Search

Friday, March 8, 2019

রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ৯১০ কোটি টাকা অপচয়


ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন



নির্বাচন কমিশন পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে ৯১০ কোটি টাকা বাজেট চূড়ান্ত করেছে। চতুর্থ উপজেলা নির্বাচন ছয় ধাপে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এবার পাঁচ ধাপে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। নির্বাচনের কাজ সম্পন্ন করতে ইসি ব্যয় করবে ৯১০ কোটি টাকা। পাঁচ বছর আগে ২০১৪ সালে ছয় ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাজেট ছিল ৪০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনের বাজেট থেকে আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্য বাজেট ৫১০ কোটি টাকা বেশি।

নির্বাচন কমিশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ৯১০ কোটি টাকার বাজেটের বিরাট অংশ, অর্থাৎ ৭৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে নির্বাচন পরিচালনায় নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য। এই বরাদ্দের বড় অংশ ব্যয় হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাতাবৃদ্ধির পেছনে। উপজেলা নির্বাচনে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের পারিশ্রমিকও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই পারিশ্রমিক বা ভাতা বৃদ্ধির কারণ বুঝতে কারো অসুবিধা বা কষ্ট হওয়ার কথা নয়। জনমনে গুঞ্জন উঠেছে, নির্বাচনের সাথে নিয়োজিত ব্যক্তিরা বিগত ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচন কী পরিমাণ উৎসাহ ও চতুরতার সাথে ২৯ ডিসেম্বর রাতেই সম্পন্ন করেছেন, সে কাররেণই তাদের পারিশ্রমিক বা ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।’

উপজেলা নির্বাচনে সমালোচিত ও প্রশ্নবিদ্ধ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করার সিদ্ধান্তের কারণেও বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসি সূত্র মতে, শুধু ইভিএম পরিচালনা এবং সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য ১৭০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অথচ সংবাদমাধ্যমে ইসি সচিব উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের তফসিল ঘোষণাকালে বলেছেন, যথাযথ প্রস্তুতি না থাকায় নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। প্রশ্ন উঠেছে, ইভিএম পরিচালনা ও এতদসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ খাতে ১৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার পরেও যথাযথ প্রস্তুতি কেন সম্পন্ন হলো না? দেশের প্রায় সব দলের আপত্তি সত্ত্বেও বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সীমিতভাবে ইভিএম ব্যবহার করে কী ধরনের সুফল হয়েছে, তা জনগণ এখনো অবগত নন।

সংসদ নির্বাচনে জনগণ দেখেছে, ‘ভোট ডাকাতি’র মহোৎসবে ব্যালট আর ইভিএমের মধ্যে কোনো তফাৎ হয়নি, বরং ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে এটা আরো সহজ ও দ্রুত করা সম্ভব হয়েছে। যে দেশে বিগত কয়েকটি নির্বাচনে জনগণের নিজ হাতে ভোট দেয়ার প্রয়োজন হয়নি বা ভোটের মাধ্যমে জনমতের প্রতিফলন হওয়ার সুযোগ হয়নি, সে দেশে ভোটিং মেশিন ব্যবহারের বিলাসিতা করে ১৭০ কোটি টাকার অতিরিক্ত বরাদ্দ অপ্রয়োজনীয় ও অপব্যয় ছাড়া আর কিছু নয়। জনগণের কাছে তা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

দশম জাতীয় সংসদের ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন ও বয়কটের নির্বাচনের প্রহসনের পর জনগণ ভোটের প্রতি আস্থা হারিয়েছে। তার পরেও, দুই মাস পর অনুষ্ঠিত চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের কারণে ভোট দিতে পারবে এমন জনপ্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল। জনগণের মধ্যে ভোটের উৎসবমুখর আবহ সৃষ্টি হয় তখন। জনগণের প্রত্যাশা ও প্রবল ইচ্ছার ফলে চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে জনগণ বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে অংশগ্রহণ করে। জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটিয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের ফলাফলে বিএনপি থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। এ ধারা অব্যাহত থাকলে চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি সব ধাপেই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে, এটা ভেবে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল শঙ্কিত ও চিন্তিত হয়ে পড়ে।

এমনিতেই দশম সংসদের ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। উপজেলা নির্বাচনে পরাজয় মেনে নেয়া তাদের জন্য কঠিন ছিল। এমতাবস্থায়, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব পরবর্তী ধাপের নির্বাচনগুলোতে যেভাবেই হোক বিজয় কেড়ে নেয়ার জন্য দলীয় প্রার্থী, কর্মী ও প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। ফলে পরবর্তী ধাপের নির্বাচনগুলোতে প্রশাসনের সহযোগিতায় ভোটকেন্দ্র দখল, আগের রাতে ভোট ডাকাতি, জালভোট প্রদান, ভোটের দিনে প্রকাশ্যে জোরপূর্বক সরকারদলীয় প্রার্থীর পক্ষে সিল মারা প্রভৃতি হয়েছে। এভাবে নির্বাচনের ফলাফল সরকারি দলের প্রার্থীদের পক্ষে ঘুরিয়ে দেয়া হয়। ছয়টি ধাপের ফলাফল তুলনামূলক বিচার করলে দেখা যাবে, জনমতকে কিভাবে প্রশাসনের সহযোগিতায় ভূলুণ্ঠিত করে সরকারের পক্ষে নিয়ে যাওয়া যায়।

এই ছক পর্যালোচনায় এটা স্পষ্ট যে, নির্বাচন কমিশন চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনকে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার দোহাই দিয়েছে ঠিকই, কার্যত ধাপে ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে সরকারের নীলনকশা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে ভোট দেয়ার জনপ্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল। সরকারি দল ও প্রশাসনের এহেন ন্যক্কারজনক আচরণে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। এতে জনগণের ভোটের প্রতি অনীহা, অশ্রদ্ধা ও আস্থাহীনতা আরো বৃদ্ধি পায়।

আসন্ন পঞ্চম উপজেলা নির্বাচন হতে যাচ্ছে ২৯ ডিসেম্বরের রাতের নজিরবিহীন ভোট ডাকাতির মাধ্যমে অনুষ্ঠিত সংসদের নির্বাচনের দুই মাস পর। প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক মেরে দিয়েছে। এ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা জনগণের কাছে এতই সাম্প্রতিক যে, তা মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হয় না। এ নজিরবিহীন ঘটনার প্রেক্ষাপটেই বিএনপি স্বাভাবিকভাবে পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে এই উপজেলা নির্বাচন হবে একতরফা, প্রতিযোগিতাহীন ও নিষ্প্রভ। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভ করে যে প্রার্থী ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন, তিনিই নিশ্চিতভাবে উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে ‘নির্বাচিত’ বলে ঘোষণা পাবেন।

গত ২৮ ফেব্র“য়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচনের নাটক মঞ্চস্থ হতে দেখেছে দেশের সবচেয়ে সচেতন নগরবাসীরা। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার পর আতিকুল ইসলাম ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পরবর্তী মেয়র বা নগরপিতা, তা আর কাউকে বলে দিতে হয়নি। জনপ্রিয় দল বিএনপি মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করায় উপনির্বাচনটি হয়েছে প্রতিযোগিতাহীন ও একতরফা। তাই ভোটারেরা কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়ার তাগিদ অনুভব করেননি। নতুন ওয়ার্ডের ভোটকেন্দ্রগুলো ছাড়া অন্য সব কেন্দ্র ছিল প্রায় ফাঁকা। নবনির্বাচিত মেয়র হয়তো বুঝতেই পারেননি যে, তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। ভোটারদের অপেক্ষায় ছিল ভোটকেন্দ্রগুলো।

প্রতিদ্বন্দ্বী পিডিপির মেয়র পদপ্রার্থী শাহীন খান রাতে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘নিজে ৪০টির বেশি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। ভোটার উপস্থিতি একেবারেই কম ছিল। সব মিলিয়ে পাঁচ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে বলে মনে হচ্ছিল না। তবুও এত ভোট কোথা থেকে এসেছে, বুঝলাম না।’ নগরবাসীরও প্রশ্ন- এ ধরনের নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে জনগণের ট্যাক্সের টাকা খরচ বা অপচয় করার কোনো যৌক্তিকতা ছিল কি? টাকার অপচয় ছাড়াও এ উপলক্ষে ঢাকা শহরে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে বিলাসিতা করা হয়েছে এবং রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। যে উপনির্বাচনে ভোটের প্রয়োজন হয়নি, সেই নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার স্বার্থে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে বহিরাগতদের বের করার ঘোষণা জনমনে ব্যাপক হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে।

ঢাকার মেয়রের উপনির্বাচন আসন্ন পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের একটি প্রামাণ্যচিত্র হিসেবে বিবেচনা করা যায়। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনও একইভাবে একতরফা ও প্রতিদ্বন্দ্বিহীনভাবে অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছেন যে, তাকে ‘নির্বাচিত’ বলে ঘোষণা করা হবে। এটা জেনে কোনো প্রার্থী কি ভোট ভিক্ষা করার জন্য জনগণের দুয়ারে দুয়ারে যাবেন? জনগণ কি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়ার কোনো তাগিদ বা প্রয়োজন অনুভব করবেন? মোটেই না। তাহলে প্রশ্ন, পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের বাজেটের চেয়ে ৫১০ কোটি টাকা বৃদ্ধি করে ৯১০ কোটি টাকা বরাদ্দের যুক্তিসঙ্গত কারণ বা প্রয়োজনীয়তা আছে কি?

পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, জনপ্রিয় দল বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় মূলত নৌকা মার্কার প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। ইতোমধ্যে নৌকা মার্কার বহু প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। প্রতিটি নির্বাচনে কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থী নানা কারণে বা পরিচিত হওয়ার উদ্দেশ্যে নামমাত্র অংশগ্রহণ করে থাকেন। ফলাফল প্রকাশের পর ওইসব প্রার্থী কে কত ভোট পেয়েছেন, তার খবর আর কেউ রাখে না। পত্র-পত্রিকায়ও প্রকাশ করার প্রয়োজন মনে করা হয় না। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনেও হয়তো কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থী লোক দেখানো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এ ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান (পুরুষ ও মহিলা) পদে নির্বাচন উন্মুক্ত থাকার ফলে ভোটকেন্দ্রে হয়তো কিছু ভোটার উপস্থিত হবেন। কিন্তু দলীয় নির্বাচনে মূল পদে নির্বাচনের নামে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচনের মতোই নাটক মঞ্চস্থ করার কোনো বিকল্প নেই। এমতাবস্থায়, ইতোমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নৌকা মার্কার প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের সাথে অবশিষ্ট নৌকার প্রার্থীদের নির্বাচিত ঘোষণা করে দিলে অতি সহজে নির্বাচন নামের নাটক সমাপ্ত করা যায়। এভাবে, রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করা জনগণের ৯১০ কোটি টাকার অপচয় খুব সহজেই পরিহার করা যায়।


  • লেখক — সদস্য, জাতীয় স্থায়ী কমিটি, বিএনপি এবং সাবেক অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ভূতত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments:

Post a Comment