Search

Tuesday, September 4, 2018

আ'লীগ নেতাদের দখল - পূর্বাচলে স্টেডিয়ামের জমি


রাজধানীর পূর্বাচল আবাসিক এলাকায় মার্কেটের নামে স্টেডিয়ামের হাজার কোটি টাকা মূল্যের জমি দখল করে নিয়েছেন আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি (নারায়ণগঞ্জ-১) গাজী গোলাম দস্তগীর। মার্কেটের নাম ‘নীলা মার্কেট’। ওপরে-ওপরে এই মার্কেটের সর্বেসর্বা হলেন রূপগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলা। 

কিন্তু এলাকাবাসী বলছেন, প্রকৃত নিয়ন্ত্রক মানে আসল দখলদার এমপি নিজেই। ফলত ভয়ানক এ দখলবাজি ঘটনার নীরব দর্শক রাজউক ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। গোটা এলাকা এখন এমপি এবং তার সমর্থক দখলবাজদের নিয়ন্ত্রণে। তার বেআইনি কর্মকাণ্ডে সরকারের সিদ্ধান্ত অকার্যকর আর নিজ দলীয় নেতা-কর্মীরাই শুধু কোণঠাসা। রাষ্ট্রীয় আইন, বিধিবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গড়ে তোলা সাম্রাজ্যে এমপি যা করেন যা বলেন তা-ই আইন হয়ে দাঁড়ায়। 

নীলা মার্কেট মানে স্থানীয়দের ভাষায় ‘গাজীর লোকদের সাম্রাজ্য’। এ সাম্রাজ্যে গড়ে তোলা হয়েছে গাড়ি পার্কিং পয়েন্ট, স্থায়ী-অস্থায়ী বাজার, কয়েক শ দোকানপাট, রেন্ট-এ-কারের টার্মিনাল, হোটেল-রেস্তোরাঁ, মাছবাজার, মিষ্টির কারখানা, স্থায়ী-অস্থায়ী নানা অবকাঠামো। সরকারি সিদ্ধান্তে যে পূর্বাচল আবাসন এলাকা গড়ে উঠেছে সেখানে সরকারের মন্ত্রী, এমপি, আমলা, বিচারপতিসহ সব মহলের ভাগ্যে প্লট জুটেছে। অনাগত প্রজন্মের জন্য সেই প্রকল্পে বিশাল জায়গা বরাদ্দ রাখা হয় স্টেডিয়ামের জন্য। কিন্তু রূপগঞ্জের জায়গাজমি দখলের রেকর্ড স্থাপনকারী এমপির নজর থেকে সেই স্টেডিয়ামের জায়গাটিও রক্ষা পায়নি। অনেক মন্ত্রী ও ক্ষমতাধর অবহিত থাকলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে পূর্বাচল স্টেডিয়ামের জায়গা দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না। সবার প্রশ্ন— সরকার ও প্রশাসনের চেয়ে একজন এমপির হাত এত লম্বা ও শক্তিশালী হয় কী করে? গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও রাজউক কেন দখলমুক্ত করার শক্তি রাখে না? কেন নেয় না পদক্ষেপ? কেন এই স্টেডিয়ামের জায়গা এখনো দখলমুক্ত করে দিতে পারে না যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে?

গুঞ্জন আছে, মন্ত্রীরাও জানেন রূপগঞ্জে কেউ জায়গা কিনতে চাইলে কেউ বিক্রি করতে চাইলে কেউ বাড়িঘর-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করতে চাইলে গাজী এমপির ইচ্ছার বিরুদ্ধে সম্ভব নয়। একাধিক মন্ত্রীর দফতরে এ নিয়ে মীমাংসা বৈঠকও হয়েছে অনেক সময়।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নীলা মার্কেটে কয়েকশ দোকানঘর। ৫০০ দোকানের আলাদা কাঁচাবাজারও গড়ে উঠেছে সেখানে। এসব দোকানঘর থেকে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্রতিদিন বিদ্যুৎ, পানি ও পরিচ্ছন্নতার দোহাই দিয়ে প্রতি দোকান থেকে আকারভেদে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে চাঁদাবাজ চক্র। মার্কেট ঘিরে ভোলানাথপুরসহ আশপাশ এলাকায় গড়ে উঠেছে মাদকের আস্তানা। এসব আস্তানায় সহজেই পাওয়া যাচ্ছে মরণ নেশা ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক। 

শুধু তাই নয়, নীলা মার্কেটের আশপাশ নির্জন জায়গা। তাই শত শত যুবক-যুবতী ঘুরতে এসে অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। নীলা মার্কেটের সামনেই একটি কবরস্থান। কবরস্থানের ভেতরেই মাদকের মজুদ গড়ে হরদম কেনাবেচা চালানো হচ্ছে। বেশ কয়েকটি দোকানঘরের পজিশন বিক্রি করা হয়েছে। একেকটি পজিশনের মূল্য ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা। এসব টাকা সংগ্রহ করেন ফটিক মিয়া।

যেভাবে গড়ে ওঠে দখলবাজির মার্কেটটিঃ 

পূর্বাচল আবাসনের ভোলানাথপুর এলাকায় বিশ্বমানের স্টেডিয়াম নির্মাণের পরিকল্পনা নেয় রাজউক। এজন্য প্রায় হাজার কোটি টাকা মূল্যের জায়গাও বরাদ্দ রাখা হয়। এ জমি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বরাদ্দ দিলেও তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখনো বুঝিয়ে দেয়নি রাজউক। ফলে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা জায়গার ওপর নজর পড়ে প্রভাবশালী জবরদখলকারীদের। এমপি গোলাম দস্তগীরের পৃষ্ঠপোষকতায় ও রূপগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলার তত্ত্বাবধানে পাঁচ বছর আগে সেখানে গড়ে তোলা হয় ক্লাব ঘর। এর নাম দেওয়া হয় ‘আওয়ামী লীগ ক্লাব’। নীলার স্বামী ফটিক আলম ও দেবর আনোয়ার হোসেন এ ক্লাব পরিচালনা করেন। তাদের নেতৃত্বেই ‘আওয়ামী লীগ ক্লাব’ ঘেঁষে একের পর এক দোকানপাট গড়ে ওঠে, চলতে থাকে পজিশন আকারে জায়গা কেনাবেচা। দেখতে দেখতেই সেখানে ৭০০ থেকে ৮০০ দোকানের বিরাট বাজার জমে উঠেছে। উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলার নামেই অবৈধ এ বাজারটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘নীলা মার্কেট’।

সেখানে একেকটি দোকানের পজিশন মূল্য বাবদ ৩ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা এককালীন আদায়ের পাশাপাশি ভাড়ার নামে দোকানপ্রতি দৈনিক এক থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে রাজউক সূত্র বলেছে, অবৈধভাবে গড়ে তোলা নীলা মার্কেটটিতে অন্তত চার দফা উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই উচ্ছেদ শেষে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আবারও সেখানে দোকানপাট নির্মিত হয়। এর পরও একাধিকবার উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েও পুলিশের সহায়তার অভাবে সফল করা যায়নি।

পূর্বাচল উপশহর গড়ে ওঠার লক্ষ্যে ভোলানাথপুরসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি এলাকার রাস্তাঘাট সুন্দর করে নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩০০ ফুট সড়ক দিয়ে খোলামেলা ঘুরে বেড়াতেও ভালো লাগে। সড়কের আশপাশের এলাকাগুলো অতিনির্জন। এজন্য বিভিন্ন স্থান থেকেই মানুষ এখানে ঘুরতে আসে। তাদের টার্গেট করেই নীলা মার্কেট ও আশপাশ এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে মাদকের আস্তানা। বসানো হয়েছে হরেকরকম জুয়ার আসর। নারীকেন্দ্রিক নানারকম অপরাধ আখড়াও জমে উঠেছে সেখানে। র‌্যাব, পুলিশসহ প্রশাসনের চোখের সামনে জবরদখলসহ অবৈধ কর্মকাণ্ড চললেও তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। 

মাদকের খোলা হাট হিসেবে ইতিমধ্যে পরিচিতি পাওয়া নীলা মার্কেটে সব ধরনের মাদকের রমরমা বাণিজ্য পরিচালনা করেন জনৈক আনোয়ার হোসেন। তার নিয়ন্ত্রণে থাকা সালাউদ্দিন, বাকির, রাসেল, নুরুজ্জামান, রাকিব, মোমেন, বাসিত, আবুসহ ১০-১২ জনের একটি গ্রুপ মাদক বিক্রি ছাড়াও খদ্দেরদের জন্য নিরাপদে সেবনের জায়গার ব্যবস্থাও করে দেন। 

এসব ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে রূপগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলা বলেন, এমপি সাহেবের নির্দেশে স্টেডিয়ামের জায়গায় এ অস্থায়ী বাজার বসানো হয়েছে।
  • কার্টসিঃ বাংলানিউজ/ সেপ্টেম্বার ৪, ২০১৮

আ'লীগ নেতাদের দখল - রূপনগরের ২২ একর লেক

মামুনুর রশীদ

  • রূপনগর আবাসিক প্রকল্পের ২২ একর আয়তনের লেক পুরো ভরাট করে দখল করেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
  • জলাবদ্ধতার ঝুঁকিতে পুরো এলাকা।
  • দখলের নেতৃত্বে রূপনগর থানা আ. লীগের সভাপতি রজ্জব হোসেন ও জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তোফাজ্জেল হোসেন
  • দখলের নেতৃত্বে ৭ নম্বর ওয়ার্ড আ. লীগের সভাপতি কাজী আবদুল হাই
  • দখলের নেতৃত্বে রজ্জব হোসেন সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহ্ এবং আবদুল হাই সাংসদ আসলামুল হকের অনুসারী।

