রাজধানীর পূর্বাচল আবাসিক এলাকায় মার্কেটের নামে স্টেডিয়ামের হাজার কোটি টাকা মূল্যের জমি দখল করে নিয়েছেন আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি (নারায়ণগঞ্জ-১) গাজী গোলাম দস্তগীর। মার্কেটের নাম ‘নীলা মার্কেট’। ওপরে-ওপরে এই মার্কেটের সর্বেসর্বা হলেন রূপগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলা।
কিন্তু এলাকাবাসী বলছেন, প্রকৃত নিয়ন্ত্রক মানে আসল দখলদার এমপি নিজেই। ফলত ভয়ানক এ দখলবাজি ঘটনার নীরব দর্শক রাজউক ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। গোটা এলাকা এখন এমপি এবং তার সমর্থক দখলবাজদের নিয়ন্ত্রণে। তার বেআইনি কর্মকাণ্ডে সরকারের সিদ্ধান্ত অকার্যকর আর নিজ দলীয় নেতা-কর্মীরাই শুধু কোণঠাসা। রাষ্ট্রীয় আইন, বিধিবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গড়ে তোলা সাম্রাজ্যে এমপি যা করেন যা বলেন তা-ই আইন হয়ে দাঁড়ায়।
নীলা মার্কেট মানে স্থানীয়দের ভাষায় ‘গাজীর লোকদের সাম্রাজ্য’। এ সাম্রাজ্যে গড়ে তোলা হয়েছে গাড়ি পার্কিং পয়েন্ট, স্থায়ী-অস্থায়ী বাজার, কয়েক শ দোকানপাট, রেন্ট-এ-কারের টার্মিনাল, হোটেল-রেস্তোরাঁ, মাছবাজার, মিষ্টির কারখানা, স্থায়ী-অস্থায়ী নানা অবকাঠামো। সরকারি সিদ্ধান্তে যে পূর্বাচল আবাসন এলাকা গড়ে উঠেছে সেখানে সরকারের মন্ত্রী, এমপি, আমলা, বিচারপতিসহ সব মহলের ভাগ্যে প্লট জুটেছে। অনাগত প্রজন্মের জন্য সেই প্রকল্পে বিশাল জায়গা বরাদ্দ রাখা হয় স্টেডিয়ামের জন্য। কিন্তু রূপগঞ্জের জায়গাজমি দখলের রেকর্ড স্থাপনকারী এমপির নজর থেকে সেই স্টেডিয়ামের জায়গাটিও রক্ষা পায়নি। অনেক মন্ত্রী ও ক্ষমতাধর অবহিত থাকলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে পূর্বাচল স্টেডিয়ামের জায়গা দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না। সবার প্রশ্ন— সরকার ও প্রশাসনের চেয়ে একজন এমপির হাত এত লম্বা ও শক্তিশালী হয় কী করে? গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও রাজউক কেন দখলমুক্ত করার শক্তি রাখে না? কেন নেয় না পদক্ষেপ? কেন এই স্টেডিয়ামের জায়গা এখনো দখলমুক্ত করে দিতে পারে না যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে?
গুঞ্জন আছে, মন্ত্রীরাও জানেন রূপগঞ্জে কেউ জায়গা কিনতে চাইলে কেউ বিক্রি করতে চাইলে কেউ বাড়িঘর-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করতে চাইলে গাজী এমপির ইচ্ছার বিরুদ্ধে সম্ভব নয়। একাধিক মন্ত্রীর দফতরে এ নিয়ে মীমাংসা বৈঠকও হয়েছে অনেক সময়।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নীলা মার্কেটে কয়েকশ দোকানঘর। ৫০০ দোকানের আলাদা কাঁচাবাজারও গড়ে উঠেছে সেখানে। এসব দোকানঘর থেকে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্রতিদিন বিদ্যুৎ, পানি ও পরিচ্ছন্নতার দোহাই দিয়ে প্রতি দোকান থেকে আকারভেদে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে চাঁদাবাজ চক্র। মার্কেট ঘিরে ভোলানাথপুরসহ আশপাশ এলাকায় গড়ে উঠেছে মাদকের আস্তানা। এসব আস্তানায় সহজেই পাওয়া যাচ্ছে মরণ নেশা ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক।
শুধু তাই নয়, নীলা মার্কেটের আশপাশ নির্জন জায়গা। তাই শত শত যুবক-যুবতী ঘুরতে এসে অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। নীলা মার্কেটের সামনেই একটি কবরস্থান। কবরস্থানের ভেতরেই মাদকের মজুদ গড়ে হরদম কেনাবেচা চালানো হচ্ছে। বেশ কয়েকটি দোকানঘরের পজিশন বিক্রি করা হয়েছে। একেকটি পজিশনের মূল্য ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা। এসব টাকা সংগ্রহ করেন ফটিক মিয়া।
