো তিনি গাড়ির ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর চোখ খুললে এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, কিছু খেতে চান কি না। এরপর জেরা শুরু হয়। বাসস্থান, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, পরিবার, মুঠোফোনের অ্যাপস, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাতায়াত, বন্ধুবান্ধব, আওয়ামী লীগ-জামায়াত-জঙ্গিগোষ্ঠীর তুলনামূলক বিচার নিয়ে প্রশ্ন করেন তাঁরা। কিছুতেই তিনি প্রশ্নকর্তাদের সন্তুষ্ট করতে পারছিলেন না। বারবারই তাঁর মনে হয়েছে চোখে চোখ রেখে একবার কথা বলতে পারলে হয়তো অপহরণকারীদের বোঝাতে পারতেন। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি, ছয় মাসের বেশি সময় তাঁর চোখ আর হাত বাঁধা ছিল। শুধু যেদিন মাছ খেতে দেওয়া হতো, সেদিন বাঁধনটা একটু আলগা করে দেওয়া হতো। অনেক দূরে কোথাও তিনি টিমটিমে একটা বাতি জ্বলতে দেখেছিলেন। শুতেন কোথায়, কী খেতেন? খাওয়াদাওয়া ভালো ছিল, থাকতেন ছোট্ট একটা অন্ধকার কক্ষে, শুতে দেওয়া হয়েছিল মেঝেতে কম্বল পেতে।

যাঁরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন, তাঁদের খুব চৌকস মনে হয়েছে। ছাড়া পাওয়ার প্রক্রিয়াটা কেমন ছিল? জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটা পর্যায়ে জেরা কমে আসে। মাঝেমধ্যে তিনি চিৎকার করে জানতে চাইতেন তাঁর অপরাধটা কী? বেশির ভাগ সময় কোনো জবাব তিনি পেতেন না। মাঝেমধ্যে কেউ কেউ এসে চুপ করতে বলতেন। একদিন কেউ একজন এসে তাঁকে জানান, ওই জায়গা থেকে তাঁকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হবে। গাড়িতে ওঠার পর বেশ লম্বা একটা ভ্রমণের পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। যাত্রাপথে শুধু গাড়িচালককে দিকনির্দেশনা দিতে শুনেছেন তিনি, লেফট ও রাইট।


গুম তো একরকম কারাবাস, এমন প্রশ্নের জবাবে একজন বলেছেন, ‘গুম হয়ে থাকার চেয়ে ১৪ বছর জেলে থাকা ভালো। অন্তত জানতে তো পারলাম আমি কোথায় আছি, কেন আছি। আমার চোখটা তো খোলা থাকছে, হাত দুটোও। আমার জীবনের অনেক দিন কোথায় পার হয়ে গেল, আমি জানলামও না।’

এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি 

অজ্ঞাতবাস থেকে ফিরে এসে চিকিৎসা নিতে হয়েছে কাউকে কাউকে। একজন বলেছেন, বছরখানেক আগে কয়েক মাস গুম থাকার পর তাঁর আত্মীয়বাড়ি ফেরেন। তিনি আর আগের মতো কথা বলেন না। তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর আটকে রাখা হয়েছিল কয়েক মাস। বারবার একই প্রশ্ন করে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল অপহরণকারীরা। তাঁরও চোখ ও হাত বাঁধা ছিল। তবে মারধর করেনি কেউ। ফিরে আসার পর তাঁর প্রথম যে সমস্যাটা হলো তা হলো অনেক দিন চোখ বাঁধা থাকায় তাঁর ফটোফোবিয়া হয়ে গিয়েছিল। বর্ণগুলো বড় করে লিখে দিলে পড়তে পারতেন। সারাক্ষণ অস্থির থাকতেন, ভয় পেতেন। এখনো তিনি বাড়ির বাইরে বের হন না। তাঁর কোনো বন্ধুবান্ধব নেই। তিনি যে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন, তাঁর কাছে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে গুম হওয়া আরও এক ব্যক্তি আসতেন। তিনি গুম হয়েছিলেন মাত্র কয়েক দিনের জন্য। তবে সেই কয়েক দিনের অভিজ্ঞতা তাঁর ঘুম কেড়ে নিয়েছে।

কাছাকাছি সময়ে ঢাকা থেকেই নিখোঁজ হওয়া আরেক ব্যক্তিও ভুগছেন একই সমস্যায়। তিনি বলছিলেন, তাঁকে অপহরণের পর একটি ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছিল। এখন দলবল ছাড়া বাসা থেকে বের হন না। লাইসেন্স করা অস্ত্র নিয়ে চলেন।

আলোচিত যাঁরা এখনো নিখোঁজ 

২০১০ সালে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং সাবেক ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর চৌধুরী আলম গুম হন। পরের বছরগুলোও রাজনৈতিক নেতাদের গুম হওয়ার বিষয়টি অব্যাহত থাকে। ২০১২ সালে গুম হন বিএনপির সাবেক সাংসদ ইলিয়াস আলী। এখনো নিখোঁজ আছেন যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আজমি ও যুদ্ধাপরাধের দায়ের ফাঁসি হওয়া জামায়াত নেতা মীর কাশিম আলীর ছেলে মীর আহমেদ বিন কাশিম।

তবে গুমের শিকার হওয়া কিংবা অজ্ঞাতবাস থেকে ফিরে আসা মানুষের তালিকায় এখন আর শুধু রাজনৈতিক নেতারা নন, আছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, আইনজীবী, সরকারদলীয় জনপ্রতিনিধিরাও। পরিবারগুলো আছেন তাঁদের ফিরে আসার অপেক্ষায়।

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ আগস্ট ৩০,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment