Search

Tuesday, September 4, 2018

What lies behind police corruption

Muhammad Nurul Huda


The recently published Transparency International Bangladesh (TIB) survey report 2017 says that law enforcement agencies were the most corrupt among 18 departments and sectors involved in providing services to households. The report points out that members of law enforcement agencies got involved in corruption, misbehaved with service-seekers, threatened and implicated them in “false cases”, detained them without complaints, made delay and showed negligence in filing general diaries (GDs) and cases, resorted to extortion, and also made delay in providing passport verification reports.

The term “law enforcement agency” is generally understood to mean police, and thus one can assume that the TIB report focuses on police misconduct. Surely, the actions or inactions of corrupt police officials are not figments of our imagination. In fact, they are hard truths which would have been less ominous had they been isolated incidents on the part of the police.

Under the circumstances, it can be noted that since the image of the police as reflected by the mirror of the public opinion has an effect on the police and police culture, both the police image and police culture appear to be tarnished as a result. Quite often, an image is nothing but a true reflection of the reality. It also needs to be understood that “justice is not a cloistered virtue: she must be allowed to suffer the scrutiny and respectful, even though outspoken, comments of ordinary men.”

Therefore, the thing that may trouble a discerning mind is how a vital state organ that is statutorily mandated to protect people's life and liberties has deviated from its cherished path in such a manner. A response to such queries and apprehensions has been given by the TIB Trustee Board Chairperson, who said that the political will of those running the country is a prerequisite for reducing corruption and bribery.

This writer would not share the enthusiasm of those who will place all the blame on the politicians and remain oblivious to the serious management deficits of the public functionaries of the department. This view, of course, does not mean to minimise the significance of the critical element of political will. In fact, on the issue of political will, it is advisable to look at the matter from a historical perspective.

There is no denying that the modern state of Bangladesh was the product of a long and violent struggle for freedom. The irony is that while the country adopted a liberal, democratic constitution, it retained the colonial administrative, police and judicial structures without recasting them to meet the changed situation. Consequently, the colonial repressive character of the policing structure remained when the ruling elite of a decolonised society decided to retain the inherited police organisation as it was, ignoring justified imperatives for change. In other words, we have failed to introduce administrative changes in tune with the provisions of the republican constitution of Bangladesh.

One needs to know that in the context of the South Asian countries—where the coercive power of state is at its most obvious, in the form of the police, and where policemen's living off the land was made integral to the scheme of police organisation designed in 1861—the problem of corruption would naturally be more ingrained and acute. An adversarial relationship between the police and the “natives” was necessary to ensure political control of, and obedience to, the colonial government. The objective was efficiently achieved by creating and sustaining an extortion-based relationship between the police and the “natives”.

Police corruption stems from several interconnected factors including low pay of the majority of policemen as opposed to the wide discretionary power made available to them, poor working conditions, ineffective internal accountability and weak external accountability mechanisms.

The lure of corruption becomes too overwhelming to resist if the salaries of policemen are not sufficient to take them beyond temptation. This is especially so in a working environment plagued by oppressive working conditions and non-availability of a positive work ecology.

Additionally, the opportunity cost of being corrupt is very low in our situation, to the extent of being negligible. In other words, if the cost of losing one's job is very low compared to the cost of losing corruption-related money, then the rational choice would obviously be to accept or demand bribes, howsoever distasteful that may sound.

Many observers including public servants are of the view that if political aspects replace professional considerations and the penalty attached to misconduct gets to become ineffective, due to external interference in the internal administration of the police, there is all the incentive for officials both to be inefficient and corrupt.

Corruption has to be looked down upon within the organisational structure of police and it must be stigmatised so that there is not much disincentive against corruption. In fact, a punishment-reward based system is essential for achieving the goal of minimising corruption. A strong accountability mechanism coupled with attractive compensation policies are essential elements of a corruption-fighting system.

We have to remember that policing cannot be equated with other civil responsibilities because of its legal empowerment of curtailing liberties. People hold liberty very dear and its curtailment is justifiably frowned upon. Quite naturally, therefore, the recruitment process in police, particularly in the subordinate ranks, needs to be sanitised as complaints of irregularities in this regard are no longer a secret. Both politicians and police managers have to take corrective actions.

The onus of ensuring a malpractice-free management of the police force—including recruitment, promotion, posting and transfer—squarely lies with the police hierarchy. The police leadership should not be happy only when reform efforts focus on issues like better salary package, more manpower, additional transport, etc. The core reform agenda entailing more responsibility coupled with stricter accountability must not elicit a lukewarm response from them.

We need to think of the steps that would be necessary to insulate police from partisan political control. The existing accountability mechanism being less than desirably effective needs to be replaced by statutory institutions like the Independent Police Complaints Authority in the UK or the Public Safety Commission in Japan. The core issue is not so much what police do—but why they do what they do. The process of making the police earnestly work for the people without the fetters has to commence.

  • Muhammad Nurul Huda is a former IGP and a columnist at The Daily Star.

  • Courtesy: The Daily Star /Sept 04, 2018

কেন ইভিএম নেব, কেন নেব না

মিজানুর রহমান খান


নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হঠাৎ উতলা হওয়া অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। মনে হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের আগে ইভিএম-বিতর্ক বিরোধী দলকে আরও চাপে ফেলতে সহায়ক হবে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এবার ‘মেশিনে ভর’ করার যুক্তি খণ্ডন করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘মেশিনের ওপর ভর করে নয়, আওয়ামী লীগ সব সময় জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছে।’

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ, ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় অভিশংসনব্যবস্থার প্রবর্তনে জনমতের ধার ধারেনি সরকারি দল। তবে বিশ্বের উন্নত গণতন্ত্রে আছে, তাই বাংলাদেশকেও করতে হবে—এ রকম একটি যুক্তি দেওয়া হয়েছে। এখন আবার ওবায়দুল কাদের বলছেন, ‘ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ সারা বিশ্বে প্রশংসিত। ভারতেও বেশ কয়েকটি নির্বাচন ইভিএমের মাধ্যমে হয়েছে। পৃথিবীর উন্নত দেশে ইভিএম ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানেও তাই হবে।’ তাঁর এই বক্তব্য যাচাইয়ের দাবি রাখে।

ভারতের নির্বাচন কমিশন ১৯৭৭ সালে প্রথম ইভিএম চালু করে। ১৯৮১ সালে প্রথম কয়েকটি রাজ্যে এর পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালু হয়। তবে ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী সংস্কারের মতো ইভিএম কার্যকর করা নিয়েও আদালতে রিট হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে মাদ্রাজ, কেরালা, দিল্লি, কর্ণাটক ও বোম্বে (নাগপুর বেঞ্চ) হাইকোর্টে রিট হয়েছে এবং তাতে তারা ইভিএমের পক্ষে রায় পেয়েছে। তিনটি সাধারণ নির্বাচন হওয়ার পরও ২০১৭ সালে উত্তরাখন্ড হাইকোর্টকে রায় দিতে হয়েছে। গত বছর সুপ্রিম কোর্টকেও রায় দিতে হয়েছে। ২০১২ সালে দিল্লি হাইকোর্ট রায় দিয়েছিলেন, এটা ‘টেম্পার প্রুফ’ (জালিয়াতি নিরোধক) নয়। আবার এ বিষয়ে ইসিকে নির্দেশনা দেওয়াও ‘জটিল’। তিনটি মৌলিক ধাপে ইভিএমের আধুনিকায়ন ঘটিয়ে ভারত এ পর্যন্ত এসেছে।

ভারতের ইসির এ–সংক্রান্ত বায়ান্ন পৃষ্ঠার একটি স্ট্যাটাস পেপারের দিকে আমাদের ইসি এবং আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। সেখানে লেখা আছে, ‘ভারতের নির্বাচনগুলো ইভিএমে হবে, সেই বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে সাধারণ ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৮ সালে।’ অথচ লোকসভার ৫৪৩ আসনেই ইভিএমে প্রথম নির্বাচনটি হয় ২০০৪ সালে। তার মানে সংসদ নির্বাচনে এটা চালু করার আগে ভারত পরীক্ষা করেছে ২২ বছর। আর রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও ইসি সময় নিয়েছে পুরো ৬ বছর।

২০০৪, ২০০৯ ও ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচন ইভিএমে হয়েছে। কিন্তু এখনো বিতর্ক পিছু ছাড়েনি। ইভিএম ত্রুটিপূর্ণ প্রমাণিত হলে ভারত দৃশ্যত আল গোরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগায়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো তারা ২০১৩ সালে স্বচ্ছতার বাড়তি রক্ষাকবচ হিসেবে ভিভিপিএটি (ভোটার ভেরিফাইয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল) চালু করে। ভোট গ্রহীতার নাম ও প্রতীক সংবলিত একটি কাগজ তৈরি করবে যন্ত্র, যা ভোটারের জন্য একটি রক্ষাকবচ। এই পদ্ধতি যুক্ত করার পরেই কেবল সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দেন। ২০০৯ সালে নাগাল্যান্ডের উপনির্বাচনে এটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। অথচ আমাদের দেশে যে ইভিএম চালু করা হয়েছে, তাতে ভিভিপিএটির কথা চিন্তাভাবনাও করা হয়নি বলে একজন কর্মকর্তা আমাদের রোববার নিশ্চিত করেন।

১৯৯০ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত নেদারল্যান্ডস ইভিএম ব্যবহার করেছে। একটি ডাচ বেসরকারি কোম্পানির (এনইডিএপি) উদ্ভাবন ছিল এটি। পরে ডাচদের দেখাদেখি জার্মানি ও আয়ারল্যান্ড ওই একই কোম্পানি থেকে নিয়ে ইভিএম চালু করেছিল। দুটি উচ্চপর্যায়ের কমিশনের সুপারিশে ডাচরা ইভিএম ত্যাগ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকে হ্যাকিংয়ের মতো প্রযুক্তিগত বিপর্যয় সত্ত্বেও জালিয়াতি নিরোধক ভোট প্রদানের ব্যবস্থা হিসেবে ইভিএমের স্বীকৃতি নিশ্চিত হলে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই এই পথে যেতে পারে। ফলে ইভিএম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়টি আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু অন্য দেশগুলো কী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেটা দেখতে হবে। দুই ডাচ কমিশনের মূল্যায়ন আমাদের জন্য প্রযোজ্য। তারা বলেছিল, ‘যন্ত্র তদারকির নিজস্ব লোকবল নেই, তাই বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। আর তাতে যন্ত্র সরবরাহকারীরাই নীতিনির্ধারণী ভূমিকা রাখে। প্রযুক্তি সেকেলে, যা ডিজিটাল হুমকি মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়। টেস্টিং রিপোর্টগুলোর গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়েছে, সে কারণে তা স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা যাচাই করতে অপারগ। নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিধিবিধান ছিল আলগা ও অপ্রতুল।’