যেভাবে গড়ে ওঠে দখলবাজির মার্কেটটিঃ
পূর্বাচল আবাসনের ভোলানাথপুর এলাকায় বিশ্বমানের স্টেডিয়াম নির্মাণের পরিকল্পনা নেয় রাজউক। এজন্য প্রায় হাজার কোটি টাকা মূল্যের জায়গাও বরাদ্দ রাখা হয়। এ জমি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বরাদ্দ দিলেও তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখনো বুঝিয়ে দেয়নি রাজউক। ফলে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা জায়গার ওপর নজর পড়ে প্রভাবশালী জবরদখলকারীদের। এমপি গোলাম দস্তগীরের পৃষ্ঠপোষকতায় ও রূপগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলার তত্ত্বাবধানে পাঁচ বছর আগে সেখানে গড়ে তোলা হয় ক্লাব ঘর। এর নাম দেওয়া হয় ‘আওয়ামী লীগ ক্লাব’। নীলার স্বামী ফটিক আলম ও দেবর আনোয়ার হোসেন এ ক্লাব পরিচালনা করেন। তাদের নেতৃত্বেই ‘আওয়ামী লীগ ক্লাব’ ঘেঁষে একের পর এক দোকানপাট গড়ে ওঠে, চলতে থাকে পজিশন আকারে জায়গা কেনাবেচা। দেখতে দেখতেই সেখানে ৭০০ থেকে ৮০০ দোকানের বিরাট বাজার জমে উঠেছে। উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলার নামেই অবৈধ এ বাজারটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘নীলা মার্কেট’।
সেখানে একেকটি দোকানের পজিশন মূল্য বাবদ ৩ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা এককালীন আদায়ের পাশাপাশি ভাড়ার নামে দোকানপ্রতি দৈনিক এক থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে রাজউক সূত্র বলেছে, অবৈধভাবে গড়ে তোলা নীলা মার্কেটটিতে অন্তত চার দফা উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই উচ্ছেদ শেষে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আবারও সেখানে দোকানপাট নির্মিত হয়। এর পরও একাধিকবার উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েও পুলিশের সহায়তার অভাবে সফল করা যায়নি।
পূর্বাচল উপশহর গড়ে ওঠার লক্ষ্যে ভোলানাথপুরসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি এলাকার রাস্তাঘাট সুন্দর করে নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩০০ ফুট সড়ক দিয়ে খোলামেলা ঘুরে বেড়াতেও ভালো লাগে। সড়কের আশপাশের এলাকাগুলো অতিনির্জন। এজন্য বিভিন্ন স্থান থেকেই মানুষ এখানে ঘুরতে আসে। তাদের টার্গেট করেই নীলা মার্কেট ও আশপাশ এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে মাদকের আস্তানা। বসানো হয়েছে হরেকরকম জুয়ার আসর। নারীকেন্দ্রিক নানারকম অপরাধ আখড়াও জমে উঠেছে সেখানে। র্যাব, পুলিশসহ প্রশাসনের চোখের সামনে জবরদখলসহ অবৈধ কর্মকাণ্ড চললেও তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
মাদকের খোলা হাট হিসেবে ইতিমধ্যে পরিচিতি পাওয়া নীলা মার্কেটে সব ধরনের মাদকের রমরমা বাণিজ্য পরিচালনা করেন জনৈক আনোয়ার হোসেন। তার নিয়ন্ত্রণে থাকা সালাউদ্দিন, বাকির, রাসেল, নুরুজ্জামান, রাকিব, মোমেন, বাসিত, আবুসহ ১০-১২ জনের একটি গ্রুপ মাদক বিক্রি ছাড়াও খদ্দেরদের জন্য নিরাপদে সেবনের জায়গার ব্যবস্থাও করে দেন।
এসব ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে রূপগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলা বলেন, এমপি সাহেবের নির্দেশে স্টেডিয়ামের জায়গায় এ অস্থায়ী বাজার বসানো হয়েছে।
- কার্টসিঃ বাংলানিউজ/ সেপ্টেম্বার ৪, ২০১৮