Search

Saturday, April 9, 2016

সরেজমিনে গন্ডামারা, বাঁশখালী - ৫টি মর্মান্তিক মৃত্যু

By Mahbub Sumon

৫ এপ্রিল রাতে নৃবিজ্ঞানী নাসরিন সিরাজ, ছাত্র ফেডারেশন চট্টগ্রাম নগরের প্রেসিডেন্ট ফরহাদ জামান, ও আমি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বাঁশখালীর আহতদের দেখতে যাই। প্রথম কিছুক্ষণ উদভ্রান্তের মত ঘুরতে হল। কারণ আমরা যেসব ওয়ার্ডে আহত লোকজন আছে বলে জেনে এসেছি বাস্তবে গিয়ে দেখি সেখানে কেউ নেই। ঘুরতে ঘুরতে কিছুক্ষণ পর আসল ঘটনা টের পাই। ৫৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৩২০০ জনকে অজ্ঞাত উল্লেখ করে বাঁশখালী হত্যাকাণ্ডের আহত এবং নিহতদের আত্মীয় পরিজনের নামেই মামলা দেয়া হয়েছে। এখন যাকে যেখানে পাওয়া যাচ্ছে তাকেই এরেস্ট করে ফেলা হচ্ছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া অবস্থায় বেশ কিছু লোক এরেস্ট হয়, সেকারণে আমাদের দেখে কোন পক্ষের লোক তা নিশ্চিত হতে না পেরে হাসপাতালের আহত লোকেরাই তাদের পরিচয় গোপন করে। ২৬, ২৭, ২৮, ১৯, ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডের নার্স রুমে কথা বলে কিছু লোকের নাম ঠিকানা জানা গেল। আমাদের বলা হল যাদের হাতে পায়ে মাথায় নতুন ব্যান্ডেজ, হাতে হ্যান্ড কাফ আর মাথার দুই দিকে দুইজন করে পুলিশ দেখবেন ওরাই বাঁশখালির আহত রোগী। সেইভাবে আমরা নতুন চোখে খোঁজা শুরু করলাম। এই দফায় ৫ জনকে পেলাম। নুরুল ইসলাম, জহিরুল ইসলাম, মুজিব, আউয়াল এবং আব্দুল আলিম। কারো পায়ে, পিঠে, গলায়, পেটে গুলি লেগেছে। কারো অপারেশন করে গুলি বের করা হয়েছে, কারো এখনো গুলি বের করা হয়নি। ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। তারা এত অসুস্থ যে তাদের পক্ষে নিজের পায়ে ২ কদম হেঁটে যাওয়া সম্ভব না। অথচ এদের একহাতে হাত কড়া, কোমরে মোটা রশি দিয়ে বেঁধে হাসপাতালের বিছানায় ফেলে রাখা হয়েছে। আর মুনকার নকিরের মত দুই শিয়রে দুইজন পুলিশ। মুজিব নামের একজনের গলা দিয়ে গুলি ঢুকে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এখনও রক্তক্ষরণ চলছে। সাথে তার বড় ভাই, কিছুক্ষণ পর পর তুলা দিয়ে মুখের রক্ত মুছে দিচ্ছেন। আমাকে দেখে আধা শোয়া অবস্থা থেকেই হাত উঁচু করে ইশারায় দেখানোর চেষ্টা করছিলেন যে তিনি আমাকে চিনতে পেরেছেন। আমি কয়েকদিন আগে ২৫ মার্চ ২০১৬ এস আলম গ্রুপের কয়েকটি গাড়ি পুড়ে দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামবাসীর উপর পুলিশের লাঠি চার্জ এবং হালকা গুলিবর্ষণের ঘটনা শুনে এবং বাঁশখালির অধিবাসী আমানুল ইসলাম (প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, যুব ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম), এডভোকেট ইকবাল, আবু বকর, অমৃত সহ গন্ডামারা ইউনিয়নের বেশ কিছু ছাত্র শিক্ষকের আহ্বানে গন্ডামারা ইউনিয়নে যাই। বাঁশখালিতে সেদিন ঢুকার পর তাদের যে অবস্থা দেখেছি তা এক কথায় আগ্নেয়গিরির লাভা উদ্গিরনের আগের অবস্থার সাথে তুলনা করা যায়। আমাদেরকে তারা বিশ্বাসই করছিলেন না। আমাকে উদ্দেশ্য করে তারা বললেন আপনি এস আলম গ্রুপের লোক হলে আজকে এখান থেকে কাপড় চোপড় নিয়ে যেতে পারবেন না। বললাম আপনাদের মত আমিও কয়লা বিদ্যুতের বিপক্ষে। বলল (পরীক্ষা করে দেখছিলেন) আচ্ছা বলেনতো কেন আপনি কয়লা বিদ্যুতের বিপক্ষে? আমি বললাম কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হলে জমি নষ্ট হবে মাটি নষ্ট হবে পানি দুষিত হবে মানুষের ক্যান্সার হবে, বিকলাঙ্গ শিশু জন্মাবে। এরকম হাজারো ঘটনা ঘটবে। এই দফায় চায়ের দোকানে আমাদের ঘিরে ধরা লোকজনের মুখের পেশি আস্তে আস্তে শিথিল হওয়া শুরু করল। একজন বলল আপনি আমাদের পক্ষে কথা বলসেন, এই জন্য আপনাকে আমরা চা খাওয়াব। নাইলে আপনার আজকে খবর নিয়া ছাড়তাম। বাঁশখালি মানুষের এরকম তেজ আমাকে বিস্মিত করেছিল সেদিন। ফুলবাড়ি, রামপালে নিশ্চিতভাবেই এরকম দৃশ্য দেখিনাই। এটা অনেক উত্তপ্ত। যদিও ফুলবাড়িতেও কয়লার জন্য মানুষের প্রাণ গেছে। সেখান থেকেও এশিয়া এনার্জি এবং তাদের দেশীয় দোসররা চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল।

গত দুই মাস ধরেই চট্টগ্রামের স্থানীয় পত্রিকা ও অন্যান্য সূত্রে শোনা যাচ্ছিল যে এস আলম গ্রুপ চট্টগ্রামের বাঁশখালি উপজেলার ৯ নম্বর গন্ডামারা ইউনিয়নে ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে যাচ্ছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য স্থানীয় জনগণকে ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং কোথাও কোথাও জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে জমি দখল করছে। বাঁশখালি এবং গন্ডামারা এলাকার কৃষক, ছাত্র, শিক্ষক, সাধারণ মানুষ ইন্টারনেট, পত্রিকা সহ নানান উৎস থেকে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষতিকর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানতে পারেন। রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সুন্দরবন নিয়ে জাতীয় কমিটির লং মার্চ এবং আরো অনেক ধরনের পরিবেশগত প্রচার প্রচারনা থেকে তারা নিশ্চিত হয় এই কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র তাদের নিঃস্ব করে দিবে। পরিবেশ এবং কয়লা বিদ্যুৎ নিয়ে তাদের সাধারণ জ্ঞান এবং সচেতনতার স্তর অবাক করার মত। ফলে বাঁশখালি গন্ডামারার অধিবাসীরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই ১/ জীবিকা হারনোর আশঙ্কায় ২/ ভিটা-মাটি হারানোর আশঙ্কায় ৩/ পরিবেশগত ক্ষতির কথা বিবেচনা করে এই কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরোধিতা করতে শুরু করেন। প্রথম দিকে এই বিরোধিতা চায়ের দোকানগুলোতে সীমাবদ্ধ ছিল। ক্রমান্বয়ে তা সারা গন্ডামারা ইউনিয়ন এবং পুরো বাঁশখালিতে ছড়িয়ে পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গন্ডামারা ইউনিয়নে ‘ভিটা মাটি রক্ষার আন্দোলন’ নামে বেশ কয়েকটি বড় ধরনের গণজমায়েত এবং সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। যেসব সমাবেশে ১৮ থেকে ২০ হাজার মানুষ উপস্থিত ছিল বলে স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে জানা যায়। মার্চ মাস পর্যন্ত কিছুকিছু সমাবেশে পুলিশের গুলি, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া এবং হতাহতের খবর চট্টগ্রাম অঞ্চলের স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত হতে থাকে।

এস আলম গ্রুপের আয়োজনে অন্য এক সমাবেশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে বলেন ‘কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করলে তেমন কোন পরিবেশ দূষণ হবেনা এবং হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে’। বক্তৃতায় তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেন যে কোন স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করতে গেলে যদি নির্মাণস্থলে একটি দুটি আম গাছ পড়ে, সেই আম গাছটিকে কেটে ফেলতে হয়। এরকম ঘটনায় তেমন কোন পরিবেশ দূষণ হবেনা এবং ৮০% লাভের জন্য ২০% ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে। এ ধরনের যুক্তি উপস্থাপন করায় এলাকাবাসী আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং ক্রমান্বয়ে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যায়।



২৫ তারিখে গন্ডামারা ইউনিয়নে ঢুকলে দেখা যায় চারপাশের প্রায় সকল জমিতে এস আলম গ্রুপ তাদের দখল চিহ্নিত করে খুটি গেঁড়ে রেখেছে। স্থানীয় লোকজনের মতে অল্প কিছু জমি এস আলম গ্রুপ ক্রয় করেছে। ক্রয় প্রক্রিয়াধীন থাকা অবস্থায় স্থানীয় লোকজনকে তারা বলেছিলেন এখানে রফতানি যোগ্য তৈরি পোশাক শিল্প কারখানা এবং সেসব রফতানি করার জন্য সমুদ্র বন্দর স্থাপন করা হবে। যার মধ্য দিয়ে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এলাকার উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানের আশায় স্থানীয় লোকজন কিছু জমি এস আলম গ্রুপের কাছে বিক্রি করে। কিন্তু কিছুদিন পরেই ‘এস এস পাওয়ার ১ লিমিটেড এবং এস এস পাওয়ার ২ লিমিটেড’ নামের সাইনবোর্ড দিয়ে এস আলম গ্রুপ নির্মাণ কাজ শুরু করলে এলাকাবাসী বিভ্রান্ত হয়ে যায়। তারা বুঝতে পারে তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে । বিভিন্ন সুত্র থেকে জানতে পারেন যে গোপনে এস আলম গ্রুপ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা আরিফুল্লার সাহায্যে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জোরপূর্বক জমি দখল এবং সরকারী খাস জমি বন্দোবস্ত নেয়ার চেষ্টা করছে। যেখানে এলাকাবাসীর কর্মসংস্থানের তেমন সুযোগ নেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং চট্টগ্রাম শহরের মহসিন কলেজ, সিটি কলেজ সহ অন্যান্য কলেজে অধ্যয়ন এবং কর্মরত গন্ডামারার ছাত্র শিক্ষকরা পত্র পত্রিকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে জানতে পারেন যে এস আলম গ্রুপের করা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে তারা ক্রমান্বয়ে ভূমিহীন এবং এখানে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ হবে। এসব জানতে পেরে এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তারা এস আলম গ্রুপের কাছে আর জমি বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং ইতোমধ্যে যেসব জমি এস আলম গ্রুপের হাতে গিয়েছে সেসব ফেরত চায়। প্রতিক্রিয়ায় এস আলম গ্রুপের নাসির গং এবং তার গুন্ডা বাহিনী ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে বেশ কিছু জমি জোরপূর্বক খুঁটি গেঁড়ে দখল করে। আশেপাশের লোকজনকে হুমকি দেয় যে তাদেরকেও ক্রমান্বয়ে এলাকা ছাড়া করা হবে।

এস আলম গ্রুপের এসব কাজে সহায়তা করে ইউপি চেয়ারম্যান মাওলানা আরিফুল্লা এবং স্থানীয় ভুমি প্রশাসনের দায়িত্ব প্রাপ্ত সরকারী কর্মচারীগন। পরবর্তীতে ভুমি প্রশাসন গন্ডামারার জমির ভুয়া কাগজপত্র তৈরি প্রক্রিয়ায় জড়িত একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায় যে গত ২/১১/২০১৫ ইং তারিখে সহকারী ভুমি কর্মকর্তা আশরাফুল আলম কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার জন্য এস আলম গ্রুপের পক্ষে নতুন করে ৩১০০ একর জমি ক্রয়ের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পেশ করেন। যেখানে ইতোমধ্যে ৬৬০ একর জমি ক্রয় করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় এবং এর বাইরে আরো ৭০০ একর সরকারী খাস জমি এস আলম গ্রুপের নামে বরাদ্দ দেয়ার সুপারিশ জানান।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায় এস আলম গ্রুপ কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার জন্য গন্ডামারা ইউনিয়নের পূর্ব বরগনা, পশ্চিম বরগনা এবং গন্ডামারা এই তিনটি মৌজায় ৪৪০০ একর জমি নেয়ার চেষ্টা করছে। এই পুরো এলাকায় প্রায় ৫০ হাজারের বেশী মানুষের বাস। সরকারী ভোটার তালিকার লিপিবদ্ধ ভোটারের সংখ্যা ২৮ হাজারের বেশী। যেখানে ৭ হাজারের বেশী পরিবারের বাস করে সেখানে ভুমি কর্মকর্তা আশরাফুল আলম মাত্র ১৫০ টি পরিবার দেখিয়ে এই ১৫০ পরিবারকে পুনর্বাসনের প্রস্তাব দিয়ে এস আলম গ্রুপের পক্ষে ভুমি ক্রয়, অধিগ্রহণের এবং বন্দোবস্তের প্রস্তাব দেন। এই তিনটি মৌজায় আরও আছে প্রায় ৭০টি মসজিদ, মক্তব, বেশকিছু কবরস্থান এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্মশান, ১টি কারিগরি স্কুল, ১টি হাই স্কুল, ৫টি কওমি মাদ্রাসা, ২টি আলিয়া মাদাসা, ৮টি প্রাইমারী স্কুল, ৫টি বাজার, ২০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র, ১টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ১টি জেটি। একইসাথে যা প্রায় ৫০০ একর জুড়ে লবণের ঘের, ১৮০০ একর ধান চাষের জমি এবং বর্ষা মৌসুমে ৫০০ একর জমির চিংড়ি ঘের এবং প্রায় ১৫০০ একর ম্যানগ্রোভ বনভুমি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।






