Search

Tuesday, December 24, 2019

CAMPUS VIOLENCE — Culture of impunity blamed

Education hampered, protests against attack on Nurul continue

Ershad Kamol and Arifur Rahman

Repeated attacks on students by the ruling party-backed student organisation and no punishment to the attackers in most cases reflect a culture of impunity in the society and hampering academic atmosphere at public universities across Bangladesh. 

The attacks also reflect the intolerance and repressive attitude of the ruling Awami League to suppress freedom of expressions in the country, said academicians and politicians.

Other than the gruesome murder of engineering student Abrar Fahad, most the perpetrators of the attack on students escaped investigation and trial.

Dhaka University professor emeritus Serajul Islam Choudhury said in cases of attacks on students, Dhaka University authorities never punished the ruling party-backed students for committing crimes.

‘We thought the situation will change following the DUCSU election that was held after 28 years. But, it did not happen. An elected DUCSU vice-president was never beaten by any student before rather they used to get respect from all students,’ he said.

‘Such moral degradation of the ruling party-backed student organisation reflects AL’s intolerant attitude towards the opposition. They know it very well that they escape punishment in the society where culture of impunity is prevalent,’ he added.  

Dhaka University retired professor and thinker Abul Kashem Fazlul Haque found it a normal behaviuor on the part of the ruling party-backed student organisation.

‘As nothing happens without intervention of the prime minister, she should also intervene in Dhaka University for resuming normalcy,’ he added.

Protests continued across the country on Monday against the attack on Dhaka University Central Students Union vice-president Nurul Huq Nur and 39 others at DUCSU office on Sunday by members of ruling party- backed Bangladesh Chhatra League and Muktijuddha Mancha, a platform of descendants of freedom fighters. It was the second attack on students by the two platforms in a week.

Road transport and bridges minister Obaidul Quader on Monday said that the prime minister, Sheikh Hasina, directed the authorities concerned to take punitive and administrative actions  against the attackers on Nurul Huq Nur.

Dhaka Medical College Hospital authorities on Monday formed a medical board to provide better treatment to the five patients now undergoing treatment there after the attacks.

Dhaka University authorities on Monday formed a six-member probe body, headed by the arts faculty dean Abu Md Delwar Hossain, to investigate into the incident.

The university authorities issuing a release termed the incident as ‘unsolicited and unfortunate’.

The police on Monday arrested two leaders of Muktijuddha Mancha, Al Mamun and Yasir Arafat Turjo, with alleged ties to attacks on Nurul and others. But, none of the Chhatra League leaders were arrested till writing the report though witnesses said that Chhatra League’s university chapter president Sanjit Chandra Das and DUCSU assistant general secretary and the university unit Chhatra League general secretary Saddam Hussain and others led the attackers entering into Nurul’s office.

Shahbagh police station officer-in-charge Abul Hasan said no case was filed so far with his police station until 8:30pm over the attack.

Condemning attack on Nurul and others, Jatiya Oiktya Front convener and also Gano Forum president Dr Kamal Hossain while addressing the steering committee meeting of the front held at his office, said that the ruling party-backed student had celebrated one year of Awami League’s one-party rule by beating general students.

‘The nature of attack on the elected DUCSU VP and others indicates that the intention of the attackers was to kill them. Tuhin Frabi is now on life support,’ Kamal in his written statement said.

‘The party that assumed in power through massive rigging is now using its student and labour fronts to beat oppositions,’ he added.

Jatiya Samajtantrik Dal faction president ASM Rab said that BUET student Abrar was killed by Chhatra League activists after Sheikh Hasina was made lifetime DUCSU member and Chhatra League activists attacked on Nurul and others after she was re-elected the AL president.

After visiting seriously injured Nurul, Tuhin Farabi and others at Dhaka Medical College on Monday, Communist Party of Bangladesh president Mujahidul Islam Selim, also a former DUCSU vice-president, said that the attack that Chhatra League activists, in presence of its DU unit president and general secretary, carried out on the elected vice-president Nurul and others was beyond mercy.

Bangladesh Nationalist Party senior joint secretary general Ruhul Kabir Rizvi at the party’s central office in the capital on Monday said that the attack on Nurul and 39 others was nothing but atrocity demonstrated by the ruling party-backed Chhatra League to mum voices of other student fronts on the DU campus.

After visiting Nurul and others at the hospital, Bangladesh Labour Party president Mostafizur Rahman Iran said that the ruling party was using Chhatra League to suppress the voice of the others as they did in the early 1970s with the defunct Rakkhi Bahini.

Rights organisation Ain O Shalish Kendra in a press release condemned attack on Nurul and others. It also said that such unwanted incidents were taking places at the public universities as the university authorities failed to take required measures.

Students Unity against Hooliganism brings out a procession on Dhaka University campus on Monday protesting against the attack on DUCSU VP and his associates. — Sourav Lasker










Over 3,000 students belonging to different student organisations from a rally held at Dhaka University on Monday demanded punishment of the Chhatra League and Muktijuddha Mancha goons who unleashed the attacks.  They also demanded resignation of the university proctor Golam Rabbani who is responsible for security on the campus as he ‘utterly failed’ to take any steps to punish the culprits, DU correspondent of New Age reported.

Teachers and students of Rajshahi University on Monday rallied on the campus protesting at the attack on students Nurul Huq Nur at Dhaka University on Sunday, reports New Age correspondent there. 

Charttra Odhikar Andolan leaders in Rangpur were attacked by the goons on Monday as they organised a rally protesting at attack on Nurul, New Age Rangpur correspondent reported.

Dhaka University Teachers Association also condemned attack on DUCSU vice-president Nurul and others terming the incident as ‘terror attack and to create anarchy in the campus’.

They demanded proper treatment of injured and also urged Nurul to act more responsibly in a statement signed by the association president Maksud Kamal and general secretary Shibli Rubait Ul Islam.

Courtesy — NewAge/Dec 24, 2019

Monday, December 23, 2019

এত দায়িত্ব ছাত্রলীগকে কে দিল?

জোবাইদা নাসরীন

গত ৭ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন সেখানকার ছাত্র আবরার ফাহাদ। তার মাত্র আড়াই মাস যেতে না যেতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একাংশ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের হামলায় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হক ও তাঁর সঙ্গে থাকা অন্তত ২৪ জন আহত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে দুজনকে ডাকসু ভবনের ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয় বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই হামলার শিকার তুহিন ফারাবিকে রাখা হয়েছিল আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে র‍্যাগিংসহ সন্ত্রাসের বিপক্ষে হাঁকডাক শুরু করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এগুলো যে শুধুই আওয়াজই ছিল, তা বোঝা গেছে এই আক্রমণ থেকেই। নুরুল হক ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাঁকে নির্বাচিত করেছেন, নেতা বানিয়েছেন। একজন নির্বাচিত ভিপির ওপর কীভাবে দাঙ্গাবাজি কায়দায় প্রকাশ্যে হামলা করা যায়? এবারই শুধু নয়, বারবারই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকার বাইরেও আক্রমণের শিকার হয়েছেন এই ভিপি। তিনি সর্ববৃহৎ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ছাত্রসংসদের সহসভাপতির (তা যে দল বা মতেরই তিনি অনুসারী হন বা না হন) ওপর এভাবে বারবার প্রাণঘাতী হামলা হচ্ছে, অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পুলিশ কিংবা সরকার কেউ তাঁকে ক্যাম্পাসে কিংবা ক্যাম্পাসের বাইরে ন্যূনতম নিরাপত্তাও দিতে পারছে না? প্রশাসন এবং ছাত্রলীগ থেকে বলা হয়েছে, সেখানে ডাকসু ভবনে নুরুর সঙ্গে বহিরাগতরা ছিল। নুরু তা স্বীকার করেই বলছেন, তিনি অনিরাপত্তাজনিত কারণে একা চলাফেরা করেন না। যদি প্রশাসন বহিরাগত বিষয়টিকেই জোর দেয় তাহলে প্রশ্ন, নুরুর নিরাপত্তার জন্য প্রশাসন কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল? ক্যাম্পাসে কী কখনো বহিরাগত আসে না? শুধুই আসা-যাওয়া নয়, ছাত্রহলগুলোতে বহিরাগতরা তো সব সময়ই থাকছে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের ‘অতিথি’ হিসেবে। সেগুলো প্রশাসন জেনেও না জানার ভান করে। কারণ হয়তো এই অতিথিদের নিয়ে কথা তারা বলতে চায় না, শুধু নোটিশ দিয়েই দায়িত্ব পালন করে।

বহিরাগত থাকলেই হামলা করা বৈধ? ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া বৈধ? লাইফ সাপোর্টে নিয়ে যাওয়ার মতো মারধরকে কীভাবে বহিরাগত তত্ত্ব দিয়ে ঢাকা যাবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগত প্রবেশ নিষেধ? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইনিয়ে-বিনিয়ে কেন বহিরাগত বিষয়টি প্রাধান্য দিচ্ছে? মানলাম আপনাদের যুক্তি যে এই বহিরাগতদের ভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি সেটি মোকাবিলা করত, প্রয়োজন হলে সেই উদ্দেশ্যে নিয়ে আসা বহিরাগতদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিত। এগুলো দেখার দায়িত্ব তো প্রশাসনের, বিশেষ করে প্রক্টর অফিসের, ছাত্রলীগ কিংবা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নয়।

মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের ব্যানারে ছাত্রলীগের এই হামলা আসলে কী ইঙ্গিত করে? ভবিষ্যতে কোথাও আর কোনো ধরনের ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত হবে না? নির্বাচন হলে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য সংগঠন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে না? কিংবা করলেও ছাত্রলীগকেই সব পদে জয়ী ঘোষণা করতে হবে? ছাত্রলীগ বাদে অন্য সংগঠনের কেউ জয়ী হলে তাঁকেও নুরুর মতো অবস্থায় পড়তে হবে? নাকি তাঁকেও ছাত্রলীগে যোগ দিতে হবে? তাঁকে ‘পাগলা’ অথবা ‘শিবির’ খেতাব দেওয়া হবে? তাকে ক্যাম্পাস ছাড়তে হবে? তাঁকে বারবার মার খেয়ে টিকে থেকে নিজের তেজস্বী জেদের পরিচয় জারি রাখতে হবে? তাঁকে ক্যাম্পাসে এ রকম মার খেতে হবে?

বাংলাদেশের মানুষের শ্রেষ্ঠ অহংকার মুক্তিযুদ্ধ। ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামীয় সংগঠনটিকে মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি ব্যবহার করে করে সন্ত্রাস করার অধিকার কে দিয়েছে? এরা কারা? কেন তারা এই ব্যানারে আক্রমণ করল? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বহিরাগতদের উদ্দেশ্য নিয়ে বিচলিত ছিল, কিন্তু এই মঞ্চের উদ্দেশ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল না কেন? কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি ব্যবহার করেছে এই কারণে? নাকি এখন এই শব্দ ব্যবহার করে কারও ওপর নিপীড়ন কিংবা হামলা করলে সেটি বৈধ হয়ে যাবে এই ভরসায়?

ডাকসুর ভিপি নুরুল হকের মতাদর্শ, রাজনীতি কিংবা তাঁর রাজনৈতিক ঘরানা নিয়েও ভিন্নমত বা বিরোধিতা থাকতে পারে। কিন্তু তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত। তাঁকেই ছাত্রছাত্রীরা দেখতে চেয়েছেন ডাকসুর নেতা হিসেবে। তাঁকে দফায় দফায় মার দিয়ে কী সফলতা অর্জন করতে চায় ছাত্রলীগ? তিনি ছাত্রলীগ করবেন? ডাকসু থেকে পদত্যাগ করবেন? নাকি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতির পরাজয়ের প্রতিশোধ? নাকি ডাকসুতে ছাত্রলীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভিন্নতম পোষণ করেন বলেই নুরকে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার জন্যই মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চকে সঙ্গে নিয়ে ছাত্রলীগের এই ‘নুরু শিক্ষা’ কর্মসূচি? বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য পদাধিকার বলে ডাকসুর সভাপতি। তিনি এর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।

ভিন্নমতকে গ্রহণ করাই হলো গণতন্ত্র। আর সেটি ছাত্র রাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতি—সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই ভিন্নমতকে জায়গা না দিতে পারার মনস্কতার ক্যাম্পাসগুলোতে বারবার সংঘর্ষ, হত্যাকাণ্ড এবং মারাত্মক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হচ্ছে। মূল রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের প্রতি আহ্বান করছি, নিজেরা ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করুন এবং ছাত্রসংগঠনগুলোকে ভিন্নমতের প্রতি সম্মান করার জন্য নির্দেশ দিন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও সংগঠননিরপেক্ষ হওয়া জরুরি। তাতে নিজেদের অবস্থান নিয়ে আর প্রশ্ন করার অবকাশ থাকবে না।

  • জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
  • কার্টসি ঃ প্রথম আলো/২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ 

Sunday, December 22, 2019

যে কারণে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত বিদেশি বিনিয়োগ পাচ্ছে না

আবু আহমেদ

আবু আহমেদ

বাংলাদেশ অর্থনীতিতে এখনো সুবাতাস বইছে। তবে এই সুবাতাস ক্ষণস্থায়ী হতে পারে, অনেকেই এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছে। একটানা এক দশক বা আরো বেশি সময় ধরে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে কয়েকটা উপাদানের উপস্থিতি প্রয়োজন হয়। এক. অব্যাহত বেশি বিনিয়োগ, বিশেষ করে ব্যক্তি খাত ও বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে। দুই. অব্যাহতভাবে রপ্তানি আয় বাড়তে হবে। তিন. স্থানীয় মুদ্রা ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা থাকতে হবে। চার. ব্যাবসায়িক পুঁজি সরবরাহের জন্য পুঁজিবাজারের সমর্থন থাকতে হবে। সেই সঙ্গে ঋণের জন্য বন্ড বা অন্য ধরনের ঋণপত্রের বাজার সচল থাকতে হবে। পাঁচ. অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি নিম্ন পর্যায়ে থাকতে হবে। ছয়. সর্বোপরি অর্থনীতিতে একটি আশাবাদের জন্ম হতে হবে এবং তা অব্যাহত থাকতে হবে। 

লোকজনকে বিশ্বাস করতে হবে যে তাদের অর্থনীতি বাড়বে এবং এই অর্থনীতিতে বিনিয়োগ ও ঝুঁকি নেওয়া যায়। তখন বিদেশিরাও এই একই ভাবনায় ভাবতে থাকবে যে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে সহজে ব্যবসা করা যাবে এবং ওই ব্যবসায় লাভ হবে। অন্য আরেকটা সত্য হলো আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং এজেন্সি যেমন বিশ্বব্যাংক, এডিবি ইত্যাদির মতো সংস্থা থেকে ঋণ করে কোনো অর্থনীতিই ওপরে উঠতে পারেনি। এসব সংস্থা ছোট প্রকল্পে অর্থায়ন করে। বড় প্রকল্পে অর্থায়ন করার জন্য এদের বাজেট নেই। বাংলাদেশ যে ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যর্থ হয়েছে সেটা হলো নিজ উদ্যোগে এই দেশ কোনো মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলের সঙ্গে সদস্য হিসেবে যোগ দিতে পারেনি। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে সুবিধাটা বাংলাদেশ পেয়ে আসছে সেগুলো WTO (World Trade Organization) ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমেই পেয়েছে। এর বাইরে বাংলাদেশ কোনো বাড়তি সুবিধা অন্য কোনো অর্থনীতি থেকেই পায়নি।

বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরে ভালো করছে বলে অন্যত্র অতি প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সংস্কারগুলোকে শিকায় তুলে রেখেছে। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশ জেনেশুনে ভর্তুকি দিয়ে এমন কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আজও চালিয়ে যাচ্ছে যেগুলো স্বাভাবিক বাজার অর্থনীতি নিরিখে এত দিনে বন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিয়ে কলকারখানা চালানোর অর্থ হলো অর্থের অব্যবহার করা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ অলস বসিয়ে রাখা। রাষ্ট্রের অধীনে এখনো হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ আছে, যেগুলো থেকে কোনো আয় প্রবাহ নেই। উল্টো ওইগুলো ব্যক্তি খাত যে ট্যাক্স দিচ্ছে সেই ট্যাক্সের অর্থ হজম করছে। তবে এ ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সরকারের বিষয়টি অনুভব করবে যখন বাংলাদেশ অর্থনীতি নিম্নমুখী প্রবণতার দিকে গতি নেবে। তখন নীতিনির্ধারকরা ভাবতে থাকবেন অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য আর কোথায় কী করা যায়। অর্থাৎ সম্পদ বসিয়ে ভর্তুকি দিয়ে রাষ্ট্রীয় কলকারখানা চালানোর নীতি অন্য অনেক দেশ অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি সামনের দিনগুলোতে পুঁজি সরবরাহের ঘাটতিতে ভুগবে। কারণ হলো এই দেশ চলনসই এবং বর্ধিত একটা পুঁজিবাজার গঠন করতে কখনোই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। এ দেশে যেসব কম্পানি বড় বড় ব্যবসা করছে তার বেশির ভাগই আজও পুঁজিবাজারের বাইরে। ব্যাংকনির্ভর অর্থায়ন অন্য অনেক দেশে অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেলেও বাংলাদেশ সেই অর্থায়ন বরং বাড়িয়েছে। ফল হলো ব্যবসাগুলো পুঁজিবাজারমুখী হতে নারাজ এবং সেই একটি কারণে এইখানে কোনো বন্ড (Bond) বা নতুন প্রডাক্টের বাজারও গড়ে ওঠেনি। জনগণের সঞ্চয়কে হয় সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য অথবা জায়গা-ফ্ল্যাট ইত্যাদি কেনার দিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ঝুঁকিবিহীন ব্যবসা থেকে যে অতিরিক্ত লাভ আসছে তার একটা অংশ আবার বিদেশে পাচার হচ্ছে।

বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগ চায়, তবে বিদেশি বিনিয়োগের সমস্যা কোথায় হচ্ছে তা বুঝতে নারাজ। বিদেশিরা কখন একটা অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করে। যখন তারা দেখে যে ব্যবসা করতে কোনো বাড়তি ঝামেলা নেই। যখন তারা দেখে যে প্রয়োজনে তারা ব্যবসা বন্ধ করে পুঁজি অন্যত্র সরাতে পারবে। যখন তারা দেখে শুধু স্বচ্ছভাবে ব্যবসা করতে গেলে তাদের বাড়তি কোনো ট্যাক্স বা চাঁদা দিতে হবে না। বিদেশিরা একটা প্রত্যাবর্তন পথ (exit route) চায়। বাংলাদেশে এখন বিদেশিরা তিনভাবে বিনিয়োগ করতে পারে—এক. শতভাগ নিজ মালিকানার, দুই. অন্য কোনো স্থানীয় অংশীদারের সঙ্গে, তিন. শেয়ার বা পুঁজিবাজারের মাধ্যমে। শতভাগ নিজের মালিকানায় ব্যবসা করতে গেলে ঝুঁকির অভাব হতে পারে। ফলে ওই ব্যবসা ছোট হতে থাকবে। ছোট ব্যবসা থেকে লাভ কম হয়। দেশীয় কোনো উদ্যোক্তার সঙ্গে যৌথ মালিকানায় ব্যবসা করতে গেলে স্থানীয় পার্টনারের ওপর বিশ্বাসের ঘাটতি অনুভব করে। তাদের জন্য সবচেয়ে সুবিধা শেয়ারবাজারের মাধ্যমে বিনিয়োগ করা। কারণ হলো শেয়ারবাজারের মাধ্যমে বিনিয়োগ করলে তারা যেকোনো সময় পুঁজি প্রত্যাহার করে নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অতি সহজ নীতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু সমস্যা হলো শেয়ারবাজারে ভালো কম্পানির অভাব। তারা যে মানের কম্পানির শেয়ার কিনতে চায় সেই মানের কম্পানির সংখ্যা ঢাকার শেয়ারবাজারে অতি অল্পসংখ্যক। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা আজতক বুঝলেন না যে অর্থনীতিতে ৮ শতাংশ বা তার অধিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকে ধরে রাখতে হলে শেয়ারবাজারের একটা সমর্থন লাগবে। ভারতের অর্থনীতি খারাপ করছে, কিন্তু ওদের শেয়ারবাজার এখন তুঙ্গে। এর কারণ হলো ভারতীয় শেয়ারবাজারে এমন অনেক কম্পানি আছে, যেগুলোর ছোট সংস্করণও বাংলাদেশ শেয়ারবাজারে নেই। ওদের ওখানে বাজার মূলধনের বিচারে হিন্দুস্তান লিভার (Hindustan Lever) হলো চতুর্থ নম্বরের কম্পানি। আমাদের এখানে বাংলাদেশ Unilever তালিকাভুক্ত আছে কি? করাচির স্টক মার্কেটও এখন চাঙ্গা। মূল কারণ হলো বিদেশিদের বিনিয়োগ। সেই মার্কেটে যেসব কম্পানির শেয়ার কেনার জন্য বিদেশিরা আগ্রহ দেখাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হলো নেসেল (Nestle) পাকিস্তান। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বাংলাদেশ নেসেল তালিকাভুক্ত আছে কি?

আসলে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা অন্যদের থেকে কোনো কিছু শিখতে চান না। অন্যরা কী করছে তা জানতে তাঁরা নারাজ। এই তো সেদিন সংবাদমাধ্যমে খবর বের হয়েছে থাইল্যান্ড স্টক এক্সচেঞ্জ (SET) তার প্রতিবেশী দেশগুলোর ভালো কম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করে যেন আত্মতুষ্টিতে ভুগছি। তবে সত্য হলো আমাদের মতো আরো অনেক অর্থনীতি এ ধরনের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল অনেক আগেই গঠন করেছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যদিক হলো, যেসব বিদেশি কম্পানি তালিকাভুক্ত হয়ে বেচা-কেনা-আয়-রোজগারকে স্বচ্ছভাবে প্রকাশ করে তাদের বলা হয় তোমরা আরো বেশি ট্যাক্স দাও। আর যেসব কম্পানি ব্যালান্সশিট তৈরি করে মিথ্যা পরিসংখ্যান দিয়ে, তাদের থেকে ট্যাক্স আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যায় না। বিদেশিরা আমাদের ব্যাপারে অনেক কিছুই দেখে। তারা আমাদের অর্থনীতিতে কী হচ্ছে, কী হতে পারে এ ব্যাপারে খবর নেয়। তবে তারা মুখ ফুটে কিছু বলে না। তাদের সুবিধা হলো তারা তাদের অর্থ মুক্তভাবে বিশ্বব্যাপী ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু তারা বাংলাদেশ অর্থনীতিতে সমস্যা দেখলে সম্ভাব্য পুঁজি অন্য অর্থনীতিতে ব্যবহার করবে। বাংলাদেশ তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে অত গুরুত্বপূর্ণ নয়। একেক সময়ে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা এমন অবস্থান গ্রহণ করেন যা বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নেতিবাচক ধারণা প্রচার করে। এই যে গ্রামীণফোন (GP) এবং টেলিফোন রেগুলেটরি সংস্থার (BTRC) মধ্যে পাওনা নিয়ে যে বিরোধ চলছে, তা বিদেশি বিনিয়োগ লাভের ক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। এই পাওনাসংক্রান্ত বিরোধটা হলো ১৯৯৭-২০১৬ সালের পাওনা নিয়ে। ইঞজঈ বলছে, তারা গ্রামীণফোনের কাছে এত হাজার কোটি টাকা পাবে। আর GP বলছে, এত টাকা নয়, আরো অনেক কম পাবে। তাহলে এই বিরোধের একটা নিরপেক্ষ মীমাংসা হতে পারত একটা নিরপেক্ষ অডিট রিপোর্ট কমিশন করার মাধ্যমে। কিন্তু রেগুলেটরি সংস্থা সেই যুক্তি মানতে রারাজ। উচ্চ মহল থেকে এই বিরোধ মীমাংসার জন্য কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও বিরোধের মীমাংসা হয়নি। হয়নি কেন তা আমাদের পক্ষে বুঝে আসেনি। GP ও BTRC-র বিরোধের কারণে শেয়ারবাজারে এই কম্পানির শেয়ার মূল্য ৫০০ থেকে পড়ে এখন ৩০০ টাকায় ঠেকেচ্ছে। এই যে GP-র শেয়ার মূল্যের এই পতন, এতে হারছে কারা? হারছে এ দেশের ৪০ হাজার খুদে শেয়ার বিনিয়োগকারী এবং হারছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ICB (Investment  Corporation of Bangladesh) এবং সাধারণ বীমা (সেটাও সরকারি সংস্থা)। তাদের বিনিয়োগ হিসাবগুলোতে লাখ লাখ GP-র শেয়ার কিনে রেখেছে। আজকে তাদের ক্ষতির পরিমাণ কত তা কি সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে কেউ খবর নিয়েছে? যে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা BTRC পাবে বলছে তার থেকে অনেক বেশি অর্থ সরকারি সংস্থা দুটো এবং এই দেশের শেয়ারবাজারের হাজার হাজার ব্যক্তি বিনিয়োগকারী ইতিমধ্যে হারিয়েছে। আমরা ব্যবহার করছি ওই ব্যক্তির মতো যে পেনি নিয়ে চিন্তিত; কিন্তু পাউন্ড নিয়ে কোনো খবর নেই। একেই কি বলে Penny wise pound foolish! যাক, বিদেশি বিনিয়োগ লাভ করতে হলে শুধু কথা দিয়ে অনুরোধ করে বাংলাদেশ ওই বিনিয়োগ আনতে পারবে না। বিদেশিরা দেখে এর মধ্যে যারা বাংলাদেশে ব্যবসা করছে তাদের অবস্থা কেমন। বাংলাদেশ যদি বিদেশি বিনিয়োগের জন্য এতই উপযুক্ত স্থান হবে, তাহলে এই অর্থনীতি থেকে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে কেন ঝেক (GlaxoSmit hKline) এবং সানোফি অ্যাভেনটিসের ((Sanofi-Aventis) মতো বিশ্ববিখ্যাত দুটি ওষুধ কম্পানির ব্যবসা বন্ধ করে দিল? এদের প্রস্থানের কারণ আমাদেরই খুঁজতে হবে।

  • লেখক  —  অর্থনীতির অধ্যাপক
  • কার্টসি  —  কালের কণ্ঠ / ডিসেম্বর ২২ , ২০১৯

সিএএ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়

আসিফ নজরুল

আসিফ নজরুল

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) নিয়ে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ভারতের বাইরেও। এই আইনের প্রতিবাদে ভারতের দুটি প্রাচীন মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদমুখর ছাত্রদের ওপর পুলিশ হামলা করেছিল। হামলার প্রতিবাদ করেছেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ভারতীয় ছাত্র ও অ্যালামনাইরা।

জাতিসংঘ মানবাধিকার অফিস মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর বৈষম্যমূলক হিসেবে আইনটির নিন্দা করেছে। কয়েকটি দেশ তাদের নাগরিকদের ভারতের কিছু রাজ্যে যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছে। সবচেয়ে অভাবিত প্রতিবাদ এসেছে পাকিস্তানের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে। সিএএতে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশে ‘নিপীড়িত’ হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধসহ মুসলমান ছাড়া অন্য যেকোনো ধর্মের মানুষকে নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান আছে। তারপরও পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের সংগঠনগুলো এই আইনের সমালোচনা করেছে, সেখানে নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রস্তাব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।

নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ চলছে





আইনটি পাস হওয়ার সময় যে তিনটি দেশের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের বর্তমানে কোনো সীমান্ত নেই। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে বৈরী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সীমান্তে সার্বক্ষণিক উত্তেজনা বিরাজমান। এ পরিস্থিতিতে সিএএ আইনের কারণে নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা হারানো ভারতীয় মুসলমানদের সবচেয়ে বেশি অনুপ্রবেশ ঘটার আশঙ্কা বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে। বিবিসির একটি রিপোর্টে ইতিমধ্যে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের কিছু ঘটনা তুলেও ধরা হয়েছে। কিন্তু এরপরও এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো অবস্থান গ্রহণ করেনি।

বাংলাদেশ সরকারের এ অবস্থান নানা কারণে উদ্বেগজনক। সরকার প্রথম থেকেই বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বর্ণনা করেছে এবং বাংলাদেশের চিন্তার কারণ নেই বলে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের কথা উল্লেখ করেছে। এড়িয়ে গেছে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, সঙ্গে আরও কয়েকজন বিজেপি নেতার অনুপ্রবেশকারীদের বাংলাদেশের বলে দাবি করার বিষয়টি। আইনটি পাস করার সময় লোকসভার আলোচনায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিপীড়নে বাংলাদেশকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে এক কাতারে ফেলার পর আমরা দেখেছি যে বাংলাদেশের দুজন মন্ত্রীর ভারত সফর স্থগিত হয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এটিও জানানো হয় যে এই স্থগিতের সঙ্গে সিএএর কোনো সম্পর্ক নেই; বরং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমন বক্তব্য প্রদান করেন যে ভারতে অনুপ্রবেশকারীরা বাংলাদেশের হলে তাদের ফেরত নেওয়া হবে।

এসব দেখে মনে হতে পারে যে সরকার বুঝে উঠতে পারছে না তাদের ঠিক কী প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত। তাদের পক্ষ থেকে অতীতে বিএনপির শাসনামলে, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু সিএএতে এই নিপীড়নের অভিযোগ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু সরকারের পর ঢালাওভাবে বাংলাদেশে সব সরকারের আমলে। বর্তমান সরকারের আমলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, প্রধান বিচারপতিসহ সরকারের শীর্ষ পদে তাদের বহু নিয়োগ ঘটেছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো হিন্দু জনগোষ্ঠীর পরিমাণও ২ শতাংশের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সিএএ বা এ নিয়ে লোকসভার আলোচনায় এর কোনো প্রতিফলন ঘটেনি।

বিজেপির বর্তমান যে রাজনীতি এবং সিএএর যা লক্ষ্য, তাতে বাংলাদেশে অতীতে নিপীড়ন হয়েছে, বর্তমানে হচ্ছে না, এটা বলা হবে—এমন আশা করারও সুযোগ নেই। সেখানে অভিযুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ, এর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া হবে বাংলাদেশের ওপর। সরকারকে তাই অবস্থান নিতে হবে দেশের পরিপ্রেক্ষিত থেকে, দেশের স্বার্থে।

২. সংখ্যালঘু নিপীড়ন সভ্যতার আদি যুগের সমস্যা। প্রথম মহাযুদ্ধের অবসানের পর জাতিপুঞ্জের উদ্যোগে নতুন জন্ম নেওয়া রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যে মানবাধিকার চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত হয়, তা ছিল সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার জন্য। জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মভিত্তিক বৈষম্য দূর করার জন্য এরপর বহু আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চুক্তি হয়েছে, বাংলাদেশ, ভারতসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এ ধরনের বৈষম্যকে সংবিধান ও আইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারপরও পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতেও এ ধরনের সমস্যা রয়ে গেছে। উগ্র জাতীয়তাবাদ, ধর্ম ও বংশগত পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি ও সন্ত্রাসী হামলা বৃদ্ধির কারণে সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর বহু অঞ্চলে এ সমস্যা আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।

আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে এ সমস্যা আগের চেয়ে প্রকট হয়েছে। এটি কী ভয়ংকর পর্যায়ে যেতে পারে, তা আমরা পাকিস্তানে আসিয়া বিবি মামলায় দেখেছি। ভারতে ক্ষমতাসীন দলের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রভাব কী প্রকটভাবে পড়েছে, তা গো–মাংস ভক্ষণ নিয়ে নির্বিচার তাণ্ডবকাণ্ডে আমরা লক্ষ করেছি। বাংলাদেশে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহানির কিছু ঘটনা ঘটেছে।

সংখ্যালঘু নিপীড়ন কমবেশি সব জায়গায় রয়েছে। কিন্তু একটি দেশ এ কারণে একতরফাভাবে কোনো প্রমাণ ছাড়া অন্য দেশের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ করলে সে দেশটি নিশ্চুপ থাকে না। সিএএতে পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের মতো দেশের কাতারে বাংলাদেশকে ফেলার পর সরকারের তাই নিশ্চুপ থাকার কারণ নেই।

সিএএর বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান নেওয়ার আরও অনেক বড় যৌক্তিকতা হচ্ছে এর সম্ভাব্য প্রভাব। এই আইনের কারণে ভারত থেকে লাখ লাখ মুসলমানের বাংলাদেশে চলে আসার মতো চাপ বা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, এর আলামত এখনই দেখা যাচ্ছে। এটি সত্যি সত্যি ঘটলে তা সামাল দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের আছে কি? গণহত্যার মুখে রোহিঙ্গারা প্রাণভয়ে একসঙ্গে এ দেশে চলে এসেছে বলে তাদের জন্য আমরা কিছু বিদেশি সাহায্য পাচ্ছি। ভারত থেকে মুসলমানরা ভীতি ও অনিশ্চয়তার কারণে এ দেশে আসতে থাকলে তেমনটি ঘটবে না।

ভারতের এই আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে মানবিক কারণেও। এই আইন প্রতিবেশী তিনটি রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার জন্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এমনকি তারা স্বেচ্ছায় ভারতে চলে গেলেও তা সেখানকার জনগোষ্ঠীর জীবনে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। আসামসহ ভারতের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে তার আভাস আমরা পাই।

বছর চারেক আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ইউরোপের বিভিন্ন দেশে থাকা ইহুদিদের আহ্বান জানিয়েছিলেন ইসরায়েলে চলে আসার জন্য। ইউরোপ আর আমেরিকায় ধর্মীয় উগ্রতা এবং পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির জোয়ারে আক্রান্ত হচ্ছিল ইহুদিরাও। ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে এমন হামলার পর তিনি এ আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর এ আহ্বানের পর ইউরোপ-আমেরিকায় ইহুদির জীবনে অনিশ্চয়তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের এ আইনও, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোতে সম্প্রদায়গত সম্পর্কের অবনতি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।

বিজেপি এই আইনকে নিপীড়িত মানুষের রক্ষাকবচ হিসেবে দাবি করেছে। সমালোচকেরা বলছেন, তাহলে ভারত পাকিস্তানের আহমদিয়া বা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা কেন বলছে না? তাঁদের বক্তব্য, ভারতের এ আইন ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় আবেগ ব্যবহার করে ক্ষমতায় থাকার অভিপ্রায় থেকে নেওয়া। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে এই আইন প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতেও এ ধরনের রাজনীতিকে বেগবান করতে পারে।

৩. ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আমাদের বিশ্লেষণের বিষয় হতে পারে, কিন্তু প্রতিক্রিয়ার বিষয় নয়। তবে এই আইনের প্রভাব অবশ্যই আমাদের প্রতিক্রিয়া দাবি করে। এই আইন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাঝুঁকি ও দেশে ভারতীয়দের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতির ওপর এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে।

দেশের স্বার্থে অবশ্যই সরকারকে এর বিরুদ্ধে স্পষ্ট ও জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার ও সুরক্ষিত করতে হবে। সেই সঙ্গে দেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও বৈষম্যহীনতাকে আরও সুরক্ষিত করতে হবে নিজস্ব সাংবিধানিক দায় থেকে।

এনআরসি আর সিএএ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, এটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হওয়ার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলোকেও এ বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া উচিত।

  • আসিফ নজরুল  —  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক 
  • কার্টসি - প্রথম আলো/ ডিসেম্বর ২২, ২০১৯

Thursday, December 19, 2019

অপুষ্ট এক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম

আসফিয়া আজিম

অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের সারিতে ঢুকে পড়েছে। বিশ্বব্যাংকের এ বছরের দারিদ্র্য পর্যালোচনা সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত এক দশকে আমাদের দারিদ্র্য কমে এসেছে অর্ধেকে। খাদ্য উৎপাদনে গত কয়েক বছরে আমরা আশাতীত উন্নতি করেছি। মানব উন্নয়ন সূচকেও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আমাদের অবস্থান বেশ ভালো। এ পটভূমিকায় সহজেই এমন আত্মতৃপ্তি আসতে পারে যে আমাদের পুষ্টি-পরিস্থিতিও তাহলে নিশ্চয়ই যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক।

৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন সেই আশাব্যঞ্জক অনুমানে ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়েছে। খবরটি বলছে, দেশের প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে না। এর আগে ৪ নভেম্বর প্রথম আলো ‘খাদ্য উৎপাদন ও অপুষ্টি দুটোই বেড়েছে’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেই প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন তিন থেকে পাঁচ গুণ বাড়া সত্ত্বেও গত এক বছরে দেশে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা মোটেই কমেনি, বরং বেড়েছে আরও চার লাখ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি’ এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার ‘বৈশ্বিক ক্ষুধাসূচক’-এর প্রতিবেদনের ভিত্তিতে করা এ প্রতিবেদন বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলঙ্কা, ভুটান, নেপাল ও মালদ্বীপের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যশক্তি গ্রহণের পরিমাণ কম। শুধু খাদ্যশক্তিই নয়, মাংস ও দুধের মতো পুষ্টিকর আমিষ গ্রহণের দিক থেকেও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। এর অনিবার্য ফলাফল অপুষ্টি। এ অপুষ্টির সবচেয়ে করুণ শিকার শিশু এবং গর্ভবতী ও প্রসূতি মা, যাঁরা আমাদের ক্রম–উন্নতিশীল এ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ রচনা করছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ওয়েবপেজে সম্প্রতি প্রকাশ পাওয়া ‘প্রগতির পথে’ নামে অন্য আরেকটি জরিপের প্রারম্ভিক প্রতিবেদনের দিকে চোখ ফেরানো যাক। ইউনিসেফের কারিগরি সহযোগিতায় পরিচালিত এই প্রতিবেদন আমাদের দিচ্ছে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষাসহ মানব উন্নয়নের কয়েকটি সূচকের সাম্প্রতিক ছবি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সামগ্রিকভাবে শিশুর পুষ্টিপরিস্থিতির উন্নয়ন দৃশ্যমান হলেও বেশ কিছু গুরুতর প্রচ্ছন্ন ঝুঁকি এখনো রয়ে গেছে, এমনকি শিশুপুষ্টির গুরুত্বপূর্ণ কিছু সূচকের ধারাও অবনতির দিকে। যেমন, শিশু জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে মায়ের দুধ দান, দুধদানের ব্যাপ্তিকাল ও শিশুখাদ্যের বৈচিত্র্য—এই তিনটি সূচকেই গত ছয় বছরে অবস্থার অবনতি ঘটেছে। ২০১৩ সালে জন্মের পরপরই শিশুকে শালদুধ খাওয়াতেন ৫৭ শতাংশ মা। ২০১৯ সালে সেটি নেমে এসেছে ৪৬ শতাংশে। কমে এসেছে মায়ের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপ্তিকালও। এ ছাড়া প্রতি দশটি শিশুর মধ্যে সাতজনের ভাগ্যেই ন্যূনতম পুষ্টিবৈচিত্র্যময় খাবার জুটছে না।

আমরা জানি, শিশুর জন্মের পরপরই শালদুধ দান, ছয় মাস বয়সের পর পুষ্টির বিচারে বৈচিত্র্যময় খাবার এবং পুরো দুই বছর পর্যন্ত মায়ের দুধ খাওয়ানো শিশুর পূর্ণ বিকাশের আবশ্যিক শর্ত। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, এসব যথাযথভাবে করা গেলে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ যথাযথ ও দ্রুত হয়। সে বুদ্ধিদীপ্ত ও সক্ষম মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে। এ কারণে চিকিৎসক, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ এবং নীতিনির্ধারকেরা এই সূচকগুলোর ওপর খুবই গুরুত্ব দিচ্ছেন। বাংলাদেশের মতো স্বল্প সম্পদের দেশ শুধু এই সূচকগুলোর সাফল্যের মধ্য দিয়ে শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি ও সংক্রামক রোগের ঝুঁকি দারুণভাবে কমিয়ে আনতে পারে। দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য নতুন প্রজন্ম তৈরি করারও এটিই মূল ভিত্তি। চীনের অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে আমাদের উদাহরণ হতে পারে।

প্রশ্ন হলো গত ছয় বছরে এসব সূচকে আমাদের পিছিয়ে পড়ার কারণ কী? সেভ দ্য চিলড্রেনের বছরখানেক আগের একটি প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে অযাচিত অস্ত্রোপচার-নির্ভর প্রসবের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদির অভাবে প্রসূতি ও শিশুর উল্লেখযোগ্য অংশ আক্রান্ত হয়ে পড়ছে বিভিন্ন সংক্রামক রোগে। ফলে জন্মের পরপর শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানো যাচ্ছে না। অস্ত্রোপচারের পর মায়ের চেতনা ফেরার আগে শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর জন্য যে দক্ষ আর উদ্যোগী স্বাস্থ্যকর্মী দরকার, দেশে তার প্রকট অভাব। শালদুধ নিয়েও অজ্ঞতা ও কুসংস্কার ব্যাপক। বাংলাদেশে ঘরে সন্তান প্রসবের সংখ্যা এখনো যথেষ্ট এবং সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রীদের মধ্যেও শালদুধ নিয়ে কুসংস্কার কাটেনি।

শিশুকে মায়ের দুধ ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর ব্যাপ্তিকাল যে ২০১৩ সালের চেয়েও কমে এসেছে, তার কারণ জটিল। দেশের অর্থনীতিতে নারীদের সম্পৃক্ততা বেড়েছে। এতে নারীদের আত্মনির্ভরশীলতা এবং পারিবারিক সচ্ছলতাও এসেছে। কিন্তু নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র এবং সামাজিক সুরক্ষা-বলয়ের অভাব মা ও শিশুর সম্পর্ককে জটিল সমীকরণের দিকে ঠেলে দিয়েছে। মায়ের কাছাকাছি থাকতে না পারায় বহু শিশু বঞ্চিত হচ্ছে মায়ের দুধ ও সঠিক পুষ্টিকর খাবার থেকে। আমাদের দেশে কর্মক্ষেত্রে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র তো দূরস্থান, অনেক প্রতিষ্ঠানে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটিও দেওয়া হয় না। ফলে বহু মা সন্তানকে দুই বছর তো দূরের কথা, ছয় মাসও দুধ দিতে পারেন না। তার জায়গা দখল করে নেয় কৌটার দুধ, যা পুষ্টির বিচারে মায়ের দুধের কোনো বিকল্পই হতে পারে না। আর নিম্নবিত্ত মায়েরা তো কৌটার দুধের বদলে শিশুর খিদে মেটান চালের গুঁড়া বা সুজিজাতীয় শর্করায়। দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক বেড়ে ওঠে প্রয়োজনীয় আমিষ, চর্বি, ভিটামিন আর মিনারেল ছাড়াই। এখনো আমাদের নিয়তি তাই প্রতি পাঁচটিতে একজন খর্বকায় এবং প্রতি নয়টিতে একজন কৃশকায় শিশু।

এখন আমরা করবটা কী? সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হয়ে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং কৌটার দুধের প্রচারের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ ঘটাতে হবে। কর্মক্ষেত্রগুলোতে দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্যোগী করে তোলা প্রয়োজন। চিকিৎসক বা নার্স থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যকর্মী-মাঠকর্মী-ধাত্রীদের শিশুর পুষ্টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ তো দিতেই হবে। বস্তুত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতি দিতে হলে অপুষ্টি নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতি গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন দরকার। এটা করতে হবে মাঠপর্যায় থেকে উঠে আসা নিয়মিত পরিসংখ্যান ও তথ্যের নিবিড় বিশ্লেষণের ভিত্তিতে। বহু খাতভিত্তিক সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা মাঠকর্মী বা ধাত্রীদের মাধ্যমে এ পরিস্থিতির খোলনলচে পাল্টাবে না।

  • আসফিয়া আজিম: জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টিকর্মী
  • কার্টসি- প্রথম আলো/ ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯

রাজাকারের তালিকা ও ইতিহাস বিকৃতির দায়

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
সায়ন্থ সাখাওয়াৎ

‘দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে শহীদ হয়েছেন। অথচ এত বছর পর রাষ্ট্র আমাকে ও আমার মাকে রাজাকারের খেতাব দিল। এই লজ্জা, এই দুঃখ কোথায় রাখব? এখন আর বেঁচে থেকে কী লাভ?’ একজন মুক্তিযোদ্ধার এই যে আক্ষেপ, এই যে বেদনা, তার রচয়িতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবিদার আওয়ামী লীগ।

কিছুদিন আগেই ‘যারা আমার ছেলেকে চাকরিচ্যুত করেছে, পেটে লাথি মেরেছে, শেষযাত্রার কফিনে তাদের সালাম, স্যালুট আমি চাই না’ চিরকুট লিখে বুকভরা অভিমান নিয়ে, রাষ্ট্রীয় সম্মান না নিয়েই চিরবিদায় নিয়েছেন দিনাজপুরের মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন। এমনি বহু জানা-অজানা অপমানের বেদনা বয়ে বেড়াতে হয়েছে বা হচ্ছে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকেই।

মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করেছিল বরিশালের আইনজীবী সুধীর কুমার চক্রবর্তীকে। তার ছেলে আইনজীবী তপন কুমার চক্রবর্তী একজন গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রথম ধাপে ১০ হাজার ৭৮৯ রাজাকারের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে তপন কুমার একজন রাজাকার! একই তালিকায় রাজাকার বানানো হয়েছে তার মা প্রয়াত ঊষা চক্রবর্তীকেও। এ তালিকায় এমন সব ব্যক্তির নামও আছে, যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে পরিচিত। এসেছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার নামও (প্রথম আলো, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯)।

তপন কুমার চক্রবর্তীর মেয়ে মনীষা চক্রবর্তী পেশায় চিকিৎসক এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের বরিশাল জেলা শাখার সদস্যসচিব। তিনি বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ধমক ও মাস্তানি উপেক্ষা করেও মেয়র প্রার্থী হয়েছিলেন। তার বাপ-দাদাকে আওয়ামী লীগ রাজাকার বানাবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ আওয়ামী লীগের দৃষ্টিতে তাদের মতের বাইরে সবাই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী। কাদের সিদ্দিকী, ডক্টর কামাল হোসেনকে পর্যন্ত যেখানে রাজাকার বলা হয়, একজন সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক জিয়াউর রহমানকে পর্যন্ত যেখানে পাকিস্তানের চর বলা হয়, সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে রাজাকার তকমা দেওয়া হয় অবলীলায়, সেখানে মনীষার বাবা বা দাদি বাদ যাবেন কেন! তবে এই যে যা খুশি তাই করতে পারছে আওয়ামী লীগ, সে জন্য আমরাও কম দায়ী নই। আমরা যদি ওই ব্যক্তিদের বিষয়ে মানহানিকর কথা বলার সময় একযোগে সঠিক প্রতিবাদটা করতাম, তাহলে হয়তো এ অবস্থা তৈরি হতো না।

কিন্তু বরিশালের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মিহির লাল দত্ত এবং তার বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ জিতেন্দ্র লাল দত্তের নামও কেন এসেছে তালিকায়, সে এক রহস্য। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর নামইবা কেন এলো সেটাও আরেক রহস্য।

রাজাকারের তালিকায় বাবা ও দাদার নাম আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করে মিহির লাল দত্তের ছেলে শুভব্রত দত্ত বলেন, ‘আমার বাবা একজন ভাষাসৈনিক এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। আমার দাদা ও এক কাকা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। আমার বাবা ও শহীদ দাদার নাম কীভাবে রাজাকারের তালিকায় এসেছে, সেটা আমার বোধগম্য নয়।’

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় নিজের নাম দেখে হতবাক, বিস্মিত, মর্মাহত ও অপমানিত হয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু। তিনি বলেছেন, সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষ সীমাহীন অযতœ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে অত্যন্ত অবহেলার সঙ্গে যে তালিকা প্রচার ও প্রকাশ করেছে, তা প্রমাণিত। তিনি একুশে পদকপ্রাপ্ত। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী তিনি তালিকাভুক্ত ভাতাপ্রাপ্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা। মন্ত্রণালয় তাকে সনদও দিয়েছে। বর্তমান সরকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দায়িত্বটি পালনের জন্য যাচাই-বাছাই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই তাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর নিয়োগ করেছে। আর এত দিন পর জানা গেল সেই লোক রাজাকার!

কিন্তু এত্তো বড় ব্লান্ডার করার পর যখন সবাই সমালোচনামুখর, তখন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলে দিলেন, আমরা না, রাজাকারের এই তালিকা পাকিস্তানিরা করেছে। আমরা নিজেরা কোনো তালিকা প্রস্তুত করিনি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা যে তালিকা করেছে, আমরা শুধু তা প্রকাশ করেছি। সেখানে কার নাম আছে আর কার নাম নেই, সেটা আমরা বলতে পারব না।

স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও এসে একাধারে এগারো বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও যদি পাকিস্তানের করা রাজাকারের তালিকা কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রকাশ করতে হয়, তাহলে এটা বুঝতে আর বাকি থাকে না যে, এ দলটি মুক্তিযুদ্ধেও প্রকৃত ইতিহাস রক্ষণাবেক্ষণ না করে অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল।

আসলে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আওয়ামী লীগের প্রকৃত দরদ কতটা আর তাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানোর কৌশল কতটা, সে প্রশ্নও কেউ কেউ তুলছেন। ১৯৭১ থেকে ৭৫ এবং ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল ক্ষমতায় থেকেও এই দলটি মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আলাদা একটি মন্ত্রণালয় করার কথাও ভাবেনি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কল্যাণ তহবিল পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে ২০০১ সালের ২৩ অক্টোবর এই মন্ত্রণালয়টিও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকারই গঠন করেছিল। জিয়াউর রহমান যুদ্ধের যে ঘোষণাটি দিয়েছিলেন, তা মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সে কারণেই জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দল গঠনের পর তার সঙ্গেই শামিল হয়েছিলেন ব্যাপকসংখ্যক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, যারা তাস খেলে আরাম আয়েশে থেকে সার্টিফিকেট নেননি। যুদ্ধের ময়দানে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যুদ্ধ করেছেন।

রাজাকারের তালিকা ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানিত করার প্রেক্ষাপটে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন। আওয়ামী লীগের কারা কারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাদের তালিকা প্রকাশ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আজকে আওয়ামী লীগের হাতেই গণতন্ত্র নিহত হয়েছে, যারা দাবি করে তারাই স্বাধীনতাযুদ্ধের একমাত্র ধারক-বাহক।

আওয়ামী লীগের এই যে চেতনার দোহাই, এই যে মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় সম্পদ বানিয়ে কুক্ষিগত করা, তার পেছনে যে আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, সেটা পরিষ্কার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা তো সংবিধানেই আছে। ‘... আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে;।’ ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্র্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’ এই তো সংবিধানে সন্নিবেশিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এগুলো কি রক্ষা করছে আওয়ামী লীগ সরকার? এ দেশে তাদের সমর্থকরা ধনী থেকে আরও ধনী হচ্ছে। আবার অন্যদিকে সাধারণ জনগোষ্ঠী আরও গরিব হচ্ছে। বিশ্বের অতিদরিদ্র পাঁচটি দেশের মধ্যেও বাংলাদেশ একটি হচ্ছে। তাহলে কীসের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলো? এই দেশে কি আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হয়েছে? এই দেশ কি জনগণের হয়েছে? বরং এসব কিছু লাঞ্ছিত হয়েছে আওয়ামী লীগের হাতে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে না দেওয়ায় দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে একটা দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। আর সেই দেশে সেই দল আওয়ামী লীগ মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিল! মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংসকারী এর থেকে বড় কাজ আর কী হতে পারে?

এই দেশ স্বাধীন করতে যে ত্রিশ লাখ মানুষ শহীদ হলেন, তাদের পরিবারের খোঁজ কি রাখে এই সরকার? ত্রিশ লাখের মধ্যে ঠিক কতটা পরিবার পাচ্ছে রাষ্ট্রীয় সুবিধা? সেটা মোট শহীদের কত শতাংশ? কেন এত বছরেও মুক্তিযুদ্ধে প্রকৃত শহীদের তালিকাটি করা গেল না? জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে কি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান কম? তাহলে জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা যে সম্মান ও সুবিধা পাচ্ছেন, তেমনি তালিকা করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদেরও কেন সম্মান ও সুবিধা দেওয়া হবে না? একসময় সে তালিকা করা হয়তো আরও দুরূহ হয়ে পড়বে। এখনো সময় আছে। প্রত্যেক ইউনিয়নভিত্তিক শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা করে তাদের নামফলক দেওয়া যেতে পারে ইউনিয়ন পরিষদের সামনে। শত বছর, সহস্র বছর পরও যাতে ওই এলাকার মানুষ জানতে পারে এই দেশটি স্বাধীন করতে তাদের কোন কোন বীর স্বজন জীবন দিয়েছেন। এদিকে হয়তো যাবে না এ সরকার। কারণ এখানে চেতনার বাণিজ্য হওয়ার সম্ভাবনা কম।

আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ ও তার চেতনাকে ভুলভাবে বহুল ব্যবহার করে এটাকে রীতিমতো হাস্যকর করে ছেড়েছে। এই যে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করল, এটা তো সরকারি দলিল। এর মাধ্যমে কি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিকৃতি করা হয়নি? শুধু ভুল স্বীকার করে তালিকা প্রত্যাহারই কী যথেষ্ট?

মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী বিদেশি বন্ধুদের দেওয়া ক্রেস্টে ভেজাল নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল ২০১৪ সালে। তখন একটি জাতীয় দৈনিকে লেখক কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছিলেন, ‘পৌনে তেরো আনাই খাদ’। আসলে শুধু ক্রেস্টের সোনায় নয়, আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একক মালিকানার দাবির অন্তত পৌনে তেরো আনাই খাদ।

  • লেখক, চিকিৎসক ও কলামনিস্ট
  • কার্টসি - দেশ রূপান্তর / ডিসেম্বর ১৯ , ২০১৯

Tuesday, December 17, 2019

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন অবশ্যই প্রশাসনিক ও প্রায়োগিক হতে হবে

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ


ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

একটি দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা ভীষণ তাত্পর্যপূর্ণ। অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে এর নিবিড় সংযোগ বিদ্যমান এবং অন্যান্য খাত যেমন—ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্প, রফতানি, আমদানির পাশাপাশি অধিক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতিতে আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। যেকোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের প্রভাব এড়াতে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং অধীনস্থ ব্যাংকের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকারিতা সরাসরি সংস্থাটির স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত।

বিষয়টি প্রশাসনিক সমস্যাকে ঘনীভূত করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার আধুনিক ধারণাটি বিকশিত হয়। ১৯২৯-৩৯ সালের মহামন্দার পর আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা ও লক্ষ্য নির্ধারণ এবং আর্থিক নীতি সম্পাদনের ক্ষমতা দেয়। ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে মূল্যস্ফীতির জোয়ারের ফলে বেশির ভাগ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের নীতিগুলো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে সফল হয়। তবে সে সময় প্রেসিডেন্ট রিগানের চিফ অব স্টাফ ডোনাল্ড রেগান যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের চেয়ারম্যান পল ভলকারকে ১৯৮৪ সালের নির্বাচনের আগে নীতিমালার হার না বাড়ানোর পরামর্শ দেন। বিনা বাক্য ব্যয়ে সেদিনের মিটিং থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন ভলকার, তবে সে পরামর্শ মোতাবেক নীতি গ্রহণ পরবর্তী সময়ে স্বল্প মূল্যস্ফীতি ও স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণ হয়। ফলস্বরূপ অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকার কর্তৃক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার ওপর জোর দেয়া হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার বিষয়টি বিবেচনা করা হয় গুরুত্বপূর্ণ দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে। প্রথমটি স্বাধীনতার লক্ষ্য, দ্বিতীয়টি কার্যসম্পাদনে স্বাধীনতা। স্বাধীনতা সম্পর্কিত বিষয়গুলোয়, বিশেষ করে সরকারের অন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তুলনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথেষ্ট পরিমাণ স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করে। প্রধান লক্ষ্যগুলো, বিশেষ করে মূল্য স্তর (মূল্যস্ফীতি) ও প্রবৃদ্ধির রক্ষণাবেক্ষণকে সাধারণত প্রধান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যা-ই হোক, প্রবৃদ্ধি হার এবং মূল্যস্ফীতির হার আর্থিক স্থিতিশীলতা ও দ্রুততর প্রবৃদ্ধি অর্জনে সরকারের বিস্তৃত নীতি পরামর্শ দ্বারা নির্ধারিত হয়। আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক (ফেড) সম্ভবত সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করে। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ব্যাংক অব ইংল্যান্ড রাজস্ব দপ্তরের মন্ত্রীদের দ্বারা প্রভাবিত থাকায় পুরোপুরিভাবে স্বাধীন ছিল না। ইউরো ব্যবহারকারী দেশগুলোর হয়ে সুদের হার পর্যবেক্ষণ করে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটি ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত স্বাধীন ছিল। তবে বর্তমানে আমেরিকা সরকার সুদের হার কমানোর জন্য ফেডের ওপর যারপরনাই চাপ প্রয়োগ করছে, যা ফেডকে ঘিরে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের লক্ষণ। ব্যাংক অব জাপান ২০১৩ সালে সরকারের সঙ্গে নীতি সমন্বয় করতে রাজি হয়, পদক্ষেপটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা হ্রাস করে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার বিষয়টি বিতর্কযোগ্য, তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা-ই হোক না কেন, ব্যাংকের লক্ষ্য অর্জনের জন্য, বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নত আর্থিক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব ধরনের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া জরুরি। তাই ব্যাংককে তার সব কার্যকরী ও সিদ্ধান্তগত কার্যক্রমে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন হতে হবে।

পারস্পরিক নির্ভরতাবিষয়ক প্রশ্নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে কৃতিত্ব দেয়া থেকে বিরত থাকতে সক্ষম হবে; এটি সরকারের ওপর নির্ভর না করেই তার ব্যয় নির্বাহ করতে পারে কিনা; গভর্নর কিংবা পরিচালক পর্ষদ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে কিনা; মুদ্রানীতি অনুসরণে গভর্নর স্বাধীন কিনা; আর্থিক সরঞ্জাম নির্বাচনে এটি কতটা স্বাধীন, সর্বোপরি এটি ব্যাংকিং নীতি ও ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি প্রভাবমুক্ত কিনা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদানের মাধ্যমে রাজনৈতিক, সামষ্টিক অর্থনীতি এবং অর্থ সংক্রান্ত—এ তিনটি বিষয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হতে পারে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ততা মূল্যের স্থিতিশীলতা, স্বাধীন পরিচালক পর্ষদ যারা দীর্ঘ সময়ের জন্য নির্বাচিত হবেন, যাদের অন্যদের থেকে পৃথক করা হবে, সংসদ ও আইনসভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপের জবাবদিহিতা এবং বিরোধ নিষ্পত্তির সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া ইত্যাদি লক্ষ্যকে ধারণ করবে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই মুদ্রা ও বিনিময় হার নীতি গঠনের ইঙ্গিত দেয়। আর্থিক স্বাধীনতা জোর দেয় হিসাবের স্বচ্ছতা, বিচক্ষণতার নীতি অনুসরণ, আর্থিক ভর্তুকি যেমন পছন্দসই সুদের হার, বিনিময় হারের গ্যারান্টি, নগদ অলাভজনক বিতরণ ও লোকসানের সংযোগ সীমাবদ্ধকরণ এবং ব্যাংকের নিট সম্পদ। সুতরাং স্বায়ত্তশাসন অবশ্যই প্রশাসনিক ও প্রায়োগিক হতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে আর্থিক নীতি সম্পাদন, ব্যাংকারদের ব্যাংক, সরকারের ব্যাংকার ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তত্ত্বাবধান। ব্যাংক অব ইংল্যান্ড (বিওই) মূলত মুদ্রানীতিমূলক কার্যাদি নিয়ে কাজ করে, এছাড়া অন্যান্য কার্য প্রুডেনশিয়াল রেগুলেশন অথরিটি (পিআরএ) এবং ফিন্যান্সিয়াল কন্ডাক্ট অথরিটি (এফসিএ) কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়; যারা সার্বিকভাবে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের নির্দেশনা অনুসারিত এ দুটি স্বতন্ত্র সংস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই দ্বৈত কার্যাদি সম্পাদন করতে হয়। সুতরাং এর কাজের পরিধি বিশাল। অন্য সেক্টরগুলোর পাশাপাশি সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্ষমতা নিবিড়ভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পারফরম্যান্সের সঙ্গে সংযুক্ত।

নিচে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো উল্লেখ করা হলো, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজগুলোকে বর্ণনা করে।

লক্ষ্য: কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে ক্রমাগত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ নৈতিক মানসম্পন্ন দক্ষতা এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পেশাদারিত্ব অর্জন, মূল্য স্থিতিশীলতা ও আর্থিক ব্যবস্থার দৃঢ়তা বজায় রাখতে আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক খাতে তদারকি, দ্রুত ও বিস্তৃত অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সমর্থন, কর্মসংস্থান তৈরি এবং বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন।

উদ্দেশ্য: দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্দেশ্য অনুসারে নিম্নে উল্লিখিত কার্য সম্পাদন করে চলেছে:

১. আর্থিক ও ঋণ নীতিমালা প্রণয়ন; ২. মুদ্রা পরিচালনা ও পেমেন্ট সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ; ৩. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিচালনা করা এবং বৈদেশিক মুদ্রার বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং ৪. ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি, অর্থ, মুদ্রা এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক নীতিসম্পর্কিত ক্রিয়াকলাপ ও প্রভাব সম্পর্কে সরকারকে পরামর্শ দান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো যথাযথ হলেও এগুলোকে কার্যে পরিণত করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রসঙ্গে মূল তর্কটা হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিতর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে রাজনৈতিক চাপ ছাড়াই আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং কোনো ধরনের রাজনৈতিক ও কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ছাড়াই আর্থিক নীতি বাস্তবায়িত করতে পারে কিনা। বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃত্বগত সীমাবদ্ধতা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, নন-পারফর্মিং লোন বৃদ্ধি, সুশাসনের ঘাটতি ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার পরিণতি হিসেবে ব্যাংকের ওপর থেকে জনগণের আস্থা কমেছে। অবস্থা বিশ্লেষণে মনে হয় যে বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত অভ্যন্তরীণ (ব্যাংকের মধ্যকার সমস্যা) এবং বাহ্যিক (ব্যাংকের পরিধির বাইরে) উভয় ধরনের প্রতিবন্ধকতার কারণে ব্যাংকিং খাতে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা কঠিন বলে মনে হচ্ছে। চাপ প্রদানকারী সংগঠনগুলো যেমন ব্যাংক মালিকদের সমিতি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার (বিএবি), ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন অ্যাসোয়িসেশন অব ব্যাংকার, বাংলাদেশ (এবিবি) ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি ব্যাংকের স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ভারসাম্য তৈরির বিষয়টি চিহ্নিত করা জরুরি। যার মানে ব্যাংককে অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ কিংবা পুরোপুরি তাদের হাতে স্বাধীনতা ছেড়ে দেয়া উচিত নয়, যা প্রায়ই ব্যাংকিং বিপর্যয়ের কারণ হয়। অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী ফরাসি অর্থনীতিবিদ জাঁ তিহল তার সহকর্মীকে নিয়ে যৌথভাবে লেখা একটি বইয়ে বিষয়টিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আর্থিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমরা কী অর্জন করতে যাচ্ছি, তা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আমানতকারী, বিনিয়োগকারী, সাধারণ জনগণ এবং প্রকৃত অর্থনীতিকে (প্রকৃত পণ্য ও পরিষেবা) সুরক্ষিত করা। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় যুক্তিটি হচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মতান্ত্রিক ঝুঁকির ডমিনো ইফেক্ট (ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকা প্রভাব) হ্রাস করা, যা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভিত্তি নষ্ট করে প্রকৃত আউটপুট, নিম্ন প্রবৃদ্ধি, উচ্চ বেকারত্ব এবং মানবকল্যাণ কার্যক্রম হ্রাসের পরিণতি ডেকে আনে। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান সংকট প্রসঙ্গে এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা আমাদের দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতির সবচেয়ে যথাযথ উদাহরণটি হচ্ছে সোনালী ও বেসিক ব্যাংকে কেলেঙ্কারি; যেখানে ঋণগ্রহীতা এবং ব্যাংক কর্মকর্তাদের আঁতাতে অস্বচ্ছ পন্থায় জনসাধারণের বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। এ ধরনের জালিয়াতির জন্য যারা দায়ী, তাদের এখন পর্যন্ত কোনো শক্তিশালী প্রশাসনিক ও আইনি পদক্ষেপের আওতায় আনা হয়নি, বরং তাদের ‘বিকৃত প্রণোদনা’ দেয়া হয় এবং ওই ব্যাংক কিংবা অন্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সৎ কর্মীদের প্রান্তিকীকরণ করা হয়েছিল।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ‘দ্বৈত’ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বিদ্যমান। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক যেমন সোনালী, রুপালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক এবং বেসিক ব্যাংকের মতো বিশেষায়িত ব্যাংক (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র, শিল্প ও বাণিজ্যিক ব্যাংক লিমিটেড), বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি), বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) এবং কয়েকটি সংবিধিবদ্ধ ব্যাংক যেমন আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক আর কর্মসংস্থান ব্যাংকগুলো অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। অন্যদিকে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিদেশী ব্যাংক, ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। নিয়ন্ত্রণের এ দ্বৈততার ফলে সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোর জন্য অসমন্বয়সাধিত ও প্রায়ই দুর্বল নীতিগত পদক্ষেপ গৃহীত হয়। ওই ব্যাংকগুলোয় বিচক্ষণ ও পরিচালনা মান কার্যকর করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের গুরুতর সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা ‘ডমিনো ইফেক্ট’-এর মাধ্যমে গোটা ব্যাংকিং খাতকে দুর্বল ও অরক্ষিত করে তুলছে। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র অর্থনীতি কোনোভাবেই বিশ্বব্যাপী মন্দা অথবা বৃহত্তর অর্থনীতির নেতিবাচক নীতি থেকে প্রভাবমুক্ত নয়, সুতরাং বিশ্বব্যাপী স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক বিকাশের একটি শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। 

জি২০-এর মতো ফোরামে বাংলাদেশের সমপর্যায়ের রাষ্ট্রগুলোকে পুনরুদ্ধারের মতো স্থিতিশীলতায় একই ধরনের অগ্রাধিকার প্রাপ্তির পাশাপাশি লক্ষণ মোকাবেলার বাইরে স্থিতিশীল কাজের এজেন্ডার জন্য (যেমন ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় অক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির অপ্রতুলতা) অন্তর্নিহিত কারণগুলো সম্বোধন করতে (যেমন শিথিল নীতি, বিচক্ষণতা ও পরিচালনার মান না মেনে চলা, দুর্বল আর্থিক প্রতিবেদন, নিরবচ্ছিন্ন তারল্য প্রসারণ, যা বুদ্বুদগুলোকে সঞ্চারিত করে) জোরালো যুক্তি প্রদান করতে হবে। ২০০৭-০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের নেপথ্য কারণ ছিল বড় ধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থতা, ধসটি নিয়ন্ত্রণের মৌলিক বিষয়গুলো থেকে বেরিয়ে বিচক্ষণতা ও পরিচালনা মান বাস্তবায়নের বাইরে চলেছে। একটি স্বাধীন ও কার্যকর বাংলাদেশ ব্যাংক রাখার জন্য তিনটি বড় পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজনীয়: (১) ব্যাংকিংয়ের মূল বিষয়গুলোকে আরো বেশি স্পষ্টভাবে তুলে ধরে একটি শক্তিশালী ও স্বতন্ত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংক, (২) বহিরাগত রাজনৈতিক/ প্রশাসনিক চাপের কারণে ঘন ঘন পরিবর্তনের সাপেক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিচক্ষণ ও পরিচালনার মানদণ্ডগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন এবং (৩) সংকট তৈরির জন্য এবং একটি নির্দিষ্ট ব্যাংকে বা গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সংকটের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি/ প্রশাসনিক পদক্ষেপের জন্য তাত্ক্ষণিক সংশোধনমূলক ব্যবস্থা।

বাস্তববিশ্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা ও পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন সহজেই অর্জিত হয় না। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর উচিত রাজনৈতিক ও অন্যান্য বাহ্যিক চাপ কমাতে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং নিজেদের কর্মকাণ্ড ঘিরে জনসমর্থন অর্জনে সচেষ্ট হওয়া। ভালো বা খারাপ সময় যা-ই হোক না কেন, তত্ত্বাবধায়করা সর্বদা লবিস্ট ও রাজনীতিবিদদের দ্বারা চাপের মুখোমুখি হন, যা আর্থিক ব্যবস্থার স্থায়িত্বকে দুর্বল করতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণে সফল হওয়ার জন্য প্রাসঙ্গিক ও বাস্তববাদী নীতি, বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনা বিধি থাকতে হবে এবং তা নিশ্চিত করতে হবে, সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তা অনুসরণ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন রক্ষার জন্য ‘বিশেষ ব্যবস্থা ক্ষমতা’ বা ‘অ্যাড-হক’ ব্যবস্থা এড়ানো উচিত। ‘নীতি’ বনাম ‘বিশেষ ব্যবস্থা’ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংককে দৃঢ়তার সঙ্গে সমাধান করতে হবে, যেখানে নীতি ও বিধিগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে—কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার অযৌক্তিক ক্ষমতা প্রয়োগ চলবে না। উচ্চ প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংস্কারের বিপদ এড়াতে যথাযথ পেশাদারি অবস্থান প্রদর্শনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভারসাম্য বজায় রাখার সময় এসেছে।

  • ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অধ্যাপক/বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
  • কার্টসি  —  বণিক বার্তা/ ডিসেম্বর ১৫, ২০১৯

‘শেষ আপিলে দোষী না হওয়া পর্যন্ত আসামি মুক্ত থাকবে’

মইনুল হোসেন



ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্ট বিচারাধীন আসামিকে জেলে রাখার বাধ্যতামূলক বিধান বাতিল করে দিয়েছে। ফলে সাবেক প্রেসিডেন্ট লুলাসহ হাজার হাজার বন্দী উপকৃত হবে।

শেষ আপিলে সাজাপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত অপরাধীদের জেলে পাঠানোর আইন ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্ট গত নভেম্বর মাসে পরিবর্তন করে দেয়ার ফলে দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে কারাবন্দী ব্রাজিলের সাবেক বামপন্থী প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাশিও লুলা দ্য সিলভা মুক্তিলাভ করেছেন।

আলজাজিরার রিপোর্ট মতে, ব্রাজিলের পেনাল কোডের এই নতুন ব্যাখ্যা অনুযায়ী যেসব সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর আপিল এখনো শেষ হয়নি এরকম কয়েক ডজন বড়মাপের আসামি উপকৃত হবেন যাদেরকে গত বছর দুর্নীতির অভিযোগে জেলে যেতে হয়েছিল।

স্মরণীয়, ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিজয় অনুকূলে থাকার পরও ২০০৩ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনকারী প্রধান বামপন্থী নেতা, যার বয়স এখন ৭৪ বছর, নির্বাচনে লড়তে পারেননি কারাদণ্ড ভোগের কারণে।

একাধিক প্রকৌশলী সংস্থাকে সরকারি কাজ দেয়ার বিনিময়ে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রেসিডেন্ট লুলাকে আট বছর ১০ মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। প্রেসিডেন্টের মতো আরো অনেকে এখন কারাগারের বাইরে মুক্ত জীবনের স্বাদ পাবেন।

ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টের এই যুগান্তকারী রায় অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াইকারীদের মধ্যে যুক্তি ও চিন্তার খোরাক জোগাবে। এই রায়ের পেছনে যে যুক্তি রয়েছে সেটা অনস্বীকার্য। শেষ বিচারে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কারো কারাদণ্ড ভোগ করার অর্থ চূড়ান্ত বিচারে দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগেই অন্যায়ভাবে শাস্তি ভোগ করা। আদালতের শেষ বিচারে যদি দেখা যায় তিনি কোনো অপরাধ করেননি এবং তিনি নির্দোষ তাহলে তার কারাগারে বন্দী জীবন কাটানোর সময়ের জন্য কী করা হবে? জীবনের হারানো অংশ ফেরত দেয়ার কোনো পথ নেই।

কারাজীবনের ক্ষতি কিংবা পরিবার-পরিজনের ভোগান্তি পুষিয়ে দেয়ার কোনো উপায় নেই। আর্থিক ক্ষতিপূরণও যথেষ্ট হতে পারে না।

শেষ বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো বিচারাধীন বন্দীকে জামিনে মুক্ত থাকার অর্থই তো সে জামিনের শর্ত অনুযায়ী সদাচরণ করবে এবং শেষ বিচারে শাস্তি হলে তার উপস্থিতি নিশ্চিত থাকবে। এটাই তো হবে ন্যায়বিচারের কথা।

অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধ চূড়ান্ত বিচারে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে সাজা ভোগে বাধ্য করার কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। কিন্তু তারপরও নানা সমস্যার কথা তোলা হয় যাতে পুলিশি গ্রেফতারকে জেলে রাখার জন্য চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করা হয়।

অভিযুক্তকে অপরাধী হিসেবে দেখা হয় কেননা শাস্তি প্রদানের এক ধরনের নিষ্ঠুর মানসিকতায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। বন্দী থাকতে গিয়ে তার যে মৌলিক অধিকারগুলো এবং বন্দিজীবনের অবমাননাসহ আরো কতভাবে যে তার ক্ষতি হচ্ছে তা ভাবা হয় না। তার জীবিকা অর্জনের পথ বন্ধ হয়ে যায়। সমগ্র সমাজের কাছে তাকে এবং তার ঘনিষ্ঠদের হেয় হয়ে থাকতে হয়।

এসব হতভাগ্যদের নিয়ে সমাজের উচ্চাসনে যারা বসে আছেন তারা মনে করেন আইনের ঊর্ধেŸ থাকার ভাগ্য নিয়ে তারা জন্মগ্রহণ করেছেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের জন্য কোর্টে হাজির করলেই মনে করা হয় তারা অপরাধ করা লোক।

নিন্ম আদালতের সাথে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে মন-মানসিকতার এক বিরাট ব্যবধান রয়েছে। বিচার ব্যবস্থা বিচার ব্যবস্থাই। অসহায় গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির পক্ষে জজ-বিচারকদের তো থাকতেই হবে। এটাই তো সুবিচারের কথা যে অভিযুক্তকে নির্দোষ হিসেবে দেখতে হবে।

শেষ বিচারিক আদালতে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্তকে নিরপরাধ বলে গণ্য করতে হবে এবং আইন ও বিচারে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে অপরাধী বলা যাবে না। শেষ কথা বলা যাবে চূড়ান্ত বিচার শেষ হওয়ার পর। চূড়ান্ত বিচার শেষ হওয়ার আগে কেন অভিযুক্তকে অপরাধী হিসেবে দেখা হবে? কেন তার ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করা হবে? চিন্তা-ভাবনা করে এসব বিচারসংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে জজ-বিচারকদের।

এদিক থেকে দেখলে ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টের রায়কে যুগান্তকারী রায় বলতে হবে। বিচারকে ন্যায্য ও মানবিক করার চিন্তা-ভাবনা চলছে পৃথিবীর সর্বত্র। সাজার জন্য সাজা; নির্দোষ প্রমাণ করার কথা ভাবা হয় না- এটা তো পুলিশি রাষ্ট্রের মানসিকতা।

চূড়ান্ত বিচারে সাজা যদি বহাল না থাকে তাহলে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির জীবন কেন জেলে পচবে, কেন তিনি পরিবারের পরিচর্যা ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত জীবনযাপনে বাধ্য হবেন, কেন তার সব অধিকার কেড়ে নেয়া হবে, এ বিষয়ে যে কেউ যুক্তিপূর্ণ আলোচনা করতে পারেন, বোঝাতে পারেন। অধিকার হিসেবে এসব বিষয়কে আমরা যদি স্বীকার করে নিই তাহলে শেষ আপিলে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে অবশ্যই অভিযুক্তকে জেলে বন্দী রাখা অন্যায়। আপিলের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিন্ম আদালতের রায়ের কারণে কাউকে বন্দী রেখে সাজাপ্রাপ্ত হিসেবে দেখলে আপিল পর্যন্ত চলমান প্রক্রিয়াকে বিচার প্রক্রিয়া বলার সুযোগ থাকে না।

বিখ্যাত জুরিস্ট লর্ড ডেনিং বলেছেন, তিনি বিচার করতে গিয়ে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও বিচারকের মানবতাবোধ মনে রাখেন।

প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় ভয়ঙ্কর অপরাধীদের তুলনায় অনেক বেশি নিরপরাধ লোক দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। বছরের পর বছর কারাদণ্ড ভোগ করার কারণে বহু নারী-পুরুষের জীবন শেষ হয়ে গেছে আপিল শেষ হতে না হতে। ইতোমধ্যে তাদের সুখ্যাতি বিনষ্ট হয়েছে। যৌবন হারিয়ে গেছে এবং পরিবার ভেঙে গেছে। তাই দীর্ঘ কারাজীবনের পর আপিলে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার কি আর তেমন অর্থ থাকে!

প্রতিহিংসার মনোভাবদুষ্ট বিচারিক ধারণার ঐতিহ্য ভেঙে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারকগণ সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। এ কারণে অনেক বিচারক এবং আইনবিজ্ঞানী বিদ্যমান আইন ও বিচার ব্যবস্থায় মানবিক দিকের ওপর জোর দিচ্ছেন।

আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত আমরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের জামিনসংক্রান্ত আইন মেনে চলছি এবং পুলিশি শক্তির বাহাদুরি দেখানোর জন্য সেই আইনের প্রয়োগে অনেক বেশি কঠোরতা অবলম্বন করছি। শাসনতন্ত্র প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলো বা জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত মানবাধিকারগুলো তেমন কোনো গুরুত্ব পাচ্ছে না। এ জন্যই গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে হরদম জেলে পাঠানো হচ্ছে।

পুলিশি শক্তির এত বেশি অপব্যবহার করা হচ্ছে যে, রাজনীতি পুলিশি মামলার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এবং এ জন্য আদালত জামিন প্রদানে অনীহা দেখাচ্ছে। জামিন দানে অস্বীকৃতি কিংবা জামিন বাতিল করার ব্যাপারটি এখন নি¤œ আদালতের ক্ষমতা প্রদর্শনের সহজ উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে যাদের খরচ বহনের ক্ষমতা আছে তারা জামিনের কোনো সুযোগ আছে কি না, তার জন্য সুপ্রিম কোর্টে এসে ভিড় করছে।

আমাদের বিচারিক প্রক্রিয়া নিরপরাধ ব্যক্তিকে পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার করার ব্যাপারটি এতটাই সহজ করে দিয়েছে যে, যেদিন থেকে কাউকে গ্রেফতার দেখানো হবে সেদিন থেকেই সে অপরাধী। পুলিশের ইচ্ছায়ই তাকে বন্দী জীবন যাপন করতে হবে। সুতরাং এই সময়ে পুলিশের হাতে থাকবে সব ক্ষমতা এবং জনগণ থাকবে সর্বতোভাবে অসহায়।

এ ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার রক্ষায় যে নিশ্চয়তা শাসনতন্ত্রে দেয়া হয়েছ তার কতটুকু মূল্য থাকে। জামিন পাওয়ার অধিকারের ক্ষেত্রে আমরা বলতে গেলে ঔপনিবেশিক আমলের চেয়েও নিকৃষ্ট অবস্থায় রয়েছি। তখন বিচার ব্যবস্থায় রাজনীতি ছিল না।

আস্থা করার মতো নেতৃত্বের অভাবে জনগণ সংগ্রাম করার সাহস হারিয়ে ফেলেছে এমন ধারণা ক্ষমতাসীনদের যে কেউ পোষণ করতে পারেন। জনগণ তাদের মৌলিক ভোটাধিকার হারানোর ফলে সব অধিকারই অর্থহীন হয়ে পড়েছে। আমাদের মতো লোকেরা তাদের জন্য দুঃখ অনুভব করি, সেই সাথে নিজেদের জন্যও।

গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ চূড়ান্তভাবে সত্য বলে প্রমাণ করার আগ পর্যন্ত তিনি আইন ও আদালত প্রদত্ত জামিনের শর্ত অনুযায়ী অবশ্যই মুক্ত জীবনযাপনের অধিকার ভোগ করতে পারবেন। এটাই হবে মানবিক বিচার ব্যবস্থা। জামিনের আবেদন মঞ্জুর না করে পুলিশি বিচারে কাউকে জেলে আটক রাখা বিচার ব্যবস্থার জন্যও অপরাধ।

এ বিষয়ে ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিকদের চেয়ে আমাদের দেশের আইনজীবী ও বিচারকগণ সুবিচারের সৈনিকসুলভ চিন্তা-ভাবনা এখনই শুরু করতে পারেন।

  • লেখক বিশিষ্ট আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
  • কার্টসি  —  নয়াদিগন্ত / ডিসেম্বর ১৪,  ২০১৯

Thursday, December 12, 2019

সরকারি হাসপাতালে ক্রয়ে দুর্নীতি

জড়িত কর্মকর্তাদেরও কালো তালিকাভুক্ত করতে হবে

সম্পাদকীয়



সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন অফিসের কেনাকাটায় দুর্নীতিতে জড়িত সব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগটি সময়োচিত।

জানা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিশেষ অনুসন্ধান শাখার পরিচালকের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির তদন্ত চলছে। প্রথম ধাপে সরকারি অর্থ তছরুপসহ দুর্নীতির মামলা হয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানের নাম তালিকায় রাখা হচ্ছে।

বস্তুত কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হলে তার দায়দায়িত্ব ওই প্রতিষ্ঠানের ওপরই বর্তায়। তবে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান চলছে বা মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, পর্যায়ক্রমে তাদেরও আনা হবে এ তালিকায়। আমরা মনে করি, কেনাকাটায় অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও কালো তালিকাভুক্ত করা উচিত। তাহলেই এ ধরনের পদক্ষেপ দুর্নীতি রোধে সহায়ক হবে।

বস্তুত, সরকারি হাসপাতালের ক্রয়ে দুর্নীতি ও অনিয়ম একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ সরকারি হাসপাতালের অসাধু কর্মকর্তাদের একটি চক্র এ দুর্নীতির মূল হোতা।

তারা কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি করছে। হাসপাতালের জন্য যন্ত্রপাতি না কিনেই ভুয়া বিল-ভাউচারে টাকা তুলে নিচ্ছে। যে দামে যন্ত্রপাতি কিনছে, তার অনেক গুণ বেশি টাকার বিল করছে। আবার প্রয়োজন ছাড়াই মেডিকেল সরঞ্জাম কিনছে অর্থ আত্মসাতের সুযোগ তৈরির জন্য। সাম্প্রতিক সময়ে সোহরাওয়ার্দী, রংপুর ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন সরঞ্জাম ক্রয়ে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক সেট পর্দার (১৬ পিস) দাম দেখানো হয়েছে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা!

এভাবে সেখানে ১০ কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। আর রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সোয়া তিন কোটি টাকাই লোপাট করার অভিযোগ উঠেছে।

এ অবস্থায় সরকারি হাসপাতালে সরঞ্জাম ক্রয়ে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা জরুরি হয়ে পড়েছে। আর এজন্য প্রয়োজন সব ধরনের কেনাকাটার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।

ক্রয়সংক্রান্ত কমিটিতে কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রেও বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। ইতঃপূর্বে দুদকের এক সুপারিশে বলা হয়েছিল, সরকারি হাসপাতালে ওষুধ ও মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ করার জন্য ক্রয় কমিটিতে বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করা যেতে পারে।

এছাড়া হাসপাতাল পর্যায়ে যন্ত্রপাতি রিসিভ কমিটিতে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ সংস্থার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে যন্ত্রপাতি গ্রহণের ব্যবস্থা, যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার স্বার্থে দক্ষ জনবল নিয়োগ দিয়ে যন্ত্রপাতি সরবরাহের বিধান করা ইত্যাদি পদক্ষেপের কথাও বলা হয় দুদকের সুপারিশে। দুদকের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হল, হাসপাতালে বিদ্যমান মেডিকেল ইকুইপমেন্টের হালনাগাদ তথ্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা।

এক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক স্টক রেজিস্টারের সঙ্গে একটি ডিসপ্লে যুক্ত করা যেতে পারে। হাসপাতালে ই-রেজিস্টার চালু করা যেতে পারে। আমরা মনে করি, অভিযুক্তদের কালো তালিকাভুক্তির পাশাপাশি এসব সুপারিশও আমলে নেয়া উচিত। মোদ্দাকথা, সরকারি ক্রয়ের সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন, তা করতে হবে। সেই সঙ্গে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠামাত্র এর সুষ্ঠু তদন্ত করে নিতে হবে ব্যবস্থা।

  • কার্টসি - যুগান্তর/  ১১ ডিসেম্বর ২০১৯

মূল্যস্ফীতির থাবা

বাজার নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দিন

সম্পাদকীয়

এক মাসের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫৮ ভাগ। বলা হচ্ছে, দ্রব্যমূল্যের বাজারে অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতিতে। মূলত পেঁয়াজসহ মসলাজাতীয় পণ্য এবং শাকসবজির দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতির এই উল্লম্ফন ঘটেছে।

উল্লেখ্য, নভেম্বর মাসে দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৪১ শতাংশে। এটি আগের মাসে ছিল ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এর বাইরে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ, যা পূর্ববর্তী মাসে ছিল ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

বিবিএসের সিপিআই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং অক্টোবরে ছিল ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং অক্টোবরে ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ।

উদার বাণিজ্য ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বাজারের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত থাকে। শুধু এবারের ‘পেঁয়াজকাণ্ড’ নয়; অতীতেও অনেকেই সময় ও সুযোগ বুঝে বাজার অস্থিতিশীল করার নানা অপপ্রয়াস চালিয়েছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে।

যোগসাজশের মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থার স্বাভাবিক গতি যদি বাধাগ্রস্ত করা হয়, তবে একদিকে যেমন ভোক্তাস্বার্থের হানি ঘটে, অন্যদিকে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। বিগত কয়েক বছরে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ সত্ত্বেও পণ্যের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা যায়নি, যা মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ।

পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশে প্রায় প্রতিটি পণ্য ও খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি হিসাবেই গত এক বছরে চাল, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, ডাল, পেঁয়াজ ও শিশু খাদ্যের দাম ৫ শতাংশ থেকে ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

বাজারে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রয়ক্ষমতা না বাড়ায় সাধারণ মানুষ, বিশেষত নিুআয়ের শ্রমজীবীরা অসহায় বোধ করেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন উচ্চবাচ্য হয় না বললেই চলে। বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকারের শক্ত কোনো ভূমিকা নেই- এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

মূল্যস্ফীতির থাবা থেকে দেশের মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্রদের সুরক্ষা দিতে হলে বাজার নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি সরকারের আর্থিক প্রণোদনামূলক কর্মসূচিগুলো আরও উৎপাদনমুখী ও মানবসম্পদ উন্নয়নমুখী করা প্রয়োজন।

এর ফলে একসময় হয়তো দেখা যাবে, প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান দ্বারা তারা নিজেরাই স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। স্বস্তির বিষয় হল, এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দামবৃদ্ধির চাপ তুলনামূলকভাবে কম। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের দাম কম।

অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতি ও জিও পলিটিক্যাল কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে আমাদের দেশীয় বাজারে মূল্যস্ফীতির অভিঘাত পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এছাড়া বন্যার কারণে শাকসবজির উৎপাদন হ্রাস, ধানের আবাদ ও পণ্য সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হওয়া ইত্যাদি কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম কয়েক মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এ পরিস্থিতি যাতে স্থায়ী না হয় সরকার সে ব্যাপারে যত্নবান হবে, এটাই প্রত্যাশা।

  • কার্টসি - যুগান্তর/ ১২ ডিসেম্বর ২০১৯