— তাবিথ আউয়াল
দু'হাজার এগার সালের ৭ই জানুয়ারি বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে ভারতীয় রক্ষী বাহিনী-বিএসএফের গুলিতে নিহত হন ১৪ বছরের কিশোরী ফেলানি খাতুন। |
ভারতের পক্ষে অনেকবার বলা হয়েছে- বাংলাদেশ সীমান্তে মৃত্যু শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হবে। ১০ বছর আগে ২০১১ সালে 'ট্রিগার হ্যাপি' শীর্ষক হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন প্রকাশের পরে ভারত সরকার প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়। পাচারকারী ও অবৈধ পথে সীমান্ত পার হওয়া নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার চুক্তি করে বিজিবি-বিএসএফ। সে দেশের সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে আমরা অঙ্গীকার শুনতে পেয়েছি। এরও আগে ২০০৮ সালে ভারত সরকার ও বিএসএফ বাংলাদেশের জনগণকে আশ্বস্ত করেছিল। এতসবের পরও বাস্তবতা ভিন্ন।
বস্তুত ২০ বছর ধরে শত-সহস্র অঙ্গীকার-আশ্বাস-প্রতিশ্রুতির পরও আমরা ফেলানীকে কাঁটাতারে ঝুলতে দেখেছি। দেখেছি এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের নামে প্রহসন। ফেলানীসহ আলোচিত সীমান্ত হত্যার একটিরও বিচার হয়নি। ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ফেলানী খাতুনের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সেটাও মানেনি। আর আমাদের কর্তাদের দেখেছি ফেলানীকে নিয়ে নিশ্চুপ থাকার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে।
কোনো দেশের সরকারের প্রতিশ্রুতি এলে এমনটা প্রত্যাশা করাই যায় যে, কার্যক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন হবে। অথচ এই ইস্যুতে দেওয়া ভারতের প্রতিশ্রুতি কোনোভাবেই বাস্তবে রূপ পাচ্ছে না। বারবার দেখা গেছে, সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কোনো ঘোষণা হওয়ার পরপরই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। প্রাণহানির পর প্রতিটি ক্ষেত্রে বিএসএফ আত্মরক্ষার যুক্তি তুলে 'সবকিছ' ভুলে যেতে চাচ্ছে। বিজিবি কিংবা সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রতিবাদ, উদ্বেগ বা অনুরোধ তখন খুব যে কাজে আসছে না, তা অনেকটাই স্পষ্ট। অবশ্য বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, সীমান্ত হত্যার ঘটনায় বিএসএফের যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। বাহিনীটি বলছে, সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বেড়ে যাওয়ায় তারা উদ্বিগ্ন এবং প্রতিটি হত্যার ক্ষেত্রেই জোরালো প্রতিবাদ করা হচ্ছে।
আমরা জানি, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা নেই। বরং দু'দেশই বিভিন্ন পর্যায় থেকে দাবি করে আসছে- এখনকার সম্প্রীতি আর সুসম্পর্ক গৌরব করার মতো। বর্তমান সময়ের সম্পর্ককে দু'দেশের জন্য যুগান্তকারী হিসেবে দাবি করা হচ্ছে। তাহলে মৃত্যুর হিসাবে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তরেখা কেন বিশ্বের অন্যতম প্রাণঘাতী- এই প্রশ্নের উত্তর জানা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বন্ধুরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করার এ ধরনের উদাহরণ খুব কম বলে দাবি করে আসছেন প্রতিবেশী দু'দেশের মানবাধিকার কর্মী এবং কূটনীতি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রকাশ্যে না এলেও সীমান্ত ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে বোঝাপড়ায় বাংলাদেশের রয়েছে দুর্বলতা। ভারতের সঙ্গে নেপাল, চীন, ভুটান, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে। এমনকি ওইসব দেশের সঙ্গে ভারতের উত্তপ্ত সম্পর্কও লোকচক্ষুর আড়ালে নয়। অথচ সেখানে এ ধরনের হত্যার ঘটনার খবর মেলা ভার। এমন প্রেক্ষাপটে এটা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে আলোচনা হওয়া উচিত।
জানুয়ারি ২০২০ থেকে নভেম্বর ২০২০ সালের পরিসংখ্যান বলছে, সীমান্তে মারা গেছেন ৪২ জন। এর মধ্যে বিএসএফের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে ৩৫ জনের আর শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছেন ছয়জন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবের বরাতে সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে সীমান্তে নিহতের সংখ্যা ছিল ১৪ জন। ২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩ জনে। আরেক পরিসংখ্যানে সংস্থাটি বলছে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে সীমান্তে ১৫৮ বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। এ হিসাবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে গড়ে প্রতি ১২ দিনে একজন বাংলাদেশি নাগরিকের মৃত্যু হয়। আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ২৬, ২০১৪ সালে ৩৩, ২০১৫ সালে ৪৬, ২০১৬ সালে ৩১, ২০১৭ সালে ২৪, ২০১৮ সালে ১৪ এবং ২০১৯ সালে ৪৩টি সীমান্ত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধে আমরা ভারত বা বিএসএফকে কতটা চাপের মধ্যে রাখতে পারি। বিএসএফের ওপর তেমন কোনো চাপ নেই বলে সংবাদমাধ্যমের বদৌলতে খোদ সে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাদের বয়ান থেকে অনেক সময় জানতে পারি। এমনকি আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ধারণা রয়েছে, সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে পতাকা বৈঠক করা এবং নিহতদের মরদেহ গ্রহণ করা ছাড়া বিজিবির কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না। সীমান্তে নাগরিকদের মৃত্যুতে সরকারের পক্ষ থেকে আগে জোরালো প্রতিবাদ জানানোর রেওয়াজ ছিল, এখন ততটা নেই।
এমন বাস্তবতায় কিছু বিষয় আমাদের আরও হতাশ করে তোলে। যেমন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন একবার বললেন, সীমান্ত হত্যায় ভারত একতরফাভাবে দায়ী নয়। আমাদের কিছু দুষ্টু ব্যবসায়ী অবৈধভাবে সীমান্তের ওপারে যায় এবং তাদের কাছে অস্ত্র থাকে। তখন ভারত বাধ্য হয়ে ভয়ে ওদের গুলি করে। এর আগে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছিলেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কাঁটাতারের বেড়া কেটে কেউ গরু আনতে গিয়ে ভারতের গুলি খেয়ে মারা যায়, তার জন্য দায়দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকার নেবে না। এসব মন্তব্য সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ করে দেয়- আমাদের সরকারি মহল বাংলাদেশিদের সুরক্ষার জন্য আন্তরিক কিনা?
আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সীমান্তে হত্যা বন্ধে বিজিবি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সরকারও কূটনৈতিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। সর্বশেষ বিজিবি দিবসে বাহিনীর মহাপরিচালকও সংবাদমাধ্যমের কাছে বলেছেন, সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার জন্য বিজিবি সবসময় চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ সময় তিনি একটি ব্যক্তিগত মতামত তুলে ধরেন। তার মতে, সীমান্তবর্তী জনগণকে শিক্ষা-দীক্ষায় এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে পারলে সেখানে হত্যা কমে যাবে। সর্বশেষ দু'দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বেশিরভাগ সীমান্ত হত্যা হয় ভারতের সীমানার অনেক ভেতরে। আমার জানামতে, ভারতের প্রচলিত আইন কাউকে হত্যার অনুমোদন দেয় না।
আমরা বলতে চাই, কারও অনুগ্রহ নয়; আমরা আমাদের অধিকারের প্রশ্নে আপসহীন থাকব। জোরালো ভাষায় স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেবো 'সীমান্ত হত্যা মানি না'।