গন্ডামারা এলাকা ঘুরে দেখার সময় প্রথমেই দেখতে পাই প্রায় ১৩টি সিএনজিতে করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ করতে আসা শ্রমিকরা তাদের বিছানা বালিশ মাল পত্র নিয়ে সাইট থেকে চলে যাচ্ছেন। কিছুটা দূরে এস আলম গ্রুপের একদল লোকের সাথে দেখা হয়। সেখানে মামুন সহ আরো বেশ কয়েকজনকে স্থানীয়দের ভয়ভীতি দেখাচ্ছিলেন। তারা অনুসন্ধানকারীদের পরিচয় জিজ্ঞেস করেন এবং একপর্যায়ে বলেন ‘কোন পরিবেশ দূষণ হবেনা’, ‘এসব কথার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই’। অনুসন্ধানকারীদের জানান যে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হয়ে পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরেছেন এবং দেখেছেন যে সেসব জায়গায় কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে সেখানে কোন দূষণ নাই। কথা প্রসঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করা হয় তিনি কোন কোন দেশে গিয়েছেন। জবাবে জানান মালি, সেনেগাল এবং কঙ্গো সহ কয়েকটি দেশে তিনি সফর করেন। উল্লেখ্য আফ্রিকার দরিদ্রতম এসব অধিকাংশ দেশেই কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নেই। যেসব দেশে আছে সেখানে আবার সবার ঢুকার অনুমতি নেই। এ প্রসঙ্গে তাকে জিজ্ঞাসা করা হল যে ‘আপনি কি কোন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভেতরে পরিদর্শন করেছেন?’ জবাবে তিনি ‘না’ বলেন। তাহলে আপনি যেসব কথা বলছেন যে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করলে পরিবেশের কোন ক্ষতি হবেনা এবং হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে তার ভিত্তি কি? জবাব না দিয়ে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন যে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করলে যে পরিবেশের ক্ষতি হবে তার ভিত্তি কি? আমরা বললাম আপনার মোবাইল সহ এখানে সবার মোবাইলে ইন্টারনেট আছে। একটু কস্ট করে গুগলে সার্চ দিয়ে দেখেন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাল মন্দ কি? তথ্য এখন সবার কাছে আছে। আপনি চাইলেই লোকজনকে উল্টা পাল্টা বুঝাতে পারবেন না।
পরবর্তীতে কয়লা বিদ্যুতের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া ছাত্র সাদ্দাম, নুর মোহাম্মদ, আবু বকর, আব্দুস সালেক সহ স্থানীয় শিক্ষক মোহাম্মদ জালাল চৌধুরী, কফিল উদ্দিন আহাম্মদ, এডভোকেট ইকবাল এবং আমানুল ইসলাম সহ সাধারণ লোকজনের সাথে কথা বললে তারা জানান, গন্ডামারা ইউনিয়নের বেশীরভাগ শ্রমজীবী। কিছু জমিতে ফসল উৎপাদন হয়। তবে বেশিরভাগের আয় বর্ষা মৌসুমে চিংড়ি আরোহণ এবং বছরের বাকি সময়ে লবণ চাষ। এখানে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হলে প্রথমত তারা ভূমিহীন হবেন, দ্বিতীয়ত তারা তাদের কর্মসংস্থান হারাবেন। তাদের পক্ষে বাপ দাদার ভিটা মাটি কবর ছেড়ে উপজেলা শহরে কিংবা আরো দূরে গিয়ে বাড়ি, জমি ক্রয় করা সম্ভব নয়। কয়েকদিন আগের একটি ঘটনা উল্লেখ করে তারা বলেন যে এস আলম গ্রুপ একটি গভীর নলকূপ স্থাপন করে পানি উঠানো শুরু করেছে। যার প্রভাবে ইতিমধ্যে সারা গন্ডামারা ইউনিয়নে টিউবওয়েলে পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। যদি এস আলম গ্রুপ এখানে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করে এবং প্রতিদিন কোটি কোটি লিটার পানি উঠায় তাহলে এলাকাবাসীর বেঁচে থাকাটাই কঠিন হবে। সেকারনে প্রান থাকতে তারা এস আলম গ্রুপকে এখানে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে দিবেনা। স্থানীয় চেয়ারম্যান মাওলানা আরিফুল্লাহ, সহকারী ভুমি কর্মকর্তা আশরাফুল আলম, এস আলম গ্রুপের স্থানীয় প্রতিনিধি নাসির, মামুনদের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে এলাকার লোকজন ক্রমেই আরো বেশী বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল। এস আলম গ্রুপের কাউকে এমনকি কোন কিছুকেই এলাকার মানুষ সহ্য করতে পারছিলেন না।

গত ৪ এপ্রিল ২০১৬ ইং তারিখে বিক্ষুব্ধ জনগণ সাবেক চেয়ারম্যান লিয়াকত আলির নেতৃত্বে মধ্যম গন্ডামারা হাজিপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সমাবেশ আহ্বান করে। সমাবেশে লোকজন জড় হতে শুরু করলে এস আলম গ্রুপের ২০ থেকে ২৫ জন বেশ কয়েকটি মোটর সাইকেলে চেপে সমাবেশস্থলে আসে এবং বলে এখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। সাথেসাথে এলাকাবাসী আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এর কিছুক্ষণ পরই সমাবেশকে লক্ষ করে মোটর সাইকেল বাহিনী এবং পুলিশের সম্মিলিত গুলিবর্ষণ শুরু হয়। গুলিতে ঘটনাস্থলেই চারজন প্রাণ হারান এবং শতাধিক আহত হন। আতংকিত লোকজন সমাবেশস্থল ছেড়ে চলে যেতে চাইলে তাদের বের হতে না দিয়ে বলা হয় ‘তোদের এখানেই আটকে রেখে মারবো’। পরবর্তীতে বেশ কয়েকজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সাবেক চেয়ারম্যান লিয়াকত আলি একই পরিবারের তিনজন সহ জাকের আহম্মদ, মরতুজা আলি, আনোয়ার আলি, জহির, জাকের হোসেন এই পাঁচজনের মৃত্যু সংবাদ নিশ্চিত করেন।

৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম শহর থেকে জাতীয় কমিটির একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে আমরা আবার গন্ডামারা ইউনিয়নে যাই। ঐতিহাসিক জলকদর খালের উপর নির্মিত ব্রিজ পার হতেই দূর থেকে দেখা যায় গন্ডামারার অগুনিত মানুষ উৎসুক হয়ে দূর থেকে তাকিয়ে আছে। উদ্দেশ্য তাদের আন্দোলনের পক্ষের লোক হলে ঢুকতে দিবে। কাছে গিয়ে পরিচয় দিলাম, বললাম আমরা আপনাদের দেখতে এসেছি। আমাদের ১২/১৩ জনকে তারা সাদরে গ্রহণ করে নিয়ে চলল ঘটনাস্থলের দিকে। পথের মধ্যে গুলি খাওয়া অনেক আহত মানুষ দেখলাম ব্যান্ডেজ পরে আমাদের সাথেই হঁটেই কিংবা স্লোগান দিয়ে চলছে। বাজার পার হয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর একটা মাটির বাড়ি। দেয়ালে গুলির দাগ। একজন এগিয়ে এসে বলল তার স্ত্রী ছোট বাচ্চাকে আগলে ধরে ঘরের মধ্যে বসে ছিল। পুলিশের পোশাক পরা এস আলমের লোকেরা (পুলিশ নয়) বাইরে থেকে দৌড়ে এসে কুলসুমা বেগমকে পাঁজরে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে দেয়। জিজ্ঞেস করলাম আপনি কিভাবে বুঝলেন তারা পুলিশ নয়? বললেন এদেরকে আমরা আগে থেকেই চিনি, এরা এলাকার লোক। এস আলমের পক্ষে কাজ করছে। এরা পুলিশে চাকরি করেনা। বাড়ির উঠানে দেয়ালে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ দেখতে দেখতে আমরা স্কুল মাঠের দিকে রওয়ানা দিলাম। যেখানে সমাবেশ এবং মূল গোলাগুলি হয়েছিল।





সমাবেশস্থলে এখনো রক্তের দাগ শুকায়নি। আমাদের দেখে অনেক মানুষ ছুটে আসলো। সবাই তাদের সেদিনকার রোহমর্ষক অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে সেদিন নিরস্ত্র মানুষদের লক্ষ্যকরে এক হাজারের বেশী গুলি এবং টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়েছে। এস আলমের গুন্ডা বাহিনী নাকি তাদের মালিককে দেখাতে চেয়েছিল তারা কত ভাল কাজ করে। এখানে জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে বেশ কয়েকজন বক্তৃতা দেয়ার পর আমরা মাওলানা বশির সাহেবের বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম। পথে পথে বহু লোক, বহু নারী আমাদের দেখে দাড়িয়ে কথা বলল, তাদের শরীরে গুলির দাগ, ব্যান্ডেজ দেখাল। বলল টিভিতেও আমাদের খবর ঠিক মত দেখাচ্ছেনা, আমাদের কথাও শুনাচ্ছেনা। আপনারা দয়া করে আমাদের কথাগুলা পৌঁছে দিবেন। তাদের কথা শুনলাম। সব ঘটনার প্রায় একই বর্ণনা। সমাবেশ উপলক্ষে সবাই জড় হয়েছিল। ১৪৪ ধারার কোন পূর্ব ঘোষণা মাইকিং কিছুই হয়নি, হঠাৎ সমাবেশ লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি চালানো হয়। যাই হোক এখান থেকে সামনে মাওলানা বশিরের বাড়ির দিকে এগুতে থাকলাম। সেখানে আরো হৃদয়বিদারক দৃশ্য। ৪ তারিখের গুলি বর্ষণে মাওলানা বশিরের আপন দুই ভাই এবং তার ভাস্তি জামাই নিহত হন। প্রথমে তার বড় ভাইকে গুলি করা হয়, তাকে বাঁচানোর জন্য অন্য ভাই ছুটে গেলে তাকেও গুলি করা হয়, তাকে বাঁচানোর জন্য তার মেয়ের জামাই ছুটে গেলে তাকেও গুলি করা হয়। তিনজনই ঘটনাস্থলে নিহত হন। তিনজনকে পাশাপাশি দাফন করা হয়েছে। আসার সময় আমারা আলাপ করছিলাম কয়লা ফুলবাড়িতে মানুষের প্রাণ নিয়েছিল, এখানেও মানুষের প্রাণ নিল। ভবিষ্যতে না জানি আরো কত নিরীহ মানুষকে কয়লার জন্য প্রাণ দিতে হয়।










একটি স্থানে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হলে সে স্থান সহ তার আশেপাশের চারশ থেকে পাঁচশ বর্গকিলোমিটার এলাকার পানিতে বিষ ছড়িয়ে পড়ে, মাটি বিষাক্ত হয়ে যায়, বাতাসে বিভিন্নরকম ক্ষতিকর গ্যাস মিশতে থাকে, যার ফলে মহামারি আকারে স্থানীয় জনগনের এজমা, হাঁপানি দেখা দেয়, গাছপালা, সবজি, গুল্ম বিষাক্ত হয়ে পড়ে, ফসল উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মাছ মানুষ পশু পাখি গরু ছাগলের ক্যান্সার, শারীরিক প্রতিবন্দি শিশুর জন্ম , বিকলাঙ্গতা সহ ভয়ানক সব রোগে আক্রান্ত হয় এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনে ভূগর্ভস্থ জলাধার থেকে প্রতিদিন এক থেকে দেড় কোটি লিটার সুপেয় পানি উত্তোলন করার কারণে আশেপাশের বিশাল এলাকায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। সার্বিক বিচারে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র এক ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসে। এধরণের একটি ক্ষতিকর প্রকল্প করার জন্য চীনা কোম্পানি SEPCOIII Electric Power Construction Corporation এর সাথে বাংলাদেশের এস আলম গ্রুপের চুক্তি সম্পাদন, নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করা এবং তার ফলশ্রুতিতে স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠীর উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, হত্যার তীব্র নিন্দা জানাই।  

No comments:

Post a Comment