Search

Sunday, December 22, 2019

সিএএ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়

আসিফ নজরুল

আসিফ নজরুল

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) নিয়ে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ভারতের বাইরেও। এই আইনের প্রতিবাদে ভারতের দুটি প্রাচীন মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদমুখর ছাত্রদের ওপর পুলিশ হামলা করেছিল। হামলার প্রতিবাদ করেছেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ভারতীয় ছাত্র ও অ্যালামনাইরা।

জাতিসংঘ মানবাধিকার অফিস মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর বৈষম্যমূলক হিসেবে আইনটির নিন্দা করেছে। কয়েকটি দেশ তাদের নাগরিকদের ভারতের কিছু রাজ্যে যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছে। সবচেয়ে অভাবিত প্রতিবাদ এসেছে পাকিস্তানের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে। সিএএতে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশে ‘নিপীড়িত’ হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধসহ মুসলমান ছাড়া অন্য যেকোনো ধর্মের মানুষকে নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান আছে। তারপরও পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের সংগঠনগুলো এই আইনের সমালোচনা করেছে, সেখানে নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রস্তাব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।

নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ চলছে





আইনটি পাস হওয়ার সময় যে তিনটি দেশের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের বর্তমানে কোনো সীমান্ত নেই। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে বৈরী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সীমান্তে সার্বক্ষণিক উত্তেজনা বিরাজমান। এ পরিস্থিতিতে সিএএ আইনের কারণে নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা হারানো ভারতীয় মুসলমানদের সবচেয়ে বেশি অনুপ্রবেশ ঘটার আশঙ্কা বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে। বিবিসির একটি রিপোর্টে ইতিমধ্যে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের কিছু ঘটনা তুলেও ধরা হয়েছে। কিন্তু এরপরও এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো অবস্থান গ্রহণ করেনি।

বাংলাদেশ সরকারের এ অবস্থান নানা কারণে উদ্বেগজনক। সরকার প্রথম থেকেই বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বর্ণনা করেছে এবং বাংলাদেশের চিন্তার কারণ নেই বলে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের কথা উল্লেখ করেছে। এড়িয়ে গেছে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, সঙ্গে আরও কয়েকজন বিজেপি নেতার অনুপ্রবেশকারীদের বাংলাদেশের বলে দাবি করার বিষয়টি। আইনটি পাস করার সময় লোকসভার আলোচনায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিপীড়নে বাংলাদেশকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে এক কাতারে ফেলার পর আমরা দেখেছি যে বাংলাদেশের দুজন মন্ত্রীর ভারত সফর স্থগিত হয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এটিও জানানো হয় যে এই স্থগিতের সঙ্গে সিএএর কোনো সম্পর্ক নেই; বরং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমন বক্তব্য প্রদান করেন যে ভারতে অনুপ্রবেশকারীরা বাংলাদেশের হলে তাদের ফেরত নেওয়া হবে।

এসব দেখে মনে হতে পারে যে সরকার বুঝে উঠতে পারছে না তাদের ঠিক কী প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত। তাদের পক্ষ থেকে অতীতে বিএনপির শাসনামলে, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু সিএএতে এই নিপীড়নের অভিযোগ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু সরকারের পর ঢালাওভাবে বাংলাদেশে সব সরকারের আমলে। বর্তমান সরকারের আমলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, প্রধান বিচারপতিসহ সরকারের শীর্ষ পদে তাদের বহু নিয়োগ ঘটেছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো হিন্দু জনগোষ্ঠীর পরিমাণও ২ শতাংশের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সিএএ বা এ নিয়ে লোকসভার আলোচনায় এর কোনো প্রতিফলন ঘটেনি।

বিজেপির বর্তমান যে রাজনীতি এবং সিএএর যা লক্ষ্য, তাতে বাংলাদেশে অতীতে নিপীড়ন হয়েছে, বর্তমানে হচ্ছে না, এটা বলা হবে—এমন আশা করারও সুযোগ নেই। সেখানে অভিযুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ, এর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া হবে বাংলাদেশের ওপর। সরকারকে তাই অবস্থান নিতে হবে দেশের পরিপ্রেক্ষিত থেকে, দেশের স্বার্থে।

২. সংখ্যালঘু নিপীড়ন সভ্যতার আদি যুগের সমস্যা। প্রথম মহাযুদ্ধের অবসানের পর জাতিপুঞ্জের উদ্যোগে নতুন জন্ম নেওয়া রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যে মানবাধিকার চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত হয়, তা ছিল সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার জন্য। জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মভিত্তিক বৈষম্য দূর করার জন্য এরপর বহু আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চুক্তি হয়েছে, বাংলাদেশ, ভারতসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এ ধরনের বৈষম্যকে সংবিধান ও আইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারপরও পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতেও এ ধরনের সমস্যা রয়ে গেছে। উগ্র জাতীয়তাবাদ, ধর্ম ও বংশগত পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি ও সন্ত্রাসী হামলা বৃদ্ধির কারণে সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর বহু অঞ্চলে এ সমস্যা আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।

আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে এ সমস্যা আগের চেয়ে প্রকট হয়েছে। এটি কী ভয়ংকর পর্যায়ে যেতে পারে, তা আমরা পাকিস্তানে আসিয়া বিবি মামলায় দেখেছি। ভারতে ক্ষমতাসীন দলের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রভাব কী প্রকটভাবে পড়েছে, তা গো–মাংস ভক্ষণ নিয়ে নির্বিচার তাণ্ডবকাণ্ডে আমরা লক্ষ করেছি। বাংলাদেশে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহানির কিছু ঘটনা ঘটেছে।

সংখ্যালঘু নিপীড়ন কমবেশি সব জায়গায় রয়েছে। কিন্তু একটি দেশ এ কারণে একতরফাভাবে কোনো প্রমাণ ছাড়া অন্য দেশের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ করলে সে দেশটি নিশ্চুপ থাকে না। সিএএতে পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের মতো দেশের কাতারে বাংলাদেশকে ফেলার পর সরকারের তাই নিশ্চুপ থাকার কারণ নেই।

সিএএর বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান নেওয়ার আরও অনেক বড় যৌক্তিকতা হচ্ছে এর সম্ভাব্য প্রভাব। এই আইনের কারণে ভারত থেকে লাখ লাখ মুসলমানের বাংলাদেশে চলে আসার মতো চাপ বা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, এর আলামত এখনই দেখা যাচ্ছে। এটি সত্যি সত্যি ঘটলে তা সামাল দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের আছে কি? গণহত্যার মুখে রোহিঙ্গারা প্রাণভয়ে একসঙ্গে এ দেশে চলে এসেছে বলে তাদের জন্য আমরা কিছু বিদেশি সাহায্য পাচ্ছি। ভারত থেকে মুসলমানরা ভীতি ও অনিশ্চয়তার কারণে এ দেশে আসতে থাকলে তেমনটি ঘটবে না।

ভারতের এই আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে মানবিক কারণেও। এই আইন প্রতিবেশী তিনটি রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার জন্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এমনকি তারা স্বেচ্ছায় ভারতে চলে গেলেও তা সেখানকার জনগোষ্ঠীর জীবনে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। আসামসহ ভারতের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে তার আভাস আমরা পাই।

বছর চারেক আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ইউরোপের বিভিন্ন দেশে থাকা ইহুদিদের আহ্বান জানিয়েছিলেন ইসরায়েলে চলে আসার জন্য। ইউরোপ আর আমেরিকায় ধর্মীয় উগ্রতা এবং পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির জোয়ারে আক্রান্ত হচ্ছিল ইহুদিরাও। ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে এমন হামলার পর তিনি এ আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর এ আহ্বানের পর ইউরোপ-আমেরিকায় ইহুদির জীবনে অনিশ্চয়তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের এ আইনও, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোতে সম্প্রদায়গত সম্পর্কের অবনতি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।

বিজেপি এই আইনকে নিপীড়িত মানুষের রক্ষাকবচ হিসেবে দাবি করেছে। সমালোচকেরা বলছেন, তাহলে ভারত পাকিস্তানের আহমদিয়া বা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা কেন বলছে না? তাঁদের বক্তব্য, ভারতের এ আইন ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় আবেগ ব্যবহার করে ক্ষমতায় থাকার অভিপ্রায় থেকে নেওয়া। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে এই আইন প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতেও এ ধরনের রাজনীতিকে বেগবান করতে পারে।

৩. ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আমাদের বিশ্লেষণের বিষয় হতে পারে, কিন্তু প্রতিক্রিয়ার বিষয় নয়। তবে এই আইনের প্রভাব অবশ্যই আমাদের প্রতিক্রিয়া দাবি করে। এই আইন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাঝুঁকি ও দেশে ভারতীয়দের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতির ওপর এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে।

দেশের স্বার্থে অবশ্যই সরকারকে এর বিরুদ্ধে স্পষ্ট ও জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার ও সুরক্ষিত করতে হবে। সেই সঙ্গে দেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও বৈষম্যহীনতাকে আরও সুরক্ষিত করতে হবে নিজস্ব সাংবিধানিক দায় থেকে।

এনআরসি আর সিএএ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, এটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হওয়ার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলোকেও এ বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া উচিত।

  • আসিফ নজরুল  —  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক 
  • কার্টসি - প্রথম আলো/ ডিসেম্বর ২২, ২০১৯

Thursday, December 19, 2019

অপুষ্ট এক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম

আসফিয়া আজিম

অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের সারিতে ঢুকে পড়েছে। বিশ্বব্যাংকের এ বছরের দারিদ্র্য পর্যালোচনা সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত এক দশকে আমাদের দারিদ্র্য কমে এসেছে অর্ধেকে। খাদ্য উৎপাদনে গত কয়েক বছরে আমরা আশাতীত উন্নতি করেছি। মানব উন্নয়ন সূচকেও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আমাদের অবস্থান বেশ ভালো। এ পটভূমিকায় সহজেই এমন আত্মতৃপ্তি আসতে পারে যে আমাদের পুষ্টি-পরিস্থিতিও তাহলে নিশ্চয়ই যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক।

৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন সেই আশাব্যঞ্জক অনুমানে ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়েছে। খবরটি বলছে, দেশের প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে না। এর আগে ৪ নভেম্বর প্রথম আলো ‘খাদ্য উৎপাদন ও অপুষ্টি দুটোই বেড়েছে’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেই প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন তিন থেকে পাঁচ গুণ বাড়া সত্ত্বেও গত এক বছরে দেশে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা মোটেই কমেনি, বরং বেড়েছে আরও চার লাখ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি’ এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার ‘বৈশ্বিক ক্ষুধাসূচক’-এর প্রতিবেদনের ভিত্তিতে করা এ প্রতিবেদন বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলঙ্কা, ভুটান, নেপাল ও মালদ্বীপের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যশক্তি গ্রহণের পরিমাণ কম। শুধু খাদ্যশক্তিই নয়, মাংস ও দুধের মতো পুষ্টিকর আমিষ গ্রহণের দিক থেকেও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। এর অনিবার্য ফলাফল অপুষ্টি। এ অপুষ্টির সবচেয়ে করুণ শিকার শিশু এবং গর্ভবতী ও প্রসূতি মা, যাঁরা আমাদের ক্রম–উন্নতিশীল এ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ রচনা করছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ওয়েবপেজে সম্প্রতি প্রকাশ পাওয়া ‘প্রগতির পথে’ নামে অন্য আরেকটি জরিপের প্রারম্ভিক প্রতিবেদনের দিকে চোখ ফেরানো যাক। ইউনিসেফের কারিগরি সহযোগিতায় পরিচালিত এই প্রতিবেদন আমাদের দিচ্ছে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষাসহ মানব উন্নয়নের কয়েকটি সূচকের সাম্প্রতিক ছবি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সামগ্রিকভাবে শিশুর পুষ্টিপরিস্থিতির উন্নয়ন দৃশ্যমান হলেও বেশ কিছু গুরুতর প্রচ্ছন্ন ঝুঁকি এখনো রয়ে গেছে, এমনকি শিশুপুষ্টির গুরুত্বপূর্ণ কিছু সূচকের ধারাও অবনতির দিকে। যেমন, শিশু জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে মায়ের দুধ দান, দুধদানের ব্যাপ্তিকাল ও শিশুখাদ্যের বৈচিত্র্য—এই তিনটি সূচকেই গত ছয় বছরে অবস্থার অবনতি ঘটেছে। ২০১৩ সালে জন্মের পরপরই শিশুকে শালদুধ খাওয়াতেন ৫৭ শতাংশ মা। ২০১৯ সালে সেটি নেমে এসেছে ৪৬ শতাংশে। কমে এসেছে মায়ের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপ্তিকালও। এ ছাড়া প্রতি দশটি শিশুর মধ্যে সাতজনের ভাগ্যেই ন্যূনতম পুষ্টিবৈচিত্র্যময় খাবার জুটছে না।

আমরা জানি, শিশুর জন্মের পরপরই শালদুধ দান, ছয় মাস বয়সের পর পুষ্টির বিচারে বৈচিত্র্যময় খাবার এবং পুরো দুই বছর পর্যন্ত মায়ের দুধ খাওয়ানো শিশুর পূর্ণ বিকাশের আবশ্যিক শর্ত। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, এসব যথাযথভাবে করা গেলে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ যথাযথ ও দ্রুত হয়। সে বুদ্ধিদীপ্ত ও সক্ষম মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে। এ কারণে চিকিৎসক, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ এবং নীতিনির্ধারকেরা এই সূচকগুলোর ওপর খুবই গুরুত্ব দিচ্ছেন। বাংলাদেশের মতো স্বল্প সম্পদের দেশ শুধু এই সূচকগুলোর সাফল্যের মধ্য দিয়ে শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি ও সংক্রামক রোগের ঝুঁকি দারুণভাবে কমিয়ে আনতে পারে। দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য নতুন প্রজন্ম তৈরি করারও এটিই মূল ভিত্তি। চীনের অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে আমাদের উদাহরণ হতে পারে।

প্রশ্ন হলো গত ছয় বছরে এসব সূচকে আমাদের পিছিয়ে পড়ার কারণ কী? সেভ দ্য চিলড্রেনের বছরখানেক আগের একটি প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে অযাচিত অস্ত্রোপচার-নির্ভর প্রসবের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদির অভাবে প্রসূতি ও শিশুর উল্লেখযোগ্য অংশ আক্রান্ত হয়ে পড়ছে বিভিন্ন সংক্রামক রোগে। ফলে জন্মের পরপর শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানো যাচ্ছে না। অস্ত্রোপচারের পর মায়ের চেতনা ফেরার আগে শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর জন্য যে দক্ষ আর উদ্যোগী স্বাস্থ্যকর্মী দরকার, দেশে তার প্রকট অভাব। শালদুধ নিয়েও অজ্ঞতা ও কুসংস্কার ব্যাপক। বাংলাদেশে ঘরে সন্তান প্রসবের সংখ্যা এখনো যথেষ্ট এবং সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রীদের মধ্যেও শালদুধ নিয়ে কুসংস্কার কাটেনি।

শিশুকে মায়ের দুধ ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর ব্যাপ্তিকাল যে ২০১৩ সালের চেয়েও কমে এসেছে, তার কারণ জটিল। দেশের অর্থনীতিতে নারীদের সম্পৃক্ততা বেড়েছে। এতে নারীদের আত্মনির্ভরশীলতা এবং পারিবারিক সচ্ছলতাও এসেছে। কিন্তু নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র এবং সামাজিক সুরক্ষা-বলয়ের অভাব মা ও শিশুর সম্পর্ককে জটিল সমীকরণের দিকে ঠেলে দিয়েছে। মায়ের কাছাকাছি থাকতে না পারায় বহু শিশু বঞ্চিত হচ্ছে মায়ের দুধ ও সঠিক পুষ্টিকর খাবার থেকে। আমাদের দেশে কর্মক্ষেত্রে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র তো দূরস্থান, অনেক প্রতিষ্ঠানে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটিও দেওয়া হয় না। ফলে বহু মা সন্তানকে দুই বছর তো দূরের কথা, ছয় মাসও দুধ দিতে পারেন না। তার জায়গা দখল করে নেয় কৌটার দুধ, যা পুষ্টির বিচারে মায়ের দুধের কোনো বিকল্পই হতে পারে না। আর নিম্নবিত্ত মায়েরা তো কৌটার দুধের বদলে শিশুর খিদে মেটান চালের গুঁড়া বা সুজিজাতীয় শর্করায়। দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক বেড়ে ওঠে প্রয়োজনীয় আমিষ, চর্বি, ভিটামিন আর মিনারেল ছাড়াই। এখনো আমাদের নিয়তি তাই প্রতি পাঁচটিতে একজন খর্বকায় এবং প্রতি নয়টিতে একজন কৃশকায় শিশু।

এখন আমরা করবটা কী? সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হয়ে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং কৌটার দুধের প্রচারের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ ঘটাতে হবে। কর্মক্ষেত্রগুলোতে দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্যোগী করে তোলা প্রয়োজন। চিকিৎসক বা নার্স থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যকর্মী-মাঠকর্মী-ধাত্রীদের শিশুর পুষ্টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ তো দিতেই হবে। বস্তুত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতি দিতে হলে অপুষ্টি নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতি গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন দরকার। এটা করতে হবে মাঠপর্যায় থেকে উঠে আসা নিয়মিত পরিসংখ্যান ও তথ্যের নিবিড় বিশ্লেষণের ভিত্তিতে। বহু খাতভিত্তিক সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা মাঠকর্মী বা ধাত্রীদের মাধ্যমে এ পরিস্থিতির খোলনলচে পাল্টাবে না।

  • আসফিয়া আজিম: জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টিকর্মী
  • কার্টসি- প্রথম আলো/ ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯

রাজাকারের তালিকা ও ইতিহাস বিকৃতির দায়

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
সায়ন্থ সাখাওয়াৎ

‘দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে শহীদ হয়েছেন। অথচ এত বছর পর রাষ্ট্র আমাকে ও আমার মাকে রাজাকারের খেতাব দিল। এই লজ্জা, এই দুঃখ কোথায় রাখব? এখন আর বেঁচে থেকে কী লাভ?’ একজন মুক্তিযোদ্ধার এই যে আক্ষেপ, এই যে বেদনা, তার রচয়িতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবিদার আওয়ামী লীগ।

কিছুদিন আগেই ‘যারা আমার ছেলেকে চাকরিচ্যুত করেছে, পেটে লাথি মেরেছে, শেষযাত্রার কফিনে তাদের সালাম, স্যালুট আমি চাই না’ চিরকুট লিখে বুকভরা অভিমান নিয়ে, রাষ্ট্রীয় সম্মান না নিয়েই চিরবিদায় নিয়েছেন দিনাজপুরের মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন। এমনি বহু জানা-অজানা অপমানের বেদনা বয়ে বেড়াতে হয়েছে বা হচ্ছে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকেই।

মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করেছিল বরিশালের আইনজীবী সুধীর কুমার চক্রবর্তীকে। তার ছেলে আইনজীবী তপন কুমার চক্রবর্তী একজন গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রথম ধাপে ১০ হাজার ৭৮৯ রাজাকারের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে তপন কুমার একজন রাজাকার! একই তালিকায় রাজাকার বানানো হয়েছে তার মা প্রয়াত ঊষা চক্রবর্তীকেও। এ তালিকায় এমন সব ব্যক্তির নামও আছে, যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে পরিচিত। এসেছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার নামও (প্রথম আলো, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯)।

তপন কুমার চক্রবর্তীর মেয়ে মনীষা চক্রবর্তী পেশায় চিকিৎসক এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের বরিশাল জেলা শাখার সদস্যসচিব। তিনি বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ধমক ও মাস্তানি উপেক্ষা করেও মেয়র প্রার্থী হয়েছিলেন। তার বাপ-দাদাকে আওয়ামী লীগ রাজাকার বানাবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ আওয়ামী লীগের দৃষ্টিতে তাদের মতের বাইরে সবাই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী। কাদের সিদ্দিকী, ডক্টর কামাল হোসেনকে পর্যন্ত যেখানে রাজাকার বলা হয়, একজন সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক জিয়াউর রহমানকে পর্যন্ত যেখানে পাকিস্তানের চর বলা হয়, সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে রাজাকার তকমা দেওয়া হয় অবলীলায়, সেখানে মনীষার বাবা বা দাদি বাদ যাবেন কেন! তবে এই যে যা খুশি তাই করতে পারছে আওয়ামী লীগ, সে জন্য আমরাও কম দায়ী নই। আমরা যদি ওই ব্যক্তিদের বিষয়ে মানহানিকর কথা বলার সময় একযোগে সঠিক প্রতিবাদটা করতাম, তাহলে হয়তো এ অবস্থা তৈরি হতো না।

কিন্তু বরিশালের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মিহির লাল দত্ত এবং তার বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ জিতেন্দ্র লাল দত্তের নামও কেন এসেছে তালিকায়, সে এক রহস্য। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর নামইবা কেন এলো সেটাও আরেক রহস্য।

রাজাকারের তালিকায় বাবা ও দাদার নাম আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করে মিহির লাল দত্তের ছেলে শুভব্রত দত্ত বলেন, ‘আমার বাবা একজন ভাষাসৈনিক এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। আমার দাদা ও এক কাকা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। আমার বাবা ও শহীদ দাদার নাম কীভাবে রাজাকারের তালিকায় এসেছে, সেটা আমার বোধগম্য নয়।’

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় নিজের নাম দেখে হতবাক, বিস্মিত, মর্মাহত ও অপমানিত হয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু। তিনি বলেছেন, সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষ সীমাহীন অযতœ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে অত্যন্ত অবহেলার সঙ্গে যে তালিকা প্রচার ও প্রকাশ করেছে, তা প্রমাণিত। তিনি একুশে পদকপ্রাপ্ত। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী তিনি তালিকাভুক্ত ভাতাপ্রাপ্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা। মন্ত্রণালয় তাকে সনদও দিয়েছে। বর্তমান সরকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দায়িত্বটি পালনের জন্য যাচাই-বাছাই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই তাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর নিয়োগ করেছে। আর এত দিন পর জানা গেল সেই লোক রাজাকার!

কিন্তু এত্তো বড় ব্লান্ডার করার পর যখন সবাই সমালোচনামুখর, তখন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলে দিলেন, আমরা না, রাজাকারের এই তালিকা পাকিস্তানিরা করেছে। আমরা নিজেরা কোনো তালিকা প্রস্তুত করিনি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা যে তালিকা করেছে, আমরা শুধু তা প্রকাশ করেছি। সেখানে কার নাম আছে আর কার নাম নেই, সেটা আমরা বলতে পারব না।

স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও এসে একাধারে এগারো বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও যদি পাকিস্তানের করা রাজাকারের তালিকা কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রকাশ করতে হয়, তাহলে এটা বুঝতে আর বাকি থাকে না যে, এ দলটি মুক্তিযুদ্ধেও প্রকৃত ইতিহাস রক্ষণাবেক্ষণ না করে অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল।

আসলে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আওয়ামী লীগের প্রকৃত দরদ কতটা আর তাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানোর কৌশল কতটা, সে প্রশ্নও কেউ কেউ তুলছেন। ১৯৭১ থেকে ৭৫ এবং ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল ক্ষমতায় থেকেও এই দলটি মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আলাদা একটি মন্ত্রণালয় করার কথাও ভাবেনি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কল্যাণ তহবিল পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে ২০০১ সালের ২৩ অক্টোবর এই মন্ত্রণালয়টিও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকারই গঠন করেছিল। জিয়াউর রহমান যুদ্ধের যে ঘোষণাটি দিয়েছিলেন, তা মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সে কারণেই জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দল গঠনের পর তার সঙ্গেই শামিল হয়েছিলেন ব্যাপকসংখ্যক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, যারা তাস খেলে আরাম আয়েশে থেকে সার্টিফিকেট নেননি। যুদ্ধের ময়দানে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যুদ্ধ করেছেন।

রাজাকারের তালিকা ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানিত করার প্রেক্ষাপটে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন। আওয়ামী লীগের কারা কারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাদের তালিকা প্রকাশ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আজকে আওয়ামী লীগের হাতেই গণতন্ত্র নিহত হয়েছে, যারা দাবি করে তারাই স্বাধীনতাযুদ্ধের একমাত্র ধারক-বাহক।

আওয়ামী লীগের এই যে চেতনার দোহাই, এই যে মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় সম্পদ বানিয়ে কুক্ষিগত করা, তার পেছনে যে আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, সেটা পরিষ্কার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা তো সংবিধানেই আছে। ‘... আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে;।’ ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্র্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’ এই তো সংবিধানে সন্নিবেশিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এগুলো কি রক্ষা করছে আওয়ামী লীগ সরকার? এ দেশে তাদের সমর্থকরা ধনী থেকে আরও ধনী হচ্ছে। আবার অন্যদিকে সাধারণ জনগোষ্ঠী আরও গরিব হচ্ছে। বিশ্বের অতিদরিদ্র পাঁচটি দেশের মধ্যেও বাংলাদেশ একটি হচ্ছে। তাহলে কীসের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলো? এই দেশে কি আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হয়েছে? এই দেশ কি জনগণের হয়েছে? বরং এসব কিছু লাঞ্ছিত হয়েছে আওয়ামী লীগের হাতে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে না দেওয়ায় দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে একটা দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। আর সেই দেশে সেই দল আওয়ামী লীগ মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিল! মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংসকারী এর থেকে বড় কাজ আর কী হতে পারে?

এই দেশ স্বাধীন করতে যে ত্রিশ লাখ মানুষ শহীদ হলেন, তাদের পরিবারের খোঁজ কি রাখে এই সরকার? ত্রিশ লাখের মধ্যে ঠিক কতটা পরিবার পাচ্ছে রাষ্ট্রীয় সুবিধা? সেটা মোট শহীদের কত শতাংশ? কেন এত বছরেও মুক্তিযুদ্ধে প্রকৃত শহীদের তালিকাটি করা গেল না? জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে কি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান কম? তাহলে জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা যে সম্মান ও সুবিধা পাচ্ছেন, তেমনি তালিকা করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদেরও কেন সম্মান ও সুবিধা দেওয়া হবে না? একসময় সে তালিকা করা হয়তো আরও দুরূহ হয়ে পড়বে। এখনো সময় আছে। প্রত্যেক ইউনিয়নভিত্তিক শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা করে তাদের নামফলক দেওয়া যেতে পারে ইউনিয়ন পরিষদের সামনে। শত বছর, সহস্র বছর পরও যাতে ওই এলাকার মানুষ জানতে পারে এই দেশটি স্বাধীন করতে তাদের কোন কোন বীর স্বজন জীবন দিয়েছেন। এদিকে হয়তো যাবে না এ সরকার। কারণ এখানে চেতনার বাণিজ্য হওয়ার সম্ভাবনা কম।

আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ ও তার চেতনাকে ভুলভাবে বহুল ব্যবহার করে এটাকে রীতিমতো হাস্যকর করে ছেড়েছে। এই যে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করল, এটা তো সরকারি দলিল। এর মাধ্যমে কি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিকৃতি করা হয়নি? শুধু ভুল স্বীকার করে তালিকা প্রত্যাহারই কী যথেষ্ট?

মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী বিদেশি বন্ধুদের দেওয়া ক্রেস্টে ভেজাল নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল ২০১৪ সালে। তখন একটি জাতীয় দৈনিকে লেখক কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছিলেন, ‘পৌনে তেরো আনাই খাদ’। আসলে শুধু ক্রেস্টের সোনায় নয়, আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একক মালিকানার দাবির অন্তত পৌনে তেরো আনাই খাদ।

  • লেখক, চিকিৎসক ও কলামনিস্ট
  • কার্টসি - দেশ রূপান্তর / ডিসেম্বর ১৯ , ২০১৯

Tuesday, December 17, 2019

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন অবশ্যই প্রশাসনিক ও প্রায়োগিক হতে হবে

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ


ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

একটি দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা ভীষণ তাত্পর্যপূর্ণ। অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে এর নিবিড় সংযোগ বিদ্যমান এবং অন্যান্য খাত যেমন—ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্প, রফতানি, আমদানির পাশাপাশি অধিক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতিতে আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। যেকোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের প্রভাব এড়াতে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং অধীনস্থ ব্যাংকের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকারিতা সরাসরি সংস্থাটির স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত।

বিষয়টি প্রশাসনিক সমস্যাকে ঘনীভূত করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার আধুনিক ধারণাটি বিকশিত হয়। ১৯২৯-৩৯ সালের মহামন্দার পর আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা ও লক্ষ্য নির্ধারণ এবং আর্থিক নীতি সম্পাদনের ক্ষমতা দেয়। ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে মূল্যস্ফীতির জোয়ারের ফলে বেশির ভাগ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের নীতিগুলো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে সফল হয়। তবে সে সময় প্রেসিডেন্ট রিগানের চিফ অব স্টাফ ডোনাল্ড রেগান যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের চেয়ারম্যান পল ভলকারকে ১৯৮৪ সালের নির্বাচনের আগে নীতিমালার হার না বাড়ানোর পরামর্শ দেন। বিনা বাক্য ব্যয়ে সেদিনের মিটিং থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন ভলকার, তবে সে পরামর্শ মোতাবেক নীতি গ্রহণ পরবর্তী সময়ে স্বল্প মূল্যস্ফীতি ও স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণ হয়। ফলস্বরূপ অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকার কর্তৃক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার ওপর জোর দেয়া হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার বিষয়টি বিবেচনা করা হয় গুরুত্বপূর্ণ দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে। প্রথমটি স্বাধীনতার লক্ষ্য, দ্বিতীয়টি কার্যসম্পাদনে স্বাধীনতা। স্বাধীনতা সম্পর্কিত বিষয়গুলোয়, বিশেষ করে সরকারের অন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তুলনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথেষ্ট পরিমাণ স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করে। প্রধান লক্ষ্যগুলো, বিশেষ করে মূল্য স্তর (মূল্যস্ফীতি) ও প্রবৃদ্ধির রক্ষণাবেক্ষণকে সাধারণত প্রধান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যা-ই হোক, প্রবৃদ্ধি হার এবং মূল্যস্ফীতির হার আর্থিক স্থিতিশীলতা ও দ্রুততর প্রবৃদ্ধি অর্জনে সরকারের বিস্তৃত নীতি পরামর্শ দ্বারা নির্ধারিত হয়। আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক (ফেড) সম্ভবত সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করে। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ব্যাংক অব ইংল্যান্ড রাজস্ব দপ্তরের মন্ত্রীদের দ্বারা প্রভাবিত থাকায় পুরোপুরিভাবে স্বাধীন ছিল না। ইউরো ব্যবহারকারী দেশগুলোর হয়ে সুদের হার পর্যবেক্ষণ করে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটি ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত স্বাধীন ছিল। তবে বর্তমানে আমেরিকা সরকার সুদের হার কমানোর জন্য ফেডের ওপর যারপরনাই চাপ প্রয়োগ করছে, যা ফেডকে ঘিরে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের লক্ষণ। ব্যাংক অব জাপান ২০১৩ সালে সরকারের সঙ্গে নীতি সমন্বয় করতে রাজি হয়, পদক্ষেপটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা হ্রাস করে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার বিষয়টি বিতর্কযোগ্য, তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা-ই হোক না কেন, ব্যাংকের লক্ষ্য অর্জনের জন্য, বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নত আর্থিক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব ধরনের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া জরুরি। তাই ব্যাংককে তার সব কার্যকরী ও সিদ্ধান্তগত কার্যক্রমে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন হতে হবে।

পারস্পরিক নির্ভরতাবিষয়ক প্রশ্নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে কৃতিত্ব দেয়া থেকে বিরত থাকতে সক্ষম হবে; এটি সরকারের ওপর নির্ভর না করেই তার ব্যয় নির্বাহ করতে পারে কিনা; গভর্নর কিংবা পরিচালক পর্ষদ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে কিনা; মুদ্রানীতি অনুসরণে গভর্নর স্বাধীন কিনা; আর্থিক সরঞ্জাম নির্বাচনে এটি কতটা স্বাধীন, সর্বোপরি এটি ব্যাংকিং নীতি ও ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি প্রভাবমুক্ত কিনা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদানের মাধ্যমে রাজনৈতিক, সামষ্টিক অর্থনীতি এবং অর্থ সংক্রান্ত—এ তিনটি বিষয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হতে পারে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ততা মূল্যের স্থিতিশীলতা, স্বাধীন পরিচালক পর্ষদ যারা দীর্ঘ সময়ের জন্য নির্বাচিত হবেন, যাদের অন্যদের থেকে পৃথক করা হবে, সংসদ ও আইনসভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপের জবাবদিহিতা এবং বিরোধ নিষ্পত্তির সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া ইত্যাদি লক্ষ্যকে ধারণ করবে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই মুদ্রা ও বিনিময় হার নীতি গঠনের ইঙ্গিত দেয়। আর্থিক স্বাধীনতা জোর দেয় হিসাবের স্বচ্ছতা, বিচক্ষণতার নীতি অনুসরণ, আর্থিক ভর্তুকি যেমন পছন্দসই সুদের হার, বিনিময় হারের গ্যারান্টি, নগদ অলাভজনক বিতরণ ও লোকসানের সংযোগ সীমাবদ্ধকরণ এবং ব্যাংকের নিট সম্পদ। সুতরাং স্বায়ত্তশাসন অবশ্যই প্রশাসনিক ও প্রায়োগিক হতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে আর্থিক নীতি সম্পাদন, ব্যাংকারদের ব্যাংক, সরকারের ব্যাংকার ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তত্ত্বাবধান। ব্যাংক অব ইংল্যান্ড (বিওই) মূলত মুদ্রানীতিমূলক কার্যাদি নিয়ে কাজ করে, এছাড়া অন্যান্য কার্য প্রুডেনশিয়াল রেগুলেশন অথরিটি (পিআরএ) এবং ফিন্যান্সিয়াল কন্ডাক্ট অথরিটি (এফসিএ) কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়; যারা সার্বিকভাবে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের নির্দেশনা অনুসারিত এ দুটি স্বতন্ত্র সংস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই দ্বৈত কার্যাদি সম্পাদন করতে হয়। সুতরাং এর কাজের পরিধি বিশাল। অন্য সেক্টরগুলোর পাশাপাশি সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্ষমতা নিবিড়ভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পারফরম্যান্সের সঙ্গে সংযুক্ত।

নিচে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো উল্লেখ করা হলো, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজগুলোকে বর্ণনা করে।

লক্ষ্য: কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে ক্রমাগত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ নৈতিক মানসম্পন্ন দক্ষতা এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পেশাদারিত্ব অর্জন, মূল্য স্থিতিশীলতা ও আর্থিক ব্যবস্থার দৃঢ়তা বজায় রাখতে আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক খাতে তদারকি, দ্রুত ও বিস্তৃত অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সমর্থন, কর্মসংস্থান তৈরি এবং বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন।

উদ্দেশ্য: দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্দেশ্য অনুসারে নিম্নে উল্লিখিত কার্য সম্পাদন করে চলেছে:

১. আর্থিক ও ঋণ নীতিমালা প্রণয়ন; ২. মুদ্রা পরিচালনা ও পেমেন্ট সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ; ৩. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিচালনা করা এবং বৈদেশিক মুদ্রার বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং ৪. ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি, অর্থ, মুদ্রা এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক নীতিসম্পর্কিত ক্রিয়াকলাপ ও প্রভাব সম্পর্কে সরকারকে পরামর্শ দান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো যথাযথ হলেও এগুলোকে কার্যে পরিণত করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রসঙ্গে মূল তর্কটা হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিতর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে রাজনৈতিক চাপ ছাড়াই আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং কোনো ধরনের রাজনৈতিক ও কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ছাড়াই আর্থিক নীতি বাস্তবায়িত করতে পারে কিনা। বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃত্বগত সীমাবদ্ধতা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, নন-পারফর্মিং লোন বৃদ্ধি, সুশাসনের ঘাটতি ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার পরিণতি হিসেবে ব্যাংকের ওপর থেকে জনগণের আস্থা কমেছে। অবস্থা বিশ্লেষণে মনে হয় যে বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত অভ্যন্তরীণ (ব্যাংকের মধ্যকার সমস্যা) এবং বাহ্যিক (ব্যাংকের পরিধির বাইরে) উভয় ধরনের প্রতিবন্ধকতার কারণে ব্যাংকিং খাতে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা কঠিন বলে মনে হচ্ছে। চাপ প্রদানকারী সংগঠনগুলো যেমন ব্যাংক মালিকদের সমিতি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার (বিএবি), ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন অ্যাসোয়িসেশন অব ব্যাংকার, বাংলাদেশ (এবিবি) ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি ব্যাংকের স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ভারসাম্য তৈরির বিষয়টি চিহ্নিত করা জরুরি। যার মানে ব্যাংককে অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ কিংবা পুরোপুরি তাদের হাতে স্বাধীনতা ছেড়ে দেয়া উচিত নয়, যা প্রায়ই ব্যাংকিং বিপর্যয়ের কারণ হয়। অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী ফরাসি অর্থনীতিবিদ জাঁ তিহল তার সহকর্মীকে নিয়ে যৌথভাবে লেখা একটি বইয়ে বিষয়টিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আর্থিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমরা কী অর্জন করতে যাচ্ছি, তা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আমানতকারী, বিনিয়োগকারী, সাধারণ জনগণ এবং প্রকৃত অর্থনীতিকে (প্রকৃত পণ্য ও পরিষেবা) সুরক্ষিত করা। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় যুক্তিটি হচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মতান্ত্রিক ঝুঁকির ডমিনো ইফেক্ট (ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকা প্রভাব) হ্রাস করা, যা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভিত্তি নষ্ট করে প্রকৃত আউটপুট, নিম্ন প্রবৃদ্ধি, উচ্চ বেকারত্ব এবং মানবকল্যাণ কার্যক্রম হ্রাসের পরিণতি ডেকে আনে। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান সংকট প্রসঙ্গে এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা আমাদের দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতির সবচেয়ে যথাযথ উদাহরণটি হচ্ছে সোনালী ও বেসিক ব্যাংকে কেলেঙ্কারি; যেখানে ঋণগ্রহীতা এবং ব্যাংক কর্মকর্তাদের আঁতাতে অস্বচ্ছ পন্থায় জনসাধারণের বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। এ ধরনের জালিয়াতির জন্য যারা দায়ী, তাদের এখন পর্যন্ত কোনো শক্তিশালী প্রশাসনিক ও আইনি পদক্ষেপের আওতায় আনা হয়নি, বরং তাদের ‘বিকৃত প্রণোদনা’ দেয়া হয় এবং ওই ব্যাংক কিংবা অন্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সৎ কর্মীদের প্রান্তিকীকরণ করা হয়েছিল।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ‘দ্বৈত’ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বিদ্যমান। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক যেমন সোনালী, রুপালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক এবং বেসিক ব্যাংকের মতো বিশেষায়িত ব্যাংক (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র, শিল্প ও বাণিজ্যিক ব্যাংক লিমিটেড), বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি), বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) এবং কয়েকটি সংবিধিবদ্ধ ব্যাংক যেমন আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক আর কর্মসংস্থান ব্যাংকগুলো অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। অন্যদিকে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিদেশী ব্যাংক, ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। নিয়ন্ত্রণের এ দ্বৈততার ফলে সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোর জন্য অসমন্বয়সাধিত ও প্রায়ই দুর্বল নীতিগত পদক্ষেপ গৃহীত হয়। ওই ব্যাংকগুলোয় বিচক্ষণ ও পরিচালনা মান কার্যকর করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের গুরুতর সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা ‘ডমিনো ইফেক্ট’-এর মাধ্যমে গোটা ব্যাংকিং খাতকে দুর্বল ও অরক্ষিত করে তুলছে। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র অর্থনীতি কোনোভাবেই বিশ্বব্যাপী মন্দা অথবা বৃহত্তর অর্থনীতির নেতিবাচক নীতি থেকে প্রভাবমুক্ত নয়, সুতরাং বিশ্বব্যাপী স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক বিকাশের একটি শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। 

জি২০-এর মতো ফোরামে বাংলাদেশের সমপর্যায়ের রাষ্ট্রগুলোকে পুনরুদ্ধারের মতো স্থিতিশীলতায় একই ধরনের অগ্রাধিকার প্রাপ্তির পাশাপাশি লক্ষণ মোকাবেলার বাইরে স্থিতিশীল কাজের এজেন্ডার জন্য (যেমন ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় অক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির অপ্রতুলতা) অন্তর্নিহিত কারণগুলো সম্বোধন করতে (যেমন শিথিল নীতি, বিচক্ষণতা ও পরিচালনার মান না মেনে চলা, দুর্বল আর্থিক প্রতিবেদন, নিরবচ্ছিন্ন তারল্য প্রসারণ, যা বুদ্বুদগুলোকে সঞ্চারিত করে) জোরালো যুক্তি প্রদান করতে হবে। ২০০৭-০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের নেপথ্য কারণ ছিল বড় ধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থতা, ধসটি নিয়ন্ত্রণের মৌলিক বিষয়গুলো থেকে বেরিয়ে বিচক্ষণতা ও পরিচালনা মান বাস্তবায়নের বাইরে চলেছে। একটি স্বাধীন ও কার্যকর বাংলাদেশ ব্যাংক রাখার জন্য তিনটি বড় পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজনীয়: (১) ব্যাংকিংয়ের মূল বিষয়গুলোকে আরো বেশি স্পষ্টভাবে তুলে ধরে একটি শক্তিশালী ও স্বতন্ত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংক, (২) বহিরাগত রাজনৈতিক/ প্রশাসনিক চাপের কারণে ঘন ঘন পরিবর্তনের সাপেক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিচক্ষণ ও পরিচালনার মানদণ্ডগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন এবং (৩) সংকট তৈরির জন্য এবং একটি নির্দিষ্ট ব্যাংকে বা গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সংকটের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি/ প্রশাসনিক পদক্ষেপের জন্য তাত্ক্ষণিক সংশোধনমূলক ব্যবস্থা।

বাস্তববিশ্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা ও পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন সহজেই অর্জিত হয় না। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর উচিত রাজনৈতিক ও অন্যান্য বাহ্যিক চাপ কমাতে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং নিজেদের কর্মকাণ্ড ঘিরে জনসমর্থন অর্জনে সচেষ্ট হওয়া। ভালো বা খারাপ সময় যা-ই হোক না কেন, তত্ত্বাবধায়করা সর্বদা লবিস্ট ও রাজনীতিবিদদের দ্বারা চাপের মুখোমুখি হন, যা আর্থিক ব্যবস্থার স্থায়িত্বকে দুর্বল করতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণে সফল হওয়ার জন্য প্রাসঙ্গিক ও বাস্তববাদী নীতি, বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনা বিধি থাকতে হবে এবং তা নিশ্চিত করতে হবে, সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তা অনুসরণ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন রক্ষার জন্য ‘বিশেষ ব্যবস্থা ক্ষমতা’ বা ‘অ্যাড-হক’ ব্যবস্থা এড়ানো উচিত। ‘নীতি’ বনাম ‘বিশেষ ব্যবস্থা’ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংককে দৃঢ়তার সঙ্গে সমাধান করতে হবে, যেখানে নীতি ও বিধিগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে—কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার অযৌক্তিক ক্ষমতা প্রয়োগ চলবে না। উচ্চ প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংস্কারের বিপদ এড়াতে যথাযথ পেশাদারি অবস্থান প্রদর্শনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভারসাম্য বজায় রাখার সময় এসেছে।

  • ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অধ্যাপক/বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
  • কার্টসি  —  বণিক বার্তা/ ডিসেম্বর ১৫, ২০১৯

‘শেষ আপিলে দোষী না হওয়া পর্যন্ত আসামি মুক্ত থাকবে’

মইনুল হোসেন



ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্ট বিচারাধীন আসামিকে জেলে রাখার বাধ্যতামূলক বিধান বাতিল করে দিয়েছে। ফলে সাবেক প্রেসিডেন্ট লুলাসহ হাজার হাজার বন্দী উপকৃত হবে।

শেষ আপিলে সাজাপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত অপরাধীদের জেলে পাঠানোর আইন ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্ট গত নভেম্বর মাসে পরিবর্তন করে দেয়ার ফলে দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে কারাবন্দী ব্রাজিলের সাবেক বামপন্থী প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাশিও লুলা দ্য সিলভা মুক্তিলাভ করেছেন।

আলজাজিরার রিপোর্ট মতে, ব্রাজিলের পেনাল কোডের এই নতুন ব্যাখ্যা অনুযায়ী যেসব সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর আপিল এখনো শেষ হয়নি এরকম কয়েক ডজন বড়মাপের আসামি উপকৃত হবেন যাদেরকে গত বছর দুর্নীতির অভিযোগে জেলে যেতে হয়েছিল।

স্মরণীয়, ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিজয় অনুকূলে থাকার পরও ২০০৩ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনকারী প্রধান বামপন্থী নেতা, যার বয়স এখন ৭৪ বছর, নির্বাচনে লড়তে পারেননি কারাদণ্ড ভোগের কারণে।

একাধিক প্রকৌশলী সংস্থাকে সরকারি কাজ দেয়ার বিনিময়ে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রেসিডেন্ট লুলাকে আট বছর ১০ মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। প্রেসিডেন্টের মতো আরো অনেকে এখন কারাগারের বাইরে মুক্ত জীবনের স্বাদ পাবেন।

ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টের এই যুগান্তকারী রায় অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াইকারীদের মধ্যে যুক্তি ও চিন্তার খোরাক জোগাবে। এই রায়ের পেছনে যে যুক্তি রয়েছে সেটা অনস্বীকার্য। শেষ বিচারে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কারো কারাদণ্ড ভোগ করার অর্থ চূড়ান্ত বিচারে দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগেই অন্যায়ভাবে শাস্তি ভোগ করা। আদালতের শেষ বিচারে যদি দেখা যায় তিনি কোনো অপরাধ করেননি এবং তিনি নির্দোষ তাহলে তার কারাগারে বন্দী জীবন কাটানোর সময়ের জন্য কী করা হবে? জীবনের হারানো অংশ ফেরত দেয়ার কোনো পথ নেই।

কারাজীবনের ক্ষতি কিংবা পরিবার-পরিজনের ভোগান্তি পুষিয়ে দেয়ার কোনো উপায় নেই। আর্থিক ক্ষতিপূরণও যথেষ্ট হতে পারে না।

শেষ বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো বিচারাধীন বন্দীকে জামিনে মুক্ত থাকার অর্থই তো সে জামিনের শর্ত অনুযায়ী সদাচরণ করবে এবং শেষ বিচারে শাস্তি হলে তার উপস্থিতি নিশ্চিত থাকবে। এটাই তো হবে ন্যায়বিচারের কথা।

অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধ চূড়ান্ত বিচারে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে সাজা ভোগে বাধ্য করার কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। কিন্তু তারপরও নানা সমস্যার কথা তোলা হয় যাতে পুলিশি গ্রেফতারকে জেলে রাখার জন্য চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করা হয়।

অভিযুক্তকে অপরাধী হিসেবে দেখা হয় কেননা শাস্তি প্রদানের এক ধরনের নিষ্ঠুর মানসিকতায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। বন্দী থাকতে গিয়ে তার যে মৌলিক অধিকারগুলো এবং বন্দিজীবনের অবমাননাসহ আরো কতভাবে যে তার ক্ষতি হচ্ছে তা ভাবা হয় না। তার জীবিকা অর্জনের পথ বন্ধ হয়ে যায়। সমগ্র সমাজের কাছে তাকে এবং তার ঘনিষ্ঠদের হেয় হয়ে থাকতে হয়।

এসব হতভাগ্যদের নিয়ে সমাজের উচ্চাসনে যারা বসে আছেন তারা মনে করেন আইনের ঊর্ধেŸ থাকার ভাগ্য নিয়ে তারা জন্মগ্রহণ করেছেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের জন্য কোর্টে হাজির করলেই মনে করা হয় তারা অপরাধ করা লোক।

নিন্ম আদালতের সাথে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে মন-মানসিকতার এক বিরাট ব্যবধান রয়েছে। বিচার ব্যবস্থা বিচার ব্যবস্থাই। অসহায় গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির পক্ষে জজ-বিচারকদের তো থাকতেই হবে। এটাই তো সুবিচারের কথা যে অভিযুক্তকে নির্দোষ হিসেবে দেখতে হবে।

শেষ বিচারিক আদালতে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্তকে নিরপরাধ বলে গণ্য করতে হবে এবং আইন ও বিচারে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে অপরাধী বলা যাবে না। শেষ কথা বলা যাবে চূড়ান্ত বিচার শেষ হওয়ার পর। চূড়ান্ত বিচার শেষ হওয়ার আগে কেন অভিযুক্তকে অপরাধী হিসেবে দেখা হবে? কেন তার ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করা হবে? চিন্তা-ভাবনা করে এসব বিচারসংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে জজ-বিচারকদের।

এদিক থেকে দেখলে ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টের রায়কে যুগান্তকারী রায় বলতে হবে। বিচারকে ন্যায্য ও মানবিক করার চিন্তা-ভাবনা চলছে পৃথিবীর সর্বত্র। সাজার জন্য সাজা; নির্দোষ প্রমাণ করার কথা ভাবা হয় না- এটা তো পুলিশি রাষ্ট্রের মানসিকতা।

চূড়ান্ত বিচারে সাজা যদি বহাল না থাকে তাহলে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির জীবন কেন জেলে পচবে, কেন তিনি পরিবারের পরিচর্যা ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত জীবনযাপনে বাধ্য হবেন, কেন তার সব অধিকার কেড়ে নেয়া হবে, এ বিষয়ে যে কেউ যুক্তিপূর্ণ আলোচনা করতে পারেন, বোঝাতে পারেন। অধিকার হিসেবে এসব বিষয়কে আমরা যদি স্বীকার করে নিই তাহলে শেষ আপিলে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে অবশ্যই অভিযুক্তকে জেলে বন্দী রাখা অন্যায়। আপিলের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিন্ম আদালতের রায়ের কারণে কাউকে বন্দী রেখে সাজাপ্রাপ্ত হিসেবে দেখলে আপিল পর্যন্ত চলমান প্রক্রিয়াকে বিচার প্রক্রিয়া বলার সুযোগ থাকে না।

বিখ্যাত জুরিস্ট লর্ড ডেনিং বলেছেন, তিনি বিচার করতে গিয়ে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও বিচারকের মানবতাবোধ মনে রাখেন।

প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় ভয়ঙ্কর অপরাধীদের তুলনায় অনেক বেশি নিরপরাধ লোক দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। বছরের পর বছর কারাদণ্ড ভোগ করার কারণে বহু নারী-পুরুষের জীবন শেষ হয়ে গেছে আপিল শেষ হতে না হতে। ইতোমধ্যে তাদের সুখ্যাতি বিনষ্ট হয়েছে। যৌবন হারিয়ে গেছে এবং পরিবার ভেঙে গেছে। তাই দীর্ঘ কারাজীবনের পর আপিলে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার কি আর তেমন অর্থ থাকে!

প্রতিহিংসার মনোভাবদুষ্ট বিচারিক ধারণার ঐতিহ্য ভেঙে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারকগণ সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। এ কারণে অনেক বিচারক এবং আইনবিজ্ঞানী বিদ্যমান আইন ও বিচার ব্যবস্থায় মানবিক দিকের ওপর জোর দিচ্ছেন।

আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত আমরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের জামিনসংক্রান্ত আইন মেনে চলছি এবং পুলিশি শক্তির বাহাদুরি দেখানোর জন্য সেই আইনের প্রয়োগে অনেক বেশি কঠোরতা অবলম্বন করছি। শাসনতন্ত্র প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলো বা জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত মানবাধিকারগুলো তেমন কোনো গুরুত্ব পাচ্ছে না। এ জন্যই গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে হরদম জেলে পাঠানো হচ্ছে।

পুলিশি শক্তির এত বেশি অপব্যবহার করা হচ্ছে যে, রাজনীতি পুলিশি মামলার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এবং এ জন্য আদালত জামিন প্রদানে অনীহা দেখাচ্ছে। জামিন দানে অস্বীকৃতি কিংবা জামিন বাতিল করার ব্যাপারটি এখন নি¤œ আদালতের ক্ষমতা প্রদর্শনের সহজ উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে যাদের খরচ বহনের ক্ষমতা আছে তারা জামিনের কোনো সুযোগ আছে কি না, তার জন্য সুপ্রিম কোর্টে এসে ভিড় করছে।

আমাদের বিচারিক প্রক্রিয়া নিরপরাধ ব্যক্তিকে পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার করার ব্যাপারটি এতটাই সহজ করে দিয়েছে যে, যেদিন থেকে কাউকে গ্রেফতার দেখানো হবে সেদিন থেকেই সে অপরাধী। পুলিশের ইচ্ছায়ই তাকে বন্দী জীবন যাপন করতে হবে। সুতরাং এই সময়ে পুলিশের হাতে থাকবে সব ক্ষমতা এবং জনগণ থাকবে সর্বতোভাবে অসহায়।

এ ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার রক্ষায় যে নিশ্চয়তা শাসনতন্ত্রে দেয়া হয়েছ তার কতটুকু মূল্য থাকে। জামিন পাওয়ার অধিকারের ক্ষেত্রে আমরা বলতে গেলে ঔপনিবেশিক আমলের চেয়েও নিকৃষ্ট অবস্থায় রয়েছি। তখন বিচার ব্যবস্থায় রাজনীতি ছিল না।

আস্থা করার মতো নেতৃত্বের অভাবে জনগণ সংগ্রাম করার সাহস হারিয়ে ফেলেছে এমন ধারণা ক্ষমতাসীনদের যে কেউ পোষণ করতে পারেন। জনগণ তাদের মৌলিক ভোটাধিকার হারানোর ফলে সব অধিকারই অর্থহীন হয়ে পড়েছে। আমাদের মতো লোকেরা তাদের জন্য দুঃখ অনুভব করি, সেই সাথে নিজেদের জন্যও।

গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ চূড়ান্তভাবে সত্য বলে প্রমাণ করার আগ পর্যন্ত তিনি আইন ও আদালত প্রদত্ত জামিনের শর্ত অনুযায়ী অবশ্যই মুক্ত জীবনযাপনের অধিকার ভোগ করতে পারবেন। এটাই হবে মানবিক বিচার ব্যবস্থা। জামিনের আবেদন মঞ্জুর না করে পুলিশি বিচারে কাউকে জেলে আটক রাখা বিচার ব্যবস্থার জন্যও অপরাধ।

এ বিষয়ে ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিকদের চেয়ে আমাদের দেশের আইনজীবী ও বিচারকগণ সুবিচারের সৈনিকসুলভ চিন্তা-ভাবনা এখনই শুরু করতে পারেন।

  • লেখক বিশিষ্ট আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
  • কার্টসি  —  নয়াদিগন্ত / ডিসেম্বর ১৪,  ২০১৯

Thursday, December 12, 2019

সরকারি হাসপাতালে ক্রয়ে দুর্নীতি

জড়িত কর্মকর্তাদেরও কালো তালিকাভুক্ত করতে হবে

সম্পাদকীয়



সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন অফিসের কেনাকাটায় দুর্নীতিতে জড়িত সব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগটি সময়োচিত।

জানা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিশেষ অনুসন্ধান শাখার পরিচালকের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির তদন্ত চলছে। প্রথম ধাপে সরকারি অর্থ তছরুপসহ দুর্নীতির মামলা হয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানের নাম তালিকায় রাখা হচ্ছে।

বস্তুত কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হলে তার দায়দায়িত্ব ওই প্রতিষ্ঠানের ওপরই বর্তায়। তবে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান চলছে বা মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, পর্যায়ক্রমে তাদেরও আনা হবে এ তালিকায়। আমরা মনে করি, কেনাকাটায় অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও কালো তালিকাভুক্ত করা উচিত। তাহলেই এ ধরনের পদক্ষেপ দুর্নীতি রোধে সহায়ক হবে।

বস্তুত, সরকারি হাসপাতালের ক্রয়ে দুর্নীতি ও অনিয়ম একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ সরকারি হাসপাতালের অসাধু কর্মকর্তাদের একটি চক্র এ দুর্নীতির মূল হোতা।

তারা কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি করছে। হাসপাতালের জন্য যন্ত্রপাতি না কিনেই ভুয়া বিল-ভাউচারে টাকা তুলে নিচ্ছে। যে দামে যন্ত্রপাতি কিনছে, তার অনেক গুণ বেশি টাকার বিল করছে। আবার প্রয়োজন ছাড়াই মেডিকেল সরঞ্জাম কিনছে অর্থ আত্মসাতের সুযোগ তৈরির জন্য। সাম্প্রতিক সময়ে সোহরাওয়ার্দী, রংপুর ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন সরঞ্জাম ক্রয়ে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক সেট পর্দার (১৬ পিস) দাম দেখানো হয়েছে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা!

এভাবে সেখানে ১০ কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। আর রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সোয়া তিন কোটি টাকাই লোপাট করার অভিযোগ উঠেছে।

এ অবস্থায় সরকারি হাসপাতালে সরঞ্জাম ক্রয়ে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা জরুরি হয়ে পড়েছে। আর এজন্য প্রয়োজন সব ধরনের কেনাকাটার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।

ক্রয়সংক্রান্ত কমিটিতে কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রেও বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। ইতঃপূর্বে দুদকের এক সুপারিশে বলা হয়েছিল, সরকারি হাসপাতালে ওষুধ ও মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ করার জন্য ক্রয় কমিটিতে বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করা যেতে পারে।

এছাড়া হাসপাতাল পর্যায়ে যন্ত্রপাতি রিসিভ কমিটিতে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ সংস্থার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে যন্ত্রপাতি গ্রহণের ব্যবস্থা, যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার স্বার্থে দক্ষ জনবল নিয়োগ দিয়ে যন্ত্রপাতি সরবরাহের বিধান করা ইত্যাদি পদক্ষেপের কথাও বলা হয় দুদকের সুপারিশে। দুদকের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হল, হাসপাতালে বিদ্যমান মেডিকেল ইকুইপমেন্টের হালনাগাদ তথ্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা।

এক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক স্টক রেজিস্টারের সঙ্গে একটি ডিসপ্লে যুক্ত করা যেতে পারে। হাসপাতালে ই-রেজিস্টার চালু করা যেতে পারে। আমরা মনে করি, অভিযুক্তদের কালো তালিকাভুক্তির পাশাপাশি এসব সুপারিশও আমলে নেয়া উচিত। মোদ্দাকথা, সরকারি ক্রয়ের সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন, তা করতে হবে। সেই সঙ্গে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠামাত্র এর সুষ্ঠু তদন্ত করে নিতে হবে ব্যবস্থা।

  • কার্টসি - যুগান্তর/  ১১ ডিসেম্বর ২০১৯

মূল্যস্ফীতির থাবা

বাজার নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দিন

সম্পাদকীয়

এক মাসের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫৮ ভাগ। বলা হচ্ছে, দ্রব্যমূল্যের বাজারে অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতিতে। মূলত পেঁয়াজসহ মসলাজাতীয় পণ্য এবং শাকসবজির দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতির এই উল্লম্ফন ঘটেছে।

উল্লেখ্য, নভেম্বর মাসে দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৪১ শতাংশে। এটি আগের মাসে ছিল ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এর বাইরে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ, যা পূর্ববর্তী মাসে ছিল ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

বিবিএসের সিপিআই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং অক্টোবরে ছিল ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং অক্টোবরে ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ।

উদার বাণিজ্য ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বাজারের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত থাকে। শুধু এবারের ‘পেঁয়াজকাণ্ড’ নয়; অতীতেও অনেকেই সময় ও সুযোগ বুঝে বাজার অস্থিতিশীল করার নানা অপপ্রয়াস চালিয়েছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে।

যোগসাজশের মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থার স্বাভাবিক গতি যদি বাধাগ্রস্ত করা হয়, তবে একদিকে যেমন ভোক্তাস্বার্থের হানি ঘটে, অন্যদিকে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। বিগত কয়েক বছরে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ সত্ত্বেও পণ্যের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা যায়নি, যা মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ।

পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশে প্রায় প্রতিটি পণ্য ও খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি হিসাবেই গত এক বছরে চাল, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, ডাল, পেঁয়াজ ও শিশু খাদ্যের দাম ৫ শতাংশ থেকে ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

বাজারে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রয়ক্ষমতা না বাড়ায় সাধারণ মানুষ, বিশেষত নিুআয়ের শ্রমজীবীরা অসহায় বোধ করেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন উচ্চবাচ্য হয় না বললেই চলে। বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকারের শক্ত কোনো ভূমিকা নেই- এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

মূল্যস্ফীতির থাবা থেকে দেশের মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্রদের সুরক্ষা দিতে হলে বাজার নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি সরকারের আর্থিক প্রণোদনামূলক কর্মসূচিগুলো আরও উৎপাদনমুখী ও মানবসম্পদ উন্নয়নমুখী করা প্রয়োজন।

এর ফলে একসময় হয়তো দেখা যাবে, প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান দ্বারা তারা নিজেরাই স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। স্বস্তির বিষয় হল, এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দামবৃদ্ধির চাপ তুলনামূলকভাবে কম। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের দাম কম।

অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতি ও জিও পলিটিক্যাল কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে আমাদের দেশীয় বাজারে মূল্যস্ফীতির অভিঘাত পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এছাড়া বন্যার কারণে শাকসবজির উৎপাদন হ্রাস, ধানের আবাদ ও পণ্য সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হওয়া ইত্যাদি কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম কয়েক মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এ পরিস্থিতি যাতে স্থায়ী না হয় সরকার সে ব্যাপারে যত্নবান হবে, এটাই প্রত্যাশা।

  • কার্টসি - যুগান্তর/ ১২ ডিসেম্বর ২০১৯

Wednesday, December 11, 2019

পেঁয়াজের মূল্য কি কমবে?

