Search

Thursday, March 14, 2019

পরাজিত হলেন শিক্ষকরা


গোলাম মোর্তোজা 
আশঙ্কা ছিলো, আশাও ছিলো। যদিও আলামত ছিলো না আশাবাদী হওয়ার।

আশাবাদীরা আশা করেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মানে শিক্ষকরা থাকবেন ডাকসু নির্বাচনের দায়িত্বে। শিক্ষকরা নির্বাচন পরিচালনা করবেন, শিক্ষার্থীরা ভোট দিবেন। সেখানে শিক্ষকরা নিশ্চয়ই এমন কিছু করবেন না, যা শিক্ষার্থীদের কাছে তাদের সম্মানহানি ঘটায়। শিক্ষকরা সেই আশ্বাস দিয়েছিলেনও।

তাছাড়া, ডাকসুর গৌরবময় ঐতিহ্যও বলে, সারাদেশের নির্বাচনের প্রতিফলন ডাকসু নির্বাচনে প্রতিফলিত হয় না। ২৮ বছর আগে ডাকসু নির্বাচন হয়েছিলো সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের আমলে। সেই নির্বাচন শিক্ষকরা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে পরিচালনা করেছিলেন, শিক্ষার্থীরা কোনো বাধা ছাড়া ভোট দিয়েছিলেন। তখনও দেশে নির্বাচন বলতে কিছু ছিলো না। কিন্তু, ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছিলো। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ‘রাতে বেলা ব্যালট বাক্স ভরার’ স্বীকারোক্তির পরও, অনেকে আশা করেছিলেন ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও হতে পারে। বাস্তবে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে যা ঘটলো, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকলো শিক্ষকদের সম্মান-শ্রদ্ধা-মর্যাদার প্রসঙ্গ। এই নির্বাচন থেকে প্রাপ্তি কী? কে বা কারা হারলেন, জিতলেন কারা?





সেসব বিষয়ে দু’একটি কথা।

১. শুরুতেই দু’টি ঘটনা, দুজন শিক্ষকের প্রসঙ্গ।

ড. শবনম জাহান
ক. যে রুমে ব্যালট বাক্স রাখা, সেই রুমের ভেতরে আরেকটি দরজা। সেই দরজা দিয়ে ব্যালটবাক্স রক্ষিত রুমে ঢোকা যায়। ছাত্রীরা আশঙ্কা করছিলেন, রাতে ব্যালটবাক্স ভর্তি করে রাখা হতে পারে।
শিক্ষার্থীরা সন্দেহ করছেন শিক্ষককে। তা নিয়ে রাতেই শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কয়েকদফা তর্ক-বিতর্ক হয়। শিক্ষক বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, আমি শিক্ষক হয়ে তোমাদের সঙ্গে এমনকিছু করব না। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের কথা বিশ্বাস করেননি। সমঝোতা হয়, শিক্ষার্থীরা দরজায় তালা দিয়ে রাখবেন। চাবি থাকবে শিক্ষার্থীদের কাছে। সেই অনুযায়ী দরজায় তালা দিয়ে শিক্ষার্থীরা চাবি রাখেন নিজেদের কাছে। সকালে ভোটগ্রহণ শুরুর আগে শিক্ষার্থীরা দেখেন দরজার তালা খোলা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা সেই রুমে ঢুকতে চাইলে, শিক্ষক বাধা দেন। শিক্ষার্থীরা তবুও রুমে ঢুকে দেখেন কোনোকিছু ভর্তি অবস্থায় কয়েকটি বস্তা। খুলে দেখা যায়, বস্তা ভর্তি ভোট দেওয়া ব্যালটপেপার। শিক্ষক তার অনুগত কয়েকজন শিক্ষার্থীকে দিয়ে বস্তাগুলো সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। সম্ভবত দু’একটি বস্তা সরিয়ে নিতে সক্ষমও হন।

ব্যালটবাক্স, পেপার রাতে শিক্ষকের কাছে পাঠিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে সকালে ব্যালটপেপারে ভোট দিয়ে বাক্সে ফেলবেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক সেই ব্যালটপেপারে রাতে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে বস্তা ভর্তি করে রেখে দিয়েছেন। সকালে সবার সামনে খুলে দেখাবেন ব্যালটবাক্স খালি। সিলগালা করে বুথে রাখবেন।ভোটগ্রহণ শুরু হলে, ভেতরের দরজা খুলে বস্তার ব্যালটপেপার ঢুকিয়ে দেওয়া হবে ব্যালটবাক্সে।

এ বক্তব্য ব্যালটপেপার উদ্ধারকারী শিক্ষার্থীদের। গণমাধ্যমের সামনে তারা একথা বলেছেন।
সাধারণত শিক্ষার্থীরা অন্যায় বা অনৈতিক কিছু করে শিক্ষকের হাতে ধরা পড়েন।

এক্ষেত্রে শিক্ষক ধরা পড়েছেন শিক্ষার্থীদের কাছে। প্রথমে সন্দেহ, তারপর হাতেনাতে ধরা। কথাগুলো শিক্ষার্থীরা ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, লিখছি খুব সহজে। লেখার পর কেমন যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলাম। শিক্ষক...? এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন জগৎবিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মনীষী জি সি দেবের মতো মানুষেরা!

সবার জীবনেই তো শিক্ষকের ভূমিকা আছে। আপনি একবার কল্পনা করে দেখেন তো ঘটনাটি?
বলছি কুয়েত মৈত্রী হলের কথা।

আর সেই শিক্ষকের নাম ড. শবনম জাহান। তাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।

খ. ‘রোকেয়া হলে উদ্ধার হলো বাক্স ভর্তি ব্যালট’ (মানবজমিন, ১১ মার্চ ২০১৯)।
রোকেয়া হলে বাক্সভর্তি ব্যালটপেপার লুকিয়ে রেখে শিক্ষার্থীদের কাছে ধরা পড়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

শিক্ষক ভোট গ্রহণ শুরুর আগে শিক্ষার্থীদের ছয়টি ব্যালটবাক্স দেখান। শিক্ষার্থীরা বলেছেন, আরও তিনটি ব্যালটবাক্স থাকার কথা, সেগুলো কোথায়? শিক্ষার্থী-শিক্ষক তুমুল তর্ক, হৈচৈ শুরু হয়েছে। দেখানো ছয়টি ব্যালটবাক্স সিলগালা করতেও রাজি হচ্ছিলেন না হল প্রভোস্ট ড. জিনাত হুদা। তৈরি হয় গোলযোগপূর্ণ পরিবেশ।

সেখানে হাজির হন কোটা আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নূরসহ অনেকে। বন্ধ দরজা খুললে সন্ধান পাওয়া যায় ব্যালটপেপার ভর্তি তিনটি বাক্সের। হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা দরজায় দাঁড়িয়ে রুমে ঢুকতে বাধা দিয়েছিলেন।

প্রভোস্ট যদিও বলছেন- এগুলো নিরাপদ রাখার জন্যেই ঐ রুমে রাখা হয়েছিলো।
রোকেয়া হলে ভোট গ্রহণ শুরু হয় দেড়-দুই ঘণ্টা দেরিতে।

রোকেয়া হলের পাঁচজন শিক্ষার্থী নির্বাচনে কারচুপির প্রতিবাদে, পুনরায় নির্বাচন এবং প্রভোস্ট ড. জিনাত হুদার পদত্যাগের দাবিতে অনশন করছেন। আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী অনশন করছেন রাজু ভাস্কর্যের সামনে।

কুয়েত মৈত্রী হলের বস্তা-ভর্তি ব্যালটপেপারে ছাত্রলীগ প্রার্থীদের পক্ষে ভোট দেওয়া ছিলো। রোকেয়া হলের ব্যালটপেপারে ভোট দেওয়া ছিলো না।

৩. ডাকসু নির্বাচনে বড় রকমের এই অন্যায়-অনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলো দৃশ্যমান হয়েছে। অন্য তিনটি মেয়েদের হলেও প্রতিরোধ হয়েছে, নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা যা ধারণা করেছিলেন তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। শামসুন নাহার হলে শিক্ষার্থীরা সারারাত জেগে পাহারা দিয়েছেন, শিক্ষকও অনৈতিক পথে হাঁটেননি। শিক্ষক শিক্ষকের মতো দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলে বস্তা-ভর্তি বা ব্যালটবাক্স আগে থেকে ভর্তির ঘটনা ঘটেনি। শিক্ষার্থীরা ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পেরেছেন। ছাত্রীরা যেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন, ছাত্র হলগুলোতে তেমন প্রতিরোধ দেখা যায়নি।

৩. ছাত্ররা কী প্রতিরোধ করতে পারেননি?

ছাত্র হল আর ছাত্রী হলের পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ছাত্রী হলে ছাত্রলীগ একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বাম সংগঠনগুলোর কার্যক্রম সক্রিয় আছে। এক সময় ছাত্রলীগ করতেন বা ছাত্রলীগ ভাবাপন্ন বহু ছাত্রী এক ধরণের স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়েছেন ছাত্রলীগের বিগত দিনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ।

ছাত্রদের হলে ছাত্রলীগ একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। সেখানে অন্য কোনো দল-মতের শিক্ষার্থীদের প্রায় প্রবেশাধিকার নেই। গণরুম-গেস্টরুম নিপীড়ন চলে মূলত ছাত্রদের উপর। ছাত্রীদের মতো বহু ছাত্র যারা ছাত্রলীগ করতেন বা ভাবাপন্ন, তারা ছাত্রলীগ থেকে দূরে সরে গেছেন। ছাত্রলীগ তাদের আদর্শ বা ভালোবাসা দিয়ে কাছে টানতে চায়নি। ক্ষমতা দিয়ে বশে রাখতে গিয়ে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। নতুন শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগে যোগ দেওয়ার কথা ভাবেন না। অমানবিক গণরুমে থাকার বিনিময়ে বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিংয়ে যান।

এমনকি, নির্বাচনের সময়ও ছাত্রলীগ তাদেরকে শ্রমিকের মতো কাজ করিয়েছে। প্রথম আলো শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে সংবাদ প্রকাশ করেছে।

ছাত্রমত ছাত্রলীগের পক্ষে না থাকলেও, হলের নিয়ন্ত্রণ ঠিকই থেকেছে। নিয়ন্ত্রণ থাকার ক্ষেত্রে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত দলীয় শিক্ষকরা ছাত্রলীগকে সহায়তা করেছেন।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে এসব শিক্ষকরা কখনো কোনো অবস্থান নেননি।

বাম এবং ছাত্রদলসহ অন্যান্য সকল সংগঠন নির্বাচনের আগের কয়েকদিন এবং নির্বাচনের দিন সমগ্র ক্যাম্পাসে সক্রিয় থাকলেও, হলগুলোতে সক্রিয় থাকতে পারেননি। প্রচারণা কাজে হলে গিয়ে আবার বেরিয়ে আসতে হয়েছে। নির্বাচনের দিন তারা হলে ঢুকতে পারেননি বললেই চলে। ফলে নির্বাচনের যে চিত্র ছাত্রী হলগুলোতে দৃশ্যমান হয়েছে, ছাত্র হলগুলোর ক্ষেত্রে তেমন হয়নি। প্রকৃত অর্থে জানা যায়নি ছাত্র হলগুলোর ভেতরে কী ঘটেছিলো। প্রতি মুহূর্তে ক্যাম্পাসে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। যদি গণমাধ্যমের স্বাধীন প্রবেশাধিকার থাকতো, তাহলে এই বিভ্রান্তি তৈরি হতো না। ছাত্রী হলের মতো ভোটের চিত্র যদি ছাত্র হলে না ঘটে থাকে, সেটাও জানা যেতো।

৪. নির্বাচনের প্রস্তুতিকালীন সময় থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন, যা শুধু প্রশ্নের পর প্রশ্ন জন্ম দিচ্ছিলো। তারা শিক্ষক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারছিলেন না, দলীয় কর্মী বা নেতার মতো হয়ে যাচ্ছিল তাদের আচরণ। কয়েকটি নমুনা-

ক. ছাত্রলীগ ছাড়া সকল সংগঠনের চাওয়া ছিলো ভোটকেন্দ্র হলে নয়, একাডেমিক ভবনে স্থাপন করতে হবে। ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে থাকা হলগুলোতে শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে না। একথা কারো অজানা ছিলো না। কিন্তু, শিক্ষকরা ছাত্রলীগের চাওয়া অনুযায়ী ভোটকেন্দ্র হলে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা ছিলো অধ্যাপক মিজানুর রহমানের। তিনি ঐতিহ্য বিবেচনায় নিয়েছেন, সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভোট দিতে যেতে পারবেন কী না, তা বিবেচনায় নেননি।

হলে ভোট কেন্দ্র রাখার সিদ্ধান্ত যে সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় ছিলো, নির্বাচনের দিন তা দৃশ্যমান হয়েছে।

খ. অন্য সব সংগঠনের দাবির প্রেক্ষিতে হলগুলো থেকে বহিরাগতদের বের করে দেওয়া ও সহাবস্থান নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। উদ্যোগের প্রথম দিন জসীম উদ্দীন হল থেকে ছাত্রলীগের বিরোধিতার মুখে পিছিয়ে আসেন শিক্ষকরা। ফলে সহাবস্থান নিশ্চিত করার আর কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে।

গ. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্বাধীন, মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে পরিচিত। তারাই গণমাধ্যমের উপর অতিরিক্ত কড়াকড়ি আরোপ করেছেন। যে গণমাধ্যম শিক্ষকদেরও প্রতিটি ন্যায্য দাবির পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে।

ঘ. প্রায় ৪৩ হাজার ভোটারের ভোট সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টার মধ্যে নেওয়া কঠিন হবে। এই যুক্তিতে ভোট গ্রহণের সময় ৪টা পর্যন্ত করার দাবি জানিয়েছিলো ছাত্রলীগ ছাড়া প্রায় সবগুলো সংগঠন। যৌক্তিক হলেও সেই দাবি মানেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

ভোট গ্রহণ চলাকালীন অনিয়ম প্রকটভাবে দৃশ্যমান হওয়ার পর ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য প্রায় সব সংগঠনের প্রার্থী-কর্মীরা নির্বাচনে অনিয়ম, বস্তাভর্তি ব্যালটপেপারসহ নানা বিষয় নিয়ে প্রধান রিটার্নিং অফিসার অধ্যাপক মাহফুজুর রহমানের কাছে গেছেন। তিনি অভিযোগগুলোর কোনোটাই অস্বীকার করেননি। এক ধরণের অসহায়ত্ব প্রকাশ পেয়েছে তার কথায়।বলেছেন, ‘আমি বিব্রত’। ন্যায়ের প্রতি দৃঢ়তার সন্ধান পাওয়া যায়নি তার বক্তব্যে। বলেছেন ‘আমি একা কিছু করতে পারব না। তোমরা মামলা করো। দায়িত্বশীলদের কাছে তোমাদের কথা পৌঁছে দেব।’

যিনি নিজে প্রধান রিটার্নিং অফিসার, যিনি সব সংগঠনকে সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিয়ে নির্বাচনে এনেছিলেন। নির্বাচন বিষয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার তার আছে। অথচ তিনি তার শিক্ষার্থীদের কাছে ‘বিব্রত’ হয়ে ‘মামলা’ করার পরামর্শ দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছেন! আবার এই সময়েই উপাচার্য বলেছেন, ‘দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।’

৫. এবার আসি ফলাফল প্রসঙ্গে। ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন নুরুল হক নুর। ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী কোটাসংস্কার আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুরকে ছাত্রলীগ যে কতোবার পিটিয়ে আহত- রক্তাক্ত করেছে, সেই হিসাব সম্ভবত ছাত্রলীগের কাছেও নেই।

নির্বাচনের দিনও ছাত্রলীগ নুরুলকে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলো। প্রক্টর গোলাম রাব্বানী সবকিছু দেখেছেন, জেনেছেন। গণমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘নুরকেই জিজ্ঞেস করেন, কেনো ছাত্রী হলে গিয়েছিলো’।

এতো প্রতিকূলতার মুখেও বিষ্ময়করভাবে নুরুল তার অবস্থান থেকে কখনো সরে যাননি। ধৈর্য-সাহস-দায়বদ্ধতা-নৈতিকতার প্রতিটি পরীক্ষায় নুরুল প্রতিবার উত্তীর্ণ হয়েছেন। নুরুল ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। মুহসীন হল ছাত্রলীগের উপ-মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।

নির্বাচনের আগেই লিখেছিলাম, ছাত্রলীগ ছাত্রদলকে নিয়ে চিন্তিত থাকলেও, তাদের জন্যে চিন্তার কারণ হয়ে উঠতে পারেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা।

গত কয়েক বছর আগের পহেলা বৈশাখে টিএসসি এলাকায় নারী নিপীড়ন, নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল-শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, কোটাসংস্কার আন্দোলনসহ যতোগুলো জনসম্পৃক্ত দাবিতে শিক্ষার্থীরা সোচ্চার হয়েছেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ তার বিরোধিতা করেছে। আন্দোলনকারী ছাত্রীদের নিপীড়ন করেছে, যৌন নিপীড়ন করেছে। ছাত্রী হলগুলোতে যে এতোটা প্রবল প্রতিরোধ দৃশ্যমান হলো, এর নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড। ছাত্রলীগ কখনো হেলমেটবাহিনী, কখনো হাতুড়িবাহিনী রূপে আবির্ভূত হয়ে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করেছে।

বাম সংগঠনগুলো সব আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থেকেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে, অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বাম সংগঠনগুলোর ভালো করার সম্ভাবনা ছিলো।

এখন নুরুল ভিপি নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে কী প্রমাণ হয় না যে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, কারচুপির যে অভিযোগ এসেছে তা সত্যি নয়? বস্তাভর্তি ব্যালটপেপার এবং ব্যালটবাক্স ভর্তির ঘটনা তো ঘটেছে মাত্র দু’টি হলে। অন্য হলগুলোতে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। অনেকেই তুলছেন, সামনেও তুলবেন।

যে বাস্তবতায় ছাত্রী হলের অনিয়ম দৃশ্যমান হয়েছে, ছাত্র হলের চিত্র দৃশ্যমান হয়নি- তা লিখেছি। একটি নির্বাচনে কখনো প্রতিটি কেন্দ্রের অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা যায় না। আর নির্বাচন পরিচালনাকারীরা যদি অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েন, তাহলে অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে অনিয়ম তুলে ধরার সকল দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে, নির্বাচনে অংশ নেওয়া সংগঠনের নেতাকর্মীদের। তাদের এজেন্টও দিতে দেওয়া হয়নি।

যদি গণমাধ্যমের গতিবিধি এতোটা নিয়ন্ত্রণ করা না হতো, তবে সব কেন্দ্রের মোটামুটি একটি চিত্র পাওয়া যেতো। অত্যন্ত সীমিত সুযোগের মধ্যে গণমাধ্যম যখন কেন্দ্রের বাইরের অপেক্ষমাণ লাইনের নানা অনিয়ম তুলে ধরেছে, তখন শিক্ষককে দেখা গেছে গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করতে। ভোটকেন্দ্রের বাইরে যারা এমন আচরণ করেছেন, ভোটকেন্দ্রের ভেতরে (বুথের কথা বলছি না) যেখানে গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকার ছিলো না (থাকলে ভোট গ্রহণে কোনো সমস্যা ছিলো না) সেখানে তারা সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করেছেন, কাউকে কি তা বিশ্বাস করানো যাবে?

দেশের সকল নির্বাচনে স্বচ্ছ ব্যালটবাক্স ব্যবহার করা হয়। কর্তৃপক্ষ একরোখা থাকলেন নিজেদের ঐতিহ্য, নিজেদের অস্বচ্ছ স্টিলের ব্যালটবাক্সই তারা ব্যবহার করলেন। অনিয়মের চিত্রগুলো দৃশ্যমান হওয়ার পরে, শিক্ষকদের সম্পর্কে ছাত্রদের তো বটেই জনমানুষের মনেও কী এই বিশ্বাস স্থায়ী হয়ে গেলো না যে, রাতে ভোট দিয়ে ব্যালটবাক্স ভরে রাখার জন্যেই অস্বচ্ছ ব্যালটবাক্স ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো?

রাতের বেলা হলে ব্যালটপেপার ও বাক্স পাঠানোর বিরোধিতাও করেছিলো সব সংগঠন, ছাত্রলীগ ছাড়া। শিক্ষকরা তাদের দাবির প্রতি কর্ণপাত না করে যে সিদ্ধান্ত নিলেন, ব্যালটপেপারের বস্তা আবিষ্কারের পর শিক্ষার্থীরা কী ভাবলেন? দেশের মানুষ কী ভাবলেন?

শিক্ষক সমিতি বিবৃতি দিয়ে বলেছে, কুয়েত মৈত্রী ও রোকেয়া হলের ঘটনা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। শিক্ষকের জিম্মায় থাকা ব্যালটপেপারে রাত ভোট দিয়ে বস্তা ভর্তি করা হলো। ভোট কারা দিলেন, বস্তা ভর্তি কারা করলেন? শিক্ষক কী করলেন?

ষড়যন্ত্র করলেন কারা? যড়যন্ত্রই বা কীসের?

সুতরাং ভিপি হিসেবে নুরুলের বিজয় এবং অনিয়মের দৃশ্যমানতা সাপেক্ষে ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে’ তা বলার সুযোগ আছে কী না, সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্যে গবেষণার প্রয়োজন হয় না।

নুরুল ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর, ছাত্রলীগও এই নির্বাচনকে প্রহসন বলেছে। পুনরায় নির্বাচন চেয়েছে। হাসপাতাল থেকে ফেরা নুরুলকে আবারও ধাওয়া দিয়েছে। তারপর ছাত্রলীগের ভিপি প্রার্থী শোভনের নেতৃত্বে নুরুলকে ভিপি হিসেবে মেনে নিয়েছে। নুরুলও এখন পুনরায় নির্বাচন চাইছেন।

যে আটজন শিক্ষক নিজস্ব উদ্যোগে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন, তারা বহুবিধ অন্যায়-অনিয়ম প্রত্যক্ষ করেছেন।

অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া নির্বাচন বাতিল করে, নতুন নির্বাচন দেওয়ার সুপারিশ করেছেন পর্যবেক্ষণকারী শিক্ষকরা।

নির্বাচনের পূর্ণাঙ্গ ফলাফল কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কোন হলে কে কত ভোট পেলেন, কোথায় কে বেশি বা কম ভোট পেলেন, তা জানা যাচ্ছে না। ফলে নির্বাচনটি নিয়ে আরও বহুবিধ প্রশ্ন ও সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

৬. ২৮ বছর পরের ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কয়েকটি দিক উন্মোচিত হলো-

ক. ডাকসুর সবচেয়ে সম্মানজনক ভিপি পদে বিজয়ী নুরুল হক নুর এবং সমাজসেবায় কোটা আন্দোলনের আকতার ছাড়া অন্য সব পদ ছাত্রলীগের। পরাজিত হলেন কারা? পরাজিত হলেন শিক্ষকরা। কোটাসংস্কার আন্দোলনের একজন নেতা বলছিলেন, ‘ছাত্রলীগ নয়, আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষকরা। ছাত্রলীগকে শিক্ষার্থীরা ভোট দিবে না জানতাম। কিন্তু, শিক্ষকরা ছাত্রলীগকে রাতে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তবুও নুরুল আর আকতারকে হারাতে পারেনি। চিন্তা করে দেখেন আমরা কতো বেশি ভোট পেয়েছি, আর ছাত্রলীগ কতো কম ভোট পেয়েছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নৈতিকতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হলেন। শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং দেশের মানুষকে লজ্জায় ফেলে ইমেজ হারালেন। মানুষ দেখলেন ‘রাতে ভোট’র মতো নৈতিক স্খলনজনিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে শিক্ষকরাও সম্পৃক্ত। আবার মানুষ এটাও জানলেন, সংখ্যায় কম হলেও কিছু শিক্ষক এখনো আছেন যারা নীতি-নৈতিকতার সঙ্গে কোনো প্রকার আপোষ করেন না।

খ. আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার সুযোগে ছাত্রলীগ দৃশ্যমানভাবে আছে, বিএনপির ছাত্রদল অদৃশ্য হয়ে গেছে। ছাত্রদল সাংগঠনিকভাবে নেই, সমর্থনে কতোটা আছে তা বোঝা যেতো সুষ্ঠু নির্বাচন হলে। ছাত্রলীগের দৃশ্যমান দাপট আর সমর্থনে যে ব্যাপক ফারাক, তা বুঝতে কষ্ট হয় না।

গ. ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের প্রচলিত ধারার ছাত্র রাজনীতির প্রতি যে শিক্ষার্থীদের মোহ কেটে গেছে- তা মোটামুটি পরিষ্কার হয়েছে।

ছাত্রদলের অনুপস্থিতিতে, ছাত্রলীগের প্রবল বিরোধিতা উপেক্ষা করে, বাম ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা সফল আন্দোলন করেছেন।

শিক্ষার্থীদের পক্ষ নিয়ে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সরব থাকায় কোটাসংস্কার আন্দোলনকারীরা শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় ছাত্রনেতায় পরিণত হয়েছেন। বাম ছাত্রনেতারা তাদের ইমেজ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন।

ঘ. ভিন্নমত হলেই ‘জামায়াত-রাজাকার’ আখ্যা দেওয়ার নীতি যে শিক্ষার্থীরা প্রত্যাখ্যান করেছেন, তা কিছুটা হলেও বোঝা গেছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে তা আরও বড়ভাবে বোঝা যেতে পারতো।

৭. নির্বাচন বর্জন করেও, ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী ভিপি নুরুল হক নুর। বর্জন করেছেন আরও চারটি প্যানেলের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে, নির্বাচিত হয়েছেন ভিপি পদে নুরুল ও সমাজসেবা সম্পাদক পদে আকতার হোসেন। নুরুলের জন্যে এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কঠিন পরীক্ষা। নুরুল ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনে থাকতে পারেন অন্যদের সঙ্গে। আবার ভিপি পদে থেকে একই সঙ্গে ভেতরে-বাইরে আন্দোলনে সক্রিয় হতে পারেন। শিক্ষার্থীদের অধিকার ও অন্যায্য দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতে পারেন।

সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নুরুলের চেয়েও বেশি বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে বর্জনকারী অন্যান্য সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে।

ডাকসু নির্বাচনের মতো একটি নির্বাচন পরিচালনা করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। কিন্তু, সমাজে বিশ্বাসযোগ্যতা পেলো না যে, তারা নৈতিকতা বজায় রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পেরেছেন।
একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সমাজে কোন পরিচয়ে নিজেদের পরিচিত করলেন, তা কী ভেবে দেখার মতো সময় তাদের আছে!

কার্টসি —  দি ডেইলি স্টার/ বৃহস্পতিবার, মার্চ ১৪, ২০১৯। 
লিঙ্ক —  http://bit.ly/2T7MbPr 

১৯৭৩ এর ডাকসুর সেই ব্যালট ছিনতাইয়ের ইতিহাস

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
সঙ্কটটা চরম আকার ধারণ করল ১৯৭৩ সালের ডাকসু ও হল ইউনিয়ন নির্বাচনের সময়।ছাত্রলীগের মুজিববাদী অংশ ততদিনে বুঝে ফেলেছে যে একাকী দাঁড়িয়ে তারা সুবিধা করতে পারবে না; কারণ তাদের বড় অংশই চলে গেছে জাসদ ছাত্রলীগের সঙ্গে, সাধারণ ছাত্ররাও মুজিববাদীদের হিংস্র তৎপরতায় ক্ষুব্ধ, সর্বোপরি ‘বৈজ্ঞানিক’ সমাজতন্ত্রের যে আওয়াজ জাসদ ছাত্রলীগ ছাত্র ইউনিয়নের কাছ থেকে ছিনতাই করে নিয়ে গেছে তারও আকর্ষণ রয়েছে। মুজিববাদীরা বুঝতে পারছিল যে তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা হবে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গেই। সে জন্য তারা সংযুক্ত প্যানেল দিল ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে মিলে। ছাত্র ইউনিয়নের নূহ আলম লেনিন হলো সহ-সভাপতি পদপ্রার্থী, ছাত্রলীগের ইসমত কাদির গামা দাঁড়াল সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য; দুয়ে মিলে লেনিন-গামা পরিষদ। বিপরীতে জাসদ ছাত্রলীগের মাহবুব-জহুর পরিষদ।

ডাকসু ভবন 
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে মুজিববাদীদের পক্ষে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। ভেতরে ভেতরে ছিলও বটে। কিন্তু নির্বাচনের দিন ফলাফল যখন আসতে শুরু করল তখন দেখা গেল অবিশ্বাস্য ঘটনা। সব হলেই বিরোধীরা জয়ী হয়েছে। অথচ সারাদিন এলাকাজুড়ে শোনা গেছে শুধু লেনিন-গামা লেনিন-গামা ধ্বনি, ঝালাপালা হয়ে গেছে ক্যাম্পাসের কান! লেনিন-গামার সমর্থকরা দৃশ্যমান ব্যাজ পরে সর্বত্র ঘোরাঘুরি করেছে, নিশ্চিত বিজয়ের উল্লাসে। অথচ নীরবে ব্যালটবিপ্লব ঘটে গেছে। অনেকটা সত্তরে ছয় দফার বিজয়ের মতোই। লেনিন-গামার ব্যাজ পরেও মাহবুব-জহুরকে ভোট দিয়ে গেছে ছেলেমেয়েরা।

মুজিববাদীরা তখন আর বিলম্ব করেনি, ছিনতাই শুরু করে দিয়েছে। হলগুলোতেই গণনার কাজ হয়েছে প্রথমে। ডাকসুর গণনাটা হবে সব শেষে, সন্ধ্যার পরে, যখন ডাকসুর নির্দিষ্ট ব্যালট বাক্সগুলো সেখানে নেয়া ও খোলা হবে। হলের ফল দেখেই তো কোনো সন্দেহ রইল না যে ডাকসুর ফল কি হবে। কাজেই সেখানেও একই ঘটনা ঘটল। কলাভবনের চারতলায় গণনার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। হঠাৎ করে সব বাতি নিভে গেল এবং পেছনের সিঁড়ি দিয়ে কে বা কারা এসে ব্যালট বাক্সগুলো নামিয়ে নিয়ে চলে গেল। দুয়েকটা বোমা বিস্ফোরণও বোধ করি ঘটেছিল। যদিও তার প্রয়োজন ছিল না। কেননা প্রতিরোধ করার মতো কেউ তো ছিল না। বিপক্ষ দলের ছেলেরা তখন আত্মরক্ষার জন্য নিজেদেরকে অপ্রকাশ্য করে তুলেছে।

চারতলার হল ঘর থেকে আমরা নিচে নেমে এলাম। উপাচার্যও আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। কলাভবনের সামনে দেখলাম চিফ রিটার্নিং অফিসার প্রফেসর ওদুদুর রহমান তাঁর গাড়িতে চড়ছেন। তারা কোথায় যাচ্ছেন এ ব্যাপারে কৌতূহল ছিল। কে যেন বলল, বত্রিশ নম্বরে। ওই যাত্রার সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে এটা তো সত্য ১৯৭৩-এর শুরুতে ডাকসুর সেই ব্যালট ছিনতাই এই ভয়াবহ বাণী দেশবাসীর কানে পৌঁছে দিল যে দেশে গণতন্ত্রের পথটা সুগম হবে না। হয়ওনি। বহু ঘটনা ঘটেছে, ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর অতি অবিশ্বাস্য সব ঘটনা, কিন্তু সূত্রপাত মনে হয় ডাকসুর ওই নির্বাচন বানচালের ব্যাপারটা থেকেই।

সব হলেরই গণনা শেষ হয়ে গিয়েছিল, বাকি ছিল স্বাক্ষর দেয়া ও ঘোষণা করা। সে অবস্থায় গণনার কাগজ ও ব্যালট বাক্স দুটোই ছিনতাই হয়ে যায়। রোকেয়া হলের রিটার্নিং অফিসার ছিলেন আমাদের বিভাগের অধ্যাপক হোসনে আরা হক, ঘটনার গতি আঁচ করতে পেরে তিনি ওই হলের রেজাল্ট শিটটা দ্রুত তার হ্যান্ডব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলেছিলেন; তাতে অবশ্যই দেখা গেছে যে মুজিববাদীরা বিপুল ভোটে হেরে গেছে, কিন্তু ওই কাগজের তো তখন আর কোনো মূল্য ছিল না। গোটা নির্বাচনটাই তো বাতিল ঘোষিত হয়ে গিয়েছিল।

  •  সূত্র — 'দুই যাত্রায় এক যাত্রী'/ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। 


‘৬৯ থেকে ২০১৯’ — চিন্তার রকমফের


মাকসুদুর রহমান 


কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে যেন,  আমার গায়ে গুলি লাগে  — ড. জোহা

হলের গেটের বাইরে  হেনস্তার হওয়ার ঘটনাটি আমাদের কনসার্ন না 

—  জিনাত হুদা, প্রাধ্যাক্ষ রোকেয়া হল


ঘটনা   এক 
রোকেয়া হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বৃহস্পতিবার,  মার্চ,১৪,  ২০১৯

জিনাত হুদা
অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগ এনে ফের ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের দাবিতে বুধবার, মার্চ ১৩, থেকে  আমরণ অনশন চালিয়ে যাচ্ছে  রোকেয়া হলের পাঁচ ছাত্রী, গভীর রাতে তাদেরকে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানীর নেতৃত্বে একদল ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর হেনস্তার অভিযোগ উঠেছে।   হেনস্তার বিষয় নিয়ে  হলটির প্রাধ্যক্ষ জিনাত হুদা একটি সংবাদ সম্মেলন করেন।  সেখানে তিনি বলেন , ‘তারা হলের গেটের বাইরে গিয়ে অবস্থান করছেন। সেখানে হেনস্তার হওয়ার ঘটনাটি আমাদের কনসার্ন না। আমাদের কনসার্ন তাদের গেটের বাইরে থেকে হলের ভেতরে নিয়ে আসা।’
বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে জিনাত হুদা এ কথা বলেন। 


ঘটনা দুই 
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ফেব্রুয়ারি ১৮, ১৯৬৯

ড. জোহা
এবার আমরা একটু পেছনে ফিরে যাই। সাল ১৯৬৯, ফেব্রুয়ারি মাস । স্থান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। সেইসময়  আন্দোলন চলছিল পুরো  দেশজুড়ে। পাকিস্তানি সামরিক  জান্তা ১৫ ফেব্রুয়ারি বন্দী অবস্থায় গুলি করে হত্যা করেন ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে।  প্রতিবাদের ঝড় ওঠে দেশব্যাপী। যার আঁচ এসে লাগে  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মাঝেও । ছাত্রদের মিছিলে  গুলি করে সেনাবাহিনী । আহত হয় অসংখ্য ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা যিনি ড. জোহা নামে ইতিহাসের পাতায় হিরন্ময় দ্যুতি ছড়াচ্ছেন, আহত ছাত্রদের হাসপাতালে নিয়ে চিকিত্সার ব্যবস্থা করেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি ছিল ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে । এতে বিনা উসকানিতে পুলিশ লাঠি চার্জ করে ছাত্রদের রক্তাক্ত করে। প্রতিবাদে নতুন কর্মসূচী ঘোষণা করে ছাত্ররা। অন্যদিকে, প্রশাসন  ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই ধারা উপেক্ষা করে মেইন গেটের সামনের মহাসড়কে পাকিস্তানি স্বৈরাশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ড. জোহা মেইন গেটে ছুটে যান। প্রক্টর হিসেবে তিনি ছাত্রদের শান্ত করার এবং ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। ছাত্ররা পিছু হঠতে না চাইলে পাক বাহিনীর ক্যাপ্টেন হাদী ছাত্রদের গুলি করার নির্দেশ দেয়। তখন ড. জোহা পাক বাহিনীর উদ্দেশে বলেন, ‘কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে যেন আমার গায়ে গুলি লাগে।’ এ সময় তিনি ‘ডোন্ট ফায়ার! ডোন্ট ফায়ার!’ বলে চিত্কার করতে থাকেন। সেদিন মহান এই শিক্ষক ড. জোহার বুকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল মতিহারের নিষ্পাপ সবুজ চত্বর। হাসপাতালে নেওয়ার পথে ড. জোহা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তার পরেরটাতো ইতিহাস!  ড.জোহার রক্তের স্রোতধারা বয়েই মূলতঃ  ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান তৈরি করেছিল এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই তা  স্বাধীনতা সংগ্রামের চুড়ান্ত বিজয়ের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিলো। 

ঢাবির রোকেয়া হল সংসদ নির্বাচন বাতিল করে পুনরায় নির্বাচন ও হল প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগসহ চার দফা দাবিতে আমরণ অনশনে বসেছেন হলের পাঁচ শিক্ষার্থী৷ ছবি: প্রথম আলো

দ্রষ্টব্য
উপরের দুটি ঘটনা দেখে নিজেকে  ভীষন রকমের ভাগ্যবান লাগছে এই কারণে ১৯৬৯ বা ওই সময়কালে জিনাত হুদাদের মতো শিক্ষকদের জন্ম হয়নি। কারণ সেদিন যদি প্রফেসর জোহার জায়গায় আজকের জিনাত হুদারা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রগঠনে যে ধারাবাহিক আন্দোলনে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেছেন তা সম্ভব হতো কি না তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হওয়ার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ রয়েছে।  কারণ বাইরের যেকোনো আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণকে নিশ্চিতভাবে আজকের জিনাত হুদারা  কনসার্ন থাকতেন না।  রোকেয়া হলের প্রাধাক্ষ্য জিনাত হুদার  ‘ছাত্রীদের হলের বাইরে  অনশনে’র বিষয়ে  করা মন্তব্যে অন্তত সেই কথাটিই পরিস্কার হয়েছে।

  • লেখক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক। 



ডাকসু নির্বাচনের বিশ্লেষণ


সায়ন্থ সাখাওয়াৎ 

মাত্র ১২ দিন আগে (২ মার্চ ২০১৯) দৈনিক দেশ রূপান্তরে লিখেছিলাম, পদাধিকার বলে যিনি ডাকসুর সভাপতি পদে নির্বাচিত (সিলেক্টেড) হয়ে আছেন, সেই ভাইস চ্যান্সেলর ভূমিকাও এতটাই পার্টিসান হয়ে পড়েছে যে, তাকে ইসির কার্বন কপি ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছে না সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো। ভিসি পদে যোগ দেওয়ার প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইস্যুতে ভিসি মহোদয়ের বক্তব্য দেখে এটা অনেকটাই স্পষ্ট, তার ব্যক্তিত্ব ইসি মহোদয়ের থেকে কোনো অংশে কম নয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা ইসি যে ভাষায় যে সুরে কথা বলেন, ‘ভিসি মহোদয়ও সে ভাষায় সে সুরেই কথা বলছেন। সরকারি দলের প্রতিপক্ষকে তারা দুজনেই তাদের প্রতিপক্ষ জ্ঞান করেন বলে মনে হওয়ার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ আছে। ফলে ইসি দেশে যেমন একটা ফ্যান্টাস্টিক নির্বাচন উপহার দিয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে অমরত্ব লাভের খায়েশ প্রকাশ করেছেন, ভিসিও তা করবেন না, সেটা বিশ্বাস করা মুশকিল।’

সে আশঙ্কা যে অমূলক হয়নি, এখন তা সবার কাছেই পরিষ্কার। জাতীয় নির্বাচনের মতোই ভোটের আগের রাতে ছাত্রলীগ প্যানেলের পক্ষে ব্যালটে সিলমারা, ভোটদানে বাধা দেওয়া, প্রার্থীর ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য সব কটি প্যানেল। এসব অনিয়মের জন্য নির্বাচনে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক মাহফুজুর রহমানও বিব্রত হওয়ার কথা উল্লেখ করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এই নির্বাচনের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে বলে বক্তব্য দিয়েছেন সাবেক ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকও। আর সাবেক ডাকসু ভিপি সিপিবি নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, ডাকসু নির্বাচনে এমন জালিয়াতি পাকিস্তান আমলের স্বৈরশাসকও করার সাহস পায়নি।

বস্তাভর্তি সিলমারা ব্যালট উদ্ধারের ঘটনা দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এই ছাত্রী। এই ছাত্রী প্রশ্ন রাখেন — যে শিক্ষকরা ভোট ডাকাতি করেন, তাদের কাছ থেকে আমরা কি শিখব। 

এমনকি অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন, অধ্যাপক কামরুল হাসান, অধ্যাপক ফাহমিদুল হকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের আট শিক্ষক এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, ‘এত বছর পরে অনুষ্ঠিত এই ডাকসু নির্বাচন সফলভাবে না করতে পারার ব্যর্থতার দায়ভার প্রশাসন থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষক সবার এবং এই ব্যর্থতা শিক্ষক সম্প্রদায়ের নৈতিকতার মানদণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।’

প্রায় ২৯ বছর পরে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচন অনেককে খানিকটা হলেও নস্টালজিক করে তুলেছে। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম যেমন ফিরে গেছেন পাকিস্তান আমলের স্বৈরশাসকের অধীনে হওয়া ডাকসু নির্বাচনে, তেমনি কেউ কেউ ফিরে গেছেন ১৯৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচনে। অনেকেই তুলে ধরেন রাজনৈতিক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের লেখা ‘জাসদের উত্থান-পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি’র (প্রথমা প্রকাশন, অক্টোবর, ২০১৪, পৃ. ১০৫-১০৬) এই উদ্ধৃতিটি, ‘... ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সেটা ছিল একটা কলঙ্কজনক দিন। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠন জিতে যাবে, এটা মেনে নেওয়ার মতো উদারতা আওয়ামী লীগ সরকারের ছিল না। জাসদ থেকে অভিযোগ করা হয়, সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নেওয়া হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরীর কাছে অভিযোগ জানালে তিনি কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি একজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হিসেবে সরকারে যোগ দেন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।’

বর্তমান ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামানকে সরকার সিইসির আসনে বসাবেন, মন্ত্রী বানাবেন নাকি ব্যবহৃত টিস্যুর মতো ছুড়ে ফেলবেন, সেটি সরকারের ব্যাপার। কিন্তু তার প্রতি শিক্ষার্থীসহ দেশের মানুষের যে ঘৃণা তৈরি হলো, সেটিও নিশ্চয়ই প্রকাশ পাবে যুগে যুগে। আজ যেমন আবার সামনে এসেছে ৭৩-এর ভিসি অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরীর কথা।

৭৩ সালে সে নির্বাচনে হেরে গিয়ে ছাত্রলীগের বাক্স ছিনতাইয়ের পর আর ঘোষিত হয়নি ফলাফল। থমকে যায় ডাকসু নির্বাচন। পরে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আবার ফিরিয়ে দেন ছাত্রদের হাতে তাদের গর্বের ডাকসু নির্বাচনের অধিকার। সে সময় ৭৯, ৮০ ও ৮২ সালে পরপর তিনটি নির্বাচন হয়, যার কোনোটিতেই ছাত্রদল ডাকসুতে ভিপি বা জিএস পদ পায়নি। তাই বলে কেউ ভোটের বাক্স ছিনতাই বা ফল পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করেননি।

নির্বাচন শুরুর আগে ব্যালট বাক্স দেখানোই বাধ্যতামূলক নিয়ম। এতে সব পক্ষ সন্দেহমুক্ত হয়। কিন্তু কিছু হলের প্রভোস্ট ব্যালট বাক্স দেখাতে অস্বীকৃতি জানান। তাতেই সন্দেহ দানা বাঁধে ছাত্রলীগ ছাড়া বাকি প্রার্থীদের মনে। ব্যালট বাক্স দেখানোর দাবিকে কেন্দ্র করে ভোটগ্রহণ বিঘিœত হয় রোকেয়া হল ও সুফিয়া কামাল হলে। রোকেয়া হল, সুফিয়া কামাল হলে এই সন্দেহের মূলে রয়েছে কুয়েত-মৈত্রী হল। এ হলে আগের রাতেই ব্যালটে ভোট দিয়ে রাখা হয়েছিল ছাত্রলীগের হল প্যানেলের প্রার্থীদের পক্ষে।

এ সরকার ও তাদের সহযোগীরা যে রাতের ভোটের ওস্তাদ, সেটা তো এরই মধ্যে জেনে গেছে সবাই। সে সন্দেহ থেকেই ডাকসু নির্বাচনে হলগুলোতে আগের রাতে ব্যালট পেপার ও বাক্স না পাঠানোর দাবি করেছিল ছাত্রলীগ ছাড়া বাকি সব সংগঠন ও প্রার্থী। কিন্তু তাদের সে দাবি কানে তোলেনি দলকানা প্রশাসন। ফলে রাতের ভোটের সংস্কৃতিতে জড়িয়ে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পর্যন্ত!

শিক্ষককে এখনো সবাই শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। মা-বাবার পরই শ্রদ্ধার আসনে রাখেন শিক্ষকদের। সেই শিক্ষকরা যখন একটা দলের পক্ষে রাতের ভোটের অংশীদার হয়ে যান, দিনের ভোটের জালিয়াতির সহযোগী হয়ে যান, তখন তাদের অবস্থানটা আর
কোথায় থাকে? কতটা নিচে নামলেন তারা? শুধু কি নিজেরাই নামলেন! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষকের মুখেই কি তারা এঁটে দিলেন না কালির প্রলেপ?

এবার ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৪৩ হাজার ২৫৬ জন। তার মধ্যে ভোট পড়েছে ২৫ হাজারের কিছু বেশি। ডাকসুর ২৫ পদের মধ্যে ২৩টিতেই জয় পেয়েছে ছাত্রলীগ। শুধু ভিপি ও সমাজসেবা সম্পাদক পদে জয়ী হয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। এতে ভিপি পদে নুরুল হক নুর পেয়েছেন ১১ হাজার ৬২ ভোট। ছাত্রলীগের রেজওয়ানুল হক শোভন পেয়েছেন ৯ হাজার ১২৯ ভোট। জিএস পদে ছাত্রলীগের গোলাম রাব্বানী পেয়েছেন ১০ হাজার ৪৮৪ ভোট। রাশেদ খান পেয়েছেন ৬ হাজার ৬৩ ভোট। এজিএস পদে ছাত্রলীগের সাদ্দাম হোসেন পেয়েছেন ১৫ হাজার ৩০১ ভোট। ফারুক হোসেন পেয়েছেন ৫ হাজার ৮৯৬ ভোট। ছাত্রলীগ থেকে ‘বিজয়ী’ বাকিরাও প্রায় সবাই ভোট পেয়েছেন ১০ হাজার থেকে ১২ হাজারের মধ্যে। আর ১৮ হলের ৩৬ ভিপি-জিএসের মধ্যে ১০টিতে হেরেছে ছাত্রলীগ, যার প্রায় সবগুলোই ছাত্রীহল।

লক্ষণীয় যে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক নুর ১১ হাজারের বেশি ভোট পেলেও একই সংগঠনের আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদের ঘরে পড়েছে মাত্র ছয় হাজার! আর ফারুক পেয়েছেন ছয় হাজারের কম! নুরুল হক নুরকে যে ভিপি ‘বানানো’ হচ্ছে এমন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল নির্বাচনের দিন সন্ধ্যা থেকেই। রাত যত গভীর হয়, সে গুঞ্জনও ততই গাঢ় হয়।

অনেকেই বলাবলি করছেন, জালিয়াতির মাধ্যমে, প্রভাব খাটিয়ে সব পদ নিলেও ভিপি পদের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ ছাত্রলীগ ছেড়ে দিয়েছে তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে এবং তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার যে সম্ভাবনা রয়েছে, তা নস্যাৎ করতেই এ ছাড় দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের পরে যাতে আন্দোলন দানা বাঁধতে না পারে, নিজেদের মধ্যে যাতে বিভেদ তৈরি হয়, সে কৌশল মাথায় রেখে বাকি সব নিয়ে নিলেও ভিপি পদ ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জোর গুঞ্জন আছে।

অন্যদিক ছাত্রলীগের দৃষ্টিতেও কি এই নির্বাচন সঠিক হয়েছে? হয়নি। তারা এই ফলাফলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। এই ফলাফলকে ভুয়া বলে সেøাগান দিয়েছে। এই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। ছাত্রলীগের দৃষ্টিতে নুরকে ভিপি বানানো হয়েছে জালিয়াতির মাধ্যমে। আর ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য সব ছাত্র সংগঠনের দাবি, ছাত্রলীগ প্রশাসনের একাংশের সহযোগিতায় জালিয়াতির মাধ্যমে ফলাফল ছিনিয়ে নিয়েছে তাদের পক্ষে। তাহলে উপসংহারটা কী দাঁড়াল? উভয় পক্ষের দাবি মতেই প্রশাসন একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচন চলাকালে যে নুরকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছে ছাত্রলীগের মেয়েরা, ডাকসু ভিপি হিসেবে নির্বাচিত ঘোষণার পর যে নুরকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে ছাত্রলীগ, সেই নুরকেই আবার খুঁজে এনে মধুর ক্যান্টিনে নিয়ে বুক মিলিয়েছেন ছাত্রলীগের সভাপতি ও ডাকসু ভিপি প্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ।

নুরুল হক নুরকে ছাত্রলীগ সভাপতির এই যে বুকে টেনে নেওয়া, তা কতটা আন্তরিকতা আর কতটা কৌশল তার, তা নুরই প্রকাশ করেছেন এভাবে, ‘ক্ষমতাসীনরা যখন সুবিধাজনক মনে করে, যখন আমাদের লাগে, তখন বুকে টেনে নেয়। আবার যখন মনে করে আমরা শত্রু, তখন মার দেয়। তার উদাহরণ আমরা গতকালও দেখেছি। বেগম রোকেয়া হলে ছাত্রলীগ নেত্রীরা আমাদের মেরেছে। গত ৩০ জুনও তারা আমাকে মেরেছিল। আজকেও শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে আমি টিএসসিতে এসেছি, কিন্তু আমাকে তারা ধাওয়া দিয়েছে। তাদের মুখে মধু, অন্তরে বিষ। তাদের বিশ্বাস করাটা খুব টাফ।’ সুতরাং নুরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যখন ছাত্রলীগের ‘তাকে লাগে’ তখন তিনি ছাত্রলীগের কাজে ব্যবহৃত হবেন নাকি যে সাধারণ ছাত্ররা তাকে আজকের নুরুল হক নুর বানিয়েছেন, তাদের চাওয়াকে মূল্য দেবেন।

কার্টসি —  দেশরূপান্তর/ মার্চ ১৪, ২০১৯। 
লিঙ্ক —  http://bit.ly/2Hz32Zl

Wednesday, March 13, 2019

An open letter to Dr Gowher Rizvi


 Taj Hashmi  

Dear Gowher,

IN HINDSIGHT, I think I should have written this letter ten years back, days after you became the international affairs adviser to the prime minister of Bangladesh. I am sorry, I failed miserably to perform my duty as a friend towards a very good old friend on time. I should have advised you what I thought and still think would be a good piece of advice to someone who was going in the wrong direction. I know, it’s too late to write this letter when you have already reached that undesirable place and, not only that, you are also enjoying the place and everything about it. You have virtually become inseparable from the place and your associates who live there.

However, I strongly believe that your associates — I won’t call them your friends, because friends are selfless well-wishers, which they are not. They are simply fortune-diggers, delusional, power-drunk people, who can do anything — actually they are doing everything — to remain in their paradise. I am so sad to tell this bluntly on your face, your presence has actually emboldened them to remain there in the main alley of power. They are possibly telling themselves: ‘If Dr Rizvi can do it, we all should do it with greater vigour and determination’!

Why I think I should have written this letter soon after you stepped on the stairs of the fake citadel of glory, as I believe what Umar bin-Khattab, the second caliph of Islam, said about one good quality of a good friend: ‘Whosoever shows you your faults is your friend. Those that pay you lip service in praise are your executioners!’ Sorry, I was delusional as I thought soon you would regret with utmost remorse about what you were going to do! Sorry for my naiveté and stupidity!

Before I spell out the purpose of this letter — which in no way is an attempt to take you out from the place which has become your permanent abode and haven, where the bartender offers the best of drinks, apparently free of any charges! However, there is a cost, not-so-hidden one, one pays even to enter the bar, let alone enjoying the colour, smell, and taste of liquid in the Bohemian crystal goblet! I write this for our old time’s sake. More precisely, I write this as I saw you making some blatantly stupid things, full of lies and half-truths in front of a TV camera at a debate or seminar at the Oxford Union, justifying the arrest and torture of Dr Shahidul Alam who is also a very good old friend of yours, which you have spelt out a couple of times during your interview. I write this because it was the last straw for me, I couldn’t take it any more!

You know telling some unpleasant truth bluntly on someone’s face is sometimes like banging your door shut to a very near and dear one. It hurts both who tells the bitter truth to a near and dear one, and also the receiver of the blunt words from an old friend and admirer. Gowher, you know this good old obscure mediocre friend of yours is simply overwhelmed by your kindness and deep love for him, for all these years! While some forget and even worse, deny getting any favour from friends, I’m not one of them. You were instrumental in inviting me to give a lecture at St Anthony’s College at Oxford, way back in 1991. Then you were the one who asked me to apply for the one-year-long prestigious fellowship at the Centre for International Affairs at the Queen Elizabeth House, at Oxford. You, as the director of the centre, played a decisive role in my selection as a visiting fellow at the QEH. Without this fellowship, I wouldn’t have been able to write my second major book, and several other journal articles and book chapters. And you did this as a parting gift to this old friend of yours before leaving Oxford to join the Asia Society, in 1994. My turn of getting favours from you didn’t stop there. You also inducted me in as a member of the editorial board of your journal, Contemporary South Asia, which I held for 16 years. Your strong references landed me to some very good jobs in the US. While referees, in general, write three paragraphs for candidates they support, each time I asked for a reference from you, you always wrote at least three pages, which were full of superlatives in my praise, which I don’t think I was really entitled to!

Last but not least, you wrote a very strong endorsement to my last book, Global Jihad and America, which I believe attracts many to my book. I can go on and on to write more about your qualities, and what you have done to the realms of academia, at Oxford, Harvard, and Virginia. The way you metamorphosed yourself from a world-class historian to a world-class professor, scholar, and analyst of international affairs, public policy, and other areas of research and development has very few parallels. And you know, I don’t get anything by writing all these in your praise. I just call a spade a spade.

I hope you would take this letter gracefully. My criticism of your association with something, which I consider abhorrently stinky is not a criticism of your persona, but your wrong choice. Then again, we may agree to disagree on this. Your defence of the present government in Bangladesh — which some people, including me, love to call ‘regime’ — shocks and surprises me; what’s most surprising is, however, your telling things which are ‘not true’ — hope you won’t mind my calling them ‘blatant lies’!

The way you defended the present government confused me a lot. You denied there was no one-party government in Bangladesh. Well, it all depends on how you call a one-party tamasha a multi-party democracy, while ruling and opposition party MPs are sitting on both sides of the aisle. It’s like Theresa May and Jerome Corbyn sitting side-by-side in the British oarliament!

At a recent Oxford Union debate, telecast by Al Jazeera’s Head to Head programme, what you told the savvy and smart host Mehdi Hussein was least convincing, to put it mildly. I couldn’t believe my eyes when I saw your handsome face on my computer monitor and heard your soothing voice that there had been some irregularities in less than twenty polling centres out of the total 40,000 on the last election day in Bangladesh. By the way, none of my close friends and relatives in Bangladesh could cast their vote. They found polling centres’ doors unopen till midday. And international media outlets, including the BBC and some Indian TV channels, showed stuffed ballot boxes minutes after the polls, which officially began at 8:00am.

Mehedi Haque/The New Age 

Interestingly, these media outlets also showed there were no voters inside the polling centres, but some outsiders busy stuffing papers (I assume, sealed ballot papers) to make the impossible possible. At the end of the day, the ruling party got around 96 per cent of votes! I am sure, one opposition candidate, one Mr Rumi, didn’t get a single vote in his constituency in Chittagong? And yet at another constituency in Khulna, the number of vote cast exceeded the total number of voters.

It’s noteworthy, the way the ruling party again came to power day after the ‘elections’ on December 30 (or the night before!) even irritated president Donald Trump. The whole exercise was as farcical as what regularly happens in countries like North Korea, and Egypt! Your other good friend retired US ambassador William Milam has called the worst election that ever took place anywhere in the world after the collapse of the Soviet Union. I hope you would be still in talking terms with him!

Shahidul Alam 

The last straw for me was your unfazed and nonchalant assertion that your ‘good friend’ Shahidul Alam was not arrested for giving an interview to Al Jazeera, he was arrested for ‘spreading misinformation that incited violence’, and that ‘freedom of speech has nothing to do with it.’ You also manufactured some ‘facts’ to misled the audience at the Oxford Union debate, and tens of thousands of others who later watched the show on TV or computer monitors. You said Shahidul Alam had told his Al Jazeera interviewer on August 6, 2018 that there were dead bodies at the Awami League office at Dhanmondi (a suburb in Dhaka) and that Awami Leaguers had raped many women at that office. This is what Sahhidul Alam didn’t tell his interviewer. I think an unconditional apology by you to Dr Shahidul Alam, and to the Bangladeshis at home and abroad, is overdue now.

With warm wishes and kind regards! No hard feelings my friend!

Sincerely,
Taj Hashmi
Adjunct Professor of Criminal Justice
Austin Peay State University, Tennessee

Tuesday, March 12, 2019

'প্রহসনের নির্বাচন মানি না, মানবো না' …এটা এখন সর্বজনীন

মাকসুদুর রহমান 



শ্লোগানটি শুনে নিশ্চয়ই  মনে হচ্ছে এটা বিরোধী কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর । অথবা গত ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মানুষ নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে ব্যর্থ সবার নীরব কন্ঠস্বর। দেশে সাম্প্রতিক সময়ে ৩০ ডিসেম্বরের ভোট ডাকাতির নির্বাচনের পর প্রতিটি মানুষই নিজের অজান্তেই উপরের শ্লোগানটি অন্তত মস্তিস্কের চিন্তাজগতে হলেও আওড়ান। তবে গত ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ - ডাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা ভোট জালিয়াতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য ‘প্রহসনের নির্বাচন মানি না, মানবো না’ শ্লোগানে ঢাকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করেছে। তাদের কন্ঠস্বর এক অর্থে ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ভোট দিতে ব্যর্থ হওয়া ক্ষুব্ধ  কোটি, কোটি অধিকার বঞ্চিত মানুষের নীরব প্রতিবাদী সুরেরই প্রতিধবনি ।

সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হচ্ছে, সোমবার সারাদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ ছাত্রসংঠন এবং সাধারণ শিক্ষার্থী ডাকসু নির্বাচনকে প্রহসনের নির্বাচন তা বাতিল করে নতুন তফসিল ঘোষণা করার দাবী জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকম্পিত করেছে তখন একমাত্র ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ এটাকে ‘নাটক’ বলে অভিহিত করেছে। অথচ গভীর রাতের সিদ্ধান্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ যাতে দানা বেঁধে উঠতে না পারে সে বিষয়টা মাথায় নিয়ে পরিকল্পিতভাবে বা অনেকটা বাধ্য হয়ে  ভিসি   যখন ভিপি হিসেবে নুরুল হক নুরের নাম    ঘোষণা দেন, তখনই সারাদিন প্রকম্পিত শ্লোগান সর্বজনীনতা খুঁজে পায় ! কারণ ততক্ষণে নির্বাচনকে ছাত্রলীগও প্রহসন অভিহিত করে তাদেরই অতিপ্রিয় ভিসির বিরুদ্ধে শ্লোগান তোলে। ভিসিসহ অন্যান্য দায়িত্বশীল শিক্ষকদের  অবরুদ্ধ করে রাখে সিনেট ভবনে। আর সকাল হতেই ছাত্রলীগ ভিসি’র বাসভবন ঘেরাও করে। 

তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ছাত্রলীগও  বুঝতে পারছে , গতকাল যে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে তা পুরোটাই ছিলো প্রহসন ! আর ভিসি’র ঘরের ছেলে হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগও  যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থীর দাবী্কে ঠেকায় পড়ে হলেও  ‘নির্বাচনকে প্রহসন’ হিসেবে মেনে নিয়েছে।

Monday, March 11, 2019

রাতের ভোট!


গোলাম মোর্তোজা


দেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন। তাদের কার্যক্রম অর্থাৎ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশ কারা পরিচালনা করবেন, তা নির্ধারিত হয়। সেই নির্বাচন কমিশনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার যখন একটি কথা বলেন স্বাভাবিকভাবেই তা গুরুত্ববহন করে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিগত নির্বাচন নিয়ে কিছু কথা বলেছেন। কথাগুলো শুধু গুরুত্বপূর্ণ বা তাৎপর্যপূর্ণই নয়, ভিন্নমাত্রার একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। জেনে নেওয়া যাক তিনি কী বলেছেন-

“... যদি ইভিএমে ভোটের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে আর আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করার সুযোগ থাকবে না।” (প্রথম আলো, ৮ মার্চ ২০১৯)।

রাতে ব্যালটবাক্স ভর্তির জন্যে কারা দায়ী, সেটা বলার সুযোগ নির্বাচন কমিশনের নেই বলেও জানান সিইসি।

“কারা সেজন্য দায়ী, তাদেরকে কী করা যাবে… সেই দীক্ষা-শিক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা যোগ্যতা আমাদের কমিশনের নেই এবং সেভাবে বলারও সুযোগ কোনো নেই যে, কী কারণে হচ্ছে, কাদের কারণে হচ্ছে, কারা দায়ী।” (বিডিনিউজ২৪.কম, ৮ মার্চ ২০১৯)।

তিনি আরও বলেছেন, নির্বাচনের পরিবেশ দিন দিন অবনতি হচ্ছে। ছবিযুক্ত, ভোটার তালিকা দিয়েও এখন কাজ হচ্ছে না। ‘নির্বাচনের মত ছোট বিষয়ে’ তিনি সেনাবাহিনী মোতায়েনেরও পক্ষে নন। পৃথিবীর কোন দেশ জাতীয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করে?- প্রশ্ন করেছেন সিইসি।

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এই কথাগুলো বিশ্লেষণ করলে যা দাঁড়ায়-

ক. নির্বাচন কমিশন অবগত ছিলো যে, নির্বাচনে আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরে রাখা হয়েছিলো।
খ. যারা রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভরেছিলেন, তাদের কিছু বলার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই।
গ. ইভিএম ব্যবহার করলে আর আগের রাতে ব্যালটবাক্স ভরে রাখা যাবে না।

২.
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে নির্বাচনের আগের ২৯ ডিসেম্বর রাত ১০টার পর থেকে অভিযোগ করা হয়েছিলো ‘ভোট কেন্দ্রে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সে ঢোকানো হচ্ছে’। সেই অভিযোগ নির্বাচন কমিশন আমলে নেয়নি। এখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেই স্বীকার করছেন, রাতে ভোটের বিষয়টি। কেনো তিনি তখন কিছু বলেননি বা করেননি? যারা রাতে ভোট দিয়েছেন তাদের বলার ‘দীক্ষা-শিক্ষা, ক্ষমতা-সুযোগ-যোগ্যতা’ নির্বাচন কমিশনের নেই, তিনি নিজেই তা বলছেন। কিন্তু, আমরা তো জানি যে, নির্বাচন কমিশন যাদের প্রয়োজন মনে করেন তাদের নির্বাচনী কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। যাদের সম্পৃক্ত করেন তাদের শুধু কিছু বলা নয়, তাদের বিষয়ে যে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার- ক্ষমতা, সুযোগ নির্বাচন কমিশনের আছে। বাংলাদেশের সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে। ’দীক্ষা-শিক্ষা’ নির্বাচন কমিশনের, না প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনারদের নেই, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

প্রাসঙ্গিকভাবেই মানুষের জানতে ইচ্ছে করবে, নির্বাচন কমিশন যাদের নিযুক্ত করেছেন তাদের বাইরে অন্য কেউ বা কোনো শক্তি রাতের বেলা ব্যালটবাক্স ভরাট করেছেন? নির্বাচন কমিশনকে অবহিত না করে সরকার নির্বাচনী কার্যক্রমের সঙ্গে কাউকে নিযুক্ত করতে পারেন না। নির্বাচন কমিশন কখনো তেমন কোনো অভিযোগ করেওনি। তাহলে রাতের বেলা ব্যালটবাক্স ভরনেওয়ালাদের কে বা কারা নিযুক্ত করলো? নির্বাচন কে করছে? নির্বাচন কমিশন, না অন্য কেউ?

ইভিএম বিষয়ে অনেকবার বিস্তারিত লিখেছি। এই আলোচনায় বিস্তারিত বলছি না। প্রাসঙ্গিকভাবে যা না বললেই নয়, রাতে ব্যালটবাক্স ভরনেওয়ালাদের নির্বাচন কমিশন যদি কিছু বলতে না পারে, তাহলে ইভিএম মেশিনগুলো তারা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে? যারা রাতের বেলা বাক্স ভরেছেন, তারা ইভিএম মেশিনেও রাতে ভোট দিলে ঠেকাবেন কীভাবে? ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরতে তাও তো কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হয়। ইভিএমে তো খুব অল্প সময়ে অনেক ভোট দেওয়া যায়।

যার ভোট তার স্মার্ট কার্ড বা আঙ্গুলের ছাপ ছাড়া মেশিনে ভোট দেওয়া যাবে না বলে যা বোঝানো হচ্ছে, যা তথ্য হিসেবে সঠিক নয়। প্রিসাইডিং অফিসার নিজে যে কারো ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। সেভাবেই মেশিনের প্রোগ্রাম সেট করা থাকে। সাধারণত প্রিসাইডিং অফিসার ২৫ জনের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। এই সংখ্যা বাড়ানো, প্রোগ্রাম যারা সেট করবে তাদের কাজ। সুতরাং ইভিএমেই সমাধান- এই বক্তব্যও মেনে নেওয়া যায় না।
৩.
রাতে ব্যালটবাক্স ভরা বিষয়ে সিইসি এখন যা বলছেন, নির্বাচনের পরপরই তা সুনির্দিষ্ট করে বলেছিলো টিআইবি। ৫০টি কেন্দ্রের মধ্যে তারা ৪৭টি কেন্দ্রে অনিয়ম পেয়েছিলো। ৩৩টিতে আগের রাতে ব্যালটবাক্স ভরে রাখার প্রমাণ পেয়েছিলো। টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী শতকরা ৬৬ ভাগ কেন্দ্রে রাতে ভোট দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিলো।

সেই সময় টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনকে নির্বাচন কমিশন বলেছিলো, এটা কোনো গবেষণাই নয়। পূর্ব নির্ধারিত মনগড়া তথ্য দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। কিন্তু, সিইসির এখনকার বক্তব্য আর টিআইবির প্রতিবেদনের মূল বক্তব্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

সিইসির বক্তব্য নিশ্চয় মনগড়া নয়।

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য অনুযায়ী এটি কি অনুমিত হয় না যে, টিআইবির প্রতিবেদন সঠিক ছিলো?

ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার আগে ব্যালটবাক্স ভর্তির ভিডিও চিত্র দেখিয়েছিলো বিবিসি। নির্বাচন কমিশন বেলা ৩টার দিকে ওই কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ বাতিল করে দিয়েছিলো? রাতে কারা ব্যালট বাক্স ভরলো, নির্বাচন কমিশন তা তদন্ত করে প্রকাশ করেনি।

খুলনার একটি আসনে মোট ভোটারের চেয়ে প্রার্থীদের প্রাপ্ত মোট ভোট বেশি হয়ে গিয়েছিলো। রিটার্নিং অফিসারের দেওয়া ঘোষণা অনুযায়ী রিপোর্ট প্রকাশ করায় অসত্য সংবাদ প্রকাশের দায়ে সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। কিন্তু, সংবাদটি যে অসত্য ছিলো না, ডয়চে ভেলেসহ অন্যান্য গণমাধ্যম তথ্য ও ভিডিওচিত্রের বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলো। বগুড়ার কয়েকটি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিলো। এসব ঘটনাগুলোর কোনো তদন্ত নির্বাচন কমিশন করেছে- এমন তথ্য জানা যায়নি।

এখন কী বিবিসির ভিডিওচিত্র, ভোটারের চেয়ে বেশি ভোটের ভিডিওচিত্র, টিআইবির প্রতিবেদন ও সিইসির বক্তব্য আমলে নিয়ে, রাতে ভোটের বিষয়ে একটি সামগ্রিক তদন্তের উদ্যোগ নিবে নির্বাচন কমিশন?

৪.
রাতে ভোট বিষয়ক অভিযোগের এখানেই শেষ নয়।

‘ভোটের আগের রাতেই ভুয়া ভোটের মাধ্যমে ব্যালটবাক্স ভর্তি করে রাখাসহ নানা অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে’- জাসদ নেতা শরীফ নুরুল আম্বিয়া, (দ্য ডেইলি স্টার, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)।

‘উপজেলা নির্বাচনে এবার রাতের বেলা ভোট হবে না। এখন দিনের বেলাতেই হবে ভোট ডাকাতি’- রাশেদ খান মেনন, (বাংলা ট্রিবিউন, ৬ মার্চ ২০১৯)।

শরীফ নুরুল আম্বিয়ার জাসদ এবং রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি ক্ষমতাসীন মহাজোটের অংশ। দুজনের বক্তব্য থেকেও রাতে ভোটের বা ব্যালটবাক্স ভরে রাখার তথ্য মিলছে। যে নির্বাচনে রাতে ভোটের কথা বলছেন, সেই নির্বাচনে রাশেদ খান মেনন এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। জাসদ থেকেও মইনউদ্দিন খান বাদল এমপি নির্বাচিত হয়েছেন।

বামজোটও বলেছে ভোট ডাকাতি হয়েছে, রাতের বেলা ভোট হয়েছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কি ‘রাতে ব্যালট বাক্স’ ভরে রাখা বক্তব্যের অধিকতর ব্যাখ্যা দিবেন? যারা রাতে বাক্স ভরলেন তাদের নির্বাচন কমিশন যেহেতু কিছু বলতে পারেনি, গণমাধ্যমের সামনে এসে তো প্রধান নির্বাচন কমিশনার তার অক্ষমতার কথা বলতে পারেন। কারা রাতে ভোট দিলো, তা প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানেন। তিনি যদি বলেন ‘কিছু বলার সুযোগ নেই’ বা ‘ক্ষমতা নেই’- এই নির্বাচনটিকে ইতিহাস কীভাবে মূল্যায়ন করবে?

নির্বাচন কমিশন বলছে, উপজেলা নির্বাচনে অনিয়ম হলে সেই আসনের নির্বাচন বাতিল করে দেওয়া হবে। তিনি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচন বাতিল করে দিতে চাইছেন, অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া নির্বাচন সম্পর্কে কথা বলবেন না কেনো? আপনাদের যে কাজ করা সাংবিধানিক দায়িত্ব, সেই কাজ বিষয়ে আপনারাও যদি অভিযোগের সুরে কথা বলেন, কাজটি করবেন কে?

‘সুযোগ নেই’, ‘ক্ষমতা নেই’ বললে কী সাংবিধানিক এই পদে থাকার যৌক্তিকতা থাকে?


Sunday, March 10, 2019

ডাকসু নির্বাচন ২০১৯ — প্রশ্ন করুন, কাকে ভোট দিচ্ছেন?


মোঃ নিজাম উদ্দিন


আবু বকরের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে! ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল সে। অত্যন্ত কষ্ট করে তার দরিদ্র মা-বাবা সন্তানকে মানুষ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছিল। টিউশনি করে চালাত সে তার পড়াশোনার খরচ। অসম্ভব মেধাবী আবু বকর ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ছিল। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে এখন পর্যন্ত সে ই সর্বোচ্চ ফলাফলের অধিকারী!

বেঁচে থাকলে এখন আবু বকর হয়ত দেশের নাম করা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত অথবা বড় কোনো অফিসার!

কিন্তু তার স্বপ্ন সফল হয়নি! শিক্ষার জন্য সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও তাকে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল লাশ হয়ে! আবু বকরের মায়ের চোখের জল হয়ত শুকিয়েছে,বাবার হয়ত এখন সন্তানের জন্য দোয়া ছাড়া কিছু ই করার নেই! ভাই বোনেরা হয়ত এখনও কাঁদে!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসাবে আবু বকর আপনারও ভাই। ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১০, কারা মেধাবী আবু বকরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলে তার রুমের সামনে গুলি করে হত্যা করেছিল তা নিশ্চয়ই এদেশ ভুলে যায়নি! হত্যাকারীরা এখন বুক ফুলিয়ে হাঁটে! তারা বেকসুর খালাস!

১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ - ডাকসু নির্বাচন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সচেতন ছাত্র হিসাবে আপনি কোনো ভাবেই ডাকসু নির্বাচনে কোনো আবু বকরের খুনী হত্যাকারীদের প্যানেলে আপনার ভোট দিতে পারেন না।

দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হিসাবে ডাকসু নির্বাচনে ব্যালটে সিল মারার  আগে নিজের বিবেককে প্রশ্ন করুন - কাকে ভোট দিচ্ছেন?


  • লেখক — মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সহ-সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটি। 

ডাকসু নির্বাচন ২০১৯ — ৩০ ডিসেম্বর মার্কা নীলনকশা নির্বাচনের শঙ্কা এবং প্রত্যাশা

মাকসুদুর রহমান 

আগামী কাল সোমবার, মার্চ ১১, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সংসদ  —  ডাকসু নির্বাচন। দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত এবারের নির্বাচন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়াও সারাদেশের সচেতন মানুষদের উত্তেজনা, আবেগ, আশাঙ্কার শেষ নেই।  তবে ৩০ ডিসেম্বরের ভয়াবহ ভোট জালিয়াতির নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ডাকসু নির্বাচনের যে তফসিল ঘোষণা করে তাতেই এ নির্বাচনের পরিণতি সম্পর্কে সবাই আঁচ করতে পারেন। আর সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে বিবেচিত যে ‘ডাকসু’ সেখানেও এবার  ‘সিইসি’ নুরুল হুদার ভুত ভর করেছে! যেখানে প্রধান ক্রীড়াণক হিসেবে ভূমিকা রাখছেন বিতর্কিত ভিসি আখতারুজ্জামান। তিনি যে সিইসি নুরুল হুদার দেখানো পথেই একটি নীলনকশার ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন করেছেন তা প্রমাণের জন্য নিন্মোক্ত কারণগুলোই যথেষ্ট  —  

১। ছাত্রলীগ ছাড়া ক্রিয়াশীল সকল  ছাত্রসংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের  দাবী উপেক্ষা করে ভোট কেন্দ্র হলে স্থাপন।

২। ব্যালট বক্স স্টিলের তৈরি।  স্বচ্ছ নয়, তাই  বাহির থেকে কিছুই দেখা যায় না।

৩।  ভোট প্রদানের জন্য ব্যবহৃত  ব্যালট পেপারে নামের পাশে খালি ক্রস চিহ্ন দিতে হবে।

৪। ব্যালট পেপার ভাঁজ করা যাবে না (ভাঁজ করলে নাকি ভোট বাতিল বলে গণ্য হবে)। 

৫।  প্রার্থীরা নিজেদের কোনো পোলিং এজেন্ট রাখতে পারবে না। নির্বাচনী পোলিং এজেন্ট থাকবে হাউজ টিউটর স্যাররা ( গত ১০ বছরে যেসব ছাত্রলীগ  ক্যাডার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেয়েছেন,মূলতঃ তারাই নির্বাচনী কাজে দায়িত্ব পালন করবেন)। 

৬।  ভোটকেন্দ্রে বুথ এলাকায় কোন সাংবাদিক ঢুকতে পারবেন না। তারা হলের গেস্টরুম পর্যন্ত যেতে পারবেন বড়জোর (স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রগুলোর প্রকৃত চিত্র জানার সুযোগ আর থাকছে না)! 

৭। ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে সময় মাত্র ৬ ঘন্টা। প্রতি ভোটারকে ৩৮টি ভোট দিতে হবে  (যারা হলের বাইরে থাকে মূলতঃ ভোট দেয়া থেকে বিরত রাখতেই এই সিদ্ধান্ত)। 

প্রশ্ন উঠতে পারে এতসব সন্দেহ, অবিশ্বাস, আশাঙ্কা মাথায় নিয়ে কেন ছাত্রসংগঠন ও সর্বোপরি সাধারণ শিক্ষার্থীরা ডাকসু নির্বাচন নিয়ে সবাই উৎসাহিত বা পরিস্কার করে বললে উত্তেজিত। এর কারণ একটাই, ‘ডাকসু’ই পারে বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান স্থবির গণতান্ত্রিক অচলাবস্থা দূর করতে আলোর পথ দেখাতে।

সেটা যদি হয়, ৭৩ এর ব্যালট বাক্স ছিনতাই বা ২০১৮ এর নীলনকশার  ধরনের নির্বাচন তবুও। কারণ ‘ডাকসু’ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে যে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের চেতনা জাগ্রত হয়েছে, তা আগামী দিনে বাংলাদেশের বৃহত্তর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রূপ নেয়ার সমূহ সম্ভাবনার পথ সুগম করবে।


  • লেখক —  রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক। 


Friday, March 8, 2019

রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ৯১০ কোটি টাকা অপচয়


ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন



নির্বাচন কমিশন পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে ৯১০ কোটি টাকা বাজেট চূড়ান্ত করেছে। চতুর্থ উপজেলা নির্বাচন ছয় ধাপে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এবার পাঁচ ধাপে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। নির্বাচনের কাজ সম্পন্ন করতে ইসি ব্যয় করবে ৯১০ কোটি টাকা। পাঁচ বছর আগে ২০১৪ সালে ছয় ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাজেট ছিল ৪০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনের বাজেট থেকে আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্য বাজেট ৫১০ কোটি টাকা বেশি।

নির্বাচন কমিশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ৯১০ কোটি টাকার বাজেটের বিরাট অংশ, অর্থাৎ ৭৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে নির্বাচন পরিচালনায় নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য। এই বরাদ্দের বড় অংশ ব্যয় হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাতাবৃদ্ধির পেছনে। উপজেলা নির্বাচনে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের পারিশ্রমিকও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই পারিশ্রমিক বা ভাতা বৃদ্ধির কারণ বুঝতে কারো অসুবিধা বা কষ্ট হওয়ার কথা নয়। জনমনে গুঞ্জন উঠেছে, নির্বাচনের সাথে নিয়োজিত ব্যক্তিরা বিগত ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচন কী পরিমাণ উৎসাহ ও চতুরতার সাথে ২৯ ডিসেম্বর রাতেই সম্পন্ন করেছেন, সে কাররেণই তাদের পারিশ্রমিক বা ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।’

উপজেলা নির্বাচনে সমালোচিত ও প্রশ্নবিদ্ধ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করার সিদ্ধান্তের কারণেও বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসি সূত্র মতে, শুধু ইভিএম পরিচালনা এবং সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য ১৭০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অথচ সংবাদমাধ্যমে ইসি সচিব উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের তফসিল ঘোষণাকালে বলেছেন, যথাযথ প্রস্তুতি না থাকায় নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। প্রশ্ন উঠেছে, ইভিএম পরিচালনা ও এতদসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ খাতে ১৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার পরেও যথাযথ প্রস্তুতি কেন সম্পন্ন হলো না? দেশের প্রায় সব দলের আপত্তি সত্ত্বেও বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সীমিতভাবে ইভিএম ব্যবহার করে কী ধরনের সুফল হয়েছে, তা জনগণ এখনো অবগত নন।

সংসদ নির্বাচনে জনগণ দেখেছে, ‘ভোট ডাকাতি’র মহোৎসবে ব্যালট আর ইভিএমের মধ্যে কোনো তফাৎ হয়নি, বরং ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে এটা আরো সহজ ও দ্রুত করা সম্ভব হয়েছে। যে দেশে বিগত কয়েকটি নির্বাচনে জনগণের নিজ হাতে ভোট দেয়ার প্রয়োজন হয়নি বা ভোটের মাধ্যমে জনমতের প্রতিফলন হওয়ার সুযোগ হয়নি, সে দেশে ভোটিং মেশিন ব্যবহারের বিলাসিতা করে ১৭০ কোটি টাকার অতিরিক্ত বরাদ্দ অপ্রয়োজনীয় ও অপব্যয় ছাড়া আর কিছু নয়। জনগণের কাছে তা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

দশম জাতীয় সংসদের ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন ও বয়কটের নির্বাচনের প্রহসনের পর জনগণ ভোটের প্রতি আস্থা হারিয়েছে। তার পরেও, দুই মাস পর অনুষ্ঠিত চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের কারণে ভোট দিতে পারবে এমন জনপ্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল। জনগণের মধ্যে ভোটের উৎসবমুখর আবহ সৃষ্টি হয় তখন। জনগণের প্রত্যাশা ও প্রবল ইচ্ছার ফলে চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে জনগণ বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে অংশগ্রহণ করে। জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটিয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের ফলাফলে বিএনপি থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। এ ধারা অব্যাহত থাকলে চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি সব ধাপেই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে, এটা ভেবে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল শঙ্কিত ও চিন্তিত হয়ে পড়ে।

এমনিতেই দশম সংসদের ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। উপজেলা নির্বাচনে পরাজয় মেনে নেয়া তাদের জন্য কঠিন ছিল। এমতাবস্থায়, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব পরবর্তী ধাপের নির্বাচনগুলোতে যেভাবেই হোক বিজয় কেড়ে নেয়ার জন্য দলীয় প্রার্থী, কর্মী ও প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। ফলে পরবর্তী ধাপের নির্বাচনগুলোতে প্রশাসনের সহযোগিতায় ভোটকেন্দ্র দখল, আগের রাতে ভোট ডাকাতি, জালভোট প্রদান, ভোটের দিনে প্রকাশ্যে জোরপূর্বক সরকারদলীয় প্রার্থীর পক্ষে সিল মারা প্রভৃতি হয়েছে। এভাবে নির্বাচনের ফলাফল সরকারি দলের প্রার্থীদের পক্ষে ঘুরিয়ে দেয়া হয়। ছয়টি ধাপের ফলাফল তুলনামূলক বিচার করলে দেখা যাবে, জনমতকে কিভাবে প্রশাসনের সহযোগিতায় ভূলুণ্ঠিত করে সরকারের পক্ষে নিয়ে যাওয়া যায়।

এই ছক পর্যালোচনায় এটা স্পষ্ট যে, নির্বাচন কমিশন চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনকে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার দোহাই দিয়েছে ঠিকই, কার্যত ধাপে ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে সরকারের নীলনকশা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে ভোট দেয়ার জনপ্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল। সরকারি দল ও প্রশাসনের এহেন ন্যক্কারজনক আচরণে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। এতে জনগণের ভোটের প্রতি অনীহা, অশ্রদ্ধা ও আস্থাহীনতা আরো বৃদ্ধি পায়।

আসন্ন পঞ্চম উপজেলা নির্বাচন হতে যাচ্ছে ২৯ ডিসেম্বরের রাতের নজিরবিহীন ভোট ডাকাতির মাধ্যমে অনুষ্ঠিত সংসদের নির্বাচনের দুই মাস পর। প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক মেরে দিয়েছে। এ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা জনগণের কাছে এতই সাম্প্রতিক যে, তা মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হয় না। এ নজিরবিহীন ঘটনার প্রেক্ষাপটেই বিএনপি স্বাভাবিকভাবে পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে এই উপজেলা নির্বাচন হবে একতরফা, প্রতিযোগিতাহীন ও নিষ্প্রভ। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভ করে যে প্রার্থী ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন, তিনিই নিশ্চিতভাবে উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে ‘নির্বাচিত’ বলে ঘোষণা পাবেন।

গত ২৮ ফেব্র“য়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচনের নাটক মঞ্চস্থ হতে দেখেছে দেশের সবচেয়ে সচেতন নগরবাসীরা। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার পর আতিকুল ইসলাম ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পরবর্তী মেয়র বা নগরপিতা, তা আর কাউকে বলে দিতে হয়নি। জনপ্রিয় দল বিএনপি মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করায় উপনির্বাচনটি হয়েছে প্রতিযোগিতাহীন ও একতরফা। তাই ভোটারেরা কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়ার তাগিদ অনুভব করেননি। নতুন ওয়ার্ডের ভোটকেন্দ্রগুলো ছাড়া অন্য সব কেন্দ্র ছিল প্রায় ফাঁকা। নবনির্বাচিত মেয়র হয়তো বুঝতেই পারেননি যে, তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। ভোটারদের অপেক্ষায় ছিল ভোটকেন্দ্রগুলো।

প্রতিদ্বন্দ্বী পিডিপির মেয়র পদপ্রার্থী শাহীন খান রাতে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘নিজে ৪০টির বেশি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। ভোটার উপস্থিতি একেবারেই কম ছিল। সব মিলিয়ে পাঁচ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে বলে মনে হচ্ছিল না। তবুও এত ভোট কোথা থেকে এসেছে, বুঝলাম না।’ নগরবাসীরও প্রশ্ন- এ ধরনের নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে জনগণের ট্যাক্সের টাকা খরচ বা অপচয় করার কোনো যৌক্তিকতা ছিল কি? টাকার অপচয় ছাড়াও এ উপলক্ষে ঢাকা শহরে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে বিলাসিতা করা হয়েছে এবং রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। যে উপনির্বাচনে ভোটের প্রয়োজন হয়নি, সেই নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার স্বার্থে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে বহিরাগতদের বের করার ঘোষণা জনমনে ব্যাপক হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে।

ঢাকার মেয়রের উপনির্বাচন আসন্ন পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের একটি প্রামাণ্যচিত্র হিসেবে বিবেচনা করা যায়। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনও একইভাবে একতরফা ও প্রতিদ্বন্দ্বিহীনভাবে অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছেন যে, তাকে ‘নির্বাচিত’ বলে ঘোষণা করা হবে। এটা জেনে কোনো প্রার্থী কি ভোট ভিক্ষা করার জন্য জনগণের দুয়ারে দুয়ারে যাবেন? জনগণ কি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়ার কোনো তাগিদ বা প্রয়োজন অনুভব করবেন? মোটেই না। তাহলে প্রশ্ন, পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের বাজেটের চেয়ে ৫১০ কোটি টাকা বৃদ্ধি করে ৯১০ কোটি টাকা বরাদ্দের যুক্তিসঙ্গত কারণ বা প্রয়োজনীয়তা আছে কি?

পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, জনপ্রিয় দল বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় মূলত নৌকা মার্কার প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। ইতোমধ্যে নৌকা মার্কার বহু প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। প্রতিটি নির্বাচনে কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থী নানা কারণে বা পরিচিত হওয়ার উদ্দেশ্যে নামমাত্র অংশগ্রহণ করে থাকেন। ফলাফল প্রকাশের পর ওইসব প্রার্থী কে কত ভোট পেয়েছেন, তার খবর আর কেউ রাখে না। পত্র-পত্রিকায়ও প্রকাশ করার প্রয়োজন মনে করা হয় না। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনেও হয়তো কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থী লোক দেখানো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এ ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান (পুরুষ ও মহিলা) পদে নির্বাচন উন্মুক্ত থাকার ফলে ভোটকেন্দ্রে হয়তো কিছু ভোটার উপস্থিত হবেন। কিন্তু দলীয় নির্বাচনে মূল পদে নির্বাচনের নামে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচনের মতোই নাটক মঞ্চস্থ করার কোনো বিকল্প নেই। এমতাবস্থায়, ইতোমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নৌকা মার্কার প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের সাথে অবশিষ্ট নৌকার প্রার্থীদের নির্বাচিত ঘোষণা করে দিলে অতি সহজে নির্বাচন নামের নাটক সমাপ্ত করা যায়। এভাবে, রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করা জনগণের ৯১০ কোটি টাকার অপচয় খুব সহজেই পরিহার করা যায়।


  • লেখক — সদস্য, জাতীয় স্থায়ী কমিটি, বিএনপি এবং সাবেক অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ভূতত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।