শেখ মামুনূর রশীদ
বিশিষ্ট আইনজীবী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, আমি প্রধানমন্ত্রী হতে চাই না। এমন প্রস্তাব আমাকে কেউ দেয়নি। আমি নিজ থেকে এমন কথা কাউকে বলিনি। এ নিয়ে ন্যূনতম আগ্রহও প্রকাশ করিনি। আমি এ দেশের মানুষের ভোটের অধিকার পুনরুদ্ধার করতে চাই।
তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। গণতন্ত্রকে বিদায় দিয়ে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আবারও প্রহসনের নির্বাচন করতে চাইলে জনগণ তা প্রতিহত করতে রুখে দাঁড়াবে। কখন কীভাবে রুখে দাঁড়াবে তা এখনই বলা সম্ভব না। কখন জনগণের ঐক্য হবে, তা-ও আগাম বা অনুমাননির্ভর কিছু বলা সম্ভব নয়। সময়ই সব নির্ধারণ করে দেবে। ইতিহাস বলে বাঙালি যখনই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তখনই বিজয় ছিনিয়ে এনেছে।
কামাল হোসেন আরও বলেন, আইয়ুব খান এবং ইয়াহিয়া গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিল। স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে গিয়ে তারা বলেছিল- ‘আগে উন্নয়ন, আগে অর্থনৈতিক মুক্তি, পরে গণতন্ত্র।’ এ তত্ত্ব দিয়ে বাঙালিকে বঞ্চিত করতে চেয়েছিল। বিষয়টি বুঝতে পেরে এর বিপরীতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- আগে স্বাধীনতা, আগে ভোটের অধিকার, আগে গণতন্ত্র। এগুলো হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে। উন্নয়নও হবে। সম্পদের সুষম বণ্টন হবে। বৈষম্য থাকবে না, ন্যায়ভিত্তিক সমাজও প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই স্বাধীন বাংলাদেশে এখন আমরা কার ফর্মুলা অনুসরণ করব? আইয়ুব খান এবং ইয়াহিয়ার ফর্মুলা? নাকি বঙ্গবন্ধুর ফর্মুলা? বাস্তবতা হচ্ছে- আইয়ুব-ইয়াহিয়ার ফর্মুলা দিয়ে সরকারের অনেকে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করছেন। এ ফর্মুলা দিয়ে বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে না।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রের মালিকদের দাবিয়ে রাখা হবে, তাদের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হবে, তাদের বাকস্বাধীনতা হরণ করা হবে- এটা বেশিদিন চলতে পারে না। আইয়ুব-ইয়াহিয়া পারেনি, এ সরকারও পারবে না।
ড. কামাল হোসেন বলেন, মানুষের ভোটের অধিকার খর্ব করে যারা ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’ ফর্মুলা দিচ্ছেন, আসলে তারা এর মধ্য দিয়ে নিজের ভাগ্য গড়ার ফন্দি আঁটছেন। উন্নয়নের ফর্মুলা দিয়েই ব্যাংক লুট করা হচ্ছে। কারা ব্যাংক লুট করছে মানুষ তা জানে। একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধরাই রয়ে গেল। আর্থিক খাত প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। শেয়ারবাজারের চিত্র সবার জানা। বিনিয়োগ নেই। কর্মসংস্থান নেই। বিদেশে টাকা পাচার বাড়ছে। শোনা যাচ্ছে মাত্র কয়েক বছরে এ দেশের কেউ কেউ এখন বিদেশেও অন্যতম সম্পদশালীর মধ্যে একজন। মোদ্দাকথা, উন্নয়নের ফর্মুলায় কিছু লোকের ভাগ্য খুলেছে। সাধারণ মানুষ পথে বসেছে। এই সুবিধাবাদীরা সরকার ও দলের একটু খারাপ অবস্থা দেখলে বিদেশে পাড়ি দেবে। দেশে আজ গণতন্ত্র থাকলে, জবাবদিহতা থাকত। লুটপাটকারীরা ভয় পেত। মানুষের কাছে তাদের জবাবদিহিতা করতে হতো। যা এখন তাদের করতে হয় না।
তিনি বলেন, আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত করে ব্যক্তি, দল ও পরিবারতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে। বিচার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। প্রশাসনসহ সবকিছুকে দলীয়করণ করা হয়েছে। এ অবস্থার অবসান চাই। দেশের মানুষও তাই চায়।
