সম্পাদকীয়
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি যেন এক অপ্রতিকার্য সমস্যা হিসেবে স্থায়িত্ব লাভ করেছে। এত বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, দাবিদাওয়া, সুপারিশ, পরামর্শ, আইন সংশোধন সত্ত্বেও সড়কে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হলো না। সরকারের যেসব সংস্থার এ বিষয়ে অনেক কাজ করার আছে, তারা যেন তাদের দায়িত্ব ভুলে গেছে। কিংবা তারা ধরেই নিয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ করার ব্যাপারে তাদের কিছু করার নেই।
গত রোববার ভোরে কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলায় যে যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে ২ জন নিহত ও ২৫ জন আহত হয়েছেন, সেই বাসের চালক তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলেন বলেই যে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, তা ওই চালকের সহকারীর বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়। এর পরের ২৪ ঘণ্টায় দুই ছাত্রসহ সাত জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে নয়জনের। বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষায় বলা হয়, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য যেসব কারণ দায়ী, সেগুলোর মধ্যে এক নম্বরে আছে চালকদের বেপরোয়া ও দায়িত্বহীন যান চালানো। কুষ্টিয়ার এই ঘটনায় চালক চোখে ঘুম নিয়ে বাসটি চালাচ্ছিলেন—এটাকে তাঁর বেপরোয়া আচরণ বলা না গেলেও দায়িত্বহীন আচরণ অবশ্যই বলতে হবে। কারণ, তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় বাস চালানো আইনত নিষিদ্ধ। এই আইন যদি তাঁর জানা না-ও থেকে থাকে, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানেই তাঁর বোঝার কথা যে কাজটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ: অনেক মানুষের প্রাণ হাতে নিয়ে তিনি গাড়ি চালাচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, এভাবে তাঁকে নিজের জীবনটিও হারাতে হতে পারে।
বেপরোয়া যানবাহন চালানো বন্ধ করতে চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি সংগত কারণেই অত্যন্ত প্রবল। তবে যেসব চালক ইচ্ছা করে বেপরোয়াভাবে যান চালান না, তাঁদের দ্বারাও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, যদি তাঁদের শারীরিক অবস্থা যানবাহন চালানোর উপযোগী না থাকে। বিশেষভাবে যেসব চালক রাতের বেলা যানবাহন চালান, তাঁরা যদি পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়ার অবকাশ না পান, তাহলে তাঁদের দ্বারা দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু যানবাহনের মালিকেরা এবং চালকেরা নিজেরাও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন না। অনেক চালক বেশি আয় করার জন্য তাঁর স্বাভাবিক শারীরিক সামর্থ্যের কথা না ভেবে, পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিয়ে রাতের পর রাত যানবাহন চালান। এ বিষয়ে আইনি নির্দেশনা হলো, কোনো চালক দিনে টানা আট ঘণ্টার বেশি যান চালাতে পারবেন না। কিন্তু এটা মেনে চলা হয় না, দূরপাল্লার অনেক যানবাহনের চালক টানা ১৬, এমনকি ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত যান চালান। বিশেষত দুই ঈদের সময় এই প্রবণতা বেড়ে যায়।
কিন্তু শুধু চোখে ঘুম নিয়ে যান চালানোর জন্যই নয়, আরও অনেক কারণে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। গত রোববার ১৩ ঘণ্টায় দেশের ৭টি জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ১৬ জন মানুষ। প্রথম আলোর হিসাবে গত ৬৪১ দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫ হাজার ৬৪৫ জন। এই সব অপমৃত্যু অনিবার্য ছিল না, সড়ক দুর্ঘটনা কোনো প্রাকৃতিক দুর্ঘটনাও নয় যে এ বিষয়ে মানুষের কিছু করার নেই। বিশেষজ্ঞরা সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো চিহ্নিত করেছেন, কী কী উপায়ে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব, সে বিষয়েও তাঁদের অনেক সুপারিশ আছে। কিন্তু বিআরটিএ, ট্রাফিক পুলিশসহ সরকারি যেসব সংস্থার ওই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করার কথা, তারা এ বিষয়ে ফলপ্রসূ কিছু করে না। চালকদের ভুয়া লাইসেন্স দেওয়া কমেনি, চলাচলের অনুপযোগী যানবাহনগুলো সড়ক-মহাসড়ক থেকে তুলে নেওয়ার কোনো পদক্ষেপ নেই। চালকের দোষে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি ঘটলে সেই চালকের বিরুদ্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত করা হয় রাজনৈতিক প্রভাবে।
কিন্তু এভাবে অনন্তকাল চলতে দেওয়া যায় না। এই নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই?
- কার্টসিঃ প্রথম আল/নভেম্বর ২৮,২০১৮