জার্মানরা ২০০৫ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ইভিএম ব্যবহার করলেও সমালোচনার মুখে তা বন্ধ করে। সেখানে গণনা পর্যায়ে হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটেছিল। ২০০৯ সালে জার্মান ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত ইভিএম নাকচ করেন। আদালত তাঁর রায়ে দুটি মুখ্য কারণ দেখান। প্রথমত, বিদ্যমান জার্মান সংবিধান ইভিএম সমর্থন করে না। কারণ, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতিটি অত্যাবশ্যকীয় ধাপ জনগণের পরীক্ষা করে দেখার অধিকার আছে। কিন্তু যন্ত্র তাদের সেই অধিকার কেড়ে নিয়েছে। দ্বিতীয় যে কারণ দেখানো হয়েছে, সেটি উচ্চশিক্ষিত নাগরিকের দেশ জার্মানির জন্য যদি প্রযোজ্য হয়, তাহলে শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের জন্য তা আরও বেশি মাত্রায় প্রাসঙ্গিক। রায়ে বলা হয়েছে, ভোটের গণনা এমন হতে হবে, যাতে ভোটাররা কারিগরি বিশেষজ্ঞ জ্ঞান জানা ছাড়াই নিজেরাই যাচাই করতে পারেন। সেই নিশ্চয়তা ইভিএম দেয় না। বাংলাদেশ সংবিধান বলেছে, সংসদ গঠন হতে হবে ‘প্রত্যক্ষ ভোটে’। প্রস্তাবিত ইভিএম এই শর্ত পূরণ করে না। তাই সংবিধান সংশোধন লাগবে।

আয়ারল্যান্ডও ২০০২-২০০৪ সালে ইভিএম ব্যবহারের পরে বিতর্কের মুখে দুটি কমিশন করে এবং তারাও দেখতে পায় যে, ‘ওই ডাচ যন্ত্র বিশ্বস্ত নয়। প্রযুক্তিগত রক্ষাকবচ অপ্রতুল। কোনো একটিমাত্র সংস্থার দ্বারা ভোটদান থেকে গণনা ও ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত প্রক্রিয়া যাচাই করা সম্ভব নয়। উপরন্তু সব সংসদীয় আসনে ইভিএমের নিরাপত্তা (ফিজিক্যাল সিকিউরিটি) নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ ধরনের উদ্বেগ বাংলাদেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক।

আমরা বিশেষভাবে স্মরণ করতে পারি, ২০০০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিতর্কিত ভোট গণনা এবং বুশের কাছে আল গোরের হেরে যাওয়া। ফ্লোরিডার পুনরায় ভোট গণনাকে অসাংবিধানিক বলে একটা তর্কিত সমাধান দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট। গোর সব ভোট ‘হাতে গণনা’র দাবি করেছিলেন। সেটা পূরণ হয়নি। গোর বলেছিলেন, ‘আমাদের গণতন্ত্রের শক্তি ও গণঐক্যের স্বার্থে আমি রায়টা মানছি মাত্র।’ ওই অভিজ্ঞতার পরে যুক্তরাষ্ট্র ডাইরেক্ট রেকর্ডিং ইলেকট্রনিক (ডিআরই) চালু করে, যার আওতায় এখন একাধিক স্থানে ভোটদান রেকর্ড হয়ে যায়। দেখার বিষয়, এই উন্নততর ডিআরই চালুর পরেও ভোটারদের মনের খুতখুতানি যায়নি। এরপর তারা উল্লিখিত ভোটার ভেরিফাইয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল চালু করে।

ইভিএম এখন পর্যন্ত বিশ্বে এমন একটি ব্যবস্থা, যা নিতান্তই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ভারতের সঙ্গে অন্যদের তুলনা হবে না। কারণ, তারা আমদানি করেনি। নিজেরা উদ্ভাবন করে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে হাতে গোনা যারা ইভিএম ব্যবহার করছে, তারাও অনেকে সাধারণ নির্বাচন করতে সাহস করছে না। আমরা নিজেদের ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের গণতন্ত্র চর্চা করি বলে দাবি করি। সেই গণতন্ত্রের সূতিকাগার ইংল্যান্ডও ইভিএম ব্যবহারের সাহস করেনি। ২০০০ সাল থেকে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে কিছু পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে মাত্র। ২০১৬ সালে এক প্রশ্নের উত্তরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে বলা হয়েছে, ‘সাংবিধানিক সংস্কারে আমাদের পূর্ণ কর্মসূচি চলমান রয়েছে, কিন্তু তার মধ্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং চালু বা সে জন্য কোনো সংবিধিবদ্ধ আইন করার কোনো চিন্তাভাবনাও নেই।’

বিএনপি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে ষড়যন্ত্র দেখছে। এটা তারা তাদের অভ্যাসগত অবস্থান বা রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে বলে থাকতে পারে। কিন্তু আমরা ওপরের আলোচনার দিকে সরকারের এবং ইসির নজর কাড়তে চাই। একই সঙ্গে আমরা নির্বাচন কমিশনকে এখনই আড়াই হাজার কোটির বেশি টাকায় ইভিএম কেনার প্রকল্প বাতিল করতে অনুরোধ রাখব।


  • লেখক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
  • কার্টসি —  প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৮ 

আসামি যখন মন্ত্রিপুত্র

সম্পাদকীয়

অপরাধ সংঘটিত হলে তার বিচার করার জন্য আইন আছে, আইন প্রয়োগের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষ আছে এবং আদালত আছে। অপরাধের শিকার ব্যক্তি কিংবা তাঁর স্বজন বিচার চাইতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারস্থ হবেন, মামলা করবেন। তার পরেই শুধু বিচারের আইনানুগ প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যদি বিচারপ্রার্থীর মামলাই গ্রহণ না করে, তাহলে বিচারের কোনো পথ থাকে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। হত্যা, ধর্ষণসহ নানা গুরুতর অপরাধের বিচারপ্রার্থীরা মামলা করার জন্য থানায় গেলে পুলিশ মামলা গ্রহণ করে না—এমন অভিযোগের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই প্রকাশিত হয়।

এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে গত ৩১ জুলাই ময়মনসিংহ শহরে সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ডের কথা। সেদিন দুপুরে যুবলীগের দুটি পক্ষের সংঘর্ষে শেখ আজাদ নামে মহানগর যুবলীগের এক সদস্যকে গুলি করে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। প্রকাশ্য দিনের আলোয় এই হত্যাকাণ্ড ঘটে; কিন্তু যুবলীগ সদস্যের স্ত্রী মামলা করার উদ্দেশ্যে লিখিত অভিযোগ নিয়ে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানায় গেলে পুলিশ মামলাটি গ্রহণ করেনি। স্বামীকে হারিয়ে সংক্ষুব্ধ নারীটি নিরুপায় হয়ে আদালতে রিট আবেদন করেন। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার হাইকোর্ট মামলাটি নথিবদ্ধ করার জন্য ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানার পুলিশকে নির্দেশ দিলে শুক্রবার পুলিশ মামলাটি নথিবদ্ধ করে।

প্রশ্ন হলো ময়মনসিংহ থানার পুলিশ মামলাটি নিতে রাজি হচ্ছিল না কেন। এর উত্তরে এ দেশের আইন প্রয়োগচর্চার ক্ষেত্রে একটি সাধারণ প্রবণতা ফুটে ওঠে: প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করতে গেলে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ মামলা নিতে অপারগতা কিংবা অস্বীকৃতি জানায়। বর্তমান ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, নিহত শেখ আজাদের স্ত্রী তাঁর স্বামীর হত্যাকারী হিসেবে যে ব্যক্তিদের আসামি করে মামলাটি করতে গিয়েছিলেন, তাঁদের তালিকায় আছেন মোহিত উর রহমান ওরফে শান্ত নামের এক যুবক, যিনি একাধারে ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সরকারের ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের ছেলে।

ক্ষমতাসীন দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা হলেই যেখানে থানা-পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা নিতে রাজি হয় না, সেখানে মোহিত একজন মন্ত্রীর ছেলে! হাইকোর্টের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানার পুলিশ যে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা নিচ্ছিল না—এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কিন্তু ক্ষুব্ধ হওয়ার ও প্রতিবাদ জানানোর জোরালো কারণ আছে। হত্যাকাণ্ডের মতো গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের আইনি প্রতিকারের জন্য আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের যেখানে আপন দায়িত্ববোধ থেকেই এগিয়ে যাওয়া উচিত, সেখানে মামলা নথিবদ্ধ না করে বিচারপ্রার্থীর সঙ্গে অসহযোগিতা করা অবশ্যই নিন্দনীয়। উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশ না আসা পর্যন্ত হত্যা মামলা গ্রহণ না করা আইনের শাসনের নীতি অগ্রাহ্য করার শামিল।

শেষ পর্যন্ত যখন মামলাটি গ্রহণ করা হয়েছে, তখনো নিহত শেখ আজাদের স্বজনদের স্বস্তি বোধ করার কারণ ঘটেনি। কারণ, পুলিশ মামলা গ্রহণের পর ধর্মমন্ত্রীর ছেলে মোহিতসহ ২৫ জন আসামির কাউকেই গ্রেপ্তার করেনি। মন্ত্রীর ছেলে তো আইনের ঊর্ধ্বে নন, আইনের চোখে সবাই সমান। তাহলে তাঁকেসহ অন্য আসামিদের কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না—এই প্রশ্নের সঙ্গে এই সংশয়ও থেকে যাচ্ছে যে মামলাটি পরিচালনার ক্ষেত্রে পুলিশের গাফিলতি থাকতে পারে। আমরা এ বিষয়টির ওপরেই বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাই: আদালত নির্দেশ দিয়েছেন বলে মামলা গ্রহণ করার মধ্য দিয়েই যেন পুলিশের দায়িত্ব-কর্তব্য শেষ হয়ে না যায়। হত্যার বিচার ও হত্যাকারীদের আইনানুগ শাস্তি নিশ্চিত করার পথে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব যেন বাধা সৃষ্টি না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৮

গ্রেপ্তার, মামলা-হামলা বন্ধ করুন

সম্পাদকীয় 

অস্বীকার করা যাবে না যে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ অপরিহার্য। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা বিরোধী দল বিএনপিকে নির্বাচনে আসার জন্য হরহামেশা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু নির্বাচন করার জন্য যে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকা দরকার, সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য থেকে শুরু করে সরকারি দল কিংবা সহযোগী দলের নেতা-কর্মীরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার সহায়ক ভূমিকা পালন না করে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো বিএনপিরও শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করার অধিকার আছে। ১ সেপ্টেম্বর ছিল দলটির ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ উপলক্ষে বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশের অনুমতি চেয়েছিল। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সে আবেদন নাকচ না করে দলীয় অফিসের সামনে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে। অন্যান্য দল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে পারলে বিএনপি কেন পারবে না? তারপরও ডিএমপির সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই।

কিন্তু ঢাকার সমাবেশকে কেন্দ্র করে শহরের বিভিন্ন প্রবেশমুখে যাত্রীদের হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে আরও লক্ষ করলাম, ঢাকার বাইরে সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, গৌরীপুরসহ বেশ কিছু এলাকায় পুলিশি বাধার কারণে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি পালিত হতে পারেনি। কোনো কোনো স্থানে কর্মসূচি পালনের আগেই বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি স্থানে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে আরও বেশ কিছু নেতা-কর্মীকে।

পুলিশ প্রশাসনের কিছু অতি উৎসাহী কর্মকর্তা সরকারকে খুশি করতে এ ধরনের হঠকারী কাজ করলেও শেষ পর্যন্ত যে মামলা টেকে না, তার ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে। বর্তমান সরকারের সময় বিএনপির অসংখ্য নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করলেও পুলিশ অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। বরং এসব রাজনৈতিক মামলাকে কেন্দ্র করে পুলিশের উৎকোচ–বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। বিএনপির যেকোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি বা সভা-সমাবেশের মধ্যে ষড়যন্ত্র খোঁজা হাস্যকরও বটে।

বিএনপি নেতা-কর্মীদের ষড়যন্ত্র আবিষ্কারে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী–ই নয়, ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীদেরও তৎপর দেখা যায়। শরীয়তপুরে বিএনপির এক নেতার বাড়িতে আয়োজিত বৈঠকে হামলা হয়েছে ও বগুড়ায় ছাত্রলীগের হামলায় যুবদলের তিন কর্মী আহত হয়েছেন। এসব ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিষ্ক্রিয় থাকে। তাদের যেখানে সক্রিয় হওয়ার কথা, সেখানে নিষ্ক্রিয় থাকা, আর যেখানে নিষ্ক্রিয় থাকার কথা, সেখানে অতি সক্রিয় হওয়া আইনের শাসন কিংবা গণতন্ত্রের সহায়ক নয়।

নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসছে। এমন অবস্থায় সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিশ্চিত করার স্বার্থে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি ও সভা-সমাবেশ যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে যে সুযোগ-সুবিধা পায়, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এটা সংবিধান স্বীকৃত অধিকার। কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আর কোনো অহেতুক মামলা দায়ের ও গ্রেপ্তার নয়।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপি শনিবার ঢাকায় সমাবেশ করেছে। শান্তিপূর্ণভাবে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমরা আশা করব বিএনপিসহ যেকোনো বিরোধী দল কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেবে। তবে শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মূল দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারকেই নিতে হবে। সামনের দিনগুলোতে দেশে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের পরিস্থিতি ও পরিবেশ বজায় থাকবে এবং সরকার এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না, এটাই প্রত্যাশিত।  

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৮ 

Thursday, August 30, 2018

বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুম পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে - এএলআরসি

জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে পাঠানো এএলআরসির রিপোর্ট


বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুম পরিস্থিতির শুধুই অবনতি হয়েছে। ৩৯তম নিয়মিত অধিবেশন উপলক্ষে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের কাছে পাঠানো এক রিপোর্টে এসব কথা বলেছে মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টার (এএলআরসি)। 

এতে বলা হয়েছে এ সরকারের মেয়াদে ২০০৯ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ৩১ শে জুলাই সময়ের মধ্যে কমপক্ষে ৪৩২ জনকে গুম করেছে আইন প্রয়োগকারী এজেন্সিগুলো। লোকজনকে তুলে নেয়া ও গুম করার সঙ্গে অভিযুক্ত হিসেবে যাদের নাম উঠে এসেছে তারা হলো ডিবি, পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমস ইউনিট (সিটিটিসিইউ), র‌্যাব ও একটি গোয়েন্দা সংস্থা। এএলআরসি আরো বলেছে, নাগরিকদের তুলে নেয়া ও গুমের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ অব্যাহতভাবে অস্বীকার করে যাচ্ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। নিখোঁজ হওয়ার কয়েক সপ্তাহ বা মাস পরে এক-চতুর্থাংশ মানুষকে পাওয়া যাচ্ছে বন্দি অবস্থায়।

তাদের বিরুদ্ধে আনা হচ্ছে নানা রকম বানোয়াট ফৌজদারি অভিযোগ। এ অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে যারা ঘরে ফিরেছেন, তারা কখনো মুখ খোলার সাহস দেখান না। এএলআরসি আরো বলেছে, জোরপূর্বক গুমের ঘটনায় পর্যায়ক্রমিকভাবে অভিযোগ নিবন্ধিত করতে অস্বীকার করে বাংলাদেশ পুলিশ। তারা বলে অভিযোগ থেকে আইন প্রয়োগকারী এজেন্সির নাম বাদ রাখতে হবে। এ ছাড়া গুম শব্দটির পরিবর্তে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের দ্বারা অবহরণ অথবা নিখোঁজ শব্দ ব্যবহারে বাধ্য করে অভিযোগকারীকে। এর ফলে অভিযোগ মেকানিজমে পরিপূর্ণ সুবিধা অস্বীকার করায় প্রাথমিকভাবে ধাক্কা খান অভিযোগকারী। অভিযোগ করার মেকানিজমে এই যথাযথ সুবিধা না পাওয়াটা হচ্ছে ন্যায়বিচার না পাওয়ার বিষয়। উপরন্তু অভিযোগকারী ও গুমের শিকার ব্যক্তির পরিবার অব্যাহতভাবে ভীতির সম্মুখীন হন। তাদেরকে শারীরিক ও ডিজিটাল নজরদারিতে রাখে পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। 

এ ছাড়া অভিযোগকারী একই রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। সেখানে অভিযোগের জন্য আইনজীবীর সহায়তা নেয়া বাধ্যতামুলক। কিন্তু নানা রকম প্রতিশোধ নেয়ার কারণে আইনজীবীরা এসব চ্যালেঞ্জ নিতে অনীহা দেখান। পুলিশ স্টেশন অথবা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে যেসব অভিযোগ জমা পড়ে তার তদন্ত করে না পুলিশ। তবে ২০১৫ সালে সাতজন মানুষ গুমের একটি ঘটনায় তদন্ত করেছে তারা। ফলে গত ১০ বছরে এমন ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের মাত্র একটি ঘটনায় বিচার হয়েছে। তারা জোরপূর্বক গুম করেছিল। এবং পড়ে সেই গুমের শিকার ব্যক্তিদের মৃতদেহ ভেসে উঠেছিল। 

এএলআরসি আরো বলেছে, ২০০৯ সাল থেকে সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট ডিভিশনে প্রায় ১০টি ‘হাবিয়াস করপাস’ রিট জমা পড়েছে। সুনির্দিষ্ট রিটে হাই কোর্ট রুল দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোর ‘বুরোক্র্যাট ও অফিসিয়ালদের’ বিরুদ্ধে। তাদেরকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। ওদিকে গুমের সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর লোকজন জড়িত থাকার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে এটর্নি জেনারেলের অফিস।  তবে ২০০৯ সাল থেকে যেসব মানুষ অপহৃত হয়েছেন, তারা কোথায় আছেন তা কেউ জানেন না, সেইসব মানুষকে হাজির করার জন্য রাষ্ট্রীয় কোনো এজেন্সিকে কোনো নির্দেশ কখনো দেন নি সুপ্রিম কোর্ট। 

জাতীয় সংসদে এক বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুমের ঘটনা নতুন নয়। সারা বিশ্বেই এমন ঘটনা ঘটে চলেছে। তার মতে, বৃটেন ও যুক্তরাষ্ট্রেও গুম হয় মানুষ। তিনি দাবি করেন, প্রতি বছর যুক্তরাজ্যে গুম হন দুই লাখ ৭৫ হাজার বৃটিশ নাগরিক। যুক্তরাষ্ট্রে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি। এমন বক্তব্য গুমের শিকার ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার পাওয়াকেই শুধু বাধাগ্রস্ত করে না। একই সঙ্গে যারা এসব ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তারা দায়মুক্তি পেয়ে আরো উৎসাহিত হয়। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু ক্ষমতাসীন সরকারের ইচ্ছামতো তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করে। এই বাস্তবতা ভিকটিমের অধিকার লঙ্ঘিত হওয়ায় তার ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগকে অস্বীকার করে। 

এএলআরসি বলেছে, তারা বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুমের জটিল বাস্তবতা সম্পর্কে অব্যাহতভাবে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ ও ওয়ার্কিং গ্রুপ অব এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সে’কে জানিয়ে আসছে। 

এএলআরসি বলেছে, এর প্রেক্ষিতে মানবাধিকার পরিষদ ও নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের ব্যাপকভাবে বোঝা উচিত যে, সরকার গুমের অভিযোগ অস্বীকার করছে, অপরাধকে জাস্টিফাই করছে, এর সঙ্গে জড়িতদের দায়মুক্তির গ্যারান্টি দিচ্ছে, অভিযোগকারী ও ভিকটিমের আত্মীয়দের হয়রান বা ভীতি প্রদর্শন করছে, ন্যায়বিচারের মেকানিজমের সুবিধা পাওয়া প্রতিরোধ করছে। এবং এরাই জোরপূর্বক গুমের জন্য দায়ী। এএলআরসি আরো বলেছে, যখন এমন একটি সরকার থাকে তখন গণতান্ত্রিক ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে জোরপূর্বক গুমের ন্যায়বিচার পাওয়া অসম্ভব। উপরন্তু এখানে যে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বাস্তবে তা ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে রোহিঙ্গা সঙ্কট দিয়ে। এক্ষেত্রে মানবাধিকার পরিষদের উচিত বাংলাদেশ সরকারের কাছে জানতে চাওয়া যে, অন্য দেশের একটি অপরাধ দিয়ে নিজের দেশের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকে ছাড় দেয়া বৈধ কিনা। এ অবস্থায় মানবাধিকার পরিষদের প্রতি এএলআরসি আহ্বান জানাচ্ছে স্পেশাল র‌্যাপোর্টিউর অন বাংলাদেশের জন্য একটি ম্যান্ডেট সৃষ্টির জন্য, তারা প্রায় ১৬ কোটি মানুষের মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং করবে। 
  • কার্টসিঃ মানবজমিন/ আগস্ট ৩০,২০১৮ 

‘গুম হওয়ার চেয়ে কারাবাস ভালো’

শেখ সাবিহা আলম

  • আজ আন্তর্জাতিক গুম দিবস
  • ২০০৯ সাল থেকে এ বছরের জুলাই পর্যন্ত ‘গুম’ হয়েছেন ৪৩২ জন
  • ফিরে আসা ব্যক্তিরা অপহরণকারীদের ব্যাপারে মুখ খোলেননি
  • গুমের শিকার পাঁচ ব্যক্তি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে

বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল সেদিন। গাড়ি ধরবেন বলে রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন কেবল, হঠাৎ ছয়-সাতজন লোক কিছু না বলে একরকম ছোঁ মেরে তাঁকে মাইক্রোবাসে তুলে ফেলেন। চোখ আর হাত দুটো বাঁধা হয়ে যায় মুহূর্তে। কিন্তু ব্যাপারটা কী? কেউ কোনো কথার জবাব দিচ্ছেন না। রাতের ঢাকার ফাঁকা রাস্তায় শুধু গাড়িটা ছুটছে। একপর্যায়ে তিনি কোনো এক গন্তব্যে পৌঁছালেন। তখনো জানতেন না এই অজ্ঞাতবাসেই ছয় মাস কাটাতে হবে তাঁকে।

যাঁর কথা বলা হচ্ছে, তিনি ২০১৬ সালে ছয় মাসের বেশি সময় গুম হয়েছিলেন। আজ আন্তর্জাতিক গুম দিবস। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের হিসাবে ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত এমন মানুষের সংখ্যা ৪৩২। তাঁদের মধ্যে খোঁজ পাওয়া গেছে ২৫০ জনের। অজ্ঞাতবাস থেকে যাঁরা ফিরেছেন, তাঁরা আর অপহরণকারীদের ব্যাপারে মুখ খোলেননি। অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে চিকিৎসাধীন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলেছে, পরিবার, স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছেন, র‍্যাব, ডিবি ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে তাঁদের স্বজনদের তুলে নেওয়া হয়েছে। অনেক সময় তাঁরা জিডিও করতে পারেননি। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বরাবর গুমের অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, যখনই কোনো নিখোঁজ সংবাদ আসে, তখনই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আইনি পন্থায় তাঁকে খুঁজে দিতে বাংলাদেশ পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করে।

গুমের শিকার হওয়া পাঁচ ব্যক্তি সম্প্রতি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। এই পাঁচজনই ২০১৬ ও ২০১৭ সালের বিভিন্ন সময় গুমের শিকার হন। জীবন নিয়ে ফিরে আসা এই মানুষগুলো বলেছেন, গুম হওয়ার চেয়ে তাঁদের কাছে কারাবাস ভালো।

গুমের শিকার ব্যক্তিদের কথা 

প্রথমে যাঁর কথা বলা হলো তিনি গাড়ির ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর চোখ খুললে এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, কিছু খেতে চান কি না। এরপর জেরা শুরু হয়। বাসস্থান, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, পরিবার, মুঠোফোনের অ্যাপস, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাতায়াত, বন্ধুবান্ধব, আওয়ামী লীগ-জামায়াত-জঙ্গিগোষ্ঠীর তুলনামূলক বিচার নিয়ে প্রশ্ন করেন তাঁরা। কিছুতেই তিনি প্রশ্নকর্তাদের সন্তুষ্ট করতে পারছিলেন না। বারবারই তাঁর মনে হয়েছে চোখে চোখ রেখে একবার কথা বলতে পারলে হয়তো অপহরণকারীদের বোঝাতে পারতেন। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি, ছয় মাসের বেশি সময় তাঁর চোখ আর হাত বাঁধা ছিল। শুধু যেদিন মাছ খেতে দেওয়া হতো, সেদিন বাঁধনটা একটু আলগা করে দেওয়া হতো। অনেক দূরে কোথাও তিনি টিমটিমে একটা বাতি জ্বলতে দেখেছিলেন। শুতেন কোথায়, কী খেতেন? খাওয়াদাওয়া ভালো ছিল, থাকতেন ছোট্ট একটা অন্ধকার কক্ষে, শুতে দেওয়া হয়েছিল মেঝেতে কম্বল পেতে।

যাঁরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন, তাঁদের খুব চৌকস মনে হয়েছে। ছাড়া পাওয়ার প্রক্রিয়াটা কেমন ছিল? জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটা পর্যায়ে জেরা কমে আসে। মাঝেমধ্যে তিনি চিৎকার করে জানতে চাইতেন তাঁর অপরাধটা কী? বেশির ভাগ সময় কোনো জবাব তিনি পেতেন না। মাঝেমধ্যে কেউ কেউ এসে চুপ করতে বলতেন। একদিন কেউ একজন এসে তাঁকে জানান, ওই জায়গা থেকে তাঁকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হবে। গাড়িতে ওঠার পর বেশ লম্বা একটা ভ্রমণের পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। যাত্রাপথে শুধু গাড়িচালককে দিকনির্দেশনা দিতে শুনেছেন তিনি, লেফট ও রাইট।


গুম তো একরকম কারাবাস, এমন প্রশ্নের জবাবে একজন বলেছেন, ‘গুম হয়ে থাকার চেয়ে ১৪ বছর জেলে থাকা ভালো। অন্তত জানতে তো পারলাম আমি কোথায় আছি, কেন আছি। আমার চোখটা তো খোলা থাকছে, হাত দুটোও। আমার জীবনের অনেক দিন কোথায় পার হয়ে গেল, আমি জানলামও না।’

এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি 

অজ্ঞাতবাস থেকে ফিরে এসে চিকিৎসা নিতে হয়েছে কাউকে কাউকে। একজন বলেছেন, বছরখানেক আগে কয়েক মাস গুম থাকার পর তাঁর আত্মীয়বাড়ি ফেরেন। তিনি আর আগের মতো কথা বলেন না। তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর আটকে রাখা হয়েছিল কয়েক মাস। বারবার একই প্রশ্ন করে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল অপহরণকারীরা। তাঁরও চোখ ও হাত বাঁধা ছিল। তবে মারধর করেনি কেউ। ফিরে আসার পর তাঁর প্রথম যে সমস্যাটা হলো তা হলো অনেক দিন চোখ বাঁধা থাকায় তাঁর ফটোফোবিয়া হয়ে গিয়েছিল। বর্ণগুলো বড় করে লিখে দিলে পড়তে পারতেন। সারাক্ষণ অস্থির থাকতেন, ভয় পেতেন। এখনো তিনি বাড়ির বাইরে বের হন না। তাঁর কোনো বন্ধুবান্ধব নেই। তিনি যে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন, তাঁর কাছে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে গুম হওয়া আরও এক ব্যক্তি আসতেন। তিনি গুম হয়েছিলেন মাত্র কয়েক দিনের জন্য। তবে সেই কয়েক দিনের অভিজ্ঞতা তাঁর ঘুম কেড়ে নিয়েছে।

কাছাকাছি সময়ে ঢাকা থেকেই নিখোঁজ হওয়া আরেক ব্যক্তিও ভুগছেন একই সমস্যায়। তিনি বলছিলেন, তাঁকে অপহরণের পর একটি ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছিল। এখন দলবল ছাড়া বাসা থেকে বের হন না। লাইসেন্স করা অস্ত্র নিয়ে চলেন।

আলোচিত যাঁরা এখনো নিখোঁজ 

২০১০ সালে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং সাবেক ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর চৌধুরী আলম গুম হন। পরের বছরগুলোও রাজনৈতিক নেতাদের গুম হওয়ার বিষয়টি অব্যাহত থাকে। ২০১২ সালে গুম হন বিএনপির সাবেক সাংসদ ইলিয়াস আলী। এখনো নিখোঁজ আছেন যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আজমি ও যুদ্ধাপরাধের দায়ের ফাঁসি হওয়া জামায়াত নেতা মীর কাশিম আলীর ছেলে মীর আহমেদ বিন কাশিম।

তবে গুমের শিকার হওয়া কিংবা অজ্ঞাতবাস থেকে ফিরে আসা মানুষের তালিকায় এখন আর শুধু রাজনৈতিক নেতারা নন, আছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, আইনজীবী, সরকারদলীয় জনপ্রতিনিধিরাও। পরিবারগুলো আছেন তাঁদের ফিরে আসার অপেক্ষায়।

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ আগস্ট ৩০,২০১৮ 

বিশ্বব্যাপী অনাস্থায় ইভিএম

মতবিরোধ খোদ ইসিতেও


শামছুল ইসলাম 


পৃথিবীর শতকরা ৯০ ভাগ দেশে ই-ভোটিং পদ্ধতি নেই। যে কয়েকটি দেশ এটি চালু করেছিল, তারাও ইতোমধ্যে তা নিষিদ্ধ করেছে। ২০০৬ সালে আয়ারল্যান্ড ই-ভোটিং পরিত্যাগ করে। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে জার্মানির ফেডারেল কোর্ট ইভিএমকে অসাংবিধানিক ঘোষণা দেয়। একই বছর ফিনল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্ট ইভিএমে সম্পন্ন তিনটি মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের ফলাফল অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করেন।

ড. অ্যালেক্স হালডারমেন নামে এক প্রযুক্তিবিশেষজ্ঞ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে ইভিএমের ওপর গবেষণা করে প্রমাণ পেয়েছিলেন, আমেরিকায় ভোট কারচুপির প্রতিরোধক (টেম্পার প্রুফ) নয় ইভিএম। ফলে সেই অঙ্গরাজ্যেও ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। আমেরিকার ২২টির বেশি অঙ্গরাজ্যে এটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং অন্যগুলোতেও তা নিষিদ্ধ হওয়ার পথে।

সম্প্রতি ইভিএম তথা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে কারচুপি সম্ভব বলে অভিযোগ তুলে ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ফের ব্যালট পেপারে ভোটের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। তারা একযোগে নির্বাচন কমিশনের কাছে ইভিএমের মাধ্যমে কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ জানিয়েছে। এভাবে বিশ্বব্যাপী আস্থা হারাচ্ছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)।

অথচ ঠিক এমনই সময়ে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন (ইসি) দেড় লাখ ভোটিং মেশিন কেনার পথে হাঁটছে। এ জন্য ৩৮০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে তারা। তবে মতবিরোধ রয়েছে খোদ ইসিতেও। একজন কমিশনার ভিন্নমত দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। আরো দুই কমিশনার জানেনই না ইভিএম ক্রয়ের খবর।

এ দিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে পুরোপুরি বিপরীত মেরুতে রয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। নির্বাচনে ইভিএম বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে সংসদ নির্বাচনে ই-ভোটিংয়ের প্রবর্তন বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে নির্বাচনে সরকার ই-ভোটিং রাখতে চায়, যা দুরভিসন্ধিমূলক।

নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে খোদ নির্বাচন কমিশনারদের মধেও। পাঁচ কমিশনারের তিনজন এ প্রকল্প সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন। তাদের একজন আরপিও সংশোধনের বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার সাংবাদিকদের বলেছেন, সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকার নতুন যে প্রকল্প পাঠানো হয়েছে বলে বলা হচ্ছে, সে বিষয়ে আমাকে কিছুই জানানো হয়নি; আপনাদের কাছে জানতে পারলাম।

এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেছেন, আমি ইভিএমের প্রকল্পের বিষয়ে কিছু জানি না; ইসি সচিব ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানেন। যখন এগুলো ব্যবহার করার জন্য কমিশন সভায় আলোচনা হবে, তখন বলব। এর আগে বিষয়টি নিয়ে বলার কিছু নেই, আমি বলতেও চাই না। কমিশনার কবিতা খানম বলেন, জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে হলে তা আরপিওতে সংযুক্ত করতে হবে। তারপর কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে ইভিএম ব্যবহার করবে কি না। ইভিএম কেনার নতুন প্রকল্পের বিষয়ে আমি কিছু জানি না।

সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে আরপিও সংশোধন করা হচ্ছে- সে বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে একজন কমিশনার ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এরই মধ্যে তিনি এটি প্রস্তুত করেছেন।

এতে বলা হয়েছে, গত ২৬ আগস্ট আরপিও সংশোধনের জন্য কমিশন সভায় তিন ধরনের প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। ওই দিন দু’টি প্রস্তাব বাদ দিয়ে শুধু একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনার জন্য সীমাবদ্ধ রাখা হয় এবং ৩০ আগস্ট পর্যন্ত কমিশন সভা মুলতবি করা হয়। স্থানীয় নির্বাচনগুলোয় এরই মধ্যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দল ও ভোটারের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রথম থেকে বলে আসছেন- রাজনৈতিক দলগুলো সম্মত হলে সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হবে। সরকারে প থেকে স্বাগত জানালেও বিরোধী রাজনৈতিক প থেকে এর বিরোধিতা করা হয়েছে। তাই একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে অধিকতর আলোচনা প্রয়োজন ছিল।

২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একটি ওয়ার্ডে ভোট গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইভিএমের যাত্রা শুরু হয়। ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেখানকার টিচার্স ট্রেনিং কলেজ কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের সময় ইভিএম বন্ধ হয়ে যায়। তার পর এটি সারানো আর সম্ভব হয়নি। ফলে ওই কেন্দ্রে আবার ভোট গ্রহণ করতে বাধ্য হয় নির্বাচন কমিশন। এসব সমস্যা চিহ্নিত করতে নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান বুয়েটকে একাধিকবার অনুরোধ করা হলেও তারা সমস্যা চিহ্নিত করেনি, বরং ইসি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ তোলে বুয়েট।

ইভিএম নিয়ে মতবিরোধ তৈরি হয়েছিল আগের কমিশনেও। সাবেক নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক সিইসির কাছে এক ইউও (আনঅফিশিয়াল) নোটে লেখেন, কমিশনে যে ইভিএম রয়েছে তাতে ভোট সংখ্যার কাগজ রেকর্ডের ব্যবস্থা নেই; ভোটারের পরিচিতি শনাক্তকরণেরও ব্যবস্থা নেই। ফলে এ যন্ত্র দিয়ে ভোটে কারচুপি রোধ করা সম্ভব নয়।

এ দিকে পাশের দেশ ভারতে ইভিএমের বিরোধিতা ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। বিজেপি অবশ্য ইভিএম বজায় রাখারই পক্ষপাতী, তবে ভারতের নির্বাচন কমিশন সব দলেরই মতামত খতিয়ে দেখবে বলে কথা দিয়েছে।

গত চার বছরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ইভিএম নিয়ে কারসাজির অজস্র অভিযোগ তুলেছে একাধিক বিরোধী দল। এবারে নির্বাচন কমিশনের ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে গিয়ে কংগ্রেসসহ একাধিক বিরোধী দল দাবি জানিয়েছে ইভিএম পদ্ধতিটাই বাতিল করে দেয়া হোক।

কংগ্রেস মুখপাত্র অভিষেক মনু সিংভি বলেছেন, শুধু আমরাই নই। দেশের অন্তত ৭০ শতাংশ রাজনৈতিক দলই মনে করে যত দ্রুত সম্ভব কাগজের ব্যালট আবার ফিরিয়ে আনা উচিত। এই দাবিতে আমরা অনড় থাকব। কারণ ইভিএমের ওপর আমাদের বিশ্বাস টলে গেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জালিয়াতির সুযোগ থাকায় ইভিএমে এক চাপে ৫০টি ভোট দেয়া সম্ভব। বিদেশের মাটিতে বসেও ইভিএম হ্যাকিং করা যায় এবং একটি ইভিএম হ্যাকিং করতে এক মিনিটের বেশি সময় লাগে না।

সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, কোনো প্রযুক্তি গ্রহণের আগে তার ভালো-মন্দ খতিয়ে দেখা উচিত। আর নির্বাচনের অন্যতম স্টেক হোল্ডার হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। যে প্রযুক্তিই গ্রহণ করা হোক না কেন তা রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়েই করা উচিত।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জে. (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ছোট পরিসরের নির্বাচনে ইভিএম যৌক্তিক হতে পারে, কিন্তু সংসদ নির্বাচনের মতো ক্ষমতা বদলের নির্বাচনে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা এখনো অর্জন করতে পারেনি কমিশন নির্বাচন। এ ছাড়া, খোদ ইভিএম উদ্ভাবনকারী দেশগুলোও এই প্রযুক্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
  • কার্টসিঃ নয়াদিগন্ত/আগস্ট ৩০,২০১৮ 

Wednesday, August 29, 2018

৪২ সেকেন্ডে ফিটনেস পাচ্ছে যানবাহন!

সামছুর রহমান

  • মিরপুর কার্যালয় ফিটনেস সনদ দিচ্ছে অস্বাভাবিক দ্রুততায়
  • প্রতি ঘণ্টায় দেওয়া হয়েছে গড়ে ৮৬টি সনদ
  • ১৬ কার্যদিবসে দেওয়া হয়েছে সাড়ে ১৬ হাজার সনদ
  • নির্দেশনা মেনে সনদ দিতে লাগার কথা এক থেকে দেড় ঘণ্টা
  • তাড়াহুড়োয় ফিটনেস পরীক্ষা হলে মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়
  • দায়সারা পরীক্ষায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াবে



রাজধানীর মিরপুরের বিআরটিএ কার্যালয়ে গতকাল দুপুরে ডিজিটাল নম্বরপ্লেট, লাইসেন্স ডেলিভারি বুথের সামনে ভিড় ছিল। তবে নতুন আবেদনের বুথগুলো তুলনামূলক ফাঁকা ছিল।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ের চেহারাই বদলে গেছে। ফিটনেস সনদ নিতে যানবাহনের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। সংস্থাটি কাজও করছে বিদ্যুৎ গতিতে। যেমন ১ থেকে ২০ আগস্ট এই ২০ দিনে মিরপুর কার্যালয় থেকে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়েছে। কর্মঘণ্টা ধরে হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে, গড়ে ৪২ সেকেন্ডেই একটি করে যানবাহনকে ফিটনেস সনদ দিয়ে দিয়েছে বিআরটিএ।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিতভাবেই বলছেন, সব প্রক্রিয়া শেষ করে এত কম সময়ে যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক। তাড়াহুড়ো করে ফিটনেস পরীক্ষা সম্পন্ন করা হলে পরীক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। দায়সারা পরীক্ষায় ফিটনেস সনদ পাওয়া যানবাহন দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াবে।

গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে র‍্যাডিসন হোটেলের সামনে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। সেদিন থেকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর থেকে বিআরটিএর কার্যালয়ে ফিটনেস নবায়নের বিপুলসংখ্যক আবেদন জমা পড়ছে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে বিআরটিএ বাড়িয়েছে দিনের কর্মঘণ্টা। ৪ আগস্ট থেকে বিআরটিএ কার্যালয়ে লাইসেন্স নবায়ন, গাড়ির ফিটনেস ও নবায়ন কার্যক্রম প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত চালু থাকছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনিবারও খোলা রাখা হচ্ছে বিআরটিএ কার্যালয়।

বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার যানবাহনের। সরকারি ও সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে এই ২০ দিনে কর্মদিবস ছিল ১৬টি। দৈনিক ১২ কর্মঘণ্টা হিসাবে বিআরটিএর কার্যালয় খোলা ছিল ১৯২ ঘণ্টা। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় দেওয়া হয়েছে গড়ে ৮৬টি ফিটনেস সনদ।

বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ফিটনেস সনদ দিতে হলে সংশ্লিষ্ট যানবাহন কারিগরি ত্রুটিমুক্ত হতে হবে। কারিগরি ও বাহ্যিক অন্তত ৬০টি বিষয় বিবেচনায় আনার কথা বলা হয়েছে আইনে। ফলে একটি যানের সনদ দিতে ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা লেগে যাওয়া স্বাভাবিক। এক মিনিটের কম সময়ে ফিটনেস সনদ দেওয়া অসম্ভব। শুধু চোখে দেখা ছাড়া এত অল্প সময়ে ফিটনেস সনদ দেওয়া সম্ভব নয়।

তবে এ বিষয়ে বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) মাহবুব-ই-রব্বানি প্রথম আলোকে বলেন, একটি স্ট্যান্ডার্ড (মান) রক্ষা করেই ফিটনেস সনদ দেওয়া হচ্ছে। যে গাড়ির ফিটনেস সনদ দেওয়া হচ্ছে, তার অধিকাংশ প্রাইভেট কার। এসব গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষায় বেশি কিছু দেখা লাগে না। অনেকে গাড়ি মেরামত ও রং করে ফিটনেস পরীক্ষার জন্য আসছেন। এটিও দ্রুত পরীক্ষার কাজ শেষ করতে ভূমিকা রাখছে।

বিআরটিএর তথ্য অনুসারে, বর্তমানে ঢাকায় যানবাহন আছে প্রায় ১৩ লাখ। মোটরযান আইন অনুযায়ী চাকা, ইঞ্জিনক্ষমতা ও ধরন বিবেচনায় নিয়ে যানের নিবন্ধন দিয়ে থাকে বিআরটিএ। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের ফিটনেস সনদ দরকার হয় না। কারসহ অবাণিজ্যিক যানবাহনের বেলায় তৈরির সাল থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরের ফিটনেস সনদ একসঙ্গেই দেওয়া হয়। বাস, ট্রাকসহ আর সব যানবাহনের ফিটনেস সনদ নিতে হয় প্রতিবছর।

বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকায় নিবন্ধিত যানবাহনের মধ্যে মোটরসাইকেল রয়েছে ৫ লাখ ৭০ হাজার। আর ১০ শতাংশ গাড়ি নতুন। ফলে কমবেশি ৬ লাখ যানবাহনের প্রতিবছরই ফিটনেস সনদের প্রয়োজন হয়।

ফিটনেস পরীক্ষার সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন রয়েছে বিআরটিএর। গাইডলাইন অনুসারে যানবাহনের মালিক প্রথমে আবেদন করেন। আবেদনপত্র গ্রহণের পর তা যাচাই-বাছাই করা হয়। এরপর আবেদন করা যানবাহনটি পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনের কাজ শেষ হলে যাচাই করা হয় যানবাহনের উপযুক্ততা।

বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ে দুই ধরনের পদ্ধতিতে যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা করা হয়। ডিজিটাল ভেহিকল ইন্সপেকশন সেন্টারে (ভিআইসি) পরীক্ষা করা হয় গণপরিবহন ও ভারী যানবাহনের ফিটনেস। ব্যক্তিগত ও হালকা যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা করা হয় খালি চোখে।

গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, ভিআইসির সামনে ফিটনেস পরীক্ষার জন্য লাইনে দাঁড়ানো একটি কাভার্ড ভ্যান। একজন পরিদর্শনকর্মী চালকের আসনে বসে ওজন, টায়ারের বিট বা ঘনত্ব, গতি ও গতিরোধক বা ব্রেক পরীক্ষা দেড় মিনিটের মধ্যে শেষ করেন। নামার আগে ভেতরের আসন, রং ঠিক আছে কি না, সেটি পরীক্ষা করে নেন।

বুথে দায়িত্ব পালনকারী বিআরটিএর একজন মোটরযান পরিদর্শক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ভিআইসিতে পরিদর্শনের ধাপে চার ধরনের পরীক্ষা হয়। ওজন স্কেলে ‘এক্সেল লোড’ পরীক্ষা করা হয়। টায়ারের ঘনত্ব পরীক্ষা করা হয়। এরপর পরীক্ষা করা হয় গতি। সবশেষে গাড়ির গতিরোধক বা ব্রেক পরীক্ষা করা হয়। সব মিলিয়ে পরিদর্শন ধাপটি শেষ করতে ১৮-২০ মিনিট লাগার কথা।

যদিও বিআরটিএর নির্দেশনা অনুযায়ী, পরিদর্শন ধাপটি শেষ করতে কমপক্ষে ৩০ মিনিট, প্রয়োজনে ১ ঘণ্টা সময় উল্লেখ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, একটি গাড়ির ফিটনেস যথাযথভাবে পরীক্ষা করতে ন্যূনতম ১ ঘণ্টা লাগে। এত কম সময়ে ফিটনেস দেওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি মনে করেন, বিআরটিএ একদিকে টাকা নিয়ে যথাযথভাবে ফিটনেস পরীক্ষা না করে সঠিক সেবা দিচ্ছে না, অন্যদিকে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ফিটনেস সনদ পাওয়ায় জনগণের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ছে।
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ আগস্ট ২৯, ২০১৮

ভোটের অধিকার আদায়ে জনগণ এবার রুখে দাঁড়াবে - ড. কামাল হোসেন

শেখ মামুনূর রশীদ

বিশিষ্ট আইনজীবী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, আমি প্রধানমন্ত্রী হতে চাই না। এমন প্রস্তাব আমাকে কেউ দেয়নি। আমি নিজ থেকে এমন কথা কাউকে বলিনি। এ নিয়ে ন্যূনতম আগ্রহও প্রকাশ করিনি। আমি এ দেশের মানুষের ভোটের অধিকার পুনরুদ্ধার করতে চাই।

তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। গণতন্ত্রকে বিদায় দিয়ে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আবারও প্রহসনের নির্বাচন করতে চাইলে জনগণ তা প্রতিহত করতে রুখে দাঁড়াবে। কখন কীভাবে রুখে দাঁড়াবে তা এখনই বলা সম্ভব না। কখন জনগণের ঐক্য হবে, তা-ও আগাম বা অনুমাননির্ভর কিছু বলা সম্ভব নয়। সময়ই সব নির্ধারণ করে দেবে। ইতিহাস বলে বাঙালি যখনই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তখনই বিজয় ছিনিয়ে এনেছে।

কামাল হোসেন আরও বলেন, আইয়ুব খান এবং ইয়াহিয়া গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিল। স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে গিয়ে তারা বলেছিল- ‘আগে উন্নয়ন, আগে অর্থনৈতিক মুক্তি, পরে গণতন্ত্র।’ এ তত্ত্ব দিয়ে বাঙালিকে বঞ্চিত করতে চেয়েছিল। বিষয়টি বুঝতে পেরে এর বিপরীতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- আগে স্বাধীনতা, আগে ভোটের অধিকার, আগে গণতন্ত্র। এগুলো হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে। উন্নয়নও হবে। সম্পদের সুষম বণ্টন হবে। বৈষম্য থাকবে না, ন্যায়ভিত্তিক সমাজও প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই স্বাধীন বাংলাদেশে এখন আমরা কার ফর্মুলা অনুসরণ করব? আইয়ুব খান এবং ইয়াহিয়ার ফর্মুলা? নাকি বঙ্গবন্ধুর ফর্মুলা? বাস্তবতা হচ্ছে- আইয়ুব-ইয়াহিয়ার ফর্মুলা দিয়ে সরকারের অনেকে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করছেন। এ ফর্মুলা দিয়ে বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে না।

তিনি বলেন, রাষ্ট্রের মালিকদের দাবিয়ে রাখা হবে, তাদের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হবে, তাদের বাকস্বাধীনতা হরণ করা হবে- এটা বেশিদিন চলতে পারে না। আইয়ুব-ইয়াহিয়া পারেনি, এ সরকারও পারবে না।

ড. কামাল হোসেন বলেন, মানুষের ভোটের অধিকার খর্ব করে যারা ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’ ফর্মুলা দিচ্ছেন, আসলে তারা এর মধ্য দিয়ে নিজের ভাগ্য গড়ার ফন্দি আঁটছেন। উন্নয়নের ফর্মুলা দিয়েই ব্যাংক লুট করা হচ্ছে। কারা ব্যাংক লুট করছে মানুষ তা জানে। একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধরাই রয়ে গেল। আর্থিক খাত প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। শেয়ারবাজারের চিত্র সবার জানা। বিনিয়োগ নেই। কর্মসংস্থান নেই। বিদেশে টাকা পাচার বাড়ছে। শোনা যাচ্ছে মাত্র কয়েক বছরে এ দেশের কেউ কেউ এখন বিদেশেও অন্যতম সম্পদশালীর মধ্যে একজন। মোদ্দাকথা, উন্নয়নের ফর্মুলায় কিছু লোকের ভাগ্য খুলেছে। সাধারণ মানুষ পথে বসেছে। এই সুবিধাবাদীরা সরকার ও দলের একটু খারাপ অবস্থা দেখলে বিদেশে পাড়ি দেবে। দেশে আজ গণতন্ত্র থাকলে, জবাবদিহতা থাকত। লুটপাটকারীরা ভয় পেত। মানুষের কাছে তাদের জবাবদিহিতা করতে হতো। যা এখন তাদের করতে হয় না।

তিনি বলেন, আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত করে ব্যক্তি, দল ও পরিবারতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে। বিচার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। প্রশাসনসহ সবকিছুকে দলীয়করণ করা হয়েছে। এ অবস্থার অবসান চাই। দেশের মানুষও তাই চায়।

সোমবার যুগান্তরকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. কামাল হোসেন এসব কথা বলেন। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচন, বিএনপির সঙ্গে বৃহত্তর জোট গঠন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব, দুর্নীতি, লুটপাট, বিচার বিভাগসহ নানা ইস্যুতে খোলামেলা কথা বলেন তিনি। সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগও খণ্ডন করেন এ সময় ড. কামাল হোসেন। বলেন দেশ নিয়ে আগামী দিনের পরিকল্পনার কথা। কেমন সরকার চান, কেমন দেশ চান, কেমন নির্বাচন চান, কেমন হবে আগামী দিনের বাংলাদেশ- এসব বিষয়েও নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন প্রবীণ এ আইনজীবী। সাক্ষাৎকারের পুরো বিবরণ নিচে দেয়া হল-

যুগান্তর : আপনার দৃষ্টিতে দেশের বর্তমান অবস্থা এখন কেমন? কী মনে হয় আপনার?

ড. কামাল : আমরা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। বঙ্গবন্ধু একটি লক্ষ্য নিয়ে দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন। সেই সংগ্রামের ফসল স্বাধীনতা। তিনি দেশের মানুষের মাঝে স্বাধীনতার সুফল তুলে দিতে চেয়েছিলেন, ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা উপহার দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। ঘাতকরা তার স্বপ্নপূরণ করতে দেয়নি। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। আমরা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করলাম, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করলাম। সফলতার মুখও দেখলাম। আবার সেই গণতন্ত্র হারিয়ে গেল। ভিন্ন নামে স্বৈরতন্ত্র জেঁকে বসল। দল ও পরিবারতন্ত্র কায়েম হল। দুর্নীতি ও লুটপাট মহামারী আকারে রূপ নিল। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না।

আসলে ৫ জানুয়ারির একতরফা প্রহসনের নির্বাচনই সর্বনাশের মূল কারণ। বলা হল- সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার এ নির্বাচন অনিবার্য ছিল। বলা হল- দ্রুততম সময়ের মধ্যে সব দলের অংশগ্রহণে আবার একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা হবে। উচ্চ আদালতেরও এমন নির্দেশনা ছিল। শাসক দলের কথায় আমরা বিশ্বাস করলাম। কিন্তু তা আর করা হল না। ক্ষমতাসীনরা তাদের প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে, সবকিছু অস্বীকার করে গায়ের জোরে ক্ষমতায় টিকে থাকার আয়োজন করল। ফলাফল যা হওয়ার তাই হল। মানুষ আশাহত হল। ভোটের অধিকার আর গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো হল। শুধু তাই না, মানুষের এখন কথা বলার স্বাধীনতা নেই। লেখার স্বাধীনতা নেই। মতপ্রকাশের অধিকার নেই। সবকিছু চলছে গায়ের জোরে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সিমাহীন লুটপাট, অর্থ পাচার। ব্যাংক খালি, শেয়ারবাজারে লোপাট- এসব দেখে মনে হচ্ছে দেশে হরিলুট চলছে। বলার কেউ নেই। দেখার কেউ নেই।

যুগান্তর : এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের উপায় কী?

ড. কামাল : এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের একটাই পথ- আর তা হচ্ছে, জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দেবে, পছন্দমতো তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করবে। এই জনপ্রতিনিধিরা জনগণের স্বার্থরক্ষা করবে। ভোটে নির্বাচিত না হয়ে যারা কাগজে-কলমে জনপ্রতিনিধি হন তাদের দায়-দায়িত্ব কম। তারা নিজের আখের গোছানোর কাজে বেশি ব্যস্ত থাকেন। ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যারা জনপ্রতিনিধির খাতায় নাম লিখিয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই নিজের আখের গোছানোর কাজে ব্যস্ত। তাই সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করতে হবে এবং জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এতেই সুশাসনও প্রতিষ্ঠিত হবে। দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ হবে।

যুগান্তর : কী করে এটা সম্ভব হবে বলে আপনি মনে করেন?

ড. কামাল : জনগণের ঐক্যই এটা প্রতিষ্ঠা করতে পারে। বঙ্গবন্ধু জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন বলেই স্বাধীনতা এসেছিল। নব্বইয়ে জনগণ একবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে সুফল পেয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগকে নিয়ে আমরা ১৪ দল করেছিলাম। দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলাম, এর সুফলও আমরা পেয়েছিলাম। এবারও যদি জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে সুফল মিলবে। গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জনগণকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মনে রাখতে হবে, ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। ইতিহাস বলে বাঙালি যখনই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে চাইলে এবারও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

যুগান্তর : আপনি কি এমন একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নেবেন? এ ঐক্যে কি বিএনপিও থাকবে?

ড. কামাল : একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। আমরা গণফোরাম প্রতিষ্ঠা করেছি প্রায় ২৫ বছর হল। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত জনগণের ঐক্য প্রতিষ্ঠায় বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। আমরা ঐক্য চেয়েছি বলেই ২০০৫ সালে আমাদের গরিব পার্টির ভাঙা অফিসে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারা এসেছিলেন। শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগের তখনকার প্রায় সব বড় নেতা গণফোরামের ইডেন কমপ্লেক্সের অফিসে এসে আমাদের সঙ্গে ঐক্য করতে চেয়েছিলেন। আমরা সে ঐক্যে সায় দিয়েছিলাম বলেই পরবর্তী সময়ে ১৪ দল হয়েছিল। আর ১৪ দলীয় জোট হয়েছিল বলেই ভুয়া ভোটার দিয়ে সেই সময়ের সরকার ও নির্বাচন কমিশন যে প্রহসনের নির্বাচন আয়োজন করতে চেয়েছিল, তা করতে পারেনি। মানুষ ঐক্যবদ্ধ থাকলে ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনও হতো না। আগামীতে আরেকটি প্রহসনের নির্বাচন যাতে না হয়- তাই দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা ঐক্য প্রতিষ্ঠার কাজটি এগিয়ে নিতে চাই। কারও ভয়-ভীতিতে আমরা পিছু হটব না।

আরেকটি কথা বলতে চাই, গণফোরাম এবং ঐক্য প্রক্রিয়ার ব্যানারে আমরা জাতীয় ইস্যুতে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছি। এ ঐক্যে যে কেউ চাইলে সাড়া দিতে পারেন। জামায়াতে ইসলামী ছাড়া সবার জন্য ঐক্যের দরজা খোলা। আমরা গণতন্ত্র চাই। আইনের শাসন চাই। সব দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই। এসব দাবিতে সমমনাদের ঐক্য হতেই পারে। অনেকেই গণফোরামের সঙ্গে অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের ঐক্যের কথা বলছেন। আসলে আমাদের মধ্যে নতুন করে ঐক্য গড়ার কিছু নেই। আমরা এক সঙ্গে অনেকদিন ধরেই পথ চলছি। আমাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়। আমরা এক সঙ্গে আছি, থাকব। একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জনগণের ঐক্য প্রতিষ্ঠায় কাজ করব।

এ ঐক্য প্রক্রিয়ায় বিএনপিও চাইলে আসতে পারে। তাদের কয়েকজন শীর্ষ নেতা আমার সঙ্গে দেখা করেছেন, কথা বলেছেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এ দেখা বা কথা হয়নি। অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হয়েছে। তাই ধারণার ওপর ভর করে এখনই কোনো কথা বলা ঠিক হবে না। বিএনপির সঙ্গে জোট হবে কী হবে না, তা সময়ই বলবে। আমরা আসলে জোট গঠনের চাইতে মানুষে মানুষে ঐক্য প্রতিষ্ঠাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। যদিও সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য হয়েই আছে। এ ঐক্যকে কাজে লাগিয়ে জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের সংবিধান জনগণকেই রাষ্ট্রের মালিকানা দিয়েছে। সেই মালিকদের দাবিয়ে রাখা হবে, তাদের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হবে, তাদের বাকস্বাধীনতা হরণ করা হবে- এটা বেশিদিন চলতে পারে না। আইয়ুব-ইয়াহিয়া পারেনি, এ সরকারও পারবে না। মানুষকে তার অধিকার আজ হোক, কাল হোক ফিরিয়ে দিতেই হবে।

যুগান্তর : এ ক্ষেত্রে আপনার পক্ষ থেকে কোনো রোডম্যাপ দেয়া হবে কিনা?

ড. কামাল : সত্যিকার গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সর্বোপরি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করাসহ রাষ্ট্র ও সমাজের অর্থবহ পরিবর্তনের জন্য আমরা ৭ দফা দিয়েছি। এটাই আমাদের রোডম্যাপ। এই রোডম্যাপ ধরে আমরা এগোচ্ছি। একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি। অনেকে এ উদ্যোগে সাড়া দিয়েছেন। আরও অনেকে সময়মতো সাড়া দেবেন। মানুষ কখন কীভাবে ঐক্যবদ্ধ হবে, সাড়া দেবে- তা আগাম বলা যাবে না। কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেশের তরুণ ছাত্র-যুবকরা যেভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নেমেছিল, কেউ কি তা আগাম ধারণা করতে পেরেছিল- পারেনি। একইভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই ছাত্রী নিহত হওয়ার পর দেশজুড়ে যে শিশু-কিশোর-ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল- তা-ও কি কারও ধারণায় ছিল? হয়তো ক্ষমতার জোরে, লাঠিপেটা করে, পুলিশ দিয়ে, হেলমেট-হাতুড়িসহ দলীয় ক্যাডার বাহিনী দিয়ে শক্তিপ্রয়োগ করে এবারের আন্দোলন থামানো গেছে। বারবার কি লাঠিপেটা করে আন্দোলন দমানো যাবে? গণবিস্ফোরণ আটকে রাখা যাবে?

যুগান্তর : সরকারি দলের নেতারা দাবি করছেন তারা আগের চাইতে এখন আরও অনেক বেশি শক্তিশালী। আগামী নির্বাচনেও তারা জয়ী হবেন এবং সরকার গঠন করবেন। আপনি কী মনে করেন?

ড. কামাল : আমিও শুনেছি সরকারের লোকজন দাবি করছেন, তারা অতীতের চাইতে এখন আরও অনেক বেশি শক্তি সঞ্চয় করেছেন। আগামী নির্বাচনেও তারা জয়ী হবেন এবং সরকার গঠন করবেন। তাদের দাবি, ভোটের মাধ্যমে তাদের বিদায় দেয়া কঠিন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে- তারা শক্তিশালী হলে, জনপ্রিয় হলে, নিজেদের ওপর এতটা আস্থা থাকলে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু ভোট দিতে ভয় পায় কেন? সব দলকে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে আপত্তি কোথায় তাদের? সংসদ বহাল রেখে, পদ-পদবি ঠিক রেখে কেন তারা নির্বাচনে যেতে চায়? পৃথিবীর কোথাও কি এভাবে নির্বাচন হয়? এ সরকারের সময় একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনও সুষ্ঠু হয়নি। বরিশাল সিটি নির্বাচনে তো সকাল ৮টার আগেই ভোট শেষ হয়ে গেছে। এত জনপ্রিয় সরকার, ভোটে তাদের কেন এত ভয়? আসলে তারা নিজেরাও জানে, দিন দিন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পায়ের নিচে আর মাটি নেই। তাই ক্ষমতায় টিকে থাকতে লাঠিই একমাত্র তাদের ভরসা।

যুগান্তর : সংসদ বহাল রেখে সরকারি দলের অধীনে নির্বাচন হলে তা কতটা গ্রহণযোগ্য হবে? আপনারা কি এ অবস্থায় নির্বাচনে অংশ নেবেন?

ড. কামাল : এ ক্ষেত্রে গণফোরাম এবং ঐক্য প্রক্রিয়ার পক্ষ থেকে আমরা পরিষ্কার করে বলেছি, বর্তমান সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হবে না। ভোট হতে হবে সব দলের অংশগ্রহণে। ভোট হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও দেশ-বিদেশে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। ভোটের আগে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে যে ভোট সুষ্ঠু হয় না, তা বর্তমান সরকার বারবার প্রমাণ করেছে। তাই ভোট হতে হবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। আর তা হলে জনগণের রায় প্রতিফলিত হবে। যদি সরকার এসব দাবি-দাওয়া না মেনে ৫ জানুয়ারির মতো আরও একটি প্রহসনের নির্বাচন করতে চায়, তাহলে জনগণ এবার রুখে দাঁড়াবে। জনগণ কীভাবে রুখে দাঁড়াবে তা এখনই বলা সম্ভব না। এটা সময়ই বলে দেবে। আমরা কী করব- এটাও তখন বলতে পারব। অনুমাননির্ভর কথা বলাটা ঠিক হবে না।

যুগান্তর : জাতীয় নির্বাচনের আর বেশিদিন বাকি নেই। অক্টোবরে নির্বাচনকালীন সরকার। ডিসেম্বরে নির্বাচন। অনেকে বলছেন, আপনার নেতৃত্বে সরকারবিরোধী বৃহত্তর একটি জোট গঠিত হচ্ছে। এ জোট এক সঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন এবং পরবর্তী সময়ে সরকার গঠন করবে। আপনি হবেন আগামী দিনের সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী। এসব বক্তব্যের সত্যতা বা সম্ভাবনা কতটুকু?

ড. কামাল : এখানে আমার একক নেতৃত্ব বলে কিছু নেই। আমরা সবাই মিলে একটি উদ্যোগ নিয়েছি মাত্র। বর্তমান সরকার মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। আমরা ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাই। আমরা একটি ঐক্যের ডাক দিয়েছি। আরও অনেকে যার যার অবস্থান থেকে ঐক্যের ডাক দিয়েছে। এই ঐক্যের উদ্যোগ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়- তা সময় বলে দেবে। সরকারবিরোধী বৃহত্তর জোটের বিষয়টি মানুষের মুখে মুখে আলোচিত হচ্ছে। বাস্তবে এটি এখনও তেমন কোনো রূপ লাভ করেনি। তাই এ বিষয়ে আগাম মন্তব্য করা কঠিন। তবে আমরাও চাই যথাসময়ে নির্বাচন হোক। আর এ নির্বাচন হোক সব দলকে নিয়ে। দেশবাসী আরেকটা প্রহসনের নির্বাচন দেখতে চায় না। আমি প্রধানমন্ত্রী হচ্ছি বা হতে চাই এটাও ঠিক না। আমি এমন আগ্রহ বা ইচ্ছার কথা কখনও কোথাও কারও কাছে প্রকাশ করিনি। কেউ আমাকে এমন প্রস্তাবও দেয়নি। তবে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী আমাকে আগামী দিনে সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাওয়ার বিষয়ে তার আগ্রহের কথা ব্যক্ত করেছেন। এটি একান্তই তার নিজস্ব চিন্তা এবং মতামত।

যুগান্তর : আপনি আগামীতে কী ধরনের সরকার দেখতে চান?

ড. কামাল : আগামীতে আমরা একটি গণমানুষের সরকার দেখতে চাই। যেখানে রাষ্ট্র জনগণের রক্ষক হবে। রাষ্ট্র জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, লুটপাট, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার বন্ধ হবে, বিনিয়োগ হবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, মাদক, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে, রাষ্ট্র হবে কল্যাণকর, ব্যক্তি, দল ও গোষ্ঠীর ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্র এবং সরকার জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। উৎপাদন বাড়ছে, রেমিটেন্স বাড়ছে। বাস্তবতা হচ্ছে- এখানে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই, কৃতিত্ব নেই। সব কৃতিত্ব সাধারণ মানুষের। খেটে খাওয়া দিনমজুর, শ্রমিক, কৃষক তার সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রবাসীরা তাদের কষ্টার্জিত টাকা পাঠাচ্ছে। গার্মেন্ট শ্রমিকরা রাত-দিন পরিশ্রম করছে বলেই প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। রাষ্ট্র কেবল লুটপাটকারীদের পাশে থেকেছে। শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের জন্য তাদের অবদান শূন্য। আমরা সত্যিকারের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের বাংলাদেশ দেখতে চাই। এখানে আমাদের কোনো বিশেষ চাওয়া-পাওয়া নাই। আমরা মনে করি, দেশের মানুষের সামনে উজ্জ্বল একটি ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। এ ভবিষ্যৎ যারা নষ্ট করছে, তাদের বিদায় জানাতে হবে। সর্বশেষ কোটাবিরোধী আন্দোলন ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন আমাদের নতুন বার্তা দিয়েছে। এ বার্তা হচ্ছে- গুটিকয়েক লুটেরা, ব্যাংক ডাকাত, ঋণখেলাপি, দলবাজ, মতলববাজ ছাড়া এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনও বিবেকবোধসম্পন্ন। তারা একটি ইতিবাচক পরিবর্তন চায়। আমরা এই চাওয়াটকে এগিয়ে নিতে চাই।

যুগান্তর : আগামী ২২ সেপ্টেম্বর ঐক্য প্রক্রিয়ার উদ্যোগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নাগরিক সমাবেশ। কাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন? কী ঘোষণা দেবেন এ সমাবেশ থেকে?

ড. কামাল : জামায়াতে ইসলামী ছাড়া সব দলকে আমরা আমন্ত্রণ জানাব। আমরা কার্যকর গণতন্ত্র, নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং ভোটাধিকার রক্ষার দাবি জানাব। ভবিষ্যতে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সরকার দেখতে চাই, তা বলব। কালো টাকা, পেশিশক্তি, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা ও দলীয় প্রভাবমুক্ত বাংলাদেশ চাই, তা বলব। আমরা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার কথা, গ্রামে-গঞ্জে মানুষে মানুষে যে ঐক্য গড়ে উঠেছে, তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলব।

যুগান্তর : ক্ষমতাসীন দলের একাধিক শীর্ষ নেতার অভিযোগ- আপনি ভোটের রাজনীতিতে ব্যর্থ হয়ে সরকার উৎখাতে ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন। এ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে গভীর রাতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এখন বিএনপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। এসব সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আপনি কী বলবেন?

