Search

Wednesday, September 11, 2019

চাঁদাবাজির দেশ

ড. আবদুল লতিফ মাসুম


মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান একবার বলেছিলেন, এটা বাজিকরের দেশ। বাজিকর বলতে তিনি চাঁদাবাজ, দলবাজ, রংবাজ, ধান্ধাবাজ, চালবাজ ইত্যাদি, হরেক রকমের ‘বাজিকর’দের বুঝিয়েছেন। এটি একটি অপ্রিয় সত্য যে, মূলত আমরা চাঁদাবাজ নিয়ন্ত্রিত সমাজ ও রাষ্ট্রে বসবাস করছি। ঘর থেকে বাইরে পা ফেলার পর থেকেই আপনাকে বিভিন্ন রকমের চাঁদাবাজির মোকাবেলা করতে হয়। কোথাও যাবেন, নিজ গাড়িতে অথবা বাসে, পথে পথে আটকাবে পুলিশ। আরো আছে টোলের নামে সরকারি চাঁদাবাজি। চাকরি চাইবেন? ব্যক্তি ও দলকে ‘চাঁদা’ দিতে হবে। ব্যবসা করতে চান? সিন্ডিকেট আছে। চাঁদা দিতে হবে ওদের। ভালো স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করাবেন? সেখানেও লিখিত-অলিখিত চাঁদাবাজি চলছে। খাবার কিনবেন বা খাবেন? সেখানেও ভ্যাট নামক আইনসিদ্ধ ‘চাঁদাবাজি’। হাসপাতালে রোগী ভর্তি করাবেন? আছে চাঁদাবাজির জন্য ‘দালাল’। এসব প্রশ্নের সমর্থনে টিভি চ্যানেলে এবং সংবাদপত্রে প্রতিদিন প্রতিবেদন দেখতে পাচ্ছেন।

সংবাদপত্র থেকে সাম্প্রতিক কিছু খবরের নমুনা দেয়া হলো। 

এলেঙ্গা হাইওয়েতে পুলিশের ব্যাপক চাঁদাবাজি 
(২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ : ইত্তেফাক)। 
চাঁদাবাজি করেই ওরা গাড়ি বাড়ির মালিক 
(সেপ্টেম্বর ০১, ২০১৯ : জনকণ্ঠ)। 
চাঁদাবাজি যে গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা : গ্রেফতার ৯ 
(১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ : ভোরের কাগজ)। 
আজমেরী ওসমানের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা, দুইজনের রিমান্ড আবেদন 
(৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ : নিউজ নারায়ণগঞ্জ)।
চাঁদাবাজি মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান 
(২২ আগস্ট ২০১৯ : জাগো নিউজ ২৪.কম)। 
নাটোরে নিষিদ্ধ থ্রি হুইলার থেকে যুবলীগ নেতার চাঁদাবাজি 
(৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ : বাংলাদেশের খবর)। 
শেরপুর-জামালপুরের মতো প্রতিটি জেলায় এখন পথে পথে হচ্ছে চাঁদাবাজি। ছাতকে চাঁদাবাজি নিয়ে দু’পক্ষের সংঘর্ষে নিহত ১, ওসিসহ আহত ৫০ 
(১৫ মে, ২০১৯ : সিলেট ভিউ.২৪কম)। 
শৈলকুপা পৌরমেয়রের চাঁদাবাজি বন্ধে বিক্ষোভ 
(৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ : দেশ সংবাদ)। 
বরগুনার অপরাধচক্র ০০৭ বন্ড গ্রুপ 
(৭ জুলাই ২০১৯ : ডেইলি স্টার)। 
ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয়ে সোর্সের চাঁদাবাজি, জনতার ধাওয়া, পালাল দুই এএসআই
 (১৭ আগস্ট ২০১৯ : আওয়াজ বিডি.কম)। 
সীতাকুণ্ড চাঁদার টাকার ভাগ নিয়ে বিরোধে যুবক খুন 
(৩০ আগস্ট ২০১৯ : যুগান্তর)। 
সাঁথিয়ায় ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনি, নিহত ২ 
(৭ আগস্ট ২০১৯ : ইত্তেফাক)। 
মদনপুরে বেপোরোয়া খলিল-কাবিলা বাহিনী 
(৩ সেপ্টেম্বর : ডান্ডিবার্তা)। 
রাস্তায় নয়, অফিসেই চাঁদা নিতে চান এনায়েত উল্যাহ 
(১৫ এপ্রিল ২০১৯ : চ্যানেল আই)। 
শরীয়তপুর-চাঁদপুর ফেরিঘাটে গাড়ি পারাপারে চাঁদাবাজির অভিযোগ 
(১৪ মে ২০১৯ : বাংলাট্রিবিউন.কম)। 
পাহাড়ে বন্ধ হচ্ছে না খুন-সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি। এক বছরে ৪৫ খুন অপহরণ অর্ধশত 
(১১ নভেম্বর ২০১৮ : ইনকিলাব)।
ভাগ-ভাটোয়ারা নিয়ে বিরোধ, সীতাকুণ্ডে যুবক খুন
(৩০ আগস্ট ২০১৯ : বাংলাদেশ মেইল.নিউজ)।
জকিগঞ্জে চাঁদাবাজ সালামকে চার্জশিট থেকে বাঁচাতে পুলিশের পাঁয়তারা! 
(২৩ আগস্ট ২০১৯ : সাপ্তাহিক ক্রাইম সিলেট)।

এসব সংবাদ পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে, কিভাবে চাঁদাবাজি আমাদের সমাজের গহিন গভীরে বাসা বেঁধেছে। পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ সবচেয়ে ব্যাপক। বোঝা যায়, কিভাবে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা চাঁদাবাজির মাধ্যমে আঙুল ফুলে শুধু কলাগাছ নয়, তালগাছ হয়ে গেছে। তারা চাঁদাবাজি করেই গাড়ি-বাড়ির মালিক। এই তো সেদিন যাদের দুবেলা ভাত জুটত না, আমাদের চোখের সামনেই গত এক দশকে তারা এখন গাঁও-গেরামে দালান-কোঠা তুলেছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাঁদাবাজিকে তারা পেশা হিসেবে নিয়েছে। এর উদাহরণ রাজধানীতে আরো স্পষ্ট। রাজধানীর সব ফুটপাথে ‘হকার্স মার্কেট’ বসিয়ে চাঁদাবাজি করে মোটা অঙ্কের আয় করছে তারা। একেক জায়গায় একেকজন চাঁদাবাজ গডফাদারের আবির্ভাব ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জে গডফাদার কী ভাষায় প্রশাসনকে শাসিয়েছে, গত সপ্তাহের পত্র-পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়েছে। আজমেরী তার ভাইয়ের ছেলে। তাকে চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাই এখন আস্ফালন। স্থানীয় পর্যায়ের নেতা চেয়ারম্যান, মেম্বারদের নানা কারসাজিতে চাঁদাবাজির বিষয়টি এ দেশে অনেক পুরনো। রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা স্থানীয় পর্যায়ে যেন ভদ্রতার আবরণ ছুড়ে ফেলেছেন। এখন তারা চৌকিদার কিংবা ঝাড়–দার থেকেও নাকি ঘুষ নেন। সেখানে চাঁদাবাজির নতুন এক কৌশল অবলম্বন করছেন স্থানীয় নেতারা। বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের হামলা ও মামলা দিয়ে বাড়ি ছাড়া করছেন তারা। তবে মোটা অঙ্কের চাঁদার বিনিময়ে রেহাই পাচ্ছেন কেউ কেউ। গত বছর নির্বাচনের আগে ও পরে গায়েবি বা আজগুবি মামলার ঘটনা সবারই জানা। চাঁদা না দিলে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের সহায় সম্পত্তি, জমি, ঘের-মৎস্য খামার দখল করে নিচ্ছেন শাসক দলের নেতাকর্মীরা। চাঁদাবাজির বড় একটি শিকার প্রবাসীরা। বিমানবন্দর থেকে তাদের ওপর চাঁদাবাজি শুরু। হয়তো ভেবেছেন, ঘরে ফিরলে রেহাই পাবেন তারা। কিন্তু সেখানেও চাঁদাবাজদের হানা। দলীয় চাঁদাবাজদের হামলায় কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটেছে অতি সম্প্রতি। পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি সবচেয়ে ব্যাপক এবং ওপেন সিক্রেট। পথে পথে ঘাটে ঘাটে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পকেটে গুঁজে নিচ্ছে পুলিশ। ড্রাইভার থেকে মালিক পর্যন্ত চাঁদাবাজির চ্যানেল সম্প্রসারিত। চাঁদাবাজি নিয়ে দুপক্ষের সংঘর্ষে প্রায়ই হতাহতের ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে শাসকদলের দুটো সংগঠনে এর ব্যাপকতা ভয়ঙ্কর-ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। এদিক দিয়ে ছাত্রলীগ এতটা ‘সুনাম’ কুড়িয়েছে যে, তাদের প্রধান উপদেষ্টা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিদারুণ নাখোশ হয়েছেন। চাঁদাবাজিতে মানুষ এত বেশি ক্ষুব্ধ যে, গণপিটুনিতে তারা প্রাণ হারাচ্ছে। বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে চাঁদাবাজি নিয়ে আধিপত্যের চলছে লড়াই। অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে পাল্টাপাল্টি গ্রুপিং এবং খুনের ঘটনা ঘটছে। এসব নিয়ে মামলা মোকদ্দমা হচ্ছে না, তা নয়। তবে পুলিশের সহযোগিতায় আইনের ফাঁকফোকড়ে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে অনেকে।

এসব হলো বেসরকারি চাঁদাবাজির গল্প। অতি সাম্প্রতিককালে সরকারি চাঁদাবাজিও প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শাসক দলের লুটপাটে রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য হতে চলেছে। আর্থিক সঙ্কট মেটাতে বিভিন্ন উৎস থেকে বিপুল ঋণ নিচ্ছে সরকার। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও ব্যয় নির্বাহ করতে সরকার অন্যান্য উৎস থেকেও অর্থের জোগান খুঁজছে হন্যে হয়ে। গত বছরে ৬৮টি সরকারি প্রতিষ্ঠান মুনাফা করেছে। আর লোকসান দিয়েছে ২০টি। এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনব্যয় মেটানোর পরে বাড়তি টাকার পরিমাণ দুই লাখ ১২ হাজার ১০০ কোটি। এই টাকা বিভিন্ন ব্যাংকে ‘ফিক্সড ডিপোজিট’ হিসেবে জমা আছে। সব টাকা পয়সা ‘ফতুর’ করার পর সরকারের এবার নজর পড়েছে এই অর্থের ওপর। এসব সরকারি স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের টাকা নিয়ে নেয়ার বুদ্ধি এঁটেছে সরকার। উন্নয়নের নামে প্রায় অচল হয়ে পড়া রাষ্ট্রীয় কোষাগারে এই অর্থ জমা দেয়ার আইন করছে সরকার। এবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে এ জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। নতুন এই আইন অনুযায়ী আপৎকালীন ব্যয় নির্বাহের জন্য পরিচালন ব্যয়ের সাথে এর আরো ২৫ শতাংশ অর্থ এসব সংস্থা সংরক্ষণ করতে পারবে। ওই সংস্থার কর্মীদের পেনশন বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থও তারা সংরক্ষণ করবেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের ২১ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা, পেট্রোবাংলার ১৮ হাজার ২০৪ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ১৩ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ৯ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউকের চার হাজার ৩০ কোটি টাকা এখন সরকার আইনানুগভাবেই নিয়ে নিতে পারবে।

উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং ব্যয় নির্বাহ করতে ব্যাংক থেকে ব্যাপক ঋণ গ্রহণ করেছে সরকার। বাজেট ঘাটতি মেটাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা সরকার গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থ বছরের প্রথম ৩৯ দিনে ২৩ হাজার ৭৬১ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ সরকার নিয়ে ফেলেছে। এটি নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকের চেয়েও বেশি। এদিকে, সরকারকে এ ঋণের জোগান দিতে গিয়ে ব্যাংকগুলো বিপাকে পড়েছে।



ব্যাংকিংখাতে অবাধ লুটপাটে জনগণের আস্থা হ্রাস পেয়েছে। উঠতি ধনিকশ্রেণী সরকারের আনুকূল্যে অযাচিত ও অন্যায় ঋণ গ্রহণ করছে। ব্যাংক খাতে তাই আমানত কমে গেছে। অন্যদিকে, ঋণ প্রবাহ বেড়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার ঘাটতি শুরু হয়েছে। অপরদিকে, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ছিল তিন লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে গড় হিসাবে তিন লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা আদায় করা যাবে বলে সরকার আশা করছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ধার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংক থেকে এ ধরনের অর্থ গ্রহণ সরকারের একপ্রকার দেউলিয়া হওয়ার লক্ষণ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা। এটি বাংলাদেশের গত ৪৮ বছরের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।

সরকারি অর্থ আয়ত্তাধীন করার পরও বর্তমান সরকারের যেন খায়েশ মিটছে না। সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় তথা পরিবহন খাতে যখন ব্যাপক লুটপাট চলছে, তখন সরকার জাতীয় মহাসড়কে আইনসম্মত চাঁদাবাজির ব্যবস্থা পাকাপাকি করে ফেলছে। বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোতে গাড়ি চলাচলের ক্ষেত্রে টোল নেয়ার নিয়ম চালু করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি একনেকের সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বাংলাদেশে সেতু পারাপার আর কোনো কোনো উড়াল সড়ক ব্যবহারের ক্ষেত্রে টোল আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সড়ক ও জনপদে বিভিন্ন কায়দায় টোল আদায় করা হচ্ছে; কখনো সড়ক কর্তৃপক্ষের নামে, আবার কখনো বা পরিবহন সমিতির নামে অথবা জনকল্যাণের নামে। একনেকের সভার নির্দেশনার পর সড়ক ও জনপথ অধিদফতর সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান প্রণয়ন করছে। অবশ্য এতে জনগণের দুর্ভোগ আরো বাড়বে। কারণ যখনই কোনো কর ধার্য করা হয়, ব্যবসায়িক মহল প্রকারান্তরে তা সাধারণ মানুষের ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে দেয়। রাজনৈতিক দলগুলো মহাসড়কে টোল আদায়ের প্রস্তাব প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছে। জনসাধারণ আশা করে, সরকার জনস্বার্থে প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করা নেবে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাঁদাবাজি জনসাধারণের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। সরকার যত শিগগিরই বিষয়টি অনুধাবন করবে, ততই জনগণের মঙ্গল। 

  • লেখক অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। 
  •  কার্টসি —  নয়াদিগন্ত /সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৯। 

NRC in Assam: What Happened? What’s Next?

Ali Riaz


People check their names after the publication of the final list of the National Register of Citizens (NRC) at a roadside shop in Pavakati village of Morigoan district on August 31, 2019. Photo: AFP

The bizarre phenomenon called updating the National Registry of Citizens (NRC) in Assam, completed under the auspices of the Indian central government with direct supervision of the Indian Supreme Court, which made 1.9 million people stateless citizens, has engendered strange events to date and indicates the likelihood of stranger episodes in the coming months. Since the culmination of a four-year process with the publication of the final list on 31 August, not only did those who have been excluded became devastated, but also the progenitors of this controversial task are now dissatisfied with the outcome but for a different reason.

Although the genesis of the crisis is well known, it is necessary to recall as many of the current features of the crisis and the possible trajectories shaped by it. The issue of updating the 1951 National Register of Citizens (NRC) came to the fore in in the six-year long agitation by All Assam Students Union beginning in 1979 which demanded the “identification and deportation of illegal immigrants” from Assam. The expression “illegal immigrant” was a clear reference to Bangla speaking people, alleging that they have “migrated” from Bangladesh. The movement, initially billed as against the “outsider”, was transformed into a movement against “foreigners”. Massacres throughout the period, particularly in 1983, of Bangla speaking Muslims who have lived for generations, were neither spontaneous nor sporadic, but instead were well planned and brutally executed; in some cases, plans were hatched for months.

While the All Assam Students Union (AASU) and the All Assam Gana Sangram Parishad (AAGSP), were at the forefront, the All Assam Volunteers Force (AAVF) was a key actor in the agitation and violence. There were allegations that the AAVF was acting on behalf of or was at least connected to the RSS. Besides, by the admission of the RSS ideologues Rajat Sethi and Shubhrastha, (The Last Battle of Saraighat: The Story of the BJP’s Rise in the North-east, 2017), the RSS had established its branches all over the Assam by 1975 and the “selfless service by swayamsevaks from all across the country” was instrumental in building the organisation. As such, the tone, tenor and contour of the agitation had the marks of RSS’s long-term agenda. Therefore, it is not surprising that the BJP, as it became stronger all around the country and had its eyes set in the northeast, weaponised the issue of citizenship in the 2000s.

The Assam Accord, signed in 1985 with then Prime Minister Rajiv Gandhi, remained on paper until the Supreme Court in 2013 pushed it to the politicians’ court. The BJP’s initial slow move, which the BJP supporters are now trying to portray as the BJP’s reluctance, was not because it was less enthusiastic, but instead it was preparing the ground for a larger gain—tying it up with its national anti-Muslim agenda and xenophobic exclusionary jingoism that has permeated the Indian society in the past decade. Day by day the ground was prepared in Assam and nationally, by the Assam Gana Parishad (AGP), the legatee of the so-called anti-foreigners’ movement, and the BJP, the product of the RSS, respectively.

With the interjection of the Supreme Court, various institutional actors, such as the bureaucracy, became entangled in the politics of identity in a highly polarised society where religion has been pushed by Sangh Parivar as the principal marker. The exercise no longer remained about who is or who is not a citizen in the legal term, but what constitutes citizenship, who determines the citizenship and how the discourse of citizenship is framed, propagated and consumed. The implication of this exercise will neither be limited to Assam—as the BJP has already demanded NRC in other states; nor will it be restricted to the outcome of the “appeal process” in Assam, for it has already shaped the discursive terrain of citizenship. Who among the 1.9 million, now being referred to the Foreigners Tribunal, escape the disenfranchisement, is important from the humanitarian point of view and in legal terms, but how politics of religiously informed identity becomes the essential part of being Indian is the more important issue with larger ramifications. That is what the NRC debate and the list have achieved.

Of course, the BJP’s claim that Assam is inundated by millions of “infiltrators” and “termites”—in other words Bangladeshis—who need to be thrown out, has not been validated; even the initial list of 4 million—a figure which was close to the BJP and AGP propaganda—tuned out to be grossly inaccurate. In equal measure, the expectation that the list will contain overwhelming numbers of Muslims, has not come true. Instead the majority, according to some account 60 percent, are Bangla speaking Hindus. There are also many people of Nepali origin, despite living in Assam for decades and generations, excluded. Those who are taking comfort in this information and arguing that the BJP has lost the game, should be careful as to whether this argument will feed into the BJP propaganda and eventually help similar exercises in other states. The inherent bias of the exercise against Muslims can’t be ignored because the list has a smaller number of them. Throughout the process of NRC, BJP and its ilk had made it amply clear that Muslims are the “enemy” who will be identified. This is not isolated from the lynching of Muslims in the name of cow protection, and the activities in Kashmir. Additionally, if we juxtapose this with the previously proposed 2016 Citizenship (Amendment) Bill, which promises to offer citizenship to all except the Muslims, there is no scope for doubt as to the content of the BJP agenda.

Since publication of the draft list and more so after the final list, the BJP and its ilk are crying foul and demanding rectification. The bizarre development is that one of the principal backers of the NRC in Assam has called for a general strike and threatening to launch agitations. There seems to be consensus among political parties—from the BJP to Congress to TMC—that the NRC list, which cost 1300 crore Indian rupees, is unacceptable. Notwithstanding the political objective of the NRC process, one can say without the hesitation that it has been bungled up. Assam’s finance minister, Himanta Biswas Sarma, a vocal supporter of NRC has spewed anti-immigrant venom, and claimed in August 2018 that legacy papers—those which prove longstanding residency of the inhabitants—have been “managed”, rendering the process of updating the NRC ineffective. But there is no reason to expect that the NRC will be scrapped altogether.

What comes next?

Those who are not listed can appeal to the Foreigners Tribunal (FT) in the next 120 days, and later seek redress from the court of law. According to media reports, Assam has 100 Foreigners Tribunals, 221 more are to be set up in all districts soon, and eventually the number will be about 500. But there are reasons to be concerned about the process itself. The discrepancy between the draft list and the final list clearly points to an inefficient bureaucracy. It took almost a year for it to sort out some of the mess. Will the FTs be another example of the incompetence? Can an issue which is fraught with political overtone be addressed fairly by a state appointed institution? There are logistical questions, can such a huge number of applications be dealt with in such short time?  Will the poor people have the resources to pursue the process, especially those whose appeal will fail in the FT process?

The Indian government clearly said that until the legal process is exhausted nobody will be considered as a foreigner, and that pushing them back to Bangladesh is not on the table. But there is no clear direction as to what will happen thereafter. The news that new detention centres are being built does not send a positive message to those who are to be disenfranchised. In June the press reported that the state government was preparing to build ten more detention centres in addition to six it already has. During the negotiations between the Congress-led central government and the agitators, leading to the Assam Accord in 1985, one suggestion was to resettle those who will be deemed “outsider” to other states, under the auspices of the central government. The proposal didn’t make into the 1985 Accord. That seems to be not in the mind of the central government at this point.

The logistical issues aside, despite the debacles of the process, the belligerent rhetoric of the Sangh Parivar hasn’t subsided. Therefore, what is most likely to happen in the coming months is the enactment of the Citizenship (amendment) Bill. The implication of this requires no elaboration—religion as the principal marker of Indian citizenship will be enshrined in the constitution, forever.



  • The writer is a Distinguished Professor of Political Science at Illinois State University, USA.
  • Courtesy — The Daily Star/ Sep 8, 2019.


নির্ভরতা ও জবাবদিহির অন্তরালে


সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
আলোচ্য বিষয়ে কয়েকদিন আগে এই কলামেই লিখেছিলাম। আজকের লেখাটি বলা যায় এরই পরবর্তী ধাপ। জবাবদিহিবিহীন ক্ষমতা যে কতটা দুরন্ত হতে পারে, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল নারায়ণগঞ্জে কর্তব্য পালনরত র‌্যাবের একটি ইউনিটের আচরণে। একসঙ্গে সাতজন মানুষকে তারা নিজ হাতে মেরে নদীতে নিয়ে ফেলে দিয়েছিল। লাশগুলো বেয়াদপি করেছে, ভেসে উঠেছে, নইলে গোটা ঘটনাটিই ডুবে যেত, হয়তো আর খবরই পাওয়া যেত না। নিহতদের মধ্যে ঘটনাক্রমে একজন আইনজীবীও ছিলেন, যার জন্য অন্য আইনজীবীরা হৈচৈ করেছেন; লাশগুলোর ভাসমান অস্তিত্বের সঙ্গে ওইসব ধ্বনি একত্র হয়ে বিচার দাবি করার দরুন নানা টালবাহানা সত্ত্বেও বিচার শেষ পর্যন্ত একটা হয়েছে, ফাঁসির হুকুম হয়েছে ২৬ জনের, যাদের অধিকাংশই র‌্যাবের সদস্য। র‌্যাব যে আক্রমণের মুখে আত্মরক্ষার জন্য মানুষগুলোকে খুন করেছে তা নয়; র‌্যাবের ওই ইউনিটটি ভাড়া খাটছিল মূল অপরাধীর হাতে। অর্থাৎ কি-না তারা পরিণত হয়েছিল ভাড়াটে খুনিত। ভাবা যায়? এই ইউনিটের কমান্ডার ছিলেন যিনি তার শ্বশুর আবার আওয়ামী লীগের একজন বড় নেতা ও সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী। ক্ষমতার এই চাপের নিচে পড়ে নিহত মানুষগুলোর পক্ষে বাঁচার কোনো উপায় ছিল না। তাঁরা বাঁচেননি। র‌্যাব বলেছিল, অপরাধটা বাহিনীর নয়, বিপথগামী কিছু সদস্যের। বলাটা স্বাভাবিক। তবে প্রশ্ন থেকে যায় বৈকি। এই বিপথগামীরা যে বিপথে ঘোরাফেরা করছিল, বাহিনী কি সেটা টের পায়নি? টের পেয়ে যদি নিবারণের পদক্ষেপ নিয়ে না থাকে, তবে সেটা যেমন বিচ্যুতি, জেনেও যদি না-জেনে থাকে, তবে সেটা আরও বড় বিচ্যুতি। দুটির কোনোটিই গ্রহণযোগ্য নয়।


সারাদেশের অপরাধীদের ওপর যারা চোখ রেখেছে, তারা যদি নিজেদের ঘরের অপরাধীদের খবর না রাখে, তবে ঘটনা তো রীতিমতো বিপজ্জনক। আর যখন দেখা যাচ্ছে যে, অপরাধ করার পরও তাদের বিরুদ্ধে বাহিনীর নিজের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তখন তো ব্যাপারটা সত্যি সত্যি আতঙ্কজনক। 

এত শক্তিশালী ও সুসজ্জিত একটি বাহিনীর সদস্যদের কেউ কেউ যদি ভাড়া খাটে, বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র ও লোকজনকে দুস্কর্মে ব্যবহার করে এবং পার পেয়ে যায়, তাহলে নাগরিকরা তাদের নিরাপত্তা কার কাছ থেকে আশা করবে? সময় সময় র‌্যাব যে নিতান্ত ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে, তার দৃষ্টান্তও বিরল নয়। ওই নারায়ণগঞ্জেই তো ঘটেছে নানা ঘটনা। মেধাবী কিশোর তানভীর মুহম্মদ ত্বকীকে হত্যা করেছে একদল দুর্বৃত্ত। বুকের ওপর চেপে বসে গলা চেপে ধরে মেরে ফেলে বস্তায় ভরে তাকেও ফেলে দেওয়া হয়েছিল ওই নদীতেই। ত্বকীর অসহায় লাশটিও ভেসে উঠেছিল। সে ঘটনা সারাদেশের মানুষ জানে। কাজটা কারা করেছে তাও প্রকাশ পেয়েছে। মামলা হয়েছে। তদন্ত এগোচ্ছিল না। অবশেষে হাইকোর্টের নির্দেশে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল র‌্যাবকে। অপরাধীদের র‌্যাব ঠিকই শনাক্ত করেছে। কী কারণে, কীভাবে, কোথায় ওই নৃশংস কাজটি করা হয়েছে, সে রহস্যও তারা জেনেছে। র‌্যাব তদন্ত রিপোর্ট সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশও করেছিল। কিন্তু আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করার যে অত্যাবশ্যকীয় কাজ সেটা আর করা হয়নি। অসমাপ্তই রয়ে গেছে। চতুর্দিক থেকে দাবি উঠেছে, একের পর এক সভা হয়েছে, মানববন্ধন, বিক্ষোভ, বিবৃতি প্রদান কিছুই বাকি থাকেনি। কিন্তু অপরাধীদের যে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, সেটা এখনও করা গেল না। অদৃশ্য হস্তক্ষেপের দরুনই হবে, র‌্যাব গুটিয়ে নিল নিজেকে। অদৃশ্য হস্ত অদ্যাবধি অনড়ই রয়েছে স্বীয় অবস্থানে। মনে হচ্ছে থাকবেও।

র‌্যাবের হাত শক্ত; কিন্তু তার চেয়েও শক্ত হাত আছে বৈকি। শক্ত ও মস্ত। র‌্যাবের তুলনায় পুলিশের কাজের বিস্তার অনেক বেশি। বাহিনীটিও বড়। পুলিশের বিশেষ তৎপরতা যে সরকারের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে দমন-পীড়নে নিয়োজিত থাকে, সে নিয়ে তো কোনো তর্ক নেই। প্রধান বিরোধী দলকে কোন কোন উপায়ে জনসভা করা থেকে নিবৃত্ত করা যাবে, সে নিয়ে উদ্ভাবনশক্তির অত্যাশ্চর্য প্রমাণ তারা দিয়ে থাকে; বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা সাজিয়ে কীভাবে রাজনৈতিক কাজ করা থেকে তাদের সরিয়ে রাখা যাবে, সে কর্তব্য পালনেও তাদের ঈর্ষণীয় দক্ষতা। জনগণের পক্ষ নিয়ে যারা আন্দোলন করেন, যেমন সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন, গ্যাস তেল বন্দর বিদ্যুৎ রক্ষার জন্য আন্দোলন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন, রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনবিরোধী আন্দোলন তাদেরকে কেমন করে পদে পদে বাধা দেওয়া যাবে, বিক্ষোভ তীব্র হওয়ার লক্ষণ দেখা দিলে কেমন করে লাঠি, টিয়ার গ্যাস, জলকামান ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে, সেসব ব্যাপারে পুলিশ বাহিনীর সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন তাদের নিকৃষ্টতম নিন্দুকেরাও তুলতে পারবে না। 





সাংবাদিক পেটানোতেও তারা অত্যন্ত পারঙ্গম। এ ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতা মনে হয় অহর্নিশ নিশপিশ করতে থাকে। নিশপিশানির ব্যাখ্যা অবশ্য আছে। সাংবাদিকরা কিছুটা বেয়াড়া মনে হয়। উল্টাপাল্টা লেখে, ছবি তোলে, সে ছবি কাগজে ছাপায়, টিভিতে দেখায়, মনে হয় ভয়ডর অফিসে জমা রেখে তবে পথে বের হয়েছে। সাংবাদিকতার পথটা আজও এখানে মসৃণ করা যায়নি। তাছাড়া সাংবাদিকরা এখন আর আগের মতো ঐক্যবদ্ধ নন, তাদের একটা অংশ (সেটাই বড়) সরকার সমর্থক, অন্য অংশটি সরকারবিরোধী। দুই অংশ যে একসঙ্গে রুখে দাঁড়াবে, বলবে একজন সাংবাদিকের গায়ে হাত দেওয়া মানেই সব সাংবাদিককে অপমান করা, সে কাজ আর করতে পারেন না। তবে পুলিশের ক্ষমতার আসল রহস্যটা রয়েছে সরকারের নেক নজর লাভপ্রসূত জবাবদিহির অভাবে। জবাবদিহির দায় আজ কারও নেই, বিশেষভাবে নেই পুলিশের। তবে পুলিশকে নানাদিকে যে চোখ রাখতে হয়, এটাও ঠিক। যেমন বইমেলার ওপর।





ধর্মীয় জঙ্গিরা তাদের অপছন্দের বই লেখার জন্য লেখক ড. অভিজিৎ রায়কে মেলার মধ্যেই হত্যা করেছিল। প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে তারা তার কার্যালয়ে গিয়ে জবাই করে এসেছে। পুলিশ নিরাপত্তা দিতে পারেনি। এমনকি অপরাধীদের যে শাস্তি দেবে তার ব্যবস্থাও করেনি। এর আগে ওই মেলা প্রাঙ্গণেই হুমায়ুন আজাদ আক্রান্ত হয়েছেন এবং পরে তিনি প্রাণত্যাগ করেছেন। খুনিরা নিরাপদে পালিয়ে গেছে, এখন পর্যন্ত তাদের শাস্তি হয়নি। পরের বছর মেলার আগেই মেট্রোপলিটন পুলিশ লেখকদের সতর্ক করে এক হুকুমনামা জারি করেছিল। এতে ঘাতকদের সতর্ক না করে, লেখকদেরই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, তারা যেন এমন কিছু না লেখেন, যা মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে। আঘাত করছে না করছে সেটার বিচার করবে কে? কেন করবে পুলিশ। তাদের গোয়েন্দারা মেলায় ঘোরাফেরা করছে, সন্দেহজনক কোনো কিছু দেখলে লেখকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ রকম ব্যবস্থার কথা অন্য কোনো দেশে তো নয়ই, খোদ আমাদের দেশেও ইতিপূর্বে শোনা যায়নি। অন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ পৃথিবীকে পথ দেখাতে সক্ষম হয়েছে; এবার মনে হয় এই নতুন ক্ষেত্রেও দেখাবে। কোথায় ধমকে দেবে জঙ্গিদের, উল্টো ভয় দেখাচ্ছে লেখকদের। ডাকাতকে না শাসিয়ে শাসানো হচ্ছে বিপন্ন গৃহস্থকে। ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কতদূর গড়াবে জানি না। তবে অনেকদূর গড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করারই কারণ রয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে পেনাল কোডের বিশেষ ধারা এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনের দোহাই দেওয়া হয়েছে। ওইসব আইনি ব্যবস্থা তো আছেই; আদালত রয়েছে, মামলা চলতে পারে। তাহলে আবার এই নতুন পদক্ষেপ কেন? পেছনে কি হেফাজতে ইসলামওয়ালাদের খুশি করার ইচ্ছা আছে? কে জানে! তবে এটা তো জানা আছে, সবারই যে পুলিশি হস্তক্ষেপ কখনোই সামান্য ব্যাপার নয়। গ্রেফতার, তারপরে রিমান্ড, রিমান্ড নিয়ে কেন লিখেছ, মতলবটা কী, কে মদদ দিয়েছে, এসব জরুরি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের কল্পনা লেখকদের জন্য মোটেই উৎসাহবর্ধক হবে না।

পেনাল কোডের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পেনাল কোড ব্রিটিশের তৈরি। পাকিস্তানি বিদায় হয়েছে, বাংলাদেশ কায়েম হয়েছে, ব্রিটিশের পেনাল কোড তবু আছে। কিন্তু এমনকি পেনাল কোডেরও তো বিভিন্ন জায়গাতে উল্লেখ আছে যে, পুলিশের দিক থেকে নির্যাতন করাটাই একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু লিপিবদ্ধ আইনের জগৎ আর কাজের জগৎ তো এক নয়; বিশেষ করে আমাদের প্রাণপ্রিয় এই বাংলাদেশে। ব্রিটিশ আমলে ভারতে নির্যাতন চালালে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে তাও দুয়েক সময়ে মৃদুমন্দ সমালোচনার শব্দ শোনা যেত, আমাদের নিজেদের পার্লামেন্টের সময় হয় না ওইসব দিকে তাকানোর। তাছাড়া পার্লামেন্ট তো প্রায়শই বিরোধীদলবিহীন অবস্থায়। এই যে এত রকমের এত সব দায়িত্ব পুলিশের, পরিশ্রম তো আছেই, ঝুঁকি রয়েছে, সমালোচনাও সহ্য করতে হয়। সম্প্রতি রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায় পুলিশের ওপর বোমা নিক্ষেপের ঘটনাটি তাদের ঝুঁকির বিষয়টাই তুলে ধরেছে। বিনিময়ে তাদের প্রাপ্তিটা কী? বেতন ভাতা? সে তো সবাই পায়। ঘুষ? সেটা বাহিনীর সবাই নেয় না, সবাই পায়ও না। সঙ্গতভাবেই তাই পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে সম্মান বৃদ্ধি, পদের উন্নয়ন, সুযোগ-সুবিধার সম্প্রসারণ ইত্যাদির দাবি উঠছে। বিশেষজ্ঞরা লক্ষ্য করেছেন, দাবিগুলোর প্রকৃতিতেও পরিবর্তন এসেছে। দাবিগুলো ছিল এই ধরনের : পদের উন্নয়ন, মোবাইল ফোনের টাকা, পোশাক ভাতা, চিকিৎসা সুবিধার সম্প্রসারণ, কম্পিউটার, যানবাহন ক্রয়ের জন্য বরাদ্দ, গাড়ি রিকুইজিশন করার অনুমতি, আবাসন সুবিধা বৃদ্ধি এবং বিদেশি দূতাবাসে নিয়োগ।

গত তিন বছর ধরে পুলিশ সপ্তাহ উদযাপনের সময় প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দাবি তোলা হচ্ছে, পুলিশ সুপারদের মোবাইল কোর্ট গঠনের এখতিয়ার দানের এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুলিশের জন্য স্বতন্ত্র একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠার, যেটির প্রধান আবার হবেন পুলিশ বাহিনীরই একজন সদস্য। উল্লেখ্য, পুলিশের আইজিকে সিনিয়র সচিবের সমান পদমর্যাদা দেওয়া হয়ে গেছে। ২০১৩ সালে পুলিশের হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইন নামে একটি আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। ২০১৫ সালে পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল যে, আইনটি সংশোধন করে এমন ব্যবস্থা রাখা চাই, যাতে ওই আইনের অধীনে কোনো নালিশ এলে পুলিশ নিজেই তার তদন্ত করতে পারবে। জাতীয় সংসদের একজন সদস্য সে আইনের একটি সংশোধনী উত্থাপন করতে চেয়েছেন, যাতে বলা হয়েছে যে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন বা মৃত্যু ঘটলে সংশ্নিষ্ট পুলিশের শাস্তি হবে। পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে এই সংশোধনীর আপত্তি জানানো হয়েছিল। সন্দেহ কী যে, আপত্তিটি গৃহীত হলে পুলিশের জবাবদিহির অভাবের মাত্রা এখন যেমন আছে তার চেয়ে বেড়ে যাবে। নতুন আইনটি তার কার্যকারিতা হারাবে। তাছাড়া জবাবদিহির ব্যাপারটা তো আইনের ব্যাপার যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি আইন প্রয়োগের ব্যাপারে।

বলা বাহুল্য, এসব দাবি ও আপত্তির ভিত্তিটা মোটেই আধ্যাত্মিক নয়, পুরোপুরি বৈষয়িক বটে। বৈষয়িক অন্তরালে কি রয়েছে পুলিশের ওপর সরকারের নির্ভরতা?

  • কার্টসি —  সমকাল / সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৯ । 

লজ্জার মৃত্যু ও উগান্ডান আদর্শ

ফারুক ওয়াসিফ


সব পর্দা আড়াল করে না। সব বালিশ হালকা না। আড়ালের বদলে কোনো কোনো পর্দা দুর্নীতির গুমর ফাঁস করে। কোনো কোনো বালিশ প্রকাশ করে লুটপাটের বিপুল ভার। কোথাও কোনো লজ্জা নেই। আমরা আকছার দুর্নীতি করে গিয়ে বলি, সরল বিশ্বাসে করেছি। কারণ, আমরা জেনে গেছি, ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে ‘সরল বিশ্বাসের’ দোহাই দেওয়া আছে। আমরা নির্মল বায়ু প্রকল্পে গুচ্ছ গুচ্ছ কর্মকর্তাকে বিদেশে ঘুরতে পাঠাই।

রাজধানীর দুই মেয়রই এখন বিদেশে। দক্ষিণের মেয়র গেছেন মশকনিধন শিখতে। কোথায় আবার, সিঙ্গাপুরে। অন্য মেয়র ইউরোপে মেয়রদের সম্মেলনে চলে গেছেন হুইলচেয়ারে বসে। যাত্রার আগের দিন কোনো কারণে পায়ে ব্যথা পাওয়ায় তাঁকে এই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। তবু বিদেশে তো যেতে হবেই, যা কিছু ভালো তা তো সব বিদেশেই।

এমনকি যে উগান্ডা নিরাপদ পানি প্রাপ্তিতে বাংলাদেশের চেয়ে দুর্দশায়, সেখানেও আমাদের পানির উন্নয়ন জানতে যাওয়া চাই। তাই নিরাপদ পানি প্রকল্পের খাতিরে ৪১ জন মিলে উগান্ডা দেশ ঘুরে আসি। বুঝলাম বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প, তারাই পাঠিয়েছে। গেলে যাবেন প্রকৌশলী-প্রশাসকেরা। অন্যদের সেখানে কী কাজ?

তাঁরা উগান্ডা সফর করে না এলে কি জানতে পারতাম, সেখানে নিরাপদ পানি পাওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের চেয়ে কম হলেও অন্য জিনিস ভালো? সেখানকার ওয়াসা যত্রতত্র সড়ক খুঁড়ে হাঁ করে রাখে না, রাস্তাঘাটও পরিষ্কার। এতেও যে আমাদের কর্তাদের বোধোদয় হবে, সে ভরসা কম। কারণ আর কিছু না, উগান্ডান কর্মকর্তাদের যা আছে, তা আমাদের নেই। সেই বস্তুর নাম হলো লজ্জা।

লজ্জাই নাকি সভ্যতা। লজ্জা ছাড়া মানুষ হিংস্র হতে পারে, বর্বর হতে পারে, অমানবিক হতে পারে। মানুষ নিজেও তা জানে। জানে মনের ভেতরের গোপন সব বাসনা ও প্ররোচনা তাকে কীভাবে লজ্জার কথা ভেবে সামলাতে হয়। সেই হিংস্রতা ও বর্বরতা সামাল দিতে তাই নৈতিকতা এসেছে, আইন এসেছে। সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে মানুষ। এসবের চাপে মানুষ নিজেকে সভ্য করে তুলেছে। বলা যায়, যতটা সভ্যতা ততটাই মানবিক হয়েছে তারা। যিনি অকাতরে মিথ্যা বলে যান, আপন–পর সবাইকে ধোঁকা দেন; তিনি কখনো মানবিক হতে পারেন না। লজ্জার মাথা না খেলে কেউ দেশ ও জাতির মাথা খাওয়ার চেষ্টা করতে পারে না।

বড়পুকুরিয়ার কয়লার পাহাড় থেকে শুরু করে বগুড়ায় সারের গোডাউন ভোজভাজির কায়দায় গায়েব হয়ে গেলেও কিছু হয় না। প্লাবনের মতো দুর্নীতি, তবু এক মন্ত্রী বললেন, এগুলো নাকি ছোট ব্যাপার। এসবই লজ্জার মৃত্যুর লক্ষণ। সাবেক এক অর্থমন্ত্রী হাজার কোটি টাকার ব্যাংক লোপাটকে মামুলি ব্যাপার বলে মনে শুধু করতেনই না, সাংবাদিকদের সামনে তা বলতেনও। তিনিই আবার অনিয়মের পথে শুল্কমুক্ত গাড়ির আবদার করে বসেন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও ডিন চিরকুট দিয়ে অবৈধভাবে ছাত্র ভর্তি করাচ্ছেন। আবার তিনিই দিবারাত্র নীতি–নৈতিকতার কথা প্রচার করে যাচ্ছেন। যে সাংসদ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হননি, তিনি সবক দিচ্ছেন গণতন্ত্রের।

লজ্জা গণতন্ত্রেরও শর্ত। জিল লক নামের এক আমেরিকান ভদ্রলোক Democracy and the Death of Shame (গণতন্ত্র ও লজ্জার মৃত্যু) নামে বই লিখেছেন। সমাজ থেকে লজ্জা উঠে গেছে বলে যখন মানুষ আহাজারি করে, তখন বুঝতে হবে যে জনতা অসন্তুষ্ট। মানুষ অনেক অপকর্ম করে না লজ্জার ভয়ে। আমরা জামাকাপড় পরা থেকে শুরু করে ভদ্রতা–শিষ্টতা চালিয়ে যাই লজ্জাবোধের জন্য। দুর্নীতি, অপরাধ, অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকে মানুষ যদি লজ্জা–ফ্যাক্টর কাজ করে মনে। এসব প্রকাশ পেলে লোকে কী বলবে, কেমন করে মানুষের সামনে দাঁড়াব, কেমন করে ছেলে–মেয়ে, মা–বাবা, স্ত্রী–স্বামীর মুখোমুখি হব—এসব চিন্তা যার মাথায় কাজ করে, তার পক্ষে লজ্জাকর কাজ করা কঠিন।

জনগণের ধিক্কারের ভয়ে রাজনীতিবিদেরা অনেক কিছু করেন না, করলেও চূড়ান্ত গোপনীয়তার সঙ্গে করেন। কিন্তু ট্রাম্পের মতো ভদ্রলোকের মুখে অনেক কথা আটকায় না দেখে বোঝা যায়, লজ্জাহীনেরা ক্ষমতার শীর্ষে উঠতে পারে আজকাল। পুরোনো প্রেমিকাকে তিনি ঘোড়ামুখো বলতে দ্বিধা করেন না। হরদম মিথ্যা বলেন, সকালের কথা বিকেলে অস্বীকার করেন। লজ্জা নামক জরুরি মানবিক বৈশিষ্ট্যটি না থাকায় এটা নিয়ে তাঁকে তেমন বেগ পেতে হয় না।

পশুপাখি মানুষের সামনে কোনো কিছু করতে লজ্জা পায় না। মানুষও পশুপাখিকে লজ্জা পেয়ে কোনো কিছু করা থেকে বিরত থেকেছে বলে শোনা যায় না। এ বিষয়ে মনে হয় গবেষণা করতে হতে পারে, তার জন্য প্রয়োজনে বিদেশেও যাওয়া লাগতে পারে যে, বাংলাদেশের শাসক–প্রশাসকেরা জনগণকে পশুপাখির স্তরে বলে মনে করেন কি না। সতেরো কোটি মানুষকে যদি তাঁরা মানুষ মনে করতেন, তাহলে অন্তত লজ্জা পেতেন।

ভয় হয়, ওপরতলার দেখাদেখি সমাজটাই নির্লজ্জ হয়ে ওঠে কি না। ভাবুন তো, কাল থেকে লজ্জা নামক জিনিসটা কোনো গায়েবি কারণে চলে গেল, চোখের পর্দা উঠে গেল! অবস্থাটা কল্পনা করুন আর ভাবুন প্রকৃতির সবচেয়ে হিংস্র ও লোভী প্রাণী মানুষ সে অবস্থায় কী কী করতে পারে! এবং তার কী কী আলামত ইতিমধ্যে আমাদের চারপাশে দেখা দিচ্ছে?

— লেখক সাংবাদিক।
  • কার্টসি —  প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৯। 

Monday, September 9, 2019

ব্যাংক নয়, তবে কি আস্থার জায়গা সিন্দুক?

রুমিন ফারহানা


অক্টোবর ২০১৮, একটি খবর নজর কাড়ল পুরো বিশ্বের। বিশ্ববিখ্যাত গাড়ি উৎপাদক টয়োটা বিনাশর্তে সারা বিশ্ব থেকে ফেরত নিল তাদের উৎপাদিত একটি বিশেষ মডেলের ২৪ লাখ গাড়ি। সমস্যা কী ছিল? এ ২৪ লাখ গাড়ির গ্রাহক কি টয়োটাকে বলেছিল গাড়ি ফেরত নিতে? একদম না। কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগেই গাড়ির ত্রুটি ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা দিয়ে ২৪ লাখ বিক্রি হওয়া গাড়ি বিনা বাক্যব্যয়ে ফেরত নেয় টয়োটা।

কারণ একটাই, এ ধরনের ত্রুটি তার ব্যবসার যে মূল পুঁজি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস সেই জায়গাটিতে আঘাত হানে। মানুষের বিশ্বাসের প্রতি এ শ্রদ্ধাবোধই তৈরি করে একেকটি ব্র্যান্ড। যে কারণে একটি পণ্যের অসংখ্য উৎপাদনকারী থাকার পরও দেখা যায়, মানুষ একই জিনিস কয়েকগুণ বেশি দাম দিয়ে একটি বিশেষ উৎপাদকের কাছ থেকে কিনছে। এর নাম ব্র্যান্ড ইমেইজ, যা তৈরি হয় দীর্ঘদিনের শ্রম, ঘাম আর সততায়।

প্রতিটি ব্যবসায় আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত হয় আরও নানা ধরনের পুঁজি। কিন্তু ব্যাংক এমন একটি ব্যবসা যার ভিত্তি মানুষের বিশ্বাস। সেই জায়গা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে যে কোনো ব্যাংক রাতারাতি ধসে পড়তে বাধ্য। কোনো এক সকালে একটি ব্যাংকের বেশিরভাগ গ্রাহক ব্যাংকে গিয়ে যদি তাদের সম্পূর্ণ আমানত তুলে ফেলতে যান, তাহলে দুর্বল ব্যাংকের কথা বাদই দিলাম, সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যাংকটিও দেউলিয়া হয়ে পড়বে। বাংলাদেশ ঠিক এমনই এক অবস্থার মুখোমুখি।

ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় একেবারেই শীর্ষে, এমনকি বিশ্বেও শীর্ষ পর্যায়ে। চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার প্রায় ১২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে যখন সারা বিশ্বে এ হার নিম্নমুখী; যা ২০১৭ সালে ৩.৪৪ শতাংশে নেমে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১০ সালে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছরের মার্চ শেষে এ হার ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশে ঠেকেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী কিছু দেশের খেলাপি ঋণের হার নেপাল ১.৭ শতাংশ, ভিয়েতনাম ০.৯ শতাংশ, শ্রীলংকা ৩.৪ শতাংশ, পাকিস্তান ৮.২ শতাংশ, ভারত ৯.৩ শতাংশ।

দেশের সব অর্থনীতিবিদ তো বটেই, সরকারসমর্থক অর্থনীতিবিদরাও ব্যাংকের লুটপাটকে এ দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিছুদিন আগে পত্রিকায় রিপোর্ট এসেছে অবলোপনকৃত ঋণ বাদেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে; কিন্তু এটাও সঠিক অঙ্ক নয়। অর্থনীতির প্রখ্যাত একজন আওয়ামীপন্থী অধ্যাপক আমাদের জানান অবলোপনকৃত ঋণ এবং আরও কিছু ঋণ যেগুলো আদৌ ফেরত পাওয়া যাবে না, সেগুলো হিসাব করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অন্তত তিন লাখ কোটি টাকা।

অথচ মাত্র কিছুদিন আগেই ঋণখেলাপিদের জন্য ঋণের মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল করার সুবিধা দেয়া হয়েছিল এবং সুদ ধার্য করা হয়েছিল মাত্র ৯ শতাংশ যা ১০ বছরে পরিশোধযোগ্য। অথচ ভালো ঋণগ্রহীতাদের জন্য সুদের হার এর দেড় থেকে দুইগুণ। সরকারের এ সিদ্ধান্ত হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জড হলে প্রাথমিকভাবে তা স্থগিত করা হয়। পরিতাপের বিষয় হল, সেই স্থগিতাদেশ চেম্বার আদালতে গেলে সেখানে তা স্থগিত করা হয় এবং দফায় দফায় এর মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ৩ সেপ্টেম্বর ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

খেলাপিদের এ ধরনের সুবিধা আমরা অতীতেও লক্ষ করেছি। যেমন ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পোদ্যোক্তাদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার জন্য ২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠনের নীতিমালা জারি করা হয়। যেসব শিল্প গ্রুপের ৫০০ কোটি টাকার ওপরে খেলাপি ঋণ ছিল তাদের ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এবং যেসব শিল্প গ্রুপের এক হাজার কোটি টাকার ওপরে খেলাপি ঋণ ছিল তাদের এক শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নবায়নের সুযোগ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। উদ্দেশ্য ছিল বিশেষ সুবিধা নিয়ে ঋণ পুনর্গঠনের মাধ্যমে শিল্পগুলোর লোকসান কাটিয়ে ওঠা। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলো চালু রেখে আয়-উপার্জনের মাধ্যমে ঋণের অর্থ পরিশোধ করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন সুবিধা নিয়ে ওই সময় ১১টি শিল্প গ্রুপ ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করেছিল। এর ফলে ওই সময় রাতারাতি খেলাপি ঋণ কমে যায়। কিন্তু পুনর্গঠনের সুবিধা নিয়ে এসব শিল্প গ্রুপ ঋণ নবায়ন করলেও পরে ওইসব খেলাপি ঋণ যথাযথভাবে পরিশোধ করেনি। উপরন্তু যে পরিমাণ ঋণ পুনর্গঠন করেছিল, তার কিস্তি পরিশোধ না করায় সুদে-আসলে তা ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, উচ্চ আদালত থেকে খেলাপি ঋণের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে বড় গ্রুপগুলোর অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।

ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের মাধ্যমে একই পরিবার থেকে চারজন পরিচালক থাকা এবং পরপর তিন মেয়াদ অর্থাৎ ৯ বছর পদে থাকা ব্যাংকের এ বিপর্যয় তৈরি করার জন্য কাজ করেছে। এছাড়াও তিন মাস যদি কোনো ঋণখেলাপি থাকে তাহলে তাকে খেলাপি ঋণ বলা হবে। এটিই বিশ্বের নিয়ম। অথচ বাংলাদেশে বর্তমানে তিন মাস নয়, নয় মাস যদি খেলাপি থাকে তাহলে সেটা খেলাপি ঋণ হবে। এর মাধ্যমে সরকার কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণের অনুপাত কম দেখাতে পারবে।

ব্যাংকের রেগুলেশনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে ক্রমাগত নিষ্ক্রিয় করে ফেলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ এবং বিএবি ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এখন নজিরবিহীনভাবে বিএবি’র সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে ডেকে নিয়ে গিয়ে আড়াই শতাংশ কর্পোরেট ট্যাক্স কমানো, এক শতাংশ সিআরআর কমানোসহ নানা সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের অনুমোদনের খবর পত্রিকায় আসে। ব্যাংক মালিকরা নানা সুবিধা নেয়ার পর ৬ শতাংশ সুদে আমানত নেয়া আর ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়ায় অঙ্গীকার করা হয়েছিল যা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। উল্টো নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর লুটপাটের চক্করে পড়ে ১৩টি ব্যাংক খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ প্রভিশন রাখার অবস্থায় নেই।

এর মধ্যে একটা মজার খবর নজর কাড়ল আমাদের। ঋণখেলাপিদের পরে এবার জালিয়াতি করে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতকারীদেরও বিশেষ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এ তালিকায় প্রথমেই এসেছে বহুল আলোচিত হলমার্ক গ্রুপের নাম। সরকার এ ব্যবসায়ী গ্রুপকে এককালীন ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের বিশেষ সুবিধা দিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিচ্ছে, যদিও এ সুবিধা শুধু অনিচ্ছাকৃত খেলাপিদের জন্য থাকার কথা ছিল, জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্তদের জন্য নয়।

ব্যাংক শুধু ২৫০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক অতি ধনীদের আমানত সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকে না, বরং হাজার টাকার মালিক নিম্ন-মধ্যবিত্ত, এমনকি দরিদ্র মানুষেরও আমানত রক্ষা করে। অতি ধনীরা বরং সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা সুইজারল্যান্ডে নিভৃতে-নিরাপদে লোকচক্ষুর আড়ালে টাকা রাখতে পারে। যার প্রমাণ আমরা দেখি গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির রিপোর্টে, যেটি বলছে বছরে দেশ থেকে পাচার হচ্ছে গড়ে ৭৬ হাজার কোটি টাকা; কিন্তু গরিবের সেই সুযোগ নেই।

খেলাপি ঋণের নানা কুফলের মধ্যে অন্যতম হল তারল্য সংকট যা সরাসরি বেসরকারি বিনিয়োগে প্রভাব ফেলে। সম্প্রতি পত্রিকায় দেখলাম, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফিন্যান্সিয়াল কর্পোরেশনসহ স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যয় করার জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নেয়া হবে। এ ধরনের ৬৮টি সংস্থার ২ লাখ ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা যখন আবারও উন্নয়নের নামে তুলে নেয়া হবে তখন অনেক ব্যাংকই তারল্য সংকট আরও প্রকট হবে।

ঋণখেলাপিবান্ধব সরকারের নানা পদক্ষেপের ভুক্তভোগী হয় দেশের সাধারণ মানুষ এবং সৎব্যবসায়ী। ব্যাংকের সঙ্গে সঙ্গে ডুবতে বসেছে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো, নন ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল ইন্সটিটিউশন্স (এনবিএফআই)। সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা গেছে, ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৯টিই কোনো না কোনোভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এদের মধ্যে ১২টিকে লাল তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অতি সম্প্রতি পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের খবর আমাদের সামনে এসেছে। এর মানে আমানতকারীদের দায়িত্ব সরকার নিচ্ছে না, ব্যাংকের সম্পদ বিক্রি করে আমানতকারীদের প্রাপ্য শোধ করবে, যা একটি অতি দীর্ঘ এবং ভীষণ অনিশ্চিত প্রক্রিয়া। এ প্রতিষ্ঠানের অবসায়ন স্পষ্ট করেছে সরকার ভবিষ্যতেও একই সমস্যায় পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও সম্ভবত একই পদক্ষেপ নেবে। এর মানে লাল তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীরা ভবিষ্যতে ভয়ংকর বিপদে পড়তে যাচ্ছে।

মধ্যবিত্ত তার কষ্টার্জিত অর্থ বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকের স্থায়ী আমানতকেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে, কারণ এটি ঝুঁকিহীন। কিন্তু এটাও এখন এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে, আমানতকারীরা তাদের টাকা ফেরত পাবে কিনা সেই সন্দেহ তৈরি হয়েছে। তাই অনেকেই তাদের আমানত তুলে নিয়ে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছেন শেয়ারবাজারে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে একের পর এক বড় দরপতন হচ্ছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, কারসাজি ছাড়া বাজারে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে না।

ব্যাংক, এনবিএফআই, শেয়ারবাজার, বীমা সব ধ্বংসের পর সাধারণ মানুষের আর সিন্দুক ছাড়া উপায় থাকবে না। বছরের পর বছর দেশের আর্থিক খাতকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে, দেশের অর্থনীতিতে একটা ভয়ংকর ধস অনিবার্য। এ মুহূর্তেও যদি শক্তহাতে এর হাল ধরা হয়, তাহলেও ক্ষতি কিছু কমিয়ে আনা যাবে; কিন্তু এর সম্পূর্ণ নিরাময় অসম্ভব। এর প্রধান ভুক্তভোগী হবে দেশের সাধারণ মানুষ, যাদের শ্রম আর ঘামে তৈরি হয় দেশের অর্থনীতি।

  •  লেখক অ্যাডভোকেট, সুপ্রিমকোর্ট, সংসদ সদস্য। 

সূত্র — যুগান্তর/সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৯।   লিঙ্ক — http://bit.ly/2lZIsIW

Thursday, September 5, 2019

সাইফুর রহমান এবং কিছু স্মৃতি

আহবাব চৌধুরী খোকন


সাইফুর রহমান
অক্টোবর ৬, ১৯৩২ — সেপ্টেম্বর ৫, ২০০৯

৫ সেপ্টেম্বর বরেণ্য রাজনীতিবিদ ও অর্থনৈতিক সংস্কারক সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৯ সালের এই দিনে পবিত্র রমজান মাসে মৌলভীবাজার থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দীর্ঘ সময়ের সফল অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমান ছিলেন সৎ, মেধাবী ও পরিশ্রমী। প্রতিভাবান এই মানুষটির জন্ম ১৯৩২ সালের ৬ অক্টোবর মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বাহারমর্দন গ্রামে। ১৯৪৯ সালে মৌলভীবাজার সরকারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৫১ সালে এমসি কলেজ থেকে আইএসসি ও ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। তিনি ১৯৫৮ সালে লন্ডনের ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট থেকে কৃতিত্বের সাথে ডিগ্রি অর্জন করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাভোগ করেন। তিনি ১৯৬২ সালে দেশে ফিরে এসে আত্মপ্রকাশ করেন চৌকস পেশাজীবী হিসেবে। প্রতিষ্ঠা করেন ‘রহমান, রেহমান অ্যান্ড হক’ নামে একটি নিরীক্ষা ফার্ম। এই ফার্ম আজো চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সাইফুর রহমানের কৃতিত্বের স্মারক হয়ে আছে। তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যে অভিজ্ঞ অ্যাকাউনট্যান্ট হিসেবে তেল, গ্যাস, কেমিক্যাল, ট্রান্সপোর্ট, ইন্স্যুরেন্স, ব্যাংকিং ইত্যাদি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় পরামর্শক হিসেবে দেশে-বিদেশে প্রভূত সুনাম অর্জন করেন। ১৯৭৬ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যোগ দেন রাজনীতিতে।

তিনি ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিএনপির রাজনীতিকে লালন করে গেছেন। সাইফুর রহমান প্রথমে জিয়া সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা এবং ১৯৭৮ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত প্রথমে শহীদ জিয়াউর রহমান ও পরে মরহুম বিচারপতি আবদুস সাত্তার সরকারের অর্থ ও বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালে ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারি করে এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের প্রায় সব নেতার সাথে তাকেও গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হয়। তিনি নীতির প্রশ্নে আপস করেননি। বরং বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিএনপি পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় প্রায় পুরো ৯ বছর তিনি রাজপথে থেকে সরকারের জুলুম-নির্যাতন মোকাবেলা করেছিলেন। ১৯৯১ সালে জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে আবার সরকার গঠন করলে সাইফুর রহমান আবারো অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। তিনি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত দুই দফায় ১০ বছর বেগম জিয়া সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

সাইফুর রহমান ছিলেন সাহসী, দেশপ্রেমিক ও স্পষ্টভাষী। যতটুকু মনে পড়ে, মৃত্যুর বছর চারেক আগে তার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল। তিনি সিলেট শাহী ঈদগাহে ঈদের নামাজ পড়ে মৌলভীবাজার যাচ্ছিলেন। তার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব (এপিএস) কাইয়ুম চৌধুরীর সাথে তাকে মৌলভীবাজার পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম। তখন তার সাথে ছিলেন সিলেট ও মৌলভীবাজারের দুই জেলা প্রশাসক, দুই জেলার পুলিশ সুপার, তার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা ও সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি ও বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।

অন্যান্য ঈদের দিনের মতো ওই দিন মৌলভীবাজারে তার বাগানবাড়িতে জনতার ঢল নেমেছিল। এর সপ্তাহখানেক আগে তিনি আমেরিকা সফর করে গেছেন। আমি নিউ ইয়র্ক থেকে এসেছি শুনে সিলেটি ভাষায় বললেন, ‘আমেরিকায় তো দেখলাম বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। এত ঠাণ্ডা যে, এবার গিয়ে বেশ অসুস্থ ছিলাম।’ বললাম, ‘স্যার, আমি জানি। তখন দেশে চলে এসেছিলাম। তাই আপনার সাথে দেখা হয়নি।’ দেখলাম, তিনি বেশ ক্লান্ত। বিদায় নিয়ে চলে গেলেন বাহারমর্দনের বাড়িতে। সেখানে তার পৈতৃক বাড়ি। সিলেটে এলে তিনি তার বাবার স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িতেই রাত কাটাতেন।

জাতীয়তাবাদী রাজনীতির একজন অনুসারী হিসেবে আদর্শ এই মানুষটির সাথে নিজের অনেক স্মৃতি রয়েছে। ১৯৯১ থেকে ২০০১ মৌলভীবাজার, সিলেট ও সুনামগঞ্জে অসংখ্যবার তার সাথে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে সফরসঙ্গী হওয়ার সুযোগ হয়েছে। সিলেট জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক ও পরে জেলা বিএনপির সাংস্কৃতিক ও আপ্যায়ন সম্পাদক হিসেবে ১৯৯৩ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তার সব কর্মসূচিতে থাকার সুযোগ পেয়েছি। ১৯৯১ সালের কথা। আমি তখন ফেঞ্চুগঞ্জ থানা ছাত্রদলের সিনিয়ার যুগ্ম আহ্বায়ক। ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানাকে কেন্দ্র করে সিলেটে তখন আন্দোলন তুঙ্গে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম আবদুুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে বৃহত্তর সিলেটের বিরোধীদলীয় ১৮ জন সংসদ সদস্য সারকারখানায় বিশাল প্রতিবাদ সভা করে গেছেন।

শিল্প মন্ত্রণালয় ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে দেখিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এ ব্যাপারে একটি বিজ্ঞাপন ও বিটিভিতে প্রচারিত হয়েছে। ফেঞ্চুগঞ্জে তখন দু’টি ধারায় আন্দোলন চলছে। একটি ধারার নেতৃত্ব দিয়েছে ‘গণদাবি পরিষদ’। নেতৃত্বে ছিলেন সিলেট-৩ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য মাহমুদুস সামাদ চৌধুরী ও ডা: মিনহাজ উদ্দিন। আর অন্য ধারায় ‘সর্বদলীয় সারকারখানা রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ।’ এতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রদল নেতা কাইয়ুম চৌধুরী, উপজেলা বিএনপি নেতা আনোয়ারুল করিম চৌধুরী, বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম প্রমুখ। প্রতিদিন মিছিল-মিটিং হচ্ছে। ছাত্র আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। (ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, আঞ্জুমানে তালামিজ ও জাতীয় ছাত্র ঐক্য সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছিলে ওই ছাত্রঐক্য)। আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম ফেঞ্চুগঞ্জে নতুন সারকারখানা নির্মাণ না করে সারকারখানা বন্ধ করা যাবে না।

অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান তখন ৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের একটি প্লান্ট উদ্বোধন করতে ফেঞ্চুগঞ্জে আসবেন। আন্দোলনরত জনতার পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল- সারকারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল করা না হলে মন্ত্রীকে ফেঞ্চুগঞ্জে নামতে দেয়া হবে না। তিনি যে দিন ফেঞ্চুগঞ্জে আসবেন, ওই দিন লাঠিমিছিল করা হবে। তিনি এ খবর পেয়ে তো খুবই ক্ষুব্ধ।

এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সিলেট থেকে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, জেলা বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতারা ফেঞ্চুগঞ্জ এলেন। উপজেলা পরিষদের হলরুমে গভীর রাত অবধি সর্বদলীয় মিটিং হলো। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো, সাইফুর রহমানের উদ্বোধন অনুষ্ঠান হবে। লাঠিমিছিল বাতিল। তবে উপজেলা বিএনপি আহ্বায়ক ও আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং সারকারখানার সিবিএ সভাপতি নেতৃত্বে আন্দোলনরত নেতারা সাইফুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের দাবি-দাওয়া জানাবেন। অবশেষে সে দিন এদের সভা হলো এবং এম সাইফুর রহমানের নির্দেশে সে দিন শিল্প মন্ত্রণালয় সারকারখানা বন্ধের হঠকারী সিদ্ধান্ত বাতিল করেছিল। সিলেট বিভাগ প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা কখনো ভুলে যাওয়ার নয়।

১৯৯৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সিলেটে আসার কথা। আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে তার জনসভার আয়োজন চলছে। সাইফুর রহমান এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে নাকি বলেছিলেন, ‘যদি এই জনসভা থেকে সিলেটকে দেশের নতুন বিভাগ হিসেবে ঘোষণা না দেন, তাহলে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করব।’ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিশাল জনসভায় সিলেটকে নতুন বিভাগ ঘোষণা দেন।

১৯৯৭ সালের কথা। আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায়। আমার সুযোগ হয়েছিল তার সাথে ঢাকা থেকে সকালের ‘পারাবত’ ট্রেনে শ্রীমঙ্গল যাওয়ার। ট্রেনের একটি ডাবল কেবিনে করে আমরা ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশন থেকে একসাথে শ্রীমঙ্গল যাচ্ছি। স্যার ট্রেনে উঠেই ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি ও কাইয়ুম চাচা তার সামনের সিটে বসে আস্তে আস্তে গল্প করছি। ট্রেন চলতে চলতে আখাউড়া স্টেশনে এসে থামলে লোকজনের চিৎকারে মন্ত্রীর ঘুম ভেঙে গেল। জানতে চাইলেন, ট্রেন এখন কোথায় আছে। আমরা বললাম, আখাউড়া। 


বেশ রেগে বললেন, এই একটি স্টপেজে প্রতিটি যাত্রীর ক্ষতি হয় এক ঘণ্টা আর লাভ হয় চোরাকারবারিদের। অথচ এখানে মাত্র অর্ধ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করতে পারলে ট্রেন সোজা সিলেট চলে যেতে পারে। ইঞ্জিন ঘোরানোর জন্য এখানে থামতে হতো না। আল্লাহ যদি কখনো আমাকে আবার সুযোগ দেন, এখানে ইঞ্জিন ঘোরানোর আর কোনো দরকার হবে না। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি আবারো ক্ষমতায় এলে, সাইফুর রহমান অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী হন এবং আখাউড়ায় সিলেটের মানুষের সুবিধার্থে এক কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করেন। 

ঢাকা থেকে সিলেট এবং সিলেট থেকে ঢাকাগামী সব ট্রেনের স্টপেজ আখাউড়া থেকে উঠিয়ে দেয়া হলো, যা আজো বহাল আছে। এখনো দেশে গেলে ট্রেনে করে ঢাকা যাওয়ার সময় তার ওই কথা মনে পড়ে।

সাইফুর রহমান মন্ত্রী থাকাকালে উন্নয়নের ব্যাপারে দেখিয়েছেন বিস্ময়কর কৃতিত্ব। মনে আছে, ১৯৯১ সালে আমরা স্যারের সাথে রাজনগরে রাগীব আলীর চা বাগানে দুপুরের লাঞ্চ করে রওনা হলাম ফতেহপুর বাজারে। ফতেহপুর সিলেট এবং মৌলভীবাজারের বর্ডার। বিশাল গাড়ির বহর নিয়ে যখন ফতেহপুর যাচ্ছিলাম, তখন ওই কাঁচা রাস্তার অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল রাস্তা নয়, আমরা যাচ্ছি যেন হাওরের ওপর দিয়ে। অর্থমন্ত্রী স্পট পরিদর্শন করলেন, প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্টদের সাথে পরামর্শ করলেন এবং জনসভায় প্রদত্ত বক্তৃতায় জনগণের দাবির মুখে ওই রাস্তা করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। তিনি তখন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী। আওয়ামী লীগের আজিজুর রহমান মৌলভীবাজার সদরের এমপি ছিলেন। 


এক বছর পর সাইফুর রহমান আবারো ফতেহপুর গেলেন ওই রাস্তা উদ্বোধন করতে। কী সুন্দর রাস্তা এক বছরে নির্মিত হয়েছে, না দেখলে বিশ্বাস করার নয়।

তিনি ছিলেন একজন দেশদরদি মানুষ। বিশেষত সিলেট বিভাগে যত অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, তার বেশির ভাগ কৃতিত্বের অধিকারী সাইফুর রহমান। তিনি তার কর্মের জন্য মানুষের অন্তরে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।

  • লেখক প্রবাসী সংগঠক ও কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, সাইফুর রহমান স্মৃতি ফোরাম, নিউ ইয়র্ক। 
  • কার্টসি — নয়াদিগন্ত / সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৯।  
  • লিঙ্ক - https://bit.ly/2lFS4Z9

Tuesday, September 3, 2019

এফআইআর সংবিধান লঙ্ঘন করতে পারে না


মইনুল হোসেন

মইনুল হোসেন
আগাম জামিন প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাম্প্রতিক এক রায়ে প্রদত্ত নতুন গাইডলাইনগুলো আগের অনমনীয় অবস্থানের সাথে তুলনায় অনেক নমনীয়। গ্রেফতারজনিত হয়রানি এবং জামিন প্রত্যাখ্যানজাত পারিবারিক দুর্ভোগ লাঘবে এই গাইডলাইনগুলো অনেকটাই মানবিক বিবেচনাপ্রসূত। এ ধরনের গাইডলাইনকে অবশ্যই স্বাগত জানাতে হয়।

কিন্তু মৌলিক অধিকারের গুরুত্ব বিবেচনায় রাখলে নিছক এফআইআর-এ আনীত অভিযোগ বাস্তবতার নিরিখে প্রদত্ত দিকনির্দেশনা আরো নমনীয় হওয়া প্রয়োজন। এফআইআর-এ আসামি করা হলেই ব্যক্তিকে আইনত অপরাধী কিংবা ফেরারি বলে বিবেচনা করা অন্যায়। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণকারীকে আইনের প্রতি অনুগত বলে গণ্য করাই বাঞ্ছনীয়। চার্জশিট বা অভিযোগপত্র দাখিলের আগে কোনো লোককে ‘অপরাধী’ বলা যায় না, বরং তাকে আইনের দৃষ্টিতে নির্দোষ বলে ধরে নিতে হবে। জামিনকে কেন্দ্র করে বিচার বিভাগে দুর্নীতি অনুপ্রবেশের মাধ্যমে মামলার রাজনীতি সহজ হয়েছে। সংবিধান ও আইনের প্রতি মানুষের আস্থা কিভাবে নিঃশেষ করে দেয়, সেসব বিষয় বিচারপতিদের জানা।

জামিন না পেলে পরিবারের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পায়; বিশেষ করে অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি হন। চাকরি হারানো ছাড়া পারিবারিকভাবে অন্যদের জন্য কত ধরনের সমস্যা ও দুর্ভোগ সৃষ্টি হতে পারে, তা আমাদের দেশে অবশ্যই বিবেচনায় রাখার কথা। এসব মানবিক ও সামাজিক বিষয়গুলো বিবেচনায় না থাকা আমাদের বিচারব্যবস্থায় স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবে চলে আসছে।

গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি অপরাধী এবং তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে, এরূপ চিন্তাধারা বিচারকদের অনেকের মধ্যে কাজ করে বলে মনে হয়। বিষয়টির গভীরে যাওয়ার কথা ভাবা হয় না। তা না হলে তাকে আদালতে হাজির করার সাথে সাথেই জামিন না দিয়ে জেলে পাঠানো হতো না। তারপর পুলিশ রিমান্ডে দেয়াও এত সহজ ব্যাপার হতো না। আমাদের দেশে মিথ্যা এফআইআর দেয়া যে কত সহজ, তা ভুলে যাওয়া হয়।

পুলিশকে সহায়তার নামে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির সংবিধানপ্রদত্ত স্বাধীনতা খর্ব করা যায় না। কিন্তু বাস্তবে সেটাই ঘটছে। আমাদের বিচারব্যবস্থায় নির্দোষ ব্যক্তিরা অধিকতর অসহায়। তারা সাধারণ ও সহজ প্রকৃতির এবং যারা সহজ পথকে সঠিক মনে করে, তাদের মধ্যে নীতিবোধ একটু বেশি থাকে। ‘আমি কোনো অপরাধ করিনি, আমার কোনো ভয় নেই’ বলা বাংলাদেশের বাস্তবতায় মোটেও সত্য নয়। আমাদের বিচারব্যবস্থায় পুলিশকে অধিক পরিমাণে বিশ্বাস করা হয়। একবার পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করলেই তাকে তার সব আত্মবিশ্বাস হারাতে হয়। তিনি সম্পূর্ণ অসহায়।

পুলিশনির্ভর রাজনীতির কারণে বর্তমানে পুলিশ সবচেয়ে ক্ষমতাশালী। আর পুলিশের শক্তিবলেই সরকারও সর্বময় ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছে। জনসমর্থনের শক্তির প্রয়োজন হয় না। 

চার্জশিট বা অভিযোগপত্রের আগে কারাগারে রেখে শাস্তি দেয়া পুলিশের বিচার। কারণ, বিচারিক প্রক্রিয়ায় কারাজীবন শুরু হয় বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে।

এর আগে আপিল বিভাগের এক রায়ে আগাম জামিন সম্পর্কে কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করা হয়েছে। রায়ে উপলব্ধি করতে চাওয়া হয়নি যে, এফআইআরের ভিত্তিতে আগাম জামিন প্রত্যাশীকে কোনোভাবেই অপরাধী হিসেবে দেখা যাবে না। তাকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে এবং রাষ্ট্রপক্ষকে তার অপরাধ প্রমাণ করতে হবে। অর্থাৎ বিচারের জন্য তাকে ‘নিরপরাধ’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
অপর একটি রায়ে তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেন, কারো বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলেই তিনি একজন পলাতক আসামি। যদিও তার অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি, তার মতে, কথিত ব্যক্তি একজন ‘ফিউজিটিভ’। তিনি আরো বলেন, একজন পলাতক আসামি যদি হাইকোর্ট বিভাগে আত্মসমর্পণ করে, তবে তাকে হয় জামিন দিতে হবে অথবা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। সংক্ষেপে বলা যায়, মাননীয় বিচারপতি এভাবে আগাম জামিনের ধারণাকে নাকচ করে দিলেন।

পূর্বোক্ত রায়ে বলা হয়েছে, হাইকোর্টের বিচারপতিদের সতর্কতার সাথে এফআইআরের গভীরে না গিয়ে অযৌক্তিকভাবে নিজ বিবেচনা প্রয়োগ করার সুযোগ নেই। তাদের আরো স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়, পুলিশের তদন্ত কাজে যেন বাধা সৃষ্টি না হয়।

অন্য কথায় এফআইআরে একজন লোক সম্পর্কে আনীত অভিযোগের ব্যাপারে পুলিশের তদন্তে কোনো প্রমাণযোগ্য তথ্য পাওয়া যাবে কি যাবে না, জামিন প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে তা কোনো প্রভাব ফেলবে না। কোনো ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে অপর কোনো ব্যক্তিবিশেষ অভিযোগ আনলেই তাকে প্রমাণিত সত্য হিসেবে দেখতে হবে কেন? উভয়েই এ দেশের নাগরিক। যিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করছেন, তাকে বিশ্বাস করা হবে না কেন? মামলা দিয়ে কাউকে অপমান করা আমাদের দেশে খুবই সহজ।

সংবিধানস্বীকৃত ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং বিচারে দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আসামি যে নির্দোষ, এই সার্বজনীন ধারণা আগেকার দু-দু’টি রায়ে মোটেই আমলে নেয়া হয়নি। পুলিশ রাজনৈতিক চাপের ঊর্ধ্বে নয়, তারপরও পুলিশের শক্তিকে সর্বাধিক গুরুত্ব ও সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি একেবারেই অমানুষ ও অসহায়। অভিযোগ করা হয়েছে, তাই জেলে বন্দী জীবন তার ভোগ করতেই হবে।

পুলিশের তদন্তকার্যে সহায়তার নামে নির্দোষ আসামির কারাবরণ কোনোভাবেই সংবিধানে স্বীকৃত ব্যক্তিস্বাধীনতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ ধরনের চিন্তা অবশ্যই বিচারকসুলভ নয়। এটাও চিন্তা করা প্রয়োজন যে, একবার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়ে গেলে হাইকোর্ট তখন আগাম জামিনের বিষয় বিবেচনা করতে চান না। সুতরাং আগাম জামিন না দিলেও আসামিকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করা জরুরি নয়।

আদালতগুলো ভুয়া ও রাজনৈতিক মামলায় ভরপুর হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, এফআইআরে অভিযোগ করলেই জামিন প্রত্যাখ্যান করার প্রবণতা।

আপিল বিভাগের সর্বশেষ রায়ে আপিল বিভাগের বিচারপতিরা একত্রে আগাম জামিন তথা জামিনের ব্যাপারে অনেক মানবিক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তাদের প্রদত্ত এক গাইডলাইনে তারা বলেন, গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে আবেদনকারীকে হয়রানি ও অপমান করার জন্য অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে কি না, দেখতে হবে। কারণ, গ্রেফতারের সাথে জড়িত থাকে পারিবারিক দুঃখ-বেদনা ও অপমান। গ্রেফতারের পরিণতি শুধু আসামিই ভোগ করে না, পরিবার- এমনকি একইভাবে সম্প্রদায়কেও ভোগ করতে হয়।

আরেক গাইডলাইনে বিচারপতিগণ বলেন, আগাম জামিনের মেয়াদ আট সপ্তাহের বেশি হওয়া উচিত নয় এবং চার্জশিট পেশ করার পর আগাম জামিন অব্যাহত থাকা উচিত নয়।

চার্জশিট পেশ করার আগে তিনি অভিযুক্তই (accused) নন; অভিযোগপত্র পেশের আগে জামিন পাওয়ার প্রশ্নটিকে তার মৌলিক ও আইনগত অধিকারের অংশ হিসেবে দেখাই সুবিচার। গাইডলাইনগুলোতে এ ধরনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। স্বাধীন দেশে শাসনতন্ত্র বা সংবিধান আমাদের মৌলিক অধিকার ভোগ করার নিশ্চয়তা দিয়েছে। কোর্টের বিচারে শাস্তি হলে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে। কিন্তু বিচার ছাড়াই জেল খাটা আইন হতে পারে না যদি না দেখা যায় যে, ব্যক্তিটির অতীত কর্মকাণ্ড ভয়াবহ এবং সমাজের নিরাপত্তার জন্য তাকে জেলে রাখা জরুরি।

রাজনীতি যে, পুলিশের মামলার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তা তো সবারই জানা। পুলিশকে কিভাবে ক্ষমতাসীনদের রাজনীতির অঙ্গসংগঠন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাও অজানা কিছু নয়। পুলিশকে জনগণের আস্থা হারাতে হচ্ছে। বিচার বিভাগ ব্যক্তির মৌলিক এবং মানবিক অধিকার রক্ষায় কঠোর হলে পুলিশ রক্ষা পাবে, পুলিশি মামলার রাজনীতি থেকে আদালত চাপমুক্ত হবেন।

এফআইআর-কে গভীরে গিয়ে দেখা এমন কোনো বড় বিষয় নয়। এফআইআরের মাধ্যমে একজনকে মিথ্যাভাবে গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত করে হয়রানি, অপমান এমনকি জেলে আটক রাখা খুবই সহজ। শুধু একটি এফআইআরের তথ্যানুযায়ী, একজনের সাংবিধানিক অধিকার এত সহজে ক্ষুণ্ণ করা যেতে পারে না। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও তার মৌলিক অধিকার রক্ষা করাই আদালতের দায়িত্ব।

অত্যন্ত জোরের সাথে আমরা বারবার মত প্রকাশ করেছি যে, বিচার বিভাগকে রাজনীতিকদের বলয় থেকে অবশ্যই বাঁচানো দরকার। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত রাজনৈতিক মামলা এবং তাদেরকে জেলে পুরে রাখার বাস্তবতা অস্বীকার করলে বিচারব্যবস্থাই একসময় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। তখন দেশে চলবে বিচারবিহীন হিংসাবিদ্বেষের ক্ষমতা দখলের নৈরাজ্য।

এফআইআরের ভিকটিমদের জামিন আদেশ দিয়ে বিচারের জন্য পুলিশকে সাক্ষী-প্রমাণ হাজির করার নির্দেশ প্রদান করলে আদালতে হয়রানিমূলক ও মিথ্যা রাজনৈতিক মামলার বোঝা হ্রাস পাবে। জামিন আদেশ না দেয়ার জন্য আদালতের ওপর সরকারের পক্ষ থেকে খোলাখুলি চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। আমার নিজেরও সে অভিজ্ঞতা রয়েছে। জামিনযোগ্য মানহানির মামলায় নিম্ন আদালাতের অসহায় অবস্থা দেখে আমার অনেক কষ্ট লেগেছে।

ভুয়া মামলা দায়ের করার জন্য পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ প্রশস্ত করা যাবে না। তখন সরকার আদালতের বাহানা দিয়ে বলে, ‘আদালত জামিন না দিলে সরকারের কী করার আছে? এটাই তো আইনের শাসন।’