শায়রুল কবির খান


বর্তমান সরকারের আমলে প্রধানত দু’টি কারণে পণ্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়েছে। প্রথমত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, দ্বিতীয়ত বাজার ব্যবস্থাপনা। প্রথম অংশে বাজার ব্যবস্থাপনার কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরতে চাই। দ্বিতীয় অংশে বিবেচনায় আনতে চাই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।


উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থাকে জোরদার করার বিষয়ে জনগণের স্বার্থরক্ষায় শুরু থেকেই এই সরকারের জোরালো প্রচেষ্টার অভাব ছিল। জনগণের সরকারকে কী রকম প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হয়, তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম জিয়াউর রহমান সরকারের সময়। ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমানের সরকারের আমলে ১০ মাস বৃষ্টি হয়নি। অনেকের ধারণা ছিল, খরায় কৃষকের উৎপাদন বন্ধ, দুর্ভিক্ষ হবে। কিন্তু তা হয়নি বরং ৮১ সালে দুই লাখ টন চাল রফতানি হয়েছে। খাদ্যগুদাম করার জন্য বিশ্ব ব্যাংকসহ অনেক দেশের কাছে ঋণ সহায়তা চেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। শত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও সারাদেশে প্রান্তিক পর্যায়ে খাদ্যগুদাম তৈরি করতে সক্ষমতা দেখিয়েছেন বিএনপির এই প্রতিষ্ঠাতা।



এক. প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হয়ে থাকে পণ্যের মোট সরবরাহ ও মোট চাহিদার ভিত্তিতে। চাহিদার চেয়ে পণ্য সরবরাহ কম হলে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে—যতক্ষণ না চাহিদার ও সরবরাহে একটা সমতা আসে। বর্তমান সরকারের আমলে অস্বাভাবিক পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে দুটি কারণে। উৎপাদনের উপকরণের যেমন—বীজ, সার, তেল, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদির দফায় দফায় মূল্য বৃদ্ধি। এ কারণেই পণ্যমূল্য বৃদ্ধি এখনও অব্যাহত রয়েছে। সংরক্ষণ করা যায়, এমন সব পণ্যের বাজার গত কয়েক মাসে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার আরও একটি কারণ হলো—সংরক্ষণ-পণ্যের গুদামে আকস্মিক তল্লাশি, কোনও-কোনও ক্ষেত্রে সিলগালা করা কিংবা বাজারে বিক্রির জন্য চাপ সৃষ্টি করা। কালোবাজারি ও ব্যবসায়ী সংরক্ষণকারীকে একই মনে করা ঠিক নয়। পণ্য সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিপণন কার্যক্রম। উদাহরণস্বরূপ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কর্মকৌশল ঠিক করে খাদ্য গোডাউন করেছিলেন বিধায় ধান ও চাল সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছিল। যার ফলে আজ বাংলাদেশ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। নিত্য প্রয়োজনীয় যেকোনও পণ্য উৎপাদনের পর সংরক্ষণ করেই চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ হয় বাজার ব্যবস্থাপনা।

দুই. মৌসুমভিত্তিক উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে তা আরও গুরুত্বপূর্ণ। সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকলে অমৌসুমে আমরা চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, পেতাম না এবং সব উৎপাদিত পণ্যই পানির দরে বিক্রি হতো। সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত কার্যক্রমের ফলেই কৃষিপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল হয়ে ওঠে। যথেষ্ট প্রতিযোগিতা থাকলে সংরক্ষণকারী, পণ্য অতিরিক্ত সময়ের বেশি একদিনও ধরে রাখবে না। অথচ পণ্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য আমরা সরবরাহ ও চাহিদার অবস্থা বা ভারসাম্যের কথা চিন্তা না করে প্রথমেই আঘাতটা সংরক্ষণকারীর ওপর করার চেষ্টা করি। অবশ্য সপ্তাহকয়েক পরেই বাজারের আরও বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় কর্তৃপক্ষকে পিছুটান দিতে হয়। ততদিনে সরবরাহ সংকট উত্তরোত্তর মূল্যবৃদ্ধিকে উসকে দেয়। পণ্য আমদানিকারক সিন্ডিকেট কিংবা বাজার ব্যবস্থার যেকোনও পর্যায়েই সিন্ডিকেট তৈরি হয়ে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের সুযোগ তৈরি হলে অবশ্যই তা হয় ভোক্তাদের চরম ক্ষতির কারণ। এ রকম বাজার ব্যর্থতাকেই বরং সরকার হস্তক্ষেপ করে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে।

সেটা বাজার প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই–এক্ষেত্রেও ধরপাকড়, হুমকি বরং বাজারে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ভীতি তৈরি করে পণ্য সরবরাহে আরও বাধা তৈরি করতে পারে। সিন্ডিকেট তৈরি হতে না দেওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করার দায়িত্ব সরকারের। আমদানিকারক কিংবা বাজারের যেকোনও পর্যায়েই ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট তৈরি হয় রাজনীতিকদের (ক্ষমতাসীন) পরোক্ষ সমর্থন কিংবা সরাসরি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুযোগে। ব্যবসার যেকোনও পর্যায়ে যেন যথেষ্ট প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হয়, সেটাই সরকারের দেখার বিষয়। পূজা-পার্বণ, ঈদ ছাড়া বাংলাদেশে পণ্য চাহিদার আকস্মিক বৃদ্ধি ঘটে না বরং ইদানীং গ্রামে-গঞ্জেও ক্ষুদ্র ব্যবসার সুযোগ অসম্ভব রকম সীমিত হয়েছে। অবৈধ স্থাপনাগুলো ভাঙচুরের কারণে বহু পরিবার কর্মহীন হয়েছে, ব্যবসায়ীরা ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ায় চাহিদায় ভাটা পড়েছে। তবু কেন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে?

(ক) দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষি পণ্যসামগ্রীর প্রায় প্রতিটির ঘাটতি রয়েছে।

(খ) আমদানি পর্যায়ে বর্তমান সরকারের রাজনীতিক ব্যবসায়ীদের আঁতাতের ফলে সিন্ডিকেট তৈরি হওয়ায় মূল্যকে তারা যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পেয়েছিল। পাশপাশি আমদানির জন্য বড় বড় আমদানিকারকের ওপর নির্ভরশীলতার জন্য ওই অপরাজনীতি দায়ী।

(গ) পণ্য উৎপাদনে অত্যাধিক খরচ, সেচ-বিদ্যুৎ ও সারের বণ্টন অব্যবস্থাপনা এর জন্য দায়ী।

(ঘ) পণ্য পরিবহনে নানা অনিয়ম ও সম্প্রতি পরিবহন সেক্টরে অরাজকতা পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ চেষ্টা, চাঁদাবাজি ও পুলিশের অবৈধ কার্যক্রমের খরচও এর সঙ্গে যুক্ত হয়। দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা অর্জন (মূল্যের ওঠানামার ব্যাপকতা কমে যাওয়া), দ্রব্যমূল্য সাধারণ ক্রয়সীমার মধ্যে রাখতে পারাটাই যেকোনও সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্যের বড় মাপকাঠি। অর্থনীতির প্রকৃত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেলেই কেবল এটি সম্ভব।

তিন. উৎপাদন ঘাটতি মেটানোর জন্য প্রযুক্তি উন্নয়ন ও হস্তান্তরে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। উৎপাদন উপকরণগুলোর সরবরাহ যতটা সম্ভব ছেড়ে দিতে হবে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে। সর্বত্রই প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করা ছাড়া বাজারব্যবস্থার সুফল উৎপাদক কৃষক শ্রেণি কিংবা ভোক্তা—কেউই পেতে পারে না। কৃষি উৎপাদন উপকরণগুলোর ক্ষেত্রে যেমন-সেচ ও চাষের যন্ত্রাদি, সার, পল্লী বিদ্যুৎ সরঞ্জাম ও বিদ্যুৎ মূল্য, উন্নত বীজ, আমদানির ও বিক্রির ক্ষেত্রে সারচার্জ, ট্যাক্স অবশ্যই থাকবে না। সরকারি সার বিতরণে ডিলারশিপকে গ্রামের বাজারভিত্তিক বহু ব্যবসায়ীর কাছে ছড়িয়ে দিতে হবে। সার, বীজ, যন্ত্রাদি আমদানিতে এসবের যথাযথ মানকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রাখতে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। আমদানিতে সিন্ডিকেট  যেন গড়ে না ওঠে, সে জন্য যেকোনও আমদানিতে যথাসম্ভব অধিক সংখ্যক আমদানিকারককে সুযোগ দিতে হবে। ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল আমাদানিতে বিগত বছরে রাজনৈতিক-ব্যবসায়ীদের সংশ্লিষ্টতার কারণে সিন্ডিকেটগুলোর মুনাফালোভী কার্যক্রমে দেশবাসীকে এসব পণ্যের জন্য আকাশছোঁয়া মূল্য দিতে হয়েছে। এখন ওই সিন্ডিকেটগুলো ভাঙার ব্যবস্থা করাই হচ্ছে সরকারের জরুরি দায়িত্ব।

চার. এসবক্ষেত্রে, পণ্য সংরক্ষণ সময়সীমা বেঁধে দেওয়াও বাজার কার্যক্রমে সরাসরি হস্তক্ষেপের শামিল। এই হস্তক্ষেপ বাজারে অংশগ্রহণকারীরা ভীতসন্ত্রস্ত হলে এবং বাজার কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়লে দীর্ঘমেয়াদে বাজার দাম আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। বাজার কার্যক্রমে এজেন্টদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া উচিত। যার কাজ তাকেই করতে দেওয়া বাঞ্ছনীয়। এ ক্ষেত্রে খুব আপৎকালীন সময়ের জন্য সরকার গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় অত্যাবশকীয় পণ্যের-বাজারের স্টক গড়ে তুলতে পারে। যেন জাতীয় কোনও দুর্যোগের সময়ে আমদানি-রফতানি ব্যাহত হলে তা বাজারে ছেড়ে নিম্নবিত্ত ও দুস্থ শ্রেণিকে সহায়তা দিতে পারে। এটাও হওয়া উচিত টার্গেট গ্রুপভিত্তিক। কোনোভাবেই উন্মুক্ত বিক্রয় নয়। বাজার ব্যবস্থার বিকল্প সরকার হতে চাইলে তা অর্থনীতিতে আরও বিপর্যয় ডেকে আনে। স্বাধীনতার পরপর বিধ্বস্ত বাজার ব্যবস্থায় সরকারি অত্যধিক হস্তক্ষেপে আমরা যে ভুল করেছিলাম, তার ধারাবাহিকতা কোনও না কোনও সময়ে কোথাও না কোথাও প্রতিফলিত হয়। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ কৃষিপণ্য বাজার ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে দক্ষ। ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াকে সামনে রেখেই এ কথার যৌক্তিকতা প্রমাণে যথেষ্ট গবেষণার ফলাফল কৃষি অর্থনীতিবিদদের হাতে রয়েছে। রাজনৈতিক ব্যর্থতা ও অসততার পরেও এই স্বাধীন বাজার ব্যবস্থাই বিগত সময়ে আমাদের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দিয়েছে। উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থাকে অবমূল্যায়ন করার কোনও কারণ নেই। ব্যবসায়ী ও উৎপাদক শ্রেণি হচ্ছে অর্থনীতির মূলচালিকা শক্তি, তাদের আস্থায় নিতে হবে।

পাঁচ. বেসরকারি পর্যায়ে সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য, গুদাম ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সৃষ্টিতে বিশেষ ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা থাকা উচিত। পচনশীল দ্রব্য সংরক্ষণ, প্রযুক্তি উন্নয়ন ও কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোয় জরুরি ভিত্তিতে গবেষণা কার্যক্রম চালু করা উচিত। সংরক্ষণ ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ বিষয় সহায়তায় সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে। এই বিষয়ে ব্যবসায়ীদের জন্য প্রশিক্ষণ সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত। কৃষক উৎপাদকদের যেন পণ্য সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ তারাও নিতে পারবেন।

ছয়. আমদানি ক্ষেত্রে কাস্টমস ও প্রশাসনের দুর্নীতি ও দীর্ঘসূত্রতা কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কেননা বাজার ব্যর্থতা এর অন্যতম কারণ। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য তারাও বহুলাংশে দায়ী। যেকোনও পণ্য চলাচল জরুরি খাত হিসেবে বিবেচিত হবে। কৃষি ব্যবসা এখন আমাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মূলধারা। এই খাতকে বেগবান করতে সরকারের করণীয় যথেষ্ট কিছু রয়েছে। বাজেটে আমরা ভর্তুকি রাখি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে। এর ফলাফল উৎপাদক শ্রেণির হাতে পৌঁছে না। ভর্তুকিতে যে অদক্ষতা ও অপচয় অবশ্যই কমাতে হবে। বরং ভর্তুকির টাকা কৃষি গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ব্যয় করলে তা অনেক বেশি লাভ দেবে। কৃষককে মূল্য সমর্থন দেওয়ার জন্য খাদ্যশস্য সংগ্রহ নীতিমালা ও ব্যর্থতাই পর্যবসিত। শুধু রাজনৈতিক ক্যাডাররাই সংগ্রহ কেন্দ্রে বিক্রির সুযোগ পায়। এসবের পর্যালোচনা করে গতানুগতিক এই কর্মসূচিগুলো সীমিত করা উচিত এবং ওইসব অর্থ দিয়ে বাজার অবকাঠামো গড়ে তোলার প্রচেষ্টা নেওয়া উচিত। প্রতিটি জেলায় ও উপজেলায় বিসিক শিল্পনগরী কার্যক্রমের আদলে অসংখ্য পাইকারি বাজার সৃষ্টি জরুরি হয়ে পড়েছে। অনেক কৃষি পণ্যের কেন্দ্রীয় বাজার হিসেবে ঢাকার আশেপাশে অন্তত আরও কয়েক ডজন বৃহৎ পাইকারি বাজার সৃষ্টি করা অপরিহার্য। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে বাধাহীন পণ্য চলাচলের যত চ্যানেলে সৃষ্টি করা সম্ভব, তা-ই করতে হবে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে।

সাত. দ্বিতীয় অংশে আমরা ভুলে গেলে চলবে না, বর্তমান সরকার নৈতিকভাবে পরাজিত। সরকার পরিবর্তনে গত ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনৈতিকভাবে ২৯ ডিসেম্বর রাতেই প্রশাসনকে দিয়ে দখল করে নিয়েছে। প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে যত রকম চেষ্টাই করুক নৈতিকভাবে পরাজিত সরকার জনগণের কাছে কোনও সময়েই মূল্যায়ন পাবে না। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না। সরকারি অতিরিক্ত ব্যয় মেটানোর জন্য সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিচ্ছে, অন্যদিকে ব্যাংক মালিকরাও লুটপাট করছেন। বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীর কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি দফায় দফায় বৃদ্ধি করে জনগণের টাকায় সরকার ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে। পরিবহণ সেক্টরের কথা আর নাই বললাম; তারা কথায় কথায় ধর্মঘটের ডাক দেন।

এরকম পরিস্থিতিতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে  প্রতিবাদ করবে তাকেও পুলিশ দিয়ে দমন করে চলছে। তাহলে কী দাঁড়ালো? একদিকে সরকার নিজে শক্তিশালী গোষ্ঠীর কাছে অসহায়, অন্য দিকে সাধারণ জনগণ সরকারের কাছে মূল্যহীন। এর চেয়ে পরিত্রাণ পেতে হলে ভোটের অধিকার ফিরিয়ে এনে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। তবেই দেশের সার্বিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে জনগণ রক্ষা পাবে। তা না হলে দিনে-দিনে সবকিছুর মূল্য বাড়বে, সাধারণ জনগণের জীবনের মূল্য কমবে। দেখবেন পেঁয়াজের মূল্যও সয়ে গেছে, এরপর আরও একটি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি হবে।

  • লেখক —  সহ সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংসদ—জাসাস 
  • কার্টসি —  বাংলাট্রিবিউন / ডিসেম্বর ১১, ২০১৯ 

Impossible to meet growth target as economy under pressure


The government is borrowing the most from the banking system and if it continues, the government’s bank borrowing may cross the target

On the basis of various indicators, it is apparent that our economy is under tremendous pressure even though there is no recession yet. In essence, the country's economic progress is not satisfactory at all.  

Export growth is not good at all. In fact, this area has been experiencing negative growth over the last few months. The negative growth exceeded 17 percent in October. The growth was 7 percent during the July-October period. 

The import of capital machinery and industrial raw material has declined considerably. As a result, the government's revenue collection is not reaching the target. In fact, there is a big shortfall. This is creating big pressure on the government's fiscal management. The government has to borrow a large amount of money from internal sources to finance the budget deficit. 

The government is borrowing the most from the banking system because the sale of savings certificates has dropped due to various restrictions. 

If such borrowing continues, the government's bank borrowing may cross the target, and private entrepreneurs will be deprived. 

According to the latest Bangladesh Bank data, private sector credit growth has dropped to 10 percent, which is worrying. 

And if private sector investment does not pick up, there will be no new employment and no rise in revenue collection. In fact, the government will have to borrow again to finance the budget. 

The government should take effective initiatives after analysing this information. At first, the government should analyse the reason for the slump in export earnings. It has to find out if the problem is in the demand side or in the supply side.  

If there is a demand side problem, we have to find the reason for the decline in exports. Different countries including Vietnam and Cambodia are doing better than us in garment exports to the international market – then why are we lagging behind, what is our problem?   

We have to find the reason for it and solve the problem. Increasing exports by devaluing the Taka will not bring in any sustainable positive results. 

And the overall investment friendly environment in the private sector is not improving. Our position in the World Bank's 'ease of doing business index' is still 168, which means that 167 countries are above ours. 

On top of that, our rank is not good in the corruption index either. The government has to pay attention to the problems in the long run. 

Analysing all the factors, I apprehend that the GDP growth target will not be fulfilled in the current fiscal year too. Economic growth was shown to be 8.1 percent in the last fiscal year, but I do not agree with that figure. Again, for the current fiscal year, the GDP growth target has been set at 8:2 percent which will be impossible to meet. 

Link - https://bit.ly/2rr6e3V

Tuesday, December 10, 2019

অপরাধ প্রণোদনা পেয়েছে

জসিম উদ্দিন

যুক্তরাজ্যের পুলিশকে জনগণের বন্ধু বলা হয়। নাগরিকরা রাস্তাঘাট, হাটবাজার, গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পুলিশকে মুশকিল আহসানকারী হিসেবে পায়। শুধু যুক্তরাজ্য কেন, পুরো ইউরোপে পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী হিসেবে জনগণের সেবার দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং পূর্ব এশিয়ার উন্নত দেশগুলোতে পুলিশ জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করছে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল ও অস্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার দেশগুলোতে পুলিশের ভূমিকা ব্যাপক বিতর্কিত। আমাদের দেশে পুলিশবাহিনী মানে অনেক ক্ষেত্রে জনগণের মনে ভীতিজাগানিয়া একদল অস্ত্রসজ্জিত লোক। তারা আইনি সুরক্ষা নিয়ে মানুষের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এর বিপরীত চিত্রও সামান্য কিছু পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে পুলিশের জাতীয় জরুরি সেবাদানকারী ৯৯৯ সার্ভিস একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছে। ছিনতাই, ধর্ষণসহ অনেক সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ পুলিশবাহিনীর কিছু সদস্য করেছে, আর এ সার্ভিসটিকে ঠিক এর বিপরীত উন্নতমানের একটি সেবা বলা যায়। উন্নত বিশ্বের পুলিশের যে সেবা, তার ছোঁয়া এই সার্ভিসে পাওয়া যাচ্ছে।

এ সেবার আওতায় জরুরি ভিত্তিতে জীবনাশঙ্কায় পড়া মানুষ উদ্ধার পাচ্ছে, রোগীরা অ্যাম্বুলেন্স পাচ্ছে, দ্রুত ফেরি পারাপারের সহযোগিতা পাচ্ছে রোগীরা। ধর্ষণ, গৃহকর্মী নির্যাতন ও মুক্তিপণের জন্য পণবন্দীরা সহযোগিতা পাচ্ছেন। লিফটে আটকে পড়া, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া দুর্ঘটনা ও অগ্নিকাণ্ডে সাহায্য মিলছে। পারিবারিক সমস্যায়ও এ সার্ভিসের আওতায় সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের মধ্যেও একদল আক্রান্ত লোক ৯৯৯ নাম্বারে ফোন করে উদ্ধার পেয়েছেন।

মেঘনার মিয়ারচরে বিআইডব্লিউটিএ খননকাজ চলছিল। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাসের পর খননকাজে ব্যবহৃত ছয়টি পন্টুন কিনারে নোঙর করে প্রকৌশলী ও শ্রমিকরা অবস্থান করছিলেন। রোববার দুপুরে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে একটি পন্টুনের নোঙর ছিঁড়ে যায়। ৩০ জন শ্রমিকসহ পন্টুনটি মেঘনায় ভেসে যায়। আসন্ন বিপদে শ্রমিকরা আতঙ্কিত হন। উত্তাল নদীতে ডুবে যাওয়াই তাদের পরিণতি মনে হচ্ছিল। ঘোর বিপদের সময় এক শ্রমিক ফোন করেন ৯৯৯ নাম্বারে। ৩টার সময় এ আকুতি জানানোর ২ ঘণ্টার মধ্যে কোস্টগার্ড তাদের উদ্ধার করে। এমন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় উদ্ধার পাওয়ার আশা যখন প্রায় সবাই ছেড়ে দিয়েছে, সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করেছে পুলিশের ৯৯৯ নাম্বার।

এ নাম্বারে ফোন করতে কোনো খরচ হয় না। ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে এ সেবা। বিপদগ্রস্তরা এ সার্ভিসের মাধ্যমে সমস্যার সমধান পান। পুলিশের প্রতি সাধারণ যে ধারণা, তাতে আক্রান্ত ব্যক্তি থানা পুলিশের সহযোগিতা পাবেন, এমনটি সাধারণত কেউ প্রত্যাশা করে না। কিন্তু এই নাম্বারে ফোন করার পর নিকটবর্তী থানার দায়িত্বশীল পুলিশের সাথে কথা বলিয়ে দেয়া হয়। তখন পুলিশ আর তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। ডিজিটাল পদ্ধতির এ একটা ইতিবাচক সুযোগ। কেউ চাইলে দায়িত্ব এড়াতে পারে না, কিংবা অন্যায় করতে পারে না। মুক্তিপণ আদায়ের মতো ঘটনায় এর মাধ্যমে সেবা পাওয়া গেছে। এমনটি আমাদের দেশে সাধারণত অবিশ্বাস্য।

রাজধানীর আবদুল গনি রোডের পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে এ সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। দুটো ফ্লোরে সাড়ে ৪০০-এর বেশি কর্মী কয়েকজন পুলিশ অফিসারের তত্ত্বাবধানে রাতদিন এ সেবা দিয়ে যাচ্ছে। ৯৯৯ নাম্বারটি প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিচ্ছে। যেখানে মানুষ পুলিশবাহিনীকে এড়িয়ে চলে। একান্ত বাধ্য না হলে তারা পুলিশের ধারকাছ মাড়ায় না। সেখানে এই সার্ভিস শুরু হওয়ার পর বিগত ২০ মাসে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ কল এসেছে এ নাম্বারে। সেবা নিয়েছে প্রায় ২৬ লাখ লোক।

বিপরীত চিত্র ভয়াবহ। বাংলাদেশে পুলিশের সেবা তো দূরের কথা, কিছু ক্ষেত্রে নৈতিকতার এমন অবনতি ঘটেছে এবং কিছু পুলিশ নিজেরা আইন ভঙ্গ করছে। অন্যায় অপকর্ম করছে লাগামহীন। পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাসেমের ছেলে আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজ রাসেলের পরিবারের সদস্যদের তুলে নেয়ার অভিযোগে সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তার ‘অপরাধ’ পুলিশ সুপার হারুন আর রশিদকে তিনি চাঁদা দিতে অস্বীকার করে আসছিলেন। ঘটনার দিন রাসেলকে না পেয়ে তার স্ত্রী-সন্তানকে ঢাকার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় নারায়ণগঞ্জ পুলিশ। গুলশানের বাসা থেকে স্ত্রী-সন্তানকে তুলে নিয়ে যাওয়ার একটি ভিডিও রাসেল তার ফেসবুকে শেয়ার করেন। এরপর ব্যবসায়ীদের তরফে প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে। বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায়ের নজরে এলে এসপি হারুনকে প্রত্যাহার করা হয়। এই ব্যবসায়ী তার বিরুদ্ধে করা পুলিশ সুপারের অপরাধের যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা নজিরবিহীন। সাধারণ ব্যাপার হচ্ছে, আইনের রক্ষক হিসেবে ব্যবসায়ীরা পুলিশের কাছে নিরাপত্তা পাবেন। উল্টো পুলিশ নিজেই তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ করছে। হারুনকে প্রত্যাহার করার পর সংবাদমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে এখন অনেকে মুখ খুলছেন। ভুক্তভোগীরা বিপদে পড়ে যাওয়ার ভয়ে এত দিন তাদের বিরুদ্ধে করা অপরাধ চেপে গেছেন।

এসপি হারুনের চাঁদাবাজি নিয়ে ২০১৬ সালের ৫ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে রাসেল একটি লিখিত অভিযোগ করেন। ওই চিঠিতে তিনি হারুনের বিরুদ্ধে পাঁচ কোটি টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ আনেন। বিস্তারিত বিবরণে তিনি জানান, হারুনের পক্ষে উপপরিদর্শক আজহারুল ইসলাম আম্বার ডেনিমের স্টোর ম্যানেজার ইয়াহিয়া বাবুকে ফোন করে টাকা দাবি করেন। এর আগেও রেস্তোরাঁয় হারুন তাকে ডেকে নিয়ে পাঁচ কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঠিকানায় পাঠাতে বলেন। টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আম্বার ডেনিমের ৪৫ জন শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গাজীপুর থানায় ধরে নিয়ে মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠানো হয়। এসব যখন ঘটছে, তার প্রতিকার চেয়ে রাসেল পাত্তা পাননি। সরকারের পক্ষ থেকে অপরাধীদের আশকারা কোন পর্যায়ে রয়েছে, এ ঘটনা তার দৃষ্টান্ত।

পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে, একজন দুই কোটি টাকা দিয়ে নারায়ণগঞ্জে জায়গা কেনেন। তাকে ডেকে নিয়ে ওই জায়গা ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেন এসপি হারুন। এ সময় তিনি জায়গার ক্রেতাকে অকথ্য গালিগালাজ করেন। পরে উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে ক্রেতাকে জমির দখল নিতে হয়। পত্রিকা লিখেছে, কয়েক মাস আগে এসপির আদালতে ডাক পড়ে গার্মেন্টের অতিরিক্ত সুতা বা বন্ড ব্যবসায়ীদের। এসপি জানিয়ে দেন ডিবির পরিদর্শক এনামুল যা বলে তাই শুনতে হবে। তারপর ব্যবসায়ীদের গোডাউনে হানা দেয় এনামসহ পুলিশ সদস্যরা। বাধ্য হয়েই চার থেকে সাত লাখ করে টাকা দেন একেক ব্যবসায়ী। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালেই আটক করে নিয়ে যাওয়া হতো থানাহাজতে। এমন অনেক ঘটনার মধ্যে একটির শিকার সিদ্ধিরগঞ্জের বালু ব্যবসায়ী শাহজাহান। দুই মাস আগে এক সন্ধ্যায় ঘটে ঘটনাটি। এসপি হারুনের ছক অনুসারে নাসিকের ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আলী হোসেন আলার কার্যালয়ে অভিযান চালায় ডিবি পুলিশ। ডিবি পুলিশের এসআই আলমগীরের নেতৃত্বে ব্যবসায়ী শাহজাহানকে আটক করে নিয়ে যায়।

কাউন্সিলর আলা জানান, পরে কাউন্সিলর আলাকেও ডেকে নেয় ডিবি। ডিবি অফিসে নিয়ে শাহজাহানের কাছে ৫০ লাখ টাকা দাবি করে হারুন। এ সময় তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। মাদক মামলায় ফাঁসানো থেকে শুরু করে ক্রসফায়ারে হত্যার ভয় দেখানো হয়। একপর্যায়ে ২০ লাখ টাকা দিতে সম্মত হন ওই ব্যবসায়ী। কাউন্সিলর আলার উপস্থিতিতে নগদ ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়েও সে দিন মুক্তি পাননি শাহজাহান। পরদিন সকালে আরো ২২ লাখ টাকা (মোট ৩৯ লাখ ৫০ হাজার) দিয়ে মুক্তি মেলে শাহজাহানের। এ ঘটনার পর থেকে ব্যবসায়ী শাহজাহান অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন।

নারায়ণগঞ্জের আরেক ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীনকে ডেকে নিয়ে ৪৫ লাখ টাকা আদায় করেন এসপি হারুন। জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে তিনি নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় একটি জিডি করতে গেলে এই অভিযোগটিকে ২২ লাখ টাকার চাঁদাবাজির মামলায় রূপ দেন এসপি হারুন। এই অভিযোগে জয়নালকে নারায়ণগঞ্জ থানায় ডেকে নিয়ে গ্রেফতার করেন তৎকালীন ওসি কামরুল। এ সময় তার কাছে এসপির নির্দেশের কথা বলে এক কোটি টাকা দাবি করা হয়। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে আরো মামলার হুমকি দেয়া হয়। পরে ২০ লাখ টাকা দিতে রাজি হন জয়নাল। তাতে কাজ হয়নি, আরো তিনটি মামলা করানো হয়। অবশেষে মামলা ও রিমান্ড নিয়ে নির্যাতন করার ভয় দেখানোর পর ৪৫ লাখ টাকা দেন জয়নাল। জয়নাল আবেদীন বলেন, আমি নিজ হাতে তিন বারে ১০ লাখ টাকা দিয়েছি এসপি হারুনের কাছে। বাকি টাকা দেয়া হয়েছে আমার স্ত্রী ও অন্যদের মাধ্যমে। এ ছাড়া তিনি জানান, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অস্ত্র জমা দিতে যান তিনি। এ সময় থানায় ফ্লোরে একটি গুলি পড়ে যায়। পরে এসপি হারুনের নির্দেশে তাকে আটকে রেখে অভিযোগ করা হয় জয়নাল পুলিশকে গুলি করেছেন। এ ঘটনায় ১৫ লাখ টাকা দিতে বাধ্য হন জয়নাল আবেদীন।

পত্রিকা আরো লিখেছে, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রোডের উৎসব পরিবহনের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। প্রায় ৩০ লাখ টাকার বিনিময়ে এসপি হারুন একটি পক্ষকে সমর্থন দেন। এ বিষয়ে উৎসব পরিবহনের চেয়ারম্যান কামাল মৃধা বলেন, আমি বৃদ্ধ বয়সে গত ২০ মে থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত কমপক্ষে ৭০ বার এসপি অফিসে গিয়েছি। তিনটি লিখিত অভিযোগ করেছি, কিন্তু আমি আইনি সহযোগিতা পাইনি।

এগুলো এসপি হারুনের সর্বসাম্প্রতিক ক্রিয়াকাণ্ড। তার অপরাধী হয়ে ওঠার একটি দীর্ঘ পটভূমি রয়েছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা কিভাবে অপরাধী হন তার ঘটনাটি একটা কেসস্টাডি হতে পারে। বর্তমান সরকারের একেবারে প্রথম মেয়াদের ঘটনা। ২০১১ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনঃস্থাপনের দাবিতে বিএনপি জোট হরতাল ডেকেছে। তৎকালীন সংসদে বিরোধী দলের চিপ হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুকের নেতৃত্বে সংসদ ভবনের পাশে বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ হামলা চালায়। ফারুকের সাথে পুলিশ সদস্যদের ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে সেখানে উপস্থিত অতিরিক্ত সহকারী কমিশনার হারুন আর রশিদ তার ওপর চড়াও হন। হারুন তাকে ঘুষি ও লাথি মারেন। ফারুক দৌড়ে পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে চান। কয়েকবারই তাকে ধরে এনে মারধর করেন হারুন। হারুনের উপর্যুপরি মারধরে তিনি গুরুতর অসুস্থ হন। তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মাথায় তাকে ১১টি সেলাই দিতে হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জের আজকের অব্যাহতি পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তা হারুন আর রশিদই অপরাধটি করেছিলেন।

ওই ঘটনায় লুকোছাপা কিছু ছিল না। সব কিছু একেবারে প্রকাশ্যে ঘটেছিল। মারধরের পুরো ঘটনাটি পরে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এসেছে। স্পষ্ট দেখা গেছে, একজন নির্বাচিত প্রতিনিধিকে কিভাবে পেটানো হচ্ছে। তারপর সাধারণভাবে মনে হয়েছিল, এ ঘটনার বিচার হবে। দেখা গেল উল্টো জয়নাল আবদিনের বিরুদ্ধে পুলিশি মামলা হয়েছে। তিনি মার খেয়ে মামলার হয়রানিতে পড়ে গেলেন। হাসপাতাল থেকে তিনি এ হয়রানির শিকার হতে লাগলেন। অপরাধী পুলিশ অফিসার হারুনের বিচারের পরিবর্তে অপরাধের শিকার সংসদ সদস্য জয়নুল আবদিনের বিরুদ্ধে হয়রানির এমন চিত্র বাংলাদেশের পুলিশের জন্য একটা বার্তা বহন করেছে। এই ঘটনা এই বার্তাই দিয়েছে ‘অপরাধ’ যা সংঘটিত হয়েছে সেটা নয়। অপরাধ হচ্ছে ক্ষমতাসীনরা যা ‘অপরাধ’ হিসেবে বিবেচনা করছে। অন্ততপক্ষে সংসদ জয়নাল আবদিনের সহকর্মীরা নিজেদের মানসম্মান রক্ষার স্বার্থে সে দিন এগিয়ে আসতে পারতেন। তারা কেউই সে দিন এগিয়ে আসেননি। এরপর পুলিশ কর্মকর্তা হারুনের উন্নতি এবং পুরস্কার পেতে দেখা গেছে। তিনি সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পোস্টিং পেয়েছেন। তারপর আজ জন্ম নিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের পুলিশ কর্মকর্তা হারুন।

হারুনের বিরুদ্ধে উপস্থিত সব অভিযোগ নারায়ণগঞ্জের। তিনি এর আগে ঢাকা মেট্রোপলিটন ও গাজীপুরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ওই সময়ে তিনি একেবারে নিয়মকানুন ও আইনের রক্ষক হয়েছেন সেই খবর নেই, বরং এই তিনিই একই অপরাধের কাজ করে থাকতে পারেন একই সময়ে। সুযোগ পেলে ভুক্তভোগীরা নিশ্চয়ই তা প্রকাশ করবেন। ব্যাপার হচ্ছে, এ ধরনের অপরাধের জন্য অবশ্যই একা হারুন দায়বান নন। তাকে এভাবে গড়ে তোলার অনুকূল পরিবেশ সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে। কারণ, অপরাধ সংঘটনের জন্য তিনি কোনোভাবে শস্তি পাচ্ছিলেন না। এ অবস্থায় এটাই স্বাভাবিক যে, অপরাধী তার অপরাধের মাত্রা বাড়াবে।

অপরাধ একটা সংক্রামক ব্যাধি। সংঘটিত একটি অপরাধ সংবাদমাধ্যমের খবরে ছড়িয়ে পড়লে সেই অপরাধ আরো বেশি করে সংঘটিত হয়। নতুন অপরাধ চালু হওয়ার ক্ষেত্রে একজন থাকেন এর সূচনাকারী। এর পরে এর অনুসারী হয়ে যান আরো অনেকে। হারুন যখন রাজনৈতিক নেতাদের পেটানোর এমন ব্লাংক চেক পেলেন, সেটা অনেকের জন্য ছিল সবুজ সঙ্কেত। এ সুযোগের অসৎ ব্যবহার অনেকে করেছেন। সরকার এর মাধ্যমে বিরোধীদের ন্যায্য দাবিগুলো দমন করার সুযোগ নিয়েছে। এখন তো আর রাজনৈতিক বিরোধিতা নেই। অপরাধী মন তো কখনো বসে থাকবে না। তারা এখন অন্যান্য অপরাধে বেশি করে জড়িয়ে পড়ছেন। সেগুলো হচ্ছে আর্থসামাজিক অপরাধ।

অপরাধকে ঘৃণা করতে চাই, অপরাধীকে নয়। যারা ঘৃণ্য কর্মে জড়িয়ে পড়েন, তারা ফিরেও আসতে পারেন। প্রতিটি মানুষের জন্য পরিশুদ্ধ হওয়ার নিশ্চয়ই একটি সময় রয়েছে। বারবার সুযোগ পেয়েও যারা সঠিক শুদ্ধ হতে চান না, তাদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত। মানুষের সমাজে ভালোর জন্য পুরস্কার এবং মন্দের জন্য তিরস্কারের উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেই অর্থে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ইনসাফপূর্ণ বলা যায় না। এখানে যার শক্তি আছে, আইন ও প্রশাসন তার পক্ষে কথা বলে।

  • কার্টসি — নয়াদিগন্ত/ নভেম্বর ১৩, ২০১৯