ড. কামাল : দেখুন সরকারি দলের নেতারা কোথায় ষড়যন্ত্র দেখছেন, তা তারা ভালো বলতে পারবেন। আমি কখনও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না, এখনও নেই। এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। সরকার পারলে প্রমাণ করুক- কোথায়, কীভাবে আমি ষড়যন্ত্র করছি। মানুষের অধিকার রক্ষার পক্ষে কথা বলার অর্থ কি ষড়যন্ত্র করা? আর বিএনপির সঙ্গে আমার হাত মেলানোর কিছু নেই। ভোটের অধিকার রক্ষায় এক সময় আওয়ামী লীগ আমার কাছে এসেছিল, বিএনপিও চাইলে আসতে পারে। আরেকটি কথা- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো আমাদের শত্র“দেশ না। তাই না? তাদের দেশের রাষ্ট্রদূতের বিদায় উপলক্ষে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার তার বাসায় ডিনারের আয়োজন করেছিলেন। আমাকে আমার স্ত্রীসহ তিনি দাওয়াত দিয়েছেন। আমি সেখানে গেছি। খাওয়ার টেবিলে সৌজন্য সাক্ষাৎ আর কথাবার্তা হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক বিষয় আলোচনার টেবিলে ছিল না। এখানে ষড়যন্ত্রের কথাটা এলো কীভাবে, বুঝলাম না। বরং নিচে নেমে এসে দেখলাম হেলমেট বাহিনী ধাওয়া করছে। এটা কেমন আচরণ?

যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।

ড. কামাল : আপনাকেও ধন্যবাদ।

  • কার্টসিঃ যুগান্তর/ আগস্ট ২৯,২০১৮ 

কারাগারে নীরব চাঁদাবাজি!

ধারণক্ষমতার তিন গুণ বন্দী আছে পানির সমস্যা


মনির হোসেন 
কেরানীগঞ্জের নতুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে বেশির ভাগ বন্দী আরামে থাকা-খাওয়া সুবিধার পাশাপাশি টিভি বিনোদনেরও সুযোগ পাচ্ছেন। তবে তাদের প্রতি টিভির বিপরীতে মাসিক হারে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হচ্ছে।

কারাগারসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পুরো কারাগারে চার শতাধিক ওয়ার্ড (সেল) রয়েছে। বেশির ভাগ ওয়ার্ডে এলইডি টেলিভিশন আছে। আর এসব টেলিভিশন চালাতে ব্যবহার করা হচ্ছে পেনড্রাইভ। তবে প্রতিটি প্যান ড্রাইভ অনুমোদনের জন্য কারাগারের সুবেদারকে ৩০০০ হাজার করে টাকা দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া পেনড্রাইভ দিয়ে টেলিভিশন দেখার সুযোগ দেয়ার জন্য মাসিক ১৫০০ টাকা করে বন্দীদের পরিশোধ করতে হচ্ছে। ওই সুবেদারের চাহিদা মোতাবেক সব বন্দী নীরবে টাকা পরিশোধ করছেন বলে কারাগারে কর্তব্যরত একাধিক কারারক্ষী ও বন্দীর স্বজনদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু কি তাই, নিয়ম বহির্ভূতভাবে কারা অভ্যন্তরে টাকা পাঠাতেও চলছে বাইরের কারা ক্যান্টিন থেকে রমরমা বাণিজ্য।

অভিযোগ রয়েছে, বাইরে থেকে কোনো স্বজন বন্দীর কাছে ৫০০ টাকা পাঠালে ভেতরে সেই টাকা হয়ে যাচ্ছে ৪০০ টাকা। কমিশন বাবদ ১০০ টাকা কারাক্যান্টিনে কেটে নেয়া হচ্ছে। এভাবে প্রতিদিন নানা কৌশলে একটি চক্র লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অপর দিকে হাসপাতালে থাকতে হলেও একজন বন্দীকে গুনতে হচ্ছে প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। যদিও ধারণক্ষমতার প্রায় তিন গুণ বন্দী বর্তমানে কেরানীগঞ্জের কারাগারে অবস্থান করছে।

পেনড্রাইভের মাধ্যমে টেলিভিশন দেখা এবং অবৈধভাবে নগদ টাকা কারাগারে পাঠানোর অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যার আগে ও পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সদ্য যোগ দেয়া সিনিয়র জেল সুপার মো: ইকবাল কবীরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি টেলিফোন ধরেননি। সুবেদার হাবিবের সাথে যোগাযোগ করে তাকেও পাওয়া যায়নি।

গত শনিবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকা সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, কিছু দিন আগে ভেঙে পড়া নির্মাণাধীন কারাগারের গেটটি ওই অবস্থায় পড়ে আছে। পাশে ডিউটি করছিলেন কারারক্ষী হাসান। তিনি আগত বন্দীর স্বজনদের কাছে জানতে চান সাথে ক্যামেরা জাতীয় কিছু আছে কি না। এরপরই ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন। টিনশেড ঘেরা কারা ক্যান্টিন এলাকায় দেখা যায়, টেবিল চেয়ার নিয়ে পাঁচজন কারারক্ষী বন্দীর সাথে সাক্ষাৎ প্রার্থীদের নাম ঠিকানা লিখে বিনা টাকায় টিকিট দিচ্ছেন। আধঘণ্টা পর পর সাক্ষাৎ করার ডাক পড়ছে। এ সময় কারা ক্যান্টিন থেকে কয়েকজনকে মালামাল ক্রয় করতে দেখা যায়।

নিত্যপণ্যের দাম কেমন- জানতে চাইলে এক বন্দীর স্বজন বলেন, খুব একটা দাম তারা চাচ্ছে না। হাফ হাতা একটি নীল কালারের গেঞ্জি ২০০ টাকা চাচ্ছে। ফ্রুটো জুস ৭০ টাকা। বাইরেও একই দাম। তবে পেছনের কারা ক্যান্টিনে প্রতিটি জিনিসপত্রের দাম ৫-১০ টাকা বেশি বলে জানান বন্দীর স্বজনেরা।

টিনেশেডের পশ্চিম পাশে দেখা যায়, টেবিল চেয়ার নিয়ে কারারক্ষীরা বন্দীর কাছে পিসিতে টাকা পাঠাচ্ছে। এ সময় সাভার থেকে আসা রাজু নামে এক বন্দীর স্বজন শহীদ উদ্দিন (ছদ্মনাম) এ প্রতিবেদককে বলেন, ঈদের আগের দিন সাভারের ডিবি পুলিশ আমার শ্যালককে ইয়াবাসহ ধরে সরাসরি এই জেলে পাঠিয়ে দিয়েছে। এরপর থেকে কয়েকবার এসে তার সাথে সাক্ষাৎ করেছি।

তিনি বলেন, ভেতরে থাকার কোনো সমস্যা নেই। তবে খাবারের একটু সমস্যা আছে।

তিনি দাবি করেন, মিথ্যা মামলায় ডিবি পুলিশ তার শ্যালককে বাসা থেকে ডেকে ৪০ পিস ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। ‘সে ইয়াবা সেবন তো দূরের কথা, জীবনে সিগারেট পর্যন্ত খায়নি’। এখন তার জামিন করানোর চেষ্টা করছি। এ সময় তিনি তার মোবাইল ফোনটি ইউসুফের ক্যান্টিনে ১০ টাকার বিনিময়ে রেখে সাক্ষাৎ কক্ষে চলে যান।

খিলগাঁও থেকে আসা দুই যুবকের সাথে এক কারারক্ষী কথা বলছিলেন। পরে ওই যুবকের কাছে পরিচয় গোপন রেখে জানতে চাইলে তারা বলেন, আমরা সরাসরি দেখা করার কথা বলেছি। তখন ওই কারারক্ষী সরাসরি দেখা হবে, তবে তার জন্য আট হাজার টাকা দাবি করছে। এ সময় তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ট্যাকা এখন কাগজ হয়ে গেছে। আমার আসামির যে মামলা ওই টাকা দিয়ে তো তার জামিনই করাইয়্যা ফেলতে পারমু। দুই যুবকের একজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ভাই আর বইল্যান না, ঈদের আগের দিন হাট থেকে গরু কিনে রাত ২টায় বাড়িতে ফিরি। এরপর বাড়ির সামনে থেকে খিলগাঁও থানার দারোগা আমিনুল তাকে সন্দেহজনকভাবে ধরে থানায় নিয়ে যায়। তাকে ছাড়িয়ে দেবে বলে এলাকার এক ফর্মা আমাকে টেলিফোন করে ১০ হাজার টাকা দাবি করে। পরে ঈদের কথা চিন্তা করে ফর্মাকে পাঁচ হাজার টাকা দিতে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু ১০ হাজার টাকার কমে দারোগা ছাড়বেই না। ৫ হাজার টাকায় ছাড়তে রাজি হয়েছে। তবে আসামির নামে ছোট একটি ধারায় মামলা দেবে। কোর্ট থেকে তাকে ছাড়িয়ে আনতে হবে। তখন আমরা জেদ করে বলেছি, তাহলে তাকে কোর্ট থেকেই আনব। এখন কারাগারে আসছি আর আদালতে দৌড়াচ্ছি।

কারাগারে বন্দীর সাথে সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কী আর করুম। দেখা করতে আসি কিন্তু তার চেহারা দেখা ছাড়া কথা তেমন বুঝি না। তারা বলেন, শুনেছি ভেতরে খাবার পানির কিছুটা সমস্যা আছে।

বাইরের কারা ক্যান্টিনে স্লিপ আর কলম হাতে বসে আছেন আরিফ নামে এক কারারক্ষী। কারাগারে নগদ টাকা পাঠানোর জন্য তার কাছে জানতে চাইলে তিনি শুরুতেই বলেন, কত হাজার পাঠাবেন তাড়াতাড়ি বলেন। পিসির মাধ্যমে পাঠাতে চাইলে কোনো টাকা লাগবে না। এখান থেকে দুই ঘণ্টায় টাকা চলে যাবে আপনার লোকের কাছে। ৫০০ টাকা পাঠালে ভেতরে পাবে ৪০০ টাকা। এরপর তাকে জানালাম ১০ হাজার টাকা যদি পাঠাই তাহলে কত টাকা দিতে হবে। তখন তিনি বলেন, তাহলে এক হাজার টাকা দিলেই হবে। তখন তিনি তার মোবাইল নম্বর ও নাম চিরকুটে লিখে দেন এ প্রতিবেদকের হাতে।

জানা গেছে, শনিবার পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৯ হাজার ৬০৮ জন বন্দী অবস্থান করছিলেন। এরমধ্যে হাজতী ৭ হাজার ৮৯৯ জন, কয়েদী ১৫৭১ জন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ১২৩ জন, আরপি তিন জন, ৫৪ ধারার চারজন, ডিভিশনপ্রাপ্ত আটজন।

  • কার্টসিঃ নয়াদিগন্ত/ আগস্ট ২৯,২০১৮