অন্যদের রাজনৈতিক ফায়দা লোটার সুযোগ দিয়ে বিচার বিভাগ এভাবে নিজের ধ্বংস নিজে অনিবার্য করতে পারে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আদালতকে ব্যবহার করার গণবিরোধী প্রবণতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। একমাত্র সুপ্রিম কোর্টই সংবিধানের অভিভাবক ও রক্ষক হিসেবে মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষার দায়িত্ব নিতে পারেন। রাজনীতি যে পুলিশিব্যবস্থা নয়, তা প্রতিষ্ঠা করতে সুপ্রিম কোর্টকে সক্ষমতা প্রদর্শন করতে হবে। বিচারব্যবস্থার শক্তি যে জনগণ এবং জনগণের প্রদত্ত শাসনতন্ত্র তা স্মরণে না রাখলে বিচারব্যবস্থা টিকে থাকবে না।

সরকার যখন কাউকে ‘আইনের আওতায়’ আনার কথা বলে; তার অর্থ হলো তাকে পুুলিশের হাতে তুলে দেয়া।

সংবিধানের রূপ-চরিত্র যতটুকুই থাকুক না কেন, সংবিধান নামে গণতান্ত্রিক একটি দলিলের অস্তিত্ব যত দিন আছে তত দিন আমাদের অর্থাৎ, বিচারক ও আইনজীবীদের বিচারব্যবস্থা রক্ষায় নিবেদিত থাকতে হবে। আইন ও আদালতকে ব্যবহার করে রাজনীতি করতে দেয়া যাবে না। রাজনীতি রাজনীতির পথে চলবে। বিচারক ও আইনজীবীদের নেতৃত্ব থাকবে বিচারব্যবস্থায়। মৌলিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার জন্য সবাইকে সক্রিয় থাকতে হবে, যাতে নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও রক্তাক্ত সঙ্ঘাতের দ্বারপ্রান্ত থেকে দেশকে ফিরিয়ে আনা যায়।

—  লেখক প্রবীণ আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। 

সূত্র —  নয়াদিগন্ত/আগস্ট ২৫, ২০১৯ 
লিঙ্ক —   http://bit.ly/2lBq5d2 

Monday, September 2, 2019

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের জন্ম


ড. এমাজউদ্দীন আহমদ 


জিয়াউর রহমান তার লিখিত প্রবন্ধ ‘আমাদের পথ’-এ বলেছেন : ‘আমাদের সামনে বর্তমানে লক্ষ্য একটাই - আর তা হলো দেশ ও জাতি গঠন। দু’শ বছর পরাধীন থাকার ফলে দেশ ও জাতির অনেক ক্ষতি হয়েছে। সময় নষ্ট হয়ে গেছে। তাই আমাদের প্রয়োজন অবিলম্বে জনশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দেশের জনগোষ্ঠীকে একটা পথে পরিচালিত করাই সর্বোত্তম পথ বলে আমি মনে করি।’ ঐতিহাসিক স্মিথের (R.E.) বক্তব্যও ঠিক এমনি। রোম প্রজাতন্ত্রের পতনের কারণগুলো চিহ্নিত করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘বিভিন্ন সামাজিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে সমগ্র সমাজকে সমাজকল্যাণের স্বর্ণসূত্রে আবদ্ধ করে অতীতের বিরাট কোনো অর্জনের নিরিখে ভবিষ্যতের পথে চালিত করা সম্ভব।’ তিনি আর বলেন, ‘সমাজ একটি অনুভূতিপ্রবণ সচেতন সত্তা। এর মিলন সূত্রটি সরিয়ে নাও অথবা ছিন্ন করো, দেখবে সমাজ হাজারো ভাগে বিভক্ত ও খ-ছিন্ন হয়েছে। সমাজে তখনো মানুষ বাস করবে বটে, কিন্তু সবার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনকারী ঐক্যসূত্রটি তখন আর থাকবে না। সমাজকল্যাণ এবং জনকল্যাণের এই সূত্রটি একবার ছিন্ন হলে সমাজ হারাবে তার গতি। সামাজিক শক্তিগুলো হয়ে পড়ে বিভ্রান্ত। লিপ্ত হয় পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে। জাতীয় জীবন হারায় তার চিৎশক্তি। সবকিছুকে গ্রাস করতে থাকে তখন অনাকাক্সিক্ষত এক স্থবিরতা ও নৈরাজ্য। এমনি সময়ে মহান কোনো নেতার আকস্মিক আগমন না ঘটলে ওই সমাজে পতন অনিবার্য। এভাবেই রোমান প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটে। সংকটকালে রোমে কোনো ত্রাতার আবির্ভাব ঘটেনি।

১৯৭৫ সালের শেষদিকে দৃষ্টি দিন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজের দিকে, দেখবেন স্মিথের কথা কত বাস্তব, কত সত্যনিষ্ঠ। কত ব্যাখ্যামূলক। কৃতসংকল্প এবং সাস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণে ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের জনগণ জীবনপণ করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অনলকুন্ড থেকে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার লাল গোলাপ। হস্তগত করে রক্তরঞ্জিত পতাকা। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে স্থায়ী করে নিজেদের ঠিকানা। প্রত্যেকের প্রত্যাশা ছিল, এতদিনের বঞ্চনা থেকে সবাই মুক্তি লাভ করবে। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সবাই অংশগ্রহণ করবে এবং নিজেদের উদ্যোগে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রচনার সুযোগ লাভ করবে। সবার জীবনে আসবে সার্থকতার স্পর্শ, সাফল্যের কিঞ্চিত ভাগ। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থানসহ সব কল্যাণমূলক ক্ষেত্রে সবাই অংশীদার হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সম্মানীয় নাগরিক হিসেবে সবাই মাথা উঁচু করবে। কিন্তু মাত্র তিন বছরের মধ্যে জনগণের সব সুখস্বপ্ন শূন্যে মিলিয়ে গেল। জনকল্যাণমুখী ঐক্যসূত্র ছিন্ন হলো। দেশে প্রবর্তিত হলো সমাজতন্ত্রের নামে এক অপচয়প্রবণ পীড়নমূলক লুটেরা অর্থনীতি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সীমাহীন অবনতি জনজীবনকে পর্যুদস্ত করল। দলকে সমাজতান্ত্রিক দীক্ষায় দীক্ষিত না করে এবং দলীয় নেতৃত্বকে সমাজতন্ত্রের অঙ্গীকারে সিক্ত না করে সমাজতন্ত্র প্রবর্তনের ফলে বঙ্গবন্ধুর কথায়, ‘চাটার দলের’ লুটেরাদের দাপটে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল। সবচেয়ে মারাত্মক আকার দেখা দিল সব সামাজিক শক্তিগুলোর বিভাজনে। অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত হতে লাগল দেশের ফরমাল (Formal) ও ইন-ফরমাল সংস্থাগুলো। মুজিবনগরে কর্মরত কর্মকর্তা এবং দেশের অভ্যন্তরে কর্মরত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এবং পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা সৈনিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়ে ওঠে। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে বামপন্থার অনুসারী এবং কেন্দ্রের অনুসারীরা নতুনভাবে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। মুক্তিযোদ্ধারাও বিভিন্ন গ্রুপে খ-ছিন্ন হয়ে দেশময় নিজ নিজ প্রভাব বলয় রচনায় লিপ্ত হয়। এক কথায়, সমগ্র সমাজজীবনকে গ্রাস করতে উদ্যত হয় এক ধরনের নৈরাজ্য। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। বিচার বিভাগ প্রবল প্রতাপান্বিত নির্বাহী বিভাগের পদতলে লুটিয়ে পড়ে। ব্যক্তিশাসনের নিগড়ে বন্দি হয় নাগরিকদের রাজনৈতিক জীবন। যে আইনের শাসনের প্রত্যাশা নিয়ে জনগণ যুদ্ধে নেমেছিল মাত্র ক’বছরের মধ্যে তা পরিণত হয় মস্ত বড় এক প্রহসনে। অর্থনীতির অবস্থা তখন ছিল নৈরাজ্যজনক। উৎপাদন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলে দেশের কলকারখানা, মিল-ফ্যাক্টরি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে এসে পড়ে। এই অদক্ষ, দুর্নীতিপরায়ণ বুভুক্ষু দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন তাদের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিবৃত্তিতে নিয়োজিত হয়, তেমনি সীমাহীন উৎপাদন হ্রাসের ফলে এবং আন্তর্জাতিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে সমগ্র দেশে মূল্যস্ফীতির হার কোনো কোনো ক্ষেত্রে শতকরা পাঁচশ থেকে সাতশ ভাগ বৃদ্ধি পায়।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পর জনজীবনে নেমে আসে মৃত্যুর করাল ছায়া। বাংলাদেশ হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এক করুণার পাত্র, ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। জনগণের কাছে তখনো স্বাধীনতার স্থপতি নন্দিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল উল্লেখযোগ্য। তাকেই ঘিরে জনগণ বুক বেঁধেছিল আশায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, আত্মকলহ ও ষড়যন্ত্রের ফলে এবং সামরিক বাহিনীর কিছুসংখ্যক নির্মম ঘাতকের হাতে তিনি সপরিবারে নিহত হলে জনগণের সামনে আশার প্রদীপটিও নিভে যায়। আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং ষড়যন্ত্রের কথা সুস্পষ্ট হয় যখন দেখা যায় আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদ ১৫ আগস্টে ক্ষমতাসীন হলে শুধু সামরিক বাহিনীর তিন প্রধান তাকে স্যালুট করে তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন তাই নয়, দলের শীর্ষ পর্যায়ের কিছু নেতা মোশতাক সরকারের স্বীকৃতি আদায় তথা তার সরকারকে স্থিতিশীল করার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আবদুল মালেক উকিল ব্রিটেনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছে যা বলেছিলেন, তা উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। বর্ষীয়ান নেতা মহিউদ্দীন আহমদ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে যান মোশতাক সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির আবেদন নিয়ে। সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী হন এই সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী নিযুক্ত হন এই সরকারের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা। সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিপরিষদের ১৯ জনের মধ্যে ১১ জন এবং ৯ জন প্রতিমন্ত্রীর ৮ জন মোশতাক আহমদের মন্ত্রিপরিষদে যোগ দেন। মোশতাক সরকার কিন্তু স্থিতিশীল হয়নি। সক্ষম হয়নি জনগণের আনুগত্য ধারণ করে তাদের আশা-আকাক্সক্ষার মাধ্যমরূপে বেশিদিন টিকে থাকতে। যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিভিন্ন পর্যায়ে দীর্ঘদিন জনগণকে সংহত করে, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে জাতীয় ঐক্যের সমর্থনকারীর ভূমিকা পালন করে তার অবসান ঘটে। এমনি সময়ে আবির্ভাব ঘটে জিয়াউর রহমানের। তারই উদ্যোগে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় ঐক্যভিত্তিক বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। বাংলাদেশ ফিরে পায় নতুনভাবে তার প্রাণশক্তি জিয়ার সৃজনশীল নেতৃত্বে। জনগণ জিয়ার মধ্যে ফিরে পায় তাদের সুহৃদকে। জাতীয়তাবাদী দলের সৃজনশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের সামাজিক শক্তিগুলো (Social Force) ফিরে পায় নতুন এক ঐক্যসূত্র। A People’s President সাব হেডিংয়ে জায়ারিং (Lawrence Ziring, Jr.) তার Bangladesh : From Mujib to Ershad : An Interpretive Study গ্রন্থের ১৪৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘জিয়া কৃষক-জনতার একজন হিসেবে জনগণের মাঝে মিশে গেলেন। তারাই হলেন জিয়ার দৃষ্টির প্রধান কেন্দ্রবিন্দু’[Zia ingratiated himself with the peasant masses. They received his primary attention.] ! যখন বাংলাদেশের দায়িত্বভার জিয়াউর রহমান গ্রহণ করেন, তখন দেশের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান হয় প্রাণহীন অবস্থায় ছিল, না হয় ছিল জরাজীর্ণ, শতধাবিভক্ত। তখন দেশে কোনো রাজনৈতিক দল বিদ্যমান ছিল না। দেশের দক্ষিণপন্থি দলগুলো মুজিবনগর সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠনের সময় বামপন্থার দলসহ সব দল বেআইনি ঘোষিত হয়। ১৫ আগস্টের পর খন্দকার মোশতাক আহমদ শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে বাকশালও নিষিদ্ধ হয়। প্রশাসনিক ব্যবস্থা অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে হয়ে পড়ে ত্রিভঙ্গমুরারী। না ছিল তার গতিশীলতা, ছিল না সুসংহত কাঠামো। রাষ্ট্রপতির ৯নং আদেশের ফলে প্রশাসনিক দক্ষতা ও নৈতিক মান সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যায়। সামরিক বাহিনী ওই সময়ে অন্ততপক্ষে চার ভাগে বিভক্ত ছিল। এর একাংশ কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে বামঘেঁষা হয়ে পড়ে। তাওয়াবের নেতৃত্বে আর এক অংশ ডানপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে। পাকিস্তান থেকে আগতরা সংহত হয় এরশাদের নেতৃত্বে আর এক অংশের নেতৃত্ব দিতে থাকেন খালেদ মোশাররফ। ফলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর অভ্যুত্থান এবং প্রতি-অভ্যুত্থানের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় রাজনৈতিক ব্যবস্থা হয়ে ওঠে অনিশ্চিত, ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এমনি সময়ে রাষ্ট্রীয় জাহাজের হাল ধরতে হয়েছিল জেনারেল জিয়াকে। জেনারেল জিয়া দায়িত্ব গ্রহণের পর, বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠনের পর শাসন-প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রচলিত নীতির আমূল পরিবর্তন সাধন করেন এবং পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য নতুন নীতি প্রবর্তন করেন।

সামরিক বাহিনীর মধ্যে পেশাদারিত্বের ওপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ, রাষ্ট্র কৃত্যকদের প্রশিক্ষণ এবং তাদের মধ্যে জনকল্যাণের চেতনার বিস্তার, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ইন্দো-সোভিয়েত কক্ষপথ থেকে সরিয়ে এনে বিশ্বময় বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি, বহুদলীয় গণতন্ত্রের ক্ষেত্র রচনা, বন্ধুবিহীন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন নতুন সহযোগী ও বন্ধু সৃষ্টি, কৃষিক্ষেত্রে সর্বাধিক উৎপাদনের লক্ষ্যে সেচ-উত্তম বীজ-সার সমন্বয়ে নতুন কৌশল প্রয়োগ, শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ গণতন্ত্রের বিভিন্ন অনুষঙ্গের প্রয়োগ, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এসব নীতির ফল হয় অত্যন্ত শুভ। অল্প সময়ে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি হয়ে ওঠে স্বাভাবিক। দেশে সুশাসনের সূচনা হয়। মিল-ফ্যাক্টরিতে উৎপাদন বেড়ে যায়। কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনের গতি ত্বরান্বিত হয়। দলবিধি অনুযায়ী প্রায় ২ ডজন রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত হয়। দেশের অভ্যন্তরে সন্তোষের মাত্রা সন্তোষজনক হয়ে ওঠে। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতে থাকে। The Sunday Observer (7 November 1976) তার সম্পাদকীয়তে লেখে : ‘বাংলাদেশের মৃতদেহে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে (Life breathes again in the corpse of Bangladesh)। লন্ডনের Sunday Times (২৫ জানুয়ারি ১৯৭৬) এই সংখ্যায় লেখা হয়, ‘বাঙালিদের মুখ আশার মৃদুহাস্যে উদ্ভাসিত’ (Bangalis are beaming with smiles of hope)। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বাংলাদেশ সরকারের প্রবর্তিত নীতিসমূহকে Remarkable breakthrough বলে চিহ্নিত করেন। এই প্রেক্ষাপটে জেনারেল জিয়ার নেতৃত্ব এবং তার প্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠা এবং সফলতার মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ পাওয়া যে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল গণতন্ত্রের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে সেই বহুদলীয় গণতন্ত্রের ক্ষেত্র তৈরি করেন এবং তার সুযোগ্য সহধর্মিণী দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৯৯১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে আবার সংসদীয় গণতন্ত্রের সূচনা হয়। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি স্বাধীন অ্যাক্টর হিসেবে মাথা উঁচু করে পথচলা শুরু করে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় অবস্থান সৃষ্টি করে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী দল নন্দিত দল হিসেবে দেশের অন্যতম বৃহত্তম দলে রূপান্তরিত হয়। জনগণ লাভ করে আইনের শাসনের আশীর্বাদ। নির্বাচন ব্যবস্থা কার্যকর হয়।

 — ড. এমাজউদ্দীন আহমদ : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।  

Sunday, September 1, 2019

বিএনপির ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী — জিয়া নেই, বিএনপি আছে



ড. মাহবুব উল্লাহ্
আজ ১ সেপ্টেম্বর। ১৯৭৮ সালের এই দিনে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠনের ঘোষণা প্রদান করেন।

এ উপলক্ষে তিনি ২ ঘণ্টাব্যাপী এক সংবাদ সম্মেলনে নবগঠিত দল সম্পর্কে তার চিন্তাভাবনা তুলে ধরেন। তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সব ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে এ নবগঠিত দলে যোগদানের আহ্বান জানান।

তার দলের প্রধান লক্ষ্যগুলো ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, জনগণের ইস্পাত কঠিন ঐক্যের মাধ্যমে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে সুসংহত করা হবে, জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাজনীতি গড়ে উঠবে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হবে; প্রগতি অর্জন, স্বনির্ভরতা এবং অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হবে জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমে।


জিয়া নবগঠিত দলটির আহ্বায়ক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তার বক্তব্য পেশ করছিলেন। তিনি জানান, দলটির ১১ সদস্যবিশিষ্ট স্থায়ী কমিটি, সংসদীয় বোর্ড এবং গ্রাম পর্যায় থেকে গড়ে ওঠা দলটির একটি ইলেকট্রোরাল কলেজ থাকবে। এর আগে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের পক্ষ থেকে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিজয় অর্জন করেন। আলোচ্য সংবাদ সম্মেলনে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের নেতারা অংশগ্রহণ করেন।

জিয়া বলেছিলেন, জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত কোন কোন দল নবগঠিত দলে একাত্ম হবে তা পরবর্তী সময়ে জানানো হবে। উল্লেখ্য, কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস পার্টি জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে সক্রিয়ভাবে শামিল হলেও নবগঠিত দল বিএনপিতে যোগদান করেনি।

কাজী জাফর আহমদ জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেছিলেন এবং তার অধীনে প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে একমত হতে না পারলেও পার্টির অভ্যন্তরে সংগ্রামের নীতির ভিত্তিতে ওই দলেই থেকে গিয়েছিলেন জীবনের শেষ কয়েকটি বছরের আগ পর্যন্ত। তিনি এরশাদের দল থেকে বের হয়ে এসে তার নেতৃত্বে আরেকটি জাতীয় পার্টি গঠন করেন। তরুণ বয়সে বাম রাজনীতির লড়াকু এই সৈনিক শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রতি দৃঢ় আস্থা ব্যক্ত করেন। জীবনের শেষ দিনগুলোয় তার বক্তব্য ছিল, জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট হয়ে বিএনপিতে যোগ না দেয়া ছিল তার জীবনের একটি বড় রাজনৈতিক ভুল। জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টভুক্ত দলগুলো ছিল আওয়ামী লীগবিরোধী। ১৯৭২-৭৫ পর্যায়ে তৎকালীন শাসক দল আওয়ামী লীগের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে অনেক রাজনৈতিক দলই আওয়ামী লীগবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছিল। সে সময় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও (জাসদ) আওয়ামী লীগবিরোধী ছিল।

বস্তুত তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রকাশ পেয়েছিল ঘোরতর আওয়ামী লীগবিরোধী তৎপরতার মাধ্যমে। জিয়া তার নতুন দলে আওয়ামী - বাকশালবিরোধীদের সমবেত করতে চাইলেও জাসদের সেখানে কোনো ঠাঁই ছিল না।

কারণ ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বরের সিপাহি জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, তারা ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্নে পরস্পরের বৈরী এবং তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী। জিয়ার নবগঠিত দলে মূলত আওয়ামী লীগবিরোধীরাই সমবেত হয়েছিল।

এদের একটি বড় অংশ এসেছিল মশিউর রহমান জাদু মিয়ার নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি থেকে। এ দলটি ছিল মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ। ভাসানীপন্থীরা ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে ব্যক্তিগতভাবে অথবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপদল হিসেবে অনেকেই বিএনপিতে যোগদান করে। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, জাসদ ও মুসলিম লীগেরও কেউ কেউ ছিলেন।


জিয়া মনে করতেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের থাবা থেকে মুক্ত নয়। কাজেই এ আগ্রাসী শক্তিবিরোধী সবাইকে জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। অন্যথায় সম্প্রসারণবাদের ষড়যন্ত্রের ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব খর্ব হয়ে পড়বে। জিয়া ছিলেন একজন সৎ দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা এবং জনগণের অন্তস্তলে আসন পাওয়া একজন জাতীয় বীর। এ কারণেই সম্প্রসারণবাদীরা জিয়াকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। একটি ভারতীয় ইংরেজি সাপ্তাহিকের সূত্রে জানা যায়, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ সেরকম আয়োজনই করেছিল। কিন্তু এ অবস্থার মধ্যে ভারতের রাজনীতিতে পটপরিবর্তন ঘটে। ইন্দিরা গান্ধীর পরিবর্তে মোরারজি দেশাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি যখন জানতে পারলেন, জিয়া হত্যার একটি প্রকল্প কার্যকর হতে চলেছে, তিনি তখনই এটি স্থগিত করার নির্দেশ দেন।

কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী আবার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করলে পুরনো প্রকল্পটি আবার চাঙ্গা করা হয়। অনেকেই মনে করেন, এরই পরিণতিতে ১৯৮১-র ৩০ মে রাতে জিয়া সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহী অফিসারদের হাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নৃশংসভাবে নিহত হন। জিয়ার মৃত্যুর পর ঢাকায় শেরে বাংলানগরে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এমন বিশাল জনসমুদ্রে অতীতে কিংবা পরবর্তীকালে কোনো রাষ্ট্রপতিকে শেষ বিদায় জানানো হয়েছে কিনা সন্দেহ।

প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তার 
জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি সাত্তার বিপুল ভোটে বিএনপি থেকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন। কিন্তু তার শাসন স্বল্পকাল স্থায়ী হয়। ’৮২ সালের মার্চে সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ নানা কলাকৌশল করে বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে সামরিক শাসন জারি করেন। এ পর্যায়ে বিএনপির অভ্যন্তরে নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা নিয়ে টানাপোড়েন চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত জিয়াপত্নী বেগম খালেদা জিয়া দলের হাল ধরেন। বলা যায়, তখন থেকে ক্রন্দসি বিধবা থেকে জাতীয় নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।

শুরুতে বেগম জিয়া খুব ভালো বক্তৃতা করতে পারতেন না। কিন্তু যতই দিন গড়াতে লাগল, ততই তিনি একজন পরিপক্ব নেত্রী হিসেবে তৈরি হলেন। তার সবচেয়ে বড় গুণ হল তার ক্যারিশমা। তিনি কোথাও দাঁড়ালে মুহূর্তের মধ্যেই ব্যাপক জনসমাগম হয়। তিনি ৯ বছরব্যাপী এরশাদের বিরুদ্ধে আপসহীনভাবে লড়াই করে আপসহীন নেত্রীর মর্যাদা অর্জন করেন। এ সময় অনেক সুবিধাবাদী নেতা দল ছেড়ে গেলেও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব গুণের ফলে দলের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়নি।

জেনারেল এরশাদের পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়া তার দলের জন্য একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হন এবং সরকার গঠন করেন। ১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ পর্বে বিএনপি দুই দুইবার পূর্ণ মেয়াদে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করে। মাঝখানে ১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপিকে কার্যত অংশগ্রহণহীন নির্বাচনের আয়োজন করতে হয়। মাত্র দেড় মাসেরও কম সময় ক্ষমতায় থেকে বিএনপি সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংযোজন করে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পথ সুগম করে দেয়। কারণ দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে কঠোর আন্দোলন করছিল।

বিএনপির বিরুদ্ধে অন্যদের, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের একটি বড় অভিযোগ হল, এটি সেনা ছাউনিতে গড়ে ওঠা একটি দল। এ সমালোচনায় সত্যতা আছে।

কিন্তু যখন একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করে কার্যত অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অবসান ঘটানো হয়েছিল তখন কোথাও না কোথাও থেকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করার প্রয়োজন ছিল।

একটি দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য রাজনৈতিক শূন্যতা থাকতে পারে না। জিয়া রাজনৈতিক দল নিবন্ধন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শুভ সূচনা ঘটান। এর ফলে আওয়ামী লীগও নবজীবন লাভ করে। অবশ্য দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোও রাজনীতি করার সুযোগ পায়, যা আজ অবধি চালু আছে। জিয়া সরকারের বড় সাফল্য ছিল দেশে পোশাকশিল্প গড়ে তোলা এবং বিদেশে শ্রমশক্তি রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা।আজও বাংলাদেশের অর্থনীতি এ দুটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

গণতন্ত্রের মা বেগম খালেদা জিয়া 

বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের সাফল্য হল খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি চালু করে ছেলেশিশু এবং মেয়েশিশুদের ব্যাপকভাবে স্কুলমুখী করা। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীও তার শাসনামলে বিস্তৃত হয়। দেশে বেশ কিছু নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করে সড়ক যোগাযোগকে উন্নত করা হয়। বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলেই ২০০৫ সালের পোশাকশিল্প খাতে এমএফএ ফেজ অডিটের চ্যালেঞ্জ দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করা হয়। এর ফলে পোশাকশিল্পে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ও ফরওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প-কারখানা স্থাপিত হয়।

তার শাসনামলে খেলাপি ঋণের সমস্যা থাকলেও এখনকার মতো আর্থিক খাত বিধ্বংসী খেলাপি ঋণের সমস্যা সৃষ্টি হয়নি। শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারির ঘটনাও ঘটেনি। দেশে আর্থিক শৃঙ্খলা তুলনামূলকভাবে মজবুত ছিল। তবে এ কথাও সত্য, উপর তলার কেউ কেউ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এক-এগারোর অবৈধ সেনাশাসিত সরকারের সময় থেকে বিএনপির ওপর যেভাবে নির্যাতনের স্টিমরোলার চালানো শুরু হয় তা আজ অবধি অব্যাহত আছে।

অত্যাচার, নির্যাতন ও গুম-খুনে দলটি ম্রিয়মাণ অবস্থায় আছে। ২০০৭ সাল থেকে বিএনপি নির্যাতন-নিপীড়নের মুখে যে রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেছে তা কতটুকু সঠিক বা বেঠিক ছিল দলটিকে সে মূল্যায়নের মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন। অতীতের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করেই ভবিষ্যতের পথে এগোতে হবে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির আলোকে জিয়া প্রবর্তিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের রাজনীতির রূপরেখা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে।

দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং বেগম খালেদা জিয়ার কারামুক্তির দাবি সংবলিত কর্মসূচি প্রণয়ন করে তা জনগণের মধ্যে নিয়ে যেতে পারলেই বিএনপি বিদ্যমান সংকট থেকে বের হয়ে আসতে পারবে। বিএনপির জন্য প্রয়োজন সঠিক রাজনীতি, সঠিক পন্থা এবং সুদৃঢ় সংগঠন।

ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
 কার্টসি —  যুগান্তর/ রোববার, সেপ্টেম্বর ১, ২০১৯। 
 লিঙ্ক — http://bit.ly/2UnNVqo