-----------------------------------------
ওয়াসিম ইফতেখার
-----------------------------------------
'নারীরা দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী' — তাঁদেরকে কর্মহীন রেখে দারিদ্র বিমোচন ও সমৃদ্ধি অসম্ভব। নারীর সক্ষমতাকে বিকশিত করার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁদেরকে দেশ বিনির্মাণের হাতিয়ারে পরিণত করার প্রয়োজনীয়তা প্রথম উপলব্দি করে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম। তিনি বিশ্বাস করতেন যে নারীদেরকে উন্নয়ন উৎপাদনে সম্পৃক্ত করাই আধুনিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম শর্ত। আর এইভাবেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব ও ভবিষ্যতমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে শহীদ জিয়া হয়ে ওঠেন ‘আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি’।
ঐতিহাসিকভাবে রক্ষণশীল বাংলাদেশে নারীরা সাধারণত ঘরেই অবস্থান করতেন এবং দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাঁদেরকে সম্পৃক্ত করার কোন উদ্যোগই ছিলনা। নারীদের সচেতন করে তাঁদেরকে ঘর থেকে বের করে পড়ালেখায় ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত করা ছিল অত্যন্ত কঠিন কাজ। সেই কাজটি করেছেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম। সেই লক্ষ্যে তিনি আইন প্রণয়ন ও কর্মসূচি গ্রহণ করেন। আর এভাবেই বাংলাদেশে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম সংস্কারক শহীদ জিয়া।
পরবর্তীতে স্বৈরাচার এরশাদশাহীর আমলে শহীদ জিয়া প্রণীতসব যুগান্তকারী উদ্যোগের মতো নারীউন্নয়নের কর্মসূচিও থেমে যায়। বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১-৯৬ ও ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত সময়কালে জিয়া প্রণীত
নারীউন্নয়ন কর্মসূচিকে বৈপ্লবিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যান।
দেশের উন্নতিতে নারীদের গুরুত্ব তুলে ধরতে শহীদ জিয়ার উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে।
তিনি বলেন —
“দুটি সবল হাত থাকলে একটা কাজ যত সহজে করা যায়, একহাত সে কাজ অসম্ভব হতে পারে। পুরুষ এবং মহিলা সমাজের দুটি হাতের মতন। দেশকে মনের মত গড়তে হলে দু’টি হাতেরই দরকার এবং দুটোকেই সবল হতে হবে।”
সূত্র — দৈনিক দেশ/ জানুয়ারি ৩০, ১৯৮১।
নারীদের চাকুরীর ব্যবস্থা করতে শহীদ জিয়া বিশেষ পদক্ষেপ নেন। যেমন — নারীদের জন্যে সরকারি চাকরিতে শতকরা ১০ ভাগ পদ নির্ধারিত করে নির্দেশ জারি করেন। শিক্ষকতাসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে যতদিন না মহিলাদের কোটা পূরণ হয় ততদিন কেবল মেয়েদেরই নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ জারি করেন। ফলে মেয়েদের কোটা পূরণ হতে বেশি সময় লাগেনি।
১৯৭৮ সালে প্রথম মহিলা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা এবং মহিলা মন্ত্রী নিয়োগ করেন।
প্রথম মহিলা কর্মজীবী হোস্টেল নির্মানের ব্যবস্থা করেন । অনেক কর্মজীবী মহিলারা এতে উপকৃত হয়েছেন এবং চাকরিকালে তাঁদের বাসস্থানের সমস্যা অনেকাংশে দূর হয়।
তিনি নারী সমাজকে স্বনির্ভর করতে চেয়েছিলেন। তিনি বুঝতেন যে মেয়েরা নিজেরা যদি উপার্জনক্ষম হয়, তাহলে সেই পরিবারের সকলের কাছে তাঁর মর্যাদা বেড়ে যাবে এবং নারীদের উপর অযথা হয়রানি ও অত্যাচার কমে যাবে।
তিনি বুঝতেন মেয়েরা শিক্ষিত হলে সেই পরিবারের ছেলেমেয়েরাও শিক্ষিত হবে। মেয়েদের আত্মবিশ্বাস এবং সমাজে মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য তিনি মেয়েদের গ্রামপ্রতিরক্ষা দলেও অন্তর্ভুক্ত করেন। তাঁর সময়েই গ্রামপ্রতিরক্ষা বাহিনীতে ৩৫ লাখ মহিলা সদস্য অন্তর্ভুক্ত হয়।
প্রেসিডেন্ট জিয়া বিশ্বাস করতেন পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীতে নারী অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে তাঁদেরকে এগিয়ে নিতে হবে।
আনসার, পুলিশ বাহিনীতে নারীদের নিয়োগ দেন জিয়া।
তিনি অনুধাবন করেছিলেন ক্রমবর্ধমান অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রনে ও নারীর ক্ষমতায়নে প্রশাসনের মূলধারাতে নারীদের অংশ গ্রহণ সমাজকে এগিয়ে দেবে।
বর্তমানে সেনাবাহিনীতে নারীরা যোগ দিচ্ছেন। শুধু ডাক্তার বা নার্স হিসাবে নয়, সরাসরি যোদ্ধা হিসাবে, গোলন্দাজ বা কমিউনিকেশন ইউনিটে অফিসার হচ্ছেন। এই সিদ্ধান্ত কিন্তু ১৯৮০ সালেই জিয়াই নিয়ে ছিলেন। উনি খুব স্পষ্ট ভাষাতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন — ‘ভবিষ্যৎ সেনাবাহিনীর জন্য মেয়েদের প্রস্তুত হতে হবে।’
প্রতিটি জনসভাতেই তিনি মেয়েদেরকে শিক্ষিত হতে বলতেন। তাঁদেরকে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করতেন যেন তারা স্বাবলম্বী হয়, কোন না কোন কাজ করে যেন তারা সংসারের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে সেইসব পরামর্শ দিতেন।
তাঁর ভাষাতে —
“আপনারা জেগে উঠুন; আপনারা আমাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আপনারা সক্রিয়ভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করুন, আপনাদের স্বামীদেরকেও বাধ্য করুন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বনের জন্য।”
পরিবার পরিকল্পনার কথা এই দেশে এক সময় ভাবাই যেতো না। অথচ জিয়া আগামীর সমস্যা সবাইকে বুঝিয়ে এই দেশে পরিবার পরিকল্পনা প্রকল্প হাতে নেন। মিশরের গ্রান্ড ইমামকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছিলেন দেশে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ কেন নাজায়েজ নয়, তা বিস্তারিত বুঝিয়ে ছিলেন অতি রক্ষণশীলদের।
চট্টগ্রামের মত রক্ষণশীল এলাকাতেও তিনি এমনি ভাবেই কথা বলতেন এবং মেয়েরাও তাঁর কথাতে প্রাণ পেতো, উল্লসিত হতো, তিনি যে মেয়ের মনের কথাগুলিই বলতেন তা বোঝা যেতো মেয়েদের উল্লাস মুখর আর আন্তরিক হাততালির ধ্বনি থেকে।
মহিলাদের মধ্যে আত্মসচেতনতা ও আত্মবিশ্বাস তিনি জাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন পুরুষ ও মহিলা সব্বাইকে দেশের উন্নয়নের কাজে শরিক করতে।
তাঁর কথায় —
“সেই জন্য আমাদের পার্টিতে মহিলা অঙ্গ দল, যুব মহিলা অঙ্গ দল আছে এবং জাতীয়তাবাদের যে চেতনা রয়েছে,আমাদের যে আদর্শ রয়েছে তাতে আমরা সকলকে অন্তর্ভুক্ত করেছি। আমাদের ধর্মও বলে যে কাজের বেলাতে পুরুষ ও মহিলা সব সমান।”
মেয়েদেরকে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনাতে সম্পর্কে সচেতন হতে তিনি সব জনসভাতেই সর্বদা পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলতেন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা একই সূত্রে গাঁথা। পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে স্বাস্থ্য থাকবে না। তাঁর আগে আর কোন নেতা মহিলাদের স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যাপারে কোন সক্রিয় মনোভাব বা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নাই। আত্ম-কর্মসংস্থানমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে অগুনতি মহিলা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে জিয়ার আরো একটি কাজ আমাদের জানা থাকা খুব প্রয়োজন। বাংলাদেশে মেয়েদের ফুটবল খেলাকে আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। তাঁর সময় থেকেই মেয়েদের আন্তঃস্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট চালু হয়।
— লেখক ব্লগার, ইন্টারনেট এক্টিভিস্ট ও গবেষকতথ্য সুত্র ও কৃতজ্ঞতা —
বিচিত্রা, দৈনিক ইত্তেফাক
এস আব্দুল হাকিম, সাবেক মহা পরিচালক, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা