Search

Sunday, May 30, 2021

অর্থনীতিতে শহীদ জিয়া ও বিএনপির ভূমিকা

-------------------------------------------------------------------

ড. আবুল হাসনাত মোহা. শামীম ও ফারহান আরিফ

-------------------------------------------------------------------

টানা নয় মাস যুদ্ধের পর সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা ছিল ভয়াবহ রকমের ভঙ্গুর ও বিধ্বস্ত। এমন এক পরিস্থিতিতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে প্রয়োজন ছিল একটি শক্তিশালী ও দূরদর্শী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণ করে মুজিব সরকার এ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। ক্ষমতা গ্রহণ করে শেখ মুজিব বলেছিলেন, তিনি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু আদতে কোন ধরনের সমাজতন্ত্র তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তার কোনো নির্দেশনা ছিল না। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠাকরণে মুজিব সরকারে ঐ সময়ে কোনো অভিজ্ঞ ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তিও ছিলেন না। যার ফলে বিভিন্ন কল-কারখানা জাতীয়করণ করা হলেও সেটাকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার কোনো আবশ্যক বৈশিষ্ট্য ছিল অনুপস্থিত। 

যার ফলে অচিরেই মুজিব সরকারের এ পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে এক হিসাবমতে অন্তত দশ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে;  চোরাকারবারি, মজুতদারি, কালোবাজারি ও লুটপাটের দরুন দেশজ অর্থনীতির এক ভঙ্গুর দশা দৃশ্যমান হয়। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান উপসামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন অবস্থাতেও জিয়া এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিজের কাছে রেখেছিলেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় কাটিয়ে দেশকে পুনরুজ্জীবিত করার এক বিশাল গুরুভার বহন করেন। শহীদ জিয়া মিশ্র অর্থনীতিতে বিশ্বাস করতেন। তিনি ব্যক্তি ও সরকারি উভয় খাতকেই গতিশীল করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সারা দেশের আনাচে- কানাচে লিফলেট আকারে বিমান থেকে ফেলে জিয়ার উন্নয়ন দর্শন সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। শহীদ জিয়া বলতেন, বাংলাদেশ অর্থ হচ্ছে গ্রাম। বাংলাদেশের উন্নতির জন্য আমাদের গ্রাম ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন করতে হবে। তিনি মনে করতেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নকে শহর থেকে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত না পৌঁছাতে পারলে জাতীয় মুক্তি অসম্ভব। তাই তিনি সব সময় গ্রামমুখী অর্থনীতির কথা বলতেন। বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার অনুসন্ধানে তিনি মাইলের পর মাইল গ্রাম্য মেঠোপথ হেঁটে বেড়িয়েছেন। ১৯৭৬ সালের ৬ ডিসেম্বর শহীদ জিয়া পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যবৃন্দ এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে এক বৈঠকে তার অর্থনৈতিক উন্নয়ননীতির রূপরেখা তুলে ধরেন। তাঁর উন্নয়ন নীতিজুড়ে ছিল বিভিন্ন প্রকল্প পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ, গ্রামভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা, গ্রামসমূহকে মৌলিক চাহিদা পূরণে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলা ও দেশের বিপুল জনশক্তির সুষ্ঠু ও যথাযথ ব্যবহারসহ বহুমুখী পরিকল্পনা। পরবর্তীতে এরই ধারাবাহিকতায় বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ও ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার এ অগ্রযাত্রা অব্যহত রাখে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিকাশে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের গড়ে দেয়া ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে এর বাস্তবায়নার্থে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-এর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। বক্ষ্যমান প্রবন্ধে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শহীদ জিয়া ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। 

তৈরি পোশাকশিল্প রফতানিমুখীকরণ

প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলেই বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের হাঁটি হাঁটি পা করে যাত্রা শুরু, যা আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশ। ১৯৭৮ সালের ৪ জুলাই তাঁরই উদ্যোগে বাংলাদেশি উদ্যোক্তা নুরুল কাদের খান দক্ষিণ কোরিয় শিল্পগ্রুপ দেইউ-এর সঙ্গে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে যৌথ উদ্যোগে একটি শভাগ রফতানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা দেশ গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠা করেন। উভয় পক্ষে গৃহীত এক চুক্তির মাধ্যমে ১৩০ জন তরুণ-তরুণী দক্ষিণ কোরিয়ার পুসান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরাই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের ভিত ও এর মূল মানবসম্পদের ভিত গড়ে দেন। দক্ষিণ কোরিয়া শিল্পগ্রুপ দেইউ’র তৎকালীন চেয়ারম্যান কিম উ-চুং এর সঙ্গে দেশ গার্মেন্টসের মালিকের সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে দেয়ার উদ্যোগ জিয়াউর রহমান নিজে গ্রহণ করেছিলেন। শহীদ জিয়া বাংলাদেশে রেডিমেড গার্মেন্টসের সূচনা এবং বিলম্বে দায় পরিশোধের ব্যাক টু ব্যাক এলসি প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি ১৯৭৮ সালে তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশের জন্য সর্বপ্রথম স্পেশাল বন্ডেড ওয়্যারহাউজ স্কিম চালু করেন। এই স্কিম চালু করার ফলে রফতানিকারকরা সরাসরি শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির অনুমোদন পায়। বর্তমানে এই শিল্পই দেশের অর্থনৈতিক হৃদযন্ত্রে সর্বাধিক রক্ত সঞ্চালন করে থাকে। শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকারি কল-কারখানায় তিন শিফ্টে কাজ শুরু হয় জিয়ার সময়েই। তিনি শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো এবং বছরে ছুটি ও বোনাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭৬ সালে তৈরি পোশাক শিল্প খাত বাংলাদেশের মোট রফতানির ০.০০১% অংশীদার ছিল, তা ২০০২ সালে এসে ৭৭% দখল করেছিল। তৈরি পোশাক শিল্প বিদেশে রফতানি করার জন্য যত প্রকারের সুযোগ-সুবিধা দেয়া দরকার, তা নিশ্চিত করা হয়েছিল বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের সময়। সেই সময় বাংলাদেশে নারীদের প্রধান কর্মক্ষেত্র তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মসংস্থান বাড়ে ২৯%। তিনি তাঁর শাসনামলে শুধু তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আরও নতুন নতুন পণ্য রফতানির উদ্যোগ গ্রহণে উৎসাহিত করেন ।

VAT- সংযোজন

মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট VAT (Value Added Tax) বিংশ শতাব্দীতে উদ্ভাবিত একটি নতুন কর। দেশীয় পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রয়, বিদেশি পণ্য আমদানি ও রফতানি সব ক্ষেত্রে মূল্য সংযোজন কর আরোপযোগ্য। ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে করারোপ তদন্ত কমিশন কর্তৃক সরকারিভাবে বিক্রয় করের বিকল্প হিসেবে মূসক চালু করা হয়। ১৯৮২ সালে বিক্রয় কর অধ্যাদেশ জারি করে ১ জুলাই থেকে পূর্ববর্তী ‘বিক্রয় আইন ১৯৫১’ বাতিল করে নতুন আইন প্রতিস্থাপন করা হয়। দেশের মানুষের সামাজিক সুরক্ষায় কর ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার আনা হয় নব্বই-এর দশকের শুরুতেই, যোগ হয় ভ্যাট। অস্ট্রেলিয়া সরকারের অর্থনীতিবিদ জ্যোতি রহমান ডেইলি স্টারে তার একটি কলামে লেখেন, Saifur Rahman also understood that in order to invest in human capital, government revenue needed to rise. His solution was to rationalize the tax code, lowering the rate and broadening the base. The Value Added Tax, introduced in 1991, was a major milestone on this front. উল্লেখ্য, বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে ১৯৯১ সালের ১ জুলাই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান সংসদে ‘মূল্য সংযোজন কর বিল ১৯৯১’ উত্থাপন করেন, যা ৯ জুলাই পাস হয়। বিলটি পরদিন রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করলে তা ‘মূল্য সংযোজন কর আইন ১৯৯১’ হিসেবে কার্যকর হয়।

যুব মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা

যুবসমাজকে সুসংগঠিত এবং উৎপাদনমুখী শক্তিতে রূপান্তর ও জাতীয় উন্নয়নের মূলধারায় অবদান রাখার জন্য জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে যুব মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় হিসেবে পুনঃনামকরণ করা হয়। যুবশক্তিকে বিভিন্ন অর্থপূর্ণ কাজে লাগানোর জন্য ‘যুব কো-অপারেটিভ কমপ্লেক্স’-এর ব্যবস্থা করেন। জেলায় জেলায় প্রতিষ্ঠা করেন যুব প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ভোকেশনাল ইনস্টিটিউশন (কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র)। আজ এখান থেকেই ট্রেনিং শেষ করে মধ্যপ্রাচ্যসহ সারাবিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমিকরা চাকরি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে চলেছে। ১৯৭৮ সালের এক জরিপে জানা যায়, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশই যুবক। হতাশা, সন্ত্রাস, বেকারত্ব ও মাদকাসক্ত থেকে যুব সমাজকে রক্ষা করতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ১৮-১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শেরেবাংলানগরে দুদিনব্যাপী জাতীয় যুব সম্মেলন আয়োজন করে যুব সমাজকে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন।  

বিদেশে জনশক্তি রফতানি কার্যক্রম চালু

স্বাধীনতা-পরবর্তী দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশের উন্নয়নে দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশে^র নানা দেশে জনশক্তি রফতানির ব্যবস্থা করেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, যুবকদের চাহিদা পূরণে দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি খুবই জরুরি। দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলেই পরীক্ষামূলকভাবে কুয়েত ও সৌদি আরবে স্বল্পসংখ্যক শ্রমিক প্রেরণের মাধ্যমে বিদেশে জনশক্তি রফতানির ধারণাটি বাস্তব রূপ লাভ করেছিল, যা আজ দেশের অর্থনীতির মূল চাকায় পরিণত হয়েছে। এর মধ্য দিয়েই মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ শুরু হয়। আজ সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমিকদের যে শ্রমবাজার তৈরি হয়েছে তার মূল কৃতিত্ব শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের।

স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন

কৃষিপ্রধান অর্থনীতি এবং গ্রামপ্রধান দেশে যে কোনো বিপ্লবের সূচনা করতে হয় গ্রাম থেকে। ১৯৪১ সালে মাও সে তুং চীনে এভাবেই বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও গ্রাম থেকেই রাজনীতি শুরু করেছিলেন। মাঠের পর মাঠ এবং ক্ষেতখামার মাড়িয়ে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তিনি মাসের ২০ (বিশ) দিনই রাজধানীর বাইরে গ্রামে ছুটে বেড়িয়েছেন। ভিক্ষুকের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে একটি জাতীয় আন্দোলন হিসেবে ১৯৭৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর স্বনির্ভর বাংলাদেশ কর্মসূচির সূচনা করেন শহীদ জিয়া। পল্লীর সাধারণ মানুষের অবস্থার পরিবর্তনের জন্য শহীদ জিয়ার আগ্রহে ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য কৃষকদের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ১০০ কোটি টাকার বিশেষ ঋণ বিতরণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। একজন কৃষক নির্ধারিত ঋণ পরিশোধ করে বছরে তিনটি ফসলের জন্য ঋণ নিতে পারতেন। এই কর্মসূচির বৈশিষ্ট্য ছিল ঋণ নেয়ার জন্য জমি ব্যাংকে বন্ধক রাখার প্রয়োজন হতো না এবং বর্গাচাষীসহ জমির মালিকও এ ঋণ নিতে পারতেন। ১৯৮০ সালের ১৪ জুলাই রাজবাড়ী, ফরিদপুরে গ্রামীণ কর্মী ও কৃষক সম্মেলনে শহীদ জিয়া বলেছিলেন, ‘গ্রামীণ জনগণের হাতেই বর্তমান শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের সাফল্যের চাবিকাঠি।...বছরে তিনটি ফসলের নিশ্চয়তা বিধান করে শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনই আমাদের লক্ষ্য নয়, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় নির্বাহে সহায়তা করার জন্য রফতানি করার মতো উদ্বৃত্ত খাদ্যও আমাদের উৎপাদন করতে হবে।’ শহীদ জিয়া গ্রামীণ মহিলাদের মাধ্যমে পরিবারের ও দেশের উন্নয়নে ছোট ছোট কুটির শিল্প, হাঁস-মুরগি, মাছ চাষসহ আঙ্গিনা ভরে তুলতে চেয়েছিলেন বিভিন্ন বৃক্ষ বা সবজি দিয়ে। প্রেসিডেন্ট জিয়াই বাড়ির চারদিকে ফলফলাদি ও সবজি চাষ এবং রাস্তার দুপাশে ফলের গাছ লাগানোর জন্য গ্রামবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি দেশে ফ্রি মার্কেট ইকোনমি (মুক্তবাজার অর্থনীতি) চালু করেছিলেন। ফলে বাংলাদেশ অতি দ্রুত চরম দারিদ্র্য অবস্থা থেকে উঠে এসেছিল। এ প্রসঙ্গে ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনালের সুজান গ্রিন ঢাকা থেকে পাঠানো এক ডেসপাচে লিখেছিলেন, ‘সাম্যের প্রতীক ও সৎলোকরূপে ব্যাপকভাবে গণ্য জিয়াউর রহমান স্বনির্ভর সংস্কার কর্মসূচি শুরু করে বাংলাদেশের ভিক্ষার ঝুড়ি ভাঙার প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন।’ এছাড়া মালয়েশীয় দৈনিক ‘বিজনেস টাইমস’-এ প্রকাশিত ওই ডেসপাচে আরো বলা হয়, ‘অতীতে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত করেছিল যে মহামারি সমস্যাগুলো, প্রেসিডেন্ট জিয়া কার্যত সেগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ নভেম্বর ১৯৭৮)। এরই ধারাবাহিকতায় বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারও ডাল-ভাত কর্মসূচি, ছাগল-পালন কর্মসূচি ইত্যাদির মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জন শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ ব্লাকবেঙ্গল ছাগল পালনের জন্য সহজশর্তে ঋণদান কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য। উল্লেখ্য, বর্তমানে ব্লাকবেঙ্গল ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ। বাংলাদেশের ব্লাকবেঙ্গল জাতের ছাগল বিশ্বের সেরা জাত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। 

কৃষিখাতে ব্যাপক উন্নয়ন

উন্নয়ন আর উৎপাদনে বাংলাদেশকে স্বনির্ভর দেশ হিসেবে গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ১০০ কোটি টাকা কৃষিঋণ চালু করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া। তিনি কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে ১৯৭৬ সালে খাল কাটা কর্মসূচিসহ নানামুখী স্বনির্ভর কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। ওয়াশিংটন পোস্ট-এর সংবাদদাতা মি. উইলিয়াম ব্র্যাংহ্যাম তাঁর ‘সোনার গাঁ’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের দীর্ঘকালের খাদ্য রাজনীতি প্রেসিডেন্ট জিয়াই বন্ধ করতে পেরেছিলেন। তাঁর আমলেই দেশের মাটিতে খাদ্যশস্যের প্রাচুর্য দেখা দেয়।’ কৃষক-বন্ধু জিয়াউর রহমান আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন করায় কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটে। যেখানে ১৯৭৪-৭৫ সালে সারাদেশে ধান উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ১১ লাখ ৯ হাজার মেট্রিক টন, সেখানে ১৯৮০-৮১ সালে সমগ্র দেশে ধান উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৩৬ লাখ ৬২ হাজার মেট্রিক টন। ১৯৯১-৯৬ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারও কৃষি খাত উন্নয়নে ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা এবং সুদসহ ৫ হাজার টাকা কৃষিঋণ মওকুফ করা হয়। এতে প্রায় ২৫ লাখ কৃষক সরাসরি উপকৃত হয়। গ্রাম-গঞ্জে ও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পোলট্রি ফার্ম গঠন করেন। বর্তমানে সারা দেশে কয়েক লাখ পোলট্রি খামার রয়েছে। এই শিল্পে কর্মরত আছেন ৬০ লাখ লোক যার অধিকাংশই শিক্ষিত বেকার তরুণ যুবক। ছাগল-পালন কর্মসূচি গ্রহণ করে হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়। ২০০১ সালে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে এসে বিএনপি সরকার আবারও কৃষি খাতের উন্নয়নের জন্য প্রথম বছরেই ২০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়। ২০০৪ সালে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৫০ লাখ প্রান্তিক কৃষককে বিনামূল্যে বীজ ও সার সরবরাহ করা হয়। এছাড়া কৃষি খাতে ১০ শতাংশ ইনসেনটিভ দেয়াও ছিল এই শাসনামলের আরেকটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা

দার্শনিক রুশো বলেছেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও গৌরবমন্ডিত শিল্প হচ্ছে কৃষি’। বর্তমান পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক কৃষিকর্মে  নিয়োজিত। বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ডও হলো কৃষি যেখানে দেশের মোট শ্রমশক্তির ৫৮ ভাগ কৃষিতে জড়িত। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কৃষিকে বাংলাদেশের প্রাণ বলে অভিহিত করেন। কাজেই বাস্তবতার আলোকেই তাঁর সময় ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)। বিভিন্ন ফসলের জাত উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, টেকসই প্রযুক্তি উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, কৃষি প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য ম্যানডেট নিয়ে যাত্রা শুরু করে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটি।  সরকারি পর্যায়ে কৃষি কর্মকান্ডের সূত্রপাত মূলত এখান থেকেই।

খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্যশস্য গুদামজাতকরণ কর্মসূচি

দেশের দরিদ্র গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখেই দরিদ্রের কন্ঠস্বর শহীদ জিয়া নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। শস্য সংগ্রহের সময় শস্যের দাম তুলনামূলক কম থাকায় এবং একই শস্য পরবর্তীতে বেশি দামে ক্রয় করায় কৃষক বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষক যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য তিনি ১৯৭৮ সালে শস্য গুদাম ঋণ কর্মসূচি চালু করেন। বাংলাদেশে ১৩০টিরও বেশি শস্যগুদাম আছে যেখানে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য মজুদ রেখে স্বল্পসুদে ঋণ নিতে পারে এবং মৌসুম শেষে বেশি দামে শস্য বিক্রি করে তা পরিশোধ করতে পারে। এছাড়া অতিরিক্ত উৎপাদিত ফসল গুদামজাত করে আপৎকালীন মজুদ গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শহীদ জিয়া সারাদেশে খাদ্য গুদাম তৈরি করেন।

সার কারখানা নির্মাণ

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে কৃষি বিপ্লবের ফলে দেশে সারের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়। ক্রমবর্ধমান সারের এ চাহিদা মেটাতে তিনি সার কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ১৯৮১ সালে তিনি আশুগঞ্জ সার কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি আরও সার কারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তা দেখে যেতে পারেননি।

বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ((BREB)) প্রতিষ্ঠা

আধুনিক বিশ্বের উন্নয়ন ও সভ্যতার অন্যতম মাপকাঠি হলো বিদ্যুৎ। দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলকে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার আওতায় আনতে শহীদ জিয়া ১৯৭৭ সালের ২৯ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে BREB (Bangladesh Rural Electrification Board) প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যুৎ ব্যবহার করে সেচ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং গ্রামাঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করাই ছিল এই কর্মসূচির প্রধান উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড বা ইজউই প্রতিষ্ঠা এবং এর উন্নয়ন ছিল তৃতীয় বিশ্বের জন্য অন্যতম এক মাইলফলক।

গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প চালু

দারিদ্র্য বিমোচনের নানা উপায় ও কৌশল নিয়ে জিয়াউর রহমানের চিন্তা থেকেই টাঙ্গাইল জেলায় পরীক্ষামূলক ভাবে গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প চালু হয়েছিল। গ্রাম্য এলাকায় ভূমিহীন দরিদ্রদের ঋণের ব্যবস্থা করতেই এর প্রতিষ্ঠা। কালের পরিক্রমায় সেটিই এখন গ্রামীণ ব্যাংক হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং নোবেল পুরস্কারও জয় করেছে। বর্তমানে বেশকিছু দেশ এ মডেল অনুসরণ করে কাজ করছে।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় গঠন

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবাসী শ্রমিকদের বিশাল অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে ও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিগত বিএনপি সরকার ২০ ডিসেম্বর ২০০১ তারিখে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় গঠন করে এবং বিদেশে বাংলাদেশের দুতাবাসসমূহ যাতে প্রবাসীদের কল্যাণে যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করে তার নিশ্চয়তা বিধানের প্রচেষ্টা নেয়া হয়। বিদেশী কর্মসংস্থানের গুণগতমান বৃদ্ধি, কর্মী নিয়োগে মধ্যস্বত্বভোগী দালালদের প্রতারণা ও তৎপরতা রোধ করে সচ্ছতা বৃদ্ধি ও দেশের সকল অঞ্চলের জনগণকে বৈদেশিক কর্মসংস্থানে সুষম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চতকরণ ও প্রবাসীদের সামগ্রিক কল্যাণের লক্ষ্যেই এই উদ্যোগ। 

বেসরকারি খাতের বিকাশ

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো বেসরকারি খাতের উন্নয়ন। ধ্বংসপ্রায় কারখানাগুলোকে বেসরকারিকরণ করেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। শিল্প-কারখানাগুলো ফিরে পায় প্রাণ, কর্মসংস্থান হয় লক্ষাধিক মানুষের। বেসরকারি খাতের উন্নয়ন ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টেকসই করা সম্ভব নয়। তাইতো তিনি শুধু সরকারি খাতের বন্ধ কলকারখানাই চালু করেননি বরং বেসরকারি খাতের বিকাশেও যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করার জন্য ১৯৭৬ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ চালু করেন। তিনি ১৯৭৯ সালে জাতীয়কৃত শিল্প-কারখানাকে বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করেন। ১৯৮০ সালে বিরাষ্ট্রীয়করণ আইন পাস করেন। এরই ধারাবাহিকতায় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার ১৯৯৩ সালে প্রাইভেটাইজেশন বোর্ড গঠন করে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকরের দ্বিতীয় মেয়াদে ২০০১ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানাকে বেসরকারি খাতে নেয়ার জন্য প্রথম বাজেটে ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়াও ছিল একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এছাড়া বেসরকারি খাতে বিদ্যমান দীর্ঘ ৩১ বছরের চিনি আমদানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ছিল বিএনপি সরকারের উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক সিদ্ধান্ত।

বৈদেশিক রিজার্ভ বৃদ্ধি

জিয়াউর রহমান তাঁর শাসনামলে দেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে এক বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছিলেন। একটি গবেষণা রিপোর্টে দেখা যায়, ১৯৭৪-এ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৩৮.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ১৯৭৯-তে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩৭৪.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৯৮১-৮২ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল জিডিপি’র ০.৭% যা ১৯৯৩-৯৪ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৮.২% (দৈনিক দিনকাল, ৩০ মে ২০০২)। বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক রিপোর্ট থেকে সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায়, ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারের ০৬ (ছয়) মাসের শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৮৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল এদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম। তাই এ সময়ে টাকার দাম কমে যায়নি, জিনিসপত্রের দামও হঠাৎ বেড়ে যায়নি, যা আজকাল অহরহ পেপার-পত্রিকায় চোখে পড়ে। রিপোর্টে আরো দেখা যায়, ২০০১ সালে খালেদা সরকারের সময় তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৩০৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। উল্লেখ্য যে, বিএনপি সরকারের শেষের দিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৬১৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ঐ সময় পর্যন্ত সর্বোচ্চ। 

অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন

১৯৭৯ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তিস্তা ব্যারেজ গড়বে এ দেশের প্রকৌশলীগণ। পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে নির্মাণ পর্যন্ত সব কাজই করেছেন আমাদের দেশীয় প্রকৌশলীগণ। স্কুল, কলেজ, সরকারি ভবন, সড়ক-মহাসড়ক, সেতু-কালভার্ট, বিদ্যুৎ, গ্যাসলাইন, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি অবকাঠামোগত খাতে বিএনপি সরকারের সময়ে ব্যাপক উন্নয়নসাধিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল ১৯৯৪ সালের ১৬ অক্টোবর যমুনা বহুমুখী সেতুর ভৌত নির্মাণ শুরু করা এবং প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুর প্রায় ৭০% কাজ সম্পন্ন করা। মেঘনা-গোমতী সেতু নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাতায়াত নির্বিঘœ করা, চট্টগ্রামে একটি অত্যাধুনিক রেলস্টেশন নির্মাণ এবং চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য প্রকল্প গ্রহণ। দেশের সবক’টি প্রধান হাইওয়ের উন্নয়ন, বড় বড় নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণ, মুন্সীগঞ্জে ধলেশ্বরী সেতু নির্মাণ, কর্নফুলী নদীর ওপর তৃতীয় সেতু নির্মাণকাজে অগ্রগতি, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও জাপানের অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি প্রাপ্তি ও সম্ভাব্যতা যাচাই কাজের সমাপ্তি, সিলেট এয়ারপোর্টে নতুন দুুটি বিল্ডিং নির্মাণÑ এসবই হচ্ছে বিগত বিএনপি ও চারদলীয় জোট সরকারের ০৫ (পাঁচ) বছরে যোগাযোগ খাতে উন্নয়নের রেকর্ড। এছাড়া ঢাকায় স্থায়ী হাজি ক্যাম্প নির্মাণ করা হয় বিএনপি শাসনামলেই। টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার জন্য ৩০০ একরেরও বেশি জমি তবলীগ জামায়াতকে প্রদান করা হয়। 

ব্লু-ইকোনমি ও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যে দেশ সমুদ্রকে যত বেশি ব্যবহার করতে পেরেছে, সে দেশ অর্থনীতিতে তত বেশি সমৃদ্ধশালী হয়েছে। খাদ্য উৎপাদন, খনিজ সম্পদ আহরণ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সমুদ্রের ভূমিকা অপরিসীম। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনা ও উদ্যোগে ‘সামুদ্রিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি’ ১৯৮১ সালের ১৯ থেকে ২১ জানুয়ারি দেশের সেরা ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী এবং একদল বিজ্ঞানীকে সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রগামী যাত্রীবাহী জাহাজ ‘হিজবুল বাহার’-এ চড়ে বঙ্গোপসাগরে একটি ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষা সফরের আয়োজন করে। শহীদ জিয়ার এই সমুদ্র অভিযান বা শিক্ষা সফরের মূল উদ্দেশ্যও ছিল দেশের সেরা ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বঙ্গোপসাগরকে পরিচয় করিয়ে দেয়া; বঙ্গোপসাগরের সম্পদ ও সম্ভাবনাকে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অবহিত করা এবং সমুদ্রবিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের সামুদ্রিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ সংক্রান্ত গবেষণা কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। প্রেসিডেন্ট জিয়ার হাজারো কাজের মধ্যে এই কর্মসূচি ছিল একটি ক্ষুদ্র, অথচ দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কসুলভ কর্মসূচি। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট জিয়ার আগ্রহ ও নির্দেশেই সরকার সামুদ্রিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, শিপিং মন্ত্রণালয়, মৎস্য অধিদপ্তর, জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ, পেট্রোবাংলা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ‘জাতীয় কমিটি’ গঠন করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় খালেদা জিয়ার সরকারও তাঁর প্রথম শাসনামলে ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন। তিনি বঙ্গোপসাগরের জলদস্যুতা ও চোরাচালান হ্রাসে কোস্টগার্ড বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন।

দারিদ্র্য নিরসন

শহীদ জিয়ার জীবদ্দশার একটি বড় সময় কেটেছে এদেশের মানুষের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে। তাঁর পরিকল্পনা ছিল দারিদ্র্য দূরিকরণ, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা। জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহের সাথে সামঞ্জস্য রেখে খালেদা জিয়ার সরকার মধ্য-মেয়াদি পরিকল্পনা হিসাবে একটি ‘দারিদ্র্য নিরসন’ কৌশলপত্র প্রণয়ন করেন। দারিদ্র্য নিরসনের জন্য বাজেট বরাদ্দের হার প্রতি বছরই বৃদ্ধি করা হয় এবং ২০০৬-০৭ অর্থবছরে এর হিস্যা দাঁড়ায় মোট ৫৬ শতাংশ। পল্লী অঞ্চলের অতি দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য হ্রাসের জন্য সরকার সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচি সম্প্রসারিত করেছিল। দেশের উত্তরাঞ্চলে মঙ্গাপ্রবণ এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ৫০ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করা হয়েছিল সেই সময়ে। চরাঞ্চলে বসবাসরত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অবস্থার উন্নয়নে ৫০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প (চর জীবিকায়ন কর্মসূচি) গ্রহণ করা হয়। এ সময়ে দেশের দারিদ্র্যের হার ০৯ শতাংশ হ্রাস পায়। 

সমাজের পশ্চাৎপদ ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর কল্যাণে  বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়। বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাদের মাসিক ভাতা ও সুবিধাভোগীর সংখ্যা উভয়ই বৃদ্ধি করা হয়। বয়স্ক ভাতা ও ভাতাগ্রহীতার সংখ্যা উভয়ই বাড়ানো হয়। এছাড়া দুঃস্থ মহিলাদের স্বাবলম্বী করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে ‘দুঃস্থ’ মহিলাদের ঋণদান কর্মসূচি চালু করা হয় সেই সময়ে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জন কেনেথ গ্যালব্রেইথ (১৯০৮-২০০৬) বলেন, In economics, hope and faith co-exist with great scientific pretension and also a desire for respectability. বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে জিয়াউর রহমানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন চিন্তায় এর প্রতিফলন সুস্পষ্ট। জিয়া তাঁর যুগান্তকারী ১৯-দফা কর্মসূচিতে বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর যে চিন্তা ও চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন, আজ অবধি বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার মূলে তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। একটি তলাবিহীন ঝুড়ি উপাধি পাওয়া দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে দৃঢ় প্রত্যয়ের প্রয়োজন ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়া তা ধারণ করতেন। তারই দেখিয়ে যাওয়া পথ ধরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) অতীতে উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতিতে জোর দিয়ে এসেছে এবং আগামীতেও এ ধারা অব্যহত রাখবে বলেই জাতি প্রত্যাশা রাখে।




  •  লেখকদ্বয় গবেষক 

সঙ্কটকালে নেতৃত্বের করণীয় — শহিদ জিয়ার নেতৃত্ব থেকে শিক্ষা

-----------------------------------

—    ড এম আহমেদ 

-----------------------------------

রোববার ,মে, ৩০, ২০২১ জিয়াউর রহমান বীরউত্তম — স্বাধীনতার ঘোষক, বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট, সবচেয়ে সফল প্রেসিডেন্ট, সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্টের চল্লিশতম শাহাদৎবার্ষিকী I আল্লাহ আমাদের এই সৎ, দক্ষ, জনদরদী এবং ভিশনারি নেতার শাহাদৎ কবুল করে জান্নাত নসিব করুন।

জাতির এই ক্রান্তি লগ্নে, সঙ্কটকালে আমাদের উচিত জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বের বিচার বিশ্লেষণ করে সঙ্কট থেকে মুক্তির পথ বের করা I দেশ ও জাতির প্রতিটি সঙ্কটকালে জিয়াউর রহমান বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন এবং সঙ্কট থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চের কাল রাতের গণহত্যার পর পুরা জাতি যখন দিশেহারা, তখন ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’ বলে জাতিকে অন্ধকারে আলো দেখিয়েছেন, আশা জাগিয়েছেন, মনোবল যুগিয়েছেন।

 ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘Leader must be seen and heard’ - বিশেষ করে সঙ্কটকালে। 

মার্চ ২৭, ১৯৭১, রেডিয়োতে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বর শুনে জাতি যে উজ্জীবিত হয়েছিল, যার প্রমান অনেকের লেখায় পাওয়া যায়, তা থেকেই বুঝা যায় সঙ্কটকালে নেতার কথা বলা, যতদূর শুনিয়ে, যতজনকে শুনিয়ে, কথা বলা কতটুকু জরুরি। বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বকে এই বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে। তবে সেই সাথে এটাও মাথায় রাখতে হবে, তারা যেন ধারভাষ্যকার না হয়ে যান - কে কেমন, কী করছে, কী ঘটছে, এসব বর্ণনায় সীমাবদ্ধ না থাকেন, প্যাসিভ ভাষায় কথা না বলেন, এই করতে হবে, সেই করতে হবে, এই করা উচিত, সেই করা উচিত, তাদের বা ওদের এগিয়ে আশা উচিত। একটিভ ভয়েসে কথা বলতে হবে, ‘করব’ এই শব্দটা থাকতে হবে মুখে। তাদের কথায় যেন দিক নির্দেশনা থাকে, সঙ্কট থেকে মুক্তির স্পষ্ট ছবি ফুটে উঠে, দিনক্ষণ সুনির্দিষ্ট না হলেও মুক্তির একটা সময় সীমা যেন অনুসারীরা দেখতে পারেন সেই ভাষায় কথা বলতে হবে। 

১৯৭৫ এ আবার যখন এই জাতি সঙ্কটে পড়লো, ভোটাধিকার হারাল, বাক স্বাধীনতা হারাল, তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হল, হতাশাগ্রস্ত দেশে ভয়ানক হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হল, তখোনো উদ্ধার করতে এগিয়ে এসেছেন জিয়াউর রহমান বীরউত্তম। দেশ যখন সর্বগ্রাসী সঙ্কটে - মানুষ খাদ্য সঙ্কটে, অর্থ সঙ্কটে, নিরাপত্তার সঙ্কটে, ‘আবার তোরা মানুষ হ’ নামের সিনেমা হওয়ার পটভূমি দেশে, তখন তিনি দেশের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন, মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। 

সঙ্কট মুক্তির পথ গণতন্ত্র, সঙ্কটে মুক্তির পথ বাক স্বাধীনতা। তাই বন্ধ করে দেওয়া গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ খুলে দিয়েছেন দ্রুততম সময়ে, বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিয়েছেন, বাক স্বাধীনতাও ফিরিয়ে দিয়েছেন, প্রবাসে থাকা শেখ হাসিনাকেও দেশে ফিরতে দিয়েছেন। তাই তো জিয়াউর রহমান ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা, আওয়ামীলীগের পুনর্জন্ম দাতা এবং শেখ হাসিনাকে দেশে প্রত্যাবর্তনের সুযোগদাতা’।

সর্বব্যাপী সঙ্কটে দিশে হারা জাতিকে সঙ্কট থেকে মুক্তি দিতে জিয়াউর রহমান যে পদ্ধতিটি অনুসরণ করেছিলেন তা হচ্ছে, বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের পদায়ন করা এবং নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া। জিয়াউর রহমানের মন্ত্রীসভা এবং তাঁর সময় নিয়োগকৃত বিভিন্ন বিভাগের পরিচালকদের এবং নীতি নির্ধারকদের তালিকার দিকে নজর দিলে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। আজকের সঙ্কটাপন্ন অবস্থা থেকে দেশকে উদ্ধার করতে হলে, ভোটাধিকার উদ্ধার করতে হলে, বাক স্বাধীনতা উদ্ধার করতে হলে, ফ্যাসিবাদ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হবে বিএনপিকে বিশেষজ্ঞদের দ্বারস্থ হতে হবে। একদিকে বিশেষজ্ঞদের চুলচেরা বিশ্লেষণে বিএনপির দুর্বলতা চিহ্নিত করে সেগুলি দূর করার পথ বাতলে নিতে হবে, অন্য দিকে কিভাবে ফ্যাসিবাদী চিন্তা চেতনা থেকে ফ্যাসিবাদীদের মুক্ত করে দেশকে ফ্যাসিবাদের ভয়াল থাবা থেকে মুক্ত করা যায় তার পথ বাতলে নিতে হবে। জাতির এই সঙ্কটকালে জিয়াউর রহমানের চল্লিশতম শাহাদৎবার্ষিকীতে জিয়াউর রহমানের জীবন থেকে সঙ্কট থেকে উত্তরণের এই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে বিএনপি দ্রুততম সময় ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার করবে, বাকস্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করবে, দেশকে এবং দেশের মানুষকে ফ্যাসিবাদী ব্যক্তি, দল এবং চিন্তা চেতনা থেকে মুক্ত করবে এই প্রত্যাশা । 

  • লেখক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ। 


স্বাস্থ্যসেবায় শহিদ জিয়ার অমর কীর্তি

-----------------------------------

ড. জাহিদ দেওয়ান শামীম

-----------------------------------

১৯৭২- ১৯৭৫ —  বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিপরীতে ছিল একদলীয় বাকশাল, ছিল না মানুষের বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, চুরি-ডাকাতি, লুটপাট ও দুর্নীতি ছিল রন্ধ্রেরন্ধ্রে, গণবাহিনীর সাথে রক্ষীবাহিনীর যুদ্ধে রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত খুন হত, পার্বত্য অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আস্ফালন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, নির্বাহী বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা ও সেনাবাহিনীসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিতর্কিত করা হয়েছিল। পাশাপাশি খাদ্য ও স্বাস্থ্য সেবার অভাবে সারাদেশে দুর্ভিক্ষ ও রোগবালাইয়ে মানুষের মৃত্যুসহ স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল। 

সব সেক্টরের এরকম বিভীষিকাময় ও ভয়াবহ অবস্থায় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের হাল ধরেন। এই ভঙ্গুর অবস্থা থেকে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, স্বনির্ভর, শক্তিশালী সমৃদ্ধ এবং আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মানুষের বাকস্বাধীনতা ফিরিয়ে দিলেন, বিচার, আইনশৃঙ্খলা, নির্বাচনী, নির্বাহী ও শিক্ষা বিভাগের সংস্কার ও আধুনিকায়নের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবাকে মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেওয়া ও আধুনিকায়নের জন্য অনেক যুগান্তকারী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। 

স্বাস্থ্য সেক্টরে অবদান নিয়ে আলোচনার শুরুতেই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি ক্ষণজন্মা পুরুষ, ইতিহাসের মহান নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রনাঙ্গনের যোদ্ধা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তমকে। স্বাস্থ্য সেক্টরে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবিস্মরণীয় ও উল্লেখযোগ্য অবদান —  দেশে প্রথিতযশা ও স্বনামধন্য বেসরকারি চিকিৎসকদের মেডিকেল কলেজে শিক্ষক ও উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন - মেডিসিনের প্রফেসর ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, শিশু বিশেষজ্ঞ (ইউরোলজী) প্রফেসর ডা. আজিজুর রহমান, বারডেমের প্রফেসর ডা. মুহাম্মদ ইব্রাহিম, চক্ষু বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ । স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্যসেক্টরকে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা দুইটি অধিদপ্তরের ভাগ করেন। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলোর ব্রিটিশ জেনারেল মেডিকেল কাউন্সিলের স্বীকৃতিr ব্যবস্থা করেন। মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তিতে প্রেসিডেন্টের কোটা বাতিল করে মেধাভিত্তিক ভর্তির ব্যবস্থা করেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া। মেডিকেল কলেজে আমলা, রাজনীতিবিদ ও প্রফেসরদের স্বজনপ্রীতির শিক্ষার্থী মাইগ্রেশন বাতিল করে মেধাভিত্তিক মাইগ্রেশন পদ্ধতি চালু করেন। মেডিকেলের মেজর সাবজেক্ট গুলোতে (মেডিসিন, সার্জারি ও গাইনী) সাব-স্পেশালিটি চালু করেন। তিনি মিডিল ইস্টসহ মুসলিম বিশ্বে দেশীয় চিকিৎসকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি বিদেশে কর্মরত স্বনামধন্য দেশী চিকিৎসকদের দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের মেধাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। 

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে কলেরা (আইসিডিডিআরবি) হাসপাতাল, দক্ষ নার্স তৈরির লক্ষ্যে ৫ জানুয়ারি ১৯৮১ সালে মহাখালীতে নার্সিং কলেজ এবং ১৯৮১ সালের ৩ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট জিয়া জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। উনার প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় নিপসম, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান ও ইপিআই প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ৫০ শয্যার ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, পিজি হাসপাতালের সি-ব্লক, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটসহ চিকিৎসকদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান বিএমএ ভবন-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তিনি গ্রামীণ জনগণের চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধিকরণের লক্ষ্যে ২৭৫০০ পল্লী চিকিৎসক নিয়োগের পাশাপাশি মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে কমিউনিটি স্বাস্থ্য সেবার জন্য গ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন এবং সদ্য পাশ করা তরুণ চিকিৎসকদের থানা হেল্থ কমপ্লেক্সে ৩ বছর কাজ করা বাধ্যতামূলক করেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, স্বনির্ভর, শক্তিশালী, সমৃদ্ধ এবং আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস ও সূদরপ্রসারী চিন্তা ছিল। বাংলাদেশ নিজে পায়ে মাথা উচু করে দাঁড়াক এটা দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা মেনে নিতে পারেনি। এজন্যই ষড়যন্ত্রকারীরা ক্ষণজন্মা এই মহানায়ককে ১৯৮০ সালের ৩০মে রাতের আঁধারে কাপুরুষোচিত ভাবে হত্যা করে। যার ফলে, বর্তমানে গুম-খুন, ধর্ষণ, শাসকদলের সন্ত্রাস, দুর্নীতি, দুঃশাসন ও লুটপাটের মাধ্যমে দেশ আবারো এক বিভীষিকাময় ও ভয়াবহ অবস্থায় মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জিয়াউর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে একটি জাতিকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে উনার দর্শন ও আদর্শকে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ ও শেষ করতে চেয়েছিল। যা কিনা সম্ভব হয় নাই। বর্তমান বিভীষিকাময় অবস্থার মধ্যেও কোটি কোটি জনতা মুক্তির জন্য জিয়ার দর্শন ও আদর্শ বুকে ধারন করে আছে। তাই, জিয়ার দর্শন ও আদর্শ বিশ্বাসী সকল দেশপ্রেমিক নাগরিকদের সাথে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিকে সব ধরনের জাতিঘাতী এবং রাষ্ট্রঘাতী অপকৌশলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং মানষের ভোটাধিকার, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক মুক্তি ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে হতে হবে জয়ী । 

  • লেখক সিনিয়র সাইন্টিস্ট, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র। 


দফা দশ — দেশবাসীর জন্য ন্যূনতম চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা

--------------------------------- 

— জাকারিয়া চৌধুরী 

---------------------------------

শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম এর ঐতিহাসিক ১৯ দফা কর্মসূচিতে ১০ নম্বরে বলা ছিল ‘সকল দেশবাসীর জন্য ন্যূনতম চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা’। অর্থাৎ দেশের প্রতিটি নাগরিকের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা তিনি নিয়েছিলেন সেই প্রায় সাড়ে চার দশক আগে!

সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি কয়েকটি কার্যকর উদ্যোগ হাতে নিয়ে ছিলেন।  তিনি বেয়ারফুট ডাক্তার বা গ্রামডাক্তার কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। প্রতিটি গ্রামে সাধারণ মানুষ যাতে ন্যূনতম প্রাথমিক চিকিৎসা পায় তার জন্য লাখ লাখ গ্রাম ডাক্তার প্রশিক্ষণ ও পোস্টিংয়ের ব্যবস্থা করেন। 

স্বাস্থ্য ক্যাডার প্রবর্তন করেন। জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম জোরদার করেন। ইউনিসেফ-এর সহযোগিতায় শিশুদের ঘাতক ব্যাধি নির্মূলে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি ইপিআই প্রবর্তন করেন। ওরস্যালাইন বিতরণকে একটা সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিয়ে কলেরা-ডায়রিয়ার মহামারি রোধ করা হয় সেই সময়ে। 

নার্স, মিডওয়াইফ ট্রেনিং এর ব্যবস্থা নেয়া হয়। প্রতি ইউনিয়নে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র স্থাপন এবং প্রতি থানায় (এখন উপজেলা) স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স স্থাপন করেন। বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থা হোমিও ও ইউনানি শিক্ষার ব্যবস্থা প্রসারে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। প্যারামেডিক্স ও স্বাস্থ্যকর্মী প্রশিক্ষণ জোরদার করেন। নতুন হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন, বেড বৃদ্ধি, আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম সংযোজন করেন। জনস্বাস্থ্য, চিকিৎসা সেবাকে গুরুত্ব দিতে ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম, বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও এম এ মতিনের মতন লোকদের রাষ্ট্রক্ষমতা ও নীতিনির্ধারণের শীর্ষস্তরে নিয়ে আসা। 

এই কথা আজ নিশ্চিত বলা যায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভিত্তি তিনি শক্তিশালীভাবে স্থাপন করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল প্রতিটি নাগরিকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা। জিয়াউর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে সেই অভিযাত্রাকে থামিয়ে দেয়া হয়। 

কোভিড নাইনটিন বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার চরম দূর্বলতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছে। শহীদ জিয়ার অভাব অনুভব করছি। 

  • লেখক চিকিতসক ও ব্লগার। 


আপনি কি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে চিনতেন?

---------------------------------

আখতার-উল-আলম

---------------------------------


তুরস্কের অ্যাম্বাসেডর সাহেব আমাদের দূতাবাসে এসেছেন। বয়স্ক কূটনীতিক। অভিজ্ঞ এবং ঝানু। ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে ওআইসির একটা সম্মেলনে তুরস্ক সফরের সৌভাগ্য হয়েছিল আমার । আমি তখন দৈনিক ইত্তেফাকে। সে সময় এই ভদ্রলোকের সাথে কিছুটা পরিচয়। বাহরাইনে এসে তাকে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত হিসেবে পেয়ে সেই পূর্ব পরিচয়টা যেন নতুন করে পেলেই তিনি আমাদের বাসায় বা দূতাবাসে আসতেন। আমিও সময় পেলে তাঁর ওখানে গিয়ে আড্ডা দিতাম। আমার স্ত্রীও সময় পেলে তার বাসায় যেত। তার স্ত্রীও সময়ে অসমেয় আমাদের বাসায় এসে আমার স্ত্রীর ও মেয়ের সাথে সময় কাটাতেন। নাতিকে নিয়ে খেলতেন।

সেদিন মান্যবর রাষ্ট্রদূত মনে হলো হাতে সময় নিয়েই এসেছেন। নানা বিষয় নিয়ে চলছিল আলাপ আলোচনা। বাংলাদেশের কিছু কিছু পোস্টার তার সামনে। একখানা পুস্তকে শহীদ জিয়ার ছবিখানাই দেখছিলেন। এক সময়ে হঠাৎ করে বলে উঠলেন, এক্সেলেন্সি, যদি কিছু মনে না করেন, একটা আরজ জানাতে চাই। …. আপনি কি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের একখানা পোর্ট্টেট আমাকে দিতে পারেন?

আমি যাথাসমেয় তাঁকে ওই পোর্ট্টেট দেব, কথা দিলাম। সে সময়ে অ্যাম্বেসিতে দু’জন ফার্স্ট সেক্রেটারি ছিলেন। মোহাম্মদ শরিফুল আলম আর জমির উদ্দিন আহমাদ। খুব সম্ভব জমির সাহেবই রাষ্ট্রদূত সাহেবের কাছে জানতে চাইলেন, এক্সেলেন্সি, আপনি কি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে চিনতেন?

তুরস্কের মান্যবর রাষ্ট্রদূতের মুখে যেন ফুটে উঠল একটা বেদনার ভাব। বললেন, আমার জীবনের সে এক দুর্লভ স্মৃতি, বলতে পারেন আনন্দঘন অভিজ্ঞতা। আপনারা যে জিয়াউর রহমানকে চেনেন ও জানেন, আমার চেনাজানার জিয়াউর রহমান তার তা থেকে ভিন্ন, একেবারেই আলাদা। শুধু আপনার নয়, এটা তুরস্কের এবং গোটা মুসলিম উম্মহরও দুর্ভাগ্য যে, আমরা তাকে পেয়েছিলাম বেশিদিনের জন্য নয়। আমরা তাঁকে হারিয়ে কি যে হারিয়েছি, সেকথা বলে শেষ করতে পারব না। কেননা, তিনি এখনো ওআইসির নানা কর্মকাণ্ডে, ওআইসিতে তুরস্কের যোগদানের নেপথ্য নায়ক হিসেবে বিরাজ করছেন। অনেকেই জানেন না। কিন্তু বিষয়টির সাথে আমি ব্যক্তিগতভাবে জড়িত বলেই তার হারিয়ে যাওয়াকে আমি নিজের ক্ষতি বলে মনে করি। বেদনা বিধুর কণ্ঠে কথাগুলো শেষ করেন মান্যবর রাষ্ট্রদূত। তাঁর দু’চোখ অশ্রুভরা।

  • লেখক প্রখ্যাত সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাষ্ট্রদূত।


জিয়াউর রহমান মানেই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ

-----------------------------

—  তারেক রহমান 

-----------------------------


 

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, উদ্দেশ্যমূলক ও সুক্ষভাবে নানারকম ইস্যু তৈরী করে সমাজের সর্বস্তরে মানুষে মানুষে বিরোধ-বিভাজন তৈরী করে মানুষের ঐক্য বিনষ্ট করে দেয়া হচ্ছে। স্বাধীন দেশের নাগরিকরা আজ পরাধীন।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘আমরা সকলে বাংলাদেশী। এই মাটি আমাদের, এই মাটি থেকেই আমাদের অনুপ্রেরণা আহরণ করতে হবে। জাতিকে শক্তিশালী করাই আমাদের লক্ষ্য। ঐক, শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম, নিষ্ঠা ও কঠোর মেহনতের মাধ্যমেই তা সম্ভব।’

স্বাধীনতার ঘোষকের ৪০ তম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে শনিবার, মে ২৯, ২০২১, বিএনপি আয়োজিত এক ভার্চুয়াল আলোচনাসভায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এসব কথা বলেন। তারেক রহমান বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে তাই এবার আরেকটি যুদ্ধের শপথ নিতে হবে। এবারের যুদ্ধ স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধ, এবারের যুদ্ধ মাফিয়ামুক্ত দেশ গড়ার যুদ্ধ, এ যুদ্ধে আমাদের শ্লোগান দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও।

সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরীর পরিচালনায় সভায় দলের স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যরা বক্তব্য দেন। সভায় বিএনপির জেলা-উপজেলার নেতারা এবং দলের অঙ্গসংগঠনের নেতারাও যুক্ত ছিলেন।

সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তারেক রহমান বলেন, স্বাধীনতার ঘোষককে হত্যা ছিল ৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের পরাজিত অপশক্তির সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ। বাংলাদেশকে তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করার সুদূরপ্রসারী চক্রান্তের অংশ। তাই স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর এই গর্বিত সময়ে দেখতে হচ্ছে সীমান্তে ফেলানীকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে কাঁটাতারে। যেন ঝুলছে অসহায় বাংলাদেশ।

তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশকে আজ এতটাই অসহায় করে ফেলা হয়েছে দেশের মর্যাদার পক্ষে কথা বলায় স্বাধীন বাংলাদেশে বেড়ে ওঠা কতিপয় কুলাঙ্গার আবরারদের মতো দেশপ্রেমিককে পিটিয়ে হত্যা করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। তারেক রহমান বলেন, পরদেশের স্বার্থ রক্ষায় নিজ দেশের মানুষকে হত্যা করার মতো স্বদেশী খুনি যখন তৈরী হয়ে যায় তখন বুঝতে হবে আবরার হত্যা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশে চলমান যে নির্মম বাস্তবতা, এটি হচ্ছে ৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সেই পরাজিত অপশক্তির ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের-ই কুফল।

তারেক রহমান বলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব, এমন একজন নেতৃত্ব, যার পেশাগত কিংবা আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি কর্ম প্রতিটি পদক্ষেপ বিএনপির তথা জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রতিটি নেতা-কর্মী গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করতে পারেন, অনুসরণ করতে পারেন ।

তারেক রহমান বলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে শহীদ জিয়া আগন্তুক কোনো ব্যক্তি নন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে, আধুনিক বাংলাদেশের ইতিহাসে শহীদ জিয়া একটি অনিবার্য নাম। শহীদ জিয়ার গৌরবগাঁথা আলোচনায় র্যাব-পুলিশের হুমকি ধামকি কিংবা আদালতের রায়ের দোহাই দেয়ার প্রয়োজন হয়না।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম সাধীনতা বার্ষিকীর বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত স্বাধীনতার ঘোষক জিয়ার লিখিত ‘একটি জাতির জন্ম’ শীর্ষক নিবন্ধটিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অনন্য দলিল উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, ছাত্র জীবন থেকেই তরুণ জিয়া মন ও মননে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন লালন করেছিলেন। স্বাধীনতার জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত রেখেছিলেন। শুধু ছিলেন সময়ের অপেক্ষায়।

‘একটি জাতির জন্ম’ শীর্ষক নিবন্ধে শহীদ জিয়া লিখেছেন, ‘সেই স্কুল জীবন থেকেই মনে মনে আমার একটি আকাঙ্খাই লালিত হতো, যদি কখনো দিন আসে তাহলে এই পাকিস্তানবাদের অস্তিত্বেই আমি আঘাত হানবো। সযত্নে এই ভাবনাটাকেই আমি লালন করতাম। অপেক্ষায় ছিলাম উপযুক্ত সময় আর উপযুক্ত স্থানের’ ।

তারেক রহমান বলেন, এ কারণেই দেখা যায় দেশে বিদেশে সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য এবং বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে জিয়াউর রহমানকে কোনো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে হয়নি। স্বাধীনতার ঘোষণায় কোনো রকমের জড়তা ছিলোনা।

স্বাধীনতার ঘোষককে জানতে হলে, মানতে হলে, বুঝতে হলে অন্য কারো বিরোধিতা কিংবা কারো সঙ্গে তুলনা করার প্রয়োজন নেই। বরং প্রতিটি যুগান্তকারী কাজের মধ্য দিয়েই শহীদ জিয়া স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল, বলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

তারেক রহমান বলেন, স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে শহীদ জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল তূর্যধ্বনির মত।

আবার ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের সময় স্বাধীনতার ঘোষকের নেতৃত্বেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ তাই বাংলাদেশের পক্ষের শক্তির কাছে গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তির কাছে জিয়াউর রহমান একটি সাহসের নাম জাতীয়তাবাদী শক্তির কাছে জিয়াউর রহমান মানেই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আরো বলেন, দেশ আজ এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। দেশে সবচেয়ে ভুলুন্ঠিত মানবিক মর্যাদা। সবচেয়ে অবহেলিত বিবেকবোধসম্পন্ন গণতন্ত্রকামী মানুষ। গণতন্ত্র নির্বাসিত। গুম-খুন-অপহরণ এখন সাধারণ বিষয়ে পরিণত করে ফেলা হয়েছে। দেশে চলছে পুলিশী রাজ। পুলিশ এখন সেনাবাহিনীকে নিয়েও রং-তামাশা করছে। পার্লামেন্ট এখন যেন স্রেফ নাট্যশালা। বিচারালয়কে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি বিভাগে পরিণত করা হয়েছে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি লুটপাট এখন ওপেন সিক্রেট।

মাদার অফ ডেমোক্রেসি বেগম খালেদা জিয়াকে দেশপ্রেমিক মানুষের ঐক্যের প্রতীক উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, খালেদা জিয়াকে বন্দি রেখে আওয়ামী লিগ ক্ষমতার মেয়াদ হয়তো কয়েক বছর দীর্ঘায়িত করেছে। কিন্তু কয়েকযুগ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। দেশ আজ দু’ভাগে বিভক্ত। একদিকে মাফিয়া চক্র অন্যদিকে গণতন্ত্রকামী জনগণ।

তারেক রহমান বলেন, ১৯৭১ সালে হানাদাররা যেভাবে রাতের অন্ধকারে স্বাধীনতাকামী মানুষকে তুলে নিয়ে গিয়ে গুম করেছিল হত্যা করেছিল একইভাবে স্বাধীন বাংলাদেশেও এখন আওয়ামী হানাদারবাহিনী গণতন্ত্রকামী মানুষকে রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে গিয়ে গুম-অপহরণ করছে, হত্যা করছে। লাঞ্চিত করছে, অপমান করছে।

সভায় আরো বক্তব্য বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমিরুদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। এছাড়াও বক্তব্য দেন ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতা হাবিব উন নবী খান সোহেল, এম এ কাইয়ুম, ঢাকা জেলার ডা. দেওয়ান মো. সালাহউদ্দিন, চট্টগ্রাম মহানগরের ডা. শাহাদাত হোসেন, দক্ষিণের মোস্তাক আহমেদ খান, বরিশাল দক্ষিণের এবায়দুল হক চাঁন, রাজশাহী মহানগরের মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, খুলনা জেলার শফিকুল আলম মনা, রংপুর মহানগরের সাইফুল ইসলাম, ময়মনসিংহ উত্তরের অধ্যাপক একেএম শফিকুল ইসলাম, দক্ষিণের ডা. মাহবুবুর রহমান লিটন, যশোরের অধ্যাপক নার্গিস বেগম, কুমিল্লা দক্ষিণের হাজী আমিনুর রশীদ ইয়াছিন, উত্তরের আখতারুজ্জামান সরকার, ফেনীর শেখ ফরিদ বাহার, হবিগঞ্জের জি কে গউস, সুনামগঞ্জের কলিমউদ্দিন আহমেদ মিলন, কক্সবাজারের শাহজাহান চৌধুরী, ফরিদপুরের সৈয়দ মোদারেস আলী ইছা, নওগাঁয়ের হাফিজুর রহমান, ঠাকুরগাঁওয়ের তৈমুর রহমান বক্তব্য দেন।

মির্জা আলমগীরের সভাপতিত্বে এবং প্রচার সম্পাদক শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী ও সহপ্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম আলীমের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জীবন-কর্মের ওপরে স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বক্তব্য রাখেন।


শাহাদতবার্ষিকীতে বীরউত্তম জিয়ার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

-----------------------------------------------------

সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক

-----------------------------------------------------

শহীদ জিয়ার মূল্যায়ন


মানুষ মরণশীল; প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও মরণশীল ছিলেন। জীবন ও মৃত্যু মহান আল্লাহ তায়ালার হাতে; এখানে বান্দার হাত রাখার কোনো জায়গা নেই। মানুষ হিসেবে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কোনো-না-কোনো দিন মারা যেতেন। পৃথিবীর বহু দেশের বহু রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী বা জাতীয় নেতা দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় আততায়ীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন। আমাদের দেশে, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, পরিবশগত কারণে শাহাদতবরণ করেছেন। কিন্তু তিনি স্মৃতিতে অমর। চট্টগ্রাম মহানগরের ষোলোশহরে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে, ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর প্রথম প্রহরেই তিনি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ২৭ মার্চ তারিখে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে, প্রথমে নিজের নামে ও নিজের দায়িত্বে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে একই কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর নামে পুনরায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস যাবত সেক্টর কমান্ডার এবং ফোর্স কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তথা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। অতঃপর একজন শৃঙ্খলামুখী অফিসার হিসেবে ১৯৭৫ এর ২৪ আগস্ট সকাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে চাকরি করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনী প্রধান হন। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব টলটলায়মান ছিল, তখন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সুদৃঢ়ভাবে, প্রত্যক্ষভাবে সেনাবাহিনীর এবং পরোক্ষভাবে পুরো জাতির হাল ধরেন। তিনি ছিলেন জনগণের হৃদয়ের মানুষ। তিনি ছিলেন কাজের মানুষ। সামরিক শৃঙ্খলাকে, সামরিক আবেগকে তিনি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিয়ে আসেন। তার রাজনৈতিক বিরোধীগণ, তার সমালোচনা করতেই পারেন। কিন্তু বিশ্লেষণমূলক ব্যক্তিগণ বিনাদ্বিধায় বলবেন যে, জিয়াউর রহমান সমন্বয়ের রাজনীতি, সহনশীলতার রাজনীতি, সমঝোতার রাজনীতি ও বহুদলীয় রাজনৈতিক গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। গবেষকগণ স্বীকার করেন যে, তিনি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তৃণমূল মানুষের অংশগ্রহণে বিশ্বাস করতেন, কঠোর শৃঙ্খলায় বিশ্বাস করতেন এবং নিজেকে দুর্নীতির ঊর্ধ্বে রাখায় বিশ্বাস করতেন। তিনি তরুণ ও মেধাবীদের রাজনীতিতে আগ্রহী করে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। সবকিছু মিলিয়ে তিনি সেনাপতি থেকে রাষ্ট্রনায়ক হয়েছিলেন; তিনি বন্দুকের যোদ্ধা থেকে কোদালের কর্মী হয়ে দেশ গড়ার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছিলেন। মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর এবং তার সঙ্গীরা, নিজেদের প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে, তারা জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে ভুল করেছিলেন।

বহিরাঙ্গন

জিয়ার দূরদৃষ্টিমূলক, রাষ্ট্রনায়কোচিত কর্মকাণ্ডের কারণে, বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে প্রথম পা রাখে; বাংলাদেশ পৃথিবীর জাতিগুলোর মিলনমেলায় নিজের নাম উজ্জ্বলভাবে প্রস্ফুটিত করে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান দেশগুলো, তাৎক্ষণিক প্রতিবেশী অমুসলমান দেশগুলো এবং বিশ্বের নেতৃত্ব প্রদানকারী পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সাথে, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৯৮০ সালে ইরাক এবং ইরান-এর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল; উভয় পক্ষের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ওই যুদ্ধ নিরসনের লক্ষ্যে যে তিন সদস্যের তথা তিনজন রাষ্ট্রপ্রধানের কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। সর্বোপরি সবেমাত্র উদীয়মান সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি চীনের সাথে যুগপৎ ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন তিনি।

দু’টি ঘটনার মোড়

জিয়াউর রহমান ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি, কাকুল থেকে কমিশন পান, ১২তম লং বা দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের একজন সদস্য হিসেবে। তার অন্যতম সতীর্থ (সামরিক পরিভাষায় কোর্সমেট) ছিলেন সফিউল্লাহ। ১৯৫৫ সালে কমিশন পাওয়ার সময় মেধা তালিকায় জিয়াউর রহমান ছিলেন জ্যেষ্ঠ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, জিয়াউর রহমান এবং সফিউল্লাহ উভয়েই গুরুত্বপূর্ণ সময়োচিত নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন; উভয়েই সেক্টর কমান্ডার এবং ফোর্স কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭২ সালের এপ্রিলের কথা। জ্যেষ্ঠ জিয়াউর রহমানকে ডিঙিয়ে বা পাশ কাটিয়ে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত করা হয়েছিল কনিষ্ঠ সফিউল্লাহকে এবং জিয়াউর রহমানকে করা হয়েছিল সেনাবাহিনীর উপপ্রধান। আমার মূল্যায়নে, সে দিন সরকার একটি পেশাগত ৫ কৌশলগত ভুল করেছিল। ৩ বছর ৪ মাস পর, ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের ২৪ তারিখ, তৎকালীন মোশতাক সরকার, জিয়াউর রহমানকে সফিউল্লাহর স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন। তত দিনে সফিউল্লাহ সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে ৩ বছর ৪ মাস দায়িত্ব পালন করেছেন। জিয়ার সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আড়াই মাসের মাথায় সংঘটিত হয় ৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এর ঐতিহাসিক ঘটনা। জিয়াউর রহমান অনানুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় জড়িত হওয়া শুরু করেন ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখ থেকে। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম পদত্যাগ করায় তৎকালীন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। এই সময় থেকে, মৃত্যুর দিন পর্যন্ত, জিয়াউর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে ছিলেন।

ক্রসরোডে বা জংশনে জিয়াউর রহমান

দায়িত্ব নেয়ার পর জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে একাধিক বিষয়ে যথা প্রশাসনিক বিষয়ে, উন্নয়ন বিষয়ে, পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে, সামরিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। তাকে কোনো-না-কোনো একটি মহাসড়ক বেছে নিতে হয়েছিল। এই কলামের পাঠকের চিন্তার সুবিধার্থে আমি উদাহরণস্বরূপ পাঁচটি অপশন বা বিকল্প যেটি সেই সময়ে জিয়াউর রহমানের সামনে উপস্থিত হয়েছিল সেগুলো এখানে লিখছি। তখন বাংলাদেশের সামনে বেছে নেয়ার জন্য রাস্তাগুলো ছিল নিম্নরূপ : (এক) উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের পরিপূরক সড়ক অথবা, গণতন্ত্র ব্যতীত শুধু উন্নয়নের সড়ক। উল্লেখ্য, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে তত্ত্ব ও অভ্যাসগুলো সেগুলো হলো সততা বা অসততা, নীতি বা দুর্নীতি এবং সংযম অথবা লুটপাট। (দুই) মুসলিম বিশ্বের সাথে যথাসম্ভব সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রেখে বাকি বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন অথবা, মুসলিম বিশ্বকে অবহেলা করে বাকি বিশ্বের সঙ্গে দহরম-মহরম করা (তিন) বাংলাদেশের তাৎক্ষণিক প্রতিবেশীদের প্রাধান্য দিয়ে বাকি বিশ্বের সাথে সম্পর্ক রাখা অথবা, প্রতিবেশীদের অবহেলা করে বাকি বিশ্বের সাথে দহরম-মহরম করা। (চার) শিক্ষানীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদিতে ধর্মীয় মূল্যবোধের উপস্থিতি রাখা অথবা, ধর্মীয় মূল্যবোধের উপস্থিতি না রাখা। ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সম্পর্ক নৈতিকতা, সামাজিক আচার-আদবের। (পাঁচ) দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কি বাকশালীয় তথা একদলীয় তথা সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির মডেলটি অব্যাহত রাখা হবে, নাকি বহুদলীয় উন্মুক্ত গণতন্ত্র পুনরায় চালু করা হবে? বাংলাদেশ কোন রাস্তাটা বেছে নেবে সেটি নির্ভর করছিল বাংলাদেশের তৎকালীন নীতি নির্ধারকমণ্ডলীর ওপর এবং সেই নীতিনির্ধারকমণ্ডলীর কর্ণধার ছিলেন জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। আমরা এখানে সবগুলো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারছি না স্থানাভাবে। শুধু দু’টি বিষয় আলোচনা করব; যথা- বহুদলীয় গণতন্ত্র ও সার্ক।

বহুদলীয় গণতন্ত্রের সিদ্ধান্ত

জিয়াউর রহমান বহুদলীয় রাজনীতিকে বাংলাদেশে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেন। যার ফলে আগে থেকেই পরিচিত বহু রাজনৈতিক দল নব উদ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কাজ শুরু করে। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসের আগে তথা সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে বাকশাল নামক একক রাজনৈতিক দল কায়েমের আগে যে রকম আওয়ামী ছিল, সেই আওয়ামী লীগ পুনরায় কাজ শুরু করে। বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের ফলে তখন একাধিক নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছিল যার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল তথা বিএনপি। বিএনপি জিয়াউর রহমানের অমর সৃষ্টি। তাই বলা হয়, জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথমে ছিলেন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট; ১৯৭৩-এর মার্চের নির্বাচনের পরও তিনি হয়ে যান প্রধানমন্ত্রী এবং এইরূপভাবে জানুয়ারি ১৯৭৫ পর্যন্ত দেশ পরিচালনা করে গেছেন। জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু পুনরায় দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী হন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর, খোন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশ চালান; মোশতাকই সামরিক শাসন জারি করে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছিলেন। মোশতাকের অপসারণের পর ৫ নভেম্বর ১৯৭৫ থেকে বিচারপতি সায়েম দেশ চালিয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় জিয়াউর রহমানও রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার অব্যাহত রেখেছিলেন।

সার্ক বা দক্ষিণ এশিয়া সহযোগিতা সংস্থা

‘সার্ক’ মানে ইংরেজিতে সাউথ এশিয়া অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কোঅপারেশন। বাংলাদেশের জন্মে বা স্বাধীন আবির্ভাবে ভারতের ভূমিকা অনস্বীকার্য ও অনবদ্য। স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাবের কারণে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র আকারে ক্ষুদ্র হয়ে যায় এবং ভারতের সাথে পারস্পরিক শক্তির ভারসাম্য পাকিস্তানের বিপক্ষে যায়। অপরপক্ষে বাংলাদেশকে পাশে নিয়ে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত হেভিওয়েট শক্তিতে পরিণত হয়। ভারতের প্রভাব বলয় থেকে সসম্মানে বের হয়ে নিজের স্বাধীন সত্তা বিকশিত করার জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তুত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। অপরপক্ষে ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ এবং পারস্পরিক উপকারিতার স্বার্থে ভারতের সাথে বাংলাদেশকে একটি হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেই হতো। এই চিন্তাটি ১৯৭৭ বা ১৯৭৮ বা ১৯৮০ সালে যেমন জিয়াউর রহমান মহোদয়ের মানসপটে প্রোথিত ছিল, তেমনই আজো আমি বা আমার মতো আরো কোটি মানুষের মনে প্রোথিত আছে। জিয়াউর রহমান তাই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একটি সহযোগিতামূলক সংগঠনের চিন্তা উপস্থাপন করেন। তার উদ্যোগে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ নামক প্রতিষ্ঠান তথা থিংক ট্যাংক বা চিন্তার আধার স্থাপিত হয়েছিল। তাদের মাধ্যমেই পররাষ্ট্রনীতির বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এইরূপ একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা জিয়া দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর শীর্ষ রাজনীতিবিদ ও চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গের সামনে সফলভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। ফলে জন্ম নেই সার্ক। 

জিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সর্বোত্তম উসিলা 

যারা জিয়াউর রহমানকে ভালোবাসেন, তাদের অনুভূতি হলো, জিয়াউর রহমান, ১৯ দফার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের জন্য একটি ভিশন তুলে ধরেছিলেন। জিয়াপ্রেমিকদের অনুভূতি হলো, জিয়ার অনুসরণের মধ্যেই বিএনপির সাফল্যের চাবিকাঠি নিহিত। জিয়াউর রহমানের স্মৃতি কারো প্রতিদ্বন্দ্বী নয়; জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক সাফল্য কারো প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। এই দু’টি কথা আন্তরিকভাবে মেনে নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই কলামের লেখক অর্থাৎ আমি নিজে একজন রাজনৈতিক কর্মী এবং ২০ দলীয় জোটের অংশীদার একটি দলের প্রধান। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে মনে করি, গত তেরো বছর যাবত বিএনপি নিজে কিছু ভুল করেছে এটা যেমন সত্য, তার থেকেও অনেক বড় সত্য হলো বিএনপির ওপর নির্যাতন নিপীড়নের খড়গ্হস্ত নেমে এসেছে। আমি মনে করি, বিএনপিকে ক্ষতিগ্রস্ত বা বিএনপিকে নির্মূল করা মানে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী ঘরানার রাজনীতিকে ক্ষতি করা বা নির্মূল করা। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি মনে করি, ধৈর্যের ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে বিএনপির অখণ্ডতাকে সুরক্ষা দিতে হবে; এই কাজে আমি একজন নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক সহযোগী হয়ে নিজেকে সৌভাগ্যমান মনে করি। জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শ, রাজনৈতিক কারিশমা ও দেশ গঠনের আদর্শের ক্ষতি করার জন্য অতীতে বহু চক্রান্ত হয়েছে; বর্তমানেও যে হচ্ছে না তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? অতএব, সাধু সাবধান!

  • লেখক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি। 


ইতিহাসে নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছেন জিয়া

 -------------------------------

— ড. মারুফ মল্লিক

-------------------------------

 

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্যদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে দেশের ইতিহাসে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন জিয়াউর রহমান। 

ক্ষমতায় আসার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সামরিক শাসকের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ নিলেন। রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করে রাজনীতির মাঠে নামলেন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বিএনপি টিকে রইল।

এর মূল কারণ হচ্ছে জিয়াউর রহমান কিছু কৌশল ও নীতির প্রয়োগ করেছিলেন। রাজনীতিতে বড় চমকটি হচ্ছে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে তাঁর নতুন অবস্থান। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নামে নতুন এক রাজনৈতিক ধারণার প্রবর্তন ও সূচনা করেন তিনি। বহুমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে তিনি রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হন। প্রথমেই প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রকে ঢেলে সাজানো হয়। এরপর সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করা হয়। প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীকে পুরো নিয়ন্ত্রণে এনে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে অনেকটা পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর আদলে বাস্তবায়ন করা হয়। এর একটি দিক ছিল সামাজিক অংশগ্রহণ ও অপরদিকে সামরিক প্রশিক্ষণ। তবে রাশিয়ার জার বা জাপানের মেইজি সাম্রাজ্যের মতো আমলানির্ভর ছিল না বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষভাবে জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করেছিলেন জিয়া। খাল খনন, গণশিক্ষা, গ্রাম সরকার, ভিডিপির মতো বিভিন্ন কর্মসূচিতে নাগরিকদের সরাসরি যুক্ত করা হয়েছে। গ্রাম বা গণমানুষকে ভিত্তি করে বিভিন্ন কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়েছে।

জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী ধারণার বিভিন্ন পরিকল্পনার মধ্যে একধরনের গণভিত্তিক কর্মসূচি লক্ষ করা যায়। এমনকি কৃষিজমির আল বা বিভাজনও তুলে দেওয়ার কথা জিয়া বলেছিলেন। অনেকেই মনে করেন, দেশে কৃষি খাতে যৌথ খামার পদ্ধতি শুরু করার পরিকল্পনা হয়তো ছিল জিয়ার। জিয়া সরাসরিই কৃষি সমবায়ের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে উদার অর্থনীতির সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থার সমন্বয়ের চিন্তাও থাকতে পারে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে একধরনের মিশ্র ব্যবস্থা বলা যেতে পারে। তৃণমূলে গণভিত্তিক উৎপাদন ও শাসনব্যবস্থা প্রয়োগের চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। তৃণমূল থেকে মতামত তৈরি করে কেন্দ্রে সিদ্ধান্ত প্রণয়নের প্রবণতা ছিল ওই সময়। এসবের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা হয়েছে। যেমন আগে সেচ ও কৃষি যন্ত্রের খাত পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু জিয়ার আমলে কৃষি খাতে বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়। সেচের জন্য গ্রামে গ্রামে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল গড়ে ওঠে। একজন সেচযন্ত্র কিনে অন্যদের চাষের জমিতে পানি সরবরাহ করত। এ ধরনের গণভিত্তিক উৎপাদন প্রক্রিয়া সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে দেখা যায়। তবে ওই সময়ের সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে সবকিছু সরকারি নিয়ন্ত্রণে ছিল। 


কিন্তু জিয়াউর রহমান সরকারি পর্যবেক্ষণ বজায় রেখে স্থানীয় জনসাধারণের হাতে এসব ছেড়ে দেন। যে কারণে পুঁজিবাদের চরম মুনাফামুখী আচরণ বা সমাজতন্ত্রের অতি কঠোর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে সরে এসে বাংলাদেশ পশ্চিম ইউরোপ ঘরানার নতুন একটি মডেল তৈরি করতে পেরেছিল ওই সময়ের জন্য। নতুন ধারার এই অর্থনৈতিক কাঠামোর কারণে দেশের শিল্প ও কৃষি খাতে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। জনসাধারণ সরাসরি এ পরিবর্তনের সুফল ভোগ করেছিল। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজ থেকে শিক্ষিত নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির সৃষ্টি হতে থাকে। ১৯৪৭-এর আগে বা পাকিস্তান আমলে পিছিয়ে থাকা গ্রামীণ জনগোষ্ঠী নগরমুখী হতে থাকে। কৃষকের ছেলে আর কৃষিতে নিয়োজিত না হয়ে অফিস-আদালত, মিল-কলকারখানাতে নিজের কর্মের সংস্থান খোঁজে নেয়। এর ফলে নতুন নতুন পেশা ও নাগরিক জীবনের বিকাশ ঘটতে থাকে।

জিয়াউর রহমানের শাসনামলকে দুই ভাগে আলোচনা করা যায়। একটি হচ্ছে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান ও নীতিকৌশল। অপরটি হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি। তিনি রাজনীতির দুয়ার সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। গণমাধ্যমকে স্বাভাবিকভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছিলেন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর সময়ে একুশে ও স্বাধীনতা পদক প্রদান করা শুরু হয়। জাতীয় লোকসংগীত উৎসব, জাতীয় নাট্যোৎসব, জাতীয় বার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী, বেতার-টিভির সম্প্রসারণ, টিভির রঙিন সম্প্রচার, জাতীয় শিশু-কিশোর পুরস্কার প্রবর্তন, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শুরু করা, চলচ্চিত্রের জন্য অনুদান তহবিল গঠন, ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আর্কাইভ চালু করা, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হয়। মেয়েদের স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়।

মূলত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি দিয়ে জিয়াউর রহমান তাঁর রাজনৈতিক সমালোচনা, ব্যর্থতা, সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। যে কারণে তাঁর বিভিন্ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক থাকলেও গণমানুষের মধ্যে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। এতে বিএনপিরও একটি জনভিত্তি তৈরি হয়ে যায়। 

  • লেখক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।  

[ আমাদের সম্পাদকীয় নীতিমালা অনুযায়ী লেখাটি সম্পাদনা করা হয়েছে। মূল লেখাটি দৈনিক প্রথম আলোতে মে ৩০, ২০২১, এ প্রকাশিত হয়েছে] 


বাংলাদেশের শিক্ষার টেকসই উন্নয়ন, প্রসার ও কর্মমুখীকরণে শহিদ জিয়া ও বিএনপির অবদান

----------------------------------------------------------

অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাত মোহাঃ শামীম ও 

অধ্যাপক ড. মোঃ মোর্শেদ হাসান খান

------------------------------------------------------


আলোচনার শুরুতেই শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করছি ইতিহাসের মহান নেতা, ক্ষণজন্মা পুরুষ, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তমকে। শহীদ জিয়া সমন্ধে কোনো বলাই যথেষ্ট হবেনা। জিয়া একটি ইতিহাস। জিয়া একটি প্রতিষ্ঠান। জিয়া একটি বৈপ্লবিক চেতনা। জিয়া একটি রাজনৈতিক দর্শন। ব্যক্তি চিরস্থায়ী নন। সুতরাং ব্যক্তিকে টিকে থাকতে হয় তার কর্ম ও আদর্শ দিয়ে। শহীদ জিয়া যে সকল কাজ করে গেছেন, যে আদর্শের উদাহরণ রেখে গেছেন, তাতে যুগের পর যুগ ধরে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তিনি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আমরা মনে করি, ব্যক্তির অমরত্ব সম্ভবত সেখানেই। 

জিয়াউর রহমান ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন নম্র, ভদ্র ও নিরহঙ্কার। তিনি ছিলেন স্বল্পভাষী। একজন প্রেসিডেন্ট হয়েও তিনি সাদাসিধে জীবন যাপন করতে ভালোবাসতেন। আনুষ্ঠানিকতা এবং প্রেসিডেন্ট পদের দাবিতে তিনি সবসময় ভালো কাপড় পড়তেন। কিন্তু ঘরের ভিতরে তিনি ছেঁড়া কাপড় তালি দিয়ে রিপু করে ব্যবহার করতেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার ভাষায়, “আমার দেশের মানুষ গরীব, জনগণ গরীব; তাদের অর্থে আমার বিলাসিতা করা উচিত নয়, সরকারি অর্থ মানেই জনগণের অর্থ।” তিনি একমাত্র প্রেসিডেন্ট যাকে ক্ষমতার অপব্যবহার কিংবা অর্থের লোভ-লালসা স্পর্শ করতে পারেনি। একবার নেপালের রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহদেব এবং স্ত্রী রানী ঐশ্বর্যলক্ষী দেবী বাংলাদেশ সফরে আসলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁদের দুই সন্তান। এটা দেখে জনাব তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমানের মনে প্রশ্ন জাগলো তাদের পিতাও তো দেশের প্রেসিডেন্ট তাহলে তারা কেন বিদেশ যেতে পারবেনা? একদিন সকালে পুত্র তারেক রহমান মা বেগম খালেদা জিয়ার সামনে এসে বললেন, নেপালের রাজা-রানী তাঁদের সন্তান নিয়ে বাংলাদেশ এসেছিলেন। তাহলে আমাদের দুই ভাইকে সঙ্গে নিচ্ছনা কেন? মা পুত্রের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দরজার দিকে ইশারা করে বললেন, প্রশ্নটা এবার ওখানে কর। পেছনে ফিরে তারেক রহমান দেখলেন, পিতা প্রেসিডেন্ট জিয়া দাঁড়িয়ে আছেন। পুত্রের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, তোমরা তো রাজার ছেলে নও, তোমাদের বিদেশ ভ্রমণের খরচ রাষ্ট্র বহন করবে কেন? জিয়াউর রহমানের সততা সম্পর্কে একজন বিদেশি সাংবাদিক তার বক্তব্যে বলেছেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার সততা শুধু বাংলাদেশের রাজনীতিকদের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের রাজনীতিকদের জন্যও অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত (বাংলাদেশ টাইমস, ৯ নভেম্বর, ১৯৮১)। তাঁর সততার খ্যাতি বিশ্বজোড়া।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন সৎ, আদর্শ, মহৎ ও ধার্মিক মানুষ। মহান আল্লাহর প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। তিনি সিগারেট ও মদ্যপান করতেন না। তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন, পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতেন এবং রমজানে যথারীতি রোজা রাখতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু প্রকৃতির মানুষ। তিনি একদিন এক গ্রামে সফরকালে হটাৎ লক্ষ্য করলেন, এক বাড়িতে এক মহিলা নিজে ‘ঘাইন’ টানছেন। এটি দেখে তিটি বিস্মিত হয়েছিলেন, অত্যন্ত দুঃখ পেয়েছিলেন, ব্যাথিত হয়েছিলেন। তিনি তৎক্ষণাত উক্ত বাড়িতে উপস্থিত হয়ে মহিলার ‘ঘাইন’ টানার বিষয়ে জানতে চাইলেন। যখন তাঁকে জানানো হলো যে, ঐ পরিবার এতই গরীব ‘ঘাইন’ টানার জন্য গরু কিনতে সমর্থ নয়, প্রেসিডেন্ট জিয়া তখনই গরু ক্রয়ের জন্য তিন হাজার টাকা দান করলেন।




বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট জিয়ার খাবারের মেন্যু ছিল: ডাল, রুটি, সবজি আর বড়জোর কিছুটা মাছ বা মাংস। সেই সময় জিয়ার খাবারের আমন্ত্রণকে অনেকে পানিশমেন্ট ফুড হিসেবে বিবেচনা করত। প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তিনি পেয়েছেন অমূল্য উপহার। এসব উপহার, এমনকি ব্যক্তিগতভাবে দেয়া উপহার তিনি নিজে নেন নি। এসব জমা দিয়েছেন বঙ্গভবন কোষাগারে। মোটকথা, তিনি জাতির সঙ্গে কখনো হিপোক্রেসি করেননি বলেই জাতির কাছে আজ জিয়া সততার প্রতীক। মাওলানা ভাসানীকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনাকে সব সময় সরকার বিরোধী ভূমিকায় দেখা যায়, এমনকি যখন আপনার নিজের দল মন্ত্রিসভা গঠন করেছিল তখনও আপনি একই জনসভায় দাঁড়িয়ে আপনার পাশে বসা মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার উচ্চারণ করে বক্তৃতা দিয়েছেন। অথচ দেখা যায় আপনি জিয়াউর রহমানের প্রতি সহানুভূতিশীল। জিয়ার প্রতি এই দুর্বলতার কারণ কী? মাওলানা জবাবে বলেছিলেন, তোমরাতো রাজনীতি দেখছো বহুদিন ধরে, আমার রাজনৈতিক জীবনও বহুদিনের, “এমন একটা লোক দেখলামনা (জিয়া ব্যতিত) যে ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে নিজেকে দুর্নীতি আর সজনপ্রীতির উর্দ্ধে রাখতে পেরেছে, আমাকে একটামাত্র উদাহরণ দেখাও।”


জিয়া জনগণের সঙ্গে প্রত্যেক্ষ যোগাযোগের (খাল খনন, গণশিক্ষা ইত্যাদি) মাধ্যমে কাজ করেছেন। তার আগে কোন নেতা নেত্রীকে দেশের মানুষ এতো কাছে থেকে দেখার, কথা বলার ও কাজ করার সুযোগ পায়নি। জিয়ার এই স্বল্পকালীন রাজনৈতিক জীবনে তিনি প্রায় ৫০০০ জনসভা, কর্মীসভা, সমাজ সংগঠনমূলক সভা করেছেন। এটা বাংলাদেশে তো বটেই, পৃথিবীর অন্যদেশের তুলনায়ও রেকর্ড। তিনি জনসভায় দীর্ঘ বক্তব্য দিতেন, প্রশ্নোত্তর করতেন, মতামত দিতেন এবং হাজার মানুষের সঙ্গে হাত মিলাতেন। দলের কথার চেয়ে বেশি কাজ করার কথা বলতেন। ভাগ্য উন্নয়নের কৌশল আলোচনা করতেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কথা বলতেন। এগুলোই ছিল গনসংযোগে তাঁর রাজনৈতিক ভাষা। বিরোধী দলকে গালিগালাজ, অন্য নেতৃত্ত্বকে অসম্মান করার চেষ্টা তাঁর ভাষায় ছিলনা। তিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতেন তাঁর বক্তব্যে। জাতিকে বিভক্ত করতেন না। তাঁর দল থেকে তখন প্রচুর লিফলেট, ছোট বই এবং অসংখ্য পোষ্টার ছাপা হতো। 

বন্যা থেকে রক্ষা পাবার, স্বাস্থ্য সুরক্ষার, এমনকি গম বীজ কেমন করে রাখতে হবে তার পোষ্টার লিফলেটও বিএনপি থেকে ছাপা হয়েছিল। তিনি চেয়েছিলেন বিএনপি শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, একটি রাজনৈতিক শিক্ষালয়ও হবে।

শিক্ষার টেকসই উন্নয়ন, প্রসার এবং কর্মমুখীকরণে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধত্তোর বাংলাদেশে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ও প্রসারকে সবার আগে গুরুত্ব দিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক শহীদ জিয়া গণমানুষের উন্নয়নে যে প্রকল্পগুলো গ্রহণ করেছিলেন তা পরবর্তীকালে আরও গতিশীল হয়েছিল আপোষহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সুশাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। শহীদ জিয়ার উন্নয়ন মডেল অনুসরণ করে বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি ও চারদলীয় জোটের শাসনামলে শিক্ষাকে দেয়া হয়েছিল সর্বোচ্চ গুরুত্ব এবং অগ্রাধিকার। কারিগরি শিক্ষার প্রসার, শিক্ষাকে জীবনমুখী ও কর্মমুখী করে তোলার পাশাপাশি পরীক্ষায় নকল দূরীকরণেও তাঁর সরকারের সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয়। উল্লেখ্য, সরকারি চাকরীতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ বৎসর থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর-এ উন্নীত করা হয় বিএনপি শাসনামলেই। আমরা একটু পর্যবেক্ষণ করলেই কয়েকটি বিষয়ে ওয়াকিবহাল হতে পারি। পয়েন্ট আকারে বিষয়গুলোকে এভাবে তুলে ধরা যায়Ñ

গণশিক্ষা কার্যক্রম চালু

ব্যক্তিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। যথার্থই বলা হয়, শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা মানুষকে তার ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের চাহিদা ও করণীয় সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। জিয়া মনে করতেন, দেশের মানুষ শিক্ষিত না হলে দেশের কোনো উন্নতি হবেনা। তিনি মানুষকে লেখাপড়া শেখানোর জন্য দেশে গণশিক্ষা কর্মসূচি চালু করেন। শিশুদের স্কুলে পাঠিয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদানের পাশাপাশি নিরক্ষর বয়স্ক জনগোষ্ঠীকেও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে সাক্ষর করে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। ১৯৮০ সাালে প্রেসিডেন্ট জিয়া ০১ বৎসরে ০১ কোটি নিরক্ষর এবং দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ০৪ কোটি নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে স্বাক্ষরতা সেবা প্রদানের উদ্দেশ্য নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে Mass Education Programme (MEP) কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন।

১৯৮০ সালে সরকারি উদ্যোগে দেশব্যাপী চালু করেছিলেন গণশিক্ষা। তিনি নিজে হারিকেন জ্বালিয়ে গ্রাম বাংলার কর্মসূচির উদ্বোধন করেছিলেন। একই সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মীদেরকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে। নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছেপেছিলেন ০১ (এক) কোটি বই। গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করে মাত্র দেড় বছরে ৪০ (চল্লিশ) লাখ বয়স্ক মানুষ নতুন করে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র পড়াশোনার পরিবেশ ফিরিয়ে এনেছিলেন। শিক্ষার প্রসারে গ্রন্থাগারকে গুরুত্ব দিয়ে ১৯৮০-৮১ অর্থ বছরে ‘থানা পাবলিক লাইব্রেরি কাম অডিটোরিয়াম স্থাপন’ শীর্ষক একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন।

আদর্শ নাগরিক গড়ার লক্ষ্যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে তিনি ঢেলে সাজিয়ে প্রতিটি নাগরিকের জন্য সহজলভ্য করে দেন। 

ছাত্রদেরকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে উৎসাহ প্রদান করেন। তাদের জন্য নানা রকম অনুষ্ঠান আয়োজন করে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট উপস্থিত থাকতেন। ‘হিজবুল বাহার’ নামক একটি জাহাজে করে কৃতি ছাত্রছাত্রীদের তিনি শিক্ষা ভ্রমণেরও ব্যবস্থা করেন। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া শিক্ষাব্যবস্থার সাথে নতুন একটি বিষয় সংযুক্ত করেন। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের যাতায়াত সুবিধার জন্য দেশের প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজসমূহে পরিবহন ব্যবস্থা সংযুক্ত করে দেন। 

তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন নিজস্ব তহবিল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে বাস ও মিনিবাস উপহার দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করেন যা ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে একটি কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। 

বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা


প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে বিভিন্ন সময়ে এর সংস্কার ও উন্নয়নের প্রচেষ্টা করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার অপরিহার্যতার প্রতি লক্ষ্য রেখে জিয়াউর রহমান ১৯৮০ সালে দেশে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯৩ সালে ৫ বছরের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করেন। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শিক্ষালাভে আগ্রহী করতে খালেদা সরকার ১৯৯৩ সালে ‘শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য’ কর্মসূচিও চালু করেছিলেন। 

বিএনপি ২০০১ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসার পর ২০০৩ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠন করে প্রাথমিক শিক্ষাব্যাবস্থাপনাকে আরো এক ধাপ উপরে নিয়ে যায়। ২০০৩ সালে শুরু হওয়া প্রাথমিক শিক্ষায় ৭৮ লক্ষ শিশু ১০০ টাকা হারে বৃত্তি পেয়ে আসছে। বেগম খালেদা জিয়ার ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকাকালীন প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তি হার উল্লেখযোগ্য ও সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছায়। এই সময়ে ভর্তির হার ৯৭ শতাংশে উন্নীত হয়।

মাদ্রাসা শিক্ষা

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে (১৯৭৬-৮১ খ্রি.) বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ শুরু হয়। যুগের চাহিদা এবং জাতীয় ঐতিহ্য ও প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমন্বিত উপায়ে ইসলাম ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালে দেশে একটি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর শান্তিডাঙ্গায় (কুষ্টিয়া ও যশোর সীমান্তবর্তী এলাকা) রাষ্ট্রপতি জিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিস্তর স্থাপন করেন। ১৯৮০ সালে জাতীয় সংসদে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাশ করা হয়। মাদ্রাসা শিক্ষার বহুমুখী উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রপতি জিয়ার আমলে ১৯৭৮ সালে ‘মাদ্রাসা শিক্ষা অধ্যাদেশ’ বলে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড স্থাপিত হয়। ১৯৭৯ সালের ৪ জুন থেকে এর কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মেয়াদ শেষে জিয়া সরকার যে দ্বি-বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে সেখানে মাদ্রাসা শিক্ষাখাতের উন্নয়নে ১.২১ কোটি টাকা পৃথক বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। সামাজিক বাস্তবতা অনুধাবন করে স্বাধীন বাংলাদেশে শহীদ রাষ্ট্রপতি 

জিয়াউর রহমানই প্রথম ঘোষণা দিয়েছিলেন দেশের প্রতিটি জেলায় একটি সরকারি গার্লস কলেজ, একটি সরকারি বয়েজ কলেজ ও একটি সরকারি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার। প্রথম দুটি বাস্তবায়িত হলেও তৃতীয়টি বাস্তবায়িত হয়নি, যা দেশের বর্তমান বাস্তবতার আলোকে প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক।

১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-০৬ সালে খালেদা জিয়ার সরকারও বিভিন্ন মেয়াদে মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ সময় এবতেদায়ি মাদ্রাসাকে বেসরকারি প্রাথমকি স্কুলের সমপর্যায়ে উন্নীতকরণ ও শিক্ষকদের সুযোগসুবিধা প্রদান করা হয়। বিএনপি শাসনামলেই ২০০৩ সন থেকে সরকার এবতেদায়ি মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীদের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করে আসছেন। বিএনপি সরকার মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য গাজীপুরে মাদ্রাসা ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে। ২০০২ সালে গঠিত মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কার কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বিএনপি সরকারই ২০০৬ সালে প্রথম ফাজিলকে ব্যাচেলর ও কামিলকে মাস্টার্স ডিগ্রি প্রদান করেছিল (সূত্রঃ জাতীয় শিক্ষা কমিশন ২০০৩)।

দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সরকারের আমলেই একটি এফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আরবী ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ২০০৬ সালে জাতীয় সংসদে একটি আইন পাশ হয়। এরই ধরাবাহিকতায় ২০১৩ সালে বাংলাদেশে আরবী ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। একই বছরে খালেদা জিয়া সরকার কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ শ্রেণি দাওরায়ে হাদিসকে আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজের সমমানের মাস্টার্স ডিগ্রির মান দিয়ে ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়কর্তৃক একটি পরিপত্র জারি করা হয়। সম্প্রতি, সরকার আরেকটি পরিপত্রের মাধ্যমে দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান প্রদান করেছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা 

উচ্চ শিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন (Private University Act) প্রবর্তন করেন। এর মাধ্যমে বেসরকারি উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও পঠন-পাঠন শুরু করেছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষার বিস্তারে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০০টিরও উপরে যেখানে প্রায় ০৬ লাখের কাছাকাছি বা অধিক সংখ্যক ছাত্রছাত্রী উচ্চ শিক্ষায় নিয়োজিত রয়েছে।

শিক্ষায় দূরশিক্ষণ পদ্ধতি চালু 

কর্মজীবি মানুষ, যাদের কর্মস্থলে দীর্ঘকাল উপস্থিত থেকে সনাতন পদ্ধতিতে শিক্ষাগ্রহণ সম্ভব নয়, যে সব বয়স্ক মানুষ যথাসময়ে নানা কারণে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন নি এবং বিভিন্ন স্তরের পেশাজীবীদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করার জন্য শিক্ষায় দূরশিক্ষণ পদ্ধতির লক্ষ্যে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ 

উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) প্রতিষ্ঠা করেন। দূরশিক্ষার মাধ্যমে সমগ্র মানুষকে অতি স্বল্প সময়ে কর্মক্ষম মানব সম্পদে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যেই এই উদ্যোগ (সূত্রঃ জাতীয় শিক্ষা কমিশন ২০০৩)।

শিক্ষার সুযোগ গ্রহণে অসমর্থ বিশাল গ্রামীণ যুবক ও নারী সম্প্রদায়ের সামনে বাউবি শিক্ষা কর্মসূচি এক বিস্তৃততর অঙ্গন উন্মোচন করে দিয়েছে। ফলে তারা স্ব-কর্ম (self-employment) দ্বারা যেমনি স্বাবলম্বী হচ্ছে তেমনি এ দেশের অর্থনীতি ও জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। বাউবি থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২২ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী তাদের কাঙ্খিত শিক্ষা সমাপ্ত করেছে । এক কথায়, শিক্ষার সুযোগ ও সুবিধাবঞ্চিত নানা শ্রেণি-পেশায় নিয়োজিত মানুষকে বাংলাদেশের শিক্ষা ও উন্নয়নে যুক্ত করে টেকসই উন্নয়নের ধারাকে প্রণোদিত করার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাউবি’র বিকল্প বাংলাদেশে নেই।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা

একটি সফল গণতান্ত্রিক আন্দোলন শেষে এককভাবে নির্বাচনে জিতে ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি সরকার। বিএনপির শাসনামলেই ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে এটি বিশ্বের ৫ম বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। স্নাতক পর্যায়ে বাংলাদেশের মোট শিক্ষার্থীর ৪৮ শতাংশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। বর্তমানে অধিভূক্ত কলেজের সংখ্যা ২৭০০ এবং ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১৩ (তের) লক্ষ (সূত্রঃ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ওয়েবসাইট)।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা

বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসার পর তথ্য প্রযুক্তি ও কম্পিউটার খাতের গুরুত্ব তীব্রভাবে অনুভব করে। এরই ধারাবাহিকতায় বিএনপি সরকার তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় গঠনের মাধ্যমে এ খাতকে জাতীয় উন্নতিতে সম্পৃক্ত করার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রযুক্তি হস্তান্তর, নব নব প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং এগুলোকে ব্যাবহারের মাধ্যমে দেশের শিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে বিএনপি শাসনামলে ১২ (বার)-টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া দেশের বড় বড় ৪টি বিআইটিকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়।

নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে সরকারি চাকুরিতে নারীদের জন্য কোটা সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করার প্রথম ঘোষণা দেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় চাকরিতে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ পদ সংরক্ষিত রাখার বিধান করেছিলেন জিয়াউর রহমান। নারী উন্নয়নে জিয়ার অবদানের ধারাবাহিকতায় ১৯৯১-৯৬ শাসনামলে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার নারী শিক্ষার 

প্রসারে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। প্রথমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং পরবর্তীকালে ডিগ্রি পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করে দেওয়া হয়। মেয়ে শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া রোধ করতে শিক্ষা উপবৃত্তিও চালু করা হয়। দরিদ্র শিশুদের শিক্ষার জন্য তার সরকার ‘শিক্ষার জন্য খাদ্য’ নামে এক বৃহৎ কর্মসূচিও চালু করেন। শিক্ষাবান্ধব খালেদা জিয়া সরকারের নীতির কারণে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের স্কুল পর্যায়ে ছেলে ও মেয়েদের অনুপাত ৫২ঃ৪৮-এ উন্নীত হয়। ২০০৬ সাল নাগাদ তা ৫০ঃ৫০ হয়ে যায়। বিখ্যাত লেখক ও গবেষক নিকোলাস ক্রিস্টফ বাংলাদেশের উন্নয়নের রহস্য নিয়ে তার এক লেখায় বলেন, “What was Bangladesh’s secret? It was education and girls”. তিনি আরো বলেন,b, “As Bangladesh educated and empowered its girls, those educated women became pillars of Bangladesh’s economy.”

খালেদা জিয়ার সময়েই মেয়েদের জন্য ০২ (দুই) টি নতুন ক্যাডেট কলেজ ও ০৩ (তিন) টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হয়। নারীর ক্ষমতায়ন ও সংসদে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণও করা হয়। উল্লেখ্য, ফোর্বস সাময়িকীর বিশ্বের ১০০ ক্ষমতাবান নারী নেতৃত্বের তালিকায় ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অবস্থান ছিল ১৪ তম।

নারীদের জন্য এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা

২০০১ সালে বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসার পর নারীদের উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে। এশিয়া ও বিশ্বে টেকসই অর্থনৈতিক ও মানব উন্নয়নের জন্য দক্ষ ও পেশাদার সেবাভিত্তিক নারী নেতা সৃষ্টির লক্ষ্যে চট্রগ্রামে নারীদের জন্য ‘এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন’ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি বিশেষতঃ এশিয়ান সমাজে পশ্চাৎপদ ও অনগ্রসর নারীদের জন্য শিক্ষার অবারিত সুযোগ সৃষ্টির এক অনন্য প্রয়াস।বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বের ১৬ টি দেশের ৫০১ জন ছাত্রী লেখাপড়া করছে। ‘এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন’এ প্রায় ৭০ শতাংশ বাংলাদেশি এবং বিদেশি শিক্ষার্থীরা বিনা খরচে পড়াশোনা করছে (সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৩শে এপ্রিল ২০১৪) ।

জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন

বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে ০৭ (সাত)-টি বিজ্ঞ শিক্ষা কমিশন বা শিক্ষা কমিটি গঠিত হয়েছে। ১৯৯১-৯৬ সালে এবং পুনরায় ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে বেশ কিছু যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার সুফল দেশবাসী পাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায়, বিএনপি সরকার ২০০২ ও ২০০৩ সালে দেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় সমস্যাবলী চিহ্নিত করে এর উন্নতিকল্পে জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। 

ইপসা (IPSA) প্রতিষ্ঠা

কৃষিতে উচ্চ শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য জিয়াউর রহমানের সময়Bangladesh College of Agricultural Science (BCAS) প্রতিষ্ঠিত হয়। জাপান সরকারের সক্রিয় সহযোগিতায় শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ-সুবিধা গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে কৃষি বিজ্ঞানে দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন মেটাতে সরকার ১৯৮৩ সালে কলেজটিকে স্নাতকোত্তর কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইপসাতে  (IPSA: Institute of Postgraduate Studies in Agriculture) রুপান্তরিত করে। 

এরই ধারাবাহিকতায়, ১৯৯১-৯৬ শাসনামলে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারও কৃষি শিক্ষার প্রসারে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। ১৯৯১ সালে কোর্সভিত্তিক এমএস ও পিএইচডি প্রোগ্রাম নিয়ে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয় বেগম খালেদা জিয়ার হাত ধরে। ১৯৯৪ সালে রাষ্ট্রপতির এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ওচঝঅ একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হয়। ১৯৯৮ সালের ২২ নভেম্বর ওচঝঅ পূনর্গঠন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ^বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। 

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা 

বর্তমান পৃথিবীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ লোক কৃষিকর্মে নিয়োজিত। বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ডও হলো কৃষি যেখানে দেশের মোট শ্রমশক্তির ৫৮ ভাগ কৃষিতে জড়িত। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কৃষিকে বাংলাদেশের প্রাণ বলে অভিহিত করেন। কাজেই, বাস্তবতার আলোকেই তাঁর সময় ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)। বিভিন্ন ফসলের জাত উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, টেকসই প্রযুক্তি উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, কৃষি প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য ম্যানডেট নিয়ে যাত্রা শুরু করে স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানটি। সরকারি পর্যায়ে কৃষি কর্মকান্ডের সূত্রপাত মূলতঃ এখান থেকেই।উল্লেখ্য, এ পর্যন্ত ২০৮টিরও বেশি ফসলের ৫১২টি উচ্চ ফলনশীল (হাইব্রিডসহ) রোগ প্রতিরোধক্ষম ও বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশ প্রতিরোধী জাত এবং ৯০০ টিরও বেশি কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে, যা দেশে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার যোগান নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে (সূত্রঃ ১ জানুয়ারি ২০১৮, নয়াদিগন্ত)। 

নকল প্রতিরোধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা

মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে পরীক্ষাব্যবস্থায় যেসব অনিয়ম ক্যান্সার আকারে আমাদের পুরো জাতিকে মেধাশুন্য করছে তার মধ্যে অন্যতম হলো প্রশ্ন ফাঁস বা নকল। প্রশ্ন ফাঁস আগেও হয়েছে তবে বর্তমানে তা এক মহামারি এবং যে কোনো সংক্রামক ব্যাধির চেয়েও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। 

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিষয়টি অনুধাবন করে ১৯৭৭ সালে সর্বপ্রথম সরকারি চাকুরিতে লোক নিয়োগের জন্য পিএসসির মাধ্যমে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের নিয়ম প্রবর্তন করেন। উল্লেখ্য, আগে শুধু মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে আমলা নিয়োগ দেয়া হতো। শুধু মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে এভাবে আমলাতন্ত্র নিয়োগ ছিল মেধাভিত্তিক প্রশাসন তৈরির নীতির পরিপন্থি।

“খালেদা জিয়ার অঙ্গিকার, কোয়ালিটি এডুকেশনের আবিষ্কার”। নানা প্রতিবন্ধকতার ভেতরেও বিএনপি ও চারদলীয় জোট সরকার শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নয়নে কাজ করেছেন। পাশাপাশি সকল পাবলিক পরীক্ষায় নকলমুক্ত পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করে নকল প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বিশেষত, নকল প্রতিরোধে তৎকালীন জোট সরকারের মাননীয় মন্ত্রী এহসানুল হক মিলন হয়ে উঠেছিলেন অবিসংবাদিত এক নাম। সম্প্রতি নকল ও প্রশ্নফাঁসের জালে আটকে পড়ে জাতির যখন ত্রাহি অবস্থা, তখনও তৎকালীন মন্ত্রী এহসানুল হক মিলন বিভিন্ন স্থানে বক্তব্য রেখেছেন নকল প্রতিরোধ ও প্রশ্নফাঁস থেকে মুক্তির নানা পথ প্রদর্শন করে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের পর দেশমাতৃকার উন্নয়নে মনোনিবেশ করেছিলেন। দেশ বিনির্মাণে তাঁর ৫০ বছর পূর্বের গৃহীত কর্মসূচিগুলো এখনো প্রসঙ্গিক এটাই তাঁর অনন্যতা। তিনি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য যে কর্মসূচিগুলো গ্রহণ করেছিলেন সেখানে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায় শিক্ষাখাত। ফলে তারই ধারাবাহিকতায় দেখা গেছে, শিক্ষার উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের অর্জন বহুমুখী ও ব্যাপক। বিএনপি যখনই সরকার গঠনের সুযোগ পেয়েছে তখনই সময়োপযোগী ও জনকল্যাণমুখী নানা কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার উন্নয়ন ত্বরান্বিত করেছে। বিগত দিনগুলোতে যেমন নকল প্রতিরোধ এবং শিক্ষার সুযোগ সবার 

জন্য অবারিতকরণে বিএনপির ভূমিকা ছিল মূখ্য। তেমনি আগামী দিনগুলোতেও বিএনপি দেশ ও জাতির কল্যাণে শিক্ষাক্ষেত্রে তার যুগোপযোগী ভূমিকা অব্যাহত রাখবে এটাই বাংলাদেশের মুক্তিকামী জাতীয়তাবাদী জনতার প্রত্যাশা।

পরিশেষে, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহামান কতখানি জনগণের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন তা বোঝা যায় তাঁর মর্মন্তুদ জীবনাবসানের দিনের ঢাকার দৃশ্য থেকে। তাঁর দেহাবশিষ্ট শেষবারের মতো একবার দেখার জন্য অগণিত মানুষের সেদিন ঢল নেমেছিল বিমানবন্দরে। এ প্রসঙ্গে পার্লামেন্টে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, ৩০ মে থেকে ০৩ জুন লাখ লাখ জনতা শুধু ঢাকা নয় সারাদেশে অনুভূতি প্রকাশ করেছে, প্রমানিত হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের কত কাছাকাছি এবং প্রাণপ্রিয় ছিলেন। তাঁর সততার প্রতি অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা জানাতে তিনি বলেন আমরা যে গণতন্ত্রের কথা বলি তা জিয়ার মাধ্যমে সংবিধানে গৃহীত হয়েছে। আমি নিজে যে পার্লামেন্টে এসেছি তাও জিয়ার জন্য। শহীদ জিয়ার প্রতি মানুষের যে এত ভালবাসা, এত শ্রদ্ধা, এত ভক্তি ও এত অনুভূতি ছিল তা সেদিন প্রমাণ করেছে। আমরা এমন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

  • লেখকদ্বয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। 



৩০শে মে— বাংলাদেশের ইতিহাসের নির্মমতম দিন



৩০শে মে ১৯৮১, দিনটা ছিলো শুক্রবার। প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টির রাত। জানালার কাচে আছড়ে পরছে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা। সময় ভোর চারটা। বৃষ্টি কমে এসেছে। রাতের সুনসান নীরবতা ভেঙে হঠাৎ একটি সামরিক গাড়িবহর তড়িঘড়ি করে ছুটে গেলো চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের দিকে। সার্কিট হাউজের গেট অতিক্রম করে গাড়ি থেকে নেমে রকেট লাঞ্চার থেকে সার্কিট হাউজের দেয়াল উদ্দেশ্য করে একটা রকেট ছুঁড়ে মারলো লে. কর্ণেল ফজলে হোসেন। দেয়াল ফুঁড়ে তৈরি হলো যাতায়াতের পথ। সেই পথেই এগিয়ে গেলো আক্রমনকারী দলের ১৬ জন সদস্য। আততায়ীর গুলিতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করলেন স্বাধীনতার ঘোষক, রনাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীরউত্তম, সেক্টর কমান্ডার, জেড ফোর্সের প্রধান, আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। 

মাত্র ৪২ বছর বয়সে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে পরিচিতি পাওয়া একটি রাষ্ট্রের দায়িত্বভার আসে জিয়াউর রহমানের কাঁধে। তাঁর মাত্র ৪ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশকে তিনি শূন্য থেকে পূর্ণতার দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে কারণেই বুঝি ৩০শে মে ১৯৮১ বাংলাদেশের ললাটে দুর্ভোগের যে কালো মেঘ ছেয়ে গিয়েছিল তারই ছায়া পড়েছিল প্রকৃতিতে। অঝর ধারায় ঝরেছিল প্রকৃতি সেদিন। বাংলাদেশের ইতিহাসে কারো জানাজায় এত মানুষের সমাগম হয়নি যেমনটি হয়েছিল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জানাজার। কোটি কোটি মানুষের চোখের পানিতে সেদিন চির নিদ্রায় শায়িত হন বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা, আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, আমাদের রাখাল রাজা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। 

অনেকেই রাজনীতির ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর নানান ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। আমি প্রশ্ন করি এই জাতির জীবনে যদি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর না আসতো, তাহলে কী হতো? কী হতো যদি ৩ নভেম্বরের পর থেকে কার্যত কোনো সরকার না থাকা বাংলাদেশ আরো বেশ কিছুদিন সেভাবে চলতো? কোনও বহিঃশত্রুর আক্রমণের হুমকি তৈরি হলে চেইন অব কমান্ড পুরোপুরি ভেঙে পড়া একটা সেনাবাহিনী কী করত তখন? কিংবা সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গ্ৰুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে সেটা দেশকে কোন পরিস্থিতিতে নিয়ে যেত?

১৯৭৫ এর ৪৫ বছর পর এই ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে এই নভেম্বর মাসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি - ভাগ্যিস একজন জিয়াউর রহমান সেদিন এই জাতির ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ১৫ আগস্টের ঘটনার পর বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছিল এবং ধীরে ধীরে সেটা যতটা খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছিল সেটা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকেই ভীষণ বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। সেই বিপদ থেকে এই রাষ্ট্র ৭ নভেম্বর বেরিয়ে এসেছিল এত অসাধারণভাবে যার চাইতে ভালো কিছু আর হতে পারত না।ওই দিনটিতেই সামরিক-বেসামরিক মানুষ ফিরে গেল সেই মানুষটার কাছে যে মানুষটা সাড়ে পাঁচ বছর আগে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়া একটি জাতিকে পথ দেখিয়েছিলেন।

আজকে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর অবাক বিস্ময়ে ভাবি, ২৫ শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ, নিরস্ত্র জনগণের ওপর যখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউন 'অপারেশন সার্চলাইট' এর পর পুরো জাতি হয়ে পড়ে রক্তাক্ত, ভীত, দিকনির্দেশনাহীন, তখন কী হত যদি সেই মানুষগুলোর ত্রাতা রূপে আবির্ভূত না হতেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান? স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গোটা জাতির মনে সেদিন আস্থা সাহস আর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। যখন দেশের বড় বড় মাথাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি তখন সেনাবাহিনীর মেজর পদে দায়িত্ব পালনরত এই মানুষটি তাঁর সাহসে, শক্তিতে, দেশপ্রেমে ধারণ করেছিলেন গোটা বাংলাদেশকে। আর তাই ২৫ মার্চ ১৯৭১ হোক কিংবা ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ হোক বারে বারেই বাংলাদেশের মানুষ তাদের ক্রান্তিকালে ত্রাতার ভূমিকায় দেখেছে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে। 

জিয়ার তুলনা কেবলই জিয়া। বাংলাদেশের মানুষের দুর্ভাগ্য যে মাত্র সাড়ে ৪ বছর দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। এই সাড়ে ৪ বছরে একজন সফল রাষ্ট্রনায়কের মতো (Just like a perfect statesman) বাংলাদেশকে ১০০ বছরের উন্নয়নের পথ দেখিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বহুদলীয় গণতন্ত্র থেকে শুরু করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, কৃষি বিপ্লব, প্রবাসী শ্রমিক কোথায় নেই তাঁর হাতের ছোঁয়া? 

এরপর একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে জিয়া ক্রমাগত ছাড়িয়ে যেতে থাকেন নিজেকে। স্বাধীনতার পর পর সমাজতন্ত্রের নামে সবকিছুকে রাষ্ট্রীয়করনের মধ্য দিয়ে যে অদক্ষতা ও দুর্নীতির অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হয় সেখান থেকে জাতিকে মুক্ত করে আনেন তিনি। আজকে গার্মেন্ট কারখনার মাধ্যমে যে বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনের রমরমা তার সূচনা করেছিলেন জিয়া। একজন রাজনীতিবিদ ভাবেন আগামীর নির্বাচন নিয়ে আর একজন রাষ্ট্রনায়ক চিন্তা করেন আগামী ১০০ বছরে জাতি কোথায় যাবে। নানামুখী কালজয়ী পদক্ষেপ নেয়ার মধ্য দিয়ে জিয়া বারবারই নিজের রাষ্ট্রনায়কত্বের প্রমাণ দিচ্ছিলেন। 

১৯৭৪ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে পুরো রাষ্ট্রের চরিত্র পরিবর্তন করা হয়েছিল। যে গণতন্ত্রের স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল, স্বাধীনতার মাত্র ৪ বছরের মাথায় তা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ে। স্পিরিট অব দ্য কন্সটিটিউশনকে ধ্বংস করে বাকশালের নামে এক দলীয় শাসন কায়েম করা হয়। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিলুপ্ত আওয়ামী লীগ দলটিও জীবন ফিরে পেয়ে যাত্রা শুরু করে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র, সাড়ে ৭ কোটি মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, যে গণতন্ত্র সেটা আবারও তার চিরচেনা রূপ ফিরে পায় তাঁর মাধ্যমেই। আওয়ামী লীগ ভোট ছাড়া ক্ষমতায় আছে আজ সাড়ে ১২ বছর। এই পুরোটা সময় সংসদে তাদের দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও বাকশাল গঠন করবার সাহস তারা আর করেনি।  

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার স্বাদ বাংলাদেশের মানুষকে দিয়েছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। স্বাধীনতার পরপরই সকল সংবাদপত্র বাতিল করে দেশে মাত্র চারটি সংবাদপত্র প্রকাশের অনুমতি দেয়া হয়। এই চাপা, শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মানুষকে মুক্ত করে মানুষের চিন্তা, মত ও বাক প্রকাশের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করেন তিনি। বাকশাল গঠনের পর    শেখ মুজিবর রহমান নিজেই নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে নিম্ন, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ/অপসারনের কর্তৃত্ব নিজের হাতে নিয়ে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের অধীন করে ফেললে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে তার অবসান ঘটান শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের মাটিতে সত্যিকার অর্থেই সেপারেশন অব পাওয়ার নিশ্চিত করেছিলেন তিনি।

এই দেশের এক কোটির বেশি মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থাকে, যার প্রধান অংশটি থাকে মধ্যপ্রাচ্যে। মূলত এই মানুষগুলোর পাঠানো রেমিট্যান্সই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস। মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলে প্রতিবছর শ্রমশক্তিতে যুক্ত হওয়া ২২লক্ষ মানুষ কী করতো, কেউ কি একবারও ভেবে দেখছি? বিদেশে কর্মী এভাবে না যেতে পারলে তার ফলশ্রুতিতে তৈরি হওয়া বেকার সমস্যা এই দেশের সামাজিক অস্থিরতা কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারতো অনুভব করি আমরা? এই দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি পুরোপুরি নির্ভর করে আছে রেমিটেন্স এর ওপরে। কতটা ভবিষ্যতদ্রষ্টা হলে একজন মানুষ আজ থেকে চার দশকেরও বেশি সময় আগে এর গুরুত্ব বুঝতে পারেন এবং কর্মীদের মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো শুরু করেন।

এখনকার বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে সেচ দিতে দিতে আমাদের পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নেমে যাচ্ছে। এটা এক ভয়ংকর পরিস্থিতি। তাই বেশ কিছুদিন থেকে সারফেস ওয়াটার ব্যবহার করা নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। শহীদ জিয়া তাঁর সময়ে এই ভূপরিস্থ পানি ব্যবহারের জন্য খাল কাটা কর্মসূচি সারা দেশে চালু করেছিলেন।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি এই দেশের বিরাট সমস্যা হয়ে উঠতে পারে সেটা জেনেই পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি চালু করেন তিনি। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে খাদ্য মজুদের জন্য বড় বড় গুদাম তৈরি করা হয় তার সময়ে। শিক্ষাকে সব মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, গণশিক্ষা এবং বয়স্ক শিক্ষা চালু করেন তিনি।  রাষ্ট্রের সাথে পল্লীর জনগণের সম্পর্ক তৈরি করার জন্য গ্রাম সরকার, আনসার-ভিডিপি তাঁরই অবদান। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল নাগরিকদের উৎসাহ প্রদান করার কথাও ভুলে যাননি তিনি - চালু করেছিলেন একুশে এবং স্বাধীনতা পদক।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স এর যে মিথ্যে প্রপাগ্যান্ডা চালানো হয়, সেটা আসলেই ছিল তাঁর সময়ে। নিজে ছিলেন যে কোনও রকম দুর্নীতি থেকে একেবারেই মুক্ত শুদ্ধতম মানুষ আর লড়াই করে যাচ্ছিলেন সমাজ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করার।

একথা বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হয় না বর্তমানে যে বাংলাদেশ আমরা দেখছি তার মূল ভিত্তি গড়ে উঠেছিল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার হাত ধরেই। জিয়ার তুলনা কেবলই জিয়া। সততা, দেশপ্রেম,কর্মনিষ্ঠা, কঠিন নিয়মানুবর্তিতা, পরিশ্রম, সৃজনশীল চিন্তা, অসাধারণ প্রশাসনিক দক্ষতা সবকিছুর সমন্বয় একজন মানুষের মধ্যে হওয়াটা প্রায় অসম্ভব। এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছিল তাঁর মধ্য দিয়ে। তিনি নিজেও কি জানতেন, তাঁর হাতে সময় খুব কম? না হলে কেন হাতে পাওয়া প্রতি পল অনুপলকে কাজে লাগিয়ে মাত্র সাড়ে ৪ বছরে দেশকে পাল্টে দিয়েছিলেন তিনি? ক্ষমতার কেন্দ্রে আসার পর থেকেই তিনি দেশ জাতির স্বার্থে এমন সব পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছিলেন যা বহু মানুষের কায়েমি স্বার্থে আঘাত হানতে শুরু করে যার অনিবার্য পরিণতি ৩০ শে মে, ১৯৮১। 


  • লেখক - রুমিন ফারহানা 
  • বিএনপি নেত্রী ও আইনজীবী।