মাকসুদুর রহমান
কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে যেন, আমার গায়ে গুলি লাগে — ড. জোহা
হলের গেটের বাইরে হেনস্তার হওয়ার ঘটনাটি আমাদের কনসার্ন না
— জিনাত হুদা, প্রাধ্যাক্ষ রোকেয়া হল
ঘটনা এক
রোকেয়া হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বৃহস্পতিবার, মার্চ,১৪, ২০১৯
জিনাত হুদা |
অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগ এনে ফের ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের দাবিতে বুধবার, মার্চ ১৩, থেকে আমরণ অনশন চালিয়ে যাচ্ছে রোকেয়া হলের পাঁচ ছাত্রী, গভীর রাতে তাদেরকে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানীর নেতৃত্বে একদল ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর হেনস্তার অভিযোগ উঠেছে। হেনস্তার বিষয় নিয়ে হলটির প্রাধ্যক্ষ জিনাত হুদা একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি বলেন , ‘তারা হলের গেটের বাইরে গিয়ে অবস্থান করছেন। সেখানে হেনস্তার হওয়ার ঘটনাটি আমাদের কনসার্ন না। আমাদের কনসার্ন তাদের গেটের বাইরে থেকে হলের ভেতরে নিয়ে আসা।’
বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে জিনাত হুদা এ কথা বলেন।
ঘটনা দুই
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ফেব্রুয়ারি ১৮, ১৯৬৯
ড. জোহা |
এবার আমরা একটু পেছনে ফিরে যাই। সাল ১৯৬৯, ফেব্রুয়ারি মাস । স্থান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। সেইসময় আন্দোলন চলছিল পুরো দেশজুড়ে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ১৫ ফেব্রুয়ারি বন্দী অবস্থায় গুলি করে হত্যা করেন ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে দেশব্যাপী। যার আঁচ এসে লাগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মাঝেও । ছাত্রদের মিছিলে গুলি করে সেনাবাহিনী । আহত হয় অসংখ্য ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা যিনি ড. জোহা নামে ইতিহাসের পাতায় হিরন্ময় দ্যুতি ছড়াচ্ছেন, আহত ছাত্রদের হাসপাতালে নিয়ে চিকিত্সার ব্যবস্থা করেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি ছিল ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে । এতে বিনা উসকানিতে পুলিশ লাঠি চার্জ করে ছাত্রদের রক্তাক্ত করে। প্রতিবাদে নতুন কর্মসূচী ঘোষণা করে ছাত্ররা। অন্যদিকে, প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই ধারা উপেক্ষা করে মেইন গেটের সামনের মহাসড়কে পাকিস্তানি স্বৈরাশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ড. জোহা মেইন গেটে ছুটে যান। প্রক্টর হিসেবে তিনি ছাত্রদের শান্ত করার এবং ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। ছাত্ররা পিছু হঠতে না চাইলে পাক বাহিনীর ক্যাপ্টেন হাদী ছাত্রদের গুলি করার নির্দেশ দেয়। তখন ড. জোহা পাক বাহিনীর উদ্দেশে বলেন, ‘কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে যেন আমার গায়ে গুলি লাগে।’ এ সময় তিনি ‘ডোন্ট ফায়ার! ডোন্ট ফায়ার!’ বলে চিত্কার করতে থাকেন। সেদিন মহান এই শিক্ষক ড. জোহার বুকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল মতিহারের নিষ্পাপ সবুজ চত্বর। হাসপাতালে নেওয়ার পথে ড. জোহা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তার পরেরটাতো ইতিহাস! ড.জোহার রক্তের স্রোতধারা বয়েই মূলতঃ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান তৈরি করেছিল এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই তা স্বাধীনতা সংগ্রামের চুড়ান্ত বিজয়ের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিলো।
ঢাবির রোকেয়া হল সংসদ নির্বাচন বাতিল করে পুনরায় নির্বাচন ও হল প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগসহ চার দফা দাবিতে আমরণ অনশনে বসেছেন হলের পাঁচ শিক্ষার্থী৷ ছবি: প্রথম আলো |
দ্রষ্টব্য
উপরের দুটি ঘটনা দেখে নিজেকে ভীষন রকমের ভাগ্যবান লাগছে এই কারণে ১৯৬৯ বা ওই সময়কালে জিনাত হুদাদের মতো শিক্ষকদের জন্ম হয়নি। কারণ সেদিন যদি প্রফেসর জোহার জায়গায় আজকের জিনাত হুদারা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রগঠনে যে ধারাবাহিক আন্দোলনে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেছেন তা সম্ভব হতো কি না তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হওয়ার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ রয়েছে। কারণ বাইরের যেকোনো আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণকে নিশ্চিতভাবে আজকের জিনাত হুদারা কনসার্ন থাকতেন না। রোকেয়া হলের প্রাধাক্ষ্য জিনাত হুদার ‘ছাত্রীদের হলের বাইরে অনশনে’র বিষয়ে করা মন্তব্যে অন্তত সেই কথাটিই পরিস্কার হয়েছে।
- লেখক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক।
No comments:
Post a Comment