প্রফেসর ড. নুরুল ইসলাম ও ফারহান আরিফ
জলবায়ু সমস্যা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংকট। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা যে টেকসই অর্থনীতির কথা বলে থাকি, তা বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন। গত কয়েক দশক ধরে গ্রীণহাউজ ইফেক্টের পাশাপাশি জলবায়ু সংকটের নানাবিধ বহিঃপ্রকাশ আমাদের পৃথিবীকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে, উচ্চ তাপমাত্রা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং নদীভাঙ্গনসহ বিভিন্ন সমস্যা আমাদের বাস্তুসংস্থান পদ্ধতিকে অস্বাভাবিক করে তুলেছে। অন্যদিকে জনসংখ্যার ক্রমশঃ উচ্চহার ও সংকটকে ঘনীভূত করছে। জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে United Nations Framework Convention on Climate Change বা UNFCCC। পরিবেশ সুরক্ষার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯২ সালের ৩ জুন থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত ব্রাজিলের রাজধানি রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত ধরিত্রি সম্মেলনের মাধ্যমে UNFCCC প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলতঃ এটি একটি চুক্তি, যার আওতায় বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং টেকসই উন্নয়ন ও নিরাপদ পরিবেশ ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সভা, পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। প্রতিষ্ঠাকালে এ চুক্তিপত্রে ১৫৪টি দেশ সাক্ষর করেছিল। বর্তমানে UNFCCC তে অংশগ্রহণকারি সদস্য দেশের সংখ্যা ১৯৭ টি। উল্লেখ্য যে, এই চুক্তির আওতাতেই সাধারণত প্রতিবছর Conference of the Parties বা COP Summit অনুষ্ঠিত হয়। এ বছরের ৩১ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের Conference of the Parties বা COP- 26।
বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট নিরসনের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনের পূর্বে জলবায়ু ঝুঁকির সম্মুখীন রাষ্ট্রসমূহের অন্যতম বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণে সাড়াদানের বিষয় নিয়ে আলোচনা করা আবশ্যক। বাংলাদেশ ১৯৯২ সালেই UNFCCC চুক্তিতে সাক্ষর করে এবং ১৯৯৪ সালে তা অনুসমর্থন করে। তাছাড়া ২০০১ সালের ২২ শে অক্টোবর বাংলাদেশ ১৯৯৫ সালে গৃহীত কিয়েটো প্রটোকল অনুসমর্থন করে। উল্লেখ্য যে, জলবায়ু সংকটে ঝুঁকিতে পড়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশ্বব্যপী গ্রীণহাউজ গ্যাস নির্গমনের প্রভাবে বাংলাদেশ এই মূহুর্তে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ক্রমশঃ ঝুঁকি বাড়ছে। সুপেয় পানির অভাব, অতিরিক্ত লবণাক্ততার প্রভাবে কৃষিজমির উর্বরতা হ্রাস এবং জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক প্রভাবের ফলে বাংলাদেশ এই মূহুর্তে মানবিক সংকটের মুখোমুখি।
নব্বই দশক থেকে বৈশ্বিক জলবায়ু সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। আগামী বিশ্বের নিরাপত্তার স্বার্থে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে সাথে বাংলাদেশও সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে শুরু করে। তৎকালীন বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিল বেগম খালেদা জিয়া পরিচালিত বিএনপি সরকার। জলবায়ু সংকটের ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পেরে খালেদা জিয়ার সরকার এ বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। বিশেষ করে, উন্নত রাষ্ট্রসমূহের ঔদাসীন্যের ফলে সৃষ্ট এ সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ প্রথম থেকেই উচ্চকিত থাকে। পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পেরেই খালেদা জিয়ার সরকার বাংলাদেশের পক্ষে ১৯৯২ সালেই UNFCCC চুক্তিতে অনুসাক্ষর করে এবং পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে এর কার্যকারিতাকে সমর্থন করে। তৎকালীন বিএনপি সরকার বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় ভূমিকা রাখার পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরেও পরিবেশ সংরক্ষণে জোর দেয়। ১৯৯২ সালে বেগম খালেদা জিয়ার আন্তরিকতাতেই জাতীয় সংসদে পাস করা হয় বাংলাদেশের পরিবেশ নীতি- ১৯৯২। রিও ডি জেনিরিওতে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনের প্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ তৎকালীন বাস্তবতা অনুযায়ি বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বিবেচনায় এই নীতি গ্রহণ করে। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার তখন থেকেই টেকসই উন্নয়ন নীতির উপর গুরুত্বারোপ করে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাস্তুসংস্থান পদ্ধতি বজায় রেখে পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়ননীতিতে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। কৃষিজমির অনুর্বরতা রোধ, সুপেয় পানির সহজলভ্যতা নিশ্চিতকরণ, বায়ুদূষণ রোধ, বন সংরক্ষণ, বন্য জীবজন্তু ও মৎস্য সংরক্ষণ ও এদের প্রজনন সুরক্ষাসহ নিরাপদ বাস্তুসংস্থান নিশ্চিত করার উপর পরিবেশ নীতিতে গুরুত্বারোপ করা হয়। মোটকথা বিএনপি সরকারের গৃহীত পরিবেশ নীতির সারকথাই ছিল পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং টেকসই উন্নয়নকল্পে যথাযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ১৯৯২ সালে গৃহীত এই পরিবেশ নীতির উপর ভিত্তি করেই ১৯৯৫ সালে পাস করা হয় ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন- ১৯৯৫’। এছাড়াও ১৯৯৫ সালে গৃহীত হয় National Environment Management Action Plan (NEMAP)। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন- ১৯৯৫ এ উক্ত কর্মপরিকল্পনারও প্রভাব ছিল। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে মূলতঃ তিনটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়ঃ পরিবেশ সংরক্ষণ, পরিবেশ মানোন্নয়ন এবং পরিবেশ দূষণ রোধ ও হ্রাসকরণ। উক্ত আইনের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতিসাধন করার ক্ষেত্রে শাস্তি বিধানও করা হয়।
বিএনপি সরকারের পরিবেশ নীতির এই ধারাবাহিকতা পরবর্তী সময়েও চালু থাকে। বিশেষ করে, ২০০১ সালের অক্টোবরে তৃতীয়বারের মত ক্ষমতায় এসে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার দেশের পরিবেশ সংরক্ষণে যুগান্তকারি নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ২০০৪ সালে বেগম জিয়ার সরকার ওজোনস্তর ক্ষয়কারি দ্রব্য (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা প্রণয়ন করে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন- ১৯৯৫ এর ২০ নং ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই বিধিমালা আরোপ করা হয়। এই বিধিমালাতে ওজোনস্তর ক্ষয়কারি দ্রব্যসামগ্রীকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ধারা ৬ক- কে এই বিধিমালার মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়। এর ফলে ওজোনস্তর ক্ষয়কারী দ্রব্যের উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানী, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপিত হয়।
তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর বেগম খালেদা জিয়া সরকারের একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধকরণ। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার সকল প্রকার পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। জীবাণু বিনষ্টকরণ ক্ষমতার অভাব এবং অপচনশীল হবার ফলে এটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক হিসেবে দেখা দেয়। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে পলিথিন ব্যাগ পরিবেশের স্বাভাবিক বিকাশ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মারাত্মক বাঁধা হিসেবে প্রতীয়মান হয়। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার পূর্বে তার গৃহীত পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের প্রতিশ্রুতির আলোকে পলিথিন ব্যাগের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পাশাপাশি কাগজ, পাট ও কটনের মাধ্যমে প্রস্তুতিকৃত ব্যাগ ব্যবহারে উৎসাহিত করে। পরিবেশ সংরক্ষণের এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তৎকালীন সরকার ব্যাপক প্রচারণা চালায়। বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হচ্ছে ডিজেল বা পেট্রোল চালিত থ্রি হুইলার নিষিদ্ধকরণ এবং সিএনজি চালু করা। বায়ুদূষণের জন্য দায়ী কালো ধোঁয়া নির্গমন রোধে ঢাকা নগরীতে ২০০৩ সালে টু-স্ট্রোক পেট্রোল বা ডিজেল চালিত থ্রি হুইলার বাহন নিষিদ্ধ করা হয়। এর বদলে ১৩,০০০ টি সিএনজি চালিত থ্রি হুইলার বাহন চালু করা হয়। খালেদা জিয়া সরকারের এই উদ্যোগের ফলে নগরীতে বায়ুদূষণ বহুগুণে হ্রাস করা সম্ভব হয়। তার সে উদ্যোগের সুফল এখন দেশব্যপি সকলেই ভোগ করছে।
বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার UNFCCC এর আওতাভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক আয়োজিত সপ্তম অধিবেশন তথা কপ-৭ কে গুরুত্ব সহকারে নেয়। এর প্রতি সাড়া দিয়ে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় National Adaptation Programme of Action for Bangladesh (NAPA) –এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। এর আগে ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত National Adaptation Programme of Action (NAPA) প্রস্তুতকরণের লক্ষ্যে আয়োজিত এক ওয়ার্কশপে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন কিছু দেশের মানুষের জন্য জীবনযাত্রার সংকট; আর কিছু দেশের মানুষের জন্য খোদ জীবনের জন্যেই সংকট বয়ে আনছে।’ তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু পরিবর্তনকে বিশেষ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করে। এ বিবেচনায় উন্নয়ন নীতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যাচাই করা হয়। বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটের ফলে বাংলাদেশের মত ঝুঁকিতে থাকা রাষ্ট্রগুলোর জন্য টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনার উপর জোর দেয়া আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের পরিকল্পনা প্রণয়নে উদ্যোগ নেয়া হয়। এরই বহিঃপ্রকাশ ২০০৫ সালে প্রকাশিত National Adaptation Programme of Action (NAPA)। একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এ পরিকল্পনার আলোকে বেশ কিছু আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতী গ্রহণ করে। মূলতঃ NAPA –ই হচ্ছে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনকার দায়ী উপাদানসমূহ হ্রাসকরণের সূচনা। পরবর্তীতে এর উপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় নিজেদের ভূমিকা রাখতে শুরু করে। এ পরিকল্পনা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ United Nations Framework Convention on Climate Change (UNFCCC) এবং কিয়েটো প্রটোকলের প্রতি নিজেদের কৃত অঙ্গীকার বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়। বেগম খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে স্বল্পোন্নত দেশসমুহের জন্য জলবায়ু সংকট মোকাবিলার্থে, বিশেষ করে NAPA –এর সফল প্রয়োগের জন্য প্রত্যাশিত বরাদ্দ পাওয়ার দাবী জানায়।
খালেদা জিয়া সরকার ২০০৬ সালে শব্দদূষণ রোধে আরেকটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। এই নীতিমালা ‘শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা- ২০০৬’ নামে পরিচিত। উক্ত নীতিমালার আলোকে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ, যানবাহনের হর্ণ ব্যবহারের বিধিমালা, বিভিন্ন শব্দযন্ত্রের ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্থানাবিশেষ নীতিমালা ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয়।
পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণে বেগম খালেদা জিয়ার আন্তরিকতা প্রণিধাণযোগ্য। তিনি সর্বপ্রথম সামাজিক বনায়ন কর্মসূচী গ্রহণ করেন। তার সরকারের আমলে ব্যাপকহারে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। স্কুল, কলেজসমূহের পাঠ্যসূচীতে বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতায় গাছের চারা উপহার দিতে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলার উপর জোর দেয়া হয়। এছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ির আঙিনাসহ উপযুক্ত স্থানে বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে গণমাধ্যমে সরকারিভাবে সচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে ব্যাপকতর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বেগম খালেদা জিয়ার বৃক্ষরোপণের প্রতি আগ্রহ ও আন্তরিকতার প্রভাব এখনো জাগ্রুক রয়েছে। তার নেতৃত্বাধীন দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনসমূহকে বিভিন্ন উপলক্ষে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্যোগ নিতে দেখা যায়। এছাড়াও জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় খালেদা জিয়ার সরকার ক্লিন এনার্জি প্রকল্প (বিশেষ করে সোলার বিদ্যুৎ প্রকল্প) এবং বর্জ্য রিসাইক্লিং প্রকল্প গ্রহণ করে। যার সুফল বাংলাদেশের মানুষ এখন ভোগ করছে।
বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধকল্পে ঢাকার হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি অপসারণ তার শাসনামলেই শুরু হয়। যানজট এবং এর দ্বারা সৃষ্ট বায়ু ও শব্দদূষণ রোধের লক্ষ্যে তিনি ঢাকা শহরকে ঘিরে চারদিকে ওয়াটার সার্কুলার ওয়ে গড়ে তোলার প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
ভৌগলিক অবস্থানের নিরিখে বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দূর্যোগ প্রবণ দেশ। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এখানে প্রচুর ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত গ্রীণহাউজ গ্যাস নির্গমনের ফলে এ অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপকতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার এ সকল প্রাকৃতিক দূর্যোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে ব্যাপক ভূমিকা নেয়। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলসমূহে সাইক্লোন রোধে এক কোটি নারকেলের চারা রোপন করা হয়। এছাড়াও উপকূলীয় অঞ্চলসমূহে কয়েক হাজার সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ করা হয়। খালেদা জিয়া সরকারের একটি অভিনব উদ্যোগ হচ্ছে স্কুল ভবন কাম সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ। তার শাসনামলে উপকূলীয় এলাকাসমূহে প্রায় প্রতিটি স্কুলকেই সাইক্লোন শেল্টারে রূপান্তরিত করা হয়।
বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপি সরকারের পরিবেশবান্ধব এসব উদ্যোগ একেবারেই নতুন নয়। এর পথিকৃৎ ছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তিনি তার শাসনামলে নদী ও খালখনন কর্মসূচী চালু করেছিলেন। বাংলাদেশের কৃষিবান্ধব অর্থনীতির সমৃদ্ধি অর্জনের পথে জিয়ার খালখনন কর্মসূচি এক বিরাট মাইলফলক। এছাড়াও তিনি তুরাগ নদীসহ অসংখ্য খালবিল দখলমুক্ত করেছিলেন। জিয়াউর রহমান বৃক্ষপ্রেমী ছিলেন। তিনি সড়ক ও রেলপথের দুই ধারে ফলের গাছ লাগান এবং এতে সকলকে উৎসাহিত করেন। শহীদ জিয়ার বৃক্ষপ্রেমের এক সুমহান স্মারক হয়ে আছে পবিত্র আরাফাতের ময়দান। প্রতিবছর হজ্বব্রত পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে গমনকারি লাখো-কোটি হাজীদের আরাফাতের ময়দানে প্রখর রৌদ্রতাপে শীতল ছায়া দিয়ে যাচ্ছে জিয়ার নিজের হাতে রোপন করা কয়েক লক্ষ নিমগাছ। সৌদি আরবের আরাফাতের ময়দানে শীতল ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেসব নিমগাছ হাজীদের কাছে ‘জিয়া ট্রি’ নামে খ্যাত।
বস্তুতঃ পরিবেশ খাতে বাংলাদেশের বুনিয়াদি সকল পদক্ষেপই বেগম খালেদা জিয়া সরকার কর্তৃক গৃহীত। এদেশের পরিবেশ উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় বেগম খালেদা জিয়ার গৃহীত উদ্যোগসমূহ রোল মডেল হয়ে আছে। এর উপর ভিত্তি করেই বর্তমান সময়ে দেশে প্রচলিত টেকসই উন্নয়নের ধারা অব্যহত রয়েছে। সাধারণতঃ জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের মত স্বল্পোন্নত এবং ঝুকিপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর তেমন বৃহৎ কিছু করার থাকে না। উন্নত দেশগুলোর ভূমিকা এখানে বড় নিয়ামক। তথাপিও বাংলাদেশের জন্য যা করা উচিত, সেটা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ সমস্যা রোধে আন্তরিক হওয়া। বিশ্ব দরবারে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নিজেদের ঝুঁকিসমূহকে যৌক্তিক ও দালিলিকভাবে তুলে ধরে ধনী রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে নিজেদের প্রাপ্য বুঝে নিতে হবে। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে চলমান কপ-২৬ সম্মেলনে বাংলাদেশের জন্য বেগম খালেদা জিয়ার তিনবারের শাসনামলে গৃহীত বিভিন্ন পরিকল্পনাসমূহ পথিকৃৎ হতে পারে। একইসাথে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে শহীদ জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার উদ্যোগসমূহ যে কোন সরকারের জন্যই অনুসরণীয়।
লেখক পরিচিতি
- ড. নুরুল ইসলাম, অধ্যপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
- ফারহান আরিফ, সদস্য (আহবায়ক কমিটি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল।