--------------------------------------
সৈয়দ আবদাল আহমেদ
--------------------------------------
কাফি খান |
আমার চোখে তিনি একজন গ্রেট স্টেটসম্যান। অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব। যাকে মুহূর্তের জন্যও খাটো করে দেখা যায় না। উঁচু দৃষ্টিতেই দেখতে হয়। সততায় তিনি নজিরবিহীন। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সত্ মানুষ। আমার ৮২ বছরের জীবনে এমন সত্ মানুষের সাক্ষাত্ কখনও পাইনি। তাকে নির্দ্বিধায় বলব, Workaholic বা কাজপাগলা একজন মানুষ। বছরের ৩৬৫ দিনই তিনি কাজ করতেন। রাতে চার ঘণ্টার বেশি ঘুমোতেন না। কী করে যে তার ব্যাটারি রিচার্জ হতো, সে রহস্য আজও জানি না। তার সব কাজই অসাধারণ। দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করা এমনি তার একটি অসাধারণ কাজ। হ্যাঁ, আমি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কথা বলছি।
প্রেস সচিব কাফি খান এভাবেই তুলে ধরলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে। ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি জিয়ার প্রেস সচিব ছিলেন তিনি। এই চার বছর তিনি তার সান্নিধ্যে থেকেছেন। তাকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে। দেখেছেন তার কাজ।
অনন্য গুণাবলী
কাফি খান একজন প্রখ্যাত গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। স্বাধীনতার আগে এবং পরে বহু বছর তিনি ভয়েস অব আমেরিকায় (ভোয়া) কাজ করেছেন, খবর পড়েছেন। দেশের রেডিও-টেলিভিশনেও খবর পড়ার ক্ষেত্রে তিনি পরিচিত মুখ ও কণ্ঠ। সূর্যকন্যা, সীমানা পেরিয়েসহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। বহুমুখী প্রতিভার সুদর্শন এই মানুষটি লেখালেখির সঙ্গেও জড়িত। নিজের একটি অ্যাডভার্টাইজিং ফার্মও গড়ে তুলেছিলেন তিনি। এখন তার অবসর জীবন। পরিবার-পরিজন নিয়ে ওয়াশিংটনে থাকেন। সম্প্রতি বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলেন। আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে তার সাক্ষাত্কার চাইলে তিনি সানন্দে রাজি হন। তার অভিনয় জীবন সম্পর্কে এরই মধ্যে একটি সাক্ষাত্কার আমার দেশ-এ ছাপা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি খুব খুশি হন। বলেন, আমার জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ সময় আমি কাটিয়েছি রাষ্ট্রপতি জিয়ার সঙ্গে। এটাকে এক ধরনের সৌভাগ্যই বলতে পারেন। সেই দিনগুলোর আনন্দিত স্মৃতিচারণ করলেন তিনি।
গুণীর কদর
সেই স্মৃতিচারণ করে কাফি খান বললেন, রাষ্ট্রপতি জিয়ার সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল না। স্বাধীনতার আগে ভয়েস অব আমেরিকায় কাজ করতাম। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রবাসে থেকে আমরাও দেশের পক্ষে কী করা যায় চিন্তা করি। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে হালকা পরিচয় ছিল। সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী হলে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি লিখেছিলাম। তিনি তার উত্তরও পাঠিয়েছিলেন। সেটি এখনও আমার সংরক্ষণে আছে। মরহুম এনায়েত করিম, এসএএমএস কিবরিয়া, আবুল মাল আবদুল মুহিত, ড. জিল্লুর খান, আশরাফউজ্জামান খান, ড. মোহসেন—আমরা মিলে ইস্ট পাকিস্তান লীগ অব আমেরিকা ওয়াশিংটন চ্যাপ্টার নামে সংগঠন গড়ে তুলি। বাংলাদেশের পক্ষে নানাভাবে জনমত গড়ে তোলার কাজ করি। আমি এ সংগঠনের ট্রেজারার ছিলাম। বর্তমান অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব তখন দূতাবাসে চাকরি করতেন। তার বাসায় একটি বা দুটি মিটিং হওয়ার পর তিনি বললেন, আমার বাসায় আর মিটিং করা যাবে না —
অসুবিধা আছে। পরে আমার ছোট বাসাতেই মিটিং হয়। বাংলাদেশের মনোগ্রাম লাগিয়ে আমি ভয়েস অব আমেরিকার অফিসে যেতাম। এ নিয়ে আমাকে অনেক বিড়ম্বনা সইতে হয়েছে। যাই হোক, সীমিত পর্যায়ে এভাবেই তখন আমরা আমেরিকায় বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে দেশে চলে আসি।
কাফি খান |
দেশে এসে রেডিও-টেলিভিশনে সংবাদ পাঠ করি। নিজের একটি ছোট্ট ব্যবসা শুরু করি—ইন্টারস্প্যান অ্যাডভার্টাইজিং ফার্ম। এভাবে কেটে যায় কয়েকটি বছর। ১৯৭৭ সাল। রাষ্ট্রপতি জিয়া তখন ক্ষমতায়। হঠাত্ একদিন বঙ্গভবন থেকে একটি ফোন পাই। রাষ্ট্রপতির এপিএস ফজলুর রহমান ফোন করে জানান, জিয়াউর রহমান সাহেব আমার সঙ্গে কফি খেতে চান। আমি বললাম, আমার সঙ্গে তো উনার কোনো পরিচয় নেই। ফজলুর রহমান বললেন—আমি তো স্যার কিছু জানি না, আপনি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাত্ করুন, কবে পারবেন? সেটা আমি বললে তো হবে না, রাষ্ট্রপতির সিডিউল অনুযায়ীই হতে হবে। দু’দিন পর বেলা ১১টায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সময় নির্ধারিত হলো। আমি বঙ্গভবনে গেলাম। এডিসি আমাকে নিয়ে রাষ্ট্রপতির কামরায় ঢুকতেই জেনারেল জিয়া চেয়ার থেকে উঠে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে আমাকে রিসিভ করলেন। পাশের সোফায় নিয়ে গিয়ে বসালেন। বললেন—কি খাবেন চা না কফি। বললাম, একটি হলেই চলবে। কফি এলো। কী জন্য ডেকেছেন কিছুই বললেন না। শুধু কি করছেন, আমেরিকা থেকে কবে এসেছেন, ছেলেমেয়ে ও পারিবারিক অবস্থা এবং ভয়েস অব আমেরিকার চাকরির কথা জানতে চাইলেন। বললেন, একাত্তরে আপনারা তো আমেরিকায় বাংলাদেশের পক্ষে অনেক কাজ করেছেন? আমি বললাম, সীমিত পর্যায়ে করেছি। আমেরিকান সরকারের চাকরি করতাম। পাকিস্তানের সঙ্গে তখন আমেরিকার সুসম্পর্ক ছিল। তারপরও যতটুকু পেরেছি, আমরা করেছি। জিয়া বললেন—হ্যাঁ, আমি সব শুনেছি। এরপরই বললেন, দেশের জন্য এখন তো আপনাদের মতো লোকদের কিছু করা দরকার। আমি বললাম, আপনারা তো দেশের কাজ করছেনই। তারপরও দেশের প্রয়োজনে যখন যা প্রয়োজন, অবশ্যই করব।
এভাবেই শেষ হলো সাক্ষাত্। কেন ডেকেছেন কিছুই বুঝতে পারলাম না। সালাম দিয়ে বঙ্গভবন ত্যাগ করি। এর প্রায় দু’মাস পর শামসুল হুদা চৌধুরী আমাকে ডাকলেন। গেলাম তার কাছে। ১৯৫১ সাল থেকেই তাকে চিনি। তাকে হুদা ভাই বলে ডাকতাম। দেখা হতেই হুদা ভাই হেসে হেসে বললেন—রাষ্ট্রপতি সাহেব তোকে তার প্রেস সচিব বানাইতে চায়। আমি বললাম—প্রেস সচিবের জন্য তো দরখাস্ত করিনি। তিনি বললেন, না রাষ্ট্রপতি সাহেবের প্রেস সচিব দরকার। যাই হোক, দু’দফায় এ নিয়ে আলাপ আলোচনার পর জয়েন্ট সেক্রেটারি স্ট্যাটাসে ৩ হাজার টাকা বেতনে প্রেস সচিব হতে রাজি হলাম। তখন সচিবদের বেতন ছিল তিন হাজার টাকা। আমাকে বেতন হিসেবে আড়াই হাজার টাকা এবং অন্যান্য এলাউন্স বাবত পাঁচশ টাকা দেয়া হলো। আর একটি বাড়ি ও একটি গাড়ির সুবিধা।
অমায়িক ভদ্রলোক
দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা
চষে বেড়িয়েছেন সারাদেশ
তিনি সারাদেশ চষে বেড়িয়েছেন। আজ চট্টগ্রাম তো কাল সিলেট। দুর্গম এলাকাগুলোতে হেলিকপ্টারে করে গেছেন। ঢাকার বাইরে প্রতি মাসে আট দশ দিন কাটাতে হতো। বিভিন্ন জায়গায় মাইলের পর মাইল হাঁটতে হতো। এমনকি একটানা চার-পাঁচ মাইল পর্যন্ত হাঁটতে হতো। রোজার দিনেও পায়ে হেঁটে বিভিন্ন এলাকায় যেতে হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে আমাদের জিভ বেরিয়ে গেছে। কিন্তু ওই লোকটার কোনো ক্লান্তি নেই। তার ব্যক্তিগত চিকিত্সক ছিলেন ডা. মাহতাবউল ইসলাম। তিনি ডিহাইড্রেশন থেকে বাঁচাতে আমাদের লেবু দিয়ে লবণ পানি খাইয়েছেন। কিন্তু জিয়াউর রহমানের ডিহাইড্রেশনের বালাই নেই। তাকেও ডা. মাহতাবউল ইসলাম ওই শরবত খেতে পরামর্শ দিতেন। কিন্তু তিনি বলতেন, ওইসব আমার লাগবে না। তার সঙ্গে হাঁটতে গিয়ে আমরা ঘামতে ঘামতে হয়রান হয়ে গেছি। সমান তালে হাঁটতে না পেরে অনেক পেছনে পড়ে যেতাম। দেখা গেছে, অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাওয়ার পর আমরা সেখানে পৌঁছেছি। তিনি বলতেন, কি ব্যাপার, আপনাদের আসতে এতো দেরি কেন? আমি বলতাম, স্যার, আপনার তো লেফট-রাইট করার অভ্যাস। আমাদের তো একটু দেরি হবেই। তিনি মুচকি হাসতেন।
মানুষের কাছাকাছি
বিরামহীন গণসংযোগে তিনি মানুষের একেবারে কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের কাছে তার ছিল ‘রাজার’ আসন। সাধারণ মানুষ তাকে ‘রাজাই’ বলত। একটা ঘটনা শুনুন। ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় খুলনা থেকে জগন্নাথগঞ্জঘাট এলাকায় আমরা ট্রেনে গণসংযোগে বেরিয়েছি। মাঝে মধ্যে পথসভা-জনসভা হচ্ছে। এমনি একদিন বিকালে একটি স্টেশনের কাছে জনসভা শেষ করে ট্রেনে উঠছি। এ সময় গায়ে ফতুয়া ও লুঙ্গি পরা একজন বৃদ্ধ এসে বললেন, মিটিং তো শেষ—‘রাজারে দেখবার পায়াম না’ অর্থাত্ তারা তাকে রাজাই মনে করতেন। যদিও জিয়াউর রহমান এ শব্দগুলো পছন্দ করতেন না।
স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে
কাফি খান বললেন, স্বজনপ্রীতি শব্দটা রাষ্ট্রপতি জিয়ার অভিধানে ছিল না। দুর্নীতি সংক্রান্ত কোনো কাজকে তিনি কখনও প্রশ্রয় দেননি। রাষ্ট্রপতির মতো এত বড় একটি পদে থেকেও তিনি অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তার কৃচ্ছ্রতা সাধন করার দৃষ্টান্ত বিরল। নিজের পরিবারের জন্য তিনি কিছুই করেননি। নিজের জন্য তো করেনইনি। আত্মীয়স্বজনদের কেউ কোনো তদবিরের জন্য বঙ্গভবনে বা তার বাসভবনে সাক্ষাত্ করতে আসবেন, সেটা ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। তেমন সাহস কারও ছিল না। অসত্ কাউকে তিনি তার কাছে ঘেঁষতে দিতেন না। প্রেস সচিব হিসেবে বঙ্গভবনে আমার অফিস থাকলেও মাঝে মধ্যে আমাকে কাজের স্বার্থে রাষ্ট্রপতির বাসভবনেও অফিস করতে হতো। সেখানে তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে একদিনের জন্যও আমি দেখিনি। তিনি ছিলেন একেবারেই অন্তপুরবাসিনী। অফিসের ধারেকাছেও আসতে পারতেন না। তিনিও আসতেন না। তাকে একমাত্র দেখা যেত রাষ্ট্রপতি জিয়া কোনো রাষ্ট্রীয় সফরে বিদেশে গেলে সেখানে তার সফরসঙ্গী হিসেবে। তাও সব সফরে নয়। যেসব রাষ্ট্রীয় সফরে প্রটোকলের প্রয়োজনে যেতে হতো, সেগুলোতেই। এছাড়া কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান বাংলাদেশে সফরে এলে রাষ্ট্রীয় ভোজে বেগম জিয়া অংশ নিতেন। সেটাও প্রটোকলের স্বার্থে। আর দুই ঈদে নামাজ পড়ার পর বঙ্গভবনের রেওয়াজ অনুযায়ী অতিথিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য তাকে আসতে হতো।
অতুলনীয় সততা
জিয়ার সততার তো তুলনাই হয় না। তিনি যে বেতন পেতেন, তা আর কত? তিন চার হাজার টাকার মতো। আমি নিজে তার বেতনের কাগজ দেখেছি। সেখান থেকে ১৫০ টাকা রাষ্ট্রপতির রিলিফ ফান্ডে জমা দিতেন। বাকি টাকাটা দিয়ে সংসার চালাতেন। জিয়া খুব পরিমিত খাবার খেতেন। তার বাড়ির হাঁড়িতে অতি সাধারণ খাবার হতো। একটা তরকারি, একটা ডাল, একটা সবজি। মন্ত্রীদের দেখেছি তার বাসায় খেতে বললে রাজি হতো না। কারণ এতটুকু খেয়ে তো তাদের পোষাবে না। রাষ্ট্রপতি জিয়া বলতেন, এর বেশি তো এফোর্ট করতে পারি না। ঢাকার বাইরে গেলে ডিসিরা খাবারের আয়োজন করত। সেখানেও কড়া নির্দেশ ছিল—একটা ভাজি, একটা ডাল, একটা মাছ বা মাংস। এর বেশি খাবার করা যাবে না।
জিয়া মিষ্টি খুব পছন্দ করতেন। খাবারে মিষ্টি থাকলে খুশি হতেন। না থাকলে আপত্তি করতেন না। তার সততার আরেকটি দৃষ্টান্ত শুনুন। তার ছেলে আরাফাত রহমান কোকো ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে পড়ত। ওই স্কুলের প্রিন্সিপাল আমার পরিচিত। তার কাছে শুনেছি, কোকো তার কাছে পড়তে আসত। তার পায়ে ছিল ছেঁড়া জুতো। একদিন প্রিন্সিপাল কোকোকে বললেন, ওই ছেঁড়া জুতো বদলাচ্ছো না কেন? কোকোর উত্তর—বাবাকে বলেছিলাম, তিনি বলেছেন কয়েকদিন পরে কিনে দেবেন। একজন রাষ্ট্রপতি তার ছেলের এক জোড়া জুতো কিনতেও হিমশিম খাচ্ছেন। একটা পুরনো হাতঘড়ি ছিল তার। ঘড়িটি খুব দামিও ছিল না। অনেকে বলত, ওটা স্যার অনেক পুরনো হয়ে গেছে। ওটা বাদ দিয়ে একটা ভালো ঘড়ি কিনুন। কারণ ওটা আর আপনার হাতে মানায় না। জিয়া শুনে শুধু মুচকি হাসতেন। একবার এক জনসভায় ভাষণ দিতে যাবার পথে দর্শকদের ভিড় ঠেলে তাদের সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে এগুনোর সময় অথবা জনসভায় ভাষণ দিয়ে ফেরার পথেও হতে পারে—ঠিক মনে নেই আমার, ঘড়িটা জিয়ার হাত থেকে খুলে পড়ে যায় অথবা খোয়া যায়। সে জন্য তার যে কি আফসোস—ঘড়িটার শোক তিনি অনেক দিন ভুলতে পারেননি।
দুর্নীতি প্রশ্রয় দিতেন না
কাফি খান বললেন, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সফরকালে প্রাপ্ত সব উপঢৌকন বা উপহার সামগ্রী তিনি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বলে গণ্য করতেন। সেসব তিনি বঙ্গভবনে তোষাখানায় পাঠিয়ে দিতেন। এমনকি তার সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া যে অল্প কয়েকবার তার সফরসঙ্গী হন, তিনিও যেসব উপহার সামগ্রী পেয়েছেন, তা ব্যবহার করতে পারেননি। তোষাখানায় জমা দিতে হয়েছে। এই লোকটাকে সত্ বলব না তো কাকে বলব? দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেয়ার আরেকটি উদাহরণ আপনাকে দিই। রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা টিমে ছিলেন কর্নেল আনিস নামে একজন কর্মকর্তা। রাষ্ট্রপতি বিদেশে গেলে কর্নেল আনিস বিদেশ থেকে ইলেকট্রনিক পণ্য নিয়ে আসত। রাষ্ট্রপতির টিমে থাকার কারণে এগুলো বিমানবন্দরে চেকিং হতো না। ফলে ডিউটিও দিতে হতো না। কর্নেল আনিস এগুলো বাইরে বিক্রি করত। এই অভিযোগ রাষ্ট্রপতি জিয়ার কানে গেলে তিনি বিদেশ থেকে আসার সময় তার টিমের সব সদস্যের ল্যাগেজ চেকিং করার নির্দেশ দিলেন। চেকিংয়ের পর কর্নেল আনিসের ল্যাগেজে চোরাই ইলেকট্রনিক পণ্য পাওয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলো।
গ্রেট স্টেটসম্যান
জিয়াউর রহমান সত্যিই একজন গ্রেট স্টেটসম্যান। বিদেশে তিনি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। বিদেশে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে তিনি ইক্যুয়াল লেভেলে কথা বলতে পারতেন। আমি দেখেছি। যুগোস্লাভিয়া তখন ভাগ হয়নি। যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রপতি মার্শাল টিটোর তখন দুর্দান্ত প্রতাপ। টিটোর সঙ্গে জিয়া এমনভাবে কথা বলছেন—মনেই হয়নি তৃতীয় বিশ্বের একজন নেতা মার্শাল টিটোর মতো একজন স্টেটসম্যানের সঙ্গে সমানতালে বৈঠক করছেন। জিয়া ধূমপান করতেন না। মার্শাল টিটো ঘন ঘন ধূমপান করতেন। টিটো জিয়াকে সিগারেট এগিয়ে দিলে তিনি তা নিয়েছেন, এবং দু’টান দিয়েছেন। কিউবার রাষ্ট্রপতি ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গেও তাকে এভাবে ইক্যুয়াল লেভেলে বৈঠক করতে দেখেছি। নর্থ কোরিয়ার ৩০তম স্বাধীনতাবার্ষিকীতে জিয়াকে প্রধান অতিথি হিসেবে দাওয়াত করা হয়েছে। ওই অনুষ্ঠানে অনেক দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান উপস্থিত ছিলেন। ইরান-ইরাক যুদ্ধে তিনি মধ্যস্থতা করেছেন। তার ওপর দুই দেশের জনগণ এবং সরকারেরই গভীর আস্থা ছিল। যুদ্ধ বন্ধে তিনিও সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন। আমি শুনেছি, তার শাহাদাতের পর ইরাকের লোকজন বলেছেন, আমাদের যুদ্ধটা মনে হয় থেমে যেত, জিয়ার মৃত্যুতে এখন এটা অনিশ্চিত।
ভিশনারি রাষ্ট্রনায়ক
রাষ্ট্রপতি জিয়াকে একজন ভিশনারি রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে উল্লেখ করে কাফি খান বলেন, আমি কাছে থেকে তার এই দূরদর্শিতা লক্ষ্য করেছি। দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরাম— সার্ক, তারই ভিশন। যদিও এই সার্কের জন্মটা তিনি দেখে যেতে পারেননি। তিনি বেঁচে থাকলে সার্ক আরও শক্তিশালী ফোরাম হিসেবে গড়ে উঠত। বাংলাদেশের ইমেজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া জিয়ার আরেক ভিশন। তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ তিনি ঘুচিয়ে দিয়ে গেছেন। তাকে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা সমীহ করতেন। জিয়ার ছিল আলাদা একটা ক্যারিশমা। মরহুম শেখ মুজিবেরও ক্যারিশমা ছিল। মজার কথা হলো শেখ সাহেব সম্পর্কে কোনো দিন কোন নেতিবাচক মন্তব্য বা তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করার মতো কোনো উক্তি জিয়ার মুখ থেকে আমি শুনিনি। আজকাল যদিও উল্টোটা দেখি। জিয়াউর রহমানের নামটা মুছে দিলেই যেন তাকে ইতিহাস থেকে মুছে দেয়া যাবে। কিন্তু তার আসন তো মানুষের হৃদয়ে।
বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন
আমি আগেই বলেছি, তার সব কাজই অসাধারণ। তার অসাধারণ কাজই হলো দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করা। দেশে বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর একদলীয় শাসন চলছিল। ওই মিলিটারি লোকটাই তো গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনলেন। জিয়াকে বলা হয় তিনি নাকি ষড়যন্ত্র করেছেন। তিনি কখন ষড়যন্ত্র করলেন? ষড়যন্ত্র তো করেছেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। তিনি তো অন্তরীণ ছিলেন। অন্তরীণ অবস্থা থেকে তাকে বের করে এনে ক্ষমতায় বসানো হয়। তার বড় এচিভমেন্ট তিনি দেশকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে গেছেন, সঠিক রাস্তায় নিয়ে গেছেন। লাইনচ্যুত গাড়িটাকে লাইনে তুলেছেন। মিলিটারি লোক হলেও তার মুখেই আমরা শুনেছি। তিনি বলছেন, সামরিক শাসন কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ জিয়াউর রহমানের আরেকটি ভিশন। অনেক বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কথা শুনলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। জিয়া বলতেন—আমরা বাঙালি তো বটেই, যেহেতু বাংলাদেশ হয়ে গেছে, সেখানে তো আমাকে দেশের পরিচয় দিতে হবে। সেটাই তো বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। আমরা বাংলাদেশ করেছি, বাংলাদেশী পরিচয় দিতে অসুবিধা কোথায়? ওই বুদ্ধিজীবীদের কথা অনুযায়ী বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বা বাংলাদেশী পরিচয় দিলে যেন বাঙালিত্ব খারিজ হয়ে যায়। আসলে বেশি বাঙালি হতে গিয়ে বাংলাদেশী পরিচয়কে আমরা গৌণ করে ফেলছি। জিয়া ছিলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের চেতনায় বিশ্বাসী একজন খাঁটি নির্ভেজাল দেশপ্রেমিক। তার প্রিয় একটা গান ছিল—প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, যেটা পরবর্তীকালে তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপি তাদের দলীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করে। ক’দিন আগে দেখলাম, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সমাবেশে এই দেশের সংস্কৃতির বিকাশে অবদান রাখার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিন দশকেরও বেশি কাল আগে রাষ্ট্রপতি জিয়া শুধু যে সেটা ভেবেছিলেন তাই নয়, তার বাস্তব রূপও দিয়েছিলেন। এসবেরই নিদর্শন শিশুদের প্রতিভা বিকাশের জন্য টেলিভিশনে নতুন কুঁড়ি অনুষ্ঠানের আয়োজন, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী প্রতিষ্ঠা, জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রবর্তন, জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার প্রবর্তন, স্বাধীনতা ও একুশে পদক প্রবর্তন এবং জিয়ার নির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় চালু হয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও সুস্থধারার ছবি নির্মাণ। উত্সাহিত করার জন্য চালু হয় অনুদান প্রথা।
বিএনপি প্রতিষ্ঠা
আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে তিনি বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মনে করতেন, বিকল্প দল না হলে গণতন্ত্র স্থায়ী হবে না। বিএনপিকে ক্যান্টনমেন্টের দল বলা হয়। ক্যান্টনমেন্টেই বলেন আর যাই বলেন, বিএনপি একটি বিশাল রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে, এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। এরশাদ তো ৯ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তিনিও তো দল করেছেন। তার দল তো এতো বিশাল হতে পারেনি। আজ এ কথা বলতে দ্বিধা নেই জিয়ার সাড়ে তিন বছরের রাজনীতিই আওয়ামী লীগের ৫০ বছরের রাজনীতিকে মোকাবেলা করছে।
দৈনন্দিন কর্মসূচি
রাষ্ট্রপতি জিয়ার দৈনন্দিন কর্মসূচি কেমন ছিল—জানতে চেয়েছিলাম। কাফি খান বলেন, রাষ্ট্রপতির দিনের কাজ শুরু হতো সকাল সাতটায়। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দু’টা হয়ে যেত। কিন্তু ভোরে ওঠে নামাজ পড়েই অফিসের জন্য তৈরি হতেন। তার দৈনন্দিন কর্মসূচি বা নির্ঘণ্ট তৈরি করতেন মিলিটারি সেক্রেটারি। সকাল ৭টার মধ্যেই তিনি অফিসে চলে আসতেন। আমি অফিসে আসতাম সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে। একটানা কাজ। দুপুরে তিনি খাওয়া ও নামাজ পড়ার জন্য এক ঘণ্টার বিরতি নিতেন। মাগরেবের নামাজের পর বিভিন্ন পেশা ও স্তরের লোকজনের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি কথা বলতেন। রাজনীতির সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা ছিল না। ফলে ওইসব বৈঠকে আমি থাকতাম না। তবে সমাজের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে মতবিনিময়ে দেশের কল্যাণের বিষয়টিই সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে। দু’টায় বাসায় ফিরলেও খুব ভোরেই তিনি ঘুম থেকে উঠে যেতেন। ফজরের নামাজ পড়ে নাস্তা সেরে অফিসের জন্য তৈরি হতেন। চার ঘণ্টার বেশি ঘুমোতেন না। কী করে যে তার ব্যাটারি রিচার্জ হতো, সে রহস্য আজও জানি না। বঙ্গভবনে ব্যক্তিগত স্টাফ কিংবা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাকে কখনও কোনো খারাপ ব্যবহার করতে দেখিনি। গাফিলতি দেখলে কিছুটা উত্তেজিত হতেন।
- লেখক সাংবাদিক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক