Search

Monday, July 26, 2021

বাংলাদেশে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম সংস্কারক শহিদ জিয়া

 

-----------------------------------------

ওয়াসিম ইফতেখার 

-----------------------------------------



'নারীরা দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী' — তাঁদেরকে কর্মহীন রেখে দারিদ্র বিমোচন ও সমৃদ্ধি অসম্ভব। নারীর সক্ষমতাকে বিকশিত করার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁদেরকে দেশ বিনির্মাণের হাতিয়ারে পরিণত করার প্রয়োজনীয়তা প্রথম উপলব্দি করে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করেন  শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম। তিনি বিশ্বাস করতেন যে নারীদেরকে উন্নয়ন উৎপাদনে সম্পৃক্ত করাই আধুনিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম শর্ত। আর এইভাবেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব ও ভবিষ্যতমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে  শহীদ জিয়া হয়ে ওঠেন ‘আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি’। 

ঐতিহাসিকভাবে রক্ষণশীল বাংলাদেশে নারীরা সাধারণত ঘরেই অবস্থান করতেন এবং দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাঁদেরকে সম্পৃক্ত করার কোন উদ্যোগই ছিলনা। নারীদের সচেতন করে তাঁদেরকে ঘর থেকে বের করে পড়ালেখায় ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত করা ছিল অত্যন্ত কঠিন কাজ। সেই কাজটি করেছেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম। সেই লক্ষ্যে তিনি আইন প্রণয়ন  ও কর্মসূচি গ্রহণ করেন। আর এভাবেই বাংলাদেশে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম সংস্কারক শহীদ জিয়া। 

পরবর্তীতে স্বৈরাচার এরশাদশাহীর আমলে শহীদ জিয়া প্রণীতসব যুগান্তকারী উদ্যোগের মতো নারীউন্নয়নের কর্মসূচিও থেমে যায়। বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১-৯৬ ও ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত সময়কালে জিয়া প্রণীত 

নারীউন্নয়ন কর্মসূচিকে বৈপ্লবিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যান।  

দেশের উন্নতিতে নারীদের গুরুত্ব তুলে ধরতে শহীদ জিয়ার উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে। 

তিনি বলেন  — 

“দুটি সবল হাত থাকলে একটা কাজ যত সহজে করা যায়, একহাত সে কাজ অসম্ভব হতে পারে। পুরুষ এবং মহিলা সমাজের দুটি হাতের মতন। দেশকে মনের মত গড়তে হলে দু’টি হাতেরই দরকার এবং দুটোকেই সবল হতে হবে।” 

সূত্র —  দৈনিক দেশ/ জানুয়ারি ৩০, ১৯৮১। 



নারীদের চাকুরীর ব্যবস্থা করতে শহীদ জিয়া বিশেষ পদক্ষেপ নেন। যেমন —   নারীদের জন্যে সরকারি চাকরিতে শতকরা ১০ ভাগ পদ নির্ধারিত করে নির্দেশ জারি করেন। শিক্ষকতাসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে যতদিন না মহিলাদের কোটা পূরণ হয় ততদিন কেবল মেয়েদেরই নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ জারি করেন। ফলে মেয়েদের কোটা পূরণ হতে বেশি সময় লাগেনি।

১৯৭৮ সালে প্রথম  মহিলা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা এবং মহিলা মন্ত্রী নিয়োগ করেন।

প্রথম মহিলা কর্মজীবী হোস্টেল নির্মানের ব্যবস্থা করেন । অনেক কর্মজীবী মহিলারা এতে উপকৃত হয়েছেন এবং চাকরিকালে তাঁদের বাসস্থানের সমস্যা অনেকাংশে দূর হয়।

তিনি নারী সমাজকে স্বনির্ভর করতে চেয়েছিলেন। তিনি বুঝতেন যে মেয়েরা নিজেরা যদি উপার্জনক্ষম হয়, তাহলে সেই পরিবারের সকলের কাছে তাঁর মর্যাদা বেড়ে যাবে এবং নারীদের উপর অযথা হয়রানি ও অত্যাচার কমে যাবে।

তিনি বুঝতেন মেয়েরা শিক্ষিত হলে সেই পরিবারের ছেলেমেয়েরাও শিক্ষিত হবে। মেয়েদের আত্মবিশ্বাস এবং সমাজে মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য তিনি মেয়েদের গ্রামপ্রতিরক্ষা দলেও অন্তর্ভুক্ত করেন। তাঁর সময়েই গ্রামপ্রতিরক্ষা বাহিনীতে ৩৫ লাখ মহিলা সদস্য অন্তর্ভুক্ত হয়।

প্রেসিডেন্ট জিয়া বিশ্বাস করতেন পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীতে নারী অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে তাঁদেরকে এগিয়ে নিতে হবে।

আনসার, পুলিশ বাহিনীতে নারীদের নিয়োগ দেন জিয়া। 

তিনি অনুধাবন করেছিলেন ক্রমবর্ধমান অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রনে ও নারীর ক্ষমতায়নে প্রশাসনের মূলধারাতে নারীদের অংশ গ্রহণ সমাজকে এগিয়ে দেবে। 

বর্তমানে সেনাবাহিনীতে নারীরা যোগ দিচ্ছেন। শুধু ডাক্তার বা নার্স হিসাবে নয়, সরাসরি যোদ্ধা হিসাবে, গোলন্দাজ বা কমিউনিকেশন ইউনিটে অফিসার হচ্ছেন। এই সিদ্ধান্ত কিন্তু ১৯৮০ সালেই জিয়াই নিয়ে ছিলেন। উনি খুব স্পষ্ট ভাষাতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন —  ‘ভবিষ্যৎ সেনাবাহিনীর জন্য মেয়েদের প্রস্তুত হতে হবে।’ 

প্রতিটি জনসভাতেই তিনি মেয়েদেরকে শিক্ষিত হতে বলতেন। তাঁদেরকে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করতেন যেন তারা স্বাবলম্বী হয়, কোন না কোন কাজ করে যেন তারা সংসারের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে সেইসব পরামর্শ দিতেন।

তাঁর ভাষাতে — 

“আপনারা জেগে উঠুন; আপনারা আমাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আপনারা  সক্রিয়ভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করুন, আপনাদের স্বামীদেরকেও বাধ্য করুন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বনের জন্য।” 

পরিবার পরিকল্পনার কথা এই দেশে এক সময় ভাবাই যেতো না। অথচ জিয়া আগামীর সমস্যা সবাইকে বুঝিয়ে এই দেশে পরিবার পরিকল্পনা প্রকল্প হাতে নেন। মিশরের গ্রান্ড ইমামকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছিলেন দেশে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ কেন নাজায়েজ নয়, তা বিস্তারিত বুঝিয়ে ছিলেন অতি রক্ষণশীলদের।

চট্টগ্রামের মত রক্ষণশীল এলাকাতেও তিনি এমনি ভাবেই কথা বলতেন এবং মেয়েরাও তাঁর কথাতে প্রাণ পেতো, উল্লসিত হতো, তিনি যে মেয়ের মনের কথাগুলিই বলতেন তা বোঝা যেতো মেয়েদের উল্লাস মুখর আর আন্তরিক হাততালির ধ্বনি থেকে।

মহিলাদের মধ্যে আত্মসচেতনতা ও আত্মবিশ্বাস তিনি জাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন পুরুষ ও মহিলা সব্বাইকে দেশের উন্নয়নের কাজে শরিক করতে। 

তাঁর কথায় — 

“সেই জন্য আমাদের পার্টিতে মহিলা অঙ্গ দল, যুব মহিলা অঙ্গ দল আছে এবং জাতীয়তাবাদের যে চেতনা রয়েছে,আমাদের যে আদর্শ রয়েছে তাতে আমরা সকলকে অন্তর্ভুক্ত করেছি। আমাদের ধর্মও বলে যে কাজের বেলাতে পুরুষ ও মহিলা সব সমান।”

মেয়েদেরকে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনাতে সম্পর্কে সচেতন হতে তিনি সব জনসভাতেই সর্বদা পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলতেন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা একই সূত্রে গাঁথা। পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে স্বাস্থ্য থাকবে না। তাঁর আগে আর কোন নেতা মহিলাদের স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যাপারে কোন সক্রিয় মনোভাব বা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নাই। আত্ম-কর্মসংস্থানমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে অগুনতি মহিলা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে জিয়ার আরো একটি কাজ আমাদের জানা থাকা খুব প্রয়োজন। বাংলাদেশে মেয়েদের ফুটবল খেলাকে আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। তাঁর সময় থেকেই মেয়েদের আন্তঃস্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট চালু হয়। 

—  লেখক ব্লগার, ইন্টারনেট এক্টিভিস্ট ও গবেষক   

তথ্য সুত্র ও কৃতজ্ঞতা —  

বিচিত্রা, দৈনিক ইত্তেফাক  

এস আব্দুল হাকিম, সাবেক মহা পরিচালক, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা

Monday, July 19, 2021

করোনা মোকাবিলায় নাগরিক ও রাষ্ট্রের দায়

--------------------------------

শায়রুল কবির খান

--------------------------------



করোনাভাইরাসের এক অদৃশ্য শক্তির মহাসংক্রমণে আজ বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রকেই মহামারীর বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধ-পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। কত দিন এ অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে এমন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে সে বিষয়ে কোনোরকম স্পষ্ট ধারণা করতে পারছেন না কেউই। করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে সৃষ্ট এই কভিড-১৯ মহামারী নিয়ে ইতিমধ্যে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে নানারকম বিতর্ক শুরু হয়েছে। চলছে বাকযুদ্ধ। এর দায় কার? আর কীভাবে হবে এর সমাধান?

বাংলাদেশেও করোনার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়ে দোষারোপের রাজনীতি শুরু হয়েছে। অবশ্য এর একটি যৌক্তিক কারণও আছে। স্বাস্থ্যসেবা খাতে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ। যে রাষ্ট্রটি জিডিপির ৯.০৩ শতাংশ ব্যয় করে জনস্বাস্থ্য খাতে। ৫.৫৫ শতাংশ ব্যয় নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে নেপাল। ভারতের চেয়েও স্বাস্থ্য খাতে শ্রীলঙ্কার ব্যয় বেশি, জিডিপির ৩.৮১ শতাংশ। সেখানে ভারতের ব্যয় ৩.৫৩ শতাংশ। সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা আমাদের বাংলাদেশের। জিডিপির ২.২৭ শতাংশ ব্যয় নিয়ে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাত চলছে। আর পাকিস্তানের ব্যয় এ খাতে জিডিপির ২.৯০ শতাংশ।

আমাদের সরকার বছর বছর লাখ লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করে। মন্ত্রী-এমপিরা গলার আওয়াজ উঁচু করে বলে বেড়ান গত বছর এত লাখ কোটি টাকার বাজেট ছিল। এ বছর আমরা এত লাখ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছি। এই হলো আমাদের উন্নয়ন। বিগত ১৩ বছরে উন্নয়নের আওয়াজ যত পাওয়া গেছে তার বিপরীতে গুণগত পরিবর্তন সামান্যই। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ বর্তমান মহামারীতে নাগরিকরা উপলব্ধি করেছেন। গেল বছর ডেঙ্গু মশার সংক্রমণে চিকিৎসাব্যবস্থার নাজুক ও ভঙ্গুর অবস্থাও দেখেছেন দেশবাসী।

নাগরিকদের যে কটি মৌলিক অধিকার রাষ্ট্রের রক্ষা করার দায়দায়িত্ব এর মধ্যে অন্যতম খাদ্য ও চিকিৎসা। খাদ্যের অভাবে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় আর চিকিৎসাসেবার অভাবে রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে মহামারী দেখা দেয়। করোনাভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসা নিয়ে নানাভাবে দোষ দেওয়া হচ্ছে ডাক্তারদের, নার্সদের। অথচ মূলত এ দায় রাষ্ট্রের অর্থাৎ সরকারের ব্যবস্থাপনার। ২৭ এপ্রিল বিবিসি বাংলার অনলাইন সংস্করণের প্রধান সংবাদ শিরোনাম ছিল ‘সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশে এত বিভ্রান্তি কেন’। তারপরও এখনো সময় আছে, এই সংকট মোকাবিলায় বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর দমনপীড়ন বাদ দিয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার।

রাষ্ট্রের যে সংকটই আসুক না কেন, তা ঘনীভূত হওয়ার আগেই মোকাবিলা করতে সমাধানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক ঐকমত্যের বিকল্প নেই। একটি সংকট জন্ম নেওয়ার পর থেকে সংকট ঘনীভূত হওয়া পর্যন্ত আমাদের দেশের সচেতন নাগরিক সমাজের নেতৃত্ব বেশিরভাগ সময়ই প্রধান দুই দলের মতাদর্শগত সংঘাতে যেন বিভক্ত হয়ে পড়ে।

এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। যা এখন অতীব জরুরি। সরকার আর বিরোধী দলের মতাদর্শিক সংঘাতের মধ্যেও কিন্তু যৌক্তিক কথাটা তুলে ধরতে পারেন নাগরিক সমাজের নেতারা। সামগ্রিক সংকট মোকাবিলায় জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা সবার মনোযোগের কেন্দ্রে থাকার কথা হলেও সেটা দেখা যাচ্ছে না। জনগণের ন্যায্য অধিকারের বিষয়গুলো প্রধান প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর কাছে কতটুকু গুরুত্ব পাচ্ছে? ক্ষমতাসীন দল জাতীয় সংকটের মধ্যেও বিরোধী দলকে দমনপীড়ন ও দোষারোপের চক্রে রেখে ক্ষমতায় টিকে থাকার কৌশলে ব্যস্ত।




ফিরে দেখা যায়, ২০২০ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে করোনা সংক্রমণ প্রকাশ হওয়ার পর থেকে ছুটি-লকডাউন-কঠোর লকডাউন-শাটডাউন-কড়াকড়ি শাটডাউন এসবের মধ্যে দিয়েই দেশ অতিবাহিত হচ্ছে। কিন্তু মহামারী মোকাবিলায় আমরা কতটুকু এগোতে পেরেছি। টিকা সংগ্রহ ও বিতরণ নিয়েও দেখা গেছে নানা বিতর্ক। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি সাফল্যের বিপরীতের ব্যর্থতার অভিযোগও আছে। যেখানে টিকা সংগ্রহ করা দরকার ২৬ কোটি ডোজ সেখানে নিজস্ব ক্রয় ও অনুদান বাবদ প্রায় ২ কোটি ডোজও সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

আর দফায় দফায় লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধ চললেও সেটা যথাযথভাবে কার্যকর করা যাচ্ছে না। লকডাউন হচ্ছে আবার লাখ লাখ মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে, গ্রাম থেকে শহরে আসা-যাওয়ায় বাধ্য হচ্ছে। কে কোথায় কেমন করে যাবে, যাতায়াত ভাড়া কত পড়বে তার কোনোরকম ধারণা ছাড়াই সে পথে নামতে হচ্ছে মানুষকে। বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা, হেঁটে, ট্রাকে গাদাগাদি করে কোনোরকমে বাড়ি পৌঁছাতে গিয়েও মানুষকে গুনতে হচ্ছে পাঁচ থেকে সাত-আটগুণ ভাড়া। এভাবে বারবার জীবিকার তাগিদে গার্মেন্টসকর্মীসহ অন্যান্য পেশার শ্রমজীবী আর নিম্ন আয়ের মানুষদের দফায় দফায় ছুটোছুটি করতে হচ্ছে রাজধানী আর বড় বড় শহর থেকে গ্রামে আর গ্রাম থেকে পুনরায় শহরে। এতে করোনার সংক্রমণও দফায় দফায় ছড়িয়ে পড়ছে।

সে ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতির দায় আসলে কার? সাধারণ মানুষের নাকি সাধারণ নাগরিকদের ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ রাষ্ট্র পরিচালকদের?

আমাদের সমাজে যারা নাগরিক সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা হয় সরকারের অনুগত, তা না হলে রাজনৈতিক দলের লেজুড়ে পরিণত হয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম ব্যবসায়ী সমাজ। সাংবাদিক সমাজ। শিক্ষক সমাজ। চিকিৎসক সমাজ। আইনজীবীসহ প্রায় সব স্তরেই দেখা যাচ্ছে প্রায় একই পরিস্থিতি। নাগরিক সমাজের নেতারা রাষ্ট্রের নেতৃত্বে আসবেন না হয়তো, আসতেও চান না। তারা রাষ্ট্রের অসংলগ্নতাগুলোকে তুলে ধরবেন এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু জাতীয় সংকটের সময়েও তারা যথাযথভাবে ভূমিকা পালন না করায় সাধারণ জনগণ আজ অসহায়।

এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। তবেই সাধারণ নাগরিকরা হয়তো আশার আলো দেখতে পাবেন। সময় খুব দ্রুততার সঙ্গে যাচ্ছে। বিরোধী দলগুলোর কোনো বক্তব্য সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে বলে দৃশ্যমান নয়। আর সরকার নৈতিকভাবে পরাজিত হয়েও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে রাষ্ট্র পরিচালনা করে যাচ্ছে।

মহামারী মোকাবিলা আর লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধ কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকার যদি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে একটা জাতীয় পরামর্শক কমিটি গঠন করে সর্বসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করত তবে তা এই সংকটকালে জাতিকে অনেকটাই ভরসা দিতে পারত।

  • লেখক বিএনপি চেয়ারপার্সন এর মিডিয়া উইং এর সদস্য ও সাংস্কৃতিককর্মী 


Saturday, July 3, 2021

প্রেস সচিব কাফি খানের দৃষ্টিতে শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম

--------------------------------------

সৈয়দ আবদাল আহমেদ 

--------------------------------------

কাফি খান 


আমার চোখে তিনি একজন গ্রেট স্টেটসম্যান। অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব। যাকে মুহূর্তের জন্যও খাটো করে দেখা যায় না। উঁচু দৃষ্টিতেই দেখতে হয়। সততায় তিনি নজিরবিহীন। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সত্ মানুষ। আমার ৮২ বছরের জীবনে এমন সত্ মানুষের সাক্ষাত্ কখনও পাইনি। তাকে নির্দ্বিধায় বলব, Workaholic বা কাজপাগলা একজন মানুষ। বছরের ৩৬৫ দিনই তিনি কাজ করতেন। রাতে চার ঘণ্টার বেশি ঘুমোতেন না। কী করে যে তার ব্যাটারি রিচার্জ হতো, সে রহস্য আজও জানি না। তার সব কাজই অসাধারণ। দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করা এমনি তার একটি অসাধারণ কাজ। হ্যাঁ, আমি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কথা বলছি।

প্রেস সচিব কাফি খান এভাবেই তুলে ধরলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে। ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি জিয়ার প্রেস সচিব ছিলেন তিনি। এই চার বছর তিনি তার সান্নিধ্যে থেকেছেন। তাকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে। দেখেছেন তার কাজ।

অনন্য গুণাবলী

কাফি খান বললেন, জিয়া অসাধারণ একজন মানুষ। এমন একজন মানুষ, যার কাছে গেলে মনে হয়, তিনি খুব কাছের মানুষ। আবার এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, একেবারে কাছে যেতেও ভয় ভয় হয়। মানে তাকে খাটো করে দেখা যায় না। বয়স যতই হোক। ওই সময় তার বয়স আর কতই বা ছিল—৪১ বছর। তার দিকে উঁচু দৃষ্টিতেই তাকাতে হয়। আমার কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি তার যে গুণাবলী আমি দেখেছি, এক কথায় তা অতুলনীয়। তার কাজগুলো এখনও আমার চোখে ভাসে। প্রকৃতই দেশপ্রেমিক একজন মানুষ তিনি। দেশকে ভালোবাসা, দেশের জন্য কাজ করা, স্বজনপ্রীতিকে প্রশ্রয় না দেয়া, মানুষকে আপন করে নেয়া, দিন-রাত কাজ করা, সততার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করা, বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করা, দূরদর্শিতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা—এসব গুণাবলী আমাকে মুগ্ধই করেনি, মনে হয়েছে বাংলাদেশে তার মতো যদি এমন আরও কয়েকজন মানুষ পাওয়া যেত, তাহলে দেশের চেহারাটাই পাল্টে দেয়া যেত।

কাফি খান একজন প্রখ্যাত গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। স্বাধীনতার আগে এবং পরে বহু বছর তিনি ভয়েস অব আমেরিকায় (ভোয়া) কাজ করেছেন, খবর পড়েছেন। দেশের রেডিও-টেলিভিশনেও খবর পড়ার ক্ষেত্রে তিনি পরিচিত মুখ ও কণ্ঠ। সূর্যকন্যা, সীমানা পেরিয়েসহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। বহুমুখী প্রতিভার সুদর্শন এই মানুষটি লেখালেখির সঙ্গেও জড়িত। নিজের একটি অ্যাডভার্টাইজিং ফার্মও গড়ে তুলেছিলেন তিনি। এখন তার অবসর জীবন। পরিবার-পরিজন নিয়ে ওয়াশিংটনে থাকেন। সম্প্রতি বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলেন। আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে তার সাক্ষাত্কার চাইলে তিনি সানন্দে রাজি হন। তার অভিনয় জীবন সম্পর্কে এরই মধ্যে একটি সাক্ষাত্কার আমার দেশ-এ ছাপা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি খুব খুশি হন। বলেন, আমার জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ সময় আমি কাটিয়েছি রাষ্ট্রপতি জিয়ার সঙ্গে। এটাকে এক ধরনের সৌভাগ্যই বলতে পারেন। সেই দিনগুলোর আনন্দিত স্মৃতিচারণ করলেন তিনি।

গুণীর কদর

বললেন, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের একটি মহৎ গুণ ছিল তিনি দেশের ভালো ভালো লোকদের তার পাশে জড়ো করতে পেরেছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অধ্যাপক মুহম্মদ শামসউল হক, ড. এমএন হুদা, সাইফুর রহমান, শাহ আজিজুর রহমান, ড. ফসিহউদ্দিন মাহতাব—এমন অনেক লোকের সমাগম ঘটেছিল তার সরকারে ও দলে। দূরদর্শী চিন্তাভাবনার লোকের খোঁজ পেলেই তাকে তিনি বঙ্গভবনে চায়ের আমন্ত্রণ করেছেন এবং কোনো না কোনোভাবে কাজে লাগিয়েছেন। আমার কথাই ধরুন। হয়তো তিনি রেডিও-টেলিভিশনে খবর পড়া দেখে আমার বিষয়ে চিন্তা করেছেন ওকে দিয়ে আমার প্রেস সচিবের কাজটা হবে।

সেই স্মৃতিচারণ করে কাফি খান বললেন, রাষ্ট্রপতি জিয়ার সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল না। স্বাধীনতার আগে ভয়েস অব আমেরিকায় কাজ করতাম। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রবাসে থেকে আমরাও দেশের পক্ষে কী করা যায় চিন্তা করি। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে হালকা পরিচয় ছিল। সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী হলে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি লিখেছিলাম। তিনি তার উত্তরও পাঠিয়েছিলেন। সেটি এখনও আমার সংরক্ষণে আছে। মরহুম এনায়েত করিম, এসএএমএস কিবরিয়া, আবুল মাল আবদুল মুহিত, ড. জিল্লুর খান, আশরাফউজ্জামান খান, ড. মোহসেন—আমরা মিলে ইস্ট পাকিস্তান লীগ অব আমেরিকা ওয়াশিংটন চ্যাপ্টার নামে সংগঠন গড়ে তুলি। বাংলাদেশের পক্ষে নানাভাবে জনমত গড়ে তোলার কাজ করি। আমি এ সংগঠনের ট্রেজারার ছিলাম। বর্তমান অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব তখন দূতাবাসে চাকরি করতেন। তার বাসায় একটি বা দুটি মিটিং হওয়ার পর তিনি বললেন, আমার বাসায় আর মিটিং করা যাবে না —

অসুবিধা আছে। পরে আমার ছোট বাসাতেই মিটিং হয়। বাংলাদেশের মনোগ্রাম লাগিয়ে আমি ভয়েস অব আমেরিকার অফিসে যেতাম। এ নিয়ে আমাকে অনেক বিড়ম্বনা সইতে হয়েছে। যাই হোক, সীমিত পর্যায়ে এভাবেই তখন আমরা আমেরিকায় বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে দেশে চলে আসি।


কাফি খান

দেশে এসে রেডিও-টেলিভিশনে সংবাদ পাঠ করি। নিজের একটি ছোট্ট ব্যবসা শুরু করি—ইন্টারস্প্যান অ্যাডভার্টাইজিং ফার্ম। এভাবে কেটে যায় কয়েকটি বছর। ১৯৭৭ সাল। রাষ্ট্রপতি জিয়া তখন ক্ষমতায়। হঠাত্ একদিন বঙ্গভবন থেকে একটি ফোন পাই। রাষ্ট্রপতির এপিএস ফজলুর রহমান ফোন করে জানান, জিয়াউর রহমান সাহেব আমার সঙ্গে কফি খেতে চান। আমি বললাম, আমার সঙ্গে তো উনার কোনো পরিচয় নেই। ফজলুর রহমান বললেন—আমি তো স্যার কিছু জানি না, আপনি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাত্ করুন, কবে পারবেন? সেটা আমি বললে তো হবে না, রাষ্ট্রপতির সিডিউল অনুযায়ীই হতে হবে। দু’দিন পর বেলা ১১টায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সময় নির্ধারিত হলো। আমি বঙ্গভবনে গেলাম। এডিসি আমাকে নিয়ে রাষ্ট্রপতির কামরায় ঢুকতেই জেনারেল জিয়া চেয়ার থেকে উঠে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে আমাকে রিসিভ করলেন। পাশের সোফায় নিয়ে গিয়ে বসালেন। বললেন—কি খাবেন চা না কফি। বললাম, একটি হলেই চলবে। কফি এলো। কী জন্য ডেকেছেন কিছুই বললেন না। শুধু কি করছেন, আমেরিকা থেকে কবে এসেছেন, ছেলেমেয়ে ও পারিবারিক অবস্থা এবং ভয়েস অব আমেরিকার চাকরির কথা জানতে চাইলেন। বললেন, একাত্তরে আপনারা তো আমেরিকায় বাংলাদেশের পক্ষে অনেক কাজ করেছেন? আমি বললাম, সীমিত পর্যায়ে করেছি। আমেরিকান সরকারের চাকরি করতাম। পাকিস্তানের সঙ্গে তখন আমেরিকার সুসম্পর্ক ছিল। তারপরও যতটুকু পেরেছি, আমরা করেছি। জিয়া বললেন—হ্যাঁ, আমি সব শুনেছি। এরপরই বললেন, দেশের জন্য এখন তো আপনাদের মতো লোকদের কিছু করা দরকার। আমি বললাম, আপনারা তো দেশের কাজ করছেনই। তারপরও দেশের প্রয়োজনে যখন যা প্রয়োজন, অবশ্যই করব।

এভাবেই শেষ হলো সাক্ষাত্। কেন ডেকেছেন কিছুই বুঝতে পারলাম না। সালাম দিয়ে বঙ্গভবন ত্যাগ করি। এর প্রায় দু’মাস পর শামসুল হুদা চৌধুরী আমাকে ডাকলেন। গেলাম তার কাছে। ১৯৫১ সাল থেকেই তাকে চিনি। তাকে হুদা ভাই বলে ডাকতাম। দেখা হতেই হুদা ভাই হেসে হেসে বললেন—রাষ্ট্রপতি সাহেব তোকে তার প্রেস সচিব বানাইতে চায়। আমি বললাম—প্রেস সচিবের জন্য তো দরখাস্ত করিনি। তিনি বললেন, না রাষ্ট্রপতি সাহেবের প্রেস সচিব দরকার। যাই হোক, দু’দফায় এ নিয়ে আলাপ আলোচনার পর জয়েন্ট সেক্রেটারি স্ট্যাটাসে ৩ হাজার টাকা বেতনে প্রেস সচিব হতে রাজি হলাম। তখন সচিবদের বেতন ছিল তিন হাজার টাকা। আমাকে বেতন হিসেবে আড়াই হাজার টাকা এবং অন্যান্য এলাউন্স বাবত পাঁচশ টাকা দেয়া হলো। আর একটি বাড়ি ও একটি গাড়ির সুবিধা।

অমায়িক ভদ্রলোক

সব ঠিক হওয়ার পর ১৯৭৭ সালের ১২ কিংবা ১৩ নভেম্বর হবে, বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যাই। সালাম দিয়ে দেখা হতেই বুলেটের মতো প্রশ্ন—কবে জয়েন করছেন? স্যার, কবে মানে? তিনি বললেন, না আমার অত সময় নেই। আমি বললাম, ছোটখাটো একটি ব্যবসা আছে। সেটি গুছিয়ে আসতে কয়েকটা দিন লাগবে। বললেন, না অতো সময় নেই। ১ ডিসেম্বর থেকে জয়েন করুন। আমি আজই বলে দিচ্ছি, নোটিফিকেশন হয়ে যাবে। এভাবেই ১৯৭৭ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে প্রেস সচিব হিসেবে যোগ দিই। কাছাকাছি গিয়ে ভদ্রলোক মানুষটাকে দেখলাম—একজন অমায়িক মানুষ। তার ব্যবহার, তার কাজ কোনো কিছুরই তুলনা হয় না। আমি প্রেস সচিবের চাকরিতে যোগ দেয়ার পরপরই একটি বিদেশ সফর এলো। ঢাকা-কাঠমান্ডু, কাঠমান্ডু-দিল্লি, তারপর ঢাকায় এসে আবার পাকিস্তান। ওই সফরে গেলাম। প্রচণ্ড জ্বরে পড়ে গেলাম। রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত চিকিত্সক ডা. নওয়াব আলী জ্বর কমার ট্যাবলেট দিলেন। কাঠমান্ডুতে কোনোভাবে কাটিয়ে দিল্লি গেলাম। জ্বর আরও বেড়ে গেল। ফলে আজমীর শরীফে যেতে পারলাম না, অশোকা হোটেলেই রয়ে গেলাম। দিল্লি সফর শেষ করে ঢাকায় ফিরছি এফ-২৭ ফকার বিমানে করে। রাষ্ট্রপতি যে আসনে বসেছেন, তার থেকে কয়েকটি আসন পরেই আমি বসেছি। কোনাকুনিভাবে রাষ্ট্রপতি আমাকে দেখতে পান। আমার সিটের পাশে একটি সিট খালি। আমি জড়োসড়ো হয়ে বসে আছি। বিমানের পার্সার এসে জুস খেতে দিলেন। আমি জুস খাচ্ছি। এ সময় রাষ্ট্রপতি জিয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—‘কী প্রেস সেক্রেটারি সাহেব, আরও স্ট্রং কিছু খান।’ এভাবে তিনি হিউমারও করতেন।

দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা

বাংলাদেশের প্রতি রাষ্ট্রপতি জিয়ার ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা। এই দেশকে কীভাবে স্বনির্ভর করবেন, এটা ছিল তার সব সময়ের স্বপ্ন। জিয়া সব সময় বাংলাদেশের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান, আহরণ এবং তা দিয়ে দেশের চাহিদা পূরণের উপর জোর দিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, আমাদের গ্যাস যখন আছে, তখন তেলও পাওয়া যাবে অবশ্যই—শুধু খুঁজে বের করার অপেক্ষা। বড়পুকুরিয়ার কয়লা ও মধ্যপাড়ার কঠিন শিলা তার সময়েই আবিষ্কৃত হয়। তিনি বলতেন, আমাদের বাংলাদেশের অনেক সমস্যা আছে। একে স্বনির্ভর করতে হবে। স্বনির্ভর হতে হলে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হবে। ফসল ফলাতে হবে। কৃষকদের সেচের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সেচের জন্য খাল খনন করতে হবে। দেশজুড়ে তার খাল খনন কর্মসূচি বাংলাদেশকে স্বনির্ভর করার জন্যই তিনি নিয়েছিলেন। তার হাজামজা নদী, খাল ও জলাশয়গুলোর সংস্কারের কাজে স্বেচ্ছাসেবী তরুণ সমাজ সোত্সাহে এগিয়ে এসেছিল। আরও বহু লোক এসেছিল জিয়ার ‘খাদ্যের বিনিময়ে কাজ’ কর্মসূচি অনুযায়ী। খরার সময় সেচের জন্য যথেষ্ট পানি ধরে রাখা আর বর্ষায় বন্যার পানি দ্রুত নেমে যাওয়ার পথ করে দেয়া ছিল খাল খনন কর্মসূচির উদ্দেশ্য। এ কর্মসূচিতে দেশজোড়া অবর্ণনীয় উত্সাহ দেখা দিয়েছিল। জেলায় জেলায় প্রকল্প তৈরি করে ওই প্রকল্প জিয়া নিজে উদ্বোধন করতেন। কোদাল হাতে প্রথম ঝুড়ি মাটি কাটতেন জিয়া নিজে। এভাবেই তিনি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন।

চষে বেড়িয়েছেন সারাদেশ


তিনি সারাদেশ চষে বেড়িয়েছেন। আজ চট্টগ্রাম তো কাল সিলেট। দুর্গম এলাকাগুলোতে হেলিকপ্টারে করে গেছেন। ঢাকার বাইরে প্রতি মাসে আট দশ দিন কাটাতে হতো। বিভিন্ন জায়গায় মাইলের পর মাইল হাঁটতে হতো। এমনকি একটানা চার-পাঁচ মাইল পর্যন্ত হাঁটতে হতো। রোজার দিনেও পায়ে হেঁটে বিভিন্ন এলাকায় যেতে হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে আমাদের জিভ বেরিয়ে গেছে। কিন্তু ওই লোকটার কোনো ক্লান্তি নেই। তার ব্যক্তিগত চিকিত্সক ছিলেন ডা. মাহতাবউল ইসলাম। তিনি ডিহাইড্রেশন থেকে বাঁচাতে আমাদের লেবু দিয়ে লবণ পানি খাইয়েছেন। কিন্তু জিয়াউর রহমানের ডিহাইড্রেশনের বালাই নেই। তাকেও ডা. মাহতাবউল ইসলাম ওই শরবত খেতে পরামর্শ দিতেন। কিন্তু তিনি বলতেন, ওইসব আমার লাগবে না। তার সঙ্গে হাঁটতে গিয়ে আমরা ঘামতে ঘামতে হয়রান হয়ে গেছি। সমান তালে হাঁটতে না পেরে অনেক পেছনে পড়ে যেতাম। দেখা গেছে, অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাওয়ার পর আমরা সেখানে পৌঁছেছি। তিনি বলতেন, কি ব্যাপার, আপনাদের আসতে এতো দেরি কেন? আমি বলতাম, স্যার, আপনার তো লেফট-রাইট করার অভ্যাস। আমাদের তো একটু দেরি হবেই। তিনি মুচকি হাসতেন।

মানুষের কাছাকাছি

বিরামহীন গণসংযোগে তিনি মানুষের একেবারে কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের কাছে তার ছিল ‘রাজার’ আসন। সাধারণ মানুষ তাকে ‘রাজাই’ বলত। একটা ঘটনা শুনুন। ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় খুলনা থেকে জগন্নাথগঞ্জঘাট এলাকায় আমরা ট্রেনে গণসংযোগে বেরিয়েছি। মাঝে মধ্যে পথসভা-জনসভা হচ্ছে। এমনি একদিন বিকালে একটি স্টেশনের কাছে জনসভা শেষ করে ট্রেনে উঠছি। এ সময় গায়ে ফতুয়া ও লুঙ্গি পরা একজন বৃদ্ধ এসে বললেন, মিটিং তো শেষ—‘রাজারে দেখবার পায়াম না’ অর্থাত্ তারা তাকে রাজাই মনে করতেন। যদিও জিয়াউর রহমান এ শব্দগুলো পছন্দ করতেন না।

স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে

কাফি খান বললেন, স্বজনপ্রীতি শব্দটা রাষ্ট্রপতি জিয়ার অভিধানে ছিল না। দুর্নীতি সংক্রান্ত কোনো কাজকে তিনি কখনও প্রশ্রয় দেননি। রাষ্ট্রপতির মতো এত বড় একটি পদে থেকেও তিনি অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তার কৃচ্ছ্রতা সাধন করার দৃষ্টান্ত বিরল। নিজের পরিবারের জন্য তিনি কিছুই করেননি। নিজের জন্য তো করেনইনি। আত্মীয়স্বজনদের কেউ কোনো তদবিরের জন্য বঙ্গভবনে বা তার বাসভবনে সাক্ষাত্ করতে আসবেন, সেটা ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। তেমন সাহস কারও ছিল না। অসত্ কাউকে তিনি তার কাছে ঘেঁষতে দিতেন না। প্রেস সচিব হিসেবে বঙ্গভবনে আমার অফিস থাকলেও মাঝে মধ্যে আমাকে কাজের স্বার্থে রাষ্ট্রপতির বাসভবনেও অফিস করতে হতো। সেখানে তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে একদিনের জন্যও আমি দেখিনি। তিনি ছিলেন একেবারেই অন্তপুরবাসিনী। অফিসের ধারেকাছেও আসতে পারতেন না। তিনিও আসতেন না। তাকে একমাত্র দেখা যেত রাষ্ট্রপতি জিয়া কোনো রাষ্ট্রীয় সফরে বিদেশে গেলে সেখানে তার সফরসঙ্গী হিসেবে। তাও সব সফরে নয়। যেসব রাষ্ট্রীয় সফরে প্রটোকলের প্রয়োজনে যেতে হতো, সেগুলোতেই। এছাড়া কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান বাংলাদেশে সফরে এলে রাষ্ট্রীয় ভোজে বেগম জিয়া অংশ নিতেন। সেটাও প্রটোকলের স্বার্থে। আর দুই ঈদে নামাজ পড়ার পর বঙ্গভবনের রেওয়াজ অনুযায়ী অতিথিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য তাকে আসতে হতো।

অতুলনীয় সততা

জিয়ার সততার তো তুলনাই হয় না। তিনি যে বেতন পেতেন, তা আর কত? তিন চার হাজার টাকার মতো। আমি নিজে তার বেতনের কাগজ দেখেছি। সেখান থেকে ১৫০ টাকা রাষ্ট্রপতির রিলিফ ফান্ডে জমা দিতেন। বাকি টাকাটা দিয়ে সংসার চালাতেন। জিয়া খুব পরিমিত খাবার খেতেন। তার বাড়ির হাঁড়িতে অতি সাধারণ খাবার হতো। একটা তরকারি, একটা ডাল, একটা সবজি। মন্ত্রীদের দেখেছি তার বাসায় খেতে বললে রাজি হতো না। কারণ এতটুকু খেয়ে তো তাদের পোষাবে না। রাষ্ট্রপতি জিয়া বলতেন, এর বেশি তো এফোর্ট করতে পারি না। ঢাকার বাইরে গেলে ডিসিরা খাবারের আয়োজন করত। সেখানেও কড়া নির্দেশ ছিল—একটা ভাজি, একটা ডাল, একটা মাছ বা মাংস। এর বেশি খাবার করা যাবে না।

জিয়া মিষ্টি খুব পছন্দ করতেন। খাবারে মিষ্টি থাকলে খুশি হতেন। না থাকলে আপত্তি করতেন না। তার সততার আরেকটি দৃষ্টান্ত শুনুন। তার ছেলে আরাফাত রহমান কোকো ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে পড়ত। ওই স্কুলের প্রিন্সিপাল আমার পরিচিত। তার কাছে শুনেছি, কোকো তার কাছে পড়তে আসত। তার পায়ে ছিল ছেঁড়া জুতো। একদিন প্রিন্সিপাল কোকোকে বললেন, ওই ছেঁড়া জুতো বদলাচ্ছো না কেন? কোকোর উত্তর—বাবাকে বলেছিলাম, তিনি বলেছেন কয়েকদিন পরে কিনে দেবেন। একজন রাষ্ট্রপতি তার ছেলের এক জোড়া জুতো কিনতেও হিমশিম খাচ্ছেন। একটা পুরনো হাতঘড়ি ছিল তার। ঘড়িটি খুব দামিও ছিল না। অনেকে বলত, ওটা স্যার অনেক পুরনো হয়ে গেছে। ওটা বাদ দিয়ে একটা ভালো ঘড়ি কিনুন। কারণ ওটা আর আপনার হাতে মানায় না। জিয়া শুনে শুধু মুচকি হাসতেন। একবার এক জনসভায় ভাষণ দিতে যাবার পথে দর্শকদের ভিড় ঠেলে তাদের সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে এগুনোর সময় অথবা জনসভায় ভাষণ দিয়ে ফেরার পথেও হতে পারে—ঠিক মনে নেই আমার, ঘড়িটা জিয়ার হাত থেকে খুলে পড়ে যায় অথবা খোয়া যায়। সে জন্য তার যে কি আফসোস—ঘড়িটার শোক তিনি অনেক দিন ভুলতে পারেননি।

দুর্নীতি প্রশ্রয় দিতেন না

কাফি খান বললেন, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সফরকালে প্রাপ্ত সব উপঢৌকন বা উপহার সামগ্রী তিনি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বলে গণ্য করতেন। সেসব তিনি বঙ্গভবনে তোষাখানায় পাঠিয়ে দিতেন। এমনকি তার সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া যে অল্প কয়েকবার তার সফরসঙ্গী হন, তিনিও যেসব উপহার সামগ্রী পেয়েছেন, তা ব্যবহার করতে পারেননি। তোষাখানায় জমা দিতে হয়েছে। এই লোকটাকে সত্ বলব না তো কাকে বলব? দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেয়ার আরেকটি উদাহরণ আপনাকে দিই। রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা টিমে ছিলেন কর্নেল আনিস নামে একজন কর্মকর্তা। রাষ্ট্রপতি বিদেশে গেলে কর্নেল আনিস বিদেশ থেকে ইলেকট্রনিক পণ্য নিয়ে আসত। রাষ্ট্রপতির টিমে থাকার কারণে এগুলো বিমানবন্দরে চেকিং হতো না। ফলে ডিউটিও দিতে হতো না। কর্নেল আনিস এগুলো বাইরে বিক্রি করত। এই অভিযোগ রাষ্ট্রপতি জিয়ার কানে গেলে তিনি বিদেশ থেকে আসার সময় তার টিমের সব সদস্যের ল্যাগেজ চেকিং করার নির্দেশ দিলেন। চেকিংয়ের পর কর্নেল আনিসের ল্যাগেজে চোরাই ইলেকট্রনিক পণ্য পাওয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলো।

গ্রেট স্টেটসম্যান



জিয়াউর রহমান সত্যিই একজন গ্রেট স্টেটসম্যান। বিদেশে তিনি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। বিদেশে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে তিনি ইক্যুয়াল লেভেলে কথা বলতে পারতেন। আমি দেখেছি। যুগোস্লাভিয়া তখন ভাগ হয়নি। যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রপতি মার্শাল টিটোর তখন দুর্দান্ত প্রতাপ। টিটোর সঙ্গে জিয়া এমনভাবে কথা বলছেন—মনেই হয়নি তৃতীয় বিশ্বের একজন নেতা মার্শাল টিটোর মতো একজন স্টেটসম্যানের সঙ্গে সমানতালে বৈঠক করছেন। জিয়া ধূমপান করতেন না। মার্শাল টিটো ঘন ঘন ধূমপান করতেন। টিটো জিয়াকে সিগারেট এগিয়ে দিলে তিনি তা নিয়েছেন, এবং দু’টান দিয়েছেন। কিউবার রাষ্ট্রপতি ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গেও তাকে এভাবে ইক্যুয়াল লেভেলে বৈঠক করতে দেখেছি। নর্থ কোরিয়ার ৩০তম স্বাধীনতাবার্ষিকীতে জিয়াকে প্রধান অতিথি হিসেবে দাওয়াত করা হয়েছে। ওই অনুষ্ঠানে অনেক দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান উপস্থিত ছিলেন। ইরান-ইরাক যুদ্ধে তিনি মধ্যস্থতা করেছেন। তার ওপর দুই দেশের জনগণ এবং সরকারেরই গভীর আস্থা ছিল। যুদ্ধ বন্ধে তিনিও সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন। আমি শুনেছি, তার শাহাদাতের পর ইরাকের লোকজন বলেছেন, আমাদের যুদ্ধটা মনে হয় থেমে যেত, জিয়ার মৃত্যুতে এখন এটা অনিশ্চিত।

ভিশনারি রাষ্ট্রনায়ক

রাষ্ট্রপতি জিয়াকে একজন ভিশনারি রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে উল্লেখ করে কাফি খান বলেন, আমি কাছে থেকে তার এই দূরদর্শিতা লক্ষ্য করেছি। দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরাম— সার্ক, তারই ভিশন। যদিও এই সার্কের জন্মটা তিনি দেখে যেতে পারেননি। তিনি বেঁচে থাকলে সার্ক আরও শক্তিশালী ফোরাম হিসেবে গড়ে উঠত। বাংলাদেশের ইমেজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া জিয়ার আরেক ভিশন। তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ তিনি ঘুচিয়ে দিয়ে গেছেন। তাকে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা সমীহ করতেন। জিয়ার ছিল আলাদা একটা ক্যারিশমা। মরহুম শেখ মুজিবেরও ক্যারিশমা ছিল। মজার কথা হলো শেখ সাহেব সম্পর্কে কোনো দিন কোন নেতিবাচক মন্তব্য বা তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করার মতো কোনো উক্তি জিয়ার মুখ থেকে আমি শুনিনি। আজকাল যদিও উল্টোটা দেখি। জিয়াউর রহমানের নামটা মুছে দিলেই যেন তাকে ইতিহাস থেকে মুছে দেয়া যাবে। কিন্তু তার আসন তো মানুষের হৃদয়ে।

বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন



আমি আগেই বলেছি, তার সব কাজই অসাধারণ। তার অসাধারণ কাজই হলো দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করা। দেশে বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর একদলীয় শাসন চলছিল। ওই মিলিটারি লোকটাই তো গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনলেন। জিয়াকে বলা হয় তিনি নাকি ষড়যন্ত্র করেছেন। তিনি কখন ষড়যন্ত্র করলেন? ষড়যন্ত্র তো করেছেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। তিনি তো অন্তরীণ ছিলেন। অন্তরীণ অবস্থা থেকে তাকে বের করে এনে ক্ষমতায় বসানো হয়। তার বড় এচিভমেন্ট তিনি দেশকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে গেছেন, সঠিক রাস্তায় নিয়ে গেছেন। লাইনচ্যুত গাড়িটাকে লাইনে তুলেছেন। মিলিটারি লোক হলেও তার মুখেই আমরা শুনেছি। তিনি বলছেন, সামরিক শাসন কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না।

বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ


বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ জিয়াউর রহমানের আরেকটি ভিশন। অনেক বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কথা শুনলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। জিয়া বলতেন—আমরা বাঙালি তো বটেই, যেহেতু বাংলাদেশ হয়ে গেছে, সেখানে তো আমাকে দেশের পরিচয় দিতে হবে। সেটাই তো বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। আমরা বাংলাদেশ করেছি, বাংলাদেশী পরিচয় দিতে অসুবিধা কোথায়? ওই বুদ্ধিজীবীদের কথা অনুযায়ী বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বা বাংলাদেশী পরিচয় দিলে যেন বাঙালিত্ব খারিজ হয়ে যায়। আসলে বেশি বাঙালি হতে গিয়ে বাংলাদেশী পরিচয়কে আমরা গৌণ করে ফেলছি। জিয়া ছিলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের চেতনায় বিশ্বাসী একজন খাঁটি নির্ভেজাল দেশপ্রেমিক। তার প্রিয় একটা গান ছিল—প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, যেটা পরবর্তীকালে তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপি তাদের দলীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করে। ক’দিন আগে দেখলাম, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সমাবেশে এই দেশের সংস্কৃতির বিকাশে অবদান রাখার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিন দশকেরও বেশি কাল আগে রাষ্ট্রপতি জিয়া শুধু যে সেটা ভেবেছিলেন তাই নয়, তার বাস্তব রূপও দিয়েছিলেন। এসবেরই নিদর্শন শিশুদের প্রতিভা বিকাশের জন্য টেলিভিশনে নতুন কুঁড়ি অনুষ্ঠানের আয়োজন, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী প্রতিষ্ঠা, জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রবর্তন, জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার প্রবর্তন, স্বাধীনতা ও একুশে পদক প্রবর্তন এবং জিয়ার নির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় চালু হয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও সুস্থধারার ছবি নির্মাণ। উত্সাহিত করার জন্য চালু হয় অনুদান প্রথা।

বিএনপি প্রতিষ্ঠা

আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে তিনি বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মনে করতেন, বিকল্প দল না হলে গণতন্ত্র স্থায়ী হবে না। বিএনপিকে ক্যান্টনমেন্টের দল বলা হয়। ক্যান্টনমেন্টেই বলেন আর যাই বলেন, বিএনপি একটি বিশাল রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে, এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। এরশাদ তো ৯ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তিনিও তো দল করেছেন। তার দল তো এতো বিশাল হতে পারেনি। আজ এ কথা বলতে দ্বিধা নেই জিয়ার সাড়ে তিন বছরের রাজনীতিই আওয়ামী লীগের ৫০ বছরের রাজনীতিকে মোকাবেলা করছে।

দৈনন্দিন কর্মসূচি

রাষ্ট্রপতি জিয়ার দৈনন্দিন কর্মসূচি কেমন ছিল—জানতে চেয়েছিলাম। কাফি খান বলেন, রাষ্ট্রপতির দিনের কাজ শুরু হতো সকাল সাতটায়। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দু’টা হয়ে যেত। কিন্তু ভোরে ওঠে নামাজ পড়েই অফিসের জন্য তৈরি হতেন। তার দৈনন্দিন কর্মসূচি বা নির্ঘণ্ট তৈরি করতেন মিলিটারি সেক্রেটারি। সকাল ৭টার মধ্যেই তিনি অফিসে চলে আসতেন। আমি অফিসে আসতাম সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে। একটানা কাজ। দুপুরে তিনি খাওয়া ও নামাজ পড়ার জন্য এক ঘণ্টার বিরতি নিতেন। মাগরেবের নামাজের পর বিভিন্ন পেশা ও স্তরের লোকজনের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি কথা বলতেন। রাজনীতির সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা ছিল না। ফলে ওইসব বৈঠকে আমি থাকতাম না। তবে সমাজের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে মতবিনিময়ে দেশের কল্যাণের বিষয়টিই সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে। দু’টায় বাসায় ফিরলেও খুব ভোরেই তিনি ঘুম থেকে উঠে যেতেন। ফজরের নামাজ পড়ে নাস্তা সেরে অফিসের জন্য তৈরি হতেন। চার ঘণ্টার বেশি ঘুমোতেন না। কী করে যে তার ব্যাটারি রিচার্জ হতো, সে রহস্য আজও জানি না। বঙ্গভবনে ব্যক্তিগত স্টাফ কিংবা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাকে কখনও কোনো খারাপ ব্যবহার করতে দেখিনি। গাফিলতি দেখলে কিছুটা উত্তেজিত হতেন। 

 

  •  লেখক সাংবাদিক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক 


আপনার মত প্রকাশ ফ্যাসিবাদকে যেন শক্তিশালী না করে

--------------------------------------

ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা 

--------------------------------------


বাংলাদেশে নির্বাচন বলে যে একটা বস্তু, তা বহু বছর হল নাই। জাতীয় থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত যে কোনো নির্বাচন মানেই সরকারি দলের এক তরফা জয়। অনেকেই বলতে পারেন, বিএনপি নির্বাচনের মাঠে থাকে না, তাদের এজেন্টরা ভোটকেন্দ্রে যায় না, ক্যাডার দিয়ে কেন্দ্র পাহারা দেয় না আর তাই আওয়ামী লীগ একচেটিয়া নির্বাচনের দখল নেয়। গণতন্ত্রের স্বপ্ন নিয়ে শুরু হওয়া স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরে দাঁড়িয়ে এই ধরণের কথা শুধু বিস্মিতই না, দুঃখিতও করে। এখনও যদি পেশীশক্তি আর পাহারা দিয়ে কেন্দ্র দখলে রাখতে হয়, ক্যাডার দিয়ে প্রতিপক্ষের মাথা ফাটিয়ে মাঠের দখল নিতে হয়, তাহলে কী ধরণের নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হল দেশে? এমনকি পাকিস্তান আমলেও তো নির্বাচন মানে মল্লযুদ্ধ ছিল না। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই রাজনীতিতে শক্তির প্রয়োগ প্রচলিত এবং বহু পুরানো তাহলেও একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। একটি রাজনৈতিক দল তার প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে মোকাবেলা করতে পারে; কিন্তু তাকে যদি বছরের পর বছর পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র মোকাবেলা করতে হয় তখন বিষয়টা কেমন দাঁড়ায়? বাংলাদেশে গত এক যুগের বেশি সময় বিএনপিকে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হচ্ছে।      

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দ্য ইলেক্টোরাল ইন্টিগ্রিটি প্রজেক্ট ২০১৯’ তার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেখানে নির্বাচনের মানের বিবেচনায় বাংলাদেশের স্কোর ৩৮,যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। সারা পৃথিবীতেই বাংলাদেশের চাইতে খারাপ নির্বাচন হয় মাত্র ২১ টি দেশে।  এই স্টাডিতে বাংলাদেশের শুধু ২০১৪ সালের নির্বাচনকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। ২০১৮ সালের তথাকথিত নির্বাচন বিবেচনায় নেয়া হলে বাংলাদেশ সম্ভবত থাকতো বিশ্বের সর্বশেষ অবস্থানে। বলে রাখি, ফ্রিডম হাউজের সর্বশেষ রিপোর্টে ইলেক্টোরাল ডেমোক্রেসির তালিকায় বাংলাদেশ আর নেই, যার অর্থ হচ্ছে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার লেশমাত্র নেই বাংলাদেশে।

বিশ্বের নতুন পাঁচ স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ


ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এর মতে বাংলাদেশে এখন হাইব্রিড রেজিম, ফ্রিডম হাইজের মতে আংশিক মুক্ত, কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশ আসলে একটি স্বৈরতান্ত্রিক দেশ যা ২০১৮ সালেই জার্মান গবেষণা সংস্থা বেরটেলসম্যান স্টিফস্টুং পরিষ্কার ভাষায় ব্যক্ত করেছে।

২০২০ সালে প্রকাশিত এই সংস্থার দেশভিত্তিক বেরটেলসম্যান ট্রান্সফরমেশন ইন্ডেক্স (বিটিআই) এ বিএনপি সরকারের শেষ বছর, ২০০৬ সাল থেকে ২০২০ এর মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন সূচকের তুলনা করলে দেখা যায় নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার সম্পর্কিত ২০ টি সূচকেই বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমাগত নিম্নমুখী।

বাংলাদেশের স্বৈরতান্ত্রিকতার স্বীকৃতি এখন আসছে নানাদিক থেকে। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে দেয়া এক যৌথ বিবৃতিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সহ ৭ টি মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানানো হয়। কিছুদিন আগে আবারও একই ধরণের অভিযোগ তুলে জাতিসঙ্ঘসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতি পদক্ষেপ নেবার আহ্বান জানিয়েছে ১০ টি মানবাধিকার সংস্থা। 

একটি দেশে যখন কর্তৃত্ববাদী, স্বৈরতান্ত্রিক সরকার থাকে তখন তার অবশ্যম্ভাবী ফল স্বরূপ সেখানে মানবাধিকার, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমশই সংকুচিত হতে থাকে। ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়, ভিন্নমত রুদ্ধ হতে থাকে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এখানে মানুষ এখন লিখতে ভয় পায়, বলতে ভয় পায়, স্বাধীনভাবে নিজের মত প্রকাশ করতে ভয় পায়, হয়তোবা চিন্তা করতেও ভয় পায়। 

এটা এমন এক সময় যখন বুদ্ধিজীবীরাও সত্য সঠিক কথা বলতে দ্বিধাবিভক্ত হন। যাদের জাতিকে পথ দেখানোর কথা তারা ক্ষুদ্র স্বার্থ আর হিসাব নিকেশ কিংবা স্রেফ ভয়ে সরকারের সুরে কথা বলে অথবা চুপ থাকে। এমিরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ‘দেশের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী সুবিধাবাদিতায় মুখ গুঁজেছেন’। তার ভাষায় ‘বুদ্ধিজীবীরা চামচাগিরি করছেন, মীরজাফরি করছেন। বুদ্ধিজীবীরা তাদের দায়িত্ব  পালন না করে উল্টো কাজ করছেন’। 

এর মধ্যে যে দুই একজন ভীষণ ব্যতিক্রম আছেন, গনস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডঃ জাফর উল্লাহ চৌধুরী তাদের অন্যতম। সম্প্রতি তিনি শিরোনাম হয়েছেন এই কঠিন দুঃসময় বিএনপির হাল যিনি শক্ত হাতে ধরেছেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানকে নিয়ে একটি মন্তব্যের মধ্য দিয়ে। দল হিসাবে বিএনপির সহনশীলতা, দলটির নেতা  কর্মীদের সহনশীলতার স্পষ্ট প্রমাণ মেলে যদি আমরা ফিরে তাকাই বিএনপির শাসন কাল ১৯৯১-১৯৯৬ কিংবা ২০০১-২০০৬ সালের দিকে। সেই সময় আজকের মত সরকারি গোয়েন্দাদের রক্তচক্ষু, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শতেক ধারা কিংবা অলিখিত নিয়ম মেনে সরকারের সমালোচনাকারীদের গুমের সংস্কৃতি তৈরি হয়নি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কিংবা তার পরিবার নিয়ে বহু মিথ্যা সমালোচনা এমনকি ভয়ানক প্রপাগান্ডাও বহু তথাকথিত সুশীল, বুদ্ধিজীবীকে করতে দেখেছি। এমন কোনও দিন নাই যেদিন দৈনিক সংবাদপত্রের প্রথম পাতা প্রধানমন্ত্রী, তার মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের কার্টুন দিয়ে শুরু না হয়েছে। কই তখন তো শুনিনি কারো নামে মামলা হতে, কোনও পত্রিকা বন্ধ হতে, কোনও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কিংবা কোনও বুদ্ধিজীবীর এতটুকু সমস্যা হতে। এখন তো পরিষদ গঠিত হয়েছে কে, কোথায়, কখন, কোন ফেসবুক একাউন্ট থেকে সরকারের সমালোচনা করছে তা খুঁজে বের করে তার বিরুদ্ধে মামলা করতে। আর সংবাদপত্রের কার্টুন? তার সমাধি হয়েছে ২০১৪ সালেই। 

বিএনপির মত বহুত্ববাদি, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, অতি সহনশীল একটি দলের ছাত্র সংগঠনের একজন নেতা কেন তবে প্রতিবাদ করলেন সেদিন ডঃ জাফরউল্লাহর সমালোচনার?  এর কয়েকটি কারণ আছে বলে আমি মনে করি। প্রথমত, গত ১২ বছর ধরে পরিকল্পিতভাবে প্রধান বিরোধী এই দলটিকে ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়েছে। দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে বিনা অপরাধে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে দুই বছর কারাগারে থাকতে হয়েছে। এই বয়সে এসে শারীরিক অসুস্থ অবস্থায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসাটুকু থেকে বঞ্চিত তিনি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশে ফিরতে পারছেন না। দলের কেন্দ্র থেকে তৃনমূল পর্যন্ত মামলার পাহাড়। গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে নির্যাতন ও খুন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এখন নিত্যদিনের রুটিন। এসব কিছু সরিয়ে বাজেটের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি আলোচনায় অপ্রাসঙ্গিক ভাবে হঠাৎ করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে নিয়ে কটুক্তি দলের কর্মিদের আঘাত দিতেই পারে।

দ্বিতীয়ত, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে বিতর্কিত করার প্রচেষ্টা এদেশে বহুদিন ধরে চলছে। যে দলটি গত এক যুগে দেশ থেকে ভোট ব্যবস্থা বিদায় করে প্রশাসন আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহার করে ক্ষমতার আছে তার বিরুদ্ধে টু শব্দটি করার সাহস বেশির ভাগ গণমাধ্যম আর সুশীল সমাজের নেই। তারা আজকে ঘটা গুমের জন্য ১৪ বছর আগে ক্ষমতা থেকে যাওয়া বিএনপিকে দায়ী করেন। নূন্যতম বিবেক বা লজ্জা তাদের নাই। এর মধ্যে অল্প যে কয়জন সত্য বলার চেষ্টা করেন, প্রতিবাদ করেন ডঃ জাফর উল্লাহ তাদের একজন। তাই তার কাছে মানুষের প্রত্যাশাও বেশি। তিনি যখন অপ্রাঙ্গিকভাবে বিএনপির প্রধানকে আঘাত করেন, তখন সেই আঘাত দলের প্রতিটা কর্মীর বুকে লাগে।

তৃতীয়ত, দুঃসময়ের টিকে থাকা সুসময়ের বিপ্লবের শামিল। দেশি বিদেশি চক্রান্ত  মোকাবেলা করে যেভাবে বিএনপি দেশের কোটি মানুষের একমাত্র আশার আলো হয়ে টিকে আছে কেবলমাত্র সে জন্যই সে অভিবাদন পেতে পারে। 

চতুর্থত, এই মুহুর্তে বিরোধী দল বা মতের যে কোনও সমালোচনাই দিনের শেষে ফ্যাসিবাদি এই সরকারের হাতকে শক্তিশালী করবে। এটা দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হবার সময়, পারষ্পরিক সমালোচনা আর বিভেদের সময় না।

পঞ্চমত, বিএনপি প্রতিটি নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্মান করে। খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধা, চিকিৎসক ডঃ জাফরুউল্লাহ চৌধুরী আমাদের সকলেরই শ্রদ্ধার মানুষ। তিনি চাইলে যে কোনও সময়ই তার পরামর্শ দলকে দিতে পারেন। চাইলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকেও জানাতে পারেন। কিন্তু সেই পরামর্শ দেবার জায়গা প্রেসক্লাব হওয়া এই মুহূর্তে কতটা সমীচীন সে ভার আমি তার উপরই ছেড়ে দিলাম।

নিশ্চিতভাবেই বিএনপি একেবারে নিখুঁত কোনো দল নয়; পৃথিবীতেই 'নিখুঁত দল' বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। এই জাতির ইতিহাসের চরমতম স্বৈরাচারী সময়টাতে বিএনপি তার সাধ্যের সবটুকু দিয়ে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এই লড়াইয়ে পদ্ধতিগতভাবে বিএনপি'র আর কোথায় কোথায় উন্নতির জায়গা আছে, সেটা নিয়ে আলোচনা হোক, কিন্তু এমন কোনো অযৌক্তিক সমালোচনা বিএনপি'র হওয়া উচিত না, যেটা প্রকারান্তরে বিএনপির নেতাকর্মীদের হতোদ্যম করে এবং দেশের মানুষকে আশাহত করে। আর সেটা হওয়া মানেই হল এই রাষ্ট্রের উপরে প্রচণ্ডভাবে চেপে বসা ফ্যাসিবাদকে আরও শক্তিশালী করা।

  • লেখক জাতীয় সংসদ সদস্য ও আইনজীবী। 

Tuesday, June 29, 2021

গণতন্ত্রকামী জনগণের কাঙ্খিত বিজয় আনবেন তারেক রহমান

------------------------------

— মীর সোলাইমান

------------------------------

মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম এবং তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সুযোগ্য উত্তরসূরী দেশনায়ক তারেক রহমান বর্তমানে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রিয় রাজনৈতিক সংগঠন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে সুদীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি দলের বিভিন্নস্তরে অত্যন্ত সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। দলের চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে চক্রান্তমূলকভাবে কার্যত বন্দি করে রাখা হয়েছে। অত্যন্থ অসুস্থ মাদার অব ডেমোক্রেসিকে বিদেশে এডভান্সড চিকিৎসাসেবা গ্রহণের সুযোগ এখনো দেয়া হয়নি। 

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দেশনায়ক তারেক রহমান চলমান ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে তাঁর বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে নানা কৌশলে বিভিন্ন অপপ্রচার। বিএনপি ও জিয়া পরিবারের প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনকে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় মোকাবেলা করতে সরকার ব্যর্থ, তাই শুরু করেছে নতুন ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের নানাবিধ অপকৌশল। অথচ জনগণের ভোটাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার তথা মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার সংগ্রামে বিএনপিই একমাত্র ভরসা। সে কারণেই বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি  জিয়াউর রহমানসহ দলের চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশনায়ক তারেক রহমান ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার এক ব্যর্থ অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে ক্ষমতাসীন সরকার। দেশে বিদ্যমান নৈরাজ্য, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট ও মানবাধিকার বিরোধী গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দায় থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতেই জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘোরাতে এই ষড়যন্ত্র অবিরাম চলছে, একটি বিশেষ মহল সেই কাজে নিয়োজিত আছে। 

দেশনায়ক তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র না করে দেশের গুম, খুন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে সরকারের নির্লজ্জ ব্যর্থতা, দুর্নীতি, অর্থপাচার, ব্যাংকলুটসহ নানান অনিয়ম, অবিচারের বিরুদ্ধে বলুন ও লিখুন। তারেক রহমানকে নিয়ে অসত্য ভিত্তিহীন কুৎসা রটাতে একটি কুচক্রি মহল বরাবরই তৎপর। তারেক রহমান যে মিডিয়া সন্ত্রাসের শিকার এটা বাংলাদেশের প্রত্যেকটা বিবেকবান মানুষ জানে ও বোঝে। গুম, খুন ও ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর নামে লক্ষাধিক মামলা মাথায় নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা যে পরিমাণ নির্যাতন নিপীড়নের মধ্যেও গত প্রায় ১৪ টি বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলন করে যাচ্ছে তা সেই বিশেষ মহলের চোখে পড়ে না। বর্তমান সরকার যে জনগণের ভোটের অধিকার, স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়েছে এবং বাকস্বাধীনতার অন্তরায়, সেদিকে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি তথা ৪ দলীয় জোটের নিরঙ্কুশ বিজয় ও তৎপরবর্তী সুসংগঠিত বিজ্ঞানভিত্তিক রাজনীতির দ্বারা দেশনায়ক তারেক রহমান যেভাবে  উঠে আসছিলেন, তা আওয়ামীলীগের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই ২০০১ সালে বিএনপি সরকারে আসার পর থেকেই তাঁকে টার্গেট করে আওয়ামী লীগ ‘দুর্নীতির বরপুত্র’ এবং ‘সরকারের ভেতরে সরকার’ বলে ব্যাপক নেতিবাচক প্রচারণা শুরু করে। দেশনায়ক জনাব তারেক রহমানের ইমেজ প্রশ্নবিদ্ধ করার মিশনে আওয়ামী লীগ ও তাদের তল্পিবাহক মিডিয়া কোমর বেঁধে তাঁর বিরুদ্ধে দেশে বিদেশে  নির্লজ্জ  মিথ্যাচারে লিপ্ত রয়েছে। এ লক্ষ্যে তাঁর বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের বানোয়াট অভিযোগ আনতে থাকে। অথচ আওয়ামী লীগ প্রায় ১৪টি বছর সরকারে থেকেও, বিশ্বময় তন্ন তন্ন করে খুঁজেও অদ্যাবধি বের করতে পারেনি দেশেবিদেশে তারেক রহমানের কোনো অবৈধ টাকার সামান্যতম উৎস। কেবল গালগপ্প দিয়ে তো আর মানুষকে বেশিদিন ভোলানো যায় না। এর মধ্য দিয়েই প্রকাশ হয়ে যায়, দেশনায়ক তারেক রহমানকে নিয়ে আওয়ামীলীগের অসৎ ও ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের কথা। তারেক রহমান কোনো বিশেষ মহলের গাত্রদাহের কারণ হলেও, দেশের আপামর জনতা জানে এ মুহূর্তে তারেক রহমানের নেতৃত্বে একটি গণবিপ্লবের মধ্য দিয়েই পূণঃপ্রতিষ্ঠা পেতে পারে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। এ মুহূর্তে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির পছন্দের রাজনৈতিক দল বিএনপি’র নেতৃত্বে দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে তারেক রহমানের কোনো বিকল্প নেই।

বিএনপি সরকারের আমলে অবসর গ্রহণ করা পুলিশ কর্মকর্তা ও ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী হয়ে প্রকাশ্যে সভা, সমাবেশ, মিছিল করা আব্দুল কাহার আকন্দকে দিয়ে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার পূণঃতদন্ত করিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তারেক রহমানকে এ মামলার আসামী হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য দলীয় চেতনার তদন্ত কর্মকর্তা কাহার আকন্দকে নিয়োগ দেয়ার উদ্দেশ্যই ছিল এ মামলায় তারেক রহমানকে জড়ানো। এরপর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তারেক রহমানকে পলাতক দেখিয়ে, তাঁর সম্পর্কে বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে ইন্টারপোলে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য সরবরাহ করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ইন্টারপোল ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে রেড নোটিশ জারি করে। ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করার পর তার যৌক্তিকতা নিয়ে তারেক রহমানের পক্ষে লন্ডনিয়াম সলিসিটর্স ইন্টারপোল হেড কোয়ার্টার্সে আপিল করে। সেই আপিল গ্রহণ করে ইন্টারপোল তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে তারেক রহমান সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের সরবরাহকৃত তথ্য যাচাই করে কোনো সত্যতা না পেয়ে এবং বিষয়টি তাদের আর্টিকেল ৩ এর ধারায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রমাণিত হওয়ায়, রেড নোটিশ প্রত্যাহার করে নেয়। একই সাথে ইন্টারপোল হেড কোয়ার্টার্স তারেক রহমান সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের দেয়া সকল তথ্য বাতিল করে নেয়। লন্ডনিয়াম সলিসিটর্সের প্রিন্সিপ্যাল ডেভিড রিকটারের মতে, ইন্টারপোলের সিদ্ধান্তে প্রমাণিত হয়েছে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে দেয়া অভিযোগ ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এতে প্রমাণিত হয়েছে তারেক রহমান পলাতক নন এবং রাজনৈতিকভাবে হেয় করতেই তারেক রহমানের নাম ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় জড়ানো হয়েছে। ইন্টারপোল বুঝতে পেরেছে তারেক রহমানের সম্মান বিনষ্ট করতে ইন্টারপোলকে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার তারেক রহমানের রাজনৈতিক ইমেজ কালিমালিপ্ত করতে গিয়ে নিজেরাই মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হয়েছে, সেইসাথে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশের গ্রহণযোগ্যতা। বিজ্ঞানে একটি কথা আছে, Every action has its equal and opposite reaction. অর্থাৎ প্রতিটি কাজেরই সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এটিই দুনিয়ার নিয়ম।

আওয়ামীলীগ সরকার দুর্নীতি কমিশনের মাধ্যমে ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর ক্যান্টনমেন্ট থানায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মানি লন্ডারিং এর মামলা দায়ের করেছিল। ৪ বছর ধরে সেই মামলা চলার পর ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩ এর বিচারক মোঃ মোতাহার হোসেন মামলার রায়ে তারেক রহমানকে বেকসুর খালাস দেন। দুদক এবং রাষ্ট্রপক্ষ সেই মামলাতেও  তারেক রহমানকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রমাণ উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছিল। রায়ে বলা হয়েছিল, তারেক রহমান ২০০৭ সালের ৭ জুন দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে খরচ করা অর্থের কথা উল্লেখ করেছেন। তারেক রহমান টাকা উত্তোলন ও ব্যয় করার বিষয়টি গোপন বা আড়াল করেননি। ফলে ২০০২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী কোনো অপরাধ তিনি করেননি। তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তার প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণপত্র সম্পর্কে আদালত সংশয় প্রকাশ করে বলেছিল, তারেক রহমানের বিরদ্ধে আনা অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কৌঁসুলী সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হননি। কিন্তু সরকার পক্ষ সেই রায়কে মেনে না নিয়ে, বরং ঐ বিচারককে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে, এটাও নিশ্চয়ই সবার অজানা নয়। এভাবে এই সরকার একের পর এক বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে তারেক রহমানকে রাজনৈতিকভাবে হেয় করার চেষ্টা চালালেও বারবার আদালতে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার তদন্তে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। এ পর্যন্ত কোনো মামলায় দেশের আদালত কি প্রমাণ করতে পেড়েছে জনাব তারেক রহমানের অপরাধ?

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রনায়ক তারেক রহমানকে নিয়ে যতই ষড়যন্ত্র করা হোক না কেন, সকল জুলুম-নিপীড়নের অবসান ঘটিয়ে তিনি বীরের বেশে দেশে ফিরবেন এবং কোটি কোটি জিয়ার সৈনিক তাদের প্রিয় নেতাকে বরণ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আমি মনে করি দেশনায়ক তারেক রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বে নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক ক্ষমতায় বিএনপির ফিরে আসার পেছনে সবচেয়ে বড় বাধা সরকারের লেজুড়বৃত্তিক মিডিয়া। এর ফলে জাতি আদর্শিক ও পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে। তারেক রহমানের মতো এমন হাই প্রোফাইল পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ডসম্পন্ন ফ্যামিলির সন্তান দেশে তো নেই বটেই, পৃথিবীতেও বিরল। দেশনায়ক তারেক রহমান একাধারে একজন বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ঘোষক, সাবেক সেনাপ্রধান, সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রীর পুত্র। এটা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সকল রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গর্বের বিষয়।   জিয়া পরিবারকে নিয়ে এহেন মিথ্যাচারের অপপ্রয়াসে দেশের আপামর জনগণ দারুণভাবে ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি একমাত্র তারেক রহমানের ডায়নামিক নেতৃত্বেই দেশের গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার সম্ভব। দেশনায়ক তারেক রহমানের নেতৃত্বেই বিএনপি’র ও দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণের বিজয় হবে।


  • লেখক গবেষক।  


Monday, June 28, 2021

নাগরিকের জান-মাল রক্ষার জন্য প্রয়োজন সুশাসন ও সুশাসক — মোস্তফা কামাল পাশা

রাজধানীর মগবাজারের ওয়্যারলেস গেট এলাকার গতকালের বিস্ফোরণে ধসে যাওয়া ভবনের একাংশ। মগবাজার, ঢাকা, জুন ২৮, ২০২১। ছবি — সাজিদ হোসেন 


মরা ইঁদুর খাওয়ার গল্প শুনিয়ে দেশের জিডিপি বৃদ্ধি করা যায় তবে দেশের মানুষের জান ও মালের নিরাপত্তা দেওয়া যায় না। একটি দেশের নাগরিকের জান ও মালের রক্ষার জন্য সর্বাপেক্ষা প্রয়োজন সুশাসন ও সুশাসক। এই দুই জিনিসের মূল্য বা প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশের মানুষ যত  দ্রুত বুঝতে পারবে নিজের জান ও মালের রক্ষা তত দ্রুত করতে পারে বলে।

ঘুম থেকে উঠে বিছানায় থাকা অবস্থায় মোবাইল হাতে নিতেই দুইটা সংবাদ চোখে পড়লো। একটা হলো ঢাকার মগবাজারের একটি হোটেলে গ্যাস লাইন বিস্ফোরণ ও অন্যটি হলো কুয়াকাটা শহরে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পূর্বেই একটি সেতু ধসে পড়ার ঘটনা। 

যে দুইটি দুর্ঘটনার কথা উপরে উল্লেখ করেছি তার কোনটাই বাংলাদেশে প্রথম না, কিংবা এই দুই দুর্ঘটনাই শেষ না। পূর্বের প্রতিটি গ্যাস কিংবা ক্যামিকেল দুর্ঘটনার তদন্ত শেষে দেখা গেছে সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা ঘুষ-দুর্নীতি করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে বিরত থাকা কিংবা স্থানীয় সরকার দলীয় নেতা কর্তৃক আইন অমান্য করে গ্যাসের লাইন বিতরণ করা কিংবা ক্যামিকেলের গুদাম চালু রাখা। নির্মাণাধীন ব্রিজ কিংবা স্থাপনাগুলোর প্রায় ১০০% স্থাপনা ভেঙ্গে পড়ার জন্য প্রায় শতভাগ দায়ী ঠিকাদার  কর্তৃক মানহীন নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা। ঠিকাদারকে শুধু দোষ দেওয়া যা না। নির্মাণ কাজ থেকে সরকার দলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রাম থেকে মন্ত্রী পর্যায় পর্যন্ত ঘুষের পার্সেন্টেজ বিতরণ করার পরে নির্মাণ ঠিকাদার লোহার পরিবর্তে নির্মাণ কাজে বাঁশ ব্যবহার করবে সেটাই তো স্বাভাবিক। দশ বস্তা সিমেন্টের পরিবর্তে ৫ বস্তা সিমেন্ট ব্যবহার করবে সেটাই তো স্বাভাবিক। আমি দাবি করছি না যে বাংলাদেশের ঠিকাদাররা আজ থেকে ১০-২০ বছর পূর্বে নির্মাণ কাজে ১০০ ভাগ মান  বজায় রেখে নির্মাণ কাজ করেছে। তবে একটা বিষয় আমি হলফ করেই বলতে পারি আজ থেকে ১০-২০ বছর পূর্বে কোন নির্মাণ কাজে লোহার পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করে নাই। আজ থেকে ১০-২০ বছর পূর্বে ঠিকাদারদের ঐ পরিমাণ দুর্নীতি করার  সাহস ছিলও না কিংবা ঐ পরিমাণ দুর্নীতি করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করেনি। সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর তৈরি করে তা দুঃসহ মানুষদের হাতে তুলে দেওয়ার পূর্বেই তা ভেঙ্গে পড়ে নি, মডেল মসজিদ উদ্বোধনের পরের দিন পলেস্টার খসে পড়ার সংবাদ পাওয়া যায় নি। সুশাসন দিয়ে নাগরিকের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনার পরিবর্তে দলীয় নেতাকর্মীদের যেভাবে পারো টাকা বানাও কিংবা পুরো আমলাতন্ত্রকে কানাডার বেগম পাড়া কিংবা আমেরিকার জ্যাকসনহাইটে বাড়ি কেনার প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করার ব্ল্যাংক চেক দেওয়া যত দিন না বন্ধ হবে ততদিন একের পর এক বিস্ফোরণে মানুষের পোড়া শরীরের গন্ধ দেশের নাগরিকের নাকে আসা বন্ধ হবে না। উদ্বোধনের পূর্বেই সেতু, মডেল মসজিদ কিংবা আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়ির ওয়াল ধসে পড়া ছবি পত্রিকায় আসা বন্ধ হবে না।


  • লেখক কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক গবেষক।  

Sunday, June 27, 2021

‘মেড ইন বাংলাদেশ’ গাড়ির স্বপ্ন এবং বুলডোজারচাপা অটোরিকশা — ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব


বুলডোজারের নিচে অটোরিকশা পিষে ফেলা হচ্ছে। এভাবে রুটি রুজির উৎসকে ধ্বংস হতে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন এক অটোরিকশা চালক। 

টেকসই যান ও গণযোগাযোগ প্রবর্তনে প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান প্রায় শূন্য। দেশের শহর-নগর-বন্দরের আন্তসংযোগের পাশাপাশি শহর-নগর-বন্দরের সঙ্গে প্রত্যন্ত জনপদগুলোর সংযোগ তৈরি এবং পণ্য ও যাত্রী পরিবহনসেবা নাগরিকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়াই ছিল সওজ, রেলওয়ে, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ, বিটিআরসি, বিআরটিএর মতো প্রতিষ্ঠানের কাজ।

বিটিআরসি প্রতিষ্ঠিত রুটে এসি বাস সার্ভিস চালু করতে নিম্ন মানের বাস কেনায় ব্যস্ত আছে, যেগুলো কেনার মাত্র দু-তিন বছরের পরেই অচল হবে, এতে নতুন বাস কেনার প্রকল্প নামানো যাবে। তাবৎ বিশ্বে বৈদ্যুতিক রেল প্রচলিত হয়ে গেলেও বাংলাদেশ রেলওয়ে ব্যস্ত আছে নিম্ন মানের ‘তেলচালিত’ ইঞ্জিন খোঁজায়, ক্রয় দুর্নীতি ধামাচাপায় অথবা ইঞ্জিন না কিনে কোচ কেনায়। অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ ব্যস্ত অবৈধ নৌযানের লাইসেন্স দেওয়ায়, বড়জোর ড্রেজিংয়ের বরাদ্দ বাড়ানোয়। প্রযুক্তিকে, প্রকৌশল বিদ্যাকে ‘গরিবের’ চাহিদার সঙ্গে সংযোগ করার ‘টাইম নেই’ কারও।

শহর, নগর, মহানগর, মফস্বল ও গ্রামীণ অর্থনৈতিক চাহিদা, পণ্য পরিবহন ও নাগরিক যাতায়াত, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিশেষ যাতায়াতসহ স্থানীয় অর্থনীতির ‘চাহিদামাফিক’ যান ও যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপনে, গণপরিবহন প্রবর্তনে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। দেশের যা কিছু বড় রাস্তা ও সেতু, তার প্রায় সবই বিদেশিদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ অবদানে গড়া। বাকিগুলো যা আছে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা যায়, তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ লাগে না। ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল কিংবা সিভিল অবকাঠামোর নকশা ও বাস্তবায়নের কাজে ‘চুরি’ ভিন্ন অপর কোনো ‘কাজ’ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকঠাক করতে পারছে না। মোড়হীন লেন, সংযোগ লেন, সার্ভিস লেন, সিগন্যালবিহীন নিরবচ্ছিন্ন গতিতে যানবাহন চলার উপযোগিতার হিসেবে বলা চলে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মানের কোনো মহাসড়ক নেই। গতিময় প্রবেশ-বাইরের সুবিধাহীন স্থানীয় চাহিদার জন্য অপরিহার্য ধীর গতির যান চলাচলের বন্দোবস্তহীন কিছু সাধারণ রাস্তা আছে মাত্র।

রাষ্ট্র যখন দায়িত্বহীন তখন এই ‘বিশেষ’ যানগুলো স্থানীয় অর্থনৈতিক চাহিদার অনিবার্য আবিষ্কার। এসব রি-ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য দেশের ক্ষুদ্র ব্যাষ্টিক এবং বৃহৎ অর্থনীতিতে অসামান্য ভূমিকা রেখে চলেছে।

চরম বাস্তবতা হচ্ছে, রিকশা, অটোরিকশা, নছিমন-করিমন-টেম্পো, ইঞ্জিনচালিত নৌযান, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, রিকশাভ্যানই সাধারণ গ্রামীণ ও শহুরে মানুষের মূল গণপরিবহন। এর উদ্বোধন ও রক্ষণাবেক্ষণে বুয়েট কিংবা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড সনদধারীদের কোনো অবদান নেই, বরং আমাদের স্বশিক্ষিত জনতাই এসবের মূল উদ্ভাবক প্রবর্তক ও রক্ষণাবেক্ষণকারী। রিকশা ও ভ্যান গতর খাটানো কায়িক শ্রমনির্ভর বলে ব্যবহারকারীরাই এতে বৈদ্যুতিক ব্যাটারিচালিত মোটর সংযুক্ত করে শ্রমদাসত্ব থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছেন। প্রকৌশলী, পরিকল্পনাবিদ, মেয়র কিংবা মন্ত্রীর এসব ভাবার সময় হয়নি। 

অর্থাৎ গ্রাম ও শহরের জন্য সাশ্রয়ী দেশীয় কিংবা আমদানি করা সাশ্রয়ী প্রযুক্তির যানবাহনের উদ্ভাবনে কিংবা বিকাশে আমাদের প্রকৌশলী ও পরিকল্পনাবিদদের চরম ব্যর্থতাই মুড়ির টিন/ভটভটি/নছিমন/ (কিংবা শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে তৈরি পণ্য পরিবাহী গাড়ি, নৌকা ও ট্রলার) ইত্যাদি সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্র যখন দায়িত্বহীন তখন এই ‘বিশেষ’ যানগুলো স্থানীয় অর্থনৈতিক চাহিদার অনিবার্য আবিষ্কার। এসব রি-ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য দেশের ক্ষুদ্র ব্যাষ্টিক এবং বৃহৎ অর্থনীতিতে অসামান্য ভূমিকা রেখে চলেছে।

যান ও যোগাযোগে স্থানীয় অর্থনৈতিক চাহিদার বিবেচনা নেই

নিরাপদ সড়কের দাবি আসলেই সড়কে রিকশা, ভ্যান, নছিমন, করিমন, মুড়ির টিন কিংবা পাম্প ইঞ্জিনচালিত গাড়িগুলো নিষিদ্ধের কথা ওঠে, কিন্তু সড়কের মান, প্রশস্ততা, নিম্ন-উচ্চগতির যানের অনুকূলে তৈরি লেন, সংযোগ সড়ক, ট্র্যাফিক সিগন্যাল, সড়ক বাঁক ও সেতুর ডিজাইন বাস্তবায়ন ত্রুটি নিয়ে আলোচনা ওঠে না, ওঠে না ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের নিম্ন মানের পদ্ধতি এবং মোটরযানের ফিটনেস যাচাইয়ের পদ্ধতি সংস্কারের কথা। ফলে রাস্তা দেশের বাজেটের শীর্ষ বরাদ্দ খাত হলেও আমাদের সড়ক না টেকসই, না নিরাপদ। 

বাংলাদেশে হাটবাজার, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল-অফিস-আদালতসহ যেকোনো অবকাঠামোই যেহেতু একেবারে রাস্তার ওপরে হয়, তাই আন্তজেলা বা আন্ত-উপজেলা সড়কে তিন চাকা কিংবা স্থানীয় উদ্ভাবনের চার চাকার যান স্বল্পগতির চলাচল বন্ধ হলে গ্রামীণ মানুষের যাতায়াত বিকল্প কী হবে, জনপরিবহন-পণ্য পরিবহন, কিংবা রোগী পরিবহনের খরচ কী হবে, সেটা কখনো বিবেচনায় আনা হয়নি।

অর্থাৎ এককালের মাটি হাঁটা বা রিকশার পথ অটেকসই উন্নয়নের খপ্পরে পড়ে আধা-এক-দুই লেনের সড়কে উন্নীত হয়েছে, সেখানে বাণিজ্যিক বাস-ট্রাক চলাচল শুরু হয়েছে, কিন্তু হাঁটা-রিকশা-সাইকেল-ভ্যান, এসব গ্রামীণ অর্থনীতির চাহিদার প্রভিশন নেই, নেই সড়ক নিরাপত্তার টেকসই সমাধান। যে লোকটি শূন্য পরিবহন ব্যয়ে হেঁটে বা মাথায় করে বা কাঁধের ভারে বাজারে পণ্য নিতেন, তাঁর কথা (গ্রামীণ জনপদের অর্থনীতি) পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী, মেয়র কিংবা মন্ত্রীর বিবেচনায় আসেনি। 

মানুষের হাঁটার জায়গাও চুরির কবলে পড়েছে। ফলে সড়ক হয়েছে মরণফাঁদ। একই আধা বা এক লেনের রাস্তায় হাঁটা, গরু চরানো, ধানের খড় বা গোবর বা কাঠের জ্বালানি শুকানো, ঠেলা-ভ্যান-রিকশা চালানো, নছিমন, করিমন, টেম্পো, স্কুটার চালানো, হাটবাজার বসা, মাল ওঠানামা করানোর কাজ সবই হচ্ছে। এ ধরনের সড়ক ব্যবস্থাপনা যত দিন আছে, তত দিন মালের বস্তার সঙ্গে প্রাণও হাতে নিয়েই পরিবহনে ওঠা লাগছে।

সাত কিলোমিটার গড় গতির শহরে অটোরিকশার সমস্যা কোথায়?

ঢাকার উন্নয়নবিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে বিশ্বব্যাংক জানায়, ঢাকায় যানবাহনের গড় গতিবেগ হাঁটার গতির সামান্য বেশি। মানুষের হাঁটার গতি পাঁচ কিলোমিটার হলেও যান চলাচলের গতি এর চেয়ে মাত্র দুই কিলোমিটার বেশি। প্রতিদিন যানজটের কারণে রাজধানীতে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। গত ১০ বছরে রাজধানীতে যান চলাচলের গড় গতিবেগ ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে সাত কিলোমিটারে নেমেছে (১১/১১/১৮, প্রথম আলো, ১৯/০৭ /১৭ ঢাকা টাইমস)। তাহলে এই শহরে ধীরগতির বাহনের মিথ্যা বলে ২৫ কিলোমিটার গতির ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধের যুক্তি কি খোঁড়া নয়? 

এক দশকে ৬০ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকির ওপর দাঁড়ানো ১৫ হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ রিকশাওয়ালা ব্যবহার করতে পারবে না, সে অভিজাত শ্রেণি নয় বলে? নগরে সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ অদক্ষ চালক, দুর্বৃত্ত বাসমালিকের ঘাতক বাস, পাওয়ার বাইক, কিশোর-যুবক গ্যাংগুলোর বেপরোয়া রাতের গতি এবং গর্তে ভরা উচু-নিচু সড়ক। ব্যাটারিচালিত রিকশা রাজধানীর সড়ক নিরাপত্তার কারণ হিসেবে উঠে আসেনি গবেষণায়।

বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীতে ট্রাম, ট্রামবাস কিংবা বিআরটিএ চালু করার কথা কর্তারা ভাবেননি। বাসমালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধে একক কোম্পানির কনফ্লিক্টহীন বাস রুটও ৫০ বছরে দেশের রাজধানীতে চালু করা হয়নি।

যদি যুক্তি শুধু সড়ক নিরাপত্তা হয়, তাহলে অটোরিকশায় সিটবেল্ট লাগানোর বিষয়ে ভাবুন। কাঠ-বাঁশের বডি করে রিকশাকে হালকা রাখার সনদহীন ব্যক্তি উদ্ভাবিত বৈশিষ্ট্যগুলো আমলে নিন। যাত্রীবাহী বাস চলাচলের প্রধান রুট ছাড়া বাদবাকি রাস্তায় ব্যাটারিচালিত যান চলাচল নির্বিঘ্ন করে কর্মরক্ষা এবং শ্রমদাসত্ব মুক্তির পথ খোলা রাখুন, ভুলে যাবেন না যে দেশের উন্নয়ন এবং প্রবৃদ্ধি কর্মহীন, বিবিএসের কর্মসংস্থান তথ্যও মিথ্যা। অটোরিকশা নিষিদ্ধ করার সভায় বুয়েটের অধ্যাপকসহ মেয়র-মন্ত্রীরা ছিলেন, তাঁরা বিদেশি প্রযুক্তি ভালো জানতে পারেন, কিন্তু বাংলার মানুষের চাহিদার আলোকে সড়ক ও যানবাহনের উপযোগিতা তৈরি বিষয়, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য মুক্তির বিষয়ে কতটা খবর রাখেন! হঠকারী সিদ্ধান্তে প্রান্তিক সামজের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রভাব, দারিদ্র্যসীমা বিস্তৃতির অনুষঙ্গগুলো কে ভাবে! প্রযুক্তি ও প্রকৌশলবিদ্যাকে বাংলার মানুষের কল্যাণে আনার পথপরিক্রমা তৈরিতে আমরা নিদারুণ ব্যর্থ।

আন্তসংযুক্তিহীন প্রবেশ-বাহির পথ এবং মিশ্র ট্র্যাফিক যানজটের প্রধানতম উৎস বিমানবন্দরসহ ঢাকার প্রধান প্রবেশমুখের সংখ্যা অন্তত ১১। ঢাকাকে ভায়া করে অন্য জেলায় যাওয়া কিংবা বিদেশফেরত যাত্রী ও পণ্যবাহী যানের জন্য ঢাকা বাইপাসের বিকল্প রাস্তা নেই। নগরের ভেতরের ট্র্যাফিক থেকে বিমানবন্দর, নদীবন্দর এবং ঢাকার বাইরে যাওয়ার যাত্রী ও মালবাহী ট্র্যাফিক আলাদা করা হয়নি। বিমানবন্দর, ঢাকা বাইপাস, প্রবেশ-বাইরের ট্রাফিক ঢাকার অধিবাসীদের নিয়মিত ট্র্যাফিকের সঙ্গে মিশ্রিত। সরকার মহাশয় এবং প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো বিষয়টা বুঝে উঠতে পারেননি ৫০ বছরে!

২০২৫ সালের পরে ইউরোপ-আমেরিকায় বিক্রীত গাড়ির ৭০ শতাংশই বৈদ্যুতিক হবে, ২০৩০ সালের পরে বৈদ্যুতিক হবে শতভাগ গাড়ি। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ খরচ বাড়ার যুক্তিতে বাংলার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, নছিমন-করিমন-টেম্পো বন্ধের সিদ্ধান্ত বেশ হাস্যকর।

বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীতে ট্রাম, ট্রামবাস কিংবা বিআরটিএ চালু করার কথা কর্তারা ভাবেননি। বাসমালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধে একক কোম্পানির কনফ্লিক্টহীন বাস রুটও ৫০ বছরে দেশের রাজধানীতে চালু করা হয়নি। আয়তনের মাত্র ৫ শতাংশ রাস্তার শহরে, সক্ষমতার অতিরিক্ত কমিউটেশন ট্রেন/ট্রাম/ট্রামবাস/বিআরটিএ/মেট্রো ইত্যাদি আধুনিক গণপরিবহনে উঠিয়ে নিয়ে পরে ফ্লাইওভার কিংবা ওভারপাস করার কথা সক্ষমতা কর্তাদের হয়নি। মাত্র দু-তিনটি মেট্রোরুট সব ট্র্যাফিক পয়েন্ট ও গ্রোথ সেন্টার কভার করছে না বলে ভবিষ্যতের যানজট নিরসনের নিশ্চয়তা কম। সক্ষমতা শুধু গরিবের উপার্জনের ওপর বুলডোজার চালানোয়।

‘মেড ইন বাংলাদেশ’ গাড়ির স্বপ্ন

নির্মাতারা বলছেন, বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি খুব দ্রুতগতিতে পেট্রল আর ডিজেলচালিত গাড়ির বিক্রিকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ২০২৫ সালের পরে ইউরোপ-আমেরিকায় বিক্রীত গাড়ির ৭০ শতাংশই বৈদ্যুতিক হবে, ২০৩০ সালের পরে বৈদ্যুতিক হবে শতভাগ গাড়ি। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ খরচ বাড়ার যুক্তিতে বাংলার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, নছিমন-করিমন-টেম্পো বন্ধের সিদ্ধান্ত বেশ হাস্যকর। সংজ্ঞামতে এগুলোও বৈদ্যুতিক যান, যদিও দেখতে খারাপ এসব গরিবের বাহন। দরকার এসবে যাত্রী ও চালকের জন্য নিরাপত্তাবৈশিষ্ট্য সংযুক্ত করার দুর্দান্ত সব চেষ্টা। ইউরোপে ব্যাটারিচালিত সাইকেলের ব্যাপক প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটারিচালিত রিকশাও জনপ্রিয় হচ্ছে। 

এসব দ্বি-ত্রিচক্রযানের গিয়ার-প্যাডেলের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় করা হয়েছে। পা দিয়ে প্যাডেল জোরে ঘোরালে মোটরও বেশি শক্তি সরবরাহ করে। সরকার গাড়ি নির্মাণে ২০ বছরে কর ও শুল্কসুবিধা ঘোষণা করেছে, এটা তেলচালিত গাড়ি তৈরির পেছনে ব্যয় অর্থহীন। বরং এশিয়ার সর্বনিকৃষ্ট রাস্তার দেশে অটোমোবাইল যন্ত্রাংশ উৎপাদনে গিয়ে আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনতে পারে বাংলাদেশ। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ গাড়ির স্বপ্ন বৈদ্যুতিক গাড়িকেন্দ্রিক হওয়া চাই। তা যেন দোয়েল ল্যাপটপের মতো লুটেরা কিংবা টাটা-ন্যানোর মতো অদূরদর্শী প্রকল্প না হয়। গরিবের স্থানীয় বিকল্প বৈদ্যুতিক যানবাহনের উৎকর্ষ আনয়নেও মেধা ও শুল্কসুবিধা প্রয়োগের চেষ্টাটা থাকুক।

লেখক চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ অর্থনীতির ৫০ বছর গ্রন্থের রচয়িতা। 

faiz.taiyeb@gmail.com 


সূত্র — https://bit.ly/3gZriW8


Saturday, June 26, 2021

আগামীর দেশনায়ক তারেক রহমান — শওকত মাহমুদ



‘তারেক রহমান অথবা না — তারেক রহমান’,  বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে এলিট সমাজে এই বিতর্কের রঁদেভু তো কম হলো না। আজ বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৪৮তম জন্মদিনে আসুন না এই সত্য কবুল করি, অজস্র অপপ্রচার টপকে তিনি আজ এই অবারিত স্ব্বীকৃতিতে উজ্জ্বল যে, আগামীর অবশ্যম্ভাবী দেশনায়ক তিনি। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিচালনাধীন রাষ্ট্রের পরহিংসাময় এবং অসংখ্য ছিদ্রান্বেষী তদন্তেও তার রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্খলন শনাক্ত হয়নি। এই না হওয়ার ঘটনা অথবা রাষ্ট্রের এক নম্বর খলনায়ক হিসেবে তাকে সাব্যস্ত করার অপপ্রয়াস সর্বোপরি এত ঝঞ্ঝায় বিরল এক আত্মশক্তিতে নিজেকে সুস্থির রাখার গুণে তিনি আরও লোকনন্দিত হয়েছেন। বাংলাদেশের অগণন মানুষের সরল উপলব্ধিতে জনপ্রিয়তার তুল্যদণ্ডে আজ বাংলাভাষী রাজনীতিকদের মধ্যে বেগম জিয়ার শীর্ষস্থানের পর তারেক রহমানেরই অবস্থান।

পত্রিকায় কলাম লেখার সুযোগ আছে, গায়ের জোরে কতকগুলো কথা লিখে দিলাম অথবা জন্মদিনের মওকা পাওয়া গেছে বলে প্রশস্তি ঝেড়ে দিলাম, বিষয়টি কিন্তু তা নয়। ধ্রুবকের মতো এই সত্য বাংলাদেশের প্রতিটি ধূলি-কণায় বিরাজমান হয়ে উঠেছে যে, এই দেশের পরিচালনা ভার তারেক রহমানের ওপর অর্পিত হবে এবং তিনি দীর্ঘ সময় রাজনীতিকে প্রভাবিত ও প্রবাহিত করবেন। সিনা টানটান করে এই কথাটা বললে এ মুহূর্তে টিকা-টিপ্পনি জুড়ে দেয়ার লোক খুবই কম। রাজনীতিবিদদের আমলনামা আঁচ করতে চাওয়ার আস্পর্ধা নাগরিকের দিক থেকে অপরাধ নয়। সেই সন্ধিৎসায় কতকগুলো প্রশ্ন উত্থাপন জরুরি এবং সে সবের উত্তর অনায়াসে পেয়ে যাওয়াটাও সম্ভব।

বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যত নেতৃত্ব নির্ধারিত হয়ে আছে দলের নেতা-কর্মীদের আনন্দময় সম্মতিতে? তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে ২০০৯-এ বিএনপির কাউন্সিল অধিবেশন ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’ — এই স্লোগানের প্রবল উচ্চারণে তারেক রহমানকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করেছে। শহীদ জিয়া ও বেগম জিয়ার সন্তান রূপে নয় বরং এই দলের পরীক্ষিত, অপরিহার্য এবং অনিবার্য সেনাপতি হিসেবে দল তাকে চেয়েছে। 

‘তারেক রহমান : অপেক্ষায় বাংলাদেশ’ গ্রন্থের পর্যালোচনা মতে, তিনি ১৯৮৮ সালে বগুড়া জেলা বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হন। ’৯১-র সংসদ নির্বাচনের সময় ক্যাম্পেইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৯৭ থেকে বনানীতে চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে নিয়মিত সক্রিয় হন। ২০০১ সালে বিএনপির ঐতিহাসিক বিজয়ের পেছনে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির গবেষণা, মনিটরিং ও নির্বাচন পরিচালনা সেলটির অগ্রণী ভূমিকা সবারই জানা। চাইলে সরকারেও যোগ দিতে পারতেন, কিন্তু দলকে সুসংগঠিত করতেই তার প্রচণ্ড আগ্রহ। ২০০২ সালের ২২ জুন চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া তাকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব নিযুক্ত করেন। তৃণমূল-সঞ্চারী এই তরুণ বিভাগীয় প্রতিনিধি সভাগুলো করে রাজনীতিতে নতুন গতি যোগ করেন। তারেক রহমানের আগমন বা উত্থানকে উপমহাদেশের পারিবারিক উত্তরাধিকার থেকে আসা রাজনীতিকদের সঙ্গে তুলনা করা চলে না এ জন্য যে, সোনিয়া-রাজীব, বেনজীর-আসিফ-বিলওয়াল, বেগম খালেদা জিয়া বা শেখ হাসিনা যেমনি করে সৃষ্ট শূন্যতায় দলের অনুরোধে দায়িত্ব নিয়েছেন, তারেক রহমান নিজেকে দেশ-দল-মাটি মানুষের পারস্পরিক অন্বয়ের আত্মদহনে ধাপে ধাপে এগিয়েছেন। ভোগের চেয়ে ত্যাগের মানসিকতা এই তরুণের মধ্যে প্রবল। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় দলের প্রাথমিক সদস্যপদ নিয়েছেন বটে, কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এখনও নিশ্চল। সম্ভবত আগ্রহীও নন। তারেক রহমানের মতো মাটি-মানুষের অভিজ্ঞতা তার নেই। তবে শূন্যতা হলে সজীব ওয়াজেদ এক সময়ে দায়িত্ব নিলেও নিতে পারেন। 

তারেক রহমানের কম বয়সে বড় দায়িত্ব নিয়ে মহলবিশেষের ছড়ানো বিভ্রান্তি সম্পর্কে আলোচ্য গ্রন্থটির বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল শহীদ জিয়া যখন প্রেসিডেন্ট হন তার বয়স ছিল ৪১ বছর ৩ মাস। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার মধ্য-মঞ্চে তিনি যখন আবির্ভূত হন তখন তিনি ৩৯ বছর ১০ মাসের টগবগে তরুণ। ১৯৮৪ সালের ১০ মে বিএনপির চেয়ারপার্সন হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের সময় বেগম খালেদা জিয়ার বয়স ৩৯ বছর। অন্যদিকে শেখ হাসিনাকে যখন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী করা হয় তখন তার বয়স ৩৪। রাজীব গান্ধী ৪০ বছর বয়সে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সবশেষে বলব, জাতীয় ঘটনাপ্রবাহ এবং রাজনীতিকে কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য তারেক রহমানের হয়েছে। পিতার মুখ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা শোনা, মুক্তিযুদ্ধ ও তার বিজয় দেখা, ৭ নভেম্বরে জাতীয় বিপ্লবকে ভেতর থেকে অনুভব করা, শহীদ জিয়া ও বেগম খালেদা জিয়ার গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা এবং উন্নয়নে উন্নয়নে বাংলাদেশকে সবল করার মহোৎসব, কদর্য সামরিক শাসন ও আওয়ামী দুঃশাসনকে প্রত্যক্ষ করা — সব অভিজ্ঞতাই তার রয়েছে।

দ্বিতীয় প্রশ্নটি উঠতে পারে এভাবে, বাংলাদেশের কোন রাজনীতিবিদ মিথ্যা মামলায়, দৈহিক নির্যাতনে সবচেয়ে বেশি পীড়িত হয়েছেন? এক নিঃশ্বাসে যে নাম নেয়া যায় তাহলো তারেক রহমান। ১/১১’র মূল টার্গেট তারেক রহমান। ওই সময় শিশুরা এই রটনায় বড় হয়ে উঠেছিল যে, তারেক রহমান গণতন্ত্র ও সুশাসনের খলনায়ক। হাওয়া ভবন ছিল যত্তোসব অনিয়মের উৎস। তাকে ঘিরে হিন্দি সিনেমার মতো গল্প বানিয়ে, গল্প ছড়িয়ে কী বিষাক্ত ধিক্কারই না দেগে দেয়া হয়েছিল। গণতন্ত্র বিনাশের সেই কালোক্ষণে তারেক-গিবতই হয়ে উঠেছিল লিভিং স্পেন্সের নিয়মিত ঘটনা। ২০০৭ সালের ৭ মার্চ বিনা অভিযোগে শহীদ মঈনুল রোড়ের বাড়ি থেকে তারেক রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন গং গুনে গুনে ১৩টি মামলা দিয়েছিল। কোনোটিতেই তারেক রহমান সরাসরি আসামি নন। কারণ তিনি প্রজাতন্ত্রের কোনো পদেই ছিলেন না, কোনো সরকারি নথিতে নেই তার স্বাক্ষর। মামলাগুলোর কথিত আসামিদের ধরে পিটিয়ে সাজানো স্বীকারোক্তি ছিল তারেক রহমানকে ফাঁসানোর অস্ত্র। ১৩টির মধ্যে ১১টি উচ্চ আদালতের রায়ে স্থগিত হয়ে যায়। কাফরুল থানায় দ্রুত বিচার আইনে ২০০৭-এর ১৭ এপ্রিল যে মামলাটি হয়, তাতে তারেককে ফাঁসাতে মরিয়া ১/১১’র অবৈধ সরকার দু’দিনের ব্যবধানে দু’বার আইন সংশোধন করেছিল। কিন্তু হাইকোর্ট তা আমলে নেয়নি। বাকি দুই মামলার মধ্যে ‘দিনকাল’ মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের মামলা বিচারাধীন। মানি লন্ডারিংয়ের একটি মামলায় পরে তারেক রহমানকে জড়ানো হয়েছে। একুশে আগস্টের মামলায় ফাঁসানোর পাঁয়তারা আছে। অথচ সে সবেও তিনি মূল আসামি নন। সে সময়ে তার ৫৫৪ দিনের কারাবাস ছিল মানবাধিকার বিপর্যয়ের এক লোমহর্ষক ইতিহাস। আমরা কি কোনো রাজনীতিককে এর আগে দেখেছি যে র‍্যাব'র বর্ম পরিয়ে মাথায় হেলমেট সেঁটে কোর্টে হাজির করানো হয়েছে? বহু রাজনীতিক বহুবার জেল খেটেছেন। কিন্তু তাদের এমন অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন সইতে হয়নি। কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানের পরিবারের কেউ তো নয়ই, কারাগারের অন্ধকার সেলে থাকতে থাকতে কারও চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। অসুখে মৃত্যুর পথে এগিয়েছেন, গোয়েন্দা সেলে বর্বরতার শিকারও হয়েছেন। কিন্তু রিমান্ডের নামে হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ার সমকালীন স্মৃতি আর নেই। লন্ডনে আমাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি সেই রক্তাক্ত অতীতকে এভাবে বর্ণনা করেছিলেন ‘২০০৭-এর ৩১ ডিসেম্বর রিমান্ডে থাকাকালে আমার ওপর ইলেকট্রিক শকসহ নানাভাবে দৈহিক নির্যাতন করা হয়। এর মধ্যে একটি ছিল অনেক ওপর থেকে বারবার নিচে ফেলে দেয়া। অসহ্য যন্ত্রণায় আমি কুঁকড়ে উঠেছি। কিন্তু ওইসব অফিসারের বিন্দুমাত্র দয়া হয়নি। ওদের অ্যাসাইনমেন্ট ছিল আমাকে কষ্টে কষ্টে মেরে ফেলা। তারপর আবার কারাগারে। কোনো ডাক্তার আসে না, চিকিৎসা হয় না। প্রতিটি দিন কেটেছে নারকীয় যন্ত্রণায়। কোমরের ভাঙা হাড়ের যন্ত্রণা যে কী অসহ্য তা বলে বোঝাতে পারব না।’ ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে আদালতে তিনি জীবনের নিরাপত্তা চাইলেন। বললেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদের নামে চোখ বেঁধে রিমান্ডে নিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টা আমাকে নিগৃহীত করা হয়েছে। আমি একজন রাজনীতিবিদ। কোনো সন্ত্রাসী নই।’ 

২৯ জানুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হন। ২০০৮’র ৯ জুন অ্যাম্বুলেন্সে করে আদালতে নেয়া হলে কাঠগড়ায় হুইল চেয়ারেও বসে থাকতে পারেননি। ১২টি মামলায় জামিন পাওয়ার পর ২০০৮-এর ৩ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তি পান। পিজি হাসপাতালে কান্নায় ভেঙে পড়া মা বেগম খালেদা জিয়ার বুকে বেদনার্ত তারেকের রোদন ও বাষ্পরুদ্ধ কথোপকথন পিজি হাসপাতালের বাতাসকে ভারি করে তুলেছিল। ১১ সেপ্টেম্বর চিকিতসার জন্য লন্ডন যাত্রা। চার বছর পেরিয়ে গেছে। আগের চেয়ে অনেক সুস্থ, তবে এখনও খুঁড়িয়ে হাঁটেন। কিন্তু কখনও পুরোপুরি সুস্থ হবেন না। তবে অসম্ভব উঁচু তার মনোবল। কত ঋজু তার আত্মিক ভঙ্গিমা — ‘তিক্ত অতীত ভুলে এখন সামনের দিকে এগোতে চাই। একদিন আমি ফিরব। বাংলাদেশ নিয়ে আমার স্বপ্নের রূপায়ন ঘটাবো।’




তারেক রহমানের জন্য মিথ্যা মামলা আর শারীরিক নির্যাতনই কি একমাত্র শাস্তি? নজিরবিহীন এক মিডিয়া-বিদ্বেষের শিকার হয়েছিলেন তিনি। এক শ্রেণীর সাংবাদিক ও সুশীল সমাজ, আওয়ামীদের কথা না হয় বাদই দিলাম, ডিজিএফআইয়ের বানানো প্রতিবেদন ও প্রদত্ত তথ্য গ্রোগ্রাসে গিলেছে আর উগড়েছে। দুর্নীতির কত না গল্প আর ভুয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির খবর ছেপেছে। সেসব লাল শিরোনাম গণতন্ত্রকেই ক্ষত-বিক্ষত করেছে। সম্পূর্ণ পরিকল্পিত ছিল ওই অপপ্রচার। এখনও কি বন্ধ হয়েছে? বর্তমান সরকার ক্ষমতায় বসেই সেই বিদ্বিষ্ট প্রচারণা, আন্তর্জাতিক মহলে তাকে বিষিয়ে তোলা, যুক্তরাজ্য থেকে তাকে ফেরত আনার জন্য মন্ত্রী পাঠানো, লবিয়িং করা, বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজে লাগানো, বহু রকমের বই প্রকাশ—কম করেনি। কিন্তু কাজ হয়নি। 

নীরবে-নিভৃতে যন্ত্রণা বুকে চেপে তিনি প্রবাসে থেকেছেন। সময়ের বিচারের আকাঙ্ক্ষায় সতর্কতার সঙ্গে নিজেকে নির্বাসিত রেখেছেন, রাজনৈতিকভাবে একা থাকার বিবাগী সৃজন সুখকে পাখা মেলতে দিয়েছেন পশ্চিমা গণতন্ত্রের এনলাইটেনমেন্টে। দুঃসহ অতীত ও বর্তমানকে সয়ে ভবিষ্যতের জন্য নিজকে ভেতর থেকে গড়ে তুলেছেন। আমার মনে হয়, তারেক রহমান তার জীবদ্দশায় কারও মানবাধিকার খর্ব করেননি, বিরুদ্ধে লেখার জন্য কোনো সাংবাদিককে গ্রেফতার করাননি, সংবাদপত্রের অফিসে তালা মারেননি, রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে কাজ করেননি। গণতন্ত্র ও সংবাদপত্র-বান্ধব জিয়া পরিবারের ঐতিহ্য তিনি সমুন্নত রেখেছেন। উল্টো অনেক মিডিয়া হাউসের জন্ম তার শুভেচ্ছায় হয়েছে, ‘সমকাল’ পত্রিকাটির ডিক্লারেশন তিনিই দিয়েছিলেন। অথচ আজকে যখন তারেক রহমানকে ‘এনিমি অব দ্য স্টেট’ বানানোর অশুভ প্রক্রিয়া চলে, আমরা নিরুচ্চার। এমনকি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী অভিজন সমাজের কেউ কেউ আছেন যারা মুখ খুলতে কুণ্ঠাবোধ করেন। আমরা সবাই বলি, আইনের শাসনে আমরা বিশ্বাস করি। আইনের শাসনের অর্থ হলো, শত অপরাধী আইনের ফাঁক- ফোকড় দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু একজন নিরপরাধ যেন কোনো শাস্তি বা দুর্ভোগ না পোহায়। তারেক রহমানের মতো নিরপরাধ ব্যক্তিকে নিয়ে যা করা হয়েছে, তা আজ পরিষ্কার। এ মুহূর্তে আইনের শাসন মানে প্রথমে তারেক রহমানের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন ও মামলামুক্ত পরিবেশে রাজনীতি করা।

তারেক-গিবত যত হয়েছে, জীবদ্দশায় আর কোনো রাজনীতিকের বেলায় এমনটি হয়নি। পবিত্র কোরআন শরীফে সূরা আসরের ব্যাখ্যায় আলেম সমাজ বলে থাকেন, কারও নামে গিবত অর্থাৎ মিথ্যা প্রচার করা হলে এই পাপের জন্য আল্লাহ গিবতকারীকে ক্ষমা করতে পারেন না। ক্ষমা করার অধিকার একমাত্র তারই আছে, যিনি গিবতের শিকার। গিবত এমনই মহাপাপ, যে ব্যক্তি অপরের নামে গিবত গায়, সে ব্যক্তির আমলনামায় তখন যে পুণ্য ছিল তা গিবতের শিকার ব্যক্তির আমলনামায় স্থানান্তরিত হয়ে যায়। তারেক রহমান নিশ্চয়ই এদিক দিয়ে ভাগ্যবান।

সবশেষে যে প্রশ্নটি ওঠা জরুরি, আগামীতে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবেন এমন কোনো রাজনীতিকের কোনো ঘোষিত স্বপ্নের জানান পেয়েছি কি আমরা? নির্দ্বিধায় বলতে পারি তারেক রহমানের কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি। মাটি ও মানুষকে জাগিয়ে বাংলাদেশকে আপন সম্পদে স্বয়ম্ভর করা, আধুনিক ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে দাঁড় করানো, প্রান্তিক মানুষকে অগ্রে রেখে রাজনীতিকে বিকাশ করা, গণতন্ত্রের আত্মাকে সজীব-সচল করা—সবই তার ঘোষিত স্বপ্ন। শহীদ জিয়ার স্বপ্নেরই এক সময়োচিত সমপ্রসারণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অথবা এর সুঠাম-স্বনির্ভর অভিযাত্রার সঙ্গে জিয়া পরিবারের যে আত্মিক বন্ধন, তার ধারাবাহিকতায় তারেক রহমান আজ অজেয় উত্তরাধিকারে স্থিত হয়েছেন। ২০০৫ সালে একটি জাতীয় দৈনিক আয়োজিত গোলটেবিল সংলাপে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার বিশ্বাস ২০২৫ সালের বাংলাদেশ হবে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, অর্থনৈতিকভাবে সফল, উন্নত একটি গণতান্ত্রিক দেশ—যাকে অন্যরা শ্রদ্ধা করবে, বিশ্ববাসী সম্মানের সঙ্গে তাকাবে। এই হচ্ছে আমার এবং আমার প্রজন্মের সব বাংলাদেশী তরুণ-তরুণীর স্বপ্ন।’ কৃষির উন্নয়ন এবং তাকে ভিত্তি করে শিল্পের বিকাশ সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রযুক্তির উন্নয়ন, কৃষকের জন্য ভালো বীজ দেয়া, গরিবের সঙ্গে হাঁস-মুরগির প্রতিপালনসহ অসংখ্য কাজে তিনি হাত বাড়িয়েছেন আগ্রহ ভরে। গ্রামে গ্রামে জরিপ চালিয়েছেন কত মাছ, ফল, ধান হয় প্রতি গ্রামে। সাগরে ও নদীতে জেগে ওঠা পলিকে সোনা বানানোর রূপকল্পও তার নাগালের বাইরে নয়। ‘একটু উদ্যোগ, একটু চেষ্টা, এনে দেবে সফলতা’—এই কর্তব্যতন্ত্রকে ছড়িয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন প্রতিটি জনপদে মানবিকতার বিকাশ হোক, সবাই সবার জন্য হয়ে উঠুক। রাজনীতি এবং উন্নয়নে এ উচ্চারণের নেতা তারেক রহমানই। বাংলাদেশের বাঁচা এর ওপরই নির্ভর করছে।

একথা খোদ তারেক রহমানও বলতে পারবেন না, অতীতে তিনি কোনো ভুল করেননি। কাজ করলেই ভুল হয়। কিন্তু অপপ্রচারের আয়তন আর ভুলের পরিসর কখনও এক রকম ছিল না তার জন্য। তিলকে তাল করা হয়েছে স্রেফ এই উদীয়মান নেতাকে রুখে দেয়ার জন্য। ‘আমাকে দিয়ে কখন কে কোন স্বার্থে কী কাজ করাতে চেয়েছে, সব সময় তা পাহারা দেয়া সম্ভব ছিল না। হতে পারে কেউ কেউ বাড়াবাড়ি করেছে। কিন্তু যখনই আমার নজরে এসেছে আমি ব্যবস্থা নিয়েছি।’ জর্জ ফ্রিডম্যান নামে আমেরিকার নামকরা রাজনৈতিক গণক ‘নেক্সট হানড্রেড ইয়ারস’ বইয়ের ভূমিকায় রাজনীতিবিদদের ভুল সম্পর্কে বলেছেন — It is the delight of all societies to belittle their political leaders and leaders surely do make mistakes. But the mistakes they make, when carefully examined, are rarely stupid. More likely mistakes are forced on them by circumstances... politicians are rarely free actors. (রাজনৈতিক নেতাদের খাটো করতে সব সমাজই এক ধরনের মজা পায় এবং নেতারা অবশ্যই ভুল করে থাকেন। তবে সতর্ক বিচারে সেসবকে আহাম্মকি বলা যাবে খুবই কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতীয়মান, পারিপার্শ্বিকতাই বাধ্য করে ভুল ঘটাতে। রাজনীতিবিদরা প্রায়ই প্রভাবমুক্ত থাকতে পারেন না।)

৪৮তম জন্মদিনে আগামীর দেশনায়ককে শুভেচ্ছা। বাংলাদেশের ভবিষ্যত তিনি। তারেক রহমানকে ধরে এনে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দিন শেষ। এ ক্ষেত্রে সরকারের তাবত ক্ষমতা নিঃশেষ আর আন্তর্জাতিক মহলেও তার সম্পর্কে বিভ্রান্তির অবসান হয়ে গেছে। তিনি কবে ফিরবেন — আজকের বাংলাদেশে একটি এক মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। কতিপয়ের ভ্রূকুটি বাদ দিলে, দেশবাসী তার বাংলাদেশ-কাঁপানো প্রত্যাবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। ৪৯তম জন্মদিন অবশ্যই বাংলাদেশে তাকে নিয়ে আমরা পালন করব ।


লেখক  —  


সম্পাদক, উইকলি ইকোনমিক টাইমস

ভাইস চেয়ারম্যান, বিএনপি 

সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব

সাবেক সভাপতি, বিএফইউজে 

[কালোত্তীর্ণ লেখাটি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান'র ৪৮তম জন্মদিনে উপলক্ষে রচিত।]