অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী |
সঙ্কটটা চরম আকার ধারণ করল ১৯৭৩ সালের ডাকসু ও হল ইউনিয়ন নির্বাচনের সময়।ছাত্রলীগের মুজিববাদী অংশ ততদিনে বুঝে ফেলেছে যে একাকী দাঁড়িয়ে তারা সুবিধা করতে পারবে না; কারণ তাদের বড় অংশই চলে গেছে জাসদ ছাত্রলীগের সঙ্গে, সাধারণ ছাত্ররাও মুজিববাদীদের হিংস্র তৎপরতায় ক্ষুব্ধ, সর্বোপরি ‘বৈজ্ঞানিক’ সমাজতন্ত্রের যে আওয়াজ জাসদ ছাত্রলীগ ছাত্র ইউনিয়নের কাছ থেকে ছিনতাই করে নিয়ে গেছে তারও আকর্ষণ রয়েছে। মুজিববাদীরা বুঝতে পারছিল যে তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা হবে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গেই। সে জন্য তারা সংযুক্ত প্যানেল দিল ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে মিলে। ছাত্র ইউনিয়নের নূহ আলম লেনিন হলো সহ-সভাপতি পদপ্রার্থী, ছাত্রলীগের ইসমত কাদির গামা দাঁড়াল সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য; দুয়ে মিলে লেনিন-গামা পরিষদ। বিপরীতে জাসদ ছাত্রলীগের মাহবুব-জহুর পরিষদ।
ডাকসু ভবন |
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে মুজিববাদীদের পক্ষে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। ভেতরে ভেতরে ছিলও বটে। কিন্তু নির্বাচনের দিন ফলাফল যখন আসতে শুরু করল তখন দেখা গেল অবিশ্বাস্য ঘটনা। সব হলেই বিরোধীরা জয়ী হয়েছে। অথচ সারাদিন এলাকাজুড়ে শোনা গেছে শুধু লেনিন-গামা লেনিন-গামা ধ্বনি, ঝালাপালা হয়ে গেছে ক্যাম্পাসের কান! লেনিন-গামার সমর্থকরা দৃশ্যমান ব্যাজ পরে সর্বত্র ঘোরাঘুরি করেছে, নিশ্চিত বিজয়ের উল্লাসে। অথচ নীরবে ব্যালটবিপ্লব ঘটে গেছে। অনেকটা সত্তরে ছয় দফার বিজয়ের মতোই। লেনিন-গামার ব্যাজ পরেও মাহবুব-জহুরকে ভোট দিয়ে গেছে ছেলেমেয়েরা।
মুজিববাদীরা তখন আর বিলম্ব করেনি, ছিনতাই শুরু করে দিয়েছে। হলগুলোতেই গণনার কাজ হয়েছে প্রথমে। ডাকসুর গণনাটা হবে সব শেষে, সন্ধ্যার পরে, যখন ডাকসুর নির্দিষ্ট ব্যালট বাক্সগুলো সেখানে নেয়া ও খোলা হবে। হলের ফল দেখেই তো কোনো সন্দেহ রইল না যে ডাকসুর ফল কি হবে। কাজেই সেখানেও একই ঘটনা ঘটল। কলাভবনের চারতলায় গণনার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। হঠাৎ করে সব বাতি নিভে গেল এবং পেছনের সিঁড়ি দিয়ে কে বা কারা এসে ব্যালট বাক্সগুলো নামিয়ে নিয়ে চলে গেল। দুয়েকটা বোমা বিস্ফোরণও বোধ করি ঘটেছিল। যদিও তার প্রয়োজন ছিল না। কেননা প্রতিরোধ করার মতো কেউ তো ছিল না। বিপক্ষ দলের ছেলেরা তখন আত্মরক্ষার জন্য নিজেদেরকে অপ্রকাশ্য করে তুলেছে।
চারতলার হল ঘর থেকে আমরা নিচে নেমে এলাম। উপাচার্যও আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। কলাভবনের সামনে দেখলাম চিফ রিটার্নিং অফিসার প্রফেসর ওদুদুর রহমান তাঁর গাড়িতে চড়ছেন। তারা কোথায় যাচ্ছেন এ ব্যাপারে কৌতূহল ছিল। কে যেন বলল, বত্রিশ নম্বরে। ওই যাত্রার সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে এটা তো সত্য ১৯৭৩-এর শুরুতে ডাকসুর সেই ব্যালট ছিনতাই এই ভয়াবহ বাণী দেশবাসীর কানে পৌঁছে দিল যে দেশে গণতন্ত্রের পথটা সুগম হবে না। হয়ওনি। বহু ঘটনা ঘটেছে, ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর অতি অবিশ্বাস্য সব ঘটনা, কিন্তু সূত্রপাত মনে হয় ডাকসুর ওই নির্বাচন বানচালের ব্যাপারটা থেকেই।
সব হলেরই গণনা শেষ হয়ে গিয়েছিল, বাকি ছিল স্বাক্ষর দেয়া ও ঘোষণা করা। সে অবস্থায় গণনার কাগজ ও ব্যালট বাক্স দুটোই ছিনতাই হয়ে যায়। রোকেয়া হলের রিটার্নিং অফিসার ছিলেন আমাদের বিভাগের অধ্যাপক হোসনে আরা হক, ঘটনার গতি আঁচ করতে পেরে তিনি ওই হলের রেজাল্ট শিটটা দ্রুত তার হ্যান্ডব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলেছিলেন; তাতে অবশ্যই দেখা গেছে যে মুজিববাদীরা বিপুল ভোটে হেরে গেছে, কিন্তু ওই কাগজের তো তখন আর কোনো মূল্য ছিল না। গোটা নির্বাচনটাই তো বাতিল ঘোষিত হয়ে গিয়েছিল।
- সূত্র — 'দুই যাত্রায় এক যাত্রী'/ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
No comments:
Post a Comment