মিরপুরে রূপনগর আবাসিক প্রকল্পের ২২ একরের একটি লেক পুরো ভরাট করে দখল করেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। দখলের নেতৃত্বে আছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও রূপনগর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. রজ্জব হোসেন, ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী আবদুল হাই হারুন ও রূপনগর থানা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তোফাজ্জেল হোসেন ওরফে টেনু।

রজ্জব হোসেন ঢাকা-১৬ আসনের সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্ এবং আবদুল হাই হারুন ঢাকা-১৪ আসনের সাংসদ আসলামুল হকের অনুসারী।

লেকটি জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে আছে। ১০ বছর ধরে এটি দখল হলেও দুবার অভিযান চালানো ছাড়া কিছুই করেননি।

রূপনগর এলাকার ভূ-উপরিভাগের পানি ধরে রাখা এবং জলাবদ্ধতা যাতে না হয়, সে জন্য প্রকল্পে বিশাল এই লেকটি রাখা হয়। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লেকটি মিরপুর এলাকার জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত। নগর-নিসর্গের ক্ষেত্রেও তা যুক্ত করতে পারত ভিন্ন মাত্রা।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আগে কমবেশি দখল হলেও ২০০৯ সালের পর লেক দখল উৎসবে রূপ নেয়। গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতা ছাড়া পুরো লেক দখল কোনোভাবেই সম্ভব হতো না বলে মনে করেন তাঁরা।

১০১ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা রূপনগর আবাসিক প্রকল্পে ১ হাজার ২০০টি প্লট আছে। শিয়ালবাড়ী মোড় থেকে রূপনগর প্রধান সড়ক ধরে সামনে আধা কিলোমিটার এগিয়ে হাতের ডান পাশে লেকটির অবস্থান। দেখা যায়, লেকে গড়ে তোলা হয়েছে হাজার হাজার বস্তিঘর। আছে অন্যান্য স্থাপনাও।

প্রায় এক সপ্তাহের সরেজমিন পরিদর্শনের সময় বস্তিবাসী, এলাকার বাসিন্দা, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীসহ অন্তত ৮০ জনের সঙ্গে কথা হয়। স্থানীয় এসব ব্যক্তি জানান, ২০১২ সালে আরামবাগ ঈদগাহ ময়দান ও বঙ্গবন্ধু শিশু উদ্যানের নামে লেকের উত্তর-পূর্ব অংশ ভরাট করা শুরু হয়। সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহ্ এর উদ্বোধনও করেন। পরে এলাকাবাসীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ অধিদপ্তর ওই কাজ বন্ধ করে দেয়। তারা লেক দখলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও তা আর হয়নি।

এসব কথার সূত্র ধরে উত্তর-পূর্ব কোণে আরামবাগ অংশে গিয়ে দেখা যায়, লেকের বিস্তীর্ণ অংশ ভরাট করে সেখানে একটি ঈদগাহ বানানো হচ্ছে। ঈদগাহ জামে মসজিদের নামফলকে লেখা, ‘১১ মে, ২০১৭। উদ্বোধন করেন সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্’। মসজিদ থেকে ভরাট করা অংশ পেরিয়ে লেকের ভেতরের অংশে গিয়ে দেখা যায়, ভরাট হতে বাকি আছে এমন অল্প কিছু জায়গায় বাঁশ ও বেড়া দিয়ে ঘর তোলার কাজ করছেন পাঁচ-ছয়জন। এই এলাকা পড়েছে ডিএনসিসির ৬ নম্বর ওয়ার্ডে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, লেকের এই অংশ দখলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রজ্জব হোসেন। সঙ্গে আছেন রূপনগর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সালাহউদ্দিন ওরফে রবিন। তাঁরা লেকের ওপর গড়ে তোলা প্রায় ২ হাজার ঘর থেকে প্রতি মাসে ন্যূনতম ৩ হাজার টাকা করে ভাড়া আদায় করেন। সে হিসাবে প্রতি মাসে ৬০ লাখ টাকা ভাড়া ওঠে।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কয়েকবার রজ্জব হোসেনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। প্রতিবার তা বন্ধ পাওয়া যায়। পরে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা জানান, মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে রজ্জব হোসেন গা ঢাকা দিয়ে আছেন।

জানতে চাইলে সম্প্রতি মিরপুরে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বসে সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্ প্রথম আলোকে বলেন, লেকের যে অংশ ভরাট করে মসজিদ ও ঈদগাহ মাঠ বানানো হয়েছে, তা গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের নয়; হামদর্দ ল্যাবরেটরিজের। তারা যেহেতু এখানে কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করছে না, তাই এলাকার বাসিন্দাদের দাবির মুখে এই মাঠ বানানো হয়েছে।

২০১২ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর আরামবাগ ঈদগাহ ময়দান ও বঙ্গবন্ধু শিশু উদ্যানের নামে লেক ভরাটের কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল—এই তথ্য জানালে সাংসদ বলেন, ‘তখন লেকের ওপর কিছু বস্তিঘর ছিল। তাতে আগুন লাগার পর এলাকাবাসী আর বস্তি রাখতে চাননি। আমারও তাতে সায় ছিল। সে সময় আরামবাগে একটি রাস্তা উন্নয়নের সময় তোলা মাটি লেকের ভেতরে ফেলা হয়। বাচ্চারা সেখানে খেলতে শুরু করে। পরিবেশ অধিদপ্তর বলল, এখানে কোনো খেলার মাঠ হবে না। কিন্তু আমরা তো আর বাচ্চাদের খেলার ব্যাপারে নিষেধ করতে পারি না।’

প্রধান অভিযুক্ত রজ্জব হোসেনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে ইলিয়াস মোল্লাহ্ বলেন, ‘এই এলাকায় আমাদের ৭৯ শতাংশ পৈতৃক সম্পত্তি আছে। রজ্জব সেগুলো দেখাশোনা করে। এর বাইরে সে আর কী করে, তা জানি না।’ তিনি বলেন, ‘লেক দখল করে খায় সবাই। নাম হয় হাজি রজ্জবের।’

বস্তিবাসী ও স্থানীয় নেতারা জানান, লেকের পশ্চিম অংশে প্রায় দেড় হাজার ঘরের মালিক রমজান আলী মাতবর ও তাঁর ভাই ছাত্তার আলী মাতবর। এই অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী আবদুল হাই ওরফে হারুন। এতে ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোবাশ্বের চৌধুরীর নীরব সমর্থন আছে। নীরব ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি।

জানতে চাইলে কাজী আবদুল হাই প্রথম আলোকে বলেন, ‘লেকের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য আমি গত কয়েক বছরে পরিবেশ অধিদপ্তর, গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ও সিটি করপোরেশনে অন্তত ৫০টি দরখাস্ত দিয়েছি। সেই আমার বিরুদ্ধেই যদি এমন অভিযোগ ওঠে, তা দুঃখজনক।’ তাঁর দাবি, লোকে আসলে অন্য হারুনের কথা বলেছেন। তাঁদের একজন রূপনগর আবাসিক এলাকার ১৯ নম্বর রোডে বাসিন্দা। আরেকজন থাকেন ৬ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায়। এঁরা দুজনই লেক দখলে যুক্ত ও আওয়ামী লীগ করেন।

আরেক অভিযুক্ত রূপনগর থানা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তোফাজ্জেল হোসেন ওরফে টেনু বলেন, ‘আমি ২৫ বছর ধরে এই এলাকায় আছি। ছোটখাটো ব্যবসা করে খাই। আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ কেউ প্রমাণ করতে পারলে আমি নিজেই নিজের বিচার করব।’

সাংসদ আসলামুল হক দেশের বাইরে থাকায় এই দখলদারদের বিষয়ে তাঁর অবস্থান জানা সম্ভব হয়নি।

বিশাল এই লেকের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন। তিনি বলেন, ‘একসময় এই লেক বোটানিক্যাল গার্ডেন ও মিরপুর সেনানিবাসের সঙ্গে যুক্ত ছিল। শীত মৌসুমে হাজার হাজার অতিথি পাখি ভিড় করত।’ তিনি বলেন, ‘লেকটি যে প্রক্রিয়ায় দখল হয়েছে, তাতে এই দায় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।’

লেক রক্ষা করতে না পারার বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান খন্দকার আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, অনেক আগেই লেকটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসাকে দেওয়া হয়েছে। কবে ওয়াসার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা দেখে বলতে হবে।’

তবে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান লেক হস্তান্তরের প্রশ্নে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘আইনগতভাবেই গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ এটি করতে পারে না। কারণ, জলাশয় রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কখনোই ওয়াসার না। আমরা রূপনগর খালের দায়িত্ব নিয়েছি। লেকের না।’

এরপর মিরপুর গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ডিভিশন-১-এর কার্যালয়ে গিয়ে কথা হয় উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. জিয়াউর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘১৯৮৭ সালে করা মাস্টারপ্ল্যান অনুসারে রূপনগর আবাসিক এলাকার এই লেকটির আয়তন ২২ একরের (৬৬ বিঘা) কমবেশি। লেকের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে এর আগে দুবার অভিযান চালানো হয়। কিন্তু আমরা শেষ পর্যন্ত লেক রক্ষা করতে পারিনি।’ কারণ জানতে চাইলে এই প্রকৌশলী বলেন, ‘যাঁরা এই দখলদারির সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা সবাই রাজনৈতিকভাবে খুব শক্তিশালী। কিছুদিন আগে আমাদের এক সার্ভেয়ারকে (জরিপকারক) বস্তির ভেতরে আটকে রেখেছিল কয়েক ব্যক্তি। পরে পুলিশ দিয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে।’

সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘লেকটি রক্ষা করতে কেবল গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে এমন নয়। ঢাকার বুকে এমন একটি উন্মুক্ত জলাশয় বাঁচিয়ে রাখতে রাজউকেরও ভূমিকা আছে। রাজউক সেই ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এই দুটো সংস্থাই গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আবার স্পষ্ট হলো, মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই।’

জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘লেকটি রক্ষার ব্যাপারে অবশ্যই রাজউকের ভূমিকা রাখা উচিত ছিল। কিন্তু গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে আমাদের কিছু জানায়নি। আমরা শুনেছি, লেকটি খুবই ছোট করে নিয়ে আসা হয়েছে। ওয়াসাও এটা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। বিষয়টি আমি দু-একটা মিটিংয়ে বলারও চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাজ হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘এবার বিষয়টি একটু গুরুত্ব দিয়ে দেখব। দেখি কী হয়।’ 

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ২, ২০১৮

ইভিএম নিয়ে অহেতুক বিতর্কে জড়িয়ে এখন সুর নরম ইসির

  • গত বছর ইসির সংলাপে কয়েকটি বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সুপারিশ আসে
  • আওয়ামী লীগসহ সাতটি দলের দাবি ছিল ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে
  • বিএনপিসহ ১২টি দল ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়েছিল
  • শেষ সময়ে শুধু ইভিএমে ভোট নেওয়ার সুযোগ তৈরির প্রস্তাব করে ইসি
  • প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর সিইসি বললেন, কিছু আসনে ইভিএম থাকবে

শেষ মুহূর্তে এসে ইভিএম নিয়ে অহেতুক বিতর্কের সৃষ্টি করল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর ইসি সুর নরম করেছে। যদিও আগামী জাতীয় নির্বাচনে সীমিত পরিসরে হলেও ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হচ্ছে।
গতকাল সোমবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, আইনের সংশোধনী পাস হলে এবং সবার সমর্থন পেলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে দৈবচয়নের ভিত্তিতে কিছু আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম ব্যবহারের চেষ্টা করবেন তাঁরা।

গত বছর অংশীজনদের সঙ্গে ইসির সংলাপে জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন, ইভিএম ব্যবহার, ‘না’ ভোটের বিধান চালু করাসহ কয়েকটি বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সুপারিশ এসেছিল। গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়গুলো ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল ইসি। এর মধ্যে শেষ সময়ে এসে শুধু ইভিএমে ভোট নেওয়ার সুযোগ তৈরি করার প্রস্তাব করেছে ইসি। এটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ সাতটি দলের দাবি ছিল। বিপরীতে বিএনপিসহ ১২টি দল ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়েছিল। আর সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি করেছিল ২৫টি দল। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪০।

নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনে বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহারের দক্ষতা ও কারিগরি সক্ষমতা ইসির নেই। ভোটাররাও ইভিএমের সঙ্গে সেভাবে পরিচিত নন। এ অবস্থায় শেষ মুহূর্তে ৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে দেড় লাখ ইভিএম কেনা এবং সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য আইন সংস্কারে ইসির উদ্যোগ অহেতুক বিতর্ক তৈরি করেছে। গত রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে তাড়াহুড়া করা ঠিক হবে না।

এই বিতর্কের মধ্যে গতকাল রাজধানীতে ইভিএম ব্যবহার-সংক্রান্ত এক কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সিইসি নুরুল হুদা বলেন, জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত আরও পরে হবে। ইসি এখনো আরও পেছনের পর্যায়ে আছে। আইন সংশোধনের প্রস্তাব সরকারের কাছে যাবে, সেখান থেকে মন্ত্রিসভা হয়ে সংসদে যাবে। প্রকল্প অর্থ মন্ত্রণালয়ে যাবে আর্থিক সংস্থানের জন্য।

সিইসি বলেন, জাতীয় সংসদে আইন পাস হলে, ইসির সক্ষমতা অর্জিত হলে এবং ইভিএম মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হলে, বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন পেলে যতখানি সম্ভব ইভিএম ব্যবহার করা হবে। এ ক্ষেত্রে কিছু আসনে ইভিএম ব্যবহার করার চেষ্টা করা হবে। ২০১০ সালের চেয়ে এখনকার ইভিএম অনেক উন্নত বলে দাবি করেন তিনি।

ইভিএম প্রযুক্তি ব্যবহারের পক্ষে যুক্তি দিয়ে সিইসি বলেন, বর্তমান পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে সুই-সুতা থেকে শুরু করে হাজার রকমের জিনিসপত্র দরকার হয়। ইভিএম পদ্ধতিতে এসব প্রয়োজন হবে না। একজনের ভোট অন্যজনও দিতে পারবেন না।

এত টাকা ব্যয়ে ইভিএম কেনার প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনার জবাবে সিইসি বলেন, দেশের নাগরিক যাঁরা কর দেন, তাঁরা অবশ্যই জানতে চাইবেন তাঁদের টাকা অপচয় হচ্ছে কি না। ইভিএমের কোনো তহবিল ইসির কাছে আসবে না, এটা নিশ্চিত করেই ইসি এগিয়েছে। আলাদাভাবে চিঠি দিয়ে এ দায়িত্ব সরকারের কাছে রাখা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা শুরু থেকেই বলে আসছেন, জনগণকে আস্থায় নিয়ে সংশ্লিষ্টদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে তারপর ইভিএম ব্যবহার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথমদিকে সীমিত সংখ্যক সংসদীয় আসনে ইভিএমের পরীক্ষামূলক ব্যবহার করা যেতে পারে। এটাই হওয়া উচিত। ইসি যদি সে সিদ্ধান্ত নেয়, সেটাই হবে যথাযথ।

বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নিজেদের জন্য একটি আইনি কাঠামো প্রণয়ন এবং তা প্রয়োগ করে ভোটারদের নির্দ্বিধায় ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল। এই লক্ষ্যে ইসি গত বছর অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ করেছিল। সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল, কিছু মন্ত্রণালয়কে নির্বাচনের সময় ইসির অধীনে নেওয়াসহ ছয়টি সুপারিশকে ‘সাংবিধানিক বিষয়’ হিসেবে চিহ্নিত করে ইসি বলেছিল, এ ক্ষেত্রে তাদের কিছু করার নেই। নির্বাচনী আইনের সংস্কার, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করাসহ ৩৪টি প্রস্তাব ও সুপারিশকে ইসি নিজেদের এখতিয়ারভুক্ত বলেছে। কিন্তু এসব বিষয়েও কার্যকর উদ্যোগ নেই।

এসব সুপারিশ এক পাশে রেখে কমিশনের ভেতরে-বাইরে আপত্তি ও সমালোচনার মুখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) ইভিএম ব্যবহারের বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব করেছে ইসি। গত বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের আপত্তির মুখে এই অনুমোদন করা হয়।

ইসি সূত্র জানায়, গতকাল সোমবার এই প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ে মতামত নিয়ে তা উঠবে মন্ত্রিসভায়। মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেলে এটি বিল আকারে সংসদে উঠবে। ৯ সেপ্টেম্বর থেকে সংসদের অধিবেশন বসছে। এই অধিবেশনে বিলটি পাস হলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের আইনি সুযোগ তৈরি হবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের নরম সুর বেশি সন্দেহজনক। ইভিএম ব্যবহার করা হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। কিন্তু এর মধ্যে দেড় লাখ ইভিএম কেনার প্রক্রিয়া কেন? নির্বাচন সুষ্ঠু করতে ইসির সংলাপে অনেকগুলো সুপারিশ এসেছিল। সেনা মোতায়েন, হলফনামা যাচাই-বাছাই, তৃণমূল প্যানেল থেকে প্রার্থী মনোনয়নসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ছিল। সবকিছু বাদ দিয়ে শেষ মুহূর্তে শুধু ইভিএম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আরপিও সংশোধনের উদ্যোগে মানুষের সন্দেহ বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। শেষ সময়ে এসে ইসি অহেতুক বিতর্ক তৈরি করছে।
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৮ 

নদী ভরাট করে ইকোনমিক জোন!

উদ্বিগ্ন পরিবেশ অধিদপ্তর

নিহাল হাসনাইন ও আমির হোসাইন


নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার মেঘনা নদীর তীরঘেঁষে ৮৩ একর জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে আমান ইকোনমিক জোন। এ জোনেই আমান গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আমান সিমেন্টের একটি অংশ চলে গেছে নদীর ভেতরে। সিমেন্ট কারখানার পরেই রয়েছে জেটি। এর কিছুদূর পর গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান আমান শিপইয়ার্ড। এরও অংশবিশেষ চলে গেছে নদীর অভ্যন্তরে।

আমান ইকোনমিক জোনের বিরুদ্ধে মেঘনা নদী দখলের সত্যতা পেয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরও। সরেজমিন পরিদর্শন করে ঢাকা অঞ্চল কার্যালয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছে অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়। ইকোনমিক জোনের নদী দখলের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে চিঠিতে বলা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের পরিদর্শক দল আমান ইকোনমিক জোনের অভ্যন্তরীণ ও আশপাশ এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখেছে, মেঘনা নদীর প্রায় ৩০ একর জায়গা ড্রেজারের মাধ্যমে বালি ফেলে ভরাট করা হয়েছে। ওই অংশে আমান ইকোনমিক জোনের কোনো সীমানা পিলার ছিল না। সরেজমিন পরিদর্শনে ভরাটকৃত জায়গাটি মেঘনা নদী ও নদীর ফোরশোর এলাকা মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। নদীর জায়গা বালি ফেলে ভরাট করার মধ্য দিয়ে আমান ইকোনমিক জোন পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর ৬ঙ ধারা ভঙ্গ করেছে।

পাশাপাশি আমান ইকোনমিক জোনের কর্মকর্তাদের গ্রহণযোগ্য বক্তব্য থাকলে সাত কার্যদিবসের মধ্যে তা দাখিল করার অনুরোধ করা হয়েছে চিঠিতে। একই সঙ্গে বিষয়টির নিয়মানুগ সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সব ধরনের ভরাট কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমান ইকোনমিক জোনের পক্ষ থেকে কোনো তথ্যপ্রমাণ দাখিল করা হয়নি বলে জানান অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের (ভারপ্রাপ্ত) উপপরিচালক নয়ন মিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, আমান ইকোনমিক জোন শিপইয়ার্ডের নামে যে জায়গা বালি ফেলে এরই মধ্যে ভরাট করে ফেলেছে, তা সরেজমিন পরিদর্শন করে নদী দখলের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে ঠিক কী পরিমাণ নদীর জায়গা দখল করেছে, তা নির্ধারণে উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) সহযোগিতা নেয়া হচ্ছে।

গতকাল সরেজমিন আমান ইকোনমিক জোন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মেঘনা নদীর তীরে হারিয়া গোবিন্দ, সোনামোহি, বৈদ্যের বাজার মৌজা নিয়ে গড়ে ওঠা জোনটির নিজস্ব সীমানায় সুবিশাল প্রাচীর। এ প্রাচীরের পরে নদীর ভেতর আরো অন্তত ৩০০ গজ জায়গা বালি ফেলে ভরাট করছে আমান ইকোনমিক জোন। এতে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

জানতে চাইলে আমান গ্রুপের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (প্রশাসন) তানভীর আহমেদ মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে আমাদের কোনো নোটিস পাঠানো হয়নি। আমান ইকোনমিক জোন ঘেঘনা নদীর কোনো জায়গা দখল করেনি। কেউ যদি এমন তথ্য দিয়ে থাকে, সেটি ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে।

পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে আনন্দবাজার ঘাটে নৌকা চালাচ্ছেন আব্দুল জলিল। পৈতৃক সূত্রে তিনি বৈদ্যের বাজার মৌজায় ৮০ শতাংশ জমি পেয়েছিলেন। স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত সেই জমিতে নিয়মিত চাষও করেছেন। একপর্যায়ে মেঘনার এ পাড় ভাঙতে শুরু করে। তলিয়ে যায় পুরো বৈদ্যের বাজার ও এর আশপাশ এলাকার জমি। নদীতে তলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত জলিলের কাছে ওই জমির সিএস খতিয়ান ছিল। কিন্তু তলিয়ে যাওয়ার পর আরএস বা বিএস খতিয়ানে ওই সম্পত্তির জায়গা হয়নি। অবশেষে ২০১৫ সালের প্রথম দিকে ৬ লাখ টাকায় ৮০ শতাংশ জমির সিএস কাগজ বিক্রি করে দেন জলিল। এমন সিএস খতিয়ানে শুধু আব্দুল জলিলই নয়, জমি বিক্রি করেছেন হারিয়া গোবিন্দ, সোনামোহি, বৈদ্যের বাজার মৌজার অনেকে। এসব জমি কিনে মেঘনার তীরে গড়ে উঠেছে আমান ইকোনমিক জোনসহ বেশ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁর ভূমি অফিসের কানুনগো মতিয়ার রহমান জানান, ১৯৭২ সালের নদী আইনের ১৩৫ নং অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ভরা মৌসুমে পানি যতদূর পর্যন্ত যাবে, তার পুরোটাই নদীর জমি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে নদী শুকিয়ে গেলে ফোরশোর ভূমি হিসেবে আগের মালিক পুনরায় তার ওই জমির দখল পাবেন। কিন্তু কোনোভাবেই সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। শুধু চাষাবাদের কাজে ওই জমি ব্যবহার করা যাবে। সে হিসাবে আমান ইকোনমিক জোন আইন ভঙ্গ করে নদীর জায়গা ভরাট ও স্থাপনা নির্মাণ করছে।

২০১৬ সালে কোয়ালিফিকেশন লাইসেন্স পায় আমান ইকোনমিক জোন। অনুমোদন পাওয়ার দুই বছরের মাথায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নদীর ফোরশোর জমি বালি ফেলে ভরাট করার অভিযোগ ওঠে।

তবে মেঘনা নদীর জমি দখলমুক্ত করতে এরই মধ্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানান নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক রাব্বি মিয়া। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমান ইকোনমিক জোন নদী দখল করেছে কিনা, তার কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে দেখতে এবং দখলমুক্ত ও পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ইকোনমিক জোনের বেশ কয়েকটি নারায়ণগঞ্জে। এসব ইকোনমিক জোনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে যখনই আমাদের মতবিনিময় হয়, তখনই তাদের নদী ও পরিবেশ আইন মেনে কাজ করার পরামর্শ দিই।

তার পরও কৌশলে নদী দখল হচ্ছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশবাদীরা। তাদের অভিযোগ, কয়েক দফা নিষেধ করার পরও আমান ইকোনমিক জোনের নদী দখল প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। অথচ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু বলা হচ্ছে না।

আমান ইকোনমিক জোন নদীর জায়গা ভরাট করে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান নারায়ণগঞ্জ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) যুগ্ম পরিচালক গুলজার হোসেন। তিনি বলেন, কারো জায়গা যদি নদীর মধ্যে চলে যায়, সেটা নদী। সে জায়গা কেনাবেচা করলেও তা টিকবে না। কারণ ভরা বর্ষায় নদীতীরের যে পর্যন্ত পানি যাবে, সে পর্যন্ত নদীর জায়গা। আমান অর্থনৈতিক অঞ্চল যদি নদীর জায়গা ভরাট করে থাকে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে মামলা করা হবে।

  • কার্টসিঃ বনিকবার্তা/সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৮ 

What lies behind police corruption

Muhammad Nurul Huda


The recently published Transparency International Bangladesh (TIB) survey report 2017 says that law enforcement agencies were the most corrupt among 18 departments and sectors involved in providing services to households. The report points out that members of law enforcement agencies got involved in corruption, misbehaved with service-seekers, threatened and implicated them in “false cases”, detained them without complaints, made delay and showed negligence in filing general diaries (GDs) and cases, resorted to extortion, and also made delay in providing passport verification reports.

The term “law enforcement agency” is generally understood to mean police, and thus one can assume that the TIB report focuses on police misconduct. Surely, the actions or inactions of corrupt police officials are not figments of our imagination. In fact, they are hard truths which would have been less ominous had they been isolated incidents on the part of the police.

Under the circumstances, it can be noted that since the image of the police as reflected by the mirror of the public opinion has an effect on the police and police culture, both the police image and police culture appear to be tarnished as a result. Quite often, an image is nothing but a true reflection of the reality. It also needs to be understood that “justice is not a cloistered virtue: she must be allowed to suffer the scrutiny and respectful, even though outspoken, comments of ordinary men.”

Therefore, the thing that may trouble a discerning mind is how a vital state organ that is statutorily mandated to protect people's life and liberties has deviated from its cherished path in such a manner. A response to such queries and apprehensions has been given by the TIB Trustee Board Chairperson, who said that the political will of those running the country is a prerequisite for reducing corruption and bribery.

This writer would not share the enthusiasm of those who will place all the blame on the politicians and remain oblivious to the serious management deficits of the public functionaries of the department. This view, of course, does not mean to minimise the significance of the critical element of political will. In fact, on the issue of political will, it is advisable to look at the matter from a historical perspective.

There is no denying that the modern state of Bangladesh was the product of a long and violent struggle for freedom. The irony is that while the country adopted a liberal, democratic constitution, it retained the colonial administrative, police and judicial structures without recasting them to meet the changed situation. Consequently, the colonial repressive character of the policing structure remained when the ruling elite of a decolonised society decided to retain the inherited police organisation as it was, ignoring justified imperatives for change. In other words, we have failed to introduce administrative changes in tune with the provisions of the republican constitution of Bangladesh.

One needs to know that in the context of the South Asian countries—where the coercive power of state is at its most obvious, in the form of the police, and where policemen's living off the land was made integral to the scheme of police organisation designed in 1861—the problem of corruption would naturally be more ingrained and acute. An adversarial relationship between the police and the “natives” was necessary to ensure political control of, and obedience to, the colonial government. The objective was efficiently achieved by creating and sustaining an extortion-based relationship between the police and the “natives”.

Police corruption stems from several interconnected factors including low pay of the majority of policemen as opposed to the wide discretionary power made available to them, poor working conditions, ineffective internal accountability and weak external accountability mechanisms.

The lure of corruption becomes too overwhelming to resist if the salaries of policemen are not sufficient to take them beyond temptation. This is especially so in a working environment plagued by oppressive working conditions and non-availability of a positive work ecology.

Additionally, the opportunity cost of being corrupt is very low in our situation, to the extent of being negligible. In other words, if the cost of losing one's job is very low compared to the cost of losing corruption-related money, then the rational choice would obviously be to accept or demand bribes, howsoever distasteful that may sound.

Many observers including public servants are of the view that if political aspects replace professional considerations and the penalty attached to misconduct gets to become ineffective, due to external interference in the internal administration of the police, there is all the incentive for officials both to be inefficient and corrupt.

Corruption has to be looked down upon within the organisational structure of police and it must be stigmatised so that there is not much disincentive against corruption. In fact, a punishment-reward based system is essential for achieving the goal of minimising corruption. A strong accountability mechanism coupled with attractive compensation policies are essential elements of a corruption-fighting system.

We have to remember that policing cannot be equated with other civil responsibilities because of its legal empowerment of curtailing liberties. People hold liberty very dear and its curtailment is justifiably frowned upon. Quite naturally, therefore, the recruitment process in police, particularly in the subordinate ranks, needs to be sanitised as complaints of irregularities in this regard are no longer a secret. Both politicians and police managers have to take corrective actions.

The onus of ensuring a malpractice-free management of the police force—including recruitment, promotion, posting and transfer—squarely lies with the police hierarchy. The police leadership should not be happy only when reform efforts focus on issues like better salary package, more manpower, additional transport, etc. The core reform agenda entailing more responsibility coupled with stricter accountability must not elicit a lukewarm response from them.

We need to think of the steps that would be necessary to insulate police from partisan political control. The existing accountability mechanism being less than desirably effective needs to be replaced by statutory institutions like the Independent Police Complaints Authority in the UK or the Public Safety Commission in Japan. The core issue is not so much what police do—but why they do what they do. The process of making the police earnestly work for the people without the fetters has to commence.

  • Muhammad Nurul Huda is a former IGP and a columnist at The Daily Star.

  • Courtesy: The Daily Star /Sept 04, 2018

কেন ইভিএম নেব, কেন নেব না

মিজানুর রহমান খান


নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হঠাৎ উতলা হওয়া অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। মনে হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের আগে ইভিএম-বিতর্ক বিরোধী দলকে আরও চাপে ফেলতে সহায়ক হবে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এবার ‘মেশিনে ভর’ করার যুক্তি খণ্ডন করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘মেশিনের ওপর ভর করে নয়, আওয়ামী লীগ সব সময় জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছে।’

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ, ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় অভিশংসনব্যবস্থার প্রবর্তনে জনমতের ধার ধারেনি সরকারি দল। তবে বিশ্বের উন্নত গণতন্ত্রে আছে, তাই বাংলাদেশকেও করতে হবে—এ রকম একটি যুক্তি দেওয়া হয়েছে। এখন আবার ওবায়দুল কাদের বলছেন, ‘ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ সারা বিশ্বে প্রশংসিত। ভারতেও বেশ কয়েকটি নির্বাচন ইভিএমের মাধ্যমে হয়েছে। পৃথিবীর উন্নত দেশে ইভিএম ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানেও তাই হবে।’ তাঁর এই বক্তব্য যাচাইয়ের দাবি রাখে।

ভারতের নির্বাচন কমিশন ১৯৭৭ সালে প্রথম ইভিএম চালু করে। ১৯৮১ সালে প্রথম কয়েকটি রাজ্যে এর পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালু হয়। তবে ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী সংস্কারের মতো ইভিএম কার্যকর করা নিয়েও আদালতে রিট হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে মাদ্রাজ, কেরালা, দিল্লি, কর্ণাটক ও বোম্বে (নাগপুর বেঞ্চ) হাইকোর্টে রিট হয়েছে এবং তাতে তারা ইভিএমের পক্ষে রায় পেয়েছে। তিনটি সাধারণ নির্বাচন হওয়ার পরও ২০১৭ সালে উত্তরাখন্ড হাইকোর্টকে রায় দিতে হয়েছে। গত বছর সুপ্রিম কোর্টকেও রায় দিতে হয়েছে। ২০১২ সালে দিল্লি হাইকোর্ট রায় দিয়েছিলেন, এটা ‘টেম্পার প্রুফ’ (জালিয়াতি নিরোধক) নয়। আবার এ বিষয়ে ইসিকে নির্দেশনা দেওয়াও ‘জটিল’। তিনটি মৌলিক ধাপে ইভিএমের আধুনিকায়ন ঘটিয়ে ভারত এ পর্যন্ত এসেছে।

ভারতের ইসির এ–সংক্রান্ত বায়ান্ন পৃষ্ঠার একটি স্ট্যাটাস পেপারের দিকে আমাদের ইসি এবং আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। সেখানে লেখা আছে, ‘ভারতের নির্বাচনগুলো ইভিএমে হবে, সেই বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে সাধারণ ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৮ সালে।’ অথচ লোকসভার ৫৪৩ আসনেই ইভিএমে প্রথম নির্বাচনটি হয় ২০০৪ সালে। তার মানে সংসদ নির্বাচনে এটা চালু করার আগে ভারত পরীক্ষা করেছে ২২ বছর। আর রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও ইসি সময় নিয়েছে পুরো ৬ বছর।

২০০৪, ২০০৯ ও ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচন ইভিএমে হয়েছে। কিন্তু এখনো বিতর্ক পিছু ছাড়েনি। ইভিএম ত্রুটিপূর্ণ প্রমাণিত হলে ভারত দৃশ্যত আল গোরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগায়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো তারা ২০১৩ সালে স্বচ্ছতার বাড়তি রক্ষাকবচ হিসেবে ভিভিপিএটি (ভোটার ভেরিফাইয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল) চালু করে। ভোট গ্রহীতার নাম ও প্রতীক সংবলিত একটি কাগজ তৈরি করবে যন্ত্র, যা ভোটারের জন্য একটি রক্ষাকবচ। এই পদ্ধতি যুক্ত করার পরেই কেবল সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দেন। ২০০৯ সালে নাগাল্যান্ডের উপনির্বাচনে এটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। অথচ আমাদের দেশে যে ইভিএম চালু করা হয়েছে, তাতে ভিভিপিএটির কথা চিন্তাভাবনাও করা হয়নি বলে একজন কর্মকর্তা আমাদের রোববার নিশ্চিত করেন।

১৯৯০ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত নেদারল্যান্ডস ইভিএম ব্যবহার করেছে। একটি ডাচ বেসরকারি কোম্পানির (এনইডিএপি) উদ্ভাবন ছিল এটি। পরে ডাচদের দেখাদেখি জার্মানি ও আয়ারল্যান্ড ওই একই কোম্পানি থেকে নিয়ে ইভিএম চালু করেছিল। দুটি উচ্চপর্যায়ের কমিশনের সুপারিশে ডাচরা ইভিএম ত্যাগ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকে হ্যাকিংয়ের মতো প্রযুক্তিগত বিপর্যয় সত্ত্বেও জালিয়াতি নিরোধক ভোট প্রদানের ব্যবস্থা হিসেবে ইভিএমের স্বীকৃতি নিশ্চিত হলে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই এই পথে যেতে পারে। ফলে ইভিএম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়টি আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু অন্য দেশগুলো কী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেটা দেখতে হবে। দুই ডাচ কমিশনের মূল্যায়ন আমাদের জন্য প্রযোজ্য। তারা বলেছিল, ‘যন্ত্র তদারকির নিজস্ব লোকবল নেই, তাই বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। আর তাতে যন্ত্র সরবরাহকারীরাই নীতিনির্ধারণী ভূমিকা রাখে। প্রযুক্তি সেকেলে, যা ডিজিটাল হুমকি মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়। টেস্টিং রিপোর্টগুলোর গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়েছে, সে কারণে তা স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা যাচাই করতে অপারগ। নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিধিবিধান ছিল আলগা ও অপ্রতুল।’

জার্মানরা ২০০৫ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ইভিএম ব্যবহার করলেও সমালোচনার মুখে তা বন্ধ করে। সেখানে গণনা পর্যায়ে হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটেছিল। ২০০৯ সালে জার্মান ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত ইভিএম নাকচ করেন। আদালত তাঁর রায়ে দুটি মুখ্য কারণ দেখান। প্রথমত, বিদ্যমান জার্মান সংবিধান ইভিএম সমর্থন করে না। কারণ, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতিটি অত্যাবশ্যকীয় ধাপ জনগণের পরীক্ষা করে দেখার অধিকার আছে। কিন্তু যন্ত্র তাদের সেই অধিকার কেড়ে নিয়েছে। দ্বিতীয় যে কারণ দেখানো হয়েছে, সেটি উচ্চশিক্ষিত নাগরিকের দেশ জার্মানির জন্য যদি প্রযোজ্য হয়, তাহলে শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের জন্য তা আরও বেশি মাত্রায় প্রাসঙ্গিক। রায়ে বলা হয়েছে, ভোটের গণনা এমন হতে হবে, যাতে ভোটাররা কারিগরি বিশেষজ্ঞ জ্ঞান জানা ছাড়াই নিজেরাই যাচাই করতে পারেন। সেই নিশ্চয়তা ইভিএম দেয় না। বাংলাদেশ সংবিধান বলেছে, সংসদ গঠন হতে হবে ‘প্রত্যক্ষ ভোটে’। প্রস্তাবিত ইভিএম এই শর্ত পূরণ করে না। তাই সংবিধান সংশোধন লাগবে।

আয়ারল্যান্ডও ২০০২-২০০৪ সালে ইভিএম ব্যবহারের পরে বিতর্কের মুখে দুটি কমিশন করে এবং তারাও দেখতে পায় যে, ‘ওই ডাচ যন্ত্র বিশ্বস্ত নয়। প্রযুক্তিগত রক্ষাকবচ অপ্রতুল। কোনো একটিমাত্র সংস্থার দ্বারা ভোটদান থেকে গণনা ও ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত প্রক্রিয়া যাচাই করা সম্ভব নয়। উপরন্তু সব সংসদীয় আসনে ইভিএমের নিরাপত্তা (ফিজিক্যাল সিকিউরিটি) নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ ধরনের উদ্বেগ বাংলাদেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক।

আমরা বিশেষভাবে স্মরণ করতে পারি, ২০০০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিতর্কিত ভোট গণনা এবং বুশের কাছে আল গোরের হেরে যাওয়া। ফ্লোরিডার পুনরায় ভোট গণনাকে অসাংবিধানিক বলে একটা তর্কিত সমাধান দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট। গোর সব ভোট ‘হাতে গণনা’র দাবি করেছিলেন। সেটা পূরণ হয়নি। গোর বলেছিলেন, ‘আমাদের গণতন্ত্রের শক্তি ও গণঐক্যের স্বার্থে আমি রায়টা মানছি মাত্র।’ ওই অভিজ্ঞতার পরে যুক্তরাষ্ট্র ডাইরেক্ট রেকর্ডিং ইলেকট্রনিক (ডিআরই) চালু করে, যার আওতায় এখন একাধিক স্থানে ভোটদান রেকর্ড হয়ে যায়। দেখার বিষয়, এই উন্নততর ডিআরই চালুর পরেও ভোটারদের মনের খুতখুতানি যায়নি। এরপর তারা উল্লিখিত ভোটার ভেরিফাইয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল চালু করে।

ইভিএম এখন পর্যন্ত বিশ্বে এমন একটি ব্যবস্থা, যা নিতান্তই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ভারতের সঙ্গে অন্যদের তুলনা হবে না। কারণ, তারা আমদানি করেনি। নিজেরা উদ্ভাবন করে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে হাতে গোনা যারা ইভিএম ব্যবহার করছে, তারাও অনেকে সাধারণ নির্বাচন করতে সাহস করছে না। আমরা নিজেদের ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের গণতন্ত্র চর্চা করি বলে দাবি করি। সেই গণতন্ত্রের সূতিকাগার ইংল্যান্ডও ইভিএম ব্যবহারের সাহস করেনি। ২০০০ সাল থেকে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে কিছু পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে মাত্র। ২০১৬ সালে এক প্রশ্নের উত্তরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে বলা হয়েছে, ‘সাংবিধানিক সংস্কারে আমাদের পূর্ণ কর্মসূচি চলমান রয়েছে, কিন্তু তার মধ্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং চালু বা সে জন্য কোনো সংবিধিবদ্ধ আইন করার কোনো চিন্তাভাবনাও নেই।’

বিএনপি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে ষড়যন্ত্র দেখছে। এটা তারা তাদের অভ্যাসগত অবস্থান বা রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে বলে থাকতে পারে। কিন্তু আমরা ওপরের আলোচনার দিকে সরকারের এবং ইসির নজর কাড়তে চাই। একই সঙ্গে আমরা নির্বাচন কমিশনকে এখনই আড়াই হাজার কোটির বেশি টাকায় ইভিএম কেনার প্রকল্প বাতিল করতে অনুরোধ রাখব।


  • লেখক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
  • কার্টসি —  প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৮ 

আসামি যখন মন্ত্রিপুত্র

সম্পাদকীয়

অপরাধ সংঘটিত হলে তার বিচার করার জন্য আইন আছে, আইন প্রয়োগের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষ আছে এবং আদালত আছে। অপরাধের শিকার ব্যক্তি কিংবা তাঁর স্বজন বিচার চাইতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারস্থ হবেন, মামলা করবেন। তার পরেই শুধু বিচারের আইনানুগ প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যদি বিচারপ্রার্থীর মামলাই গ্রহণ না করে, তাহলে বিচারের কোনো পথ থাকে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। হত্যা, ধর্ষণসহ নানা গুরুতর অপরাধের বিচারপ্রার্থীরা মামলা করার জন্য থানায় গেলে পুলিশ মামলা গ্রহণ করে না—এমন অভিযোগের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই প্রকাশিত হয়।

এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে গত ৩১ জুলাই ময়মনসিংহ শহরে সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ডের কথা। সেদিন দুপুরে যুবলীগের দুটি পক্ষের সংঘর্ষে শেখ আজাদ নামে মহানগর যুবলীগের এক সদস্যকে গুলি করে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। প্রকাশ্য দিনের আলোয় এই হত্যাকাণ্ড ঘটে; কিন্তু যুবলীগ সদস্যের স্ত্রী মামলা করার উদ্দেশ্যে লিখিত অভিযোগ নিয়ে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানায় গেলে পুলিশ মামলাটি গ্রহণ করেনি। স্বামীকে হারিয়ে সংক্ষুব্ধ নারীটি নিরুপায় হয়ে আদালতে রিট আবেদন করেন। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার হাইকোর্ট মামলাটি নথিবদ্ধ করার জন্য ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানার পুলিশকে নির্দেশ দিলে শুক্রবার পুলিশ মামলাটি নথিবদ্ধ করে।

প্রশ্ন হলো ময়মনসিংহ থানার পুলিশ মামলাটি নিতে রাজি হচ্ছিল না কেন। এর উত্তরে এ দেশের আইন প্রয়োগচর্চার ক্ষেত্রে একটি সাধারণ প্রবণতা ফুটে ওঠে: প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করতে গেলে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ মামলা নিতে অপারগতা কিংবা অস্বীকৃতি জানায়। বর্তমান ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, নিহত শেখ আজাদের স্ত্রী তাঁর স্বামীর হত্যাকারী হিসেবে যে ব্যক্তিদের আসামি করে মামলাটি করতে গিয়েছিলেন, তাঁদের তালিকায় আছেন মোহিত উর রহমান ওরফে শান্ত নামের এক যুবক, যিনি একাধারে ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সরকারের ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের ছেলে।

ক্ষমতাসীন দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা হলেই যেখানে থানা-পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা নিতে রাজি হয় না, সেখানে মোহিত একজন মন্ত্রীর ছেলে! হাইকোর্টের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানার পুলিশ যে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা নিচ্ছিল না—এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কিন্তু ক্ষুব্ধ হওয়ার ও প্রতিবাদ জানানোর জোরালো কারণ আছে। হত্যাকাণ্ডের মতো গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের আইনি প্রতিকারের জন্য আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের যেখানে আপন দায়িত্ববোধ থেকেই এগিয়ে যাওয়া উচিত, সেখানে মামলা নথিবদ্ধ না করে বিচারপ্রার্থীর সঙ্গে অসহযোগিতা করা অবশ্যই নিন্দনীয়। উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশ না আসা পর্যন্ত হত্যা মামলা গ্রহণ না করা আইনের শাসনের নীতি অগ্রাহ্য করার শামিল।

শেষ পর্যন্ত যখন মামলাটি গ্রহণ করা হয়েছে, তখনো নিহত শেখ আজাদের স্বজনদের স্বস্তি বোধ করার কারণ ঘটেনি। কারণ, পুলিশ মামলা গ্রহণের পর ধর্মমন্ত্রীর ছেলে মোহিতসহ ২৫ জন আসামির কাউকেই গ্রেপ্তার করেনি। মন্ত্রীর ছেলে তো আইনের ঊর্ধ্বে নন, আইনের চোখে সবাই সমান। তাহলে তাঁকেসহ অন্য আসামিদের কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না—এই প্রশ্নের সঙ্গে এই সংশয়ও থেকে যাচ্ছে যে মামলাটি পরিচালনার ক্ষেত্রে পুলিশের গাফিলতি থাকতে পারে। আমরা এ বিষয়টির ওপরেই বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাই: আদালত নির্দেশ দিয়েছেন বলে মামলা গ্রহণ করার মধ্য দিয়েই যেন পুলিশের দায়িত্ব-কর্তব্য শেষ হয়ে না যায়। হত্যার বিচার ও হত্যাকারীদের আইনানুগ শাস্তি নিশ্চিত করার পথে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব যেন বাধা সৃষ্টি না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৮

গ্রেপ্তার, মামলা-হামলা বন্ধ করুন

সম্পাদকীয় 

অস্বীকার করা যাবে না যে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ অপরিহার্য। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা বিরোধী দল বিএনপিকে নির্বাচনে আসার জন্য হরহামেশা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু নির্বাচন করার জন্য যে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকা দরকার, সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য থেকে শুরু করে সরকারি দল কিংবা সহযোগী দলের নেতা-কর্মীরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার সহায়ক ভূমিকা পালন না করে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো বিএনপিরও শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করার অধিকার আছে। ১ সেপ্টেম্বর ছিল দলটির ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ উপলক্ষে বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশের অনুমতি চেয়েছিল। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সে আবেদন নাকচ না করে দলীয় অফিসের সামনে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে। অন্যান্য দল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে পারলে বিএনপি কেন পারবে না? তারপরও ডিএমপির সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই।

কিন্তু ঢাকার সমাবেশকে কেন্দ্র করে শহরের বিভিন্ন প্রবেশমুখে যাত্রীদের হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে আরও লক্ষ করলাম, ঢাকার বাইরে সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, গৌরীপুরসহ বেশ কিছু এলাকায় পুলিশি বাধার কারণে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি পালিত হতে পারেনি। কোনো কোনো স্থানে কর্মসূচি পালনের আগেই বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি স্থানে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে আরও বেশ কিছু নেতা-কর্মীকে।

পুলিশ প্রশাসনের কিছু অতি উৎসাহী কর্মকর্তা সরকারকে খুশি করতে এ ধরনের হঠকারী কাজ করলেও শেষ পর্যন্ত যে মামলা টেকে না, তার ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে। বর্তমান সরকারের সময় বিএনপির অসংখ্য নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করলেও পুলিশ অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। বরং এসব রাজনৈতিক মামলাকে কেন্দ্র করে পুলিশের উৎকোচ–বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। বিএনপির যেকোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি বা সভা-সমাবেশের মধ্যে ষড়যন্ত্র খোঁজা হাস্যকরও বটে।

বিএনপি নেতা-কর্মীদের ষড়যন্ত্র আবিষ্কারে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী–ই নয়, ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীদেরও তৎপর দেখা যায়। শরীয়তপুরে বিএনপির এক নেতার বাড়িতে আয়োজিত বৈঠকে হামলা হয়েছে ও বগুড়ায় ছাত্রলীগের হামলায় যুবদলের তিন কর্মী আহত হয়েছেন। এসব ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিষ্ক্রিয় থাকে। তাদের যেখানে সক্রিয় হওয়ার কথা, সেখানে নিষ্ক্রিয় থাকা, আর যেখানে নিষ্ক্রিয় থাকার কথা, সেখানে অতি সক্রিয় হওয়া আইনের শাসন কিংবা গণতন্ত্রের সহায়ক নয়।

নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসছে। এমন অবস্থায় সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিশ্চিত করার স্বার্থে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি ও সভা-সমাবেশ যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে যে সুযোগ-সুবিধা পায়, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এটা সংবিধান স্বীকৃত অধিকার। কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আর কোনো অহেতুক মামলা দায়ের ও গ্রেপ্তার নয়।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপি শনিবার ঢাকায় সমাবেশ করেছে। শান্তিপূর্ণভাবে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমরা আশা করব বিএনপিসহ যেকোনো বিরোধী দল কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেবে। তবে শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মূল দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারকেই নিতে হবে। সামনের দিনগুলোতে দেশে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের পরিস্থিতি ও পরিবেশ বজায় থাকবে এবং সরকার এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না, এটাই প্রত্যাশিত।  

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৮ 

Thursday, August 30, 2018

বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুম পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে - এএলআরসি

জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে পাঠানো এএলআরসির রিপোর্ট


বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুম পরিস্থিতির শুধুই অবনতি হয়েছে। ৩৯তম নিয়মিত অধিবেশন উপলক্ষে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের কাছে পাঠানো এক রিপোর্টে এসব কথা বলেছে মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টার (এএলআরসি)। 

এতে বলা হয়েছে এ সরকারের মেয়াদে ২০০৯ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ৩১ শে জুলাই সময়ের মধ্যে কমপক্ষে ৪৩২ জনকে গুম করেছে আইন প্রয়োগকারী এজেন্সিগুলো। লোকজনকে তুলে নেয়া ও গুম করার সঙ্গে অভিযুক্ত হিসেবে যাদের নাম উঠে এসেছে তারা হলো ডিবি, পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমস ইউনিট (সিটিটিসিইউ), র‌্যাব ও একটি গোয়েন্দা সংস্থা। এএলআরসি আরো বলেছে, নাগরিকদের তুলে নেয়া ও গুমের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ অব্যাহতভাবে অস্বীকার করে যাচ্ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। নিখোঁজ হওয়ার কয়েক সপ্তাহ বা মাস পরে এক-চতুর্থাংশ মানুষকে পাওয়া যাচ্ছে বন্দি অবস্থায়।

তাদের বিরুদ্ধে আনা হচ্ছে নানা রকম বানোয়াট ফৌজদারি অভিযোগ। এ অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে যারা ঘরে ফিরেছেন, তারা কখনো মুখ খোলার সাহস দেখান না। এএলআরসি আরো বলেছে, জোরপূর্বক গুমের ঘটনায় পর্যায়ক্রমিকভাবে অভিযোগ নিবন্ধিত করতে অস্বীকার করে বাংলাদেশ পুলিশ। তারা বলে অভিযোগ থেকে আইন প্রয়োগকারী এজেন্সির নাম বাদ রাখতে হবে। এ ছাড়া গুম শব্দটির পরিবর্তে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের দ্বারা অবহরণ অথবা নিখোঁজ শব্দ ব্যবহারে বাধ্য করে অভিযোগকারীকে। এর ফলে অভিযোগ মেকানিজমে পরিপূর্ণ সুবিধা অস্বীকার করায় প্রাথমিকভাবে ধাক্কা খান অভিযোগকারী। অভিযোগ করার মেকানিজমে এই যথাযথ সুবিধা না পাওয়াটা হচ্ছে ন্যায়বিচার না পাওয়ার বিষয়। উপরন্তু অভিযোগকারী ও গুমের শিকার ব্যক্তির পরিবার অব্যাহতভাবে ভীতির সম্মুখীন হন। তাদেরকে শারীরিক ও ডিজিটাল নজরদারিতে রাখে পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। 

এ ছাড়া অভিযোগকারী একই রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। সেখানে অভিযোগের জন্য আইনজীবীর সহায়তা নেয়া বাধ্যতামুলক। কিন্তু নানা রকম প্রতিশোধ নেয়ার কারণে আইনজীবীরা এসব চ্যালেঞ্জ নিতে অনীহা দেখান। পুলিশ স্টেশন অথবা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে যেসব অভিযোগ জমা পড়ে তার তদন্ত করে না পুলিশ। তবে ২০১৫ সালে সাতজন মানুষ গুমের একটি ঘটনায় তদন্ত করেছে তারা। ফলে গত ১০ বছরে এমন ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের মাত্র একটি ঘটনায় বিচার হয়েছে। তারা জোরপূর্বক গুম করেছিল। এবং পড়ে সেই গুমের শিকার ব্যক্তিদের মৃতদেহ ভেসে উঠেছিল। 

এএলআরসি আরো বলেছে, ২০০৯ সাল থেকে সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট ডিভিশনে প্রায় ১০টি ‘হাবিয়াস করপাস’ রিট জমা পড়েছে। সুনির্দিষ্ট রিটে হাই কোর্ট রুল দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোর ‘বুরোক্র্যাট ও অফিসিয়ালদের’ বিরুদ্ধে। তাদেরকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। ওদিকে গুমের সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর লোকজন জড়িত থাকার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে এটর্নি জেনারেলের অফিস।  তবে ২০০৯ সাল থেকে যেসব মানুষ অপহৃত হয়েছেন, তারা কোথায় আছেন তা কেউ জানেন না, সেইসব মানুষকে হাজির করার জন্য রাষ্ট্রীয় কোনো এজেন্সিকে কোনো নির্দেশ কখনো দেন নি সুপ্রিম কোর্ট। 

জাতীয় সংসদে এক বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুমের ঘটনা নতুন নয়। সারা বিশ্বেই এমন ঘটনা ঘটে চলেছে। তার মতে, বৃটেন ও যুক্তরাষ্ট্রেও গুম হয় মানুষ। তিনি দাবি করেন, প্রতি বছর যুক্তরাজ্যে গুম হন দুই লাখ ৭৫ হাজার বৃটিশ নাগরিক। যুক্তরাষ্ট্রে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি। এমন বক্তব্য গুমের শিকার ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার পাওয়াকেই শুধু বাধাগ্রস্ত করে না। একই সঙ্গে যারা এসব ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তারা দায়মুক্তি পেয়ে আরো উৎসাহিত হয়। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু ক্ষমতাসীন সরকারের ইচ্ছামতো তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করে। এই বাস্তবতা ভিকটিমের অধিকার লঙ্ঘিত হওয়ায় তার ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগকে অস্বীকার করে। 

এএলআরসি বলেছে, তারা বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুমের জটিল বাস্তবতা সম্পর্কে অব্যাহতভাবে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ ও ওয়ার্কিং গ্রুপ অব এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সে’কে জানিয়ে আসছে। 

এএলআরসি বলেছে, এর প্রেক্ষিতে মানবাধিকার পরিষদ ও নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের ব্যাপকভাবে বোঝা উচিত যে, সরকার গুমের অভিযোগ অস্বীকার করছে, অপরাধকে জাস্টিফাই করছে, এর সঙ্গে জড়িতদের দায়মুক্তির গ্যারান্টি দিচ্ছে, অভিযোগকারী ও ভিকটিমের আত্মীয়দের হয়রান বা ভীতি প্রদর্শন করছে, ন্যায়বিচারের মেকানিজমের সুবিধা পাওয়া প্রতিরোধ করছে। এবং এরাই জোরপূর্বক গুমের জন্য দায়ী। এএলআরসি আরো বলেছে, যখন এমন একটি সরকার থাকে তখন গণতান্ত্রিক ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে জোরপূর্বক গুমের ন্যায়বিচার পাওয়া অসম্ভব। উপরন্তু এখানে যে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বাস্তবে তা ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে রোহিঙ্গা সঙ্কট দিয়ে। এক্ষেত্রে মানবাধিকার পরিষদের উচিত বাংলাদেশ সরকারের কাছে জানতে চাওয়া যে, অন্য দেশের একটি অপরাধ দিয়ে নিজের দেশের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকে ছাড় দেয়া বৈধ কিনা। এ অবস্থায় মানবাধিকার পরিষদের প্রতি এএলআরসি আহ্বান জানাচ্ছে স্পেশাল র‌্যাপোর্টিউর অন বাংলাদেশের জন্য একটি ম্যান্ডেট সৃষ্টির জন্য, তারা প্রায় ১৬ কোটি মানুষের মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং করবে। 
  • কার্টসিঃ মানবজমিন/ আগস্ট ৩০,২০১৮ 

‘গুম হওয়ার চেয়ে কারাবাস ভালো’

শেখ সাবিহা আলম

  • আজ আন্তর্জাতিক গুম দিবস
  • ২০০৯ সাল থেকে এ বছরের জুলাই পর্যন্ত ‘গুম’ হয়েছেন ৪৩২ জন
  • ফিরে আসা ব্যক্তিরা অপহরণকারীদের ব্যাপারে মুখ খোলেননি
  • গুমের শিকার পাঁচ ব্যক্তি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে

বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল সেদিন। গাড়ি ধরবেন বলে রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন কেবল, হঠাৎ ছয়-সাতজন লোক কিছু না বলে একরকম ছোঁ মেরে তাঁকে মাইক্রোবাসে তুলে ফেলেন। চোখ আর হাত দুটো বাঁধা হয়ে যায় মুহূর্তে। কিন্তু ব্যাপারটা কী? কেউ কোনো কথার জবাব দিচ্ছেন না। রাতের ঢাকার ফাঁকা রাস্তায় শুধু গাড়িটা ছুটছে। একপর্যায়ে তিনি কোনো এক গন্তব্যে পৌঁছালেন। তখনো জানতেন না এই অজ্ঞাতবাসেই ছয় মাস কাটাতে হবে তাঁকে।

যাঁর কথা বলা হচ্ছে, তিনি ২০১৬ সালে ছয় মাসের বেশি সময় গুম হয়েছিলেন। আজ আন্তর্জাতিক গুম দিবস। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের হিসাবে ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত এমন মানুষের সংখ্যা ৪৩২। তাঁদের মধ্যে খোঁজ পাওয়া গেছে ২৫০ জনের। অজ্ঞাতবাস থেকে যাঁরা ফিরেছেন, তাঁরা আর অপহরণকারীদের ব্যাপারে মুখ খোলেননি। অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে চিকিৎসাধীন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলেছে, পরিবার, স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছেন, র‍্যাব, ডিবি ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে তাঁদের স্বজনদের তুলে নেওয়া হয়েছে। অনেক সময় তাঁরা জিডিও করতে পারেননি। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বরাবর গুমের অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, যখনই কোনো নিখোঁজ সংবাদ আসে, তখনই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আইনি পন্থায় তাঁকে খুঁজে দিতে বাংলাদেশ পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করে।

গুমের শিকার হওয়া পাঁচ ব্যক্তি সম্প্রতি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। এই পাঁচজনই ২০১৬ ও ২০১৭ সালের বিভিন্ন সময় গুমের শিকার হন। জীবন নিয়ে ফিরে আসা এই মানুষগুলো বলেছেন, গুম হওয়ার চেয়ে তাঁদের কাছে কারাবাস ভালো।

গুমের শিকার ব্যক্তিদের কথা 

প্রথমে যাঁর কথা বলা হলো তিনি গাড়ির ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর চোখ খুললে এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, কিছু খেতে চান কি না। এরপর জেরা শুরু হয়। বাসস্থান, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, পরিবার, মুঠোফোনের অ্যাপস, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাতায়াত, বন্ধুবান্ধব, আওয়ামী লীগ-জামায়াত-জঙ্গিগোষ্ঠীর তুলনামূলক বিচার নিয়ে প্রশ্ন করেন তাঁরা। কিছুতেই তিনি প্রশ্নকর্তাদের সন্তুষ্ট করতে পারছিলেন না। বারবারই তাঁর মনে হয়েছে চোখে চোখ রেখে একবার কথা বলতে পারলে হয়তো অপহরণকারীদের বোঝাতে পারতেন। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি, ছয় মাসের বেশি সময় তাঁর চোখ আর হাত বাঁধা ছিল। শুধু যেদিন মাছ খেতে দেওয়া হতো, সেদিন বাঁধনটা একটু আলগা করে দেওয়া হতো। অনেক দূরে কোথাও তিনি টিমটিমে একটা বাতি জ্বলতে দেখেছিলেন। শুতেন কোথায়, কী খেতেন? খাওয়াদাওয়া ভালো ছিল, থাকতেন ছোট্ট একটা অন্ধকার কক্ষে, শুতে দেওয়া হয়েছিল মেঝেতে কম্বল পেতে।

যাঁরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন, তাঁদের খুব চৌকস মনে হয়েছে। ছাড়া পাওয়ার প্রক্রিয়াটা কেমন ছিল? জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটা পর্যায়ে জেরা কমে আসে। মাঝেমধ্যে তিনি চিৎকার করে জানতে চাইতেন তাঁর অপরাধটা কী? বেশির ভাগ সময় কোনো জবাব তিনি পেতেন না। মাঝেমধ্যে কেউ কেউ এসে চুপ করতে বলতেন। একদিন কেউ একজন এসে তাঁকে জানান, ওই জায়গা থেকে তাঁকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হবে। গাড়িতে ওঠার পর বেশ লম্বা একটা ভ্রমণের পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। যাত্রাপথে শুধু গাড়িচালককে দিকনির্দেশনা দিতে শুনেছেন তিনি, লেফট ও রাইট।


গুম তো একরকম কারাবাস, এমন প্রশ্নের জবাবে একজন বলেছেন, ‘গুম হয়ে থাকার চেয়ে ১৪ বছর জেলে থাকা ভালো। অন্তত জানতে তো পারলাম আমি কোথায় আছি, কেন আছি। আমার চোখটা তো খোলা থাকছে, হাত দুটোও। আমার জীবনের অনেক দিন কোথায় পার হয়ে গেল, আমি জানলামও না।’

এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি 

অজ্ঞাতবাস থেকে ফিরে এসে চিকিৎসা নিতে হয়েছে কাউকে কাউকে। একজন বলেছেন, বছরখানেক আগে কয়েক মাস গুম থাকার পর তাঁর আত্মীয়বাড়ি ফেরেন। তিনি আর আগের মতো কথা বলেন না। তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর আটকে রাখা হয়েছিল কয়েক মাস। বারবার একই প্রশ্ন করে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল অপহরণকারীরা। তাঁরও চোখ ও হাত বাঁধা ছিল। তবে মারধর করেনি কেউ। ফিরে আসার পর তাঁর প্রথম যে সমস্যাটা হলো তা হলো অনেক দিন চোখ বাঁধা থাকায় তাঁর ফটোফোবিয়া হয়ে গিয়েছিল। বর্ণগুলো বড় করে লিখে দিলে পড়তে পারতেন। সারাক্ষণ অস্থির থাকতেন, ভয় পেতেন। এখনো তিনি বাড়ির বাইরে বের হন না। তাঁর কোনো বন্ধুবান্ধব নেই। তিনি যে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন, তাঁর কাছে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে গুম হওয়া আরও এক ব্যক্তি আসতেন। তিনি গুম হয়েছিলেন মাত্র কয়েক দিনের জন্য। তবে সেই কয়েক দিনের অভিজ্ঞতা তাঁর ঘুম কেড়ে নিয়েছে।

কাছাকাছি সময়ে ঢাকা থেকেই নিখোঁজ হওয়া আরেক ব্যক্তিও ভুগছেন একই সমস্যায়। তিনি বলছিলেন, তাঁকে অপহরণের পর একটি ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছিল। এখন দলবল ছাড়া বাসা থেকে বের হন না। লাইসেন্স করা অস্ত্র নিয়ে চলেন।

আলোচিত যাঁরা এখনো নিখোঁজ 

২০১০ সালে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং সাবেক ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর চৌধুরী আলম গুম হন। পরের বছরগুলোও রাজনৈতিক নেতাদের গুম হওয়ার বিষয়টি অব্যাহত থাকে। ২০১২ সালে গুম হন বিএনপির সাবেক সাংসদ ইলিয়াস আলী। এখনো নিখোঁজ আছেন যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আজমি ও যুদ্ধাপরাধের দায়ের ফাঁসি হওয়া জামায়াত নেতা মীর কাশিম আলীর ছেলে মীর আহমেদ বিন কাশিম।

তবে গুমের শিকার হওয়া কিংবা অজ্ঞাতবাস থেকে ফিরে আসা মানুষের তালিকায় এখন আর শুধু রাজনৈতিক নেতারা নন, আছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, আইনজীবী, সরকারদলীয় জনপ্রতিনিধিরাও। পরিবারগুলো আছেন তাঁদের ফিরে আসার অপেক্ষায়।

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ আগস্ট ৩০,২০১৮