সোমবার যুগান্তরকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. কামাল হোসেন এসব কথা বলেন। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচন, বিএনপির সঙ্গে বৃহত্তর জোট গঠন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব, দুর্নীতি, লুটপাট, বিচার বিভাগসহ নানা ইস্যুতে খোলামেলা কথা বলেন তিনি। সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগও খণ্ডন করেন এ সময় ড. কামাল হোসেন। বলেন দেশ নিয়ে আগামী দিনের পরিকল্পনার কথা। কেমন সরকার চান, কেমন দেশ চান, কেমন নির্বাচন চান, কেমন হবে আগামী দিনের বাংলাদেশ- এসব বিষয়েও নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন প্রবীণ এ আইনজীবী। সাক্ষাৎকারের পুরো বিবরণ নিচে দেয়া হল-
যুগান্তর : আপনার দৃষ্টিতে দেশের বর্তমান অবস্থা এখন কেমন? কী মনে হয় আপনার?
ড. কামাল : আমরা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। বঙ্গবন্ধু একটি লক্ষ্য নিয়ে দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন। সেই সংগ্রামের ফসল স্বাধীনতা। তিনি দেশের মানুষের মাঝে স্বাধীনতার সুফল তুলে দিতে চেয়েছিলেন, ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা উপহার দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। ঘাতকরা তার স্বপ্নপূরণ করতে দেয়নি। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। আমরা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করলাম, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করলাম। সফলতার মুখও দেখলাম। আবার সেই গণতন্ত্র হারিয়ে গেল। ভিন্ন নামে স্বৈরতন্ত্র জেঁকে বসল। দল ও পরিবারতন্ত্র কায়েম হল। দুর্নীতি ও লুটপাট মহামারী আকারে রূপ নিল। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না।
আসলে ৫ জানুয়ারির একতরফা প্রহসনের নির্বাচনই সর্বনাশের মূল কারণ। বলা হল- সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার এ নির্বাচন অনিবার্য ছিল। বলা হল- দ্রুততম সময়ের মধ্যে সব দলের অংশগ্রহণে আবার একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা হবে। উচ্চ আদালতেরও এমন নির্দেশনা ছিল। শাসক দলের কথায় আমরা বিশ্বাস করলাম। কিন্তু তা আর করা হল না। ক্ষমতাসীনরা তাদের প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে, সবকিছু অস্বীকার করে গায়ের জোরে ক্ষমতায় টিকে থাকার আয়োজন করল। ফলাফল যা হওয়ার তাই হল। মানুষ আশাহত হল। ভোটের অধিকার আর গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো হল। শুধু তাই না, মানুষের এখন কথা বলার স্বাধীনতা নেই। লেখার স্বাধীনতা নেই। মতপ্রকাশের অধিকার নেই। সবকিছু চলছে গায়ের জোরে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সিমাহীন লুটপাট, অর্থ পাচার। ব্যাংক খালি, শেয়ারবাজারে লোপাট- এসব দেখে মনে হচ্ছে দেশে হরিলুট চলছে। বলার কেউ নেই। দেখার কেউ নেই।
যুগান্তর : এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের উপায় কী?
ড. কামাল : এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের একটাই পথ- আর তা হচ্ছে, জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দেবে, পছন্দমতো তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করবে। এই জনপ্রতিনিধিরা জনগণের স্বার্থরক্ষা করবে। ভোটে নির্বাচিত না হয়ে যারা কাগজে-কলমে জনপ্রতিনিধি হন তাদের দায়-দায়িত্ব কম। তারা নিজের আখের গোছানোর কাজে বেশি ব্যস্ত থাকেন। ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যারা জনপ্রতিনিধির খাতায় নাম লিখিয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই নিজের আখের গোছানোর কাজে ব্যস্ত। তাই সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করতে হবে এবং জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এতেই সুশাসনও প্রতিষ্ঠিত হবে। দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ হবে।
যুগান্তর : কী করে এটা সম্ভব হবে বলে আপনি মনে করেন?
ড. কামাল : জনগণের ঐক্যই এটা প্রতিষ্ঠা করতে পারে। বঙ্গবন্ধু জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন বলেই স্বাধীনতা এসেছিল। নব্বইয়ে জনগণ একবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে সুফল পেয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগকে নিয়ে আমরা ১৪ দল করেছিলাম। দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলাম, এর সুফলও আমরা পেয়েছিলাম। এবারও যদি জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে সুফল মিলবে। গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জনগণকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মনে রাখতে হবে, ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। ইতিহাস বলে বাঙালি যখনই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে চাইলে এবারও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
যুগান্তর : আপনি কি এমন একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নেবেন? এ ঐক্যে কি বিএনপিও থাকবে?
ড. কামাল : একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। আমরা গণফোরাম প্রতিষ্ঠা করেছি প্রায় ২৫ বছর হল। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত জনগণের ঐক্য প্রতিষ্ঠায় বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। আমরা ঐক্য চেয়েছি বলেই ২০০৫ সালে আমাদের গরিব পার্টির ভাঙা অফিসে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারা এসেছিলেন। শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগের তখনকার প্রায় সব বড় নেতা গণফোরামের ইডেন কমপ্লেক্সের অফিসে এসে আমাদের সঙ্গে ঐক্য করতে চেয়েছিলেন। আমরা সে ঐক্যে সায় দিয়েছিলাম বলেই পরবর্তী সময়ে ১৪ দল হয়েছিল। আর ১৪ দলীয় জোট হয়েছিল বলেই ভুয়া ভোটার দিয়ে সেই সময়ের সরকার ও নির্বাচন কমিশন যে প্রহসনের নির্বাচন আয়োজন করতে চেয়েছিল, তা করতে পারেনি। মানুষ ঐক্যবদ্ধ থাকলে ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনও হতো না। আগামীতে আরেকটি প্রহসনের নির্বাচন যাতে না হয়- তাই দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা ঐক্য প্রতিষ্ঠার কাজটি এগিয়ে নিতে চাই। কারও ভয়-ভীতিতে আমরা পিছু হটব না।
আরেকটি কথা বলতে চাই, গণফোরাম এবং ঐক্য প্রক্রিয়ার ব্যানারে আমরা জাতীয় ইস্যুতে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছি। এ ঐক্যে যে কেউ চাইলে সাড়া দিতে পারেন। জামায়াতে ইসলামী ছাড়া সবার জন্য ঐক্যের দরজা খোলা। আমরা গণতন্ত্র চাই। আইনের শাসন চাই। সব দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই। এসব দাবিতে সমমনাদের ঐক্য হতেই পারে। অনেকেই গণফোরামের সঙ্গে অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের ঐক্যের কথা বলছেন। আসলে আমাদের মধ্যে নতুন করে ঐক্য গড়ার কিছু নেই। আমরা এক সঙ্গে অনেকদিন ধরেই পথ চলছি। আমাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়। আমরা এক সঙ্গে আছি, থাকব। একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জনগণের ঐক্য প্রতিষ্ঠায় কাজ করব।
এ ঐক্য প্রক্রিয়ায় বিএনপিও চাইলে আসতে পারে। তাদের কয়েকজন শীর্ষ নেতা আমার সঙ্গে দেখা করেছেন, কথা বলেছেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এ দেখা বা কথা হয়নি। অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হয়েছে। তাই ধারণার ওপর ভর করে এখনই কোনো কথা বলা ঠিক হবে না। বিএনপির সঙ্গে জোট হবে কী হবে না, তা সময়ই বলবে। আমরা আসলে জোট গঠনের চাইতে মানুষে মানুষে ঐক্য প্রতিষ্ঠাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। যদিও সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য হয়েই আছে। এ ঐক্যকে কাজে লাগিয়ে জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের সংবিধান জনগণকেই রাষ্ট্রের মালিকানা দিয়েছে। সেই মালিকদের দাবিয়ে রাখা হবে, তাদের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হবে, তাদের বাকস্বাধীনতা হরণ করা হবে- এটা বেশিদিন চলতে পারে না। আইয়ুব-ইয়াহিয়া পারেনি, এ সরকারও পারবে না। মানুষকে তার অধিকার আজ হোক, কাল হোক ফিরিয়ে দিতেই হবে।
যুগান্তর : এ ক্ষেত্রে আপনার পক্ষ থেকে কোনো রোডম্যাপ দেয়া হবে কিনা?
ড. কামাল : সত্যিকার গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সর্বোপরি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করাসহ রাষ্ট্র ও সমাজের অর্থবহ পরিবর্তনের জন্য আমরা ৭ দফা দিয়েছি। এটাই আমাদের রোডম্যাপ। এই রোডম্যাপ ধরে আমরা এগোচ্ছি। একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি। অনেকে এ উদ্যোগে সাড়া দিয়েছেন। আরও অনেকে সময়মতো সাড়া দেবেন। মানুষ কখন কীভাবে ঐক্যবদ্ধ হবে, সাড়া দেবে- তা আগাম বলা যাবে না। কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেশের তরুণ ছাত্র-যুবকরা যেভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নেমেছিল, কেউ কি তা আগাম ধারণা করতে পেরেছিল- পারেনি। একইভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই ছাত্রী নিহত হওয়ার পর দেশজুড়ে যে শিশু-কিশোর-ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল- তা-ও কি কারও ধারণায় ছিল? হয়তো ক্ষমতার জোরে, লাঠিপেটা করে, পুলিশ দিয়ে, হেলমেট-হাতুড়িসহ দলীয় ক্যাডার বাহিনী দিয়ে শক্তিপ্রয়োগ করে এবারের আন্দোলন থামানো গেছে। বারবার কি লাঠিপেটা করে আন্দোলন দমানো যাবে? গণবিস্ফোরণ আটকে রাখা যাবে?
যুগান্তর : সরকারি দলের নেতারা দাবি করছেন তারা আগের চাইতে এখন আরও অনেক বেশি শক্তিশালী। আগামী নির্বাচনেও তারা জয়ী হবেন এবং সরকার গঠন করবেন। আপনি কী মনে করেন?
ড. কামাল : আমিও শুনেছি সরকারের লোকজন দাবি করছেন, তারা অতীতের চাইতে এখন আরও অনেক বেশি শক্তি সঞ্চয় করেছেন। আগামী নির্বাচনেও তারা জয়ী হবেন এবং সরকার গঠন করবেন। তাদের দাবি, ভোটের মাধ্যমে তাদের বিদায় দেয়া কঠিন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে- তারা শক্তিশালী হলে, জনপ্রিয় হলে, নিজেদের ওপর এতটা আস্থা থাকলে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু ভোট দিতে ভয় পায় কেন? সব দলকে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে আপত্তি কোথায় তাদের? সংসদ বহাল রেখে, পদ-পদবি ঠিক রেখে কেন তারা নির্বাচনে যেতে চায়? পৃথিবীর কোথাও কি এভাবে নির্বাচন হয়? এ সরকারের সময় একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনও সুষ্ঠু হয়নি। বরিশাল সিটি নির্বাচনে তো সকাল ৮টার আগেই ভোট শেষ হয়ে গেছে। এত জনপ্রিয় সরকার, ভোটে তাদের কেন এত ভয়? আসলে তারা নিজেরাও জানে, দিন দিন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পায়ের নিচে আর মাটি নেই। তাই ক্ষমতায় টিকে থাকতে লাঠিই একমাত্র তাদের ভরসা।
যুগান্তর : সংসদ বহাল রেখে সরকারি দলের অধীনে নির্বাচন হলে তা কতটা গ্রহণযোগ্য হবে? আপনারা কি এ অবস্থায় নির্বাচনে অংশ নেবেন?
ড. কামাল : এ ক্ষেত্রে গণফোরাম এবং ঐক্য প্রক্রিয়ার পক্ষ থেকে আমরা পরিষ্কার করে বলেছি, বর্তমান সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হবে না। ভোট হতে হবে সব দলের অংশগ্রহণে। ভোট হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও দেশ-বিদেশে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। ভোটের আগে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে যে ভোট সুষ্ঠু হয় না, তা বর্তমান সরকার বারবার প্রমাণ করেছে। তাই ভোট হতে হবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। আর তা হলে জনগণের রায় প্রতিফলিত হবে। যদি সরকার এসব দাবি-দাওয়া না মেনে ৫ জানুয়ারির মতো আরও একটি প্রহসনের নির্বাচন করতে চায়, তাহলে জনগণ এবার রুখে দাঁড়াবে। জনগণ কীভাবে রুখে দাঁড়াবে তা এখনই বলা সম্ভব না। এটা সময়ই বলে দেবে। আমরা কী করব- এটাও তখন বলতে পারব। অনুমাননির্ভর কথা বলাটা ঠিক হবে না।
যুগান্তর : জাতীয় নির্বাচনের আর বেশিদিন বাকি নেই। অক্টোবরে নির্বাচনকালীন সরকার। ডিসেম্বরে নির্বাচন। অনেকে বলছেন, আপনার নেতৃত্বে সরকারবিরোধী বৃহত্তর একটি জোট গঠিত হচ্ছে। এ জোট এক সঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন এবং পরবর্তী সময়ে সরকার গঠন করবে। আপনি হবেন আগামী দিনের সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী। এসব বক্তব্যের সত্যতা বা সম্ভাবনা কতটুকু?
ড. কামাল : এখানে আমার একক নেতৃত্ব বলে কিছু নেই। আমরা সবাই মিলে একটি উদ্যোগ নিয়েছি মাত্র। বর্তমান সরকার মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। আমরা ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাই। আমরা একটি ঐক্যের ডাক দিয়েছি। আরও অনেকে যার যার অবস্থান থেকে ঐক্যের ডাক দিয়েছে। এই ঐক্যের উদ্যোগ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়- তা সময় বলে দেবে। সরকারবিরোধী বৃহত্তর জোটের বিষয়টি মানুষের মুখে মুখে আলোচিত হচ্ছে। বাস্তবে এটি এখনও তেমন কোনো রূপ লাভ করেনি। তাই এ বিষয়ে আগাম মন্তব্য করা কঠিন। তবে আমরাও চাই যথাসময়ে নির্বাচন হোক। আর এ নির্বাচন হোক সব দলকে নিয়ে। দেশবাসী আরেকটা প্রহসনের নির্বাচন দেখতে চায় না। আমি প্রধানমন্ত্রী হচ্ছি বা হতে চাই এটাও ঠিক না। আমি এমন আগ্রহ বা ইচ্ছার কথা কখনও কোথাও কারও কাছে প্রকাশ করিনি। কেউ আমাকে এমন প্রস্তাবও দেয়নি। তবে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী আমাকে আগামী দিনে সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাওয়ার বিষয়ে তার আগ্রহের কথা ব্যক্ত করেছেন। এটি একান্তই তার নিজস্ব চিন্তা এবং মতামত।
যুগান্তর : আপনি আগামীতে কী ধরনের সরকার দেখতে চান?
ড. কামাল : আগামীতে আমরা একটি গণমানুষের সরকার দেখতে চাই। যেখানে রাষ্ট্র জনগণের রক্ষক হবে। রাষ্ট্র জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, লুটপাট, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার বন্ধ হবে, বিনিয়োগ হবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, মাদক, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে, রাষ্ট্র হবে কল্যাণকর, ব্যক্তি, দল ও গোষ্ঠীর ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্র এবং সরকার জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। উৎপাদন বাড়ছে, রেমিটেন্স বাড়ছে। বাস্তবতা হচ্ছে- এখানে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই, কৃতিত্ব নেই। সব কৃতিত্ব সাধারণ মানুষের। খেটে খাওয়া দিনমজুর, শ্রমিক, কৃষক তার সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রবাসীরা তাদের কষ্টার্জিত টাকা পাঠাচ্ছে। গার্মেন্ট শ্রমিকরা রাত-দিন পরিশ্রম করছে বলেই প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। রাষ্ট্র কেবল লুটপাটকারীদের পাশে থেকেছে। শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের জন্য তাদের অবদান শূন্য। আমরা সত্যিকারের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের বাংলাদেশ দেখতে চাই। এখানে আমাদের কোনো বিশেষ চাওয়া-পাওয়া নাই। আমরা মনে করি, দেশের মানুষের সামনে উজ্জ্বল একটি ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। এ ভবিষ্যৎ যারা নষ্ট করছে, তাদের বিদায় জানাতে হবে। সর্বশেষ কোটাবিরোধী আন্দোলন ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন আমাদের নতুন বার্তা দিয়েছে। এ বার্তা হচ্ছে- গুটিকয়েক লুটেরা, ব্যাংক ডাকাত, ঋণখেলাপি, দলবাজ, মতলববাজ ছাড়া এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনও বিবেকবোধসম্পন্ন। তারা একটি ইতিবাচক পরিবর্তন চায়। আমরা এই চাওয়াটকে এগিয়ে নিতে চাই।
যুগান্তর : আগামী ২২ সেপ্টেম্বর ঐক্য প্রক্রিয়ার উদ্যোগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নাগরিক সমাবেশ। কাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন? কী ঘোষণা দেবেন এ সমাবেশ থেকে?
ড. কামাল : জামায়াতে ইসলামী ছাড়া সব দলকে আমরা আমন্ত্রণ জানাব। আমরা কার্যকর গণতন্ত্র, নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং ভোটাধিকার রক্ষার দাবি জানাব। ভবিষ্যতে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সরকার দেখতে চাই, তা বলব। কালো টাকা, পেশিশক্তি, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা ও দলীয় প্রভাবমুক্ত বাংলাদেশ চাই, তা বলব। আমরা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার কথা, গ্রামে-গঞ্জে মানুষে মানুষে যে ঐক্য গড়ে উঠেছে, তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলব।
যুগান্তর : ক্ষমতাসীন দলের একাধিক শীর্ষ নেতার অভিযোগ- আপনি ভোটের রাজনীতিতে ব্যর্থ হয়ে সরকার উৎখাতে ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন। এ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে গভীর রাতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এখন বিএনপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। এসব সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আপনি কী বলবেন?
ড. কামাল : দেখুন সরকারি দলের নেতারা কোথায় ষড়যন্ত্র দেখছেন, তা তারা ভালো বলতে পারবেন। আমি কখনও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না, এখনও নেই। এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। সরকার পারলে প্রমাণ করুক- কোথায়, কীভাবে আমি ষড়যন্ত্র করছি। মানুষের অধিকার রক্ষার পক্ষে কথা বলার অর্থ কি ষড়যন্ত্র করা? আর বিএনপির সঙ্গে আমার হাত মেলানোর কিছু নেই। ভোটের অধিকার রক্ষায় এক সময় আওয়ামী লীগ আমার কাছে এসেছিল, বিএনপিও চাইলে আসতে পারে। আরেকটি কথা- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো আমাদের শত্র“দেশ না। তাই না? তাদের দেশের রাষ্ট্রদূতের বিদায় উপলক্ষে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার তার বাসায় ডিনারের আয়োজন করেছিলেন। আমাকে আমার স্ত্রীসহ তিনি দাওয়াত দিয়েছেন। আমি সেখানে গেছি। খাওয়ার টেবিলে সৌজন্য সাক্ষাৎ আর কথাবার্তা হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক বিষয় আলোচনার টেবিলে ছিল না। এখানে ষড়যন্ত্রের কথাটা এলো কীভাবে, বুঝলাম না। বরং নিচে নেমে এসে দেখলাম হেলমেট বাহিনী ধাওয়া করছে। এটা কেমন আচরণ?
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. কামাল : আপনাকেও ধন্যবাদ।
- কার্টসিঃ যুগান্তর/ আগস্ট ২৯